ঝিকরগাছায় ঝাট
ঝিকরগাছার হাট হল এ-তল্লাটের সেরা। একধারে গ্যাঁড়াপোতার খাল আর অন্য ধারে মহীনরাজার ঢিবি, মাঝখানে বিশাল চত্বর জুড়ে রমরম করছে হাটখানা। এখানে না পাওয়া যায় এমন জিনিস কমই আছে। পরগনার সব ব্যাপারিই এসে জোটে। তেমনই খরিদ্দারের ভিড়। যেমন বিকি, তেমনি কিনি। সকাল থেকে রাত অবধি কত টাকাপয়সা যে হাতবদল হয় তার লেখাজোখা নেই।
তা বলে সবাই যে এসে ঝিকরগাছার হাটে পয়সা কামিয়ে নিয়ে যায় বা জিনিসপত্র কিনতে পারে তা নয়। ওই যে নবগ্রামের রসো পান্তি মুখোনা হাসি হাসি করে গন্ধবণিকদের দোকানের সামনে ঘোরাঘুরি করছে আর চতুর চোখে চারদিকে চাইছে, কিন্তু বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারছে না। হরিহরপুরের প্রসন্ন হালদারের কোমরের গেজেতে না হোক আজ তিন-চার হাজার টাকা আছে। হালদারের পো-র পাটের দড়ির কারখানা। ঝিকরগাছার হাটে ফি হাটবারে শস্তায় পাটের গুছি কিনতে আসে। তা সেই গেজেটাই তাক করে অনেকক্ষণ ধরে তক্কে তক্কে ঘুরছে রসো। সঙ্গে চেলা হাদু। গেজেটা গস্ত না করলে চেলার কাছে মান থাকবে না। কিন্তু রসো পান্তির সেই দিন আর নেই। বয়স হওয়ায় হাত-পা তেমন চলে না। আর লোকজনও ক্রমে সেয়ানা হয়ে উঠছে।
হাদু বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করছিল, “সকাল থেকে কেবল হাঁটাহাঁটিই সার হচ্ছে যে! কাজকারবার কিছুই হল না।”
“হবে রে হবে। ব্যস্ত হলে কি হয়?” প্রসন্নর সঙ্গে ওর শালা
রেমোটাও রয়েছে। সর্বদা চোখে চোখে রাখছে। প্রসন্নর কোমরখানার দিকেই ওর চোখ। “একটু ধৈর্য ধর বাবা, রেমোর খিদে বা জলতেষ্টা পেলে বা চেনাজানা কারও সঙ্গে দেখা হলেই হয়। একটু আনমনা হলেই দেখবি চোখের পলকে প্রসন্নর কোমর সাফ হয়ে যাবে।”
“ধুর মশাই, এত বড় হাটে কি আর প্রসন্ন ছাড়া মুরগি নেই? কত লোকে তো পকেটে টাকা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! একটা ছোটখাটো দাও মারলেও জিলিপি শিঙাড়াটা হয়ে যায়।”
কথাটা মিথ্যে নয়। এসব কাজকারবারে একজনকে নিয়ে পড়ে থাকলে হয় না। মা-লক্ষ্মী নানা ট্যাঁকে এবং পকেটে ছড়িয়ে রয়েছেন। তবে রসো পান্তির স্বভাব হল, যাকে দেগে রাখবে তাকেই তাক করবে। ওভাবেই বরাবর বউনি করে এসেছে। বউনিটা ভাল হলে সারা দিনে ভালই দাও মারা যায়।
রসো পান্তির এখন খুবই দুর্দিন। যখন বয়সকালে হাত এবং মাথা সাফ ছিল তখন চেলাচামুণ্ডাও জুটত মেলা। কিন্তু এখন নানা নতুন ওস্তাদের আবির্ভাব হওয়ায় বেশিরভাগ চেলাই কেটে পড়েছে। শিবরাত্রির সলতে এখন ওই হাদু। সেও কেটে পড়লে রসোর আর চেলা থাকবে না। খুবই চিন্তার বিষয়। ঘঁদুকে তাই তুইয়ে বুইয়ে রাখতে হয়। সে শুনেছে, সিংহ নাকি একটা শিকারকেই তাক করে ধরে। সেটাকে ধরতে না পারলে অন্য শিকার ছোঁয় না। দিনেকালে সে সিংহ ছিল বটে, কিন্তু এখন আর শেয়াল ছাড়া কীই বা বলা যায় তাকে।
রসো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “তাই হবে রে বাপু, তুই মাথা গরম করিস না।”
দু হঠাৎ উত্তেজিত গলায় বলে, “ওই দেখুন, নবু পালের পানের দোকানের সামনে কেমন বাবু চেহারার একটা লোক দাঁড়িয়ে পান খাচ্ছে। বাহারি চেহারাখানা দেখেছেন?”
তা দেখল রসো। বাবরি চুল, লম্বা জুলপি, গায়ে জরির কাজ করা সিল্কের পাঞ্জাবি, পরনে ধাক্কাপেড়ে ধুতি। তাগড়াই চেহারা, তাগড়াই মোচ। রাজা-জমিদারের বংশ বলেই মনে হয়। মুখটা চেনা নয়। এ-তল্লাটে নতুন উদয় হয়েছে বলেই মনে হয়।
নবুর পান খুব বিখ্যাত। হাঁচি পান, মিঠে পাত্তি বা বেনারসি পাত্তি যা চাও পাবে। মশলাও শতেক রকমের। ট্যাঁকে পয়সা না থাকলে নবুর পান হল আকাশের চাঁদ। তবে যেসব হাটুরে দু’পয়সা কামাতে পারে তারা সদানন্দর রাবড়ি বা মালপোয়া, গদাধরের মাছের চপ, হরিপদর জিবেগজা আর পালোধি, রঘুপতির মালাই সন্দেশ কিংবা লেডিকেনি, বটকৃষ্ণর তেলেভাজা আর ঘুঘনি খেয়ে আইঢাই হয়ে নবুর একখিলি পান মুখে না দিলে আরাম বোধ করে না। সে এমন মশলাদার পান যে, মুখে দিলে বিশ হাত জুড়ে গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে যায়।
লোকটা পান মুখে দিয়ে নিমীলিত নয়নে তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই চারধারটা দেখছিল।
হাদু উত্তেজিত গলায় বলে, “এ একেবারে রাজাগজা লোক। এবার একটু হাতের খেল দেখিয়ে দিন মশাই।”
রসো মৃদু গলায় বলে, “দাঁড়া বাপু, লোকটাকে আগে জরিপ করতে দে। হুট করে গিয়ে ঘাই মারলেই তো হবে না। হাবভাব একটু বুঝি। সেয়ানা না বোকা, ভ ভদ্রলোক না ভদ্রবেশী জোচ্চোর, সেসবও আঁচ করতে হয়, বুঝলি। এ-লাইন বড় কঠিন।”
হাদু বিরক্ত হয়ে বলে, “আপনাকে দিয়ে কিছু হবে না মশাই। হরু দাস বা জগা হাটি হলে এতক্ষণে কাজ ফরসা হয়ে যেত।”
রসো অর্থাৎ রসময় পান্তি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। না, হাঁদুকে রাখা যাবে না শেষ অবধি। যদিও বটে বটতলার হরু দাস আর রাঘবপুরের জগা হাটি ইদানীং খুব নাম করেছে। রাঘবপুরের দারোগা গোবিন্দ কুন্ডু পর্যন্ত প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন, হ্যাঁ, জগা হাটির মতো চালাকচতুর চোর তিনি ইহজন্মে দেখেননি। মোদ্দা কথাটা হল, নতুন যুগের এরা সব উদয় হচ্ছে আর পুরনো আমলের রসো পান্তি অস্ত যাচ্ছে। সুতরাং দু একদিন সটকাবেই। বড় মায়া পড়ে গেছে ছেলেটার ওপর, তাই বুকটা টনটন করে বটে। এও ঠিক কথা, হুট করে কিছু করে ওঠা রসোর পদ্ধতি নয়। আগে শিকারকে নজরে রাখা, মাপজোক করা, সবলতা দুর্বলতার আঁচ করা, তারপর ফাঁক বুঝে কাজে নেমে পড়াই হল তার চিরকেলে নিয়ম। কাজ ভন্ডুল হলে কপালে হাটুরে কিল, চাই কি পুলিশের গুঁতো এবং হাজতবাসও জুটতে পারে। কিন্তু নওজোয়ান হাঁদু ব্যাপারটা বুঝতে চাইছে না।
হাদু ফের চাপা উত্তেজিত গলায় বলে, “দু’হাতে ক’খানা আংটি দেখেছেন? তার ওপর গলায় সোনার চেন, হাতে সোনার ঘড়ি!”
বিরস মুখে রসো বলে, “দেখেছি রে, দেখেছি। যা দেখা যাচ্ছে না তাও দেখেছি।”
“কী দেখলেন?”
“বাঁ পকেটে অন্তত কয়েক হাজার টাকা আছে।”
“কী করে বুঝলেন?”
“ওরে, দেখে দেখে চোখ পেকে গেছে কিনা।”
বাস্তবিকই তাই। লোকটা চারদিকে দেখতে দেখতে হঠাৎ বাঁ পকেট থেকে একতাড়া একশো টাকার নোট বের করে ভ্রূ কুঁচকে একটু দেখলে, তারপর লোকে যেমন বইয়ের পাতা ফরফর করে উলটে যায় তেমনি উলটে গেল। ফের পকেটে রেখে দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে চারদিকে দেখতে লাগল।
হাঁদু চাপা গলায় বলে, “এবার চলুন।”
রসো সভয়ে বলে, “কোথায় যাব?”
“আমি গিয়ে লোকটাকে পেছন থেকে লেঙ্গি মেরে ফেলে দিয়ে পালাব, আপনি দৌড়ে গিয়ে লোকটাকে ধরে তুলে ধুলোটুলো ঝেড়ে দেবেন। আর সেই ফাঁকে–”
পাগল আর কাকে বলে! দশাসই ওই লোকটাকে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়ার মতো এলেম ছোটখাটো চেহারার হাঁদুর যে নেই সেটা রসোর চেয়ে ভাল আর কে জানে। কিন্তু ছেলেমানুষ, কিছু করার জন্য ভারী ছটফট করতে লেগেছে। বাধা পেলে বিগড়েই যাবে হয়তো। তাই অনিচ্ছে সত্ত্বেও রসো বলল, “চল তা হলে!”
কিন্তু এক কদম এগোতে-না-এগোতেই রসোর ডান পাঁজরে কে যেন একখানা পেল্লায় কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে বলল, “খবরদার!”
গুতোর চোটে ককিয়ে উঠল রসো, “বাবা রে!” ঠিক একই সঙ্গে কে যেন পেছন থেকে একখানা ল্যাং মেরে হাদুকে ফেলে দিল মাটিতে। হাদু পড়ে গিয়ে চেঁচাল, ভূমিকম্প হচ্ছে! ভূমিকম্প!
পেছন থেকে একটি সরু গলা রসোর কানের কাছে বলে উঠল, “খবরদার! ওটির দিকে নজর দিয়ো না। গত আধ ঘণ্টা ধরে আমি ওটাকে তাক করে রেখেছি। যদি ভাল চাও তো সরে পড়ো।”
ঘাড় ঘুরিয়ে রসো যাকে দেখল তাকে দেখে অনেকেরই রক্ত জল হয়ে যায়। সাতহাটির দুর্গা মালো। খুনজখম দুর্গার কাছে জলভাত। লাঠি সড়কিতে পাকা হাত, গায়ে অসুরের জোর। তার ওপর তার দলবলও আছে।
রসো সেঁতো হাসি হেসে বিনয়ের সঙ্গে বলল, “তা আগে বলতে হয় রে ভাই। তোমার জিনিস জানলে কি আর ওদিকপানে তাকাই?”
হৃদু উঠে গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে নিতান্তই নির্লজ্জের মতো হাত কচলে দুর্গাকে বলল, “ওস্তাদজি, কতদিন ধরে আপনার পায়ে একটু ঠাঁই পাব বলে বসে আছি। অধমকে যদি একটু ঠাই দেন…”
দুর্গা মালো চাপা একটা ফুঁ দিয়ে বলল, “যাঃ ব্যাটা তিনফুটিয়া, আমার দলে ঢুকতে হলে আগে বুকের ছাতি আর হাতের গুলি চাই, বুঝলি! এসব তোর কম্ম নয়। রসোর শাগরেদি করছিস তাই কর।”
হাদুকে নিয়ে তাড়াতাড়ি সরে এল রসো। আড়ালে এসে চুপিচুপি বলল, “ছিঃ ঘঁদু, এত অল্পেই হাল ছেড়ে দিলি? হুট করে গুরু বদলালে পাপ হয়, তা জানিস?”
হাঁদু হেঁদানো গলায় বলে, “তা কী করব মশাই, আপনার কাছে থেকে যে আমার কোনও উন্নতিই হচ্ছে না! আমাকে তো আখেরটা নিয়ে ভাবতে হবে নাকি?”
“অত সহজে হাল ছেড়ে দিস না। দুর্গা মালোর সঙ্গে টক্কর দিয়ে লাভ নেই। আয়, দু’জনে তক্কে তক্কে থাকি। দুর্গা হাতের সূক্ষ্ম কাজ কারবার জানে না। ওর হল মোটা দাগের হুডুম দুড়ুম কাজ। হাটের মধ্যে ওসব করার অসুবিধে আছে। আয়, আমরা বরং লোকটাকে দূর থেকে চোখে চোখে রাখি। ওর একখানা আংটির দামই পাঁচ-সাত হাজার টাকা।”
হাদু বিরস মুখে বলে, “কিন্তু মানুষের শরীর বলে কথা। ঘোরাঘুরিতে যে খিদেও পেয়ে গেল মশাই।”
“হবে হবে, সব হবে। খিদে-তেষ্টাকে জয় না করতে পারলে এ লাইনে কি টেকা যায় রে! মুনিঋষিদের কথা শুনিসনি? না খেয়ে তপস্যা করতে করতে পেটে পিঠে এক হয়ে যেত! চল বরং দুখিরামের দোকান থেকে দুটো গরম চপ খেয়ে নিবি।
জাদুকর ভজহরি বিশ্বাস ঝিকরগাছার হাটে ম্যাজিক দেখাচ্ছে কম করেও ত্রিশ বছর। আগে ম্যাজিক দেখতে লোক ভেঙে পড়ত। তাবুতে জায়গা হত না। ঝিকরগাছার হাট থেকে একদিনে তার দু-তিনশো টাকা আয় হত। কিন্তু সেইসব সুদিন আর নেই। দু’ টাকার টিকিট কেটেও কেউ আজকাল ম্যাজিকের তাঁবুতে ঢোকে না বড় একটা।
ছেঁড়া তাবুতে শতেক তাপ্পি লাগাতে হয়েছে। ভজহরির জরির ঝলমলে পোশাকেরও আর জলুস নেই। পোশাকেও মেলা তালি আর রিপু। মাথার পাগড়িখানার রং চটে গেছে। ভজহরির এখন পায়ে গেঁটে বাত, মাথায় টাক, মুখ প্রায় ফোকলা। যৌবনকালে যেসব খেলা দেখাতে পারত তা আর এই বুড়ো বয়সের শরীরে কুলোয় না। দু’জন শাগরেদ আছে তার। লালু আর নদুয়া। আগের অ্যাসিস্ট্যান্টরা এখন নিজেরাই জাদুকর হয়ে খেলা দেখিয়ে বেড়ায়। হাড়হাভাতে লালু আর নদুয়া এসে জুটেছে পেটের দায়ে। খেলা শেখায় তাদের মনও নেই, মাথাও নেই। তবু তারাও দু-চারটে এলেবেলে খেলা দেখায় বটে। কিন্তু লোকে আজকাল এসব বস্তাপচা পুরনো খেলা পছন্দ করে না।
তবু ভজহরি ফি-হাটবারে দুটো করে শো দেখায়। বেলা একটা থেকে তিনটে। সাড়ে তিনটে থেকে সাড়ে পাঁচটা। তাইতেই তার হাঁফ ধরে যায়।
নুন শোতে আজ লোক হয়েছিল সাকুল্যে বারোজন। খরচ তো উঠবেই না, উপরন্তু লোকসানই দিতে হবে। বিকেলের শোর আগে ভজহরি ভেতরে বসে জিরোচ্ছিল। বাইরে চেয়ারে বসে নদুয়া টিকিট বিক্রি করছে আর চেঁচিয়ে লোক জড়ো করার চেষ্টা করছে। ভজহরি ভাবছিল, এবার খেলা দেখানো ছেড়েই দেব। পরিশ্রম আর খরচ কোনওটাতেই পোষাচ্ছে না।
লালু এসে বলল, “ওস্তাদজি, মেয়ে কাটার খেলাটা ফের চালু করুন, ওটা লোকে খুব নেয়।”
ভজহরি খিঁচিয়ে উঠে বলে, “কচু নেয়। তা ছাড়া মেয়েই বা পাব কোথায়? ও খেলা দেখাতে যন্ত্রপাতি চাই, লোকলশকর চাই। পাব কোথা?”
চোখ বেঁধে তিরন্দাজির একটা জব্বর খেলা দেখাতেন বলে শুনেছি। একটা বাচ্চা মেয়ের মাথায় আপেল রেখে দূর থেকে চোখ বাঁধা অবস্থায় তির ছুঁড়ে আপেল গেঁথে ফেলতেন। সেটা ফের চালু করলে হয় না!”
হতাশ ভজহরি মাথা নেড়ে বলে, “না হে বাপু, ওসব আর আমার আসে না।”
খেলাটা শুনতে যত বিপজ্জনক আদতে ততটা নয়। স্টেজের এ-মুড়ো ও-মুড়ো টান টান করে একটা সরু আর শক্ত কালো সুতো বাঁধা থাকত। তির আর আপেল দুটোই পরানো থাকত সুতোর দু’ প্রান্তে। তির ছাড়লে সেটা সুতো বেয়ে গিয়ে আপেলটা গেঁথে ফেলত। সে আমলের বোকাসোকা লোকেরা খেলা দেখেই খুশি, কলকৌশল নিয়ে মাথা ঘামাত না। আজকালকার চালাক-চতুর লোককে বোকা বানানো সহজ নয়।
তবে খেলাটা দেখাতে গিয়ে একবার নিজেই বড় বোকা বনে গিয়েছিল ভজহরি। তখন তার খুব নামডাক। গঙ্গাধরপুরের রাজবাড়ির রাস উৎসবে খেলা দেখাতে গিয়েছিল সেবার। রাজা পুরন্দরচন্দ্র বাহাদুর, রাজকুমার রাজেন্দ্রচন্দ্র, মহেন্দ্রচন্দ্র, হরিশচন্দ্র, রানিমা, বউরানিরা সবাই উপস্থিত। বিরাট আসর। তখন ভজহরির মেয়ে হিমি মাথায় আপেল নিয়ে দাঁড়াত। তা সেবার হল কী, হিমি দাঁড়িয়েছে, ভজহরিও চোখবাঁধা অবস্থায় ধনুকে তির লাগিয়ে ছিলা টেনেছে। ঠিক সেইসময়ে পুটুং করে শব্দ করে সুতোটা ছিঁড়ে গেল। আর ভজহরি এমন ঘাবড়ে গেল যে, ভুল করে তিরটাও ছেড়ে দিল। ছেড়ে দিয়েই মাথা চেপে বসে পড়ল। এ কী সব্বোনেশে কাণ্ড করল সে!
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, হলে তুমুল হাততালি পড়ছিল। ভজহরি চোখের ফেট্টি খুলে দেখে, মেয়ে দিব্যি হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। আর আপেলটা উইংসের পাশে তিরবেঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। অথচ ওরকম হওয়ার কথাই নয়।
গঙ্গাধরপুরের সেই আসরে আরও অনেক কাণ্ড হয়েছিল। লোকে ম্যাজিক মনে করে হাততালি দিয়েছিল বটে, কিন্তু একমাত্র ভজহরিই জানে যে, সেগুলো মোটেই ম্যাজিক ছিল না। ব্যাপারটা
সে নিজেও ব্যাখ্যা করতে পারবে না।
নদুয়া বলল,”লোকের মুখে মুখে আপনার ভূত নাচানোর খেলার কথাও খুব শোনা যায়। বলছিলাম কি ওস্তাদজি, সেগুলো ফের ঝালিয়ে তুললে হয় না?”
ভজহরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “সেই রাবণও নেই, সেই লঙ্কাও নেই, বুঝলি! এবার আমার রিটায়ার করার সময় হয়েছে।”
নদুয়া ডুকরে উঠে বলে, “তা হলে আমাদের কী হবে?”
“তোর মতো অপদার্থের কিছু হওয়ার নয়।” বিকেলের শোয়ের সময় হয়েছে। ভজহরি মুখটুখ মুছে জল খেয়ে তৈরি হল।
লালু এসে উত্তেজিত গলায় বলল, “ওস্তাদজি, হাউস ফুল!”
“তার মানে?”
“দেড়শো টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। তাঁবুর ভেতরে আর জায়গা নেই।”
“বলিস কী?” অবাক কাণ্ডই বলতে হবে।
পরদা সরানোর পর ভজহরিও দেখল, কথাটা মিথ্যে নয়। তাবুর ভেতরে বিস্তর মানুষ জুটেছে। সর্বাগ্রে তার নজর পড়ল, একদম সামনে শতরঞ্জির ওপর খুব রাজাগজা চেহারার একজন লোক বসে আছে। হাতে হিরের আংটি, গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, চুনোট করা ধুতি, মস্ত গোঁফ, চেহারাখানাও দেখার মতো। ভিড়ের মধ্যে অল্প আলোয় ভজহরি দুর্গা মালো, রসো পান্তি এবং আরও দু-চারজন সন্দেহজনক চরিত্রকেও দেখতে পাচ্ছিল। চুরি ছিনতাই রাহাজানি করে বেড়ায়।
ভজহরি খুশি হয়ে খেলা দেখাতে শুরু করল।