Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ঝিকরগাছায় ঝাট || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 3

ঝিকরগাছায় ঝাট || Shirshendu Mukhopadhyay

তেমন দায়ে পড়লে দুর্গা মালো

তেমন দায়ে পড়লে দুর্গা মালো খুনখারাপি রক্তপাত করে বটে, কিন্তু তা বলে খুনটুন করতে সে ভালবাসে না। বিনা হাঙ্গামায় কার্যোদ্ধার হলেই সে খুশিই হয়, কিন্তু মুশকিলও সেইখানে। দুর্গা মালোর মাথায় তেমন বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। সূক্ষ্ম হাতের কাজেও সে দড় নয়। সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকার ধৈর্যও তার নেই। হাত সাফাইকারীদের মহলে তাই তার খুব বদনাম। সবাই বলে, দুর্গা মালোর হচ্ছে মোটা দাগের কাজ। এ-লাইনে তার গুরু হল পঞ্চানন পুততুণ্ড। পঞ্চাননও দুঃখ করে বলে, আমার চেলাদের মধ্যে দুর্গাটারই মাথা বড্ড মোটা। যত্ন করে সব শেখালাম, কিন্তু কিছুই তেমন শিখতে পারল না।

নিজের মধ্যে প্রতিভার অভাবটা দুর্গাও টের পায়। তাই সেটা সে গায়ের জোরেই পুষিয়ে নেয়।

মাধব পণ্ডিতের ট্যাঁক-ঘড়িটার কথাই ধরা যাক। কোমরে একটা রুপোর গোটের সঙ্গে চেন দিয়ে ঝোলানো থাকে। ইয়া বড় ঘড়ি। কোন

আদ্যিকালের কে জানে! এতকাল কারও নজরেও পড়েনি তেমন।

যুধিষ্ঠির বর্মনের বন্ধকি কারবার। একদিন দুর্গাকে ডেকে বলল, “মাধব পণ্ডিতের ট্যাঁক-ঘড়িটা যদি এনে দিতে পারিস তা হলে পঞ্চাশটা টাকা দেব।”

পঞ্চাশ টাকা শুনে দুর্গার মাথায় টিকটিকি ডেকে উঠল। মাধব পণ্ডিতের ট্যাঁক-ঘড়ির যে কোনও দাম আছে সেটাই তো কখনও মনে হয়নি। তাই দুর্গা মালোদর বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “পঞ্চাশ টাকায় হবে না। একশো টাকা কবুল করলে এনে দেব।”

যুধিষ্ঠির গাঁইগুই করতে লাগল। অবশেষে রাজি হল বটে, কিন্তু হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলল, “খবরদার, মাধব পণ্ডিত যেন টের না পায়। হাল্লাচিল্লা, মারদাঙ্গার কাজ নয় বাপু। খুব সাবধানে কৌশলে কাজ হাসিল করা চাই।”

দুর্গা মালো ওস্তাদজিকে স্মরণ করে নেমেও পড়ল কাজে। হাতসাফাইয়ের বিস্তর তালিম নেওয়া আছে, কাজটা কঠিন হওয়ার কথা নয়। কাটার যন্ত্র দিয়ে কোমরের রুপোর গোটটা কেটে ফেললেই হল। তারপর টুক করে টেনে নেওয়া। রুপোর গোটটা বেচেও কিছু পাওয়া যাবে।

মওকাও পাওয়া গেল জব্বর। গাঙপুরের গোঁসাই বাড়িতে কীর্তনের আসরে মাধব পণ্ডিত হল মধ্যমণি। কীর্তনটা গায়ও ভাল। আসরে ঢুকে অনেকের সঙ্গে দুর্গাও “হরিবোল হরিবোল” করে দু’হাত তুলে খানিকক্ষণ নাচল। মাধব পণ্ডিতের যখন বিভোর অবস্থা তখন সুযোগ বুঝে কোমরের গোটে কাটার ঢুকিয়ে কাটতে যাবে,

ঠিক সেই সময়ে মাধব পণ্ডিত “বাবা রে, গেছি রে” বলে এমন চেঁচামেচি জুড়ল যে, বলার নয়! হাতসই না হওয়ায় একটু খোঁচা লেগেছিল বটে, একটু রক্তপাতও হয়েছিল। কিন্তু তা বলে চেঁচামেচি করার কোনও মানে হয়? ভক্তিভাব এলে মানুষ যখন উঁচুতে উঠে যায় তখন কি তুচ্ছ বিষয়আশয় বা শরীরের ব্যথা বেদনার কথা খেয়াল থাকে? নাকি থাকাটা উচিত? ছ্যাঃ ছ্যাঃ, কলিকালে ভক্তিভাবটাবগুলোও রামলাখন গয়লার দুধের মতো জলমেশানো জিনিস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তেমন ভক্তিভাব হলে গলাখানা কেটে ফেললেও টের পাওয়ার কথা নয়। অমন সুযোগটা মাঠে মারা গেল।

তাই তখন বাধ্য হয়েই রাতের দিকে যখন কীর্তনের পর মাধব পণ্ডিত একা বাড়ি ফিরছিল তখন দুর্গা মুখোনা গামছায় ঢেকে তার ওপর চড়াও হল। মাথায় ডান্ডা মেরে ফেলে দিয়ে ঘড়ি আর গোট কেড়ে নিতে হল। মোটা দাগের কাঁচা কাজ, সন্দেহ নেই। কিন্তু দুর্গাই বা করে কী?

কিন্তু যুধিষ্ঠির ঘটনা শুনে আঁতকে উঠে বলল, “করেছিস কী সব্বোনেশে কাণ্ড? মাধব পণ্ডিতের ছোট জামাই যে মণিরামপুরের দারোগা! যা যা, দূর হয়ে যা, ও ঘড়ি আমি আর ছোঁবও না। তল্লাট জুড়ে এখন পুলিশের হামলা হবে।”

সেই শুনে দুর্গারও পিলে চমকাল। পরদিন গভীর রাতে গিয়ে মাধব পণ্ডিতের ঘরের জানালা দিয়ে ঘড়ি আর গোট রেখে এল।

তার হাতে সূক্ষ্ম কাজ হয় না বটে, কিন্তু তা বলে চেষ্টার সে কোনও ত্রুটি করে না। প্রথমটায় হাতসাফাইয়ের চেষ্টাই সে করে। তাতে কার্যোদ্ধার না হলে মোটা দাগের পন্থা নেয়।

আজকের কাজটিও সূক্ষ্মভাবেই হাসিল করার চেষ্টা করছে দুর্গা। রাজা গজার মতো চেহারার যে লোকটার পিছু নিয়ে সে ঘুরছে তার সর্বাঙ্গে যেন টাকার বিজ্ঞাপন। পকেটে পাঁচ-দশ হাজার নগদ, গলায় মোটা সোনার চেন, পাঞ্জাবিতে সোনার বোতাম, আঙুলে গোটাসাতেক হিরে, মুক্তো, চুনি, পান্নার আংটি। একুনে প্রায় লাখ টাকার মাল তো হবেই।

লোকটার পিছু পিছুই ভজহরির ম্যাজিক শোতে ঢুকে পড়েছে দুর্গা। তারপর সামনের সারিতে বসা লোটার ঠিক পেছনেই ঘাপটি মেরে বসেছে।

স্টেজের ওপর ভজহরি তার এলেবেলে মামুলি খেলাগুলো দেখিয়ে যাচ্ছে। খুব মন দিয়ে দেখছে লোকটা। বাহ্যজ্ঞান নেই। স্টেজের ওপর ভজহরি তার এক শাগরেদকে লম্বামতো একটা বাক্সে পুরে বাক্সটা করাত দিয়ে ঘ্যাস ঘ্যাস করে কাটছে।

খুব মোলায়েম হাতে লোকটার পাঞ্জাবির বাঁ পকেট থেকে টাকার গোছাটা বের করে নিল। লোকটা টেরও পেল না। দুর্গা এরপর একটু অপেক্ষা করল। ভজহরি বাক্সটা কেটে ফেলেছে। এমনভাবে কেটেছে যে, বাক্সের সঙ্গে তার শাগরেদেরও কেটে দু’ভাগ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তাই কি হয়? ভজহরি বাক্সটা একটা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকেই ঢাকনাটা সরিয়ে নিল। শাগরেদ লাফিয়ে উঠে সবাইকে সেলাম জানাতে লাগল। আর তুমুল হাততালি উঠল চারদিকে। আর সেই হাততালির মধ্যেই দুর্গা খুব নরম হাতে কাটারটা ধরে লোকটার গলার চেনটা কট করে কেটে ফেলে টেনে নিল। এ কাজটা অবশ্য খুব সূক্ষ্ম হল না। দুর্গার মনে হল হারটা কাটবার সময় কাটারটার একটা খোঁচা লেগেছে লোকটার গলায়। কিন্তু খেলা দেখে লোকটা এতই মুগ্ধ হয়ে হাততালি দিচ্ছিল যে, খোঁচাটা খেয়ালই করল না। এরকম ক্ষণজন্মা পুরুষ না হলে কি কাজ করে সুখ!

ভজহরি এরপর একটা খালি টুপির ভেতর থেকে প্রথমে তিনটে পায়রা আর তারপর তিন তিনটে খরগোশ বের করল। লোকটা খুব মন দিয়ে খেলা দেখছে। দেখতে দেখতে আনমনে হাতের আংটিগুলো একটা একটা করে খুলছে আর পরছে, খুলছে আর পরছে। অনেকের এরকম চঞ্চল স্বভাব আছে বটে। দুর্গা খুব ঠাহর করে ব্যাপারটা লক্ষ করতে লাগল। শেষ অবধি লোকটা আংটিগুলো খুলেই ফেলল। তারপর অবহেলাভরে পাঞ্জাবির বাঁ পকেটে রেখে দিল।

আহা, দেশটায় যে কেন এরকম লোক আরও অনেক জন্মায় না কে জানে! দুর্গা ফের ওস্তাদজিকে স্মরণ করে খুব মোলায়েম হাতে আংটিগুলো বের করে নিল। এত চমৎকার ভাবে কাজ হাসিল হয়ে যাচ্ছে দেখে দুর্গা নিজেও অবাক।

আজকের মতো যথেষ্ট হয়েছে ভেবে দুর্গা উঠে পড়তে যাচ্ছিল, ঠিক এমন সময়ে ভজহরি তার পরের খেলা শুরু করেছে। তার এক শাগরেদকে একটা কাঠের তক্তার গায়ে দাঁড় করিয়ে ভজহরি চোখ বেঁধে একের পর এক ছোরা ছুঁড়ে মারতে লাগল আর সেগুলো সাঁত সাঁত করে গিয়ে শাগরেদের শরীর ঘেঁষে তক্তায় গেঁথে যেতে লাগল।

এই খেলা দেখে লোকটা এত উত্তেজিত হয়ে পড়ল যে, “উঃ বড় গরম লাগছে তো,” বলে গা থেকে পাঞ্জাবিটা খুলে পাশের খালি জায়গাটায় রেখে দিল।

ভগবান যখন দেন তখন এভাবেই দেন। দিয়ে যেন আশ মেটে। দিতে দিতে যেন ভগবানের একেবারে খুন চেপে যায়। নিতে না চাইলেও জোর করে যেন গছাবেনই। ভগবানকে চটাতে যাবে কোন আহাম্মক? দুর্গা তাই পাঞ্জাবি থেকে চটপট বোতাম খুলে নিল।

এত সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে বহুকাল সে কোনও কাজ হাসিল করতে পারেনি। গৌরবে বুকখানা ভরে উঠল তার। দুঃখ এই, তার বন্ধুরা কেউ দেখতে পেল না, পেলে বুঝত দুর্গা সূক্ষ্ম হাতের কাজেও বড় কম যায় না!

কে যেন চাপা গলায় পেছন থেকে বলে উঠল, “সাবধান!” দুর্গা পট করে পেছনে তাকাল। গায়ে গায়ে অনেক লোক বসে ম্যাজিক দেখছে তন্ময় হয়ে। অন্ধকার বলে কারও মুখ ঠাহর হয় না! ম্যাজিক দেখেই বোধ হয় কেউ বাহবা দিল। যাক, তার কাজ হয়ে গেছে। এবার কেটে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

জিনিসগুলো গামছায় বেঁধে নিয়ে উঠতে যেতেই পেছন থেকে কে যেন চাপা গলায় বলল, “ভজহরি তো তোমার কাছে নস্যি হে। যা হাতের কাজ দেখালে! আহা! চোখ জুড়িয়ে যায়।”

দুর্গা একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল। কেউ দেখে ফেলেছে নাকি? তা হলে তো আবার সাক্ষীও জুটল।

কাছেপিঠে থেকে আরও একজন চাপা গলায় বলল, “অর্ধেক কাজ করে যাও কোথা হে! হাতঘড়িটা রইল যে! আসল সোনার ঘড়ি, মেলা দাম।”

দুর্গার অস্বস্তি বাড়ল। পেছনের লোকগুলো কি ভজহরির খেলা ছেড়ে এতক্ষণ তার খেলা দেখছিল নাকি রে বাবা? তা হলে তো ভারী লজ্জার কথা! দুর্গা ভিড়ের ভেতর দিয়েই পথ করে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল। কাজটা হয়ে গেছে বটে, কিন্তু বড্ড কিন্তু কিন্তু লাগছে দুর্গার। আজ অবধি সে এত পরিষ্কার হাতে কখনও কোনও কাজ করে উঠতে পারেনি। কিন্তু কাজটা করে উঠে তেমন স্বস্তি বোধ করছে না তো!

বেরিয়ে এসে দুর্গা এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, হঠাৎ কোথা থেকে একজন টেকো মাঝবয়সি লোক সেঁতো হাসি হাসতে হাসতে এসে পট করে তার গলায় একটা গাঁদার মালা পরিয়ে দিয়ে বলল, “অভিনন্দন! অভিনন্দন!”

দুর্গা আঁতকে উঠে বলে, “এসব কী ব্যাপার?”

লোকটা ভারী অমায়িক গলায় বলে, “এ হল গুণী মানুষের সম্মান। এত বড় একজন ওস্তাদ লোককে সম্মান জানানো তো দেশ আর দশের কর্তব্যই হে! তাই না?”

দুর্গা মালো প্রমাদ গুনল। তার মন কু ডাক ডাকতে লেগেছে। এসব যা হচ্ছে তা তো স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এর মধ্যে যে গভীর ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে হচ্ছে তার!

হঠাৎ দুর্গা পড়ি-কি-মরি করে ছুটতে লাগল। আশ্চর্যের বিষয় কেউ তাকে তাড়াও করল না, ধর, ধর বলে শোরগোলও তুলল না। তাতে ভয়টা আরও বেড়ে গেল দুর্গার। সে দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress