ঝড়ের খেয়া (Jhorer Kheya) : 21
আজ আবার ঝড় উঠেছে। বিলম্বিত কালবৈশাখী। রাস্তা ধুলোয় ধুলোয় অন্ধকার। আকাশ লাল। গাছপালা ভীষণ দুলছে। ট্রাফিকে আটকে বসে সে দেখছে। ডান দিকে ধবধবে গ্র্যান্ড হোটেল। আরও কিছু গ্র্যান্ড দোকান পার্ক স্ট্রিট পর্যন্ত। বাঁ দিকে অক্টারলনি শহিদ মিনার, তার দর্শনে যা ক্রমাগত লম্বা তালগাছের মতো নুইছে। রাস্তা জুড়ে যতদূর চোখ যায় গাড়ি গাড়ি গাড়ি মিনিবাস মোটরসাইকেল স্কুটার… সব আটকে রয়েছে। তবু জঙ্গমতা ওদের শরীরে থমকে, যেন উড়ব-উড়ব পাখির মতো। সমস্তটা একটা উধাও স্রোত, ঠিক ভ্লামিংকের ছবির মতো। বাঁ দিকে ধু ধু ময়দান। বৃষ্টি নামছে। ধুন্ধুমার বৃষ্টি। এদিক থেকে ওদিক উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে কলকাতা। খুব গরমের পর মাঠে মাঠে ডানা ভাসাবার গভীর আহ্লাদে ভরা বৃষ্টি। অনেক চেষ্টা করলেও ছাতা-ছাতা-ছাতা রেনোয়া ছবির মাঝখান থেকে বিপুল পরিসর, সমুদ্রসমান আকাশ আর একটি ছোট্ট প্রাণীর নিশ্চিন্ত নীরব অবিচল বৃষ্টিস্নান দেখা যায় না। ওই ছবি বুঝি জীবনে একবারই দেখা যায়। কিংবা বুঝি একযুগে। কেননা বিষয়, দ্রষ্টা আর প্রেক্ষিত এই সবক’টা শর্ত ক’বারই বা মেলে? জীবনানন্দের কবিতা, নন্দলালের ছবি আর ক’বারই বা ঘটে?
তনিকা স্কলারশিপ পেয়ে গেছে ল্যুভ-এর আর্ট-স্কুলে। স্বপ্ন দেখেছিল, সত্যি হবে ভাবেনি। শৌনক ভিভিয়ান কাজ করছে আঁদ্রের সালঁয়। তবে শোনা যাচ্ছে শিগগিরই ফিরে আসছে। তার জীবনে মায়ের টান শিল্পের টানের থেকে অনেক বেশি। মাস ছয়েকের মতো নাকি একসঙ্গে ছিল ওরা— তনিকা আর শৌনক। তারপর পথ বেঁকে গেছে দু’জনের দু’দিকে। কেউই অবশ্য কিছু বলেনি তাকে। সংবাদদাতা—মনীষা। তনিকা প্যারিস-মুগ্ধ কান্ট্রি-সাইড মুগ্ধ চিঠি লেখে। রোদ্যাঁ মিউজিয়াম, পিকাসো মিউজিয়াম, মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট, সুড়ঙ্গ পথে আলোকিত বৈভব, পোস্টার, বিখ্যাত শিল্পীদের মাস্টারপিস দিয়ে সাজানো, ঐতিহাসিক সেতু পোঁ আলেকসান্দ্রা, আলোয় ঝলমল সাঁজেলিজে, প্লাস দ্য লা কঁকর্দ, বৃক্ষচ্ছায়া? মনোরম বুলেভারের পর বুলেভার। আর্ক দ্য ত্রিঁয়োঁফ থেকে প্রশস্ত অ্যাভিনিউ, প্লাস ভাঁদোম। নোৎরাদামের স্থাপত্য, মাইয়লের ভাস্কর্য… পড়তে পড়তে মনে হয় সে ফিরে গেছে তার পঁচিশ বছর বয়সে। যেন কেউ তখনকার লেখা তার এক রোজনামচার বই পর্বে পর্বে পাঠাচ্ছে তার কাছে।
শৌনক ই-মেলে ব্যাকুল শ্রদ্ধা জানায়। তার লেখা ছত্রগুলোর তলে তলে অব্যক্ত কিছু খুঁজে পায় অদিতি, অস্পষ্ট একটা শিহরন, শুধু শ্রদ্ধা নয়, শুধু আনুগত্য নয়, প্রেম কি? না, তা-ও বুঝি নয় সবটা। ব্যাখ্যার অতীত কোনও জটিল অনুভূতি অদিতি যার পরিচয় জানে না, কিন্তু মেল সামনে ধরে সে বসে থাকে মন কেমন করা এক গোপন বসন্তের বাতাস-লাগা প্রত্যূষ গোধূলিতে, আমূল মুকুলিত, কিন্তু বিষণ্ণ। শৌনক তুই ভাল থাকিস। ব্যাখ্যা হয় না এমন কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়িস না। যদি পড়িসও তো শিল্পে তার স্বাক্ষর রেখে যা। ভাল থাকিস শৌনক।
গত মাসে মাধুরী মারা গেলেন। চমৎকার ছিলেন। রাতে একটু খই-দুধ আর নরমপাকের ছানার মিষ্টি খেলেন। তারপর অদিতিকে ডাক পাঠালেন। সে তো যেতই আর একটু পরে, শুভরাত্রি জানাতে, কিন্তু উনি ডাকলেন।
বললেন— তোমাকে একটা গোয়েন্দাগিরি করতে বলেছিলাম, মনে আছে বউমা?
—হ্যাঁ মা, অদিতি একটু ইতস্তত করে বলল— এমন সব ঘটনায় জড়িয়ে পড়লাম যে…।
—আমার সে অনুরোধ আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি মা। যা মৃত তাকে মৃত থাকতে দেওয়াই ভাল। কোনও দুঃখ আমার আর নেই।
অদিতির হাত জড়িয়ে ধরে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে পড়লেন উনি। এখানে থাকতে থাকতে কিছুটা যেন চিকন হয়েছেন। সামান্য একটু মাস লেগেছে শরীরে। মুখের রেখাগুলো তেমন তীক্ষ্ণ নেই আর। এখন ওঁর পোর্ট্রেট করলে সেটা হবে একটা অন্য পোর্ট্রেট, হয়তো আগের ছবিটার উত্তরসূরি বলে তাকে চেনাই যাবে না।
ক’দিন পর ভোরবেলায় শীলাদি এসে জানাল উনি ঘুমের মধ্যেই চলে গেছেন। তখনও গা গরম। রাজর্ষি তড়িঘড়ি এসেছিল মৃত মুখে আগুন দিতে, নির্ভুল চরিত্ৰজ্ঞানে ঠিক যেমনটি উনি বলেছিলেন। কাজকর্ম করে চলে গেছে।
যাবার সময়ে অদিতিকে বলে গেল— তুমি বোধহয় জানো না বনি, এই সময়টা আমার কেমন কেটেছে, সুজান চলে গেছে, একটা বাচ্চা হয়েছিল, ছেলে। রোনাল্ড গৌতমকে নিয়ে চলে গেছে। আমার জীবনটা… শুকনো… আই টেরিব্লি মিস দ্যাট চাইল্ড।
অন্য কোনও মন কেমনের কথা বলবে বলে সে দাঁড়িয়েছিল, অদিতি তাকে সাহায্য করতে পারেনি।
নীল ফাইলটা খুলে দেখা গেল সেটা মাধুরী গুপ্তর উইল। তাঁর স্বামী সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিঃশর্তে স্ত্রীকে দিয়ে গিয়েছিলেন। মাধুরী দেবী বাড়ি ও সংলগ্ন বাগান দিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয় কোনও মিউজিয়ামকে। গহনাও সব তাদেরই। একটি হিরের লকেট একজোড়া টপ অদিতির। আর সমস্ত সম্পত্তির ট্রাস্টি অদিতি ও সুবোধ ডাক্তারবাবু। শীলাবতী আজীবন সুদ ভোগ করবে। তার জীবনান্তে টাকাটা পুরোই চলে যাবে ওই মিউজিয়ামের রক্ষণাবেক্ষণে।
লাইট হলুদ হচ্ছে। স্টার্ট দিল। ধারালো বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে পথ কেটে কেটে এগোনো। ভিজে কাক হচ্ছে রাস্তার বাচ্চারা। পলিথিন ঘোমটা মাথায় দিয়ে রাস্তা পার হয়ে গেল মজুর শ্রেণীর কিছু লোক। কলুটোলার ফুটপাথে সেই ঝুপড়িটা কেন নেই কে জানে! চা ছাঁকছে না কোনও প্রৌঢ়া। ফলওলারা অনেক আগেই নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে।
পৌঁছোতে পৌঁছোতে সন্ধে। গোড়ালি জলে ছপছপ করতে করতে বাড়ি। শীলাদি দরজা খুলে দিল— মিটিমিটি হাসছে। ভেতরে গিয়ে দেখে তার গোলাপি বাথরোবটা পরে ড্রায়ারে চুল শুকোচ্ছে অনোহিতা।
—উহ দিদি, যা ভিজেছি না! নিংড়োলে একটা নদী হয়ে যাবে। খুশির হাসি। বৃষ্টিতে ভেজার ছেলেমানুষি উত্তেজনা চলকে পড়ছে হাসি থেকে। ভঙ্গি থেকে।
একটা হাঁচি এল— হ্যাঁচ্চো!
—কী রে। ঠান্ডা লাগালি নাকি, অনোহিতা!
—ওহ্, ফ্যানটাস্টিক দিদি!
—কী!
—এই তোমার মুখে অলওয়েজ অনোহিতা, মিমি বলো না কেন আমাকে? …কী মনে হয় জানো? আমি যেন আমি নই, অন্য কেউ, আমার চেয়ে অনেক বড়, অনেক ভাল কাউকে ডাকছ… কেন দিদি?
—কী জানি… অন্যমনস্ক হয়ে গেল অদিতি। —মিমিটা আদরের… শিয়োর… অনোহিতাটা… কী জানি বোধহয় এক ধরনের অ্যাডোরেশন…
—সত্যি? দিদি?
—শিয়োর। তবে তোর চোখ লাল। নির্ঘাত ঠান্ডা লাগিয়েছিস…।
—ধুৎ, এইটুকুতে ঠান্ডা লাগে? চমৎকার এক কাপ কফি খাওয়াল শীলাদি। কোত্থেকে আনাও গো কফিটা? দারুণ!
—ওটা কফি-বিন্স্ থেকে। আঁদ্রে দিয়ে গিয়েছিল। আর একটা পার্কোলেটর। তো আরেক কাপ হয়ে যাক! আমি অবশ্য ঠিক নদী-নদী ভিজিনি! তবু হয়ে যাক!
এক লাফে অদিতির সোফায় ঝাঁপিয়ে তার গালে গাল রাখল অনোহিতা।
—তোমাকে এমন খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে কেন বলো তো?
—খেয়ে ফেলবি কী রে? আমার লাগবে না?
—মানে… তোমাকে আমার ভেতরে ঢুকিয়ে নিতে ইচ্ছে করে। সব সময়ে থাকবে আমার সঙ্গে। এনিওয়ে তোমার কাছে ঘেঁষে বসে যদি এমনি কাঁধে মাথা রেখে থাকি! —ন্যাকা, ন্যাকা লাগবে না তো!
—তা তো একটু লাগবেই। অদিতি হেসে বলল,— তৃতীয় ব্যক্তি দেখলে।
—লেট দা তৃতীয় ব্যক্তি গো টু হেল!
অনেকক্ষণ ওর মাথাটা তার কাঁধে রইল।
অদিতি পোশাক পালটে এল। শীলাদির কফি এসে গেছে। চুমুক দিয়ে সে বলল— অনেকদিন আসিসনি কিন্তু।
—কী করে আসব? শ্রীমান বাবা যে সন্ধে সন্ধে ফিরবেন। একটু মিমি— জাস্ট একটু… দু’ পেগ… তা তাঁর জন্যে সব ব্যবস্থা করে রাখো। কবে তাঁর রাম লক্ষ্মণ কবে আবার তাঁর উইশ কী! আবার ককটেলেরও ফরমাশ হতে পারে। তার অরেঞ্জ জুস, টোম্যাটো জুস, উর্স্টার সস, টোব্যাসকো সস্…।
—তা তুইও কম্প্যানি দিচ্ছিস নাকি?
—একটু, জাস্ট একটু, নইলে শ্রীমান বোর্ড্ হবেন।
—দেখিস, আবার না নেশা ধরে যায়!
—পাগল! তুমি জানো না হেন লিকর নেই যা আমি খাইনি। কোনওদিন ভাল লাগেনি। তবু জেদ করে খেয়েছি। আমার এসবে কিচ্ছু হয় না। এনিওয়ে দুটো জমজমাট খবর আছে।
—কী?
—এক নম্বর আমি একটা বাংলা মিউজিক চ্যানেলে অ্যাঙ্কর সিলেক্টেড হয়েছি। পরের মাস থেকে জয়েন করছি। আর দু’নম্বর আঁদ্রেদা আমাকে একটা জরুরি ই-মেল করে তোমাকে একটা কথা জানাতে বলেছে।
—তোকে? কেন? হঠাৎ?
—টপ সিক্রেট। লাস্ট মোমেন্টে জানাতে বলেছে।
—তার মানে আসছে? না? কবে?
—কালই। তিনমাস থাকবে তোমার কাছে, অন কন্ডিশন তুমি থাকবে পরের তিন মাস প্যারিসে, জিফ-সুর-ইভেৎ-এ।
—তোর বাবা বুঝি বাইরে?
—হ্যাঁ। আবার লন্ডন! আজ আমি তোমার কাছে থাকি, হ্যাঁ?
—মানে? এই বৃষ্টিতে যাবি কোথায়? শাড়ি বার করে দিচ্ছি, পর। ব্লাউজটা ঢিলে হবে। শাড়ি দিয়ে ঢেকে নিবি, ওভাবে পরা ফ্যাশনেব্ল্ নয়, আই নো।
—ছাড়ো তো! তোমার খিচুড়ি চলে? তা হলে আজ আমি রাঁধব।
অদিতি স্মৃতিবিধুর হাসি হেসে বলল—চলে!