সুজানী গ্রামের দিকে
০৭.
সন্ধে সাতটা সাড়ে সাতটা নাগাদ আমি আর ভজনদা, মেহবুবকে সঙ্গে নিয়ে, আইসবক্সে বরফ, সোড়া, কোকাকোলা, ফান্টা এবং আলাদা করে হুইস্কি-টুইস্কি নিয়ে আমাদের গাড়িতে সুজানী গ্রামের দিকে রওনা হলাম। অ্যাডভান্স টিম আমরা। গিয়ে সব ইন্তেজাম করে রাখব।
ফুটফুট করছিল জোৎস্না। কুতনিয়া নদীটার বালি চাঁদের আলোতে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছিল। কুতনিয়া পেরিয়ে টাঁড়ের মধ্যে পায়েচলা সঁড়িপথ লক্ষ্য করে পান্ডে গাড়ি চালাতে লাগল টিগরিয়া পাহাড়ের কোলের সুজানী গ্রামের উদ্দেশে।
পথে বড়ো বড়ো পাথরের চাঁই ছিল। গাড়ি চালাতে রীতিমতো কসরত করতে হচ্ছিল।
প্রায় আধঘণ্টা লাগল পৌঁছোতে। গাড়ি বেশিরভাগ-ই সেকেণ্ড কী থার্ড গিয়ারে যাচ্ছিল। দূর থেকে বিরাট অশ্বত্থাগাছটা দেখা যাচ্ছিল। চাঁদের আলোয় তার পাতা ঝিলমিল করছিল হাওয়া লেগে। গাছের নীচে অনেক মেয়ে-পুরুষ জমা হয়েছে ইতিমধ্যেই দেখলাম। মাদলে ও কাঁসরে চাঁটি ও কাঠি পড়ছে এলোমেলো। দূর থেকেই তাদের দ্রিম দ্রিম আওয়াজ কানে আসছিল।
আমরা পৌঁছে গাড়ির বুট খুলে ফোল্ডিং ইজিচেয়ারগুলো নামালাম। চৌপাইও জোগাড় হল। আইস-বক্স নামিয়ে মেহবুবের জিম্মায় দেওয়া হল। আইস-বক্সে জলও ছিল। কোনো সাহেব সোডা দিয়ে হুইস্কি খাবেন, কেউ বা জল দিয়ে। অনুষ্ঠানের কোনো ত্রুটি নেই।
মানুদি, ফুলমণি, ও আরও অনেক মেয়ে, যারা চিড়িয়াখানায় কাজ করে সবাই সেজেগুজে এসেছে। তার মধ্যে পানুই-এর সাজ আজ দেখে কে? পানুই-এর চলায়, তাকানোতে, ইংরিজিতে যাকে আমরা ডিমেন্যুর বা গেইট বলি, তা এমন মাত্রায় ছিল যে, তা বলার নয়।
আমার হৃদয়ে আবারও বিস্ফোরণ হল। চাসনালায় আবার দুর্ঘটনা।
আমরা নেমেই গাড়ি ছেড়ে দিলাম। সাহেবরা মেমসাহেবদের সঙ্গে নিয়ে আবার দু-গাড়ি বোঝাই হয়ে আসবেন নাচ দেখতে।
ভজনদা বললেন, আর্মিতে একটা কথা আছে জানো?
কী কথা? আমি শুধোলাম।
–ওয়ার্মিং-আপ দ্যা ব্যারেলস। অবশ্য কথাটা সাহেবদের। তাই বলছি, এসো ভায়া, আসল যাত্রা আরম্ভ হওয়ার আগেই আমরা একটু ওয়ার্মিং আপ করে নিই। এসো, একটু মহুয়া খাবে।
আমি বললাম, আমার ওসব চলে না দাদা। কখনো খাইনি।
ভজনদা বললেন, এই কখনো খাইনি, কখনো করিনি কথাগুলো আমি ঘেন্না করি। ফুলশয্যার রাতে কি খাটের বাজুতে পা-ঝুলিয়ে বসে বউকে বলবে লাল মুখ করে যে, কখনো….। সব জিনিস-ই কোনো-না-কোনোদিন আরম্ভ করতে হয়। সুনার দ্যা বেটার। বুজেচো।
আমি বললাম, আমাকে মাপ করুন দাদা।
ভজনবাবু বললেন, ঠিক আছে। তোমার শেয়ারটাও আমিই খাব।
তারপর বললেন, তোমাকে সঙ্গে না এনে নবনেকে আনা উচিত ছিল। আজকে দু-জনে মিলেচুমকির ডিম-হওয়াটা সেলিব্রেট করা যেত।
তারপর আবারও বললেন, সাহেব বেছে বেছে সব মেয়েছেলে মার্কা তোমার মতো ব্যাটাছেলে যে, কোত্থেকে রিক্রুট করে আনেন, তা সাহেব-ই জানেন।
সাঁওতাল ছেলেরা ও মেয়েরা ততক্ষণে পুরোপুরি ওয়ার্ড হয়ে গেছে সূর্য ডোবার পর থেকে মহুয়া খেয়ে। ছেলেরা হাত ধরে একলাইনে দাঁড়িয়ে একটা গান গাইছিল। ওদের গানের সুরে ঘুম পেয়ে যায়–সুরে ভারি একটা মহুয়ার গন্ধভরা মনোটোনি–সেটাই বুঝি ওদের গানের বিশেষত্ব।
ওরা যে গানটা গাইছিল এগিয়ে-পেছিয়ে সে-গানের কথাগুলো এইরকম :
আইলে না গলে পুতাআইলে না গলে হোকঁহা পাবলো হো পুতাকানেকা সোনা বাহামরা গোঙ্গো শাসুরযায়সে না তৈসে হো-হামরা গোঙ্গো শাসুরববাড়োরে বিলাতে হো… ইত্যাদি ইত্যাদি
ভজনদাকে বললাম, ভজনদা এই গানটার মানে কী?
ভজনদা বললেন, বিরক্ত কোরো না তো, সবে নেশাটা চড়েছে।
তারপর বললেন, আমি সাঁওতালি ভাষা জানি না। কয়েকটা কথা ম্যানেজ করতে পারি। এইপর্যন্ত।
আমি অবাক হয়ে বললাম সে কী? বউদি সাঁওতালি বলেন, আমি ভেবেছিলাম আপনি বুঝি জানেন।
তারপর অবাক হয়ে শুধোলাম, বউদির সঙ্গে তাহলে কথাবার্তা চালান কী করে?
ভজনদা বললেন, কথাবার্তা যা দু-একটা দরকার হয়, যেমন একগ্লাস জল দাও, আর একটু ভাত দাও এসব শিখে নিয়েছি। এ ছাড়া কথার দরকার কী? বাদবাকি তো ল্যাঙ্গুয়েজ অফ দ্য বডি–সারাপৃথিবীতে এক-ই ভাষা চলে। বে-শাদি করো, তখন জানবে।
কিছুক্ষণ পর তিন-চার মাইল দূর থেকে ফাঁকা ফাঁকা চাঁদের আলো ছমছম করা টাঁড়ে দুটো হেডলাইটকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল।
গাড়িগুলো আসছে দেখে আমাদের মধ্যে এবং যারা নাচবে তাদের মধ্যেও সাজ-সাজ রব পড়ে গেল।
পাগলা সাহেব আসছে। পাগলাসাহেবকে মান্যি-গণ্যি করে না, এমন লোক এ তল্লাটে নেই।
সাহেব মেমসাহেবরা এসে পৌঁছোতেই, চেয়ারে বসতে-না-বসতেই যার যার হুইস্কি, মেমসাহেবদের কোকাকোলা, ফান্টা, সব মেহবুব হাতে হাতে ধরিয়ে দিল।
এবার মেয়েরা হাতে হাত রেখে ছেলেদের সামনে মুখোমুখি নাচতে আরম্ভ করল।
এবারে মেয়েরাই গাইতে লাগল। চার লাইনের গানটা–কিন্তু পরে দেখলাম দু-ঘণ্টা ধরে সেই একটাই গান গেয়ে চলল ওরা–অথচ ওই মনোটোনির মধ্যেই, একঘেয়েমির মধ্যেই ওদের গানের পুরো মজাটা লুকোনো ছিল :
রাজা চলে সড়কে সড়কেরানি চলে বিন সড়কে–রাজা হাতে সোনা ছাতাটুকুরি জো উড়ে না। গেরানি হাসে মনে মনে….
এ গান বোঝার জন্যে ভজনদার হেল্পের দরকার হল না। নিজেই আন্দাজে বুঝে নিলাম– রাজা পথে পথে চলেছেন, রানি পথ ছেড়ে চলেছেন–রাজার হাতে সোনার ছাতা-হাওয়ায় ছাতা উড়ে গেল। রানি দেখে হাসেন মনে মনে।
জানি না, মানেটা ঠিক হল কি না।
শেতলপাটি হাতে একটি টেপ-রেকর্ডার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর গান-বাজনা, কথাবার্তা সব টেপ করে যাচ্ছেন।
যাত্রা জমল সাহেবরা সব চার-পাঁচটা করে হুইস্কি খাওয়ার পর।
আমার সাহেব–নীলকণ্ঠ–হুঁইস্কি খেলেও যা, না খেলেও তা–মহাস্থবির–কোনোই চাপল্য নেই–মাথা ঠাণ্ডা–চোখ সজাগ।
অন্য সাহেবরা যত হুইস্কি খান, ভজনবাবু তত মহুয়া।
পৌনে-এক ঘণ্টা পরে নরক গুলজার হল। মেমসাহেবরা সকলে মেয়েদের হাতে হাত দিয়ে নাচতে আরম্ভ করলেন।
সাহেব আর বউরানি ইজিচেয়ারে পাশাপাশি বসে অতিথিদের কান্ড দেখতে লাগলেন।
হঠাৎ কাতলামাছ খেপে উঠলেন। আসলে সকালে হানিফ সাহেবের বাড়িতেই খেপে ছিলেন। এখন গোটা পাঁচ-ছয় হুইস্কি পেটে পড়াতে লিচুকে বললেন, লিচু তুমি পছন্দ করো, এখুনি আমি আমার বউ ঠিক করব।
লিচু মেমসাহেবদের মধ্যে সবচেয়ে সরল আর স্পোর্টিং। তিনি বললেন, আপনি পছন্দ করুন আমি আলাপ করিয়ে দিচ্ছি।
তারপর পানুইকে দেখিয়ে বললেন, ওই তো বিউটি-কুইন।
কাতলামাছ বললেন, ও বড়োবেশি সুন্দরী, তাই আনইন্টারেস্টিং।
কাতলামাছের কথা শুনে ভক্তি হল আমার।
কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা গেল কাতলামাছও মেয়েদের হাত ধরে নাচছেন। সে কী নাচ! একদল সুন্দরী মেয়ের মধ্যে একটা হিপোপটেমাসকে নীল জিনের ফ্লেয়ার আর লাল জিনের শার্ট পরিয়ে ছেড়ে দিলে যেমন দেখতে হয় তেমন আর কী!
কাতলামাছের ফুলমণি আর মানুদিকে পছন্দ হল। নিজেই গিয়ে দু-জনকে বললেন, আমাকে বিয়ে করবি?
মানুদি স্ট্রেট মুখের ওপর না করে দিল।
বলল, তুই বড়ো মোটা আছিস।
ফুলমণিও একেবারে গররাজি। এমনকী নিমরাজিও নয়।
কাতলামাছ ওদের বললেন তোদের সসম্মানে বিয়ে করব, বউয়ের সম্মান দেব, গাই দেব–বলদ দেব, ছেলে হলে ছেলেকে নিজের সাকসেসর বলে স্বীকার করব।
ওরা সাকসেসর-টাকসেসর কখনো শোনেনি।
ঠোঁট উলটে বলল, কিছু লিব্ব না–তোকে বিয়া করব নারে বাবু।
কাতলামাছ ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে পড়লেন।
ছাগল-দাড়ি আর বামাপদ সমানে ফ্ল্যাশ-লাইট দিয়ে ছবি তুলে যাচ্ছিলেন।
এমন সময় মেয়েরা একটা নতুন গান ধরল।
তার প্রথম লাইনটা ছিল কলকাতা-হাবড়া এইসব।
সেই গান শুরু হতেই ছাগল-দাড়ি হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, গায়ে আসা ইস্তক পরে থাকা নীল ব্যাংলনের গেঞ্জিটা খুলে ফেললেন। এমনিতেই তো নিম্নাঙ্গে যা পরেছিলেন তা না পরার-ই মতো। কেন খুললেন, বুঝলাম না।
হঠাৎ তাঁকে এমনভাবে বস্ত্র-হৃত দেখে কাতলামাছের সংগীত প্রতিভা–আট-দশটা হুইস্কির কল্যাণে প্রবলভাবে জাগরূক হল।
তিনি নাচ ছেড়ে গান ধরলেন চৌপাইতে বসে।
এতক্ষণে একটা কাজ করে ফেলেছিলেন কাতলামাছ। ওদের সোজা দোলানি সুরের মেজাজটা ধরে ফেলেছিলেন। আসলে ওঁর উচিত ছিল এমন সব সিম্পল টিউনের কলকাতা হাবড়ার মতো গান শেখা। রবিঠাকুর দীনুঠাকুরের অকল্যাণে উনি কেন যে, লাগেন উনিই জানেন।
তাই, যেই কাতলামাছের গান শুরু হল অমনি তিন-জন মেমসাহেব কাতলামাছকে চৌপাই-এর দু-পাশে বসে একদম চেপটে রাখলেন, পাছে আবারও উঠে গিয়ে কোনো বেলেল্লাপনা করেন।
ছাগল-দাড়ির ডাকনাম কপাল।
কাতলামাছ যে, স্বভাব-কবি তা এতক্ষণে জানলাম। তিনি এখন ওদের গানের ও বাজনার সঙ্গে সঙ্গে ওই তালে ও লয়ে মিলিয়ে গান শুরু করলেন। স্বরচিত।
শেতলপাটি টেপ বাগিয়ে ধরলেন সামনে।
কাতলামাছ টেনে টেনে গাইতে লাগলেন।
কপালবাবু কপালবাবু, তুমি বড়ো চালাক হয়েছে–ও-ও-ও-ও-চালাকেরও বাবা থাকে থ-ও-ও-ও-ও বাবারও বাবা থাকে থ-ও-ও-ও-ও ন্যাংটা হয়ে এসেছ, যেটুকু বা বাকি আছে -আমি খুলে লিব্ব থ-ও-ও-ও-ও।
যাত্রা পুরোপুরি জমে গেল।
এমনি স্বরচিত গান প্যারাগ্রাফের পর প্যারাগ্রাফ চলতে লাগল। ব্যাপারটাতে যারা গাইছিল, নাচছিল তারা প্রথমটাতে হকচকিয়ে গেলেও পরে সকলেই মজা পেল। এমন মজা পেল যে, ওরা নাচ-গান থামিয়ে সব কাতলামাছের ও মেমসাহেবদের সামনে এসে জড়ো হল।
আমার ইচ্ছে হল বলি কাতলামাছকে, বাহা, বাহা, বাহারে, ঘুরে ফিরে, ঘুরে ফিরে। নেহাত চাকরি যাওয়ার ভয়ে বলা গেল না।
হঠাৎ-ই সকলের খেয়াল হল রাত বারোটা বাজে।
রসভঙ্গ ও সভাভঙ্গ করতে হল।
আসর ভঙ্গ হতেই কাতলামাছ দৌড়ে গিয়ে ফুলমণি আর পানুইকে জড়িয়ে ধরে গালে দু দুটো করে চুমো দিয়ে দিলেন।
বললেন, কাল আসিস কেনে, শাড়ি দিব তুদের।
আমি ভাবলাম, এবার তির খেয়ে মরতে হবে।
ভজনদা নার্ভাস। পুরো গ্রামের লোকের চোখের সামনে এমন কান্ড।
সাহেবের চোখ দেখে মনে হল সাহেবও নার্ভাস।
ভজনদা তাড়াতাড়ি ওদের মধ্যে গিয়ে পড়ে বললেন, আরে সাহেবরা মজা করতে এসেছে।–না হলে কেউ নিজের বউয়ের সামনে ওদের চুমু খায়–দেখছিস না বউগুলোও কেমন হাসছে।
এই অকাট্য যুক্তিতে সকলেই ব্যাপারটাকে স্পোর্টিংলি নিল। কোনো অঘটন ঘটল না শেষপর্যন্ত। ঘটতে পারত! অবশ্য সাহেবরা যে, নির্দোষ মজা করতেই এসেছেন ও তাঁরা সকলেই ওয়েল-মিনিং, এ সম্বন্ধে সত্যিই ওদের কারও সন্দেহ থাকার কথা ছিল না।
যাই-ই হোক, যখন সমস্ত গুছিয়ে-গাছিয়ে সাহেবরা ও আমরা গাদাগাদি করে একইসঙ্গে গাড়িতে উঠলাম তখন রাত সাড়ে বারোটা বাজে।
এ আমার কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা। এই চাঁদনি রাত, ঝাঁকড়া অশ্বত্থাগাছ, চাঁদের আলোয় দেখা টিকরিয়া পাহাড়, সাঁওতালদের নাচ, গান, এই আশ্চর্য উন্মুক্ত নিষ্কলুষ পরিবেশ –এবং লাস্ট বাট নট দ্যা লিস্ট-কাতলামাছ–সব মিলিয়ে একটি অভিজ্ঞতার মতো অভিজ্ঞতা।
ফেরার পথে সারারাস্তা শেতলপাটি টেপ বাজাতে বাজাতে এলেন।
আমার মনে হল, কাতলামাছ এখানে এসে পর্যন্ত একমাত্র এই গানগুলিই সুরে গেয়েছেন।
চাঁদের আলোয় ভরা নিশুতি রাতে টাঁড়ের মধ্যে দিয়ে গাড়িতে আসতে আসতে সাঁওতালদের নাচ ও গানের ও কাতলামাছের গানের টেপ বাজছিল। ভারি ভালো লাগছিল। সকলেই একেবারে খোলামনে খুব হইচই করলেন।
ভজনদা ও আমার চাকরিটা রইল।
হুইস্কি বা মহুয়া কিছু না খেয়েও ওই পরিবেশের জন্যে আমারও নেশা নেশা, ঘোর ঘোর মনে হচ্ছিল।
বাড়ি পৌঁছোলাম যখন সকলে, তখন রাত প্রায় একটা বাজে।
সাহেব বললেন, টিকলু, তোমায় কাল ভোরে স্টেশনে যেতে হবে। মি. রায় বলে এক ভদ্রলোক আসবেন। একটু ডেসক্রিপশান দিচ্ছি, যাতে চিনতে ভুল না হয়–বয়স ষাটের ওপর–বেঁটে–পেট-মোটা–সাদা চুল–পরনে অলিভ গ্রিন মিলিটারির মতো পোশাক। দেখে মনে হবে রিটায়ার্ড জেনারাল। চিনতে ভুল কোরো না। ওঁকে রিসিভ করে নিয়ে আসবে। উনি এগ্রিকালচার, হর্টিকালচার, ডেয়ারি, পোলট্রি, ফিশারি, জম্ভজানোয়ার ইত্যাদি সব বিষয়ে অথরিটি। খুব সম্ভব এঁকে এখানে আমার অ্যাডভাইসার করে পার্মানেন্টলি রাখা হবে।
তারপর বললেন, দেখো, ওঁর কোনো কষ্ট না হয়। গাড়ি নিয়ে যেয়ো। আমি উঠে তৈরি হয়ে থাকব ওঁর জন্য। তুমি সোজা আমার কাছে নিয়ে আসবে।
অথিতিদের খাওয়া-দাওয়ার তদারক করলাম। তাঁরা সবাই লনে চাঁদের আলোতে বসেই খেলেন। প্রত্যেকের সামনে মেহবুব আর অশোক ছোটো ছোটো টেবিল লাগিয়ে দিল। সেদিন বাড়িতে রান্না হয়নি। বউরানির অর্ডারে শহর থেকে নান আর তন্দুরি চিকেন আনা হয়েছিল। সঙ্গে খাসির রেজালা।
ওঁদের খাওয়া হয়ে গেলে নিজের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে কোয়ার্টারে গিয়ে শুতে শুতে রাত সোয়া-দুটো বাজল। বেশি হলে আড়াই ঘণ্টা ঘুমিয়েছিলাম সে-রাতে।
অশোককে বলে রেখেছিলাম।
অশোক এসে দরজা ধাক্কা দিয়ে চা দিয়ে গেল। ঠিক সাড়ে চারটের সময়।
অশোক, মেহবুব ওরাও নিশ্চয়ই আড়াই ঘণ্টার বেশি কেউ ঘুমোয়নি। পান্ডেও তিনঘণ্টা ঘুমিয়েছে বেশি হলে। কিন্তু তাতে কারও কোনো অনুযোগ, অভিযোগ নেই। সকলের-ই হাসি মুখ।
আমি যখন তৈরি হয়ে, পান্ডের পাশে সামনের সিটে পৌনে পাঁচটার সময় এসে বসলাম গাড়িতে, তখন আমার এনার্জি দেখে আমি নিজেই চমৎকৃত হয়ে যাচ্ছিলাম। এ ক-দিনেই সাহেবের পাল্লায় পড়ে কত বদলে গেছি। কলকাতায় দুপুরে তিনঘণ্টা ও রাতে কম করে আটঘণ্টা ঘুমোতাম, অথচ এখানে এত কম ঘুমিয়েও মেজাজ বা শরীর কিছুই খারাপ লাগছে না। আসলে আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করেছিলাম যে, পুরুষ কাজে থাকলেই বা কিছু একটা নিয়ে থাকলেই সবচেয়ে ভালো থাকে–নইলে তার জীবনীশক্তিতে ভাঙন ধরতে থাকে।
মি. রায় দৈর্ঘ্যে কম, প্রস্থে বেশি, কিন্তু খুব রাশভারী লোক। মনে হল খুব রাগিও। আমাকে মানুষ বলেই গণ্য করলেন না। গট গট ছোটো ছোটো পা বড়ো বড়ো করে ফেলে হেঁটে এসে গাড়িতে উঠলেন।
বাড়ি পৌঁছেই মি. রায়কে সাহেবের কাছে নিয়ে গেলাম।
সাহেব মার্বেলের গোলটেবিলে মি. রায়ের জন্যে চা সাজিয়ে নিয়ে বসেছিলেন।
মি. রায় চা খেতে খেতেই আশ-পাশের সমস্ত গাছগুলোর কী কী ডেফিসিয়েন্সি তা বলে দিলেন। কোনটায় অর্গানিক ম্যানিয়োর দিতে হবে, কোনটায় ইনসেক্টিসাইডস স্প্রে করতে হবে; ইত্যাদি ইত্যাদি। এগ্রিকালচারের কথাবার্তাও হল সাহেবের ওঁর সঙ্গে। ভদ্রলোককে দেখে রীতিমতো চমৎকৃত হয়ে গেলাম। এমন সর্বজ্ঞ লোক আর দেখেছি বলে মনে হল না। একেবারে ইনস্ট্যান্ট কফির মতো ইনস্ট্যান্ট জিনিয়াস। সে-কারণেই এ প্রতিভার মধ্যে কনসিসটেন্সি আছে কী নেই সে-বিষয়ে সন্দেহ জাগছিল।
সাহেব আমাকে অর্ডার করলেন, ওঁর মালপত্র নিয়ে দোতলার সবচেয়ে ভালো ঘরটাতে ওঁকে সেটলড করে দিতে।
চা খেয়ে উনি বললেন, আমি তাহলে স্নান করে, পুজো সেরে আসি। পুজো না করে আমি কিছু খাই না। সংসারের সঙ্গে তো কোনো সংস্রব নেই–এখন আমি সন্ন্যাসীবাণপ্রস্থ অবলম্বন করেছি–নেহাত আপনি বললেন এত করে, তাই না এসে পারলাম না। আমি জীবনে অনেক ভোগ করেছি, টাকাপয়সা, মানসম্মান কিছুর-ই মোহ নেই–এখনও শুধু কর্মের জন্যে-কর্মযোগে বিশ্বাস করি বলেই কাজ করি।
তারপরেই একটু থেমে বললেন, আপনার কথাটা ভেবে দেখলাম। আমার দু-হাজার হলেই চলবে মাসে। আর খাওয়া-দাওয়া অন দ্যা হাউস।
সাহেব বললেন, তা তো নিশ্চয়ই! এ তো আমার সৌভাগ্য। আপনার হেল্প যদি পাই তবে…।
মি. রায় বললেন, ডোন্ট ইউ ওয়ারি। আমি আজ থেকে আপনার লোকাল গার্জেন অ্যাপয়েন্ট করলাম নিজেকে।
কথাটা শুনে আমি একটু অবাক ও ভীতও হলাম। সাহেব কি হস্টেলে-থাকা নাবালক যে, লোকাল গার্জেনের প্রয়োজন হল হঠাৎ।
আমি মি. রায়ের মালপত্র সব গুছিয়ে-গাছিয়ে দিয়ে, ওঁকে নিয়ে এলাম ওপরে ঘর দেখিয়ে দেওয়ার জন্যে।
উনি বললেন, শোনো ছোকরা, আমার জন্যে কিছু ফল আর গরম দুধ, বেশি নয়; এই এককেজি মতো; পাঠিয়ে দিয়ে ওপরে।
আমি বললাম, আচ্ছা স্যার।
.
কেন জানি না। ভদ্রলোককে আমার একেবারেই পছন্দ হল না। এই চিড়িয়াখানার পরিবেশে, সকলের এই আন্তরিক ঘরোয়া প্রায়-পারিবারিক সম্পর্কের পটভূমিতে এই লোকটা হঠাৎ হামবাগ ইম্পসটারের মতো এসেই যেন নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করতে লাগল।
কিন্তু আমার ভালো লাগা না-লাগা দিয়ে আর কী হবে। সাহেব তাঁকে গুণী-জ্ঞানী জ্ঞান করেন তাহলেই হল।
নীচে নেমে দেখলাম অতিথিরা সকলেই উঠে গেছেন। বারান্দায় চায়ের আসর বসেছে। কাল রাতের টেপ বাজছে সকাল থেকে।
কাতলামাছ, ছাগল-দাড়ি, নিনি-ছুপকি সকলে বসে আছেন। একটু পর মেমসাহেবও এলেন।
এমন সময় দেখি ফুলমণি আর পানুই এসে বারান্দার সামনে দাঁড়িয়েছে।
সাহেব ওদের দেখতে পেয়েই বললেন, কী রে? কী চাই?
ফুলমণি লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলল, উ বাবুটা বলেছিল শাড়ি দেবে।
কাতলামাছের মুখ হাঁ হয়ে গেল।
কাল রাতে নেশার ঝোঁকে যে, ওদের শাড়ি দেবেন বলেছিলেন, সে-কথা বোধ হয় বেমালুম ভুলে গেছেন উনি।
ওদের দেখে তাড়াতাড়ি হিপ-পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে কুড়ি কুড়ি চল্লিশ টাকা দিলেন ওদের।
পানুই বললেন, এতে হবেক নাই।
মেমসাহেব বললেন, হবে রে বাবা, হবে।
ওরা চলে যেতেই কাতলামাছ বললেন, আগে যদি জানতাম এরকম গচ্চা যাবে, তবে ভালো করে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটেই চুমু খেতাম। গালে চুমু খেয়ে–তাও এক সেকেণ্ডের জন্যে -এতগুলো টাকা গচ্চা দেওয়া বড়োবেশি এক্সপেনসিভ হয়ে গেল।
ছাগল-দাড়ি আমায় শুধোলেন, চল্লিশ টাকায় কতখানি পাঁঠার মাংস পাওয়া যায় এখানে?
আমি বললাম, তিনকেজি ছ-শো।
ছাগল-দাড়ি কাতলামাছকে বললেন, দ্যাখ, টাকার কী ওয়েস্টেজ করলি তুই! সকলে মিলে খাসির রেজালা কী চাপ খাওয়া যেত।
মেমসাহেব বললেন, টিকলু, মেহবুবকে বলো আরও চা নিয়ে আসতে, আর তারপর তুমি বাজারে যাবে।
আরও চায়ের পরে আরও গল্প-গুজব করলেন ওঁরা, এমন সময় ওপরের সিঁড়িতে থপ থপথপ আওয়াজ হল কারও নামার।
মেমসাহেব সবে ঘুম থেকে উঠেছেন। সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমার কচ্ছপটা কি কাল ওপরে ঘুমিয়েছিল?
সাহেব ঠোঁটে আঙুল দিয়ে শ-স-স-স করে বললেন, মি. রায় আসছেন!
মেমসাহেব ভুরু তুলে অবাক হয়ে বললেন, তিনি কে?
মেমসাহেব মি. রায় সম্বন্ধে জানতেন না।
মি. রায় টান-টান করে অলিভ-গ্রিন শিকারের পোশাক ও তারসঙ্গে লাল রঙা একটা যোধপুরি বুট পরে এসে দাঁড়ালেন বারান্দায়। আত্মপ্রত্যয় ঝরিয়ে বললেন, গুড মর্নিং টু ইউ। অল।
সাহেব প্রথমে বউরানি ও পরে তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ও মেমসাহেবদের সঙ্গে মি. রায়ের আলাপ করিয়ে দিয়ে তাঁর সম্বন্ধে বিস্তারিত বললেন।
তারপর বললেন যে, উনি খুব বড়ো শিকারিও। সুন্দরবনের ওপর অথরিটি।
ছাগল-দাড়ি নিজে শিকারি বলে শিকারির চোখ দিয়ে মি. রায়কে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখছিলেন।
হঠাৎ বউরানি মি. রায়কে বললেন, আচ্ছা মি. রায়, আপনি কি সব সময়ই শিকারের পোশাক পরে থাকেন?
মি. রায় আমার মুখের দিকে তাঁর মাংসল-পশ্চাৎদেশ সবেগে ঘুরিয়ে বউরানির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পা ফাঁক করে দুটো হাত কোমরের সমান্তরালে দু-পাশে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, কে জানে? কখন ডাক আসে?
বউরানি তাঁর অভিব্যক্তিহীন চোখে কিছুক্ষণ অপলকে মি, রায়ের হাসি হাসি আত্মবিশ্বাসী মুখের দিকে চেয়ে রইলেন!
তারপর হঠাৎ, একেবারে হঠাৎ-ই বললেন : কিছু মনে করবেন না মি. রায়, বাঘ মারার ডাক এলে কি পেন্টুলুনটা বদলাবার সময়ও পাবেন না?
কথাটাতে সকলে হো-হো করে হেসে উঠলেন।
মি. গদাধর রায় আলপিন-ফোঁটানো বেলুনের মতো চুপসে গেলেন।
সাহেব তাড়াতাড়ি সিচুয়েশন সেভ করার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েই মি. রায়কে বললেন যে, চলুন চলুন রায়সাহেব, আমরা গিয়ে টি-হাউসে বসি। আমার বন্ধুরা এসেছে ছুটি কাটাতে–এখানে আড্ডা-গুলতানি হচ্ছে, এখানে আমাদের কাজ হবে না।
মি. রায় যেতে পেরে বেঁচে গেলেন।
সাহেব বললেন, মেহবুব রায়সাহেবের ব্রেকফাস্ট টি-হাউসে পাঠিয়ে দাও।
ওঁরা চলে যেতেই হাসির ফোয়ারা উঠল।
ছাগল-দাড়ি বললেন, বউদি, আপনার মতো ঠোঁটকাটা লোক দেখেনি। কথাটা বলতে আমিও চেয়েছিলাম, কিন্তু বলতে পারতাম না।
বউরানি বললেন, আপনাদের বন্ধু মানুষ চেনে না, এ ভদ্রলোক মোটেই ভালো লোক নন, কাজের তো নন-ই; তা আমি চেহারা দেখেই বুঝেছি। চ্যাম্পিয়ন মেমসাহেব! ইনি এখানে থাকলে আমার চিড়িয়াখানার সোনার সংসারে আগুন লেগে যাবে।
একসঙ্গে বউরানিকে এতগুলো কথা বলতে কখনো শুনিনি। তাই অবাক হলাম শুনে।
এমন সময় লিচু বারান্দায় এলেন। উনি এতক্ষণ বোধ হয় হেয়ার ডু করছিলেন। মাথার ওপরে একটা হিমালয়ান স্কুইরেলের বাসার মতো প্রকান্ড বাসা বানিয়ে এসে বললেন।
ছাগল-দাড়ি বললেন, করেছ কী লিচু!
লিচু চোখ ঘুরিয়ে কটাক্ষ করলেন, স্বামীর বন্ধুকে, তারপর বউরানিকে বললেন, আচ্ছা বউদি, আপনার এমন কেশবতী কন্যার মতো চুল, আপনি কেন মাঝে মাঝে হেয়ার ডু করেন না! আপনার মতো যদি আমার চুল থাকত।
বউরানি চায়ের পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে বললেন, একবার করেছিলাম ভাই, সেই প্রথম ও সেই শেষ সুন্দরী হওয়ার চেষ্টা।
সমবেত সকলে নড়েচড়ে বসলেন।
তিনি বললেন, বলুন বউদি, বলুন।
বউরানি আস্তে আস্তে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কাটাকাটা ডায়ালগে বলতে আরম্ভ করলেন।
ইতিমধ্যে আমি চট করে ভেতরে গিয়ে অশোককে আবারও চা আনতে বলে এলাম। সাহেব-মেমসাহেবদের এখন মুড এসেছে। মুড যাতে ঠিক থাকে, তার বন্দোবস্ত করাই তো আমার কাজ।
বউরানি সাহেবের বন্ধু ও বন্ধুর স্ত্রীদের বলছিলেন, তোমাদের বন্ধুর সঙ্গে দিল্লি গেছি। ওবেরয় ইন্টারকন্টিনেনটালে উঠেছি। সঙ্গে আমার বড়ছেলে। তখন ওর বয়স এগারো বারো বছর।
স্বামী বললেন আজ সন্ধেয় কয়েকজনকে আসতে বলেছি–একটা ককটেল পার্টি দেব। আমাদের সুইটেই। তুমি যাও-না ভ্রমর, নীচের বিউটিপার্লার থেকে চুলটা বেঁধে এসো।
আমি বললাম, আমি ওসবের মধ্যেই নেই, তা ছাড়া চিনিও না কোথায় কী আছে। কখনো করিনি ওসব!
স্বামী বললেন, তুমি ছেলেকে নিয়ে যাও, ও চিনিয়ে নিয়ে যাবে।
তারপর বললেন, যাও-ই না বাবা–জীবনে একদিন চুল বেঁধেই দ্যাখো কেমন দেখায়।
পার্টি আরম্ভ হওয়ার ঘণ্টা দুই আগে, অতএব ছেলের সঙ্গে গেলুম।
দু-জন মেয়ে মিলে তো আমাকে নিয়ে পড়ল। আমরা যেমন করে চিংড়ি মাছের কাটলেট বানাবার সময় চিংড়ি মাছ থুরি, তেমন করে আমার চুল ঘুরছে তো ঘুরছেই–যতক্ষণ ধরে থুরল, ততক্ষণে আড়াইশো চিংড়ি মাছের কাটলেট বানিয়ে ভাজা হয়ে যেত।
ছেলের অতধৈর্য ছিল না। সে আধঘণ্টা মতো বসে বলল, মা আমি চললুম, তুমি চুল বেঁধে এসো।
কিছুক্ষণ পর ঘুম পেয়ে গেল। আমি চোখ বুজে ফেললুম। আমি রক্ষণশীল ঘরের মেয়ে নাপতেনি ও দাইয়েরা চিরদিন পিঁড়েতে বসিয়ে চুল বেঁধে দিয়েছে। এমন অদ্ভুত চেয়ারে বসে, হাসপাতালের নার্সের মতো পোশাকপরা মেয়েরা যে, কী করবে আমাকে নিয়ে শেষপর্যন্ত তাই ভেবেই আমার আতঙ্ক হল।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, এদেরও উচিত এনেস্থেসিয়া দিয়ে নেওয়া চুল বাঁধার আগে।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না।
কে যেন আমার ঘাড়ে মিষ্টি করে নরম আঙুলে একটি চাঁটি মেরে ইংরিজিতে কীসব বলল।
আমি তাকিয়ে দেখি, আমি যে চেয়ারে ছিলুম, সেখানে নারদমুনি বসে আছে। ভয়ে আমার কেঁদে ফেলার অবস্থা।
যাই-ই হোক, গুচ্ছের টাকা দিয়ে তো সেখান থেকে বেরোলাম, কিন্তু এখন ঘরে যাব কী করে?
শেতলপাটি ইন্টারাপ্ট করে বললেন যে, তা ঠিক ওবেরয় ইন্টারকন্টিনেন্টালে গেলে মনে হয় শহর-ই একটা ছোটোখাটো।
অশোক আবার চা নিয়ে এল।
লিচু বললেন, বলুন বউদি।
বউরানি বললেন, ঘরের নম্বর জানি না, কোন তলায় ঘর তা জানি না, ছেলে তো আমার ফেলে চলে এল। এখন আমি কী করি?
লাউঞ্জে দেখলাম, অনেক সাহেব-মেম বসে আছেন। আমিও তাদের পাশে বসে পড়ে কী করি তাই ভাবতে লাগলাম।
ওরা ড্যাবড্যাব করে আমার মাথার দিকে চাইতে লাগল।
সামনেই পাশাপাশি দুটো লিফট উঠছিল-নামছিল। অবশেষে সাহস সঞ্চয় করে নিয়ে আমি একটা বোতাম টিপে দিলুম। লিফটের দরজা খুলে গেল। আমি ঢুকতেই বন্ধ হয়ে গেল। বোতাম টিপলুম। লিফটটা সড়াৎ করে নীচে নেমে গেল।
দরজা খুলতেই দেখি, দু-জন কালো শেরওয়ানিপরা মুসলমান লোক দৌড়ে এসে আমার দু-কানে আতর-দেওয়া তুলো গুঁজে দিয়ে কুর্নিশ করল।
আমি ভয় পেয়ে আবার দৌড়ে লিফটে ঢুকে গেলুম। আবার বোতাম টিপলুম।
দরজা খুলতেই দেখি সাহেব-মেমরা যেখানে বসেছিলেন, সেই তলাতেই আবার এসে পৌঁছোলুম।
তখন আমার কী যে অবস্থা!
ছাগল-দাড়ি বাঁ-হাতে দাড়ি চুলকে বললেন, শেষে স্বামীর কাছে পৌঁছোলেন কী করে?
বউরানি বললেন, একে-তাকে জিজ্ঞেস করে-করে রিসেপশান না কী বলে, যেখানে অনেক ছেলে-মেয়েরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নীচুগলায় গল্প করে, সেখানে গিয়ে শুধোলাম, এখানে কলকাতার এ এম মিত্তির কোন ঘরে উঠেছেন, কোন তলায়?
রিসেপশনের মেয়েগুলো এমনভাবে আমার দিকে তাকাল যেন, আমি খারাপ মেয়ে-টেয়ে হব।
এদিকে বলতেও পারছি না যে, আমি তাঁর স্ত্রী। বললে তো আবার বোকা ভাববে।
ওরা বলল আমি কী চাই?
আমি বললুম, মি. মিত্তিরের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে আমার।
ওরা ঘর ও তলা বলে দিল।
কিন্তু আমি রিস্ক নিলুম না। বললুম, কাউকে সঙ্গে দিন।
একটি মেয়ে ঢঙি-ঢঙি গলায় পে-এ-এ-এ-জ বলে ডাকল।
হলুদ জামা পরা একটা বেয়ারা এসে আমায় যখন স্বামীর ঘরের সামনে পৌঁছে দিল, তখন পার্টি বেশ জমে গেছে।
দরজা খুলতেই, আমি ঢুকতেই ছেলে আবার আমাকে দেখে হাঁউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিল।
পার্টির সমস্ত লোক, সকলেই পাঞ্জাবি, আমার অচেনা; আমার দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। ছেলে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, ও মা, তোমার মাথায় ওটা কী? খুলে ফ্যালো মা, এক্ষুনি খুলে ফ্যালো–ওমা খুলে ফ্যালো।
সব অপরিচিত পাঞ্জাবি ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা, তাদের সামনে কী হেনস্থা!
স্বামী আমাকে চোখ দিয়ে ইশারা করলেন, বাথরুমে গিয়ে ওটাকে খুলে আসতে।
বাথরুমে ঢুকে তো খোলা আরম্ভ করলাম–কিন্তু যে-নারদ ঋষি তৈরি হতে এত সময় লাগল, তা কি অতসহজে খোলা যায়?
বেসিনের সামনে ঘাড় কুঁজো করে থেকে ঘাড়ে ব্যথা ধরে গেল। ওই ঠাণ্ডা এয়ার কণ্ডিশনড ঘরে মাথার জল লাগিয়ে লাগিয়ে সর্দি ধরে গেল। যখন নারদ ঋষিকে সম্পূর্ণ গলিয়ে মা-বাবার দেওয়া চুল নিয়ে বাথরুম থেকে ঘরে এলুম, তখন দেখলুম পার্টি শেষ।
ছেলে ততক্ষণে কেঁদে কেঁদে বেডরুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমার স্বামী আমাকে কাছে টেনে বললেন, ভ্রমর, তোমাকে আর কখনো হেয়ার-ডু করতে বলব না।
বউরানি একটু চুপ করে বললেন, বললেই যেন আমি আবার করতাম।
ছাগল-দাড়ি বললেন, ওই শেরওয়ানি পরা লোক দুটোর কি কোনো মতলব ছিল?
শেতলপাটি বললেন, আরে না না মোগল রেস্তরাঁয় ঢুকলে ওরা ওইরকম করে কাস্টমারদের ট্রিট করে। ওটা একটা রিচুয়াল।
হঠাৎ সকলের খেয়াল হল বামাপদকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লিচু, নিনি ও ছুপকি তিনজনেই এখানে। কাতলামাছ, ছাগল-দাড়ি শেতলপাটিও, শুধু তিনি-ই অনুপস্থিত।
ছাগল-দাড়ি বাঁ-হাতের তর্জনী ও মধ্যমার মধ্যে একটা জ্বলন্ত সিগারেট ধরে বাঁ-হাতটা আমার নাকের কাছে তুলে ধরে অনুনয় করে বললেন দেখুন-না টিকলুবাবু, বামাপদর ঘরে বামাপদ আছে কি না? থাকলে একটু ডেকে দিন।
ছাগল-দাড়ির কায়দাটা অদ্ভুত-লক্ষ করছিলাম, কাউকে কিছু অনুরোধ করতে হলেই, বক্সারের মতো ভোলা বাঁ-হাতের কেলে-কেলে আঙুলঅলা পাতাটা সোজা, যাকে অনুরোধ করা হচ্ছে তার নাকের সামনে চলে যাবে।
আমি উঠে যে-ঘরে বামাপদর থাকার কথা, সে-ঘরের সামনে গিয়ে শুধোলাম, আছেন নাকি স্যার।
ভেতর থেকে একটা অদ্ভুত হুম-হাম শব্দ আসতে লাগল। এয়ার-কণ্ডিশনার বন্ধ; বাইরের দরজা ভেজানো।
এখানে এসে ইস্তক এমন এমন অভিজ্ঞতা হচ্ছে যে, এখন তার কোনো কিছুতেই আমি চমৎকৃত হই না। ভেজানো দরজা পাল্লায় কান লাগিয়ে মনে হল ঘরের মধ্যে একটা পালকি চলছে ঘুরে-ঘুরে। হুম-হুঁমানি তুলে।
আবারও বললাম, স্যার আসব?
এবার উত্তর পাওয়া গেল। কিন্তু ভৌতিকভাবে।
বামাপদ ঝাঁকি দিয়ে বললেন, কাম। তারপর, ইন। কিন্তু কাম কথাটা একেবারে দরজার কাছ থেকে এল আর ইন কথাটা, একটু পর; দূর থেকে। এবং দুটোই ঝাঁকি দিয়ে।
ভয়ে ভয়ে আস্তে করে দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখি বামাপদ নীল গেঞ্জির ওপর নীল ফুল-হাতা সোয়েটার ও ছাগল-দাড়ির মতো একটা শর্টস পরে সারাঘরে ব্যাঙের মতো লাফিয়ে বেড়াচ্ছেন–দু-কোমরে দু-হাত দিয়ে। চোখ লাল, মুখ লাল, ঘরের মেঝে ঘামে ভিজে গেছে।
উনি আমাকে দেখেও থামলেন না।
আমি বললাম, আপনাকে ওঁরা ডাকছেন।
উনি তেমন-ই লম্ফ দিতে দিতে, ঝাঁকি দিয়ে বললেন, জগিং।…শেষ ফ্লগিং… আরম্ভ…।
এটুকু বলতেই ঘরটা দু-বার পরিক্রমা করে ফেললেন।
তারপর বললেন, যা… …চ্ছি…।
আমি তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে বাইরে এলাম।
আমার ওঁকে দেখেই কপাল ঘেমে গেল, আর উনি না জানি কী ঘামান ঘেমেছেন।
আমি ফিরতেই ছাগল-দাড়ি শুধোলেন, কী করছে?
আমি বললাম, জগিং শেষ; ফ্লগিং আরম্ভ। বললেন যে, আসছেন।
বউরানি বললেন, টিকলু এবার বাজারে যাও। আজকে তো রাতে তোমাদের হানিফ সাহেব আসবেন বিরিয়ানি বানাতে।
আমি বললাম, হ্যাঁ, তার ফর্দ আমার পকেটে।
স্কুটার-টেম্পো নিয়ে আমি চলে গেলাম বাজারে।
বাজার থেকে ফিরে আসতে অনেক সময় নিল। হানিফ সাহেব খাসির অঙ্গপ্রত্যঙ্গের যেরকম বিবরণ দিয়ে বলেছিলেন, ডা. নৃপেন দাসের মতো সার্জন হলেও তাঁরও অনেক সময় লাগত কাটা-কুটি করতে কলিজা, কবুরা, সিনা, রাং, প্রভৃতি জায়গা থেকে বিভিন্ন ওজনের রিকুইজিশান। রাং-এরও আবার ক্লাসিফিকেশন আছে, সামনাওয়ালা; পিছলাওয়ালা।
যা-ই হোক, বাজার করে ফিরতেই ভজনদার সঙ্গে দেখা। গেটের কাছে।
ভজনদা বললেন, ভেরি বিজি?
আমি বললাম, না।
উনি বললেন, বাবুর্চিখানায় বাজারের জিম্মা দিয়েই চলে এসো। কেস গড়বড়। চিড়িয়াখানার একজিসটেন্টস নিয়ে ঝামেলা হয়ে গেছে।
তাড়াতাড়ি আমি ফিরে এলাম।
ভজনদা বললেন, মিস্টার রায়কে তুমি-ই নিয়ে এসেছ আপ্যায়ন করে?
আমি বললাম, সে তো শুধু স্টেশান থেকে! আসলে সাহেব-ই ওঁকে আনিয়েছেন।
তা তো আনিয়েছেন কিন্তু এসে অবধি, উনি যা শুরু করেছেন তাতে পোলট্রির মল্লিক সাহেব ও ডেয়ারির ঘোষ সাহেব রীতিমতো ক্ষুণ্ণ। ডেয়ারিতে গিয়ে উনি বলেছেন সমস্ত গোরুর ভিটামিন ডেফিসিয়েন্সি আছে। ষাঁড়গুলোকে আরও অনেক বীর্যবান হতে হবে যদি স্বাস্থ্যবান বাচ্চা পয়দা করতে হয়। পোলট্রিতে গিয়ে বলেছেন এর দেড়গুণ ডিম হওয়া উচিত। এখনও চিড়িয়াখানায় ও গ্রিনহাউসে আসেননি। শুনলাম নাকি তিনি এগ্রিকালচারারিস্ট, বটানিস্ট, ডেয়ারি এক্সপার্ট, পোলট্রি এক্সপার্ট, জিয়োলজিস্ট, বিজনেস ম্যানেজম্যান্ট এক্সপার্ট মানে, হোয়াট নট?
তারপর একটু থেমে বললেন, ডেয়ারির ঘোষ সাহেব বলেছেন আসলে মি. রায় একটি বুলশিট।
মানে? আমি অবাক হয়ে শুধোলাম।
বুল-শিট মানে জানো না? ভজনদা অবাক হয়ে শুধোলেন।
তারপর বললেন, ষাঁড়ের গোবর।
তারপর আবার বললেন, আমি নবনেকে বলে দিয়েছি, ওকে একটা লাউডগা সাপ এনে দেবে, গ্রিনহাউসের ডিফিয়োনবিচিয়ার গায়ে জড়িয়ে রেখে দেবে। যেই উনি গ্রিন-হাউসে ঢুকবেন তখন নবনে বলবে, স্যার এই ডিফিওনবিচিয়াটা ভালো বাড়ছে না। তারপর যেই মি. রায় হাত বাড়িয়ে ডিফিওনবিচিয়া ধরতে যাবেন সাপ দেবে কিটুং করে। মাস্তানি বেরিয়ে যাবে। সাহেবের এ কী ভীমরতি হল।
আমি বললাম, সাহেবকে বলুন, আপনারা সবাই মিলে।
ভজনদা আঁতকে উঠলেন।
বললেন, মাথা খারাপ! সাহেবকে বলার সাহস নেই কারও। তবে ব্যাপারটা এমন সিরিয়াস টার্ন নেবে যে, ভাবা যায় না। ঘোষ সাহেব ও মল্লিক সাহেব দু-জনেই আমাকে বলেছেন যে, তাঁরা প্রফেশনালি অপমানিত বোধ করছেন–তাঁরা দুজনেই পার্টনারশিপ থেকে রেজিগনেশান দেবেন।
হাঁটতে-হাঁটতে আমরা ডেয়ারির কাছে গিয়ে পৌঁছোলাম।
আমি বললাম, মেমসাহেব কিন্তু ওই ভদ্রলোককে একেবারেই পছন্দ করেননি। উনি বলেছেন যে, সাহেব মানুষ চেনেন না, ওই ভদ্রলোক নাকি মোসাহেবি ছাড়া আর কিছুই জানেন না।
-সত্যি?
ভজনদা যেন হাতে চাঁদ পেলেন।
তারপর বললেন, তাহলে একটা বুদ্ধি করতে হবে।
আমি বললাম, কী বুদ্ধি?
ভজনদা বললেন, সাহেব আজ-ই রাতে আবার কলকাতা যাচ্ছেন। পরশু ফিরবেন। কালকের মধ্যে ব্যাপারটার একটা ফয়সালা করতে হবে।
ঘোষ সাহেব মন খারাপ করে তাঁর কোয়ার্টারে চলে গেছিলেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হল না।
দেখলাম সারে সারে গোরু দাঁড়িয়ে। এখানেও এক দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার। আমি শুধোলাম, এগুলো কি সব-ই দিশি গোরু? দিশি গোরুর মতো তো দেখতে নয়?
ভজনদা বললেন, অনেকরকম গোরু আছে। এসো তোমাকে চিনিয়ে দিই। ওই দ্যাখো, ওইদিকে সব দিশি গোরু। আর তার পাশে পাঞ্জাবি গোরু–এদের নাম সহিওয়াল। গায়ের রং দেখছ মেশানোকালো-সাদা, লাল-সাদা ইত্যাদি। তার পাশে লাল বড়ো বড়ো গোরুগুলো দেখছ ওগুলোর নাম–রেড সিন্ধি। তার পাশে ক্রসড জার্সি; এগুলো ইংলিশ। আরও ইংলিশ গোরু আছে, চলো দেখাই। ওইগুলো হচ্ছে হলস্টাইন তাদের পাশে রেড ডেন। ওগুলো সব বিরাট বিরাট। কালো হয়, লাল হয়।
তারপর বললেন, দুধ কিন্তু সকলের-ই সাদা।
আমি শুধোলাম, ওরা জাবনা করে খাচ্ছে কী?
আসলে জাবনা নয়–সারি করা গোরুর সামনে একেবারে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো পারমানেন্ট সিস্টেম।
ভজনদা বললেন, ক্যাটল-ফিড খাচ্ছে ওরা।
চিকেন-ফিডের মতো? আমি শুধোলাম।
ভজনদা বললেন, বাঃ, এই তো শিখে গেছ।
কী কী খায় গোরুরা?
ভজনদা বিরক্ত হয়ে বললেন, এই ক্যালকেশিয়ান সাহেব নিয়ে তো মহামুশকিলে পড়লাম। গোরু কী খায় তাও জান না? ধানগাছ চেন তো?
তারপর নিজেই বললেন, চূণী, ভুসি, অড়হর চূণী, জোয়ার চূণী, বাদাম-খোল, সরষে খোল, তিসি-খোল, খড়। গুড়ও খায় মাঝে মাঝে।
আমি বললাম, এরকম তেলের খোল খায়, গোরুর দুধ তৈলাক্ত হয়ে যায় না?
ভজনদা আমার উৎসাহে ভাটা দিয়ে বললেন, গোরুর দুধও খাওনি নাকি? আর বিরক্ত কোরো না তো আমাকে–এখন আমার মেজাজ খারাপ।
তারপরে আমাকে নিয়ে ঘোষ সাহেবের কোয়ার্টারে গেলেন।
ঘোষ সাহেব পায়জামা পরে, তোয়ালে হাতে চান করতে যাচ্ছিলেন।
বললেন, কী ব্যাপার?
ভজনদা বললেন, একটা আশার আলো দেখতে পাওয়া গেছে ঘোষ সাহেব।
বিরক্তমুখে ঘোষ সাহেব বললেন, কী?
ভজনদা আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, টিকলু বলছিল যে, মেমসাহেব নাকি মি. রায়কে একেবারেই পছন্দ করেননি। আমার মনে হয় আজ সাহেব চলে গেলেই কাল ভোরে আমরা মেমসাহেবের কাছে সকলে একসঙ্গে ডেলিগেশান নিয়ে যাব।
ভজনদা আমাকে নিয়ে ডেয়ারির দিকে যেতে যেতে বললেন, গজকচ্ছপ রায়কে ঢিঢ করতে পারলে মেমসাহেব-ই পারবেন।
ঘোষ সাহেবের কুঁচকোনো ভুরু সোজা হয়ে গেল।
বললেন, কথাটা মন্দ বলেনি ভজন।
তারপর বললেন, একটা বন্দোবস্ত করো। তুমিই ইনিসিয়েটিভ নাও।
ভজনদা বললেন, ঠিক আছে।
ভজনদা আর আমি অন্যদিক দিয়ে ফিরলাম। সেখানে গোলাপ-বাগান, চাষ হচ্ছে গোলাপের। অনেকখানি জায়গা বেড়া দিয়ে ঘেরা। অনেক সাঁওতালি মেয়ে সেখানে বাডিং করছে আর নবীনবাবু তদারকি করছেন।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কতরকম গোলাপ?
-হ্যাঁ। অনেকরকম।
নবীনবাবুকেও খুব পারটার্বড় দেখলাম, তবুও আমাকে কিছু কিছু গোলাপ চিনিয়ে দিলেন। ব্ল্যাক প্রিন্স, ক্লিওপেট্রা-পিঙ্ক রঙা। সুপারস্টারও পিঙ্ক। ডা. ভ্যালোস–এগুলো বাই-কালার ডোরাকাটা-লালের ওপর হলদের স্ট্রাইপসও হয়। গার্ডেন পার্টি–সাদা রঙা। তা ছাড়া বহুরকম মিনিয়েচার গোলাপ–লাল, সাদা, চুন-হলুদ রঙা। বহুরকমের লতানো গোলাপ।
নবীনবাবু তখন অফ-মুড। উনি ভজনদার সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন। মুশকিল হচ্ছে যে, মি. রায়,সাহেবের বাড়িতেই আছেন।
ভজনদা বললেন, টিকলু তুমি কাল ভোরে মেমসাহেবকে নিয়ে গ্রিন হাউসে চলে আসবে সাহেবের বন্ধুরা ওঠার আগেই। আমরা সকলে ওখানে জমায়েত হব ছ-টার সময়। তারপর দরজা বন্ধ করে কনফারেন্স হবে।
আমি বললাম, ঠিক আছে।
সে-রাতে লনে খুব হই-হল্লা হল। হানিফ সাহেব জব্বর বেঁধেছিলেন বিরিয়ানি। বাবুর্চিখানা একবারে সরগরম। বিকেল থেকে গুলহার কাবাব বানানোর তোড়জোড়। তখন থেকেই বাবুর্চিখানাতে বসেই হানিফ সাহেব রাম খেতে শুরু করেছিলেন ওই গরমে। তাই যখন রান্না-বান্না শেষ করে উনি লক্ষ্ণৌ-এর কাজ করা চিকনের পাঞ্জাবি, কলিদার পায়জামা, ফুলতলা নাগরা জুতো, বগলে খস আতর লাগিয়ে লনে এসে দাঁড়ালেন তখন শুধু মির্জা গালিব নন, জিগর মোরাদাবাদি, জাফফর এবং অন্যান্য তাবৎ উর্দু, ফারসি, পুশতু, আরবি কবিদের ভূত ওঁর কাঁধে ভর করছিলেন। শায়েরের ফুলঝুরি ফুটছিল আর অতিথিরা মুখ ভরতি গুলহার কাবাব নিয়ে ক্রমান্বয়ে ওয়াহ, ওয়াহ করছিলেন।
বউরানি সাহেবকে চিঠিতে যেমনটি বলেছিলেন, তেমন-ই করলেন। তখন তাঁর শরীর খারাপ হল। তিনি বিরিয়ানি ছুঁলেন তো নাই-ই; দেখলেন পর্যন্ত না। একবাটি জল-দেওয়া পান্তাভাতে একটা শুকনো-লঙ্কা পোড়া গুলে খেয়েদেয়ে তিনি শয্যা নিলেন।
সাহেব বহুবার ভ্রমর-ভ্রমর করলেন। কিন্তু কখন থামতে হবে তা সাহেব জানতেন। অনেক বছর যিনি ভ্রমরের সঙ্গে একঘরে কাটালেন, তিনি ভ্রমর কখন হুল ফোঁটাতে পারে আর কখন পারে না, তা বিলক্ষণ জানতেন।
সেই রাতে শুধু দু-জন হিরো। হানিফ সাহেব আর নবাগত সর্বজ্ঞা মিস্টার রায়। এমনটি তাদের বক্তৃতার চোটে খল-বলে কাতলামাছও ভাবনার পুকুরের নীচে গভীর পাঁকে মুখ লুকিয়ে রইলেন।
মি. রায় গন্ডায় গন্ডায় নরখাদক মেরেছেন, উনি লেডিকিলার; ইনি কি নন? তাঁর নানারকম গল্প শুনে সকলের চোখ বড়ো বড়ো।
গোলমালের মধ্যে ভজনদা আমাকে ইউক্যালিপটাস গাছের তলায় ডেকে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন, শালা বড়ো কপচাচ্ছে। জানো না বাছা তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।
আমি বললাম, সে এখন পান্তাভাত খেয়ে ঘুমোচ্ছ। কাল বুঝবেন মি. রায়, কত ধানে কত চাল।
বউ-রানিকে আমি বলে রেখেছিলাম।
সকালে উঠেই ওঁর ভীষণ রাগ। ভজনদা ওঁর হাউস-হোল্ড স্টাফের দু-জন লোককে নিয়ে গেছেন কী কাজে সাহেবের হুকুম। তাই মেমসাহেবের ঝোঁক উঠেছে, এক্ষুনি ওঁর চারজন লোক চাই। যেহেতু সাহেব ওঁকে না বলে ওঁর দু-জন লোক নিয়েছেন, সুতরাং উনি এক্ষুনি সাহেবের অর্ডার সুপারসিড করে ডেয়ারি, পোলট্রি, চিড়িয়াখানার চারজন লোক চান।
এদিকে বউরানিই এখন মি. রায়ের হাত থেকে পুরো চিড়িয়াখানা বাঁচানোর একমাত্র উপায়।
আমি বললাম, ওঁরা তো সকলেই গ্রিনহাউসে আসছেন; আপনি নিজেই ভজনদাকে বলবেন।
তখনও বাড়ির সকলেই ঘুমোচ্ছেন, খিদমদগাররা ছাড়া।
আমি বউরানিকে নিয়ে গ্রিনহাউসের দরজা ঠেলে ঢুকলাম।
ঢুকতেই ওঁরা সকলে দাঁড়িয়ে উঠলেন।
প্রথমে আমি বউরানির অভিযোগের কথা বললাম।
সঙ্গে সঙ্গে চারজনের বদলে আটজন লোকের বন্দোবস্ত হয়ে গেল।
বউ-রানি ভজনদাকে বললেন যে, আপনাদের সাহেবকে বলে দেবেন যে, ভবিষ্যতে আমার পারমিশান ছাড়া একজনও লোক নিলে, আপনারা ওঁকে না জানিয়েই একজন লোকের বদলে আমাকে আট-জন করে লোক দেবেন।
ভজনদা বললেন, বলব মেমসাহেব।
তারপর ওঁদের সকলের কথা চুপ করে আধ ঘণ্টা শুনলেন বউরানি।
তারপর বললেন, আপনাদের সাহেবের ভীমরতি ধরেছে। থাকগে, আপনারা আজ সকালে সন্ধেয় আমার এখানে খাবেন। তখন খাওয়া-দাওয়ার পর আমি যা বন্দোবস্ত করার করব।
তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, টিকলু আমরা যখন খাওয়া-দাওয়ার পর লনে বসব, তখন তুমি অশোককে দিয়ে মি. রায়ের স্যুটকেস গুছিয়ে হোল্ডঅল বাঁধিয়ে রেডি করে রাখতে বলবে। ছোটুয়া লন থেকে বাঁশি বাজালেই যেন অশোক আর মেহবুব ওঁর মালপত্র নিয়ে লনে নেমে আসে। পান্ডেকে বলে রাখবে, গাড়ি নিয়ে রাত নটার থেকে যেন বাড়ির কাছে থাকে। মি. রায়কে স্টেশনে পৌঁছোত হবে।
তারপর ভজনদার দিকে ফিরে বললেন, ভজনবাবু, আপনি কাউকে স্টেশনে পাঠিয়ে মি. রায়ের জন্যে ট্রেনের টিকিট কাটিয়ে রাখবেন মিথিলা এক্সপ্রেসের।
তারপর আগেকার দিনের রাজা-রানিরা যেমন হাততালি দিয়ে সকলকে ডিসমিস করতেন, তেমন করে নরম হাতে হাততালি দিয়ে বললেন, আপনারা কাজে যান। এ ব্যাপারটা আমার ওপর-ই ছেড়ে দিন। আপনাদের সাহেব কাল ভোরেই এসে যাবেন। সাহেব আসার আগে ওঁকে তাড়াতে না পারলে ঘোর অশান্তি হবে।
মি. ঘোষ বললেন, তা যা বলেছেন মিসেস মিত্র।
সেই সকালের পর থেকে সারাদিন বাড়ি, চিড়িয়াখানা, পোলট্রি, ডেয়ারি, গ্রিনহাউস এবং অন্যান্য সব জায়গায় সকলেই আমরা যে-যার কাজ করে যাচ্ছিলাম বটে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে দারুণ একটা টেনশান গড়ে উঠছিল। কখন দিন ফুরাবে, সন্ধে হবে এই ভরসায় আমরা ক্ষণ গুনছিলাম।
ভজনদার সঙ্গে দুপুরে একবার দেখা হল। খুব ব্যস্ত ছিলেন। উল্লুকটার কনস্টিপেশন হয়েছে। তার জন্য কী একটা ওষুধ বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
যেতে যেতে বললেন, উল্লুকের কী দোষ? এই লোকটা একদিনে আমার-ই কনস্টিপেশান করে ছেড়ে দিল।
পরিস্থিতি তুঙ্গে এল যখন বিকেলে তাঁর ইন্সপেকশন ট্যুর শেষ করে এসে মি. রায় বউরানির হাতে একটা লিস্ট দিয়ে বললেন, মিসেস মিত্র, মিস্টার মিত্র কাল ভোরে এলেই এটা ওঁকে দেবেন।
আমি আর বউরানি শুধু ছিলাম। সাহেব-মেমসাহেবরা সব কাছেই এক মন্দির দেখতে গেছিলেন দু-গাড়ি বোঝাই করে ক্যামেরা-ট্যামেরা নিয়ে।
বউরানি লিস্টটা হাতে নিয়ে বললেন, এটা কীসের লিস্ট?
মি. রায় চিজ-স্ট্র চিবোতে চিবোতে বললেন, স্যাকিং-লিস্ট। কাকে কাকে ইমিডিয়েটলি স্যাক করতে হবে, তার-ই একটা লিস্ট তৈরি করে ফেললাম।
বউরানি ধীরেসুস্থে লিস্টটাতে চোখ বুলিয়ে বললেন, এতে দেখছি ঘোষ সাহেব, মল্লিক সাহেব, ভজনবাবু, নবীন সকলের-ই নাম আছে। সকলকেই আপনি একসঙ্গে বরখাস্ত করলে এতবড়ো ব্যাপার চালাবে কে?
মি. রায় বললেন, আমি একাই চালাব। মি. মিত্রর অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বড়োই টপ–হেভি হয়ে গেছে। এক্ষুনি ছাঁটাই না করলে উনি ডুবে যাবেন।
বউরানি বললেন, এতে একটা নাম ঢোকতে আপনি ভুলে গেছেন!
-কার নাম?
বলে, মি. রায় একবার বউরানির দিকে আর একবার আমার দিকে চাইলেন। ভাবলেন, আমার নামের কথাই বলছেন বুঝি তিনি।
বউরানি আস্তে বললেন, আমার নাম।
মি. রায় বললেন, কী যে বলেন! আপনি আমার মালিক, আমি সামান্য কর্মচারী আপনাদের ভালোর জন্যেই যা-কিছু করছি।
আমি ভাবলাম, বুড়ো লোকটার আত্মসম্মান জ্ঞান পর্যন্ত নেই। সত্যিই একটা আকাট মোসাহেব।
সন্ধে হওয়ার আগেই সাহেব-মেমসাহেবরা ফিরে এলেন। তখন আমি একদৌড়ে গিয়ে ভজনদা, নবীনবাবুকে বললাম, স্যাকিং-লিস্টটার কথা।
ভজনবাবু বললেন, দাঁড়াও। শালা আজ এমনি না গেলে চ্যালাকাঠ মেরে তাড়াব।
সন্ধেবেলা লনে সকলে এসেছেন। ঘোষ সাহেব, মল্লিক সাহেব, ভজনদা, নবীনবাবু আর সাহেব-মেমসাহেবরা তো আছেনই।
কাতলামাছ ও ছুপকি ডুয়েট রবীন্দ্রসংগীত ধরল। লেডিকেনিবাবু ও ছোটুয়ার তবলা ও বাঁশি সহযোগে।
মি, রায় বললেন, এই দাড়িঅলা লোকটাই বাঙালি জাতের সর্বনাশ করল।
ছাগল-দাড়ি উদবেগের সঙ্গে তাকালেন।
কাতলামাছ বললেন, কোন দাড়িঅলা লোক?
মি. রায় বললেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এই কথাতে সমবেত সকলে মনে মনে খুব ক্ষুব্ধ হলেন।
শেতলপাটি শুধোলেন, আপনি রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন?
মি. রায় বললেন, না। আমি ট্র্যাশ পড়ি না।
তখন মনে হল, শুধু এখানের পার্টনার-কর্মচারীরাই নন, প্রতিটি লোক-ই এ লোকটা এখান থেকে বিদেয় হলে খুশি হন। একটা ধেড়ে, বুড়ো পরগাছা।
তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়ার পর সকলে আবার লনে গিয়ে জমা হল। তখন রাত সাড়ে ন টা বেজেছে।
আমরা সকলেই ঘড়ি দেখছি। মিথিলা এক্সপ্রেস ছেড়ে যায় এগারোটায়। তখনও বউরানির মতলব বোঝা যাচ্ছে না।
সাহেব-মেমসাহেবরাও একটা দুর্যোগের আশঙ্কা করেছেন। এখানকার সকলের, এমনকী তাদের স্ত্রীদের মুখগুলোও থমথমে।
এমন সময় বউরানি পান-ভরতি রুপোর হাঁসটা এনে রাখলেন। সবাইকে পান দিয়ে, নিজে দুটো পান মুখে দিয়ে বললেন, মি. রায়, আপনি আমার সামনে এসে বসুন। আপনার সঙ্গে কথা আছে কয়েকটা।
এতক্ষণ নির্লজ্জ ভদ্রলোক যাদের চাকরি খাওয়ার লিস্ট বানিয়েছেন তাঁদের সঙ্গেও কেমন হৃদ্যতার সঙ্গে গল্প করে যাচ্ছিলেন ও নিজের জ্ঞান ছড়াচ্ছিলেন, তা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম।
মি. রায় ইম্পরট্যান্স পেয়ে খুশিতে রগরগে হয়ে উঠলেন।
বউরানির সামনে এসে চেয়ারে বসে বললেন, বলুন।
খাওয়ার পর-ই আমি অশোককে নিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকে কাপড়-চোপড় বাক্সে ভরে, হোল্ডঅল বাঁধিয়ে রেখে এসেছিলাম।
বউরানি বললেন, আপনি তো ডেয়ারির গোরু সম্বন্ধে অথরিটি তাই না?
মি. রায় আবার দুটো হাত দু-দিকে ছুঁড়ে বললেন, লোকে তো সেইরকম-ই জানে।
বউরানি পরক্ষণেই বললেন আপনাকে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করব। তার জবাব দিতে পারা-না-পারার ওপর আপনার এখানকার চাকরি নির্ভর করছে। যদি দিতে পারেন, তাহলে আপনি এখানে থাকবেন, যদি না পারেন, তাহলে আজ-ই রাতের গাড়িতে আপনি কলকাতা চলে যাবেন।
মি. রায় এতজন লোকের সামনে এমন কথা শুনে ঘাবড়ে গেলেন।
হাসলেন। ব্যাপারটা লঘু করার জন্যে বললেন, আপনি খুব রসিকা মহিলা, কিন্তু আমি আপনার কথায় তো এখানে আসিনি, এসেছি মিস্টার মিত্রের কথায়। উনি প্রায় জোর করেই আমাকে এনেছেন।
তা ঠিক। বউরানি বললেন।
তারপর বললেন, আপনি ওঁর কথায় এসে থাকতে পারেন, কিন্তু যাবেন আমার কথায়। উনি যেমন জোর করে এনেছেন, প্রয়োজন হলে আমিও তেমন-ই জোর করেই আপনাকে ফেরত পাঠাব।
মি. রায় চমকে উঠলেন। বললেন, এসব কী ইনসাল্টিং কথা, এতজন অপরিচিত লোকের সামনে?
পরক্ষণেই বললেন, আমি শুতে যাচ্ছি–আই গো টু বেড আর্লি।
বউরানি বললেন, দাঁড়ান, একটু দাঁড়ান। শোবেন এখন। পুরো রাত তো পড়ে আছে।
তারপর বললেন, যা বলছিলাম, আপনি তো ডেয়ারির গোরর ওপর অথরিটি। এখন আমাকে বলুন দেখি, আপনাকে রাস্তার গোরু গুতোলে কী করবেন?
-মানে?
মি, রায় প্রশ্নটার অভাবনীয়তায় একেবারে হকচকিয়ে গেলেন।
বউরানি বললেন, পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। ভেবে বলুন।
মি. রায় মাথায় হাত দিয়ে পড়লেন। দেখতে দেখতে পাঁচ মিনিট হয়ে গেল।
বউরানি বললেন, পারলেন না।
তারপর ডেয়ারির পার্টনার ঘোষ সাহেবকে বললেন, মিস্টার ঘোষ আপনি কী করতেন?
ঘোষ সাহেব সপ্রতিভভাবে বললেন, আমি হলে, মিসেস মিত্র, কাউকে বলতাম আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে।
চমৎকার। বললেন বউরানি।
তারপর আবার মিস্টার রায়কে বললেন, দ্বিতীয় প্রশ্ন মি. রায়–আপনি দেখে থাকবেন ডেয়ারিতে বড়ো বড়ো গোবরের চৌবাচ্চা আছে।
বলেই, থেমে গিয়ে আমাকে বললেন, টিকলু, একটু কাগজ পেনসিল।
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে একদৌড়ে কাগজ পেনসিল নিয়ে এলাম।
বউরানি বললেন, আমায় নয়, ওঁকে দাও।
চোখের কোণে দেখলাম, ভজনদা সত্যিই দাঁড়কাকের মতো গলা উঁচু করে ইজিচেয়ারে বসে মি. রায়কে দেখছেন।
বউরানি বললেন, গোবরের চৌবাচ্চাগুলোর সাইজ বারো ফিট বাই বারো ফিট বাই আট ফিট। সেই চৌবাচ্চার গোবর দিয়ে চার ইঞ্চি বাই দু-ইঞ্চি বাই হাফ ইঞ্চি কতগুলো খুঁটে হবে? টেন পারসেন্ট হ্যাঁণ্ডলিং শর্টেজ।
তারপরেই, কাগজ পেনসিল এগিয়ে দিয়ে বললেন, নিন। কষে ফেলুন।
আজ্ঞে। বলে, মি. রায় প্রায় আঁতকে উঠলেন।
বউরানি বললেন, পাঁচ মিনিট সময়।
মি. রায় কাগজ পেনসিল টেনে নিয়ে আঁকা কষা আরম্ভ করলেন, এমন সময় ছুপকি হাসি চাপতে না পেরে ফিক করে হেসে ফেললেন। হাসি বড়ো সংক্রামক। ছুপকির হাসি শুনে এদিকে-ওদিকে অনেকেই হাসতে লাগলেন।
হঠাৎ নবীনবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন।
সবাই চোখ তুলে তাকালেন সেদিকে।
মি. রায় নবীনবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, ভেরি ব্যাড ম্যানার্স।
তারপর বউরানিকে বললেন, আপনি আমাকে তাড়াতে চান, এখন-ই তো তাড়ালে পারতেন। আমাকে এমন এম্বরাস করছেন কেন? তাছাড়া এটা হাইলি ইমপ্রপার। আমাকে মিস্টার মিত্র খাতির করে এনেছেন।
বউরানি বললেন, সেজন্যেই মিসেস মিত্র খাতির করে তাড়াবেন।
মি. রায় বললেন, আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এমন সম্পর্ক….।
বউরানি বললেন, আপাতত আপনি গোবরের সঙ্গে ঘুঁটের সম্পর্কটা নির্ধারণ করে ফেলুন। দু-মিনিট গ্রেস দেওয়া গেল।
রেগে উঠে মিস্টার রায় সত্যিই ক্যালকুলেশন করলেন। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেল।
বউরানি ছাগল-দাড়িকে বললেন, কপালবাবু, আপনি তো অ্যাকাউন্টেন্ট–এই নিন কাগজ পেনসিল। পাঁচ মিনিট সময়।
ছাগল-দাড়ি তিন মিনিট পর বললেন, চার লক্ষ পঁয়ষট্টি হাজার নশো চুরাশিটা ঘুঁটে হবে।
বউরানি বললেন, কারেক্ট।
তারপর মি. রায়ের দিকে ফিরে বললেন, পারলেন না।
তারপর আবার বললেন, এবার গাছগাছালি। আপনি তো এসবেও অথরিটি। আচ্ছা, বলুন তো মিস্টার রায়, পুরুষ পেঁপেগাছ ও মেয়ে পেঁপেগাছে তফাত কী?
–কী যে বলেন?
মি. রায় হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন।
-পাঁচ মিনিট সময়।
বউ-রানি বললেন।
মি. রায় দু-হাতে কপাল চেপে মুখ নীচু করে বসেছিলেন! মনে মনে সাহেব যে, তাঁকে কার হাতে ছেড়ে দিয়ে গেলেন সে-কথা ভাবছিলেন বোধ হয়।
বউরানি বললেন, পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেল।
তারপর বললেন, নবীন–তুমি জান?
নবীনবাবু কিণ্ডারগার্টেন ক্লাসের ছেলেরা যেমন করে ইয়েস মিস বলে হাত তুলে উঠে দাঁড়ায়, তেমনি করে হাত তুলে দাঁড়িয়ে রইলেন, পুরুষ পেঁপেগাছে খালি ফুল হয়, মেয়ে গাছেই শুধু ফল হয়। এই-ই তফাত।
বউরানি বললেন, গুড।
মি. রায় মুখ নীচু করেই ছিলেন।
কিন্তু বউরানি তবুও বললেন যে, গোলাপগাছও তো আপনি গুলে খেয়েছেন শুনলাম, বলুন তো ক্লিয়োপেট্রার স্বামী কে?
মি. রায় সোজা দাঁড়িয়ে উঠলেন।
মনে হল উনি দৌড়ে দোতলায় নিজের শোয়ার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করবেন।
বউরানি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, টিকলু।
আমি বললাম, রেডি।
মেমসাহেব বললেন, ছোটুয়া।
অমনি ছোটুয়া তার সেই শুয়োর-ভয়-পাওয়ানো বাঁশিতে ফুঁ দিল।
সঙ্গে সঙ্গে অশোক ও মেহবুব রায় সাহেবের সুটকেস ও হোল্ডঅল নিয়ে ওপর থেকে নেমে এল দৌড়ে।
মি. রায় বললেন, এ কী, এ কী?
ওঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই পান্ডে গাড়িটাতে কোঁ-ও-ও-ও-ও করে ব্যাক করে এনে একেবারে লনের সামনে দাঁড় করাল।
আমি পকেট থেকে বের করে বললাম, এই আপনার টিকিট, আমি সঙ্গে যাব তুলে দিতে, মিথিলা এক্সপ্রেস। এগারোটা।
মি. রায় টলতে টলতে উঠলেন।
কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা গিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে বসলেন।
মেহবুব মাল তুলে দিল বুটে।
আমি গিয়ে পান্ডের পাশে বসলাম।
বউরানি একা এগিয়ে এলেন গাড়ির কাছে।
তারপর জানলা দিয়ে মুখ ঢুকিয়ে বললেন, আরও একটি প্রশ্ন করছি আপনাকে–ট্রেনে ভাবতে ভাবতে যাবেন।
কী? কী? মি. রায় তুতলে বললেন!
বউরানি বললেন, সীতা হরণের সঙ্গে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের তফাত কী?
পান্ডে অ্যাক্সিলারেটরে চাপ দিল।
গাড়ি এগিয়ে চলল।
আমি পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, ভজনদার চিড়িয়াখানার সব ক-টা জানোয়ার লনের মধ্যে লাফাচ্ছে, উঠছে পড়ছে, ডিগবাজি খাচ্ছে, চিৎকার করছে, আর মাঝখানে বউরানি স্থির মর্মরমূর্তির মতো শান্ত হয়ে বসে–। গরম ঝোড়োহাওয়ায় ঝুর ঝুর করে চাঁপাফুল ঝরছে তাঁর মাথায়।