Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জোনাথনের বাড়ির ভূত || Suchitra Bhattacharya » Page 6

জোনাথনের বাড়ির ভূত || Suchitra Bhattacharya

০৬. পরদিন ব্রেকফাস্টের টেবিলে

পরদিন ব্রেকফাস্টের টেবিলে টোস্টে মাখন মাখাতে মাখাতে মিতিন বলল, এই, চটপট খেয়ে নে। এক্ষুনি বেরোতে হবে।

টুপুর অবাক, কোথায় যাবে?

ইলিয়ট রোড।

জোনাথন মাইকেলের বাড়ি? টুপুর আকাশ থেকে পড়ল, এই সাতসকালে?

সকালই ভাল। দুপুরে আমার কম্পিউটার ক্লাস আছে।

পার্থ ওমলেট খুঁটে খুঁটে কাঁচালঙ্কা বার করছিল। মাথা না তুলেই বলল, আমি কিন্তু টিমে আছি আজ।

তুমি বাজার যাবে না?

তিন দিনের বাজার করা আছে ম্যাডাম। রুই, চিংড়ি, মুরগি। পালা করে রান্না হবে।

আর তোমার প্রেস?

প্রেস ক্যান ওয়েট, বাট মিষ্ট্রি ক্যান নট। মাইকেলের ভূতুড়ে বাড়ি দেখেই নয় প্রেসে যাব। শুধু পাঁচটা মিনিট টাইম দাও, চট করে স্নানটা সেরে নিই।

সাড়ে আটটার মধ্যে তিনজনই তৈরি। টুপুর পরেছে লংস্কার্ট আর টপ। মিতিন ঘিয়ে রং সালোয়ার কামিজ। পার্থ জিন্স টিশার্ট। চোখে একটা সানগ্লাসও চড়াল পার্থ, কাঁধে ক্যামেরা। ভ্যানিটি ব্যাগে মিনি টেপরেকর্ডারটা ভরে নিতে ভুলল না মিতিন। বুমবুম এখনও পোচ আর টোস্ট নিয়ে নাড়াঘাটা করছে, তাকে ভারতীর জিন্মায় সমর্পণ করে বেরিয়ে পড়ল তিন মূর্তি। ট্যাক্সিতে যেতে যেতে পার্থ বলল, উৎপলকে একটা ফোন করে দিলে হত না?

কী দরকার! একটু ফাঁকায় ফাঁকায় গিয়ে দেখি না বাড়িটা। উৎপলবাবু তো কাছেই থাকে, প্রয়োজন হলে যোগাযোগ করে নেব।

উৎপলকে তো লাগবেই। মিসেস জোনস কি পিৎজা আনতে দৌড়বেন?

তোমার শুধু খাই খাই। মিতিন কড়া চোখে তাকাল, ও বাড়িতে এখন অশান্তি চলছে। গিয়ে একদম হ্যাংলামি করবে না।

পার্থ হাত ওলটাল, যো হুকুম মহারানি।

পথেঘাটে অফিসের ভিড় সবে শুরু হয়েছে। তবে এখনও তেমন জ্যাম নেই কোথাও। নটার মধ্যেই ইলিয়ট রোড পৌঁছে গেল টুপুররা। ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে জোনাথনের বাড়ির সামনে এসে মিতিন দাঁড়িয়ে রইল একটুক্ষণ। বুঝি বা খানিক দূর থেকে বুঝে নিতে চাইল অন্দরের হালচাল। সামনের তিনটে দরজাই বন্ধ, তবে জানলাগুলো সব খোলা। জনমনিষ্যির সাড়া নেই। জোনাথন কি এখনও ঘুম থেকে ওঠেননি?

বারান্দায় উঠে বারকয়েক ডাকাডাকির পর মাঝের দরজা খুলে গেল। জোনাথন নয়, বেরিয়ে এসেছেন মিসেস জোনস। চুল চুড়ো করে বাঁধা, মুখময় ঘাম, গলা থেকে অ্যাপ্রন ঝুলছে, হাতে সবজি কাটার ছুরি। মিতিনদের আগমনে চমকেছেন জোর। বললেন, তোমরা হঠাৎ?

মিতিন হেসে বলল, চলে এলাম। শুনলাম এ বাড়িতে নাকি আরও কী সব আজগুবি কাণ্ড ঘটছে?

আর বোলো না। মিসেস জোনস প্রায় হাইমাউ করে উঠলেন। বুকে ক্রস আঁকছেন ঘন ঘন। ড্রয়িংরুমে মিতিনদের বসাতে বসাতে বললেন, হোলি স্পিরিট ভয়ানক অশান্ত হয়ে গেছেন। এ বাড়ির একটা কাচও তিনি বুঝি আস্ত রাখবেন না। জানো, কাল রাতে কী হয়েছে? ডাইনিং প্লেসের ক্রকারি কেসটাও উনি ভেঙে দিয়েছেন।

পার্থ সোফার গদিটা পরখ করছিল। গ্ৰাম্ভারি স্বরে বলল, ওই ভূতটির সন্ধানেই তো আমাদের আসা।

মিসেস জোনসের ভুরু কুঁচকে গেল, এঁকে তো চিনলাম না?

মিতিন ঝুঁকে ডিসপ্লে ক্যাবিনেটের ভাঙা কাচ দেখছে। ঘুরে বলল, উনি আমার হাজব্যান্ড। পার্থ। উৎপলবাবুর কলেজের বন্ধু।

ও। মিসেস জোনসের গলায় অসন্তোষ, শোনো বাছা, তোমাদের ভূত আর আমাদের হোলি স্পিরিট এক নয়। বড়সড় কিছু না ঘটলে হোলি স্পিরিট কক্ষনও নিজেকে জানান দেন না।

মিতিন বলল, বড়সড় ঘটনা তো একটাই। ও ঘরে এক্সট্রা ফার্নিচার ঢোকানো। তাই না মিসেস জোনস?

আমার তো তাই মনে হয়। তবে আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, আমার কথার কী দাম আছে! আমি শুধু ভয় পাচ্ছি এর পর আরও বড় কিছু না ঘটে।

মিতিনের পাশ থেকে টুপুর বলল, এখনই তো যথেষ্ট তুলকালাম চলছে। এর চেয়ে সাংঘাতিক আর কী হবে?

আমি মিস্টার মাইকেলের কথা বলছি। ওঁর ওপর দিয়ে যা ঝড় যাচ্ছে। কদ্দিন আর ধাক্কা সামলাতে পারবেন কে জানে!

মিস্টার মাইকেল এখন কোথায়?

কালও তাও হেঁটে চলে বেড়াচ্ছিলেন। আজ তো বিছানা ছেড়ে উঠতেই চাইছেন না, এত শকড। মিসেস জোনস আপনমনে গজগজ করছেন, কোন আক্কেলে যে মির্না উৎপল মানুষটাকে একা ফেলে চলে গেল! ডিকেরও বলিহারি যাই। দেখল এসে বাপের এই অবস্থা, কোথায় খানিক সান্ত্বনা দেবে বাপকে, পাশে গিয়ে বসবে, তা নয়, আজেবাজে কথা শুনিয়ে সটান শুতে চলে গেল!

ডিক ডিউটি থেকে ফিরে এসেছে?

এই তো, পৌনে নটা নাগাদ। এখন সেই টানা দুটো অবধি ঘুমোবে। তারপর খেয়েদেয়ে বেরোবে চরকি মারতে। মাঝখান থেকে আমারই হয়েছে যত জ্বালা। বারবার বলছি, আমায় রেহাই দাও, ছেড়ে দাও… মির্না, উৎপল কানেই তুলছে না। মিসেস জোনস লম্বা নিশ্বাস ফেললেন, আমার মনের অবস্থাটা কেউ বোঝে না।

হুম, আপনার ওপরও বড্ড চাপ যাচ্ছে।

বাদ দাও। তোমরা একটু চা খাবে তো?

থ্যাংকস মিসেস জোনস। সত্যিই আপনার হাতের চা খেতে খুব ইচ্ছে করছিল।

আমি এক্ষুনি বানিয়ে আনছি।

মিস্টার মাইকেলের সঙ্গে একবার দেখা করতে হবে যে।

খবর দিচ্ছি। উনি আসতে পারেন তো ভাল, নইলে আমি ওঁর কাছে তোমাদের নিয়ে যাব।

সো কাইন্ড অফ ইউ।

মিসেস জোনস অন্তৰ্হিত হতেই মিতিন চাপা গলায় বলল, কাচ ভাঙার নেচারটা নোট কর। পাল্লার পুরো কাচ খসেনি, কাঠের সঙ্গে খানিকটা করে লেগে আছে। ভেঙেছেও প্রায় স্ট্রেট লাইনে, এবড়োখেবড়ো ভাবে নয়।

হোলি স্পিরিট বোধহয় পবিত্ৰ স্কেল নিয়ে এসেছিলেন। মাপ করে কেটেছেন। টিপ্পনী ছুড়েই পার্থ ক্যামেরা বার করে পটাপট ছবি তুলতে শুরু করেছে। দেওয়ালে ঝোলানো ঢাল তলোয়ার ফোকাস করতে করতে বলল, তলোয়ারের কী সাইজ, বাপস। এক ঘায়েই তিনটে মানুষ ঘ্যাচাং। এরকম তলোয়ার আগেও কোথায় যেন দেখেছি।

মিতিন চোখ ঘোরাল, কোথায় বলো তো?

কোনও মিউজিয়ামটিউজিয়ামে বোধ হয়। মনে পড়ছে না।

টুপুর বলল, শিরস্ত্রাণটাও কী জমকালো দেখেছ? ওটা মাথায় চাপিয়ে মানুষ যে কী করে যুদ্ধ করত!

তখনকার লোকজনের তাকত অনেক বেশি ছিল। খেতও বেশি। জানিস, রাজা রামমোহনের কী আহার ছিল? মাংস খেলে আস্ত পাঁঠা। দিনে বারো সের দুধ। তাও তো উনি সোলজার ছিলেননা।

মিতিন ফুট কাটল, সৈনিক হলে হয়তো আস্ত হাতিই খেতেন।

ঠাট্টাটা গায়ে মাখল না পাৰ্থ, ঘরের সমস্ত সুইচ অন করছে। খোলা জানলা দিয়ে আলো আসছিল ভালই, নতুন বা টিউবের দ্যুতিতে ঘর যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঘড়ি দেখছে টুপুর, পাৰ্থর সন্দিগ্ধ চোখ বা টিউবে স্থির। এক মিনিট..দুমিনিট…তিন মিনিট…!

মিতিন বলে উঠল, মিছিমিছি কেন কারেন্ট পোড়াচ্ছ? দিনের বেলা কিস্যু হবে না।

সত্যিই কিছু হল না। হতাশ পাৰ্থ সুইচ অফ করে ফের ক্যামেরায় মনোযোগী, ফোকাস করছে হরিণের শিং-এ, জোনাথনের বেডরুমের ভেজানো দরজা খুলে গেল। পরদা সরিয়ে ঈষৎ নড়বড়ে পায়ে ঘরে ঢুকলেন জোনাথন।

একটু যেন অবসন্ন দেখাচ্ছে জোনাথনকে। মুখে দুতিন দিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি, চুল উসখুসকো, দৃষ্টিতে একটা বিহ্বল ভাব। গলাখাঁকারি দিয়ে জোনাথন বললেন, তোমরা সকালেই এসে গেলে?

পার্থর সঙ্গে জোনাথনের আলাপ করিয়ে দিয়ে মিতিন নরম করে বলল, আমার আর তর সইছিল না মিস্টার মাইকেল। কাল রাত থেকে আপনার জন্য বড় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি।

লাভ নেই। হোলি স্পিরিট আমায় ডাকছেন। যাওয়ার সময় বুঝি হয়ে এল।

এত ঘাবড়ে যাচ্ছেন কেন? আমরা তো আছি। সবাই মিলে আপনাকে রক্ষা করব।

জোনাথন খুব একটা আশ্বস্ত হলেন না। সোফায় হেলান দিয়ে বসলেন, কাল কী হয়েছে শুনেছ তো?

মিসেস জোনস বললেন। কটা নাগাদ ঘটেছে?

সময় তো সঠিক বলতে পারব না। ওই ধরো রাত দুটো-তিনটে হবে। মোটামুটি ওই সময়ে আমি একবার বাথরুমে যাই। কাল আমায় দুখানা স্লিপিং পিল দিয়েছিল মির্না, মাথাটা কেমন টলমল করছিল। ঘর থেকে বেরোতেই চক্কর মতো একটা এসে গেল।

সামলাতে গিয়ে ক্রকারি সেটটা ধরেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ঝনঝন করে কাচ খুলে পড়ে গেল। কপাল ভাল, পায়ের ওপর পড়েনি।

কী করলেন তখন? বারান্দার আলো জ্বাললেন?

বারান্দার আলো তো জ্বলছিলই। রাতে এখন ওটা আর নেবাচ্ছি না। কোনও রকমে কাচের টুকরো বাঁচিয়ে, বাথরুম সেরে ঘরে চলে এলাম। তারপর থেকে আর চোখ বুজতে পারিনি।

পার্থ বলল, এত দুশ্চিন্তা করছেন কেন? আপনার ধাক্কাতেও তো কাচ ভাঙতে পারে।

ইম্পসিবল। ওটা অত্যন্ত মজবুত জিনিস। বিখ্যাত ফার্নিচার কাপ ল্যাজারাসের মাল। কতবার টানাহেঁচড়া হয়েছে, এদিক থেকে ওদিক সরেছে, ধাক্কাটাক্কাও কম খায়নি…। তা ছাড়া শুধু ক্রকারি কেসই নয়, মাত্র তিন রাতে কত কী যে গেল!

এই সেন্টার টেবিলটাও তো গেছে।

ওটা তো বিচ্ছিরিভাবে ভাঙল। মোটা মোমবাতি জ্বলে মির্না ওটার ওপর বসানোর চেষ্টা করছিল, খস করে ঝরে গেল। চারপাশে কাচ, মধ্যিখানটা ফাঁকা, কী ভয়ংকর বলো!

কাল বন্ধ ঘর থেকে কোনও আওয়াজ পেয়েছিলেন? না। হোলি স্পিরিট বোধ হয় কাল সারারাত বাইরেই ছিলেন। ও ঘরে তো তিনি ক্ৰোধ দেখিয়েছেন পরশু।

আপনার ঘরের দেওয়াল-আলমারিও তো পরশু রাতেই ভেঙেছিল। তাই না?

রাত্তিরে নয়, সন্ধেবেলা। জোনাথনের চোখ বিস্ফারিত হল। যেন কল্পচোখে সন্ধেটাকে দেখতে পাচ্ছেন এমনভাবে বললেন, গরমে গায়ে র‍্যাশ বেরোচ্ছে, তাই মলম বার করতে গেছিলাম। যেই না পাল্লা ধরে টেনেছি, অমনি দুটো ফ্রেমেরই কাচ খসে গেল। একশো চল্লিশ বছরের পুরনো আলমারির কাচ কি করে আপনাআপনি খসতে পারে?

তখন বাড়িতে আপনারা কে কে ছিলেন?

সবাই। আমি মির্না ডিক উৎপল।

মিসেস জোনস?

উনি তখন চলে গেছেন।

এ ঘরের বা টিউব ফেটেছিল কখন?

সে তো সন্ধে হতে না-হতেই। বিকেলে আমার হাঁটতে বেরোনোর অভ্যেস আছে। টুকটুক করে রয়েড স্ট্রিট, রফি আহমেদ কিদোয়াই রোড ধরে, পার্ক স্ট্রিটের মোড় পেরিয়ে, থিয়েটার রোড হয়ে, ম্যাকফারসন স্কোয়ার পর্যন্ত যাই। পাকা এক মাইল! ওখানে একটু জিরিয়ে সন্ধের মুখে মুখে ফিরে আসি। আমি এলে তবে মিসেস জোনস বাড়ি যান। পরশু বেড়িয়ে ফিরেছি, মিসেস জোনস যাব যাব করছেন, তখনই গেল।

তখন বাড়িতে আর কে ছিলেন? উৎপল ছিল কি?

জোনাথান একটু চিন্তা করলেন, হ্যাঁ, উৎপল ছিল। ডিকও ছিল। ডিক তো ভ্যাবাচাকা খেয়ে দৌড়ে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ডাকতে ছুটল। কিন্তু রোবরার কি মিস্ত্রি পাওয়া যায়? জোনাথান অনেকক্ষণ পর মৃদু হাসলেন, জীবনে এই প্রথম দেখলাম ডিক বেশ নার্ভাস হয়েছে। এবং বিশ্বাস করছে হোলি স্পিরিটের কী শক্তি। কাল ইলেকট্রিক লাইন চেক করানোর পর ও তো একেবারে নিঃসন্দেহ।

হোলি স্পিরিটে ফেথ এলেও ডিক কিন্তু বদলায়নি মিস্টার মাইকেল। ঐলি ঠেলতে ঠেলতে মিসেস জোনস ঢুকলেন। গোমড়া মুখে বললেন, হি ইজ স্টিল দাসেম অ্যারোগেন্ট গাই। ড্যাডির জন্য সামান্যতম ফিলিং নেই। নইলে কোনও ছেলে বাবাকে বলতে পারে, এর পর বাড়িতে একা মরে পড়ে থাকবে… সকালবেলা কোনদিন এসে আমি তোমার লাশ আবিষ্কার করব… তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা তোমার ছেলেমেয়ের কম্মো নয়!

পার্থ দাঁত কিড়মড় করল, মহা পাজি ছেলে তো! ওকে একটু ডাকা যায় না? কড়কে দিয়ে যেতাম।

মিতিন চোখের ইশারায় চুপ করতে বলল পার্থকে। মুখে হাসি হাসি ভাব ফুটিয়ে মিসেস জোনসকে বলল, আপনি তো অনেক দিন আছেন, আপনি একটু বকতে পারেন না?

ও কারুর কথাই কানে তোলে না। মিসেস জোনস চায়ের কাপ ডিশ তুলে দিলেন পার্থ মিতিনের হাতে। বেশ কিছু মুচমুচে স্যান্ডুইচও বানিয়ে এনেছেন টোস্টারে। ট্রলি সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন, নাও, গরম গরম খেয়ে নাও।

এত কেন? আমরা ব্রেকফার্স্ট করে বেরিয়েছি।

খাবে না? তোমাদের জন্য করলাম?

পার্থ বলল, মন খারাপ করবেন না। আমি একটা খাচ্ছি।

একটা নয়, পর পর তিনখানা স্যান্ডুইচ নিমেষে সাবাড়। মিতিন চায়েই সন্তুষ্ট। টুপুর শরবত নিল এক গ্লাস।

কাপ ট্রলিতে নামিয়ে রেখে মিতিন বলল, আচ্ছা, ডিকের সঙ্গে মির্নার রিলেশান কেমন?

খুব খারাপ। মির্না তো ডিককে সহ্যই করতে পারে না। উৎপলের সঙ্গে তাও গল্পটল্প করে, মির্নার সঙ্গে কথাই হয় না।

তা উৎপলবাবু তো ডিককে একটু বোঝাতে পারেন।

জোনাথন বিষণ্ণভাবে ঘাড় নাড়লেন, ডিকের টাইপটাই আলাদা। ছোট থেকেই। মতের অমিল হল, তো অমনি ফাটাফাটি। কালই তো তোমার বাড়ি থেকে ফিরে উৎপল বলছিল, তুমি নাকি সাসপেক্ট করছ সুরজমল কোনও নোংরা খেলা খেললেও খেলতে পারে। আমি অবশ্য তোমার সঙ্গে একমত নই। তাও আমি চুপচাপ শুনলাম, কোনও কমেন্ট করিনি। ভাবলাম ও যদি ইনভেস্টিগেট করাতে চায় তো করাক, ওর মনের অবিশ্বাসটা তো ঘুচবে। ডিক তো শুনেই ফায়ার। কী চোটপাটটাই না করল উৎপলের ওপর। তুমি অত্যন্ত মীন, প্রোমোটার মাত্রই খারাপ হয় না, কোনও লোকের টাকা আছে দেখলেই তোমার চোখ টাটায়, এরকম অজস্র আকথাকুকথা। উৎপলকে গালাগাল করতে করতেই নাইট ডিউটিতে বেরিয়ে গেল।

মিতিনের দৃষ্টি জোনাথনে স্থির হল, ডিকের কথা থাক মিস্টার মাইকেল। আপনার কি সত্যিই সন্দেহ হয় না, এসব কীর্তিকলাপের পেছনে সুরজমল থাকলেও থাকতে পারে?

সন্দেহের তো কারণ থাকবে?

লোকটা সকালে এল, সন্ধে থেকে আপনার কাচ ভাঙতে শুরু করল। আগের বারও লোকটা ফোন করার পরেই আপনার ফার্নিচার রুমে হট্টগোল শুরু হল। যোগাযোগগুলো কি নেহাতই কাকতালীয়?

আমার তো তাই মনে হয়।

সুরজমল সম্পর্কে আপনার কী অ্যাসেসমেন্ট?

মহা ঘুঘু। এই শনিবারই তো এসে আমায় একটা প্যাঁচ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সক্কালবেলা, আমি তখন গোলাপগাছে জল দিচ্ছি, কোথথেকে এক পাংক চুল সাধু নিয়ে হাজির। দুজনেরই কপালে ঘটা করে রক্তচন্দনের টিকা। এসে কী বিনয়! গদগদ সুরে বলছে, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ মিস্টার মাইকেল। আপনি যে শেষ পর্যন্ত বাড়িটা আমায় সেল করতে রাজি হয়েছেন তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। দিনটাও ভাল বেছেছেন, রাতে মায়ের পুজো। চলুন, সইসাবুদ সেরে আজই অ্যাডভান্স দিয়ে দিই। আমি তো তাজ্জব! আমি কবে বললাম বাড়ি বেচব? কথাটা বলতেই সুরজমল অ্যাক্টিং শুরু করে দিল। ইনিয়ে বিনিয়ে বলে, আমিই নাকি ওকে ফোন করে ডেকেছি, এখন পিছিয়ে যাওয়াটা আমার অনৈতিক কাজ হবে…! শুনে তদ্দণ্ডেই আমি বললাম, ঝুট মত কহে। ভাগো হিয়াসে।

সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল?

বেজার মুখে দাঁড়িয়ে ছিল একটুক্ষণ। তারপর এক গ্লাস জল চাইল। ওইটুকু ভদ্রতা আমি করেছি।

পার্থ চোখ সরু করে প্রশ্ন করল, জল আনতে আপনিই নিশ্চয়ই ভেতরে গিয়েছিলেন?

তো? জোনাথন হোঁচট খেলেন, কী হয়েছে তাতে?

ভাবছি ওই গ্যাপটাতে সুরজমল না কিছু করে দিয়ে থাকে।

অসম্ভব। আমি মাত্ৰ মিনিট তিনেকের জন্য ভেতরে গিয়েছিলাম।

তিন মিনিট কম সময় নয়। পার্থ মাথা দোলাল, মাত্র দেড় সেকেন্ডেরও কম সময়ে চাঁদ থেকে পৃথিবীতে আলো আসে। …আচ্ছা, ওই গুরুদেবটির হাবভাব কেমন ছিল? মানে হোয়াট হি ওয়াজ ড়ুয়িং হিয়ার?

আমার গোলাপ গাছগুলো দেখছিলেন মন দিয়ে।

কোনও ফুল ছিঁড়েছিলেন কি? কারণ ওঁরা ফুল দিয়েই অনেক সময়ে…।

তুমি থামবে? পার্থকে হালকা ধমক দিল মিতিন। জোনাথনকে বলল, আপনার হোলি স্পিরিটের সমস্যা তো মিটতে চলেছে। আমি উৎপলবাবুকে বলেছি এক্সট্রা ফার্নিচার বের করে দেওয়ার জন্য। উনি রাজিও হয়েছেন।

জানি। সম্ভবত আজ দুপুরেই উৎপল সরিয়ে দেবে।

মিসেস জোনস চলে গিয়েছিলেন, মাঝে ফিরে এসে কথাবার্তা শুনছিলেন। খুশি খুশি মুখে বললেন, থ্যাংক গড। উৎপলের তা হলে সুমতি হল! সুখবরটা এতক্ষণ জানাননি কেন মিস্টার মাইকেল? মিসেস জোনস বুকে ক্রশ আঁকলেন, প্ৰভু যিশুর কৃপায় এবার আশা করি সব মিটে যাবে।

অবসাদ কাটিয়ে ওঠা জোনাথন আবার যেন একটু ঝিমিয়েছেন। নিচু গলায় বললেন, কিন্তু ডিক তো তা মানতে চাইছে না। এই নিয়েই তো কাল মির্না উৎপলের সঙ্গে ওর বেধে গেল।

কী বলছিল ডিক?

মির্নাদের অ্যাকিউজ করছিল। বলছিল তোমরাই ঘরটায় উটকো জিনিস ঢুকিয়ে হোলি স্পিরিটকে ডিসটার্ব করে দিয়েছ। এখন ওই জঞ্জাল বার করলেই বুঝি প্রবলেম মিটবে? উনি আর কখনও শান্ত হবেন না। এ বাড়ি পারমানেন্টলি হন্টেড হাউস হয়ে গেল।

ডিকের কথা শুনেই বুঝি আপনি বেশি আপসেট হয়ে পড়েছেন?

বিচলিত হয়েছি তো বটেই। কাল ওই ক্রকারি কেস ভাঙার পর থেকে শুধুই ভাবছি। ভেবেই চলেছি। একবার মনে হচ্ছে, যা হবে হোক, সবই আমি তাঁর হাতে ছেড়ে দিলাম। আবার ভাবছি, এই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কি আর কোনও উপায় নেই? তিনি কি আর কোনও ভাবেই ঠাণ্ডা হবেন না?

চিন্তা করবেন না। দেখুন না কী হয়। মিতিন উঠে দাঁড়াল, চলুন, ভাঙচুরগুলো একবার প্রত্যক্ষ করে আসি।

পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যেই দেখা শেষ। ফার্নিচাররুমটা খুলিয়েও মিতিন দেখে নিল এক বার। জোনাথন গেলেনই না, মিসেস জোও দাঁড়িয়ে রইলেন দরজায়। দুটো চেয়ার গড়াগড়ি খাচ্ছিল মেঝেয়, সেগুলোকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল মিতিন। পার্থ পটাপট কয়েকটা ছবি তুলে নিল ঘরের। পেন্টিংটার, ফার্নিচারের কড়িবরগার। মিসেস জোনস হাঁ হাঁ করছিলেন, পার্থ শুনলই না। ঘর থেকে বেরিয়ে মিতিন বলল, আজ তা হলে আসি?

মিসেস জোনস বললেন, ডিকের ঘরে যাবে? ডিককে ডাকব?

থাক। ঘুমাচ্ছে ঘুমোক। বরং চলুন, আপনি আমাদের একটু এগিয়ে দেবেন।

হাঁটতে হাঁটতে মিসেস জোনসকে তাঁর ঘরগেরস্থালির কথা জিজ্ঞেস করছিল মিতিন। বড় দুঃখের জীবন বেচারির। মিস্টার জোনস ছবি বাঁধাইয়ের কাজ করতেন, বাস থেকে পড়ে গিয়ে কোমরে জোর চোট পেয়েছিলেন, প্রায় বছর তিনেক তিনি একেবারেই শয্যাশায়ী। একটিমাত্র ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে, বাবা-মার খবর রাখে না, একা মিসেস জোনসকেই সংসারের ঘানি টানতে হয়। এ বাড়ির লোকজনের ওপর মিসেস জোনসের অসীম মায়া।

টুপুরের বেশ কষ্ট হচ্ছিল মিসেস জোনসের জন্য। সত্যি, কত মানুষের কত যন্ত্ৰণা।

গলির মুখ অবধি এসে ফিরে গেলেন মিসেস জোনস। ক্যামেরা টুপুরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে তড়িঘড়ি প্রেসে দৌড়ল পার্থ। ভূতের বাড়ি, কাচ ভাঙা, স্যান্ডুইচ, সব মিলিয়ে আজকের অভিযান নিয়ে সে মোটামুটি সন্তুষ্ট। শুধু একটাই আফশোস, উৎপলদের জিমনাসিয়ামটা দেখা হল না। নাদিয়া এখনও ঝাঁপ খোলেনি।

অলস পায়ে হাঁটছিল মিতিন। অপ্রশস্ত ফুটপাথ ধরে।

পাশাপাশি তাল মিলিয়ে চলতে চলতে টুপুর জিজ্ঞেস করল, তোমার কী মনে হয় মিতিনমাসি? চেয়ার টেবিল বার করে দিলেই ব্যাপারটা মিটে যাবে?

মোটেই না। কাচ ভাঙার নেচার বলে দিচ্ছে সমস্যাটা সরল নয়। ভূত বাবাজি ক্রমেই মরিয়া হচ্ছেন।

মানে?

জিনিস বেরোনোর পরেও কাচ ভাঙবে। আর আমি সেটাই চাই।

টুপুরের বুক ধুকধুক করে উঠল। কেস মনে হয় জমছে!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *