ঝরে না যাক কুঁড়ি
“এই তোর বাড়ি কোথায় রে”…এক্সেলেটর থেকে নামা ভবঘুরে ছোট্ট দুটো ছেলেকে লোকটা এক ধমক দিতেই আমার নজর পড়লো। ট্রেন মিস করে মনখারাপ করে বসে থাকা আমি হয়তো নতুন কোনো গল্পের প্লট পেতে চলেছি ভেবেই সজাগ হলাম। দেখলাম চপ মুড়ির ঠোঙা থেকে হাত ভরে খেতে খেতে একটি ছেলে বিপদ বুঝে দৌড়ে পালাতে যাচ্ছিল,খপ করে ধরে ফেললো লোকটা। অন্যছেলেটি রীতিমতো কাঁচু মাঁচু হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। ওর শরীরের ভাষা যেন বলতে চাইছে” বড্ড ভুল হয়ে গেছে কাকু,ছেড়ে দাও আমাদের”।
আরে এ লোকটা ঝাল মুড়ি বিক্রি করছিল না পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মে! ঠিক চিনতে পেরেছি ভেবে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলাম, ছেলে দুটি কি তবে পয়সা না দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল! আমি উঠে পায়ে পায়ে একটু এগিয়ে যেতে হকারটি বললো, “দেখেছেন কান্ড, সরকার কিনা পড়াশোনা, কাজ শেখানোর জন্য কত প্রকল্প আয়োজন করছে আর এরা ঝাঁকে ঝাঁকে একটু বাড়িতে রাগারাগি হলো তো বেরিয়ে পড়ছে অজানার সন্ধানে”।
নোংরা জামা, ময়লা চপ্পল পড়ে দুটি কম বয়সী অচেনা ছেলেকে বুঝলাম সকাল থেকে স্টেশন চত্ত্বরে ঘুরতে দেখে অভিভাবকের মতো বাড়ি ফিরতে ধমক দিচ্ছে ঝালমুড়ি বিক্রেতা।
“এই বাড়ি কোথায় তোদের বল,যা বাড়ি যা, আর এখানে ঘুরতে দেখলেই পুলিশকে খবর দেবো”। আশ্বস্ত হলাম হকারটির মানবিক স্বত্তা দেখে। স্রোতের মতো কত অভাবী বাচ্চাছেলে স্টেশনে এসে কিছু উপার্জনের আশায় রাত কাটায়,জন্ম হয় রক্ত বীজের মতো একটা সমাজ বিরোধী থেকে অসংখ্য সমাজ বিরোধীর।
আর একটা দিন ট্রেনে খুব খিদে পেয়েছে, ট্রেনও প্রায় চল্লিশ মিনিট মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে।এদিক ওদিক তাকিয়ে কোনো হকারের সন্ধান করতেই দেখি ওই ঝালমুড়ি বিক্রেতা হাঁক দিচ্ছে। খুব খুশি হয়ে বললাম, “আরে দাদা তুমি,ভালো আছো তো”?অর্ডার দিয়ে ওকে প্রশ্ন করলাম,” হ্যাঁ গো সেই ছেলে দুটোকে স্টেশনে ঘুরতে দেখেছিলে নাকি আর কখনো?না উত্তর দিয়ে যেটা বললো শুনে মন খুব খারাপ হয়ে গেলো আমার।দুবার ঝালমুড়ি ঝালমুড়ি হাঁক দিয়ে আস্তে আস্তে আমায় বললেন,”ঠিক এমন করেই আমি আমার বাবাই কে হারিয়েছি”। মানে?বিস্ফারিত চোখে তাকাতেই দেখি সন্তান হারা বাবা চোখের জল মুছে বললো, “একদিন বাড়ি ফিরে খুব বকাঝকা করেছিলাম সারাদিন বাজে ছেলেদের সঙ্গ দেয় বলে। ঘুম ভাঙতেই দেখি মা মরা ব্যাটা আমার ঘর ছেড়ে পালিয়েছে।কত খুঁজেও আর পাই নি।তাই এমন কোনো নতুন বাচ্চা ছেলে স্টেশনে এসে উদভ্রান্তের ঘুরে বেড়ালেই বুঝতে পেরে ধমক দিয়ে বাড়ি ফেরাই”।