দুপুরের খাওয়া-দাওয়া
০৩.
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে।
সাহেব তাঁর মহারাজা-মহারানি অতিথিদের নিয়ে লাইব্রেরির পাশের গাছতলায় বসবার জায়গায় বসে, অফিসের কাজ শেষ করে এসে কোল্ড বিয়ার খেয়েছেন। পম্পা, মেমসাহেব শ্যাণ্ডি।
বউরানি সাহেব ও সাহেবের অতিথিদের সচরাচর এড়িয়ে চলেন।
তারপর যখন ওঁরা খাওয়ার ঘরে খেতে বসেছেন, আমি রংরুটের মতো দাঁড়িয়ে থেকেছি পাশে, ব্যাপার-স্যাপার দেখবার-বোঝবার জন্যে। কার কী লাগবে না লাগবে তদারকি করার জন্যে।
আজ আমার করার কিছু নেই। কারণ মালকিন ও মালিক উপস্থিত।
ফিজিক্স নিয়ে পড়াশুনা করে, কলেজ-ম্যাগাজিনে বিস্তর কবিতা-টবিতা লিখে শেষকালে খাওয়া-দাওয়ার তদারকির চাকরিতে বহাল হলাম বলে হঠাৎ একবার মনে বড়ো খোঁচা লাগল। পরক্ষণেই সাহেবের উজ্জ্বল দু-টি বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রতিভাময় চোখে চোখ পড়েই সব ভুলে গেলাম। সত্যিই মনে হল, এ আমার অনেক ভাগ্য যে, এমন যোগাযোগ শশীর মাধ্যমে ঘটেছে।
অবাক লাগল বউরানির খাওয়া দেখে। বউরানি শুধু ছানা খাচ্ছেন একটু।
রাম বাবুর্চিকে কারণ শুধোলাম ফিসফিস করে। জানা গেল মেদবৃদ্ধির ভয়ে বউরানি আর কিছুই খান না।
খাওয়া-দাওয়ার পর আমি বউ-রানিকে বললাম যে, আপনি যদি ছানা ছাড়া কিছুই না খান, তাহলে আমিও কিছুই খাব না। আপনি ভাত খেলেই আমি ভাত খাব। আপনি যা খাবেন আমিও তাই-ই খাব। এসব একেবারে ভুল ধারণা। রোগা-মোটা সব উত্তরাধিকারের ব্যাপার। কই সাহেব তো মোটা নন। কিন্তু আপনি মোটা। আমি চেষ্টা করেও মোটা হতে পারি না। যার যেরকম স্বাস্থ্য। খোদার ওপর খোদকারি করে লাভ কী?
আবারও বললাম, আজ রাত থেকে দেখবেন বউরানি, আপনি যা খাবেন, আমিও তাই-ই খাব। আমার তাহলে চাকরি করতে এসে কিন্তু না খেয়ে থাকতে হবে।
বউরানি বললেন, এ কী অলুক্ষুণে কথা!
আমি বললাম, অতসব জানি না। যা বললাম, তাই-ই হবে।
প্রথম দিন-ই চাকরিতে বহাল হয়ে এমন মাতব্বরি ও মালকিনের ছানাগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করাটা ঠিক হল কী হল না ভেবে দেখলাম না একবারও। মাতব্বরিটা করে ফেলার পর মনে হল কাজটা ভালো করলাম না।
সাহেব বোধ হয় রাম বাবুর্চি, অশোক ও মেহবুবের কাছে কানাঘুসায় পাতিকাক-বউরানি সংবাদটি শুনে থাকবেন। রাতে আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, তোমার হবে হে। তুমি বউরানিকে ছানা ছাড়াতে যদি পারো, তবে তোমার অনেক কিছু হবে।
সাহেবকে ঠিক বুঝতে পারছি না। কথাটা কী ভেবে বললেন ও কীভাবে আমার নেওয়া উচিত তা বোধগম্য হল না। তবে ঠিক করলাম, এ ব্যাপার নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করব না।
খাওয়া-দাওয়ার পর বারন্দায় বসে, বেতের তৈরি সাদা রং করা পা-রাখার জায়গায় পা রেখে সাহেব একটা সিগার খেলেন সকলের সঙ্গে গল্প করতে করতে। তারপর সকলে বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে ঘরে গেলে, নিজে উঠে চললেন লাইব্রেরির কাজ তদারক করতে। যাওয়ার সময় আমাকে বললেন, টিকলু, এবার খেয়ে নিয়ে বিশ্রাম নিয়ে নাও একটু। পাঁচটার সময় আবার চলে এসো।
তারপর বললেন, বউ-রানি ও মেহবুবের কাছে থেকে যা বোঝার সব বুঝে নিয়েছ তো?
মাথা নাড়লাম আমি।
বাবুর্চিখানার-ই এককোণের একটা টেবিলে আমাকে খেতে দিয়েছিল রাম বাবুর্চি। চমৎকার রান্না। বাড়িতে উড়ে ঠাকুর রাঁধে, মুসুরির ডালে যেন তেলাপোকা-তেলাপোকা গন্ধ বেরোয়। আর রাম বাবুর্চি ভালো বেঁধেছে, সে-যেন মনে হচ্ছে কী একটা অনাস্বাদিতপূর্ব পদ খাচ্ছি।
খেতে খেতে হঠাৎ সিগারেটের উগ্র গন্ধ নাকে এল।
চমকে তাকিয়ে দেখি, সাহেব এসে বাবুর্চিখানার দরজায় দাঁড়িয়েছেন।
এক পলক আমার থালার দিকে চেয়ে থেকে বললেন, মেহবুব, টিকলুবাবুকে আর একটু মাংস দে। মাংস কি তোদের কম পড়েছে?
তারপর বললেন, তোদের জন্য রেখেছিস তো? দেখি হাঁড়ি।
বলে, নিজেই সটান বাবুর্চিখানায় ঢুকে হাঁড়ি পরীক্ষা করে খুশি হয়ে বললেন, ঠিক আছে। এখন থেকে টিকলুবাবুই বাড়ির ম্যানেজার।
প্রথম-প্রথম ওঁকে একটু দেখিয়ে-শুনিয়ে দিবি–ওঁর কথা মেনে চলবি তোরা। কোনো ঝামেলা যেন না হয়।
তারপর বললেন, ভালো করে খাও। তুমি বড়ো রোগা টিকলু। স্বাস্থ্য ভালো করো। এখানের জল-হাওয়াও ভালো। খাও-দাও-খাটো দেখবে দু-দিনে চেহারা ফিরে যাবে।
বলেই, সাহেব চলে গেলেন আবার অফিসে। এরপর নাকি উনি এগ্রিকালচারাল ফার্মে যাবেন, একটা খুববড়ো মজা-পুকুর নিয়েছেন লিজে, সেই পুকুর কাটা শুরু হবে শিগগির তার তদারকি করে আসবেন একবার।
সব কাজ-ই করে অন্যরা, সাহেব শুধু তদারকি করেন আর ডিসিশান নেন।
এতদিনে বোধগম্য হল কী করে টাটা কী বিড়লা কী আই-সি-আই কোম্পানি বাণিজ্য করে। সব-ই একটা লোক করলে কেউ-ই জীবনে বড়ো হতে পারে না। না, খাটলেও না। ঠিকমতো লোক খুঁজে নিয়ে যার যার হাতে তার তার দাঁড় বুঝিয়ে দিয়ে নিজে হাল ধরে বসে থাকতে হয় শুধু। তবেই জীবনের জলে সাফল্যর নৌকো চলে তরতর করে।
খাওয়া-দাওয়ার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে বাবুর্চিখানার পেছনের পথ দিয়ে কোয়ার্টারে গিয়ে পৌঁছোলাম। বারান্দায় একটা ইজিচেয়ার ছিল–তাতে পাতুলে বসলাম। কেন–জানি না, এখানে এসে অবধি এই সমস্ত ব্যাপার-স্যাপার দেখে ভারী ভালো লাগছে। এ জীবনে আমরা কেউই যে ফালতু নই, ইচ্ছে থাকলে, কল্পনাশক্তি থাকলে বা তা বাস্তবে রূপায়িত করার জেদ থাকলে আমরা সকলেই যে, কিছু-না-কিছু করতে পারি জীবনে কমবেশি, এ কথাটা বোধ হয় এখানে না এলে এমন করে বুঝতে পারতাম না।
সাহেব কলকাতায় এক বিরাট অফিসে পাঁচ হাজারি চাকরি করেন। শশীর কাছে শুনেছি অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে সাহেবের কলকাতার মহলে রীতিমতো নাম আছে। অতবড়ো দায়িত্বশীল কাজ করেও অবসর সময়ে এতবড়ো একটা দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার করা, শুধু তাই-ই নয়, এটা লাভজনকভাবে চালানো, এত লোককে চাকরি দিয়ে, প্রোভাইড করে; যে-সে কথা নয়।
হু-হু করে হাওয়া আসছে টিগরিয়া পাহাড়ের দিক থেকে। হাওয়াটা যেন এক্সপ্রেস ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বইছে। সঙ্গে বয়ে আনছে শুকনো পাতা, লাল ধুলো, খড়কুটো, পাহাড়ের, মহুয়ার, সাঁওতালি মেয়ের গায়ের গন্ধ। এই হাওয়ায় বসে থাকতে-থাকতে চোখ-মুখ শুকিয়ে ওঠে, ঠোঁট ফেটে যায়, কিন্তু কেমন নেশা-নেশা লাগে।
রাতে ভালো ঘুম হয়নি, ঘুম ঘুম পাচ্ছিল; কিন্তু তবুও এই নতুন চাকরি এবং আমার মালিকের আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব, এবং রুখু হাওয়াটা আমার ঘুম চুরি করে নিয়েছে। বুঝতে পারছি আমি, ভ্যাগাবণ্ড ছেলেটা, যে রোজ দুপুরে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে তিন ঘণ্টা ঘুমোত কলকাতায় সে আর কখনো দুপুরে ঘুমোবে না।
আর একটা সিগারেট শেষ করলাম, এমন সময় দেখি দূর থেকে ভজনবাবু আসছেন।
আমাকে দেখেই বললেন, কী মশাই? কেমন বুঝছেন?
ফার্স্ট ক্লাস। আমি বললাম।
তারপর শুধোলাম, এই দুপুরবেলায় কোথায় চললেন?
কোথায় আবার? আমার পুষ্যিদের দেখতে। এখন কার তেষ্টা পেল-না-পেল দেখতে হবে, জল খাওয়াতে হবে, এই গরমে দুপুরের কষ্ট কার কতটুকু কী করে কমানো যায়, তার তদবির তদারকি করতে হবে।
তারপর বললেন, আসবেন নাকি? চলুন আমার পুষ্যিদের দেখিয়ে আনি।
উঠে পড়ে বললাম, চলুন।
একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, খাবেন? বাজে সিগারেট।
নাঃ। ভজনবাবু বললেন। ভুসিমাল আমার চলে না। এসব বিষ। সন্ধেবেলা কাজকর্ম সেরে কুয়োর ঠাণ্ডাজলে চান করে এক বোতল মৃতসঞ্জীবনী সুরা পান করি।
আমি বললাম, সেটা কী? কবিরাজি ওষুধ? ডাবর কোম্পানির? না সাধনা ঔষধালয়ের?
ভজনবাবু বললেন, না না মশায়, লি-অ-এস।
অবাক হয়ে শুধোলাম, সেটা আবার কী?
–লিকার অব-দ্য-সয়েল। মহুয়া।
বলেই হাসলেন।
ভজনবাবুর সঙ্গে চিড়িয়াখানার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, আপনারা সকলেই কি এখানে সেটলড। ক-ভাই আপনারা?
উনি বললেন, না, না। আমি একাই এখানে সেটলড কী আনসেটলড যাই-ই বলুন। আমাদের দেশ জয়নগর-মজিলপুর। মোয়া খেয়েছেন? জয়নগরের মোয়া?
বললাম, নিশ্চয়ই।
সেই। আমি সেই মোয়ার দেশের লোক। আমরা তিন ভাই এক বোন। ভজন, পূজন, সাধন। বোনের নাম আরাধনা।
আমি বললাম, এ তো রবিঠাকুরের কবিতা।
উনি বললেন, আজ্ঞে।
তারপর বললেন, ওয়াইফের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। ফ্যামিলি প্ল্যানিং কমপ্লিট করব তিন ছেলে-মেয়ে দিয়ে। রবিঠাকুরের কবিতাও কমপ্লিট করে দেব। তিন ছেলের অথবা মেয়ের নাম রাখব; সমস্ত, থাক এবং পড়ে।
আমি হেসে উঠলাম। বললাম, চমৎকার।
আজ্ঞে, ইয়েস। বলেই, একটিপ বড়ো নস্যি নিলেন।
ভজনবাবু বললেন, আমার সবকিছুই চমৎকার।
ভজনবাবুর সঙ্গে চিড়িয়াখানায় ঢুকলাম।
দু-পাশে সারি সারি ঘর। তাতে নানারকম পাখি আর জানোয়ার। ভজনবাবু চেনাতে চেনাতে চললেন।
একটা সাঁওতালি মেয়ে পশুপাখিদের জল দিচ্ছিল। ভজনবাবু ডাকলেন, ফুলমণি।
ফুলমণি বলে মিষ্টি ছিপছিপে মেয়েটি বলল, কী বলছিস রে বাবু?
একটু বেশি করে জল দাও মা। তোমরা আমাদের পিয়াসি রাখো রাখো, বাঁদর, পাখিদের বেলা তো একটু হাত খুলতে পারো।
ফুলমণি কথাটা বুঝল না, তবে বুঝল যে, তাকে নিয়ে রসিকতা করা হচ্ছে।
বলল, ইয়ার্কি করিস কেনে রে সবসময়?
ভজনবাবু বললেন, এই বাবু নতুন। আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট।
পরক্ষণেই বললেন, গোরুরগাড়ির হেডলাইট।
আমি শুধোলাম, এতগুলো বাঁদর কেন?
ভজনবাবু বললেন, মানুষের মতো দেখতে হলেই যেমন মানুষ হয় না, বাঁদরের মতো দেখতে হলেই বাঁদর হয় না। বুঝছেন মশায়। এই যে সামনে দেখছেন…
আমি বললাম, ভজনদা, আর আপনি চালাবেন না, তুমি করেই বলুন।
–বেশ। তথাস্তু-কিন্তু তোমার নামটা যেন কী?
–টিকলু।
টিকলু কথার কোনো মানে আছে? না প্রপার নাউন?
–প্রপার নাউন।
তবে তোমার একটা নাম দেওয়া যাবে।
ভালো। আমি বললাম, বউরানি তো ইতিমধ্যেই নাম দিয়েছেন পাতিকাক।
–আমার নাম দাঁড়কাক। আমি জানি।
ভজনদা বললেন।
জানেন?
আমি অবাক গলায় শুধোলাম।
তারপরেই ভজনদা আবার বললেন, এই যে সামনে দেখছ, এটা আফ্রিকান গিব্বন–তার পাশের খাঁচায়–এটা উল্লুক-বাঁদর নয়।
আমি অবাক গলায় বললাম, ওঃ ওটা উল্লুক?
ভজনদা বললেন, ইয়েস।
ডালহাউসি স্কোয়ারে চোখ খুলে চললে দেখবে অনেক উল্লুক প্যান্ট-হাওয়াই শার্ট পরে চলে যাচ্ছে।
তারপর বললেন, তার পাশের খাঁচায় দিশি বাঁদর।
পরক্ষণেই ভজনদা বললেন, এই বাঁদরটা ভারি অসভ্য। এমন করে দু-পা ফাঁক করে কোনো মহিলার বসা উচিত? এ শালিকেও একটা নাইটি বানিয়ে দিতে হবে সাহেবকে বলে। আচ্ছা তুমিই বলো। যত লজ্জা কি মহিলাদেরই? আমরা ব্যাটাছেলেরা কি লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে বসে আছি?
তারপর বললেন, ওই দ্যাখো, তার ওপাশের ঘরে লায়ন-টেইলড বাঁদর, তার পাশের ঘরে স্টাম্পড-টেইল বাঁদর। বাঁদরে-বাঁদরে একাকার।
পাখিরা যেদিকে আছে সেদিকে গিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল কতরকম রং-বেরঙের ম্যাকাও, প্যারাকিট, ফোজেন্ট, ক্যানারি, বদ্রী, কাকাতুয়া যে, তার ইয়ত্তা নেই।
ভজনদা বললেন, প্যারাকিট কতরকম হয় জানো?
না। আমি বললাম।
হয় আরও অনেকরকম। আমাদের কাছে আছে রোজেলা–এগুলো নানা রং হয়। রেড রাম্প–এদের কোমরের কাছটা লাল। কালো ঠোঁট। ব্রুক–দ্যাখো গা-টা খয়েরি, বুকের কাছটা লাল। আর ওই দ্যাখো ককলেট–এগুলো সাদাও হয়, ছাই রঙাও হয়।
তারপর দম নিয়ে বললেন, এবারে চলো ফেজেন্টস দেখাই। এগুলো সিয়ামিজ ফায়ার ব্যাক–গাটা কালো, পেছনটা লাল। মাদিগুলোর গায়ে খয়েরি ছিট ছিট হয়। আর ওই দ্যাখো সোনালি ফেজেন্টটা ওদের নাম গোল্ড ফেজেন্ট।
আমি বললাম, ওই কোণায় যে, বিরাট বাদামি রঙা কাঠবিড়ালিটা শুয়ে আছে ওটা কি কাঠবিড়ালি?
হ্যাঁ, কাঠবিড়ালি। ওগুলো এর চেয়েও বড়ো হয়। এদের নাম হিমালয়ান স্কুইরেল। উড়িষ্যার গভীর জঙ্গলেও পাওয়া যায় শুনেছি।
কচ্ছপের খাঁচাটার সামনে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে আমি বললাম যে, এতবড়ো কচ্ছপ? এ তো কলকাতার চিড়িয়াখানাতেও দেখেছি বলে মনে হয় না।
ভজনদা বললেন, এদের বলে, সাউথ ইণ্ডিয়ান লায়ন-টরটয়েস। গায়ের ওপর কেমন চৌকো চৌকো সন্দেশের ছাঁচের মতো ছাঁচ দেখেছ?
সবিস্ময়ে আমি বললাম, এই সব পশুপাখির দায়িত্ব আপনার?
-ইয়েস। সব আমার। শুধু কি তাই? কত যে কমপ্লিকেশান হয় তা কী বলব। এই তো গত সপ্তাহে ক্যানারির ডিম হবে–ডিম আর বেরোয় না– সে কী গব্ব-যন্ত্রণা–ক্যানারির যত-না কষ্ট, সাহেবের কষ্ট যেন তার চেয়েও বেশি। যেন সাহেব-ই ছেলে বিয়োবেন এমন করে পেটে হাত দিয়ে আথালি-পাতালি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এদিকে পাখিও কষ্টে মারা যায় আর কী! শেষে কলকাতার ট্রাঙ্ককল হল। ভেট এল। ক্যানারির সিজারিয়ান-সেক্সন অপারেশন হল। তারপর ডিম বেরুল। সাহেব ঠাণ্ডা হলেন। তারপর বললেন, ঝামেলা কি কম! এই চিড়িয়াখানায় বেঁচে থাকাটাই একটা দারুণ ঝামেলা।
আমি বললাম, আপনি এতসব শিখলেন কী করে?
ইচ্ছা থাকলেই শেখা যায়। সাহেবের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখে দেখে শিখলাম।
–সাহেব-ই বা এসব শিখলেন কোথায়? তিনি তো অ্যাকাউন্টটেন্ট।
–ওঁর শখ ছিল, ইচ্ছা ছিল। শখ আর ইচ্ছা থাকলে কিনা শেখা যায়?
চিড়িয়াখানায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কখন যে, পাঁচটা বাজতে চলল খেয়াল-ই ছিল না।
ভজনদার কাছ থেকে ছুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে এগোলাম।
বাড়ির কাছে পৌঁছেই দেখি, একটি সাঁওতালি মেয়ে পড়ন্ত রোদ্দুরে লনঝাঁট দিয়ে উড়ে পড়া শুকনো পাতা, ফুল, ধুলো সব সরাচ্ছে।
মেয়েটি আমাকে দেখেনি। সে আমার দিকে পাশ ফিরে কোমর বেঁকিয়ে ঝাঁট দিচ্ছিল।
ভারি সুন্দর লাগছিল তার সেই ঝাঁট দেওয়ার ভঙ্গিটি। সুন্দর মরালী গ্রীবা, কাটা-কাটা নাক-মুখ, একটা রঙিন ছাপা শাড়ি পরেছে, হলুদের মধ্যে লাল ফুল-ফুল, সঙ্গে হলুদ ব্লাউজ, মাথায় হলুদ ফুল গুঁজেছে, তার গায়ের চিকন কালো রঙে সেই হলুদ-লালের যে কী বাহার খুলেছে তা কী বলব?
আমি বাড়ির কাছে যেতেই ও আমাকে দেখল।
দেখেই এমন করে আমার দিকে তাকাল যে, আমার প্রায় ভিরমি খাওয়ার অবস্থা হল। মনে হল বুকের মধ্যে চাসনালার দুর্ঘটনা ঘটে গেল। হু হু করে হৃদয়ে শ্বাসরোধকারী গ্যাসী জল ঢুকতে লাগল চতুর্দিক থেকে।
আমি ওর দিকে আর না তাকিয়ে সোজা বাড়ির দিকে চললাম।
সাহেব সবে বুদ্বুর হাত ধরে বেড়াতে বেরিয়েছেন।
সাড়ে ছ-ফিট লম্বা অতবড়ো সাহেবের পাশে বাঁদরটাকে লিলিপুটের দেশের লোক বলে মনে হচ্ছিল। সাহেবের হাঁটুরও অনেক নীচে ছিল বুন্ধুর মাথা।
আমাকে দেখেই বললেন, শোনো টিকলু, একটু আগেই ট্রাঙ্ককল এসেছিল। মুম্বাইতে আমার একটা কনফারেন্স আছে–কাল সকাল দশটা-পঁয়তাল্লিশের ফ্লাইটে আমায় মুম্বাই যেতে হবে। তাই আমি আজ পাঞ্জাব মেলে চলে যাব রাত দুটোয়। পরশু সকালে মিথিলা এক্সপ্রেসে আমার কয়েকজন গেস্ট আসবেন। কলকাতা থেকে। পাঁচ-জন অ্যাডাল্ট, দু-জন বাচ্চা। গোমিয়া থেকে একটি কাপল–তিনটি বাচ্চা। তাঁরা গাড়িতে আসবেন।
তারপর একটু থেমে বললেন, বউরানি অবশ্য থাকবেন। যাঁরা আসছেন, তাঁরা আমার বিশেষ বন্ধু। যত্ন-আত্তির ত্রুটি কোরো না কোনো। ভালোই হল, চাকরিতে বহাল হতে-না হতেই ইণ্ডিপেন্টেলি কাজ করার সুযোগ এল তোমার।
তারপর বললেন, প্রুভ ইয়োর ওয়ার্থ।
আমি মুখ নীচু করেছিলাম।
বললাম, চেষ্টা করব।
তারপর বললাম, বুন্ধুর তো টিবি হয়েছে আর আপনি ওর সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠতা করছেন, আপনার কিছু হবে না তো?
সাহেব হাসলেন। বললেন, দুর, বাঁদরের টি বি আর মানুষের টি বি এক নয়। কিন্তু টি বি রোগটা অরিজিন্যালি গোরুর থেকে মানুষে এসেছিল। একথা জানো কি?
আমি মাথা নাড়লাম।
মনে মনে বললাম, বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি?
হঠাৎ গম্ভীর মুখে সাহেব বললেন, বুন্ধুটা আর বেশিদিন বাঁচবে না। মনে হয় ও কিছুদিনের মধ্যেই মারা যাবে। তোমাকে বলে যাই, ও যদি আমার অনুপস্থিতিতে মারা যায়, তাহলে ওকে ওই লাইব্রেরির কাছে জামগাছের নীচে কবর দিয়ো। ওর জন্যে চন্দনকাঠের কফিন তৈরি করা আছে। বাঁদরদের কী ধর্ম জানি না। তাই সাঁওতাল পুরোহিতকে বলে রেখেছি, সে এসে বুন্ধুর লাস্ট রাইটস পারফর্ম করবে।
ওকে কবর দেওয়ার পর থেকে, মালিকে বলবে কবরের ওপরে সন্ধেবেলায় ধূপ আর ইউক্যালিপটাসের পাতা পুড়বে।
তারপর বললেন, আর শোনো, রোজ সকালে একছড়া পাকা কলা দেবে ওর কবরের ওপরে।
মনে মনে ভাবলাম, আহা! সাহেবের বাঁদর হলেও এ জন্মের মতো বেঁচে যেতাম।
সাহেব বুদ্বুর গাল টিপে আদর করে বললেন, এরকম পত্নী-প্রেম আমি মানুষের মধ্যেও দেখিনি। ওর স্ত্রী গোপা খুব সুন্দরী মহিলা ছিল এবং প্রচন্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্না। প্রেমও ছিল দু জনের ভীষণ। গোপা মারা যেতেই বুদ্ধ খাওয়া-দাওয়া একেবারে বন্ধ করে দিল–এই টি বি বাধাল স্রেফ না খেয়ে।
ওই জামগাছের নীচেই গোপারও কবর আছে। তার পাশেই যেন বুদ্ধকে কবর দেওয়া হয়। অবশ্য ভজনকে এ সম্বন্ধে আগেই বলে রেখেছি। তোমাকেও বললাম।
সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিলাম।
সাহেব বললেন, সব কটা বাড়ি ঠিকমতো ঝাড়পোছ হল কি না দেখে এসো। টি-হাউসের ভেতরের ঘরের আলো জ্বলছে না। ইলেকট্রিসিয়ান আছেন আমার পার্মানেন্ট স্টাফ। তাঁকে খবর দিয়ে কাল সকালের মধ্যেই ওগুলো ঠিক করে নিয়ো।
তারপর বললেন, আমার সঙ্গে থাকার দরকার নেই এখন তোমার। তুমি বউরানির কাছে যাও। উনি ছুটি দিলে তোমার ছুটি। প্রথম দিনেই বেশি খাটুনি করতে হবে না।
বউরানির কাছে গিয়ে হাজির হলাম। দেখলাম, বউরানি মেঝেতে বসে পান সাজছেন। পাশে একটা রুপোর হাঁস রাখা আছে। এক-একটা পান সাজছেন, আর সেই হাঁসের পেটে ঢোকাচ্ছেন। হাঁসের পেটে ডিমের বদলে পেট-ভরতি পান হয়ে যাওয়ার পর হাঁসের ডানা খুলে বউরানি গোলাপজল ছিটিয়ে দিয়ে হাঁসটাকে সটান ফ্রিজের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন।
এতক্ষণ এমন মনোযোগের সঙ্গে পান সাজছিলেন উনি যে, আমার অস্তিত্ব টেরই পাননি।
হঠাৎ মুখ তুলে আমাকে দেখতে পেয়ে বললেন, কী চাও টিকলু!
বললাম, আমি কিছু চাই না। সাহেব বললেন, আপনার কাছে আসতে।
বউরানি বললেন, তোমার সাহেবের বাঁদর-পাখির ওপর যেটুকু দরদ ও মানুষের ওপরে, আমি–সুদ্ধু; তার ছিটেফোঁটাও নেই। জান তো, তোমার সাহেবের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়নি।
-মানে?
আমি অবাক হয়ে শুধোলাম।
মেমসাহেব বললেন, বিয়ের সময় নাপিত তোমার সাহেবকে মালাটা এগিয়ে দিতে গিয়ে ভুল করে সে নিজেই সেটা আমার গলায় পরিয়ে দিয়েছিল। যে আসল বর সে কোথায় হারিয়ে গেল–আর সারাজীবন কাটল এই উন্মাদের সঙ্গে।
তারপর একটু থেমে বললেন, আজ-ই তো তোমার প্রথম দিন-রাতেও তো ঘুম হয়নি। প্রথম দিন-ই কি তোমার সাহেব তোমার পরীক্ষা করেছেন?
তারপর বললেন, যাও এখন আর কী কাজ? রাতে খেয়ে নিয়ে কাল সকালে এসো।
আমি ছুটি পেয়ে বাড়ির হাতার মধ্যে একা একা পায়চারি করে বেড়াতে লাগলাম। এতবড়ো কম্পাউণ্ড যে, বাড়ির মধ্যে ঘুরে বেড়ালেই পায়ে ব্যথা ধরে যায়।
এখন বেলাশেষের স্লান রোদে টিগরিয়া পাহাড়টা ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। বেলা পড়ে এল, কিন্তু হাওয়ার বিরাম নেই। হাওয়াটা যেন আরও জোর হয়েছে দুপুরের চেয়েও। এখন হাওয়াটা আগুনের মতো গরম। এখনও পাতা-ফুল উড়ে আসছে লাল ধুলোর সঙ্গে মাইলের পর মাইল দূর থেকে।
.
চিড়িয়াখানা থেকে ময়ূর ডাকছে, ম্যাকাও ডাকছে, সন্ধের আগে সব পাখিরা ডাকাডাকি শুরু করেছে। উল্লুক, উক-উক-উক-উক করে উঠল।
ধীরে ধীরে বেলা পড়ে আসতে লাগল। রাধাচূড়া গাছে গাছে ফুল ছেয়ে আছে। চিড়িয়াখানায় কোকিলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে জংলি কোকিল কৃষ্ণচূড়া গাছের মগডালে লালের মধ্যে তার কালো শরীর লুকিয়ে বসে গলা-ফুলিয়ে ডাকছে কুহু-কুহু-কুহু। আহা! এমন ডাক যে, আমার মতো বাউণ্ডুলে, ছন্নছাড়া, একলা লোকের বুকের মধ্যেটাও উঁহু-উঁহু করে ওঠে।
কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর আমার কোয়ার্টারে এলাম। কুঁজো থেকে গড়িয়ে ঠাণ্ডা জল খেলাম একগ্লাস। বিকেলে চা খেয়েছি, আর এককাপ চা হলে বড়ো ভালো হত। বউদি বাড়িতে আদরে-আদরে আমার মাথাটি খেয়েছে একেবারে।
বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে সাতপাঁচ ভাবছি, ইউক্যালিপটাস গাছের ডালের ফাঁক দিয়ে সবে দ্বাদশীর চাঁদ উঠেছে, এমন সময় মেহবুব হঠাৎ ট্রেতে করে চা এনে হাজির।
বলল, মেমসাহেব আপনার জন্যে পাঠিয়ে দিলেন।
দেখি ট্রের ওপরে টি-পটে চা, সঙ্গে নোনতা মাঠরি।
বউরানিকে মনে মনে কী যে ধন্যবাদ দিলাম, তা আমিই জানি।
বউরানি যেন আমার মায়ের মতো, মনের কথা না বলতেই বুঝে ফেলেন।
চা খেতে খেতে অন্ধকার হয়ে এল। কাছেই কোথাও হাসনুহানা ফুটেছে। কী সুন্দর গন্ধ। হাওয়ার সঙ্গে ঝলক ঝলক, মহুয়ার গন্ধও আসছে।
ইজিচেয়ারে বসে সেই অন্ধকারের হাওয়ার শব্দটা সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন কোন অচেনা সমুদ্রের পারে চাঁদ-ওঠা বালিয়াড়িতে বসে আছি আমি। একা একা বসে হাওয়ার সঙ্গে চাঁদের সঙ্গে, ফুলের গন্ধের সঙ্গে, নিরুচ্চারে কত কী কথা বলছি।
এমন সময় হঠাৎ আমার-ই সমবয়সি একটি ছেলে কাঁকরের ওপর চটিতে কিরকির শব্দ তুলে বারান্দায় এসে উঠল।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।
ভদ্রলোক বললেন, বসুন মশাই, বসুন। আমি কি আর সাহেব যে, আমাকে এত সম্মান করতে হবে?
আমি তখনও দাঁড়িয়েই বললাম, আপনি?
ভদ্রলোক বারান্দার আলসেতে বসে পড়ে বললেন, আমার নাম নবীন রায়, আমি চিড়িয়াখানার গ্রিনহাউসের দেখাশোনা করি।
তারপর বলল, গ্রিনহাউস দেখেছেন?
আমি বললাম, না তো!
নবীনবাবু বললেন, ঠিক আছে, সব দেখবেন। তাড়া কীসের?
তারপর-ই বললেন, এখন ছুটি?
হ্যাঁ। আমি বললাম।
নবীনবাবু বললেন, চলুন একটু বেড়িয়ে আসি।
তারপর-ই বললেন, কাল থেকে শালার সাইকেলটার টায়ারটা পাথর লেগে চিরে রয়েছে–। চলুন হেঁটেই যাই।
-কোথায়?
-আরে চলুন-ই না!
নবীনবাবুর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে গেটে এলাম।
দারোয়ান আমাদের ছেড়ে দিল স্টাফ বলে।
দেখলাম, দারোয়ানের সঙ্গে নবীনবাবুর বেশ সদ্ভাব।
নবীনবাবু গেট পেরোতে পেরোতে বললেন, কেয়া? লায়গা রামস্বরূপ।
-লাইয়ে একঠো।
আমি শুধোলাম, কী?
নবীনবাবু হাসলেন। বললেন, মহুয়া।
বেশ অনেকক্ষণ জ্যোত্সালোকিত পথে ধুলো মাড়িয়ে, গাছগাছালির পাতায় পাতায়, ঝরনা ঝরানো হাওয়ায় ভেসে চললাম আমরা। দু-পাশে চন্দ্রালোকিত লালমাটির ধু-ধু টাঁড়, খখাওয়াই; ক্কচিৎ শাল ও মহুয়া। পথের পাশের একটা বাড়িতে নাম-না-জানা লতায় ফুল ধরেছে। পথের সে জায়গাটা গন্ধে ম ম করছে।
বেশ অনেকক্ষণ হেঁটে যাওয়ার পর আমরা একটা জায়গায় এসে পৌঁছোলাম।
দূর থেকেই মনে হল যে, এটা একটা ভাঁটিখানা।
নবীনবাবু চোখ নাচিয়ে শুধোলেন, চলে?
আমি বললাম, না, নবীনবাবু।
নবীনবাবু বললেন, সে কী মশায়? কলকাতার ছেলে এসব চলে না কীরকম?
লজ্জিত মুখে বললাম, চলে না মানে, কোনোদিনও চলেনি তাই।
ডোবালেন মশাই। নবীনবাবু বললেন।
তারপর স্বগতোক্তির মতো বললেন, সারাজীবন কি আমাকে ভজনদার শাগরেদ হয়েই কাটাতে হবে নাকি।
ভাঁটিখানায় আলো জ্বলছিল হ্যারিকেনের। শালকাঠের খুঁটি দেওয়া মাটির বাড়ি, নিরিবিলি শালগাছের নীচে। চারধারে শালপাতার দোনা ছড়ানো-ছিটানো ছিল। কিছু মেয়ে-পুরুষ ভাঁটিখানার সামনে ও ভেতরে, দাঁড়িয়ে-বসে ছিল। একটা অলস, মন্থর, পরিবেশে সমস্ত জায়গাটিতে।
আমি শুধোলাম, জায়গাটার নাম কী?
মিরিডি! নবীনবাবু বললেন।
বললাম, আচ্ছা এখানের বেশিরভাগ জায়গায় নামের শেষে এমন ডি কেন? এই ডি-র — কোনো মানে আছে?
নবীনবাবু হাসলেন। বললেন, ডি হচ্ছে ডিহ। ডিহ হল সাঁওতালি ভাষায় বাড়ি বা গ্রাম।
এমন সময় ভাঁটিখানার ভেতর থেকে জড়ানো-গলায় কে যেন হঠাৎ বাংলায় গান গেয়ে উঠলেন
শ্যামা মা যে, আমার কালোকালো রূপে দিগম্বরী;হৃদিপদ্ম করে যে আলো রে–শ্যামা মা যে, আমার কালো।
নবীনবাবু খরগোশের মতো কান খাড়া করে শুনলেন একমুহূর্ত, তারপর-ই বললেন, ভজনদা।
বলতে-না-বলতেই ভজনদা বাইরে বেরিয়ে এলেন, হাতে মহুয়ার বোতল নিয়ে।
আমাকে দেখেই বললেন, এ কী! হাউসকিপিং ম্যানেজার হাউসের বাইরে কেন?
আমি উত্তর করার আগেই ভজনদা বললেন, আমিও আজ চলে এলুম। আজ সাহেব মনে বড়োদুকু দিলেন। সেই দুকু ভোলার জন্যেই চলে এলুম।
নবীনবাবু গলা নীচু করে বললেন, মাল খাবে খাবে, তারজন্যে এত দুঃখের দোহাই কেন রে বাবা? মাল কি বাপের পয়সায় খাচ্ছ না, শ্বশুরের পয়সায় খাচ্ছ?
আমি বললাম, আহা! বেচারা সত্যিই হয়তো দুঃখ পেয়েছেন কোনো কথায়।
নবীনবাবু বললেন, রাখুন ভজনদার দুঃখ। রোজ-ই উনি দুঃখ পান। কোনোদিন সাহেব দেন, কোনোদিন মেমসাহেব দেন। কোনোদিন বাঁদর, কোনোদিন উল্লুক, কোনোদিন কচ্ছপ –ওঁর দুঃখ পেতেই হবে কারও-না-কারও কাছ থেকে সন্ধেবেলায়।
ভজনদা আমাদের ওভারহিয়ার করে বললেন, কীরে নবনে, আমার সম্বন্ধে টিঙ্কুকে কিছু বলেছিস? এখন থেকেই মন বিগড়োচ্ছিস?
তারপর-ই আমার দিকে বোতলসুষ্ঠু হাত তুলে বললেন, এই নবনেটার সঙ্গে মিশো না হে টিঙ্কু।
আমি বললাম, আমার নাম টিকলু!
ওই হল। আমি টিঙ্কুই বলব। কিন্তু ওই ছোঁড়ার সঙ্গে মিশলে আমি সাহেবকে বলে দেব।
আমি তখন সিরিয়াসলি ভাবছিলাম, কার সঙ্গে মিশব তা ঠিক করার সময় হয়েছে। যা সব স্যাম্পেল দেখছি, তাতে বোধ হয় বুন্ধুর সঙ্গে মেশাই সেফ।
তারপর-ই নবীনবাবুর দিকে ফিরে বললেন, আজ এলি কেন বাপ? আজ যে, তোর পানুই তুই আসার আগেই এক ব্যাটাকে সঙ্গে নিয়ে হেই উদোম টাঁড়ে চলে গেছে। পানুই কি তোর বাঁধা মাগ, না গোয়ালের গাই যে, তোর খুঁটোয় দিনরাত শুয়ে-বসে জাবর কাটবে?
তারপর একটা হেঁচকি তুলে, গলায় ঢেউ খেলিয়ে বললেন, বনকে চিড়িয়া, বনমে গিয়া।
নবীনবাবু ফিসফিস করে বললেন, ভজনদা আজ একদম তৈরি।
তারপর বললেন, নাঃ, আজ চলুন ফিরেই যাই। আজ যাত্রা অশুভ। পানুই নেই, তার ওপরে ভজনদা একেবারে হাই।
আমি বললাম, হাই হলে কী করেন উনি?
নবীনবাবু বললেন, উনি কী করেন তার ঠিক কী? অনেক কিছুই করেন। কিন্তু আমার গুরু বলে দিয়েছেন–অন্যে হাই হলেই নিজে লো হয়ে যাবে। এর চেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ আর নেই।
ভজনদার খ্যানখেনে গলায় গান শুনতে পাচ্ছিলাম
এসো প্রিয়া হবে মোর রানি,তোমার খোঁপায় পরাব ফুল।কানে ঝুমকো তারার দুল।
ফিরে আসতে আসতে শুধোলাম, পানুইটি কে? যে চিড়িয়াখানায় কাজ করে, সেই মেয়েটি?
হ্যাঁ। নবীনবাবু বললেন।
তারপর বললেন, চালুপুরিয়া।
আমি শুধোলাম, কেন একথা বলছেন?
নবীনবাবু বললেন, কী বোঝাই জানি না। মানে, ঠাকুমারা যেমন করে নাতি-পুতি হ্যাণ্ডেল করে-না, ও তেমনি করে অ্যাডাল্ট পুরুষ মানুষ হ্যাণ্ডেল করে। ঘুঘুর-সই, ঘুঘুর-সই খেলে
হাত ঘোরালে নাড় পাবে নইলে নাড় পাবে না–বলে, কেউ আবার বেশি কান্নাকাটি করলে দুদু খাইয়ে দেয়। এমন ছেলে-ভুলোনো পাড়াজুড়োনো ঘুম-পাড়ানো মাসি-পিসি আর হয় না।
হাওয়ার তেজটা আস্তে আস্তে কমছে। আমরা দু-জন পাশাপাশি হাঁটছি। পথটার দু-পাশে ছোটো ছোটো ঝোপঝাড়। এদিকে গাছপালা কম। জঙ্গল কেটে প্রায় শেষ করে এনেছে। মাঝে মাঝে দুটো-একটা হরজাই গাছ–বেশিরভাগ-ই ঝাঁটি-জঙ্গল। বাঁ-দিকে একটা পুরোনো ইটের পাঁজা। কখনো বোধ হয় এখানে ইট বানানো হয়েছিল।
ইটের ভাঁটাটার পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছি, হঠাৎ নবীনবাবু আমার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান লাগালেন।
আমি একটা ঝটকায় পেছনে চলে এলাম।
চাঁদের আলোয় দেখলাম, আমার পায়ের সামনে দিয়ে একটা কালো মোটা দড়ি আস্তে আস্তে বাঁ-দিক থেকে ডানদিকে চলে যাচ্ছে।
হঠাৎ নবীনবাবু খেপে গেলেন। দৌড়ে, বাঁ-দিকে গিয়ে পাঁজা থেকে একটা ইট তুলে নিয়ে সেই ধীরে অপস্রিয়মাণ দড়িটার পেছন পেছন দৌড়ে গেলেন, তখন-ই প্রথম বুঝলাম যে, ওটা একটা সাপ!
আমি স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সাপ দেখলেই আমার গা ঘিনঘিন করে ওঠে। ছোটোবেলা থেকে। শুধু সাপ, কেন? নরম তুলতুলে কোনো কিছু দেখলেই অমন হয়।
নবীনবাবু ততক্ষণে, পথ ছেড়ে মাঠে নেমে গেছেন। যে-সাপ কামড়ায়নি, ফোঁস করেনি, থুথু ছিটোয়নি, নির্বিবাদে পথ দিয়ে চলে গেছে কিছুই না করে–তাকে হঠাৎ তাড়া করে যাওয়ার কী দরকার বুঝলাম না।
একটু পর শক্ত মাটিতে ফটাং ফটাং করে ইটের আঘাতের শব্দ শুনে একটু সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেলাম ওদিকে।
সবিস্ময়ে দেখলাম, নবীনবাবু উবু হয়ে বসে ইটটা দিয়ে সাপটার মাথাটা বাড়ির পর বাড়ি মেরে একেবারে থেঁতলে দিচ্ছেন।
সাপটা তখনও নড়ছিল।
মাথাটা ঘা মেরে মেরে একেবারে সম্পূর্ণ থেঁতলে দেওয়ার পর নবীনবাবু প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে উঠলেন।
তারপর হঠাৎ সাপটার ল্যাজ ধরে হাতে ঝুলিয়ে আমার দিকে আসতে লাগলেন।
আমি আতঙ্কিত গলায় শুধোলাম, বিষ আছে? বিষ নেই?
কে জানে?
তাচ্ছিল্যর গলায় নবীনবাবু বললেন।
তারপর বললেন, থাকতেও পারে না-ও থাকতে পারে। আসলে সাপেরা মেয়েদের মতো –। ছোবল না-মারার আগে সব সাপকেই নির্বিষ বলে মনে হয়।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, আপনার আত্মীয়স্বজন কাউকে কি সাপে কামড়িয়েছিল? সাপের ওপর আপনার এরকম তীব্র আক্রোশ কেন?
নবীনবাবু সেই চাঁদের আলোয় লাল ধুলোয় ধূসরিত পথে অনেকক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থাকলেন–যেন আমার মতো ইনকুইজিটিভ লোক এ জন্মে আর দ্বিতীয়টি দেখেননি।
তারপর বললেন, না নয়। তবে গুরুবাক্য আমি কখনো অমান্য করি না।
আমি উৎসুক হয়ে শুধোলাম, গুরুবাক্যটা কী?
নবীনবাবু বললেন, দেকেচো কী মেরেচো!
তারপর নিজেই আমাকে শুধোলেন, কি? বুঝলেন কিছু?
আমি বললাম, সাপ?
নবীনবাবু হাসলেন।
সেই চাঁদের আলোতেও তাঁর সাদা দাঁত ঝিকঝিক করে উঠল।
–শুধু সাপ নয়। দেকেচো কী মেরেচো। ফণী–আর…..।
আমি বললাম, থাক থাক। বলতে হবে না। বুঝেছি।
উনি আবার বললেন, আমার গুরু বলেছিলেন।
কথাটার অর্থ হৃদয়ংগম করতে এবং হৃদয়ংগম করে সামলে নিতে আমার অনেকক্ষণ সময় লাগল।
ততক্ষণ নবীনবাবু মরা সাপটাকে ডান হাতে নিয়ে এগিয়ে গেছেন। সাপের ল্যাজটা ধরে আছেন, থ্যাঁতলানো মাথাটা মাটিতে সড়সড় শব্দ করে ধুলোর ওপরে লম্বা দাগ টেনে দিয়ে চলেছে।
সাপটা বেশ লম্বা আর বড়ো ছিল।
আমি তাড়াতাড়ি নবীনবাবুর বাঁ-দিকে চলে গেলাম, মরা সাপকেও বিশ্বাস নেই।
তারপর ওঁর পাশে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, গুরুবাক্য তো মানলেন। ফণী তো মারলেন। কিন্তু গুরু কি মরা সাপ হাতে করে নিয়েও যেতে বলেছেন?
নবীনবাবু এবার হেসে ফেললেন।
বললেন, আমার ডানহাত আটকা। একটা সিগারেট ধরিয়ে আমার মুখে পুরে দিন তো?
আমি দাঁড়িয়ে পড়ে, হাওয়া আড়াল করে সিগারেট ধরালাম, তারপর সেই সিগারেট থেকে আরও একটা ধরিয়ে নিয়ে নবীনবাবুকে দিলাম।
নবীনবাবু একগাল ধোঁয়া ছেড়ে বাঁ-হাতে সিগারেটটাকে মুখ থেকে নামিয়ে বললেন, সাপটি নিয়ে যাচ্ছি চুমকির জন্যে।
সে কে? অবাক হয়ে শুধোলাম আমি।
চুমকির সঙ্গে ভজনদা এখনও আলাপ করিয়ে দেননি? আশ্চর্য।
তারপরেই বললেন, চিড়িয়াখানার পরি, হুরি, সরি–ময়ূরী। সাহেবের গার্লফ্রেণ্ড। চুমকি সাপ খেতে বড়ো ভালোবাসে। রোজ রোজ তো ফণী দেখা যায় না; অন্যকিছুও অবশ্য না। তবে যখন দেখা যায়, তখন আমি চুমকির জন্যে। আর……
আমি নবীনবাবুকে তাড়াতাড়ি থামিয়ে দিয়ে বললাম, আর আমি শুনতে চাই না।
নবীনবাবু দাঁড়িয়ে পড়ে আমার মুখের দিকে অপলকে চেয়ে থেকে বললেন, আপনি মশাই একটি মহান্যাকা লোক।
আমি ব্লাশ করলাম।
অস্ফুটে বললাম, যা বলেন।
.
০৪.
ভোর চারটেয় উঠলাম। তারপর তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিয়ে গেটে এলাম।
ট্রেনটা স্টেশনে পৌঁছোয় সকাল পাঁচটার পর পর-ই। যে-ট্রেনে আমি সাহেবের সঙ্গে এসেছিলাম।
পান্ডে ড্রাইভার গাড়ি বের করে তৈরি হয়েছিল। যে স্কুটার-টেম্পো চালায়, সেও তার হলুদরঙা টেম্পো নিয়ে তৈরি।
যখন আমরা সাড়ে চারটের সময় বেরোলাম গেট খুলে, তখন পুবে সবে একটু লালের ছোপ লেগেছে। কোকিল ডাকছে, টিগরিয়ার টাঁড় থেকে, দূর কুকরিবাগ গ্রামের দিক থেকে মুহুর্মুহু কুহু-কুহু-কুহু করে।
ফুরফুর করে হাওয়া বইছে ভারি মিষ্টি। এই সাঁওতাল পরগনার বৈশাখী ভোরগুলো ভারি সুন্দর। বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া এই গানটা আমার কলকাতার বউদি ভারি ভালো গান।
হঠাৎ-ই গাড়ির সামনের সিটের দরজায় বাঁ-হাত রেখে বসে এই আধো-আলো আধো অন্ধকারে বউদিকে ভীষণ মনে পড়তে লাগল। আমি কাঠখোট্টা মানুষ, ভাব-টাব কবিত্ব-টবিত্ব প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই–কিন্তু মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে কত কী যে, কুরকুর করে উঠে–নিজেকে কুরে কুরে খায়। একবার ভালো লাগে, পরক্ষণেই দুঃখ লাগে–কারও কথা ভেবে ভীষণ খুশি খুশি লাগে–কাউকে ভালোবাসতে পেরে নিজের পিগমি সাইজের মনটা অনেক বড়ো হয়ে গেছে বলে মনে হয়।
বুঝি না। কেন এমন হয়। হয়তো সকলের-ই হয়–যদি কেউ কখনো কাউকে ভালোবেসে থাকে। কিন্তু হয়।
ভালোবাসার মতো দাগ ভগবান যেন কাউকে না দেন। খালি চুলকোয়–আর চুলকোলেই চুলকোনি বেড়ে যায়। ঢোল কোম্পানির মলম আছে দাদের। কোনো কোম্পানি এই দারুণ দাদের মলম যে, কেন বের করে না জানি না। এই জ্বালা, এই আরাম; এ আর সহ্য হয় না।
স্টেশনে পৌঁছে ওভারব্রিজ পেরিয়ে ওপাশের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দাঁড়ালাম। এমার্জেন্সির পর ট্রেনগুলোএমন টাইমে যাতায়াত আরম্ভ করেছে যে, প্রায়-ই মনে হয় নিজের ঘড়ি খারাপ হয়ে গেছে। কাঁটায় কাঁটায় ভোর পাঁচটা ন-মিনিটে ধুয়ো উড়িয়ে মিথিলা এক্সপ্রেস এসে ঢুকল স্টেশনে।
ফার্স্টক্লাসের সামনে জোড়হাতে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি–পবননন্দন যেমন করে রামচন্দ্রকে অভ্যর্থনা করেছিলেন, তেমন করে সাহেবের অতিথিদের আপ্যায়ন করার জন্যে।
আমার চাকরির সেকেণ্ড স্পেসিফিক অ্যাসাইনমেন্ট।
ট্রেন থেকে যাঁরা নামলেন তাঁদের চেহারা ও হাবভাব মোটেই প্রকৃতিস্থ বলে মনে হল না। একজন লম্বা-চওড়া। চাণ্ডিলের বেগুনের মতো গায়ের রং, মাথা-মোটা, হুবহু কাতলা মাছের মতো দেখতে-পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা, পায়ে শুঁড়তোলা নাগরা জুতো। সারারাত বোধ হয় পান চিবিয়েছিলেন–ঠোঁট দাঁত সব লালে লাল।
আর একজন বেঁটে-খাটো, ছিপছিপে, কালো। থুতনিতে একমুঠো ছাগলদাড়ি–তিনি পান খাননি,–কিন্তু তাঁর নীচের ঠোঁটটা এমনিতেই বুলবুলির পশ্চাৎদেশের মতো লাল।
আর একজন যিনি, তাঁকেই একমাত্র ভদ্রলোকের মতো দেখতে-কাঁধে ঝুলোনো কালো চামড়ার একটি বাক্স। সঙ্গে দু-জন মিষ্টি, নেকু নেকু মহিলা ও দু-টি বাচ্চা দেখলাম। এঁরা কার-কার স্ত্রী বুঝলাম না।
সাহেবের অতিথিদের ওভারব্রিজ পেরিয়ে প্রশেসান করে এসকর্ট করে নিয়ে যেতে লাগলাম। এঁদের সঙ্গেও লটবহর কম নয়। কাতলা মাছ ছাড়া আর দু-জনের কাঁধেই ভেড়ার ঠ্যাং-এর মতো কী একটা করে চামড়ার যন্তর ঝুলছে। কোনো বাজনা-টাজনা হবে বোধ হয়। বড়োলোকদের কারবার–আমি কতটুকু আর জানি। তবে এটুকু বুঝলাম ভদ্রলোকদের দেখেশুনে যে, চিড়িয়াখানায় আরও কিছু জন্তু, জানোয়ার তিন-চারদিনের জন্যে অতিথি হলেন।
সকলকে গাড়িতে তুলে দিলাম। লটবহর সব গাড়ির ক্যারিয়ারে, বুটে ও স্কুটার-টেম্পোতে এঁটে গেল।
স্টেশন থেকে বেরোতে বেরোতেই রোদ উঠল। সকাল থেকেই যা রোদের তাপ, কলকাতার মাখন-মাখন সুন্দরীরা যে, কী গলান গলবেন দুপুরে তা ভেবেই আনন্দ হল।
পান্ডে আগে সাহেব মেমসাহেবদের নিয়ে চলে গেল। আমি স্কুটার-টেম্পোতে সাহেবের বন্ধুর ছোটোমেয়ের হিসিকরা কাঁথার বাণ্ডিল, আধ-কামড় দেওয়া সন্দেশের বাক্স, কল লাগানো গরম কাপড়-জড়ানো রুপোর জলের বোতল এসব সামলাতে সামলাতে পাথর ছড়ানো পথে হিক্কা তুলতে তুলতে সামনের গাড়ির চাকায়-ওড়া কিলোখানেক ধুলো খেয়ে ব্রেকফাস্ট করে যখন চিড়িয়াখানায় এসে পৌঁছোলাম, তখন দেখলাম আসর জমে গেছে।
মেমসাহেব নিজে আমগাছের নীচের গোল শ্বেতপাথরের টেবিলে চা ও খাবার নিয়ে বসে অতিথিদের আপ্যায়ন করছেন।
চা, নোনতা মাঠরি, রসকদম, চকোলেট, সন্দেশ ইত্যাদি দিয়ে সাহেবের অতিথিরা ব্রেকফাস্ট করছেন।
মুখের ধুলোগুলো নামাবার জন্যে আমি বাবুর্চিখানায় গিয়ে রামকে বলে একগ্লাস চা নিয়ে তাড়াতাড়ি গিলে ফেললাম।
কাতলা মাছ ভারি ইন্টারেস্টিং বলে মনে হল। ইতিমধ্যেই গান জুড়ে দিয়েছেন তিনি। রবীন্দ্রসংগীত। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা এবং সুরের সঙ্গে সেই রবীন্দ্রসংগীতের কোনো মিল নেই। রবীন্দ্রনাথ ও দীনুঠাকুর যদি চিরদিন মেইন লাইনে গিয়ে থাকেন তো কাতলা মাছ বরাবর কর্ড লাইনে। গলার স্বরটা হাঁড়ির মধ্যে মুখ করে কথা বললে যেমন আওয়াজ হয়, অনেকটা তেমন।
ভাবলাম, চাকরি করতে হলে মানুষের কতরকম অত্যাচার-ই না সহ্য করতে হয়!
ইতিমধ্যে সেই ছাগল-দাড়ি ভদ্রলোক কাঁধের ভেড়ার ঠ্যাংটা খুলে ফেললেন।
ওমা :, বাজনা নয়; দেখি একটা বে-জোড় বন্দুক।
খুলে ফেলেই বন্দুকটা জোড়া লাগিয়ে ফেললেন–লক-স্টক ব্যারেল।
তাহলে সবগুলোই বন্দুক!
মেমসাহেব বললেন, টিকলু, এঁরা সব বিখ্যাত শিকারি। তুমি পান্ডের সঙ্গে এঁদের বিকেলে টিগরিয়া পাহাড়ের নীচে নিয়ে যাবে তিতির মারবার জন্য। পান্ডে জানে, কোথায় তিতির থাকে বিকেলে।
আমি মাথা নাড়লাম।
একটু পরেই একটি নতুন কচি-কলা-পাতা রঙা অ্যাম্বাসাডর গাড়ি এসে উপস্থিত হল।
তা থেকে ফুটফুটে তিনটি বাচ্চা ও হেমামালিনী ও সিম্মিকে একসঙ্গে ব্রাহ্মীশাক দিয়ে হাঁড়িতে সেদ্ধ করলে যেরকম সৌন্দর্য হয় তেমন-ই সুন্দরী এক মহিলা বাঁ-দিকের দরজা দিয়ে নেমে ফিক করে হাসলেন। ডান দিকে দেড়খানি গজদন্ত।
তারপরে তাঁর স্বামী নামলেন।
একটা শেতলপাটিকে গোল করে পাকিয়ে মাটিতে শুইয়ে তার ওপর দিয়ে স্টিমরোলার চালিয়ে দিলে যেমন চ্যাপটা, ফ্যাকাশে, লেন্থ-উইদাউট-ব্রেথ একটা ব্যাপার হয়, ভদ্রলোক ঠিক তেমন দেখতে। উনিও হাসলেন। হাসিটাও চ্যাপটা দেখাল। এবারে নরক গুলজার।
হঠাৎ মেমসাহেব বললেন, টিকলু, ডেয়ারি আর পোলট্রি থেকে ডিম আর দুধের রিকুইজিশন স্লিপ পাঠিয়ে ওগুলো আনিয়ে নাও। বাজারের লিস্ট আমি করে রেখেছি। পানটা লিখতে ভুলে গেছি। তুমি তিনশো পান আনবে।
ছাগল-দাড়ি আঁতকে উঠে বললেন, তিনশো পান কে খাবে?
মেমসাহেব একটু হাসলেন। বললেন, এখানে অনেক ছাগলের সমাবেশ-ভাববেন না। দেখতে দেখতে সব পান উড়ে যাবে। আমি ভালো করে পান সাজি তারপর দেখবেন পান কোথায় থাকে।
কাতলা মাছ সন্দেশ মুখে জবজবে গলায় বললেন, বাঃ বাঃ। আমি একাই আদ্ধেক খাব।
ভাবলাম বলি, রামছাগলে তাই-ই খায়।
আমি চলে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ মেমসাহেব ডেকে বললেন, শোনো আজ আমি এদের নিয়ে থাকব। তুমি ভাই আজ পাঠশালা চালাবে।
আমি মাথা নাড়লাম। আমার মুখটা কেমন দেখাল তা ওঁরাই বলতে পারতেন।
আমার কাজকর্ম শেষ হতে না হতেই, মেমসাহেব তলব করলেন। বললেন, পাোেেরা এসে গেছে, এইবার তুমি ওদের নিয়ে পড়ো।
চিড়িয়াখানা আর গ্রিনহাউসের মাঝামাঝি একটা বড়ো চাঁপাগাছের নীচে গোল সিমেন্টের বেদি। তার নীচে গোটা বারো-সাত থেকে দশ বছরের বাচ্চা ছেলে জমায়েত হয়েছে। সকলেই প্যান্ট-শার্ট পরে আছে; সব একরকম। সবুজ রঙের। বুঝলাম, মেমসাহেবের-ই দান।
সংস্কৃততে আমি পনেরো পেয়েছিলাম–স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায়। ফলে ফেল করেছিলাম। আমি হিন্দি সিনেমা দেখে হিন্দি একটু বলতে শিখেছি কিন্তু পড়তে পারি না। ছেলেগুলোর সকলের হাতেই দেখলাম হিন্দি অ আ ক খ-র বই।
ছেলেবেলা থেকে একটা সাধ ছিল যে, শান্তিনিকেতনে বাংলার অধ্যাপক হব। আম্রকুঞ্জে, এমন-ইবৈশাখী ভোরের হাওয়ায় আমি ধুতি-পাঞ্জাবি পরে, কাঁধে পাট করে চাদর ঝুলিয়ে বসব–আমার সামনে গোল হয়ে বসে থাকবে একগুচ্ছ রজনিগন্ধার মতো সুন্দরী, সুরুচিসম্পন্না যুবতীরা, আর আমি তাদের শেষের কবিতা পড়াব।
কিন্তু কী অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স! আজ সেই বৈশাখী ভোরেই আমি বসে আছি। ফুটন্ত জীবন্ত চাঁপারা নেই–বসে আছি একটা কেঠো কাঁঠালিচাঁপা গাছের নীচে–আর হাতে উলটো করে ধরা একটা হিন্দি বই।
আমি বললাম, বোলো বাচ্চে, অ।
ওরা বলল, ও।
বললাম, বোলো, আ।
ওরা বলল, ইয়া।
বুঝলাম, আমার চাকরিটা থাকবে না।
ইতিমধ্যে মেহবুবকে হন্তদন্ত হয়ে এদিকেই আসতে দেখা গেল।
মেহবুব এসে বলল, মেমসাহেব বলেছেন আপনাকে এক্ষুনি বাজার যেতে–আমিই পাঠশালা চালাব এখনকার মতো।
ছেলেগুলো ও মেহবুবের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নিঃসংশয় হয়ে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
বাজার থেকে ফিরতে বেলা হল। রামকে বাজারের জিম্মা ও মেমসাহেবকে পানের জিম্মা দিয়ে আমি চান-টান সারতে আমার কোয়ার্টারের দিকে এগোচ্ছি, এমন সময় ভজনদার সঙ্গে দেখা।
ভজনদা খুব ব্যস্তসমস্ত দেখা গেল।
বললাম, কী ব্যাপার?
-আরে, ব্যাপার আবার কী? সাহেব-মেমসাহেবের আর কী? উঠল বাই তো কটক যাই। আজ তোমাকে এবং আমাকে ওঁদের তিতির মারতে নিয়ে যেতে হবে বিকেলে। কাল পূর্ণিমার রাতে সুজানী গ্রামে সাঁওতালি নাচের বন্দোবস্ত করতে হবে। কুকরিবাগ, বদলাডি ও সুজানী তিন গ্রামে মেয়ে-মদ্দ জড়ো করতে হবে সুজানীর বড়ো অশ্বত্থ গাছতলায়। তাদের জন্যে বিস্তর মহুয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে। সেখানে নাচ-গান হবে সারারাত।
তারপর বললেন, আরে অর্ডার দিলেই তো হল না, যে ইন্তেজাম করে, সেই বোঝে কী ঝকমারি?
আমি নার্ভাস হয়ে গিয়ে বললাম, বিকেলে তিতির বেরোবে তো ভজনদা? না বেরোলে?
ভজনদা চটে উঠে বললেন, তিতির কি আমার পুষ্যি, যে, আমার কথায় উঠবে বসবে? তাদের ইচ্ছে হলে বেরোবে, ইচ্ছে না হলে বেরোবে না।
যদি না বেরোয়, তাহলে সাহেবরা কী মারবেন?
ভজনদা রেগে গিয়ে বললেন, না বেরোলে আমরাই পেছন ফিরে দাঁড়াব। আমাদের-ই মারবেন। আর কী করতে পারি?
তারপর একটু ঠাণ্ডা হয়ে বললেন, তুমি চললে কোথায়?
বললাম, স্নান করতে।
-অ্যাই দ্যাখো! এ কী তোমার কলকাতা নাকি? চান করে নেবে সকাল-সকাল, জল তখন ঠাণ্ডা থাকে। এখন চান করা-না করা সমান। একেবারে বিকেলে সাহেবদের তিতির মিতির মারিয়ে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসে সন্ধের সময় চান কোবরা। এখন চলল আমার সঙ্গে পোলট্রিতে একটু কাজ আছে–ঘুরে আসি।
কাল এসে পর্যন্ত পোলট্রিটা দেখা হয়নি। ভাবলাম, ভজনদার সঙ্গে দেখে আসি।
.
অনেক দূর হেঁটে গেলাম রোদে। হঠাৎ দূর থেকে দূরাগত অদ্ভুত একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম। আওয়াজটা একটা ঝিমধরা সম্মিলিত কাকলি। ওই গমগমে সমুদ্রের হালকা ঢেউ ভাঙার আওয়াজের মতো আওয়াজ যে, মুরগির আওয়াজ তা অনুমান করার ক্ষমতাও আমার ছিল না।
যতই এগোতে লাগলাম, ততই আওয়াজটা বাড়তে লাগল। একেবারে কাছে যেতে ভজনদা আমার কী বলছিলেন, তা শুনতে পর্যন্ত পাচ্ছিলাম না।
পোলট্রির সামনে পৌঁছে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আধুনিকতম কায়দায় লাইটরুফ এর ছাদ দেওয়া মুরগির লম্বা শেডের পর শেড। সমস্ত সাদা ধবধবে লেগ-হর্ন মুরগি। একটা শেডের কোণায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, প্রায় কোয়ার্টার মাইল লম্বা মুরগির খাঁচাগুলোর নীচে লাগানো টিনের স্লিপে ডিম গড়িয়ে আসছে আর খাকি হাফপ্যান্ট ও শার্ট পরা তিনটে লোক ক্রমান্বয়ে সেই ডিম কুড়িয়ে নিয়ে চলেছে একটা ঝুড়ির মধ্যে।
ভজনদা আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, ওরা হচ্ছে কালেক্টর।
–দিনে কত ডিম হয়?
আমি বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে শুধোলাম।
ভজনদা বললেন, এখন গরমের সময়, এখন কম পাই আমরা–তা এখনও প্রায় পনেরোশো থেকে আঠেরোশো হয়। শীতকালে আড়াই থেকে তিন হাজার।
তি-ন-হা-জা-র-? আমি নাভি থেকে শ্বাস টেনে বললাম।
ভজনদা নন-চ্যালান্টলি বললেন, ইয়েস।
হঠাৎ আমার খেয়াল হল যে, শেডের মধ্যে কেবল-ই মুরগি। মোরগ নেই একটাতেও। ব্যাপারটা আমার পশুপাখির প্রজননবিদ্যা সম্বন্ধে যেটুকু জ্ঞান ছিল, তাতে পরিষ্কার হল না। এই ম্যাজিকটা কী করে সম্ভব হচ্ছে আমার মাথায় ঢুকল না।
ভজনদাকে ভয়ে ভয়ে শুধোতেই উনি আমার দিকে বিস্ময়ের চোখে তাকালেন।
তারপরেই বললেন, ও সরি! তোমার তো বিয়ে-থা হয়নি।
তার পরমুহূর্তেই বললেন, বিয়ে না হলেই বা কী? মেয়ে-ছেলেদের যেমন শীতের সকালে দাড়ি কামাবার কষ্ট ভগবান দেননি তেমন আবার অন্য কিছু কিছু কষ্ট এবং কমপ্লিকেশান ভগবান তাদের দিয়েছেন তা জানো তো? মানে যা পুরুষদের দেননি।
অস্বস্তিতে আমার কান লাল হল।
মুরগিগুলোর দিকে অনেকক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থেকে বললেন, এই মুরগিগুলো মানুষের মেয়েদের চেয়ে অনেক স্বাধীন। এরা মোরগ ছাড়াই, অন্য কারও কোনো কষ্টকর ও ক্লান্তিকর সহযোগিতা ছাড়াই অবলীলায় মা হয়ে যায়। শশীকলা যেমন আকাশে ক্যালেণ্ডারের তারিখ মতো বৃদ্ধি পায়, এরাও তেমনি ক্যালেণ্ডারের তারিখমতো ডিম দিয়ে যায় সাহেবকে। সব-ই সাহেবের কপাল!
তারপর হঠাৎ বলে উঠলেন ভজনদা, ব্যাপারটা কী ইন-হিউম্যান ভেবে দ্যাখো! এরা জীবনের একটা কী ভাইটাল আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাহেবকে ডিম জোগানোর জন্য। মাঝে মাঝে যখন আমার সাহেবের ওপর রাগ হয়, তখন আমার খুব বিদ্রোহ করতে ইচ্ছে হয়।
আমি বললাম, কলকাতার কিড স্ট্রিটে একটা অর্গানাইজেশন আছে, তার নাম অ্যানিমাল লাভারস সোসাইটি। তাদের একটা বার্ড লাভিং উইং খুলতে বলে আপনার কেসটা সেখানে পুট-আপ করে দিলে মন্দ হয় না!
ভজনদা অবাক হয়ে বললেন, আছে নাকি? সত্যি!
তারপর ভজনদা পোলট্রির যিনি ইনচার্জ সাহেবের পার্টনার–মল্লিকবাবু তাঁর সঙ্গে কীসব কাজের কথাবার্তা বলার পর দূরে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, ওই যে দেখছ ওই শেডটা–ওইখানে এগলেয়িং বার্ডস নয়, টেবল-বার্ডস ডেভেলাপ করা হয়।
মানে? আমি শুধোলাম।
–মানে, খাওয়ার মুরগি। মুরগির বেলায় মানুষের মেয়েদের নিয়ম খাটে না। এখানে যে রাঁধে, সে রাঁধেই; যে চুল বাঁধে সে তাই-ই বাঁধে। বুজেছো?
-বুঝলাম।
আমি বললাম।
একটা লোক ডিম কুড়োচ্ছিল এবং অন্য একটা লোক বালতি করে গুঁড়ো গুঁড়ো কী যেন খাবার এনে মগে করে করে সব ছোটো ছোটো খোপে দিচ্ছিল।
আমি শুধোলাম, এগুলো ওরা কী খাচ্ছে ভজনদা?
ভজনদা বললেন, একে বলে চিকেন-ফিড। আমরা এখানেই তৈরি করি।
-কী দিয়ে তৈরি করেন?
-আরে আমি কী ছাই করি! এসব মল্লিক সাহেবের কাজ। পন্ডিত লোক-মুরগি সম্বন্ধে স্বয়ং ব্রহ্মার চেয়েও বেশি জ্ঞান রাখেন।
বললাম, কী দিয়ে চিকেন-ফিড বানানো হয়, একেবারেই জানেন না?
একটু একটু জানি। ভজনদা বললেন।
বললাম, সেই একটু একটুই বলুন শুনি।
ভজনদা বললেন, ভুট্টার গুঁড়ো, গমের গুঁড়ো, অয়েল রাইস ব্র্যান, বাদাম খোল, ফিশ মিল অর্থাৎ মাছের গুঁড়ো, অস্টার-শেল ক্রাশ, মানে শামুকের খোলের গুঁড়ো, ভিটামিন রুবি মিক্স, পোলট্রি মিনারাল সল্ট এইসব মিলিয়ে-টিলিয়ে চিকেন-ফিড তৈরি হয় আর কী।
আমি বললাম, এ তো এলাহি কান্ড।
ভজনদা বললেন, চার হাজার মুরগি পোষা এবং দিনে আড়াই হাজার ডিম পয়দা করা এবং তার থেকে ফায়দা করাও তো এলাহি কান্ড। আমার সাহেব নিজে যেমন সাড়ে ছ-ফুটি, সাহেবের কান্ড-মান্ডও সব এলাহি।
তারপর ভজনদা পোলট্রির পাশে একটা ছোট্ট পাকা দোতলা বাড়িতে নিয়ে এলেন। এই বাড়িতে পৌঁছোবার আগেই চিউ চিউ শব্দ শুনতে পেলাম।
আমি অবাক হয়ে বললাম, এখানে কী?
ভজনদা বললেন, এখানে সব ডে-ওল্ড চিকস রাখা আছে। মুম্বাই আরবার-এফারস ফার্মের মতো সাহেবেরও ইচ্ছে লেগহর্নের ডে-ওল্ডের চিকের ব্যাবসা করার।
দেখলাম একটা কালো অ্যালসেশিয়ান কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়িটাতে।
আমি শুধোলাম, কুকুরে মুরগির বাচ্চা খেয়ে ফেলে না?
ভজনদা বললেন, এর নাম কী জানো? এর নাম রেখেছেন সাহেব, বিবেক। যাত্রা দেখেছ কখনো? আধুনিক যাত্রা নয়, পুরোনো যাত্রা। যাত্রা-দলে একজন করে বিবেক থাকত। সে মাঝে মাঝেই এসে একটা করে গান গেয়ে নায়ক-নায়িকার বিবেক জাগিয়ে দিয়ে চলে যেত। বিবেক-ই তো এই ডে-ওল্ড চিকসদের শেয়াল, ভাম, সাপ এদের হাত থেকে রক্ষা করে। রক্ষক কখনো ভক্ষক হয়? হয় হয়তো। কিন্তু হওয়া অনুচিত।
একটা বছর বারো-তেরোর সুন্দর ছেলে উলের ব্যাডমিন্টন বলের মতো গোল গাল হলুদ হলুদ বাচ্চাগুলোর দেখাশোনা করছিল। খাবার ও জল দিচ্ছিল।
সে ভজনদাকে আতঙ্কিত গলায় বলল, বাবু হিঁয়া বড়কা বড়কা বহত চুঁহা আয়া হ্যায়।
ভজনদা বললেন, বলিস কীরে? মল্লিক সাহেবকে খবর দিয়েছিস?
তারপর বললেন, আহা! খুব চিন্তার কথা। আমিও এক্ষুনি খবর দিচ্ছি।
তারপর তার দিকে ফিরে হঠাৎ বললেন, আরে ও ছোটুয়া, মুরগির বাচ্চা যদি বড়কা বড়কা ছুঁচোয় খেয়ে যায় তাহলে সাহেবের কিছু ক্ষতি হবে–কিন্তু মুরগি আবারও ডিম পাড়বে, ডিম ফুটে আবারও বাচ্চা হবে। কিন্তু তুই তো রাতে এখানেই শুয়ে থাকিস; খুব সাবধানে থাকিস।
ছোটুয়া অবাক হয়ে বলল, কাহে বাবু?
আমিও ভজনদার কথা শুনে অবাক হলাম। ছুঁচোয় তো আর মানুষ খাবে না। মুরগির বাচ্চা খেলেও খেতে পারে।
আমিই ভজনদাকে শুধোলাম, একথা কেন বলছেন?
ভজনদা বললেন, তুমি একেবারে বালখিল্য।
কেন? আমি বোকার মতো শুধোলাম।
ভজনদা গম্ভীর চিন্তান্বিত মুখে বললেন, ছুঁচোয় মানুষের শরীরের সবচেয়ে নরম জায়গা
ছোটুয়া আতঙ্কিত গলায় বলল, হামারা নাক খা লেগা?
ভজনবাবু বললেন, আরে হতভাগা! নাক গেলে না হয় সাহেব প্লাস্টিক-সার্জারি করে তোর নাক গজিয়ে দেবেন। নাকের চেয়েও নরম জায়গা কি পুরুষের শরীরে নেই? হতভাগা! সে জায়গা খেয়ে গেলে গেল–চিরদিনের মতোই গেল। পৃথিবীর কোনো দোকানেই স্পেয়ার পার্টস পাওয়া যাবে না।
ছোটুয়া কথাটার তাৎপর্য ভালো করে হৃদয়ংগম করার আগেই ভজনদা আমার দিকে ফিরে বললেন, টিংকু, তুমিও সাবধানে থেকো–বড়োই চিন্তার বিষয়।
ছোটুয়া অত্যন্ত উত্তেজিত ও বিচলিত হয়ে শুধোল, তব বাবু ম্যায় কা করে?
ভজনদা একটু ভেবেই বললেন, তারের জাল দিয়ে একটা জাঙিয়া বানিয়ে নে। আমাকে বললেন, তুমিও একটা বানিয়ে নিয়ে। তারপর-ই আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা থেকে উত্তিষ্ঠিত হওয়ার আগেই বললেন, চলো চলো, অনেক বেলা হল। এবার যাওয়া যাক। তুমি তো আবার সাহেবদের খাওয়া-দাওয়ার দেখাশোনা করবে।