Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জোনাথনের বাড়ির ভূত || Suchitra Bhattacharya » Page 11

জোনাথনের বাড়ির ভূত || Suchitra Bhattacharya

১১. পরদিন সকালে কলকাতায় ফিরে

পরদিন সকালে কলকাতায় ফিরে পাঁচ মিনিটও হাঁপ জিরোনর অবকাশ পাওয়া গেল না। বাড়ি এসে হাত-মুখ ধুয়ে টুপুর সবে পার্থমেসোকে শরৎচন্দ্রের মামার বাড়ির গল্প শোনাতে শুরু করেছে, তখনই জোনাথন মাইকেলের ফোন। হতাশ সুরে জোনাথন জানাচ্ছেন গতকাল ফার্নিচার রুমে পার্থমেসো যে মন্ত্রপড়া টিউবলাইটটি জ্বালিয়ে দিয়ে এসেছিল সেটি নাকি আপনাআপনি নিবে গেছে। ঘটনাটা জোনাথনের নজরে পড়েছে ভোররাতে। বাথরুমে যাওয়ার সময়ে। অথচ কাল রাত সাড়ে বারোটাতেও আলোটা জ্বলছিল। জোনাথন কাল অনেক রাত অবধি জেগে ছিলেন, শুতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি বার বার এসে দেখে গেছেন চৌকাঠের ফাঁক দিয়ে আলো আসছে কি না।

ঘরটা অবশ্য এখনও খোলেননি জোনাথন। তালাবন্ধই আছে। তবে মিতিনের ওপর যে তিনি ভরসা হারিয়েছেন এটা তাঁর কথায় স্পষ্ট টের পাওয়া যায়।

পার্থ ধরেছিল ফোনটা। সবিস্তারে জোনাথনের বক্তব্য শুনিয়ে হালকা বিদ্রূপ ছুড়ল মিতিনকে, কী হল, অ্যাঁ? তোমার টিউবও গন? তোমার ঝাড়ফুঁক তা হলে ফেল মারল?

কাল গণপতি চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলার পর থেকেই বেশ গম্ভীর হয়ে আছে মিতিন। কথাও বলছে কম। ভাগলপুরের দ্রষ্টব্য বাড়িগুলো দেখার সময়েও তেমন যেন উচ্ছ্বাস ছিল না। রাতে ট্রেনেও টুপুরের সঙ্গে কটা কথা বলেছে হাতে গুনে বলা যায়। সারাক্ষণই যেন কী ভাবছে। কী যেন হিসেব কষছে মনে মনে।

প্রায় কুড়ি ঘণ্টা পরে মিতিনের মুখে এই প্রথম নির্মল হাসি ফুটল। বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, মোটেই না মশাই। বরং বলতে পারো আমার ঝাড়ফুঁক হোলি স্পিরিটকে পেড়ে ফেলেছে। তড়িঘড়ি করে আমার মন্ত্রের তেজ কাটাতে গিয়ে বেচারা চরম ভুলটা করে ফেলল।

মানে?

চলো আমার সঙ্গে। দ্যাখো কীভাবে যবনিকা ফেলি। হোলি ঘোস্টকে হাতেনাতে পাকড়াই।

টুপুর আর পার্থ মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। ব্যাপারটা ঠিক মগজে ঢুকছে না।

মিতিন চোখ পাকিয়ে বলল, তোমরা দুজনে এরকম ভ্যাবলার মতো মুখ করে থেকো না তো। এটুকু তো তোমাদের বোঝা উচিত। হোলি ঘোস্ট ও বাড়িরই কেউ।

পার্থ বলল, কে?

টুপুর বলল, আমি বুঝে গেছি। উৎপল ক্রিস্টোফার বিশ্বাস, আর মির্না বিশ্বাস। ওই দুজন চিটিংবাজ মিলেই তো কুচুটে প্ল্যান ভেঁজেছিল। সঙ্গে আছে এক মেঘনাদ। রাজনাথ সিং।

পার্থ অবাক মুখে বলল, সে আবার কে? কোত্থেকে হঠাৎ মঞ্চে এল?

মিতিন বলল, সব জানতে পারবে। তাড়াতাড়ি খোলস বদলে রেডি হয়ে নাও। আর একটা ফোন করে দাও মিস্টার মাইকেলকে। বলো আমরা ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে পৌঁছচ্ছি। এর মধ্যে উনি যেন সবাইকে খবর দিয়ে ঢেকে নেন। উৎপল মির্না ডিক মিসেস জোনস। সবাই যেন প্রেজেন্ট থাকে। ফার্নিচাররুমের তালা আমি ও বাড়ির সকলের সামনে খুলতে চাই। বাই দা বাই, তুমি লাইকোপোডিয়াম পাউডার ঠিকঠাক ছড়িয়েছিলে তো?

ও শিওর। কার্পেট ভরতি করে দিয়েছি।

কেউ দেখেনি?

নো চান্স।

গুড।

তড়াক করে লাফিয়ে উঠে স্নানে ঢুকে গেল মিতিন। পাঁচ মিনিটে বাজার সেরে ফেলল পার্থ। স্রেফ ডিম আর আলু। সদ্যজাগ্রত বুমবুমের হাতে দুধের গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি লুচি ভেজে ফেলল ভারতী। গপাগপ জলখাবার খেয়ে মিতিনের টিম মাত্ৰ বিয়াল্লিশ মিনিটের মধ্যে বেরোনোর জন্য প্রস্তুত।

ট্যাক্সিতে উঠে মিতিন পার্থকে জিজ্ঞেস করল, মাকগ্রেগরের সমাধির হদিস তো মিলেছে বললে!

মিলেছে মানে? ঢুঁড়তে গিয়ে জান কয়লা হয়ে গেছে। যা গোরুখোঁজা খুঁজেছি। গোটা সমাধি, আধভাঙা সমাধি, প্রায় ভগ্নস্তূপ বনে যাওয়া সমাধি… অর্ধেক তো নামই পড়া যায় না। কোথাও কোথাও তো রীতিমত জঙ্গল হয়ে আছে, যে-কোনও সময়ে সাপখোপ বেরিয়ে আসতে পারে…

ঠিক আছে, ঠিক আছে। অত ব্যাখ্যান লাগবে না। এখন আমরা সোজা ওই সমাধিতে যাব।

ইলিয়ট রোড যাবে না?

আগে সমাধি। তারপর ইলিয়ট রোড।

কিন্তু ওখানে যে সবাই ওয়েট করবে।

করুক। টেনশন বাড়ুক।

লোয়ার সার্কুলার রোডের কবরখানার সামনে এসে ট্যাক্সি ছেড়ে দিল মিতিন। টুপুর পার্থকে দুপাশে নিয়ে ঢুকে পড়েছে ভেতরে। বিশাল সমাধিক্ষেত্রটায় পা রেখেই মনটা কেমন অন্যরকম হয়ে গেল টুপুরের। কংক্রিটের জঙ্গলের মতো এই শহরটার মধ্যিখানে কী অপরূপ এক সবুজের সমারোহ। আম, জাম, শিরীষ, শিমুল, নিম, কৃষ্ণচূড়া, গুলমোহরের ঠাণ্ডা ছায়ায় শুয়ে আছেন কতশত মৃত মানুষ চিরনিদ্রায় রয়েছেন শান্তিতে। কাঁঠালিচাপার গাছগুলো ছেয়ে আছে ফুলে ফুলে। মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে। জ্যৈষ্ঠের মৃদু বাতাসে দোল খাচ্ছে ডালপালা। অলস ভাবে টুপটাপ খসে পড়ছে শুকনো পাতারা। এমন জায়গায় এলে বাইরের ভিড় হট্টগোল কোনও কিছুই আর টের পাওয়া যায় না।

মাঝের সোজা পথ ধরে খানিকটা গেলে ডাইনেবাঁয়ে দুদিকে দুটো আৰ্চ। ডানদিকে মধুসূদনের কবরে যাওয়ার রাস্তা, বাঁয়ে বেথুনবীথি। সত্যি, এমন ঘাসে ঢাকা পথকে বীথি বললেই বুঝি মানায় বেশি।

বেথুনবীথি ধরে খানিকটা গিয়ে ডানদিকে ঘুরল পার্থ। আবার বাঁয়ে। আবার ডাইনে। প্রায় কবরখানার পাঁচিলের কাছে এসে আগাছায় ঢাকা একখানা সমাধি দেখিয়ে বলল, ওই যে তোমাদের রবার্ট ম্যাকগ্রেগর।

সমাধির ছোট্ট চাতালটা ঝরাপাতায় ঢাকা। চাতালের গা বেয়ে খাড়া মার্বেল পাথরের ফলক। ম্যাকগ্রেগরের নাম-ধাম ঝাপসা হয়ে এলেও এখনও পড়া যায়। জন্ম সতেরোই মে, আঠেরোশো বাইশ। মৃত্যু তেইশে এপ্রিল, আঠেরোশো চৌষট্টি।

টুপুর ফিসফিস করে বলল, ট্রেনের আন্টি তো ঠিকই বলেছিলেন। তেইশে এপ্রিলই মারা গিয়েছিলেন ম্যাকগ্রেগর!

মিতিন যেন শুনতেই পেল না। এক মনে দেখছে সমাধিটা। ঝুকে চাতাল থেকে পাতা কাঠিকুটি সরাল। বেশ বড় বড় হরফে একটা এপিটাফ খোদাই করা আছে চাতালে। মাত্ৰ এক লাইনের SOMEONE WHO ONCE RULED DESTINY

পার্থ নিচু গলায় বলল, কী দাম্ভিক সাহেব রে বাবা! নিজেকে নিয়তির হৰ্তাকৰ্তা ভাবত!

হুম। মিতিন মাথা দোলাল। অন্যমনস্ক স্বরে বলল, চলো, যাওয়া যাক।

দেখা শেষ? কী দেখলে?

মিতিন সরাসরি উত্তর দিল না। আপন মনে বিড়বিড় করছে, এত সহজ একটা ক্লু অ্যাদ্দিনেও কেউ ধরতে পারেনি? আশ্চর্য!

কী বকবক করছ?

কিছু না। চলো।

কবরখানা থেকে বেরিয়ে হেঁটেই ইলিয়ট রোড চলে এল মিতিরা। জোনাথনের গেটে পৌঁছে দেখল, উৎপল উদগ্রীব মুখে অপেক্ষা করছে বারান্দায়। মিতিন সামনে আসতেই বলল, ব্যাপার কী ম্যাডাম? সবাইকে হঠাৎ একসঙ্গে তলব?

মিতিন হেসে বলল, আমার ম্যাজিকটিউবের শেষ খেলটা দেখাব যে।

কিন্তু সে তো নিবে গেছে!

নেবাটাই তো খেলা। আসুন। ডাকুন সবাইকে।

বাড়িসুদ্ধ লোক বন্ধ ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। জোনাথন দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে তাকালেন টিউবলাইটের দিকে। আলোটা জ্বলছে না বটে, তবে অক্ষতই আছে।

জোনাথন বিহ্বল স্বরে বলে উঠলেন, দেখেছ, হোলি স্পিরিট এবার শুধু নিবিয়ে দিয়ে গেছেন।

মিতিন পিছন থেকে বলল, হুঁ। সুইচ টিপে।

একসঙ্গে সব কটা চোখ ঘুরল সুইচবোর্ডে। সত্যিই তো সুইচ অফ!

জোনাথন ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, কী কাণ্ড! হোলি স্পিরিট সুইচবোর্ডে হাত দিয়ে….!

এক সেকেন্ড। মিতিন হাত তুলে সবাইকে ঘরে ঢোকা থেকে নিরস্ত করল। তারপর অতি সন্তৰ্পণে পা টিপে টিপে সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে জ্বালিয়ে দিল টিউবলাইট। আলোকিত ঘরে দাঁড়িয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, এবার আপনারা লক্ষ করুন কীভাবে হোলি স্পিরিট ঘরে এসেছিলেন। ভাল করে দেখুন কার্পেটের ওপর কী সুন্দর তাঁর পায়ের ছাপ পড়েছে। ওই যুদ্ধজাহাজের ছবি থেকে শুরু হয়েছে পায়ের ছাপ, সুইচবোর্ড অব্দি এসেছে, আবার ফিরে গেছে ছবিতে।

মির্না কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, তার মানে হোলি স্পিরিট ওই যুদ্ধজাহাজে থাকেন?

হ্যাঁ। যুদ্ধজাহাজের ভেতরেই তাঁর আস্তানা।

উৎপল সন্দিগ্ধ চোখে পাউডারের ওপর ফুটে থাকা স্পষ্ট পায়ের ছাপগুলো দেখছিল। বলল, এ তো দেখছি মানুষের পায়ের ছাপ!

পায়ের ছাপ তো মানুষেরই হবে উৎপলবাবু। হোলি স্পিরিট তো মানুষের মধ্যেই বাস করেন।

জোনাথন বললেন, আমি তো তোমার হেঁয়ালি কিছুই বুঝতে পারছি না। হোলি স্পিরিট! মানুষ! যুদ্ধজাহাজ! পায়ের ছাপ!

বোঝাচ্ছি। মিতিন পায়ে পায়ে জোনাথনের কাছে ফিরল। বৃদ্ধ মানুষটার হাত ধরে বলল, শুনুন মিস্টার মাইকেল। ঠাণ্ডা মাথায় শুনুন। হোলি স্পিরিটটিরিট কিছু নেই। আপনাকে ঘিরে, কিংবা বলা যায়, আপনার এই বাড়িটাকে ঘিরে গভীর চক্রান্তের জাল বোনা হয়েছে। নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কেউ একজন হোলি স্পিরিট আমদানি করেছেন।

কে? কে সে?

ধাপে ধাপে বলছি। মিতিন বড় করে শ্বাস নিল, আপনি যে আপনার বাড়িঘরদোর বেচার ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহী নন এ কথা আপনার পরিবারের সবাই জানে। এমনকি মিসেস জোনসও। কিন্তু যে-কোনও কারণেই হোক, সম্ভবত আপনার কিছু অর্থাভাব দেখা দিয়েছিল, আপনি ভাগলপুরের বাড়িদুটো বিক্রি করতে রাজি হন। তারপর থেকে আপনার পরিবারের কারুর কারুর ধারণা জন্মায় আপনি হয়তো এবার ইলিয়ট রোডের বাড়িটা বেচলেও বেচতে পারেন। কেউ ভেবেছে লোভে পড়ে বেচবেন। কেউ ভেবেছে চাপে পড়ে। আপনাকে প্রলুব্ধ করার উদ্দেশ্য নিয়ে এ-বাড়ির কোনও একজন এক প্রোমোটারের শরণাপন্ন হয়। সেই প্রোমোটারটি যথানিয়মে আপনাকে এসে মোটা টাকার টোপও দেয়, কিন্তু আপনি সরাসরি তাকে হাঁকিয়ে দেন।

সুরজমলের কথা বলছ? কে তার সঙ্গে কনট্যাক্ট করেছিল?

আপনার পুত্র। শ্ৰীমান রিচার্ড মাইকেল।

এত বড় সাহস তোর? আমায় না জানিয়ে….? জোনাথন রাগে গরগর করে উঠলেন, হোলি স্পিরিটের কারসাজি তবে কি ওরই?

বলছি। ধৈর্য ধরুন। মিতিন গলা ঝাড়ল, এ বাড়ি বেচার আগ্রহ কিন্তু আর একজনেরও আছে। কিংবা বলা যায় দুজনের। তবে তারা অনেক বুদ্ধিমান। আপনার বাড়ি বিক্রির বাসনা নেই জেনে তারা কিন্তু অনেক বেশি সতর্ক। তারাও যোগাযোগ রেখেছে প্রোমোটারের সঙ্গে।

সুরজমলের সঙ্গে?

না, অন্য প্রোমোটার। সে সুরজমলের চেয়েও ভয়ংকর। অবলীলায় খুনখারাপি করতে পারে। প্রয়োজন বুঝলে বাড়িতে আগুন লাগায়, আস্ত বাড়ি ধসিয়ে দেয়।

উৎপল উত্তেজিত মুখে বলল, এসব কী বলছেন আপনি? আপনি কি আমাদের দিকে আঙুল দেখাচ্ছেন?

গলা চড়াবেন না মিস্টার বিশ্বাস। আপনি কীভাবে এই বৃদ্ধ মানুষটিকে প্রতারিত করেছেন তা কিন্তু আমি জানি। ভাগলপুরের বাড়িদুটো চোদ্দো নয়, সাঁইত্রিশ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে। রাজনাথ সিং আমার কাছে সব ফাঁস করে দিয়েছে।

মির্না চেঁচিয়ে উঠল, লাই লাই। টোয়েন্টি সিক্স ল্যাক।

মিতিন আলগা হাসল, যাক, সত্যিটা স্বীকার করলেন তা হলে?

স্থানকালপাত্র ভুলে কথাটা বলে ফেলেই মির্নার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে। সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে তাকাচ্ছে সবার দিকে। জোনাথনের চোখে চোখ পড়তে একটু যেন কেঁপে উঠল।

জোনাথন স্তম্ভিত। বাক্যহারা। চোখের পলক পড়ছে না তাঁর।

উৎপল মিনমিন করে বলল, বিশ্বাস করুন ড্যাডি, আপনাকে ঠকানোর আমাদের ইচ্ছে ছিল না। হঠাৎ সার্কাসের চাকরিটা চলে গেল, রোজগারপাতি হচ্ছিল না বিশেষ, ভাবলাম একটা জিমনাসিয়াম তৈরি করি, অথচ হাতে টাকা নেই, আপনিও বললেন আপনার হাত ফাঁকা…..

তাই আপনি আর মির্না মিস্টার মাইকেলের কানের কাছে ভাগলপুরের বাড়ি বেচার ধুয়ো তুললেন। মিস্টার মাইকেল নিমরাজি হতে আর তর সইল না, বাজার যাচাই করতে ডিসেম্বর মাসে স্বামী-স্ত্রী ছুটলেন ভাগলপুর। মিস্টার মাইকেলকে না জানিয়ে। সেখানে গিয়ে একজন প্রবীণ সজ্জন মানুষকে ছোটাছুটি করিয়ে দুজন খদ্দেরও জুটিয়ে ফেললেন। দুটো বাড়ি মিলিয়ে পঁচিশ লাখ। কিন্তু আপনারা তখন লোভে অন্ধ। মিস্টার মাইকেল আপনাদের কত টাকা দেবেন না দেবেন সেই ভরসায় না থেকে গোপনে ডিল করলেন ওই ভয়ংকর প্রোমোটারটির সঙ্গে। এমন লোক যার কলকাতা ভাগলপুর দুজায়গাতেই ব্যবসা আছে। তারপর মিস্টার মাইকেলকে ভাগলপুর নিয়ে গিয়ে, কাল্পনিক একটা ভয় দেখানোর গল্প খাড়া করে হোটেলে আটকে রেখে, চোদ্দো লাখ টাকার দলিলে সই করতে বাধ্য করলেন। বাকি বারো লাখ আপনাদের পকেটস্থ হল। ওই টাকায় এবার একটা বাড়ির একতলা লিজ নিলেন, যন্ত্রপাতি কিনে ফেঁদে বসলেন জিমনাসিয়ামের ব্যবসা। সঙ্গে নিজেদের ফ্ল্যাটটাও নতুন ফার্নিচারে সাজানো হয়ে গেল। মিতিন চোখ টেরচা করল, কী, ভুল বলছি?

উৎপল গুম।

ডিক চেঁচিয়ে উঠল, দ্যাখে ড্যাডি, দ্যাখো! চিনে নাও তোমার আদরের মেয়ে জামাইকে। আমায় তো সহ্য করতে পারো না।

আপনি চুপ করুন ডিক। আপনিও কিছু সাধুপুরুষ নন। টাকার জন্য ছোঁকছোঁকানিও আপনার কম নেই। টাকা নিয়ে বুড়ো বাপকে ফেলে বিদেশ পালাতে চান। সেটাও কি ন্যায্য কাজ?

কিন্তু তার জন্য আমি কোনও চিটিংবাজি করিনি।

তার চেয়েও খারাপ কাজ করেছেন। সুরজমলের মতো শেয়ালকে ভাঙা বেড়া দেখিয়েছেন। একবার নাফার গন্ধ পেলে আর কি তাকে নড়ানো যায়? সুরজমল অতি ধুরন্ধর। একদিন মিস্টার মাইকেলের সঙ্গে দেখা করেই সে বুঝে গেছিল তাঁকে নড়ানো খুব সহজ কাজ নয়। খানিকটা পিছিয়েও গেছিল। তখনই সুরজমলের কপাল জোরে আকাশ থেকে উড়ে এল এক আশাতীত প্রস্তাব। এই বাড়িরই কেউ একজন সুরজমলকে বলল, বাড়ি আমি বিক্রি করিয়ে ছাড়ব, কিন্তু তার জন্য আমার কমিশান চাই।

ডিক গোমড়া মুখে বলল, নিশ্চয়ই এটাও উৎপলেরই কাজ?

উৎপল ঝেঁঝে উঠল, কক্ষনও না। তুমি তুমি।

একদম উলটোপালটা কথা বোলো না। খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।

এহ্, ধরা পড়ার ভয়ে মুখ ছোটাচ্ছে!

আপনারা থামবেন? আপনারা ছাড়াও এ বাড়িতে মানুষ থাকে।

কে? ড্যাডি? ডিক ভ্যাবাচ্যাকা মুখে বলল, কী যা তা বলছেন! ড্যাডি নিজের বাড়ি নিজে বিক্রি করে….!

আরও একজনকে আপনারা হিসেবে ধরছেন না, বলেই তড়িৎগতিতে দরজায় এসেছে মিতিন। খপ করে চেপে ধরল মিসেস জোনসের হাত। গম্ভীর স্বরে বলল, কী মিসেস জোন, আপনার হোলি স্পিরিটের খেলাটা আমি ধরে ফেললাম তো? কীভাবে কায়দা করে ফার্নিচার নাড়াতেন, খুলে বলে দিন।

ঘরে এই মুহূর্তে বজ্ৰপাত হলেও জোনাথন বুঝি এত চমকাতেন না। কথা বলতে গিয়ে তোলাতে শুরু করেছেন, কককী বলছ তুমি? আমাদের মিসেস জোনস…?

ইয়েস। ইনিই কুইন অফ স্পেড। এ বাড়ির যাবতীয় রহস্যময় ঘটনা এঁরই উর্বর মস্তিষ্কের ফসল।

হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠলেন মিসেস জোনস। ধপ করে বসে পড়েছেন জোনাথন মাইকেলের পায়ের কাছে, আমাকে ক্ষমা করে দিন মিস্টার মাইকেল। টাকার প্রয়োজনে আমার মাথার ঠিক ছিল না। ডাক্তার বলেছিলেন লাখ দুয়েক টাকা খরচা করে কোমরে একটা অপারেশন করাতে পারলে হয়তো একদম নরমাল হয়ে যাবে ডেভিড। আবার আগের মতো হাঁটতে চলতে পারবে। সেই আশায় আমি…। পাগলের মতো কার্পেটে মাথা ঠুকতে লাগলেন মিসেস জোনস, প্ৰভু যিশু আমায় ক্ষমা করবেন না। আমার নরকেও ঠাঁই হবে না। মিস্টার মাইকেলের মতো সোজাসিধে মানুষকে আমি ভয় দেখিয়েছি, কতশত মিথ্যে বলেছি..!

কারও মুখে কোনও কথা নেই। ঘর জুড়ে পাক খাচ্ছে মিসেস জোনসের কান্নার আওয়াজ।

টুপুরের বিস্ময়ের ঘোর কাটছিল না। পার্থ পাশ থেকে প্রশ্ন করল, কিন্তু মিসেস জোনস কী করে বন্ধ ঘরে ঢুকে গভীর রাতে ফার্নিচার নাড়াতেন? উনি তো রোজ সন্ধেবেলা বাড়ি চলে যেতেন?

আবার ফিরে আসতেন গভীর রাতে। সোজা রাস্তায় নয়, বাঁকা পথে।

কীরকম?

বাড়ির পশ্চিম দিকের পাঁচিলটা অনেকটা ভাঙা। তার ওপারে দুটো বাড়ির ফাঁক দিয়ে একটা সরু গলি আছে। গলিটা এঁকেবেঁকে গিয়ে পড়েছে রিপন লেনে। ওই রাস্তা দিয়ে এলে মিসেস জোনসের বাড়ি থেকে এ-বাড়ি বড়জোর মিনিট পাঁচেক। আমরা যেদিন প্রথম এবাড়িতে এলাম, মনে আছে সেদিন একটা ছেলে মির্নাকে দেখে পাঁচিল গলে পালিয়েছিল? ওই পথেই।

সে নয় হল। তবে তালা না খুলে ঘরে ঢুকবেন কী করে?

মাটি খুঁড়ে। যুদ্ধজাহাজ ভেদ করে, মিতিন হালকা হাসল, বুঝলে না তো?

বলেই মিতিন গটগট করে চলে গেছে যুদ্ধজাহাজের ছবিটার কাছে। কাঠের চ্যানেলের তলায় হাত রেখে কী যেন পরখ করছে। হাতড়াতে হাতড়াতে হাত এক জায়গায় এসে থামল। ওপর দিকে চাপ দিতেই অভাবনীয় দৃশ্য।

ছবিসুদ্ধ দেওয়াল মঞ্চের পরদার মতো সরে গেল দুপাশে। বেরিয়ে পড়েছে এক গহ্বর।

মির্না, উৎপল, ডিক দৌড়ে এসেছে। টুপুর, পার্থও। সকলে মিলে ঝুঁকে দেখল ফল্‌স দেওয়াল আর বাড়ির আসল দেওয়ালের মাঝের ওই ফাঁকটুকু দিয়ে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে ভূগর্ভে। মিতিন ঘুরে জোনাথনকে বলল, এই গুপ্ত বেসমেন্টের খবর কি আপনার জানা ছিল না মিস্টার মাইকেল?

জোরে জোরে মাথা ঝাঁকালেন জোনাথন, না তো। সত্যিই জানতাম না।

সেটাই স্বাভাবিক। যিনি এই গোপন বেসমেন্টটি তৈরি করেছিলেন তিনি তো বাড়ি কমপ্লিট হওয়ার তিন বছর পরেই ওপারে। তাঁর স্ত্রী মেয়ে হয়তো বা কথাটা জানতেন, তবে সেভাবে কারুর কাছে চাউর করেননি। তারপর তো মেয়ে বিয়ে হয়ে এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন, মা মারা গেলেন একসময়ে, ঘরটাও পাকাপাকিভাবে বন্ধ থাকত ব্যস, বেসমেন্টের খবর মোটামুটি চাপাই পড়ে গেছিল। ন্যান্সি মাইকেলের মৃত্যুর পর কোনও এক সময়ে ঘরটা ঝাড়াঝুড়ি করতে গিয়ে মিসেস জোনস আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন নীচের ঘরখানা। নেমে দেখুন, নীচে পৌছলে ডানদিকে একটা সুড়ঙ্গ পাবেন, তার শেষে আবার সিঁড়ি। ওই সিঁড়ি দিয়ে উঠলে মাথার ওপর লোহার ঢাকনা। ওই ঢাকনারই উলটো পিঠে লোহার আংটা আছে, যেটা এখন ঢেকে আছে ঘাসে। ওই আংটায় টান দিলেই সিঁড়ি মিলে যাবে নীচে নামার। আর নীচ থেকে ওপর ওঠার জন্য ঢাকনার ক্লিপে চাড় দিতে হবে একটা। ব্যস, আসা-যাওয়ার রাস্তা মিলে গেল। কী মিসেস জোনস, ঠিক ঠিক বললাম?

মিসেস জোনস করুণ চোখে তাকালেন। মুখে রা নেই।

মিতিন বলল, বুদ্ধিটা কিন্তু আপনি জব্বর বার করেছিলেন মিসেস জোনস। রাত্রির বেলা চুপি চুপি এসে লাঠি ঠুকে আওয়াজ করবেন, আর দিনের বেলা বুকে ক্রস এঁকে হলি স্পিরিটের গল্পে হাওয়া দেবেন। কদ্দিন আর মনের সঙ্গে যুঝবেন মিস্টার মাইকেল, হোলি স্পিরিটের আতঙ্কে একদিন না-একদিন তো ভেঙে পড়বেনই। ব্যস, আপনার কেল্লা ফতে, এন্ট্রি পেয়ে যাবে সুরজমল। কিন্তু হঠাৎ আমি এসে পড়ায় সোজা রাস্তাটা ঘোরালো হয়ে গেল। আপনার মনে ভয় ঢুকল বার বার একই কম্মো করতে গিয়ে যদি ধরা পড়ে যান। তাই ফার্নিচাররুমে উপদ্ৰবের ঘটনাটা কমিয়ে দিলেন। এবং সুরজমলকে আর একবার ঘাই মারার জন্য ঠেলে পাঠালেন। লাভ হল না দেখে শুরু করলেন অন্য খেলা। আরও বেশি করে ভয় দেখাতে চাইলেন মিস্টার মাইকেলকে।

পার্থ বলল, তার মানে কাচ ভাঙাটাও মিসেস জোনসেরই কাজ?

অবশ্যই। দেওয়াল-আলমারি ভাঙা। সেন্টার-টেবিল ভাঙা। শোকেস ভাঙা। বালব-টিউব ভাঙা। এসব কাজে অবশ্য অপ্রত্যক্ষভাবে একজন সাহায্য করেছেন। মিস্টার জোনস।

কীভাবে?

কাচ ভাঙার পদ্ধতিগুলো বাতলে দিয়েছেন তিনিই। মিস্টার জোনস কাজ করতেন ছবি বাঁধাইয়ের দোকানে। সেখানে কাচ কাটার জন্য ডগায় হিরে বা কোয়ার্টজের ছোট্ট কুচি লাগানো এক ধরনের কাঠি ব্যবহার করা হয়। হিরে বা কোয়ার্টজ দিয়ে কাচের গায়ে দাগ টেনে দিলে অতি সামান্য চাড়ে ভেঙে যায় কাচ। ওই দাগ টেনে দেওয়ার জন্যই কাচগুলো ভেঙেছে সরলরেখায়। এবং সবকটা কাচই ভেঙেছে কেউ-না-কেউ কাচে হাত ছোঁয়ানোর পর। অর্থাৎ সামান্য চাপে। মিসেস জোনসের পক্ষে বিকেলবেলা কাচগুলোতে ইচ্ছেমতন দাগ টেনে দেওয়ার কোনও অসুবিধেই ছিল না। কারণ ওই সময়টা তিনি একাই থাকেন, মিস্টার মাইকেল বেরোন বৈকালিক ভ্ৰমণে। এর পর সন্ধেবেলা থেকে শুরু হয়ে যায় কাচ ভাঙার উৎসব। অবশ্য বালব-টিউব ফাটানোর জন্য অন্য পন্থা। এর জন্য একটু কষ্ট করতে হয়েছে মিসেস জোনসকে। স্টোররুম থেকে ঘরাঞ্চি বার করে তাতে চড়ে বাথরুমের মিউরেটিক অ্যাসিড মাখাতে হয়েছে বালব-টিউবে। এটাও করেছেন উনি বিকেলবেলাই। আর সন্ধের পর যেই না বালব-টিউব জ্বালানো হয়েছে অমনি অ্যাসিড মাখানো কাচ তাত লেগে ফটাস। শুধু কালকে লাগানো এই ঘরের টিউবটাতেই উনি অ্যাসিড মাখানোর সুযোগ নেননি, সুইচ অফ করে ক্ষান্ত থাকতে হয়েছে। ভেবেছিলেন হোলি স্পিরিটই সুইচ অফ করেছেন বলে ধরে নেওয়া হবে। ওঁর আরও দুৰ্ভাগ্য, পাৰ্থর ছড়িয়ে যাওয়া লাইকোপোডিয়াম পাউডারের কল্যাণে কার্পেটের ওপর ফুটে উঠেছে ওঁর পায়ের ছাপ। ইস, কী বিশ্রীভাবে আপনি ধরা পড়ে গেলেন মিসেস মারিয়া জোনস।

মিসেস জোনস ড়ুকরে উঠলেন, আমি ঘোর পাপী। আমায় তুমি শাস্তি দাও।

মিতিন বলল, আমি শাস্তি দেওয়ার কে? আপনি তো অপরাধ করেছেন মিস্টার মাইকেলের কাছে। সাজা যা দেওয়ার তিনি দেবেন।

জোনাথন বড়সড় শ্বাস ফেললেন। ভার গলায় বললেন, কাকে শাস্তি দেব আমি? শুধু মিসেস জোনসকে? আর আমার ছেলে? আমার মেয়ে-জামাই? তাদের অপরাধের কী হবে? কী সাজা দিলে আবার আপনজনদের ওপর আমার বিশ্বাস ফিরে আসবে বলতে পারো? ওরা আমায় ভালবাসতে না পারে, আমি তো ওদের ভালবাসি। জীবনের শেষ কটা দিন ওদের ছাড়া আমি বাঁচবই বা কী করে?

জোনাথনের গলা ধরে এল। চোখ জলে ভরে গেছে। তাঁর সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে ডিক, উৎপল আর মির্না। জোনাথনের জন্য টুপুরের খুব কষ্ট হচ্ছিল। কী অসহায়। পরিস্থিতিতে যে পড়ে গেছেন মানুষটা!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *