ঝড়ের খেয়া (Jhorer Kheya) : 12
উইলিয়ামসদের বাড়ির মেজানিনে বসে আকাশের দিকে অব্যক্ত চোখে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটি। ভাইট্যাল স্ট্যাটিসটিকস নিয়ে মনে হয় তার কোনও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু চুল আর গাত্রত্বক নিয়ে একটু আছে মনে হয়। ছোট্টখাট্টো, পাঁচ ফুট বড় জোর। মাথার প্রচুর চুল শ্যাম্পু করা, মাথায় তোয়ালে বাঁধা। মুখে বোধহয় একটা কোনও প্যাক লাগিয়েছে।
মিমিকে নিয়ে ক’দিন যা গেল! কবে যে মেসো আসবেন। ইতিমধ্যে পাগলটাকে ধরে রাখতে পারলে হয়। আপাতত এত অপুষ্টিতে ভুগছে, শরীর এত দুর্বল, হাঁউ হাঁউ করে খাচ্ছে খালি। তার ওপর তনিকা ওকে বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে বলেছে—মিমি তোর চেহারা এত খারাপ হয়ে গেছে। ডোন্ট মাইন্ড, তোকে একটা ভিখিরির মতো দেখাচ্ছে।
সে তো দমবার মেয়ে নয়, বলল—বেগার মেড? তাদের স্কুল পাঠ্য ছিল টেনিসনের এই ন্যাকা ন্যাকা কবিতাটা। ভিখারিনি এসে দাঁড়াল, তার রূপে রাজসভা আলো হয়ে গেল। রাজা তাকে নিয়ে গিয়ে সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন।
—রাজা মানে কতকগুলো গ্ল্যামারাইজড লোচচা। সুন্দরী মেয়ে দেখলেই লাল ঝরবে, সিংহাসনে বসাল না আরও কিছু—কোলে বসিয়েছিল বোধহয়। ভিক্টোরীয়গুলো আবার কোলটোল শব্দ উচ্চারণ করতে লজ্জা পেত।
—না, না বেগার মেড নয় রে একেবারে কলকাতার রাস্তার ধারে, ফ্লাই-ওভারের তলার ভিখিরি। সত্যি কথা বলতে কী মেয়ে না ছেলে তা-ও বোঝা যাচ্ছে না।
—ইয়ারকি?
—সত্যি। আয়না দ্যাখ! নিজেই দ্যাখ না!
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, চোখ টেনে টেনে, গালের চামড়া টেনে টেনে দেখল।
—কী কালি! খসখসে কালো লাগছে।
—খসখসে নয়, বলে খসকা। খসকা কালো, ভুসকো কালো!
—কী হবে? আমি কি লুম্পেন হয়ে গেলাম?
—তুই কিছুদিন বিশ্রাম নে। একদম এই দারুণ গ্রীষ্মের রোদ গায়ে লাগাবি না। কিপ ইনডোর্স। ভাল করে খাওয়াদাওয়া কর। শরীরের যত্ন নে, আর মিমি, মনেরও। মনটাকে কন্ট্রোলে রাখতে হবে। যা তা ভাবলি, মুখে যা এল বলে দিলি এতে করে মুখে একটা সাতবাড়ি ঠিকে কাজ করা ঝি-ঝি ভাব এসে যায়।
এইভাবে ওকে মোটিভেট করে সে চলে এসেছে। কারও বাড়িতে থাকতে তার ভাল লাগে না। মিমির বাড়িতে তো আরওই নয়। ওদের বাড়ির একটা গন্ধ আছে, দুঃখের গন্ধ, উচ্ছৃঙ্খলতার গন্ধ, হয়তো বা বিকৃতির গন্ধও। বাড়িটা যখন প্রথম হয়েছিল চারপাশে বোধহয় তেমন বাড়িঘর হয়নি। এখন হয়ে গেছে। বিরাট বিরাট ঘর কেমন অন্ধকার অন্ধকার, সাজসজ্জা সেই কোন কালের, আন্টিমাসি কিছু বদলাতে গেলেই মিমি তুলকালাম করে, মেসো বলেন—থাক না থাক, ও যখন চাইছে না। ওর ভাল লাগছে না বলে বাড়ি রং করা হবে না, সোফার কভার, পরদা, নতুন অন্য রঙের করা চলবে না, এইগুলোতে নাকি ওর মায়ের চিহ্ন আছে, ছোঁয়া আছে। শুনলে হাসি পায়। আর সেইসব আদ্যিকালের অন্ধকার অন্ধকার জিনিসের দরুন বাড়িটা কেমন মনমেজাজ দমিয়ে দেয়। মিমি নিজেই সহ্য করতে পারে না। পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। বলে—দূর! এখনও ওখানে ওষুধ আর অ্যান্টিসেপ্টিকের গন্ধ ঝুলে আছে।
তার ঘরে সে সাদার ওপর কমলালেবু ফুটকি ফুটকি মিকি ডোনাল্ড মেশানো পরদা টাঙিয়েছে। মেঝের ওপর বিছিয়ে রাখে রঙিন চৌকানা দরি। তার সিঙ্গল খাটে, খাটটা বেশ বড়ই, একদিন-দু’দিন মিমিকে নিয়ে শোয়াই যায়, কিন্তু তার বেশিদিন শুতে হলে তার অসুবিধে হবে। খাটটার ওপর সে একটা চৌখুপি টুকরো টুকরো কাপড়ের খুব সুন্দর কাঁথা বিছিয়ে রাখে। তলায় ধবধবে চাদর। দুটো তিনটে পাতলা রঙিন কুশন। দেওয়ালে একটা ক্যালেন্ডার আছে, এক একটা ক্ল্যাসিকাল ড্যান্স নিয়ে এক একটা পাতা। তার নিজের আঁকা জল রং আছে একটা দু-ফুট দু’ ইঞ্চি বাই এক ফুট।
সেবার কলেজ থেকে নিমডি বলে একটা জায়গায় গিয়েছিল তারা। আদ্রা-চক্রধরপুরে রাত দশটায়। ভাঙাট পাহাড়। পেছনে দূরে দলমা রেঞ্জ। তখন বেশ গরম বসন্ত। পলাশ আর কুসুম দেখে নেশা লেগে যায়। এত অপূর্ব পলাশ সে শান্তিনিকেতনেও দেখেনি। দেখবেই বা কী করে? দোলের বেশ আগে থেকে ওরা সমস্ত পলাশ মুড়িয়ে তুলে নিয়ে যায়, ফ্রিজে রেখে দেয় বসন্তোৎসবে পরবে বলে। এখানকার পলাশে কেউ হাত দেয় না। উদ্যত অঞ্জলির মতো পুষ্পবান স্বাস্থ্যবান দীর্ঘ পলাশবৃক্ষরা দাঁড়িয়ে থাকে। তার সঙ্গে থাকে কুসুম গাছের লাল, সমস্ত পাতা লাল হয়ে যায়। ওরে বাবা, সে এক মোহগ্রস্ত দৃশ্য। গাছগুলো, দলমা, ধু ধু মাঠ, সরু কপিলা নদী, উঁচু-নিচু পথ সব যেন লাল স্বপ্নে বিভোর হয়ে রয়েছে। সেটাই সে জল রঙে এঁকেছিল হ্যান্ডমেড পেপারের ওপর। অনেক কিছুই জানত না তখন। ছবিটা একটু যেন ফেড করে গেছে। কিন্তু এ ছবিটা তার বিশেষ প্রিয়। কেন? ওই দৃশ্য, ওইসব দিন মনে পড়ে। রুদ্রাংশু মানে রুদ্রাংশুদার সঙ্গে ওখানেই খুব ঘনিষ্ঠতা হয়ে গিয়েছিল। সন্ধে থেকে তাদের বেড়ানো আর যেখানে-সেখানে বসে পড়া শুরু হত। এক এক দিন মাঝরাত শেষ হয়ে ভোরে খুব ভোরে শুকতারার সঙ্গে সঙ্গে মুচকুন্দ চাঁপা ফুটতে দেখত। কী সুবাস! মৃদু কিন্তু মাতাল করা। তখন অনিবার্যভাবেই সে রুদ্রাংশুর খুব কাছে চলে গিয়েছিল, সারা রাত কত কথা! এর কোলে ওর মাথা, ওর মাথা এর কোলে। একদিন এই ভাস্কর চক্রবর্তী দেখে ফেলেছিলেন। বাস! কী দুর্নাম, কী দুর্নাম, তনিকা একটা বখে-যাওয়া ক্যারেকটারলেস মেয়ে। রুদ্রাংশু তখন ঝুমুর শিল্পীদের নিয়ে একটা সিরিজ আঁকছিল। ভাস্কর চক্রবর্তী বলেছিলেন—তুমি যে এমন ওম্যানাইজার-টাইপ তা তো জানতুম না। তোমাকে তো ওইসব জায়গায় ছাড়া যাবে না। বলেছিলেন এই ভাস্কর চক্রবর্তী। এই লোকটাই। রুদ্রাংশু কেমন ঘাবড়ে গেল। তার কিন্তু ভয়ডর ছিল না। সে একদিন এক বোঝা কলার বাসনা না কী বলে টানতে টানতে ওদের থাকবার জায়গায় ঢুকল, একটা বড় চত্বর সেটা। কত গাছ, কত—এখানে-ওখানে মাটির ঘর, খড়ের চালা। একটা আশ্রম। লোকাল মাহাতোরা ওখানে হাতের কাজ শিখতে আসত। সব্বাই বললে—কী নোংরা, কী উদঘুটে বিদঘুটে! কী করবি এটা দিয়ে? স্টিল লাইফ আঁকব। এক বোঝা কলার বাসনা, পাখির বাসা পড়ে আছে পাশে, একটা লাল প্লাস্টিকের মগ মুচকুন্দ চাঁপার তলায়। কেন তোদের গোল টেবিলের ওপর চিনেমাটির ফুলদানে সূর্যমুখী ফুল আর অ্যাশট্রের ওপর সিগারেট ছাড়া স্টিল লাইফ হয় না! অ্যাক্রিলিকে করেছিল ওটা ক্যানভাসে। কী সাংঘাতিক যে হয়েছিল! কলা বাসনার এলোমেলো বোঝার মাঝে মাঝে শেড, কী রকম গামছার বুনটের মতো ধারগুলো। বাঁধনটার মোটা গিঁট, পাখির বাসাটা যেন বাসনাগুলোর পাশে গুনগুন করে কাঁদছে, আর লাল মগটার অট্টহাসি।
পীযূষ তো দেখে মুগ্ধ—নাঃ তোর হবে তনিকা, হবে।
—নতুন কথা কী বললি? তনিকা আধখানা মুখ তুলে বলেছিল।
রুদ্রাংশু বলল—কী জানিস তনিকা তোর কোনও ইনহিবিশান নেই।
কী বলতে চেয়েছিল রুদ্রাংশু, সে আলাদা করে জিজ্ঞেস করেনি। ওটা কি প্রশংসা না নিন্দা? এই সরল ঋজু প্রকাশকে কি তুমি পছন্দ করছ? ভালবাসছ? মুগ্ধ হচ্ছ? না কুঁকড়ে যাচ্ছ? রুদ্রাংশুর কথার টোনে মনে হয়েছিল দ্বিতীয়টা। নিন্দাসূচক বা বলা ভাল অস্বস্তিসূচক মন্তব্যটা। সে কিছু বলেওনি, মুখও তোলেনি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে খুব খেপে গিয়েছিল। তারপর যখন রুদ্রাংশু এখানে এসেও সম্পর্কটাকে চালাতে চাইল সে খুব শীতল মুখে বলেছিল—কোথায় যাচ্ছিলিস যেন রুদ্র? রবীন্দ্র সদন? একাই যা। আমার সময় হবে না।
—কেন কী করছিস? রাজকার্য? আমি তো কিছু দেখছি না তেমন।
—আমার কাজের তুই কী বুঝবি? জানলার ধারে বসে থাকাটাও আমার কাজ, শুয়ে থাকাটাও কাজ। আমার সময়। নেই, হবে না, যা।
—যা বাব্বা! রাগটাগ নাকি? কেন?
সে কোনও জবাব দেয়নি। বেশিক্ষণ তার ঘরে কোনও ছেলে থাকলেই মিসেস উইলিয়ামস একবার এসে পড়তেন। সেদিনও এলেন। অনর্থক গল্প জুড়লেন। রুদ্রাংশু পালাতে পথ পেল না। তার পরেও অনেকবার চেষ্টা করেছে রুদ্রাংশু, কিন্তু সে আর মুখ ফেরায়নি। সময়টা তখন খুব খারাপ গেছে তার। মন অন্ধকার হয়ে থাকত, সেই মুচকুন্দ চাঁপার তলার তারাজ্বলা মাঝরাতগুলো মনে পড়ত। খুব কষ্ট হত। কিন্তু তবু সে রুদ্রাংশুকে আর কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। কেননা তার কাছে যেটা পজিটিভ ইতিবাচক, রুদ্রাংশুর চোখে সেটাই নেগেটিভ। এটা হল স্বভাবের মৌলিক তফাত।
এই যে ইতিবাচক এই ব্যাপারটা ওই অদিতি বোর্দো গুপ্ত সরকারের আছে। তবু, দু’বার বিয়ে করলেন, দু’বারই কেস কেঁচে গেল? প্রথম যেদিন উনি বৃষ্টির সন্ধেতে তাকে গাড়িতে তুললেন, সেদিন অনেকক্ষণ সে কোনও রকম লক্ষই করেনি ওঁকে। তার ভেতরটা তখন এমন জ্বলছে! এমন জ্বলছে! মনে হচ্ছে—বৃষ্টিতে অনন্তকাল দাঁড়িয়ে থাকলেও অপমান ধোবে না। কী মনে করে কি লোকগুলো নিজেদের? একটু নামটাম হয়েছে, অধ্যাপক হয়েছে, ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ মুঠোর মধ্যে রেখে দেবে? সেই জন্যে তাদের নিজের ব্যক্তিগত লোভ মেটাবার জন্যে ইউজ করবে? লজ্জা করে না নিজেদের নাঙ্গা চেহারাটা ছোটদের সামনে বেরিয়ে পড়লে? অদিতিদি কি জানতেন লোকটা ওই রকম? সেদিন কী রকম ঠান্ডা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন? ভামটা যা শক খেয়েছিল না! একেবারে যাকে বলে হিসি করে ফেলেছিল। আশ্চর্য! সে অদিতি সরকারের নাম জানত ঠিকই, কিন্তু কখনও ছবি দেখেনি বলেই কি না কে জানে, বুঝতে তো পারেইনি! ওঁর বাড়ির দরজায় নেমপ্লেট ছিল। প্লেট নয় ঠিক, পেতল দিয়ে টানা হাতের লেখায় ছিল নামটা, সে লক্ষও করেনি। যাঁর বাড়িতে এসে উঠল তিনি কে এ সম্পর্কেও তখন তার কোনও মাথাব্যথা ছিল না। এটা যেন প্রতিদিনের সাত-পুরনো ঘটনাগুলোর একটা। অচেনা মহিলা তাকে লিফ্ট দেবেন। বাড়িতে নিয়ে যাবেন। তার জামাকাপড়ের ব্যবস্থা করবেন। খাওয়াবেন নিজে রেঁধে। ওঁর বাড়িতে অনেক ছবিও দেখেছিল সে। কোনওদিকে তাকায়নি। কোনও ভাবনাই দেয়নি বাড়িটাকে। একমাত্র তার অদ্ভুত উঠোনটাকে ছাড়া গুরুত্ব দেয়নি তার মালিককে, কোনও সভ্যতা-ভদ্রতা করেনি। অমন গরম গরম অভ্যর্থনার পরও নিজে ঠান্ডা থেকেছে, নির্বেদ জিইয়ে রেখেছে। উনি কোনও জোরাজুরি করেননি। মানুষটা যে অন্য মানুষকে চট করে অনুভব করতে পারেন, তা খুব স্পষ্ট। সে ফিক করে হেসে ফেলল—তার ব্যাগ থেকে ঝপ করে ডায়েরিটা পেয়েই অনোহিতার বাড়িতে ফোন। কী লাড্ডু! বাপ রে বাপ! ভেবে দেখতে গেলে সেদিনের সমস্ত ব্যাপারটাই ঘটেছিল শ্ৰীমতী অনোহিতার সৌজন্যে। মিমি যে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে তা সে জানতই। মিমি কবে কোনখান থেকে তাকে খবর দেবে তার জন্যে সে রেডি ছিল। শেষ তো তার সঙ্গেই দেখা হয়। তার সঙ্গে নিউ মার্কেটের ম্যাগনোলিয়ায় দেখা করল। চোখগুলো ঢুকে গেছে, হিংস্র মুখ—তনি বাড়িতে আমাকে খুঁজবি না। আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি।
—কেন?
—কেন তুই জানিস না? ন্যাকামি হচ্ছে? বাড়িতে পেতনি বসে ঘাড় মটকানোর মওকা খুঁজছে আমি ওই বাড়িতে থাকব? বাবা ফিরে এলে দেখা যাবে।
—কোথায় আছিস?
—তোর সব কথায় দরকার কী? নিজের কেস-হিস্ট্রি আমায় দিস? দরকার হলে আমি যোগাযোগ করে নেব।
এল, মিল্কশেক খেল, মিল্কশেকের গোঁফ হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুছতে মুছতে চলে গেল।
—আমি বেরোবার পাঁচ মিনিট পরে বেরোবি। বেশি চালাকি করে, গোয়েন্দাগিরি করবার চেষ্টা করবি না।
—আমার বয়ে গেছে। যা তুই জাহান্নমে যা।
জাহান্নমে গেল, কিন্তু জাহান্নমটিকে ম্যাগনোলিয়ার সিটে ফেলে গেল। একটা মোটা ব্রাউন ডায়েরি। তা সেটা না তুলে নিয়ে তনিকা কী করে? সেটা না পড়েই বা সে কী করে? আর পড়ে চমৎকৃত না হয়েই বা সে কী করে থাকে!
মাসিকে ফোন করল। উনি বললেন—ও ওর ভাস্করকাকুর কাছে আছে। ওঁর সঙ্গে…থাকছে…। এইভাবে ইতস্তত করে দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলেছিলেন আন্টিমাসি।
তা সেই ভাস্কর চক্রবর্তী যখন তনিকাকে নিজের স্টুডিয়োয় তাঁর আধুনিকতম টেকনিক দেখাতে নিয়ে যেতে চাইলেন, সে প্রথমেই প্রস্তাবটা নিয়ে নিল, কেননা, নিজের চোখে দেখতে পাবে মিমি সত্যিই ওখানে রয়েছে কি না। আর যদি থাকে, তবে মিমি থাকা সত্ত্বেও ভাস্কর চক্রবর্তী যদি তাকে ডাকতে পারেন…তা হলে ‘ও…ওঁর সঙ্গে…থাকছে’—এই ধারণাটা ঠিক নয়। কৌতুহলে, প্রায় মতলব নিয়ে বলা চলে—গিয়েছিল। মিমির চিহ্নও দেখল না, মাঝখান থেকে কয়েকটা ছবি দেখিয়ে কী কমপ্লিকেটেড এচিং করছেন দেখিয়ে, গাবিয়ে বললেন—তনিকা, তুমি একটু বসো।
—ভীষণ গরম আর ক্লান্ত লাগছে। চান করে আসি। এসে তোমাকে চা খাওয়াব।
সে ভালমানুষের মতো বলেছিল—আমি চা করছি, আপনি চান করে আসুন না সার!
—করবে? করো! যেন হাঁফ ছাড়লেন।
রান্নাঘরে গিয়ে ও মিমিকে দেখে। সিঙ্কে শুকনো প্লেট নামানো, ডিমের কুসুম আর আলুর খোসা পড়ে আছে। এখানে চায়ের কৌটো ওখানে কফির প্যাকেট। রাবার ব্যান্ড দিয়ে মুখ আটকানো। চিনি ছড়ানো তাকে। থিকথিক করছে পিঁপড়ে। তার বন্ধুর চেহারাটা ঘরময় ছড়িয়ে আছে। উপরন্তু তার একটা চেনা ঘাঘরা, একটা দড়ি থেকে লটপট করে ঝুলছে।
সে সব গুছিয়ে নিয়ে, চায়ের জলটা ফুটিয়ে, চা পাতা দিচ্ছে। ‘তনিকা তনিকা’ ভাস্কর চক্রবর্তী জলের আওয়াজের ওপর গলা তুলে কেমন করে যেন ডাকছেন। সে ঘাবড়ে গেছে, কী রে বাবা স্ট্রোক টোক হল না কি?
ছুটে গিয়ে দ্যাখে বাথরুমের দরজা হাট। শাওয়ারের তলায় ভাস্কর চক্রবর্তী দাঁড়িয়ে, পরনে তোয়ালে। —তনিকা আমার পিঠটাতে একটু সাবান ঘষে দেবে? সে পিছু হটে এসেছিল। ওর মুখ ওদিকে ছিল দেখতে পায়নি। ভেবেছিল, ফাইন্যাল পরীক্ষা সবে শেষ। এখন ছাত্রীকে পিঠে সাবান কেন, গা মুছিয়ে, পাউডার মাখিয়ে পাজামা পরিয়ে দিতে বললেও দেবে। ওর চরিত্ৰজ্ঞান মিমির থেকে প্রাপ্ত কিনা। মিমিকে ও ওই বয়সের মেয়েদের প্রতিনিধি ভেবে নিয়েছে।
সদর দরজা বন্ধ করে নিমেষের মধ্যে সে রাস্তায় নেমে এসেছিল। তখন প্রকাণ্ড একটা ধূম্র পাহাড়ের মতো মেঘ সমস্ত আকাশ ছেয়ে ফেলছে। যা পেয়েছে উঠে পড়েছে। টলি-ব্রিজ পার করে নেমে পড়েছে। ধুন্ধুমার বৃষ্টি। কোথায় তার বাড়ি? ও পার্ক সার্কাস। এখন পার্ক সার্কাস সে যাবে না। আরমান? উঃ আরমানের কথা যা মিমির ডায়েরিতে পড়ল, তার পর আর তার কাছে যাওয়া যায় না। সে সামনে ট্রাম পেল তারপর রাসবিহারী, গড়িয়াহাটের মোড়। এসপ্ল্যানেডের বাস ধরল। ভিজে চুপচুপে। এসপ্লানেডে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগল। ভিজতে লাগল…ভিজতে লাগল। কোনও চৈতন্য নেই, প্রথম শক—মিমি। দ্বিতীয় শক মিমির ডায়েরির হঠাৎ উলটে-পড়া পাতা, তৃতীয় শক—ভাস্কর চক্রবর্তী দা গ্রেট। সেই একই ঘোরে কাটছিল ক’দিন, তারপর চতুর্থ শক—অ্যাকাডেমি… ‘ফেলাইন মর্নিং’ সেকেন্ড এসেছে, বন্ধুদের হাল্লাবাজি, হঠাৎ এক অলক্ষ দেওয়ালের ওপার থেকে—তনিকা!
ভাবতে গেলে—তার ওই নির্লিপ্ত ব্যবহারের পরও উনি— তনিকা! ছবিটা ভাল লেগেছে দ্বিতীয় নির্বাচন করেছেন ঠিক আছে। বুঝতেও তো নির্ঘাত পেরেছেন ওই তনিকাই এই তনিকা, কিন্তু বিচারপতি অধ্যাপকের অহমিকা নিয়ে তো এড়িয়ে যেতেই পারতেন। বিশেষত যখন তার ভদ্রতার অভাব নির্লিপ্তি দেখতে পেয়েছেন, বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু খুঁজে বার করলেন বন্ধুদের পাহাড় ডিঙিয়ে, সুবীরের পাহাড় ডিঙোনো তো যে-কোনও মানুষের পক্ষেই শক্ত! এবং সোজাসুজি শাঁখ বাজিয়ে দিলেন—তনিকা!
সেই প্রতিধ্বনির কথা আছে না! পাহাড়ের উপত্যকায় দাঁড়িয়ে আছ তুমি। তোমার চারপাশ ঘিরে পাথুরে দেওয়াল, তুমি গান গাইলে, সে গান যেমন প্রত্যেকটা দেওয়াল আবার তোমায় শুনিয়ে দেয়, দিতে থাকে। এও সে রকম। তার হৃদ্বস্তুর অলিন্দ-নিলয়গুলো তাকেও ফিরিয়ে ফিরিয়ে শোনাচ্ছে যেন একটা উদাত্ত পিট সিগার বা গ্রামীণ লোকসংগীত। খোলা গলায় গাওয়া খোলা আকাশ বাতাস মাঠের মধ্যিখান থেকে।
ভাস্কর-ঘোরটা কেটে গেছে। এই ঘোরটা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আসলে এই ঘোরটাই ভাস্কর-ঘোরটাকে কাটাতে সাহায্য করেছে, নইলে তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলে সেটা বহুদিন চলে। বহু দিন।
উনি ঠিক কী? কী রকম? অন্তরঙ্গ হলে কেমন লাগবে? ওঁর ছাত্রছাত্রীরা তো মনে হল খুব ঘনিষ্ঠ, একটা পূজার ভাবও আছে, প্রেমের ভাবও আছে। কিন্তু কোনও বাঁধা খালের মৃদু একমুখী স্রোতে গা ভাসাতে তার ভাল লাগে না। ওদের মতো করে সে কিছু পারবে না। তার ভাল লাগে প্রকৃতি পর্যায়। নদীতে জোয়ার এসেছে জোয়ারের জলে ফুলে ফুলে ওঠো। ভাটির টান…ফিরে চলো ধীর সুখে সমুদ্রের দিকে, দুরন্ত পদ্মার পাড় ভেঙে ভেঙে পড়ছে, আতঙ্কে নীল হয়ে তুমিও ভেঙে পড়ছ, তারপর আবার দুর্দম চড়া হয়ে জেগে উঠছ। বেগুনি আকাশে হারিয়ে গেলে সন্ধেবেলা, প্রথম সূর্য হয়ে ফুটলে। রোদ হয়ে উঠলে তারপর হঠাৎ গুরু গুরু গুরু গুরু স্বননে বেজে উঠলে মেঘ ঘর্ষণের দামামা থেকে। দামাল বৃষ্টিপাত।
হঠাৎ তার মনে হল এইখানে, ঠিক এইখানেই তার মিমির সঙ্গে মিল। এই জন্যেই সে মিমিকে বোঝে। মিমিও তাকে ধরতে পারে খানিকটা। কিন্তু কেউই কাউকে পুরোটা নয়। মানুষে মানুষে কিছু তফাতের রহস্য তো থাকবেই! রহস্য থাকে থাক, কিন্তু একই প্রকৃতির মধ্যে এত তফাত কেন? কেন সে মিমির মতো হয়েও মিমির মতো নয়! কেন মিমি তার মতো হয়েও তার মতো নয়? শ্রীলামাসির সঙ্গে আন্টিমাসির বন্ধুত্বের কথা সে শুনেছে। দেখেওছে। ওঁদের মধ্যে কোনও ভুল বোঝাবুঝি ছিল না। আর শ্রীলামাসি তো প্রতিটি ব্যাপারে বন্ধুর ওপর নির্ভর করতেন, পরামর্শ চাইতেন। ‘সর্বাণী এল না কেন? এখনও কী করছে? সাতটা বেজে গেল যে!’ একথা যে কতবার শুনেছে ওদের বাড়িতে গিয়ে! তখনও পরদা-টরদার রংগুলো জ্বলে যায়নি, সোফাকভার, কুশন সব ঠিকঠাক পরিষ্কার হত। ছবিগুলো বাঁকা থাকত না। ক্যালেন্ডারের পাতা বদলাত। শ্রীলামাসি তো সবটা দেখে উঠতে পারতেন না, আন্টিমাসিই বেশিটা দেখতেন। এখন উনি থাকা সত্ত্বেও বাড়িটা ঠিকঠাক নেই। কেন? না মিমির ঝগড়ুটে চিৎকার যার ভয়ে সবাই তটস্থ হয়ে থাকে। শ্রীলামাসির সামনে, তার সামনে ধেড়ে মেয়ে মিমি তখন চকাস চকাস করে আন্টিকে কত চুমু খেয়েছে। কাল আসোনি কেন? এ রোববার সারাদিন আমাদের কাছে থাকতে হবে।—সবই তো তার দেখা! যেন কোলে বসে বাচ্চার মতো আদর খাবার বায়না করবে এক্ষুনি। আর কী আবদার! কী আবদার!—আজ এই রান্না করে দাও, কাল ওই করে দাও। খাওয়া নিয়ে কিছু ফাস করতে পারত ওই মেয়ে! শ্রীলামাসি তখন ক্ষীণ স্বরে বলতেন আজকে ওকে ছেড়ে দাও মিমি। ইয়ার এন্ডের ঝামেলা সেরে এসেছে। সর্বাণী আজ বড় ক্লান্ত।
—তুমি কেন সবেতে বাগড়া দাও বলো তো, আন্টিমাসি বলুক ও ক্লান্ত, ওর কথা ও বলতে পারবে। তোমাকে বলতে হবে না।
—সত্যিই আমি আজ পারছি না রে, পঞ্চমীকে ডাক আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি ঢাকাই পরোটা কী করে করতে হয়। ও-ই করে দেবে।
—নাঃ আমার দরকার নেই। ঠোঁট ফুলিয়ে দুমদাম করে চলে গেল একটা আঠারো উনিশ বছরের না তার চেয়েও বড় মেয়ে।
আন্টি উঠতে যাচ্ছেন। শ্রীলামাসি হাত চেপে ধরলেন— উঠতে পারবি না সর্বাণী। একদম না।
আন্টি হেসে বলতেন—যদি না খায়।
—না-ই খাক। বাজে আবদার শোনা হবে না তাই বলে। দিন দিন বড় হচ্ছে না ছোট হচ্ছে?
আন্টি বলতেন—এই শক্তটা আগে হলে পারতিস শ্রী।
কত সুন্দর সুন্দর আলাপ-আলোচনা চলত দু’জনের মধ্যে। গান বাজাতেন শ্রীলামাসি। যখন শরীরটা খুব খারাপ হত, কথা বলতেন না, দু’জনে চুপ করে শুধু বসে থাকতেন। কত সুন্দর দৃশ্য দেখেছে সে। রাতে সে ওদের বাড়ি থাকবে বলে গেছে। মিমি এত ঝিং-চ্যাক বাজাচ্ছে আর এত নাচতে নাচতে হাসতে হাসতে পাগলামি করছে যে তার শেষ পর্যন্ত বিরক্ত লাগছিল। একবার বলেছিল মাসির শরীরটা খুব খারাপ আজ, এত আওয়াজ করিস না।
—ওহ, তা হলে কোনওদিনই কিছু করা হবে না —আবার শুরু করে দিল, এবার হিন্দি ঝিং চ্যাক।
দরজা বন্ধ করে সে নীচে চলে এসেছিল। মাসির ঘরের পাশেই একটা বড় লাউঞ্জ মতো, সেখানে একটা টিভি থাকে, কয়েকটা বুক শেলফ। ঝাড়বাতিটা জ্বালিয়ে সে অনেকক্ষণ সেদিন পড়েছিল—কী যেন! ‘তাও অব ফিজিক্স।’ কী অদ্ভুত বইটা। কাপরা বলে একজন বিজ্ঞানী সমুদ্রের ওপর আমাদের নটরাজের নৃত্য উপলব্ধি করেছেন। সৃষ্টি, সৃষ্টি হচ্ছে। কত অদ্ভুত অদ্ভুত বই ও বাড়িতে। কে আনত! কতকগুলো বইয়ে শ্রীলামাসির নাম লেখা। কিন্তু বেশিরভাগই নাম-না-লেখা। রমাঁ রল্যাঁর ‘লাইফ অব শ্রীরামকৃষ্ণ’; ‘ইমিটেশন অব ক্রাইস্ট’ বলে একটা বই। ‘দা ম্যান হু ডায়েড’—দারুণ! সমান দারুণ গিরীন্দ্রশেখর বসুর ‘গীতা ভাষ্য’। সে অবশ্য ভূমিকাটার পর আর বেশি পড়েনি। কিন্তু ওইটুকুতেই চমৎকৃত। বেশ রাত্তির। সে উঠে মাসির ঘর পার হয়ে ওদিকে যাবে, তার খিদে পেয়েছে, দেখল মাসির ঘরে মৃদু আলো জ্বলছে, মাসি শুয়ে, পাশে আন্টিমাসি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ধীরে ধীরে। ডান দিকের মুখটা দেখা যাচ্ছে আন্টির। গালটা কেমন চকচক করছিল, উনি কি কেঁদেছিলেন? কী যে মমতামাখা! তারপর আস্তে গায়ের চাদরটা মাসির গায়ে টেনে দিলেন। মুখ নিচু করে খুব আলতো করে কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে মাসির কপালে একটা চুমু খেলেন। তারপর আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছেন দেখে সে তাড়াতাড়ি আবার লাউঞ্জে ফিরে যায়। আন্টি এসে বললেন— তোরা খাবি না?
—মিমি খাবে কিনা জানি না, আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। আমি দেখছি কী আছে, খেয়ে নিচ্ছি।
—চল ওকে একটু ডেকে দেখি!
ওদের বাড়ি সবাই একসঙ্গে খেতে বসত কমই। বেশিরভাগ সময়েই যে যার মতো টেবিল থেকে নিয়ে খেয়ে নিত।
আন্টির সেই আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলোনো, সেই সাবধানে চাদর টেনে দেওয়া আর সেই নিচু হয়ে দীর্ঘক্ষণ চুমো খাবার দৃশ্যটা সে স্মৃতির ঘরে আলো জ্বাললেই দেখতে পায়। কেমন ঘুম এসে যায় তখন। খুব মমতার, খুব গভীর স্নেহের, প্রেমের দৃশ্য সেটা। মা যেমন মেয়েকে, কিংবা প্রেমিক যেমন প্রেমিকাকে…কোনটা ঠিক ঠিক তুলনা হবে সে বুঝতে পারেনি। আজও পারে না।
মিমি যাবে কিনা জানে না, আপাতত মিমি না গেলেই সে খুশি হবে। আর দু’-একদিনের মধ্যেই সে ‘চিত্রভানু’তে যাচ্ছে।