জোড়া পা
কেউ একজন সাইকেলে এসে গাছতলায় বলে গেল, লাইনের পাশে বসে জগাদা বমি করছে, হেভি রক্ত! যে বলল সে আর দাঁড়াল না।
গাছতলার আড্ডাটা থতমত খেয়ে গেল। পাঁচজন এ ওর মুখের দিকে তাকাল। কোনও কথা না। বলেই পাঁচজন একসঙ্গে দৌড়ল লাইনের দিকে। যারা দূর থেকে দেখল তারা ভাবল আজ আবার হুজ্জতি হবে। এ পাড়ার লোক এমন দৌড়নো দেখতে অভ্যস্ত। এর পরেই বোমা ফাটবে। গাছতলার পাশের সিগারেটের দোকানে হরিপদ উদ্বিগ্ন চোখে তাকাল। সামনে দাঁড়ানো জগন্নাথ মিস্ত্রিকে জিজ্ঞাসা করল, কী হল? দোকান বন্ধ করব?
জগন্নাথ গোঁড়ালি তুলে এদের ছুটে যাওয়া দেখতে দেখতে বলল, একটু দাঁড়াও, সবই তো রেডি আছে, বোমের আওয়াজ পেলেই ঝাঁপ ফেলবে?
হরিপদ বলল, দূর শালা! আর ভালোগে না!
জগন্নাথ হাসল, ঝড় পেরিয়ে এলে কত এখন দমকা হাওয়ায় ভয় পাচ্ছ ভাই?
নিবারণ বিষ্ণু ওই পথেই আসছিল। কথাটা তার কানে যেতেই দাঁড়িয়ে পড়ল, হরিপদদা, গুজব ছড়িও না। সে সব দিন চলে গিয়েছে। এখন পাড়ায় যথেষ্ট শান্তি। তবে কেন ওভাবে ছুটে গেল তাই জানতে হচ্ছে।
জগন্নাথ বলল, জগা, মানে আমাদের জগন্ময় লাইনের ধারে বসে রক্তবমি করছে। একজন সাইকেলে চেপে এসে জানিয়ে গেল।
নিবারণ আঁতকে উঠল, সর্বনাশ! রক্তবমি কেন?
জগন্নাথ বলল, নিশ্চয়ই মাল খেয়েছে। দিনরাত মাল খেয়ে পড়ে থাকে।
নিবারণ আপত্তি করল, তোমাদের এই হুট করে কথা বলার অভ্যেস আর গেল না। জগন্ময় আগে ও সব খেত, এখন তার যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু রক্তবমি হবে কেন?যাই, একবার তারকদাকে খবরটাকে দিয়ে আসি।
নিবারণ বিষ্ণু চলে গেলে হরিপদ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, থাক গে! তারকদা এসে গেলে আর হুতি হবে না।
জগন্নাথ মাথা নাড়ল, তা অবশ্য। সব শালার টিকি ওর কাছে বাঁধা।
হরিপদ চাপা গলায় বলল, আস্তে কথা বল।
দেখা গেল পাশের বস্তি থেকে লিকলিকে রোগা রুক্ষ চুল নিয়ে একটি বউ ছুটে বেরিয়ে এল, তার পেছনে, পাঁচটি বিভিন্ন বয়সের বাচ্চা। বউটি এদিক-ওদিক চেয়ে কিছু দেখতে না পেয়ে ছুটে এল সিগারেটের দোকানের সামনে, কী হয়েছে? ওর কী হয়েছে?
হরিপদ সহানুভূতি আনল গলায়, পাড়ার ছেলেরা সব গিয়েছে। ওর বন্ধুবান্ধব।
কোথায় গিয়েছে? কেন গিয়েছে? বউটি চেঁচিয়ে উঠল। তার হাড়-সর্বস্ব শরীর থেকে যে আওয়াজ ছিটকে বেরুল তা বস্তির অনেক মানুষকে বাইরে টেনে আনল।
জগন্নাথ হরিপদর দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে চুপ করতে বলে ঘুরে দাঁড়াল, শোনা কথা, সঠিক কি হয়েছে জানি না মা। তবে শুনলাম জগন্নাথ রক্তবমি করছে লাইনের ধারে বসে।
শোনামাত্র ডুকরে কেঁদে উঠল বউটি। তারপরেই পড়িমড়ি করে ছোটার চেষ্টা করল। কিন্তু ততক্ষণে তাকে জড়িয়ে ধরেছে পাশে দাঁড়ানো একটি মেয়ে, কমলা বউদি, ও কমলা বউদি, শান্ত হও, ওরা তো গিয়েছে।
জগন্ময়ের বউ কমলা তখন হাল ছেড়ে দিয়ে ফুটপাতে পা ছড়িয়ে বসে কাঁদতে লাগল, ও মাগো, আমার কি হল গো, এই পাঁচ-পাঁচটা অনাথকে কে দেখবে গো? বয়সের কথা ভুলে যায়, মাল খেয়ে আবার কোথায় মারপিট করে মরেছে গো!
তাকে ঘিরে মেয়েদের ভিড় জমছিল। একজন ধমকে উঠল, আঃ, থামো তো। মাল তো এই বস্তির সব ব্যাটাছেলেই খায়। মানুষ না মরে গেলে কেউ ওভাবে কাঁদে? তোমার শাশুড়ির কথা ভাবো।
দেখা গেল জগন্ময়ের মা খানিকটা দূরে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। রোগা বেঁকে যাওয়া শরীর, চোখে ভালো করে দেখতে পায় না, মাথার চুল কদমফুলের মতো ছাঁটা। ময়লা আঁচল বাঁ হাতে তুলে মুখে চাপা দিয়েছে।
এইসময় একটা ট্যাক্সিকে এদিকে আসতে দেখা গেল। কাছাকাছি আসতেই পাড়ায় শোরগোল পড়ে গেল। ট্যাক্সির ভেতর থেকেই ছেলেরা চেঁচাচ্ছে। একজনের গলা কানে এল, কাপড় চাই, নইলে গামছা, হেভি রক্ত বের হচ্ছে।
ট্যাক্সি দাঁড়তেই দেখা গেল, অর্থাৎ বিশাল ভিড়ের মধ্যে যারা জানালায় পৌঁছতে পারল তারাই দেখল পেছনের সিটে জগন্ময় পাশ ফিরে শুয়ে আছে। তার মুখের চারপাশে রক্ত। ছেলেরা সেই রক্ত বাঁচিয়ে ট্যাক্সির মধ্যেই কোনওমতেই রয়েছে।
কমলা ঝাঁপিয়ে পড়ল, কী হয়েছে? ওগো তোমার কী হয়েছে? হায় কপাল, কি রক্ত! এত রক্ত কেন? কে মরেছে?
পাঁচজনের একজন সুনীল, সে ধমকে উঠল, কেউ মারেনি। হঠাই হচ্ছে। এই দেখি, তোর গামছাটা দে তো! উৎসুক একজনের ঘাড় থেকে গামছা টেনে নিল সে হাত বাড়িয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। তারকদকে খবর দাও কেউ। চলুন ভাই।
গামছাটা সে জগন্ময়ের মুখের সামনে পেতে দিল। জগন্ময়ের চোখ বন্ধ। ট্যাক্সির একজন বলল, বউদিকে সঙ্গে নিবি না?
বউদি? জায়গা কোথায়? তাছাড়া মেয়েছেলে ওখানে কী করবে? চলুন দাদা!
ট্যাক্সি বেরিয়ে গেল।
হঠাৎ সব শান্ত। ভিড়টা কিন্তু নড়ছিল না। মারপিট হয়নি, মুখ থেকে রক্ত পড়ছে। একজন গম্ভীর গলায় বলল, বুঝতে পেরেছি কি হয়েছে। সঙ্গে-সঙ্গে সবাই তার দিকে তাকাল।
হয় ক্যান্সার নয় টিবি। ক্যান্সার হলে বাঁচানো যাবে না। টিবি হলে বিস্তর খরচ।
হরিপদ বলল, টিবি হলে অত রক্ত পড়ে নাকি! খুকখুক কাশি, একটু-আধটু রক্ত। খেতে না পাওয়া রোগ। খোঁজ নিয়ে দ্যাখো এই বস্তির অনেকেরই ওই রোগ আছে!
তারপরেই গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। ক্যান্সার কত খারাপ অসুখ এই নিয়ে মানুষগুলো প্রায়। বিশেষজ্ঞের মতামত দিতে লাগল। কমলাকে ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সবাই এখন একমত, পরিবারটা একদম ভেঙে গেল। জগন্নাথের গলাই সবচেয়ে উঁচুতে উঠল, চিকিৎসাই বের হয়নি, কারণ কি থেকে ক্যান্সার হয় তাই কেউ জানে না। আমাদের কোম্পানির মালিকের বাবা, কোটি-কোটি টাকা, বুকের ক্যান্সার হল, আমেরিকায় নিয়ে গেল, বাঁচাতে পারল? ওসব গরিব বড়লোক বলে বাছবিচার নেই, ক্যান্সার হল সাক্ষাৎ মৃত্যু।
প্রচণ্ড রক্ত বের হয় আর কি যন্ত্রণা, চোখে দেখা যায় না। যার হয় সে তো গেল, সঙ্গে-সঙ্গে তার সংসারটাকে শেষ করে দিয়ে যায়। একজন মতামত দিল।
কেন? সংসার শেষ হবে কেন?
চিকিৎসার খরচ কি জানো? মাথা খারাপ হয়ে যাবে।
বাঁচবেই না যখন তখন চিকিৎসার চেষ্টা কেন?
সেটা কে বোঝে? লোকটা বিড়ি ধরাল, এই জগার বউ বুঝবে?
ওদের তো এই অবস্থা, পয়সা পাবে কোথায়?
এই সময় তারকাকে আসতে দেখা গেল। ভিড়টা এবার তাকে কেন্দ্রবিন্দু করে ছড়িয়ে পড়ল। সব শুনে তারকদা মাথা নাড়লেন, আমরা তো কেউ ডাক্তার নই যে চট করে রোগের নাম বলে দেব। রক্ত অনেক কারণে উঠতে পারে। মারপিট হয়নি যখন তখন বুকের কোনও শিরা ছিঁড়ে যেতে পারে হঠাৎ। মাল খেয়েছিল?
একজন বলল, হ্যাঁ।
খালি পেটে?
মালের পয়সার জন্যে ছোঁকছোঁক করত, খাবার পাবে কোথায়?
দ্যাখো এই হল ডিফারেন্স। বড়লোকেরা মদ খায় সেইসঙ্গে প্রচুর ফুড থাকে। শসা, মাংস, বাদাম। অ্যালকোহল পেটে গেলে সেগুলোকে হজম করতে-করতে অকেজো হয়ে যায়। আর যাদের পয়সা নেই, ফুড কিনতে পারে না। তাদের পেটে গিয়ে অ্যাকোহল সোজা পেটের ভেতরটাকেই খেতে শুরু করে। যাক গে। কি হল, মানে হাসপাতালের ডাক্তার কি বলল তা আমাকে জানিও। এমনি-এমনি তো হাল ছেড়ে দিতে পারি না। তারকা চলে গেলেন।
হরিপদর সিগারেটের দোকানের পাশে উবু হয়ে বসে ন্যাপা মাতাল তারকদার লেকচার শুনছিল। সে চলে যেতেই পিক করে থুতু ফেলল। তাই দেখে হরিপদ জিজ্ঞাসা করল, কী হল তোমার? অমন করলে কেন?
আচ্ছা বল তো হরি, মানুষ নিজে যেটাকে ঠিক মনে করে সেইটাকেই অন্যের ওপর চাপায় কেন? এই যে থুতু ফেললাম, পরীক্ষা করলে দেখবে এর মধ্যে ওই অ্যালকোহল আছে। কাল রাত্রে শেষ খেয়েছি। তবু আছে। কারণ গত পঞ্চাশ বছর ধরে আমি খেয়ে আসছি। এক ঠোঙা ছোলা আর। গলাতক দিশি, দিব্যি বেঁচে আছি। বাদাম মাংস শসার পয়সায় আর এক বোতল হয়ে যেত। যত জ্ঞানদাস! ন্যাপা মাতাল থুতু ফেলল। যারা এখন সবে মদে হাত দিয়েছে তারা এই প্রবীণ মাতালের কথা শুনে মনে-মনে খুশি হল। জগন্ময় যেভাবে হাসপাতালে গেল তাতে ভয় পেয়ে। গিয়েছিল সবাই।
এখানে উত্তেজনা বেশিক্ষণ থাকে না, যদি না উপলক্ষ্যকে সামনে দেখা যায়। ভিড় পাতলা হতে আরম্ভ হল। জগন্নাথ ন্যাপা মাতালকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার সঙ্গে জগা মাল খেত?
নো। কভি নেহি। হাঁটুর বয়সি ছেলে ও। তাছাড়া আমি যাই চলুর ঠেকে। এইসব ছেলেদের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। ওই যারা ট্যাক্সিতে গেল তারাই দল বেঁধে বের হত। আমার একটা প্রেস্টিজ আছে না? ন্যাপা মাতাল উঠে পড়ল।
ঘণ্টাতিনেক বাদে ছেলেরা ফিরে এল। ট্যাক্সি থেকে জগন্ময়কে ধরাধরি করে বস্তির মধ্যে চলে গেল ওরা। একজন ছুটে গেল তারকদার। ভিড় জমল গলিতে। টালির ছাদ, একটা তক্তাপোশ, মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাচ্চারা, জগন্ময়কে ওবাড়িতেই তক্তাপোশ শুইয়ে দেওয়া হল। একজন একটা প্ল্যাস্টিকের বালতি ওর মুখের পাশে রাখল, রেখে বলল, সাবধানে থাকবেন। বউদি, খুব ছোঁয়াচে রোগ। বাচ্চারা যেন কাছে না যায়।
কথাটা কমলার কানে গেল না। সে হাঁটু গেড়ে জগন্ময়ের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কাতর গলায় জিজ্ঞাসা করল, তোমার এমন হল কেন গো?কী বলল ডাক্তার?
চোখ বন্ধ অবস্থায় জগন্ময় চিঁচিঁ করে জবাব দিল, টিবি।
ঘরের দরজায় যারা উঁকি মারছিল তাদের গলা থেকে একটা আওয়াজ বের হল, ওঃ টিবি! তা হলে ক্যান্সার নয়! টিবিতে কোনও ভয় নেই, চিকিৎসা করলেই সেরে যাবে।
ঘরের কোণে দাঁড়িয়েছিল জগন্ময়ের মা। তার কথা শোনা গেল, হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে আনলে কেন? সেখানে কত ডাক্তার–।
না মাসিমা, এ হাসপাতালে টিবি রুগি রাখে না। টিবির জন্যে আলাদা হাসপাতাল আছে। সেখানে নিয়ে যেতে হবে। কোনও চিন্তা করবেন না, আমরা আছি। এই সরো-সরো, ভিড় হটাও। এ ঘরে আলো বাতাস আসতে দাও। ছেলেরা হইহই করে ভিড় সরাল। জগন্ময় হেঁচকি তুলল। ওর বউ সঙ্গে-সঙ্গে প্ল্যাস্টিকের বালতি তুলে ধরল মুখের সামনে। ওপাশ থেকে জগন্ময়ের মা। বলে উঠল, ও বউমা, ভাঙা কুঁজোটা নিতে পারতে, ওই বালতিতে কত কাজ হয়!
সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে মুখ-ভাঙা কুঁজোটা আনতে ছুটল কমলা।
তারকদা সব কথা মন দিয়ে শুনলেন। শুনে শব্দ বের করে নিশ্বাস ফেললেন, এ হবেই। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় এ হাওয়া অবধারিত। অসম সমাজব্যবস্থা, অর্থনৈতিক বৈষম্যের ফসল ফলবেই। দারিদ্র-নিপীড়িত মানুষ দুমুঠো ভালোভাবে খেতে পায় না, তাদের ফুসফুস অক্রান্ত হবেই। কিন্তু এর বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চলেছে, চলবে।
সুনীল বলল, কিন্তু তারকদা, চোখের ওপর জগা মরে যাবে?
মরবে মানে? আমরা কি মরে গেছি। তারকা প্রতিবাদ করলেন।
কিন্তু এই হাসপাতাল কিছুতেই রাখতে চাইল না।
তা তো রাখবেই না। ইনফেকসাস ডিজিজ!
কালোমানিক বলল, তাহলে কী হবে? বাড়িতে রাখলে ওর ফ্যামিলির হবে, পুরো বস্তির হবে।
তারকা বললেন, তেমনভাবে রাখলে কিছুই হবে না। কিন্তু ভালো ট্রিটমেন্ট হওয়া দরকার। ওকে এখনই টিবি হাসপাতালে ভরতি করে দিতে হবে। তোমরা নিয়ে যাও।
নিয়ে গেলেই ভরতি করে নেবে?
নেওয়া উচিত। তবে সারা দেশে অভাবী মানুষের সংখ্যা এত যে সিট খালি পাওয়া মুশকিল। ঠিক আছে, আমি টেলিফোন করে দিচ্ছি, তোমরা যাও।তারকদা বললেন।
সুনীল বলল, একটা প্রব্লেম হয়েছে। এই যে ট্যাক্সিতে নিয়ে গেলাম এলাম এতেই আমার কুড়ি টাকা খরচ হয়ে গেছে। টিবি হাসপাতালে যেতে তো অনেক লাগবে।
কালোমানিক বলল, তারপর চিকিৎসার খরচ, অতদূরে রোজ যেতে হবে।
তারকা মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ, ভালো-ভালো খাবার, ফলমূল। আসলে পথ্যটাই আসল। তারও তো খরচ প্রচুর।
সুনীল বলল, ওর কাছে এক পয়সাও নেই।
তারকদা চোখ তুললেন, তা হলে?
কালোমানিক বলল, চোখের সামনে ন্যাংটো বয়সের বন্ধু মরে যাবে?
তারকদা বললেন, অসম্ভব। এর প্রতিরোধ সবাই মিলে করতে হবে। এটা একটা জরুরি। মানবিক ইস্যু। তোমাদের আবেদনে পল্লীবাসীরা নিশ্চয়ই সাড়া দেবে। জগন্ময়ের চিকিৎসার খরচ তোলার জন্যে একটা ফান্ড তৈরি করো। সুনীল তুমি ট্রেজারার থাকবে। মনে রেখো, জনসাধারণের টাকা, প্রতিটি পয়সার হিসেব রাখবে।
সুনীল বলল, কিন্তু পাড়ার পাবলিক দেবে?
দেবে। মানুষকে এত অবজ্ঞা করো না। যাও, গাছতলায় একটা মাইক নিয়ে সবাইকে জড়ো করো। আমি ফোনটোন করে আধঘণ্টার মধ্যে আসছি। তারকদা উঠলেন।
জগন্ময় টিবি হাসপাতালে ভরতি হয়ে গেল। প্রথম দিনেই পাঁচশো টাকা চাঁদা উঠেছে। তারকার ফোনে কাজ হয়েছে। তারচেয়ে বেশি কাজ হয়েছে বক্তৃতায়। পাড়ার এক প্রবীণ প্রধান শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তারকা। তিনি জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছিলেন, জাপান বাহরিন আমেরিকায় টিবি হয় না। কারণ তাদের টাকা আছে। ওখানে এইডস হয়, কারণ ওটা বড়লোকের রোগ। এ দেশের না খেতে পাওয়া মানুষদের টিবি হয়। দেশের নাগরিক না খেয়ে রোগে পড়ছে কিন্তু সরকারের মাথাব্যথা নেই। আজ জগার হয়েছে কাল আপনার হতে পারে। একে পেটে খাবার নেই তার ওপর চারপাশে ধোঁয়া, কুৎসিত আবহাওয়া। এর সঙ্গে লড়াই করতে হলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে হবে। তাই জগন্ময় জীবনরক্ষা প্রকল্পে উদার হাতে দান করুন। একটি টাকা দান মানে আপনি বিপদের দিনে একজন বন্ধু পাচ্ছেন। খুব কাজ হয়েছে। গাছতলায় টেবিল পেতে ফেস্টুন লাগানো হয়েছে, জগন্ময় জীবনরক্ষা প্রকল্প। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত মাইক বাজছে হেডমাস্টার মশাইয়ের লিখিত বক্তৃতা উদ্ধৃত করে। যক্ষ্মার সঙ্গে লড়াই। করার জন্যে দলে-দলে মানুষ যে যার মতো দিয়ে যাচ্ছে। সেই টাকা নিয়ে সুনীল-কালোমানিকের দল টিবি হাসপাতালে ছুটছে দু-বেলা। আপেল আঙুরের সঙ্গে ওষুধ কিনে দিচ্ছে। ওষুধ পড়ার পর জগন্ময়ের মুখের চেহারা বদলেছে।
তৃতীয় দিনের সকালে কমলা এল বাচ্চাদের নিয়ে গাছতলায়। সুনীল তখন হাসপাতালে যাবে বলে হিসেব করছিল। কমলা বলল, আমরা দুইদিন খেতে পাইনি।
খেতে পাইনি মানে?
সে নেই, রোজগারও বন্ধ। যে বাড়িতে কাজ করি তারাও ফান্ডে টাকা দিয়েছে। বাজার করার পয়সা নেই। বাচ্চাগুলোর দিকে তাকাতে পারছি না।
কমলা চোখে আঁচল দিল।
কালোমানিক বলল, কিন্তু আমরা কী করব?
কমলা ক্যাশবাক্সের দিকে তাকাল, ওর নামে তো টাকা উঠেছে!
আরে এটা জগার চিকিৎসার জন্যে, অন্য খাতে খরচ করার অর্ডার নেই।
সে ওই টাকায় ভালো হয়ে এলে দেখবে আমরা মরে গেছি না খেয়ে, সেটা ভালো হবে?
আপেল আঙুর কেনা হয়েছিল। জগন্ময়ের বড় ছেলে আবদার ধরল সে আপেল খাবে। একজন তাকে ধমকাল। সুনীল শেষ পর্যন্ত দশটা টাকা এগিয়ে দিল, লোকে জানতে পারলে আমায় প্রশ্ন করবে, তবু দিচ্ছি। আর বিরক্ত করো না।
তিনদিনে পনেরশো টাকা উঠেছে। ওরা ট্যাক্সি নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছতেই শুনল ডাক্তারবাবু ডেকেছেন। অবস্থা কি খারাপ হল?দুই বন্ধু মুখ-চাওয়াচাওয়ি করল। জগাকে বাঁচাতেই হবে। ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হতেই তিনি গম্ভীর হলেন, এই পেশেন্টকে নিয়ে যান।
কেন?
এখানে ওকে রাখা যাবে না।
আশ্চর্য! এটা টিবি হাসপাতাল, জগার টিবি হয়েছে, রাখা যাবে না কেন?
আমার অন্য পেশেন্টের স্বার্থেই রাখা যাবে না। পেশেন্টের সিফিলিস আছে, তা জানেন?
সিফিলিস? চমকে উঠল ওরা।
ইয়েস। ট্রিটমেন্ট করিনি। খুব খারাপ অবস্থা। ওটা আগে সারিয়ে আনুন, তারপর টিবির চিকিৎসার জন্যে ভরতি করব।
দুটো চিকিৎসা এখানে হয় না? সুনীল মিনমিন করল।
না, হয় না।
সিফিলিসের কোনও হাসপাতাল আছে?
আমার জানা নেই। যান। রিলিজ করে দিচ্ছি।
যদি টিবিতে মরে যায়?
মরবে না। মরলে আগে সিফিলিসেই মরবে।
অগত্যা জগন্ময়কে ধরে ধরে ওরা হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়াল। সুনীল খুব খেপে গেল, তুই শালা সিফিলিস বাধালি কী করে?
জগামুখ নামাল, জানি না।
কালোমানিক বলল, মাল খেয়ে হুঁস থাকে না, কার না কার সঙ্গে–।
জগা চিনচিনে গলায় বলল, তোরা যেখানে যেতিস সেখানেই গেছি।
সুনীল চাপা গলায় বলল, তোর হয়েছে, আমাদের হল না কেন?
কার হয়েছে আমি জানব কী করে? হাসপাতালে না এলে তোরা জানতে পারতিস?
কিন্তু ডাক্তার বলল তোর অবস্থা খুব খারাপ!
হঠাৎ কেঁদে ফেলল জগন্ময়, আমি কি করব! ধন্য কবিরাজ তো ওষুধ দিচ্ছিল, কিন্তু কিছুতেই কমছিল না। এসব কথা কি কাউকে বলা যায়?
সুনীল জিজ্ঞাসা করল, মেয়েটার নাম কী?
জগন্ময় মাথা নাড়ল, জানি না।
দেখলে চিনতে পারবি?
হ্যাঁ। যন্ত্রণা হচ্ছিল জগন্ময়ের। ওকে সিঁড়িতে বসিয়ে রেখে সুনীল ইশারায় বন্ধুদের অন্যদিকে সরিয়ে নিল। জগন্ময়ের মুখেও এখন দাগ ফুটে বেরিয়েছে। যতই গামছা জড়িয়ে বসে থাক, কদিনেই বোঝা যাবে।
সুনীল জিজ্ঞাসা করল, এখন কী করা যায়?
কালোমানিক জবাব দিল, আর কি হবে, বাড়ি নিয়ে চল।
সুনীল মাথা নাড়ল অসম্ভব। পাড়ার লোকেরা যদি জানতে পারে ওর সিফিলিস হয়েছে, তা হলে কি হবে বুঝতে পারছিস?
কালোমানিক বলল, কী আর হবে? সিফিলিস তো সেরে যায়।
যায়, কিন্তু কেউ সিফিলিসের চিকিৎসার জন্যে সাহায্য দেয় না। পাবলিক ঘেন্না করে রোগটাকে। জগন্ময় জীবনরক্ষা প্রকল্প একদম ভোগে চলে যাবে। পয়সা ফেরত চাইতে পারে অনেকে। এখন ওর সিফিলিস সারাতে হবে, তারপর টিবি। অন্তত একবছর ধরে ফান্ড তুলতে হবে। কিন্তু খবরটা পাড়ায় পৌঁছলে সব খতম। সুনীল গম্ভীর গলায় বলল।
কালোমানিক এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পারল। তিনদিনে পনেরশো উঠেছে। খরচ হয়েছে। চারশোর মতো। রোজ অবশ্য পাঁচশো করে উঠবে না, পঞ্চাশও যদি ওঠে একবছরে আঠারো হাজার। পুরো টাকাটা চোখের সামনে থেকে চলে যাবে? সে কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, কী হবে গুরু?
সুনীল বলল, ওকে অন্য কোথাও রাখা দরকার।
কোথায় রাখবে? একে টিবি তার ওপর সিফিলিস! হাসল কালোমানিক, ওর বউ পর্যন্ত এখন আর ঘরে রাখতে চাইবে না।
কিন্তু আমাদের একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। যদ্দিন জগার টিবির চিকিৎসা হবে তদ্দিন–তুই বুঝতে পারছিস? আচ্ছা, একটা কাজ করলে হয় না? সুনীল আড়চোখে জগন্ময়কে দেখে নিয়ে চাপাস্বরে কালোমানিককে মতলবটা খুলে বলল।
ঘণ্টাখানেক বাদে ওদের ট্যাক্সিটা যেখানে পৌঁছল সেখানে এই প্রায় দুপুরেও দু-তিনজন সেজেগুঁজে দাঁড়িয়ে। জগন্ময়কে ট্যাক্সিতে বসিয়ে রেখে সুনীল নামছিল কালোমানিক বাধা দিল, ওকে না নিয়ে গিয়ে লাভ নেই। চেনা যাবে না।
অগত্যা জগন্ময়কে নামানো হল। জগন্ময়ের মুখ এখন গামছায় মোড়া। ধরে-ধরে নিয়ে যেতে হচ্ছে। টালির বস্তি। সস্তার বারবণিতারা এদের দেখে উঁচুগলায় ডাকাডাকি করছিল। সুনীল জগন্ময়কে জিজ্ঞাসা করল, এদের মধ্যে কেউ?
গামছা সরিয়ে জগন্ময় পিটপিট করে তাকাল। সব মুখ একরকমের মনে হচ্ছিল তার। সে মাথা নাড়ল। কালোমানিক ধমকাল, ঠিক করে দ্যাখ, এখানেই আসতিস তো?
গামছা সরানো মাত্র একটি মেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ও সুধা, দ্যাখ তোর পাখি এসেছে।
সুধা নামের মেয়েটি তার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। ক্ষয়াটে চেহারা। চোখমুখ বসা। কিন্তু মাথার চুল চকচকে! চিঁচিঁ গলায় জগন্ময় বলল, ওই যে।
ওরা জগন্ময়কে নিয়ে সুধার ঘরে ঢুকল! একটা তক্তাপোশ, আলনা, আয়না। একপাশে কাপড়টানা। সম্ভবত রান্না হয় সেখানে। জগন্ময়কে তক্তাপোশে বসিয়ে কালোমানিক ঘুরে দাঁড়াল, তোমার রোগ আছে?
একি কথা মাইরি! ঘরে ঢুকে বদনাম দিচ্ছ! সুধা খিঁচিয়ে উঠল।
সত্যি কথা বল, নইলে এক চড়ে ঘাড় ভেঙে দেব। কালোমানিক চিৎকার করল।
সুধা পিটপিটিয়ে তাকাল, আমার যাই থাকুক, তোমাদের কী?
আমাদের এই বন্ধু তোর কাছ থেকে অসুখ পেয়েছে।
ইল্লি আর কি! কচি খোকা! প্রমাণ আছে যে আমার কাছ থেকে পেয়েছে?
সুনীল এগিয়ে এল, কথা বাড়াচ্ছিস কেন? শোন সুধা, এখন থেকে তোর কাছে জগা থাকবে।
মানে? থাকবে মানে?
থাকবে। তুই খেতে দিবি। তোদের পাড়ায় তো ওইসব অসুখের চিকিৎসা জানা ডাক্তার আছে, তাদের দিয়ে চটপট ওকে সারিয়ে ফেলবি। এর জন্যে যত টাকা লাগে আমরা দেব। সুনীল বলল।
টাকা দেবে? সুধা জগন্ময়ের দিকে তাকাল।
হ্যাঁ। তুই না বললে তোর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। ওর যে অসুখ আছে তাতে তো তোর কোনও ভয় নেই। হিসেব করে বল কত টাকা লাগবে?
বলছ যখন তখন আমার আপত্তি কি! কিন্তু ও থাকলে আমার ব্যবসা চৌপাট হয়ে যাবে। সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেবে তো?
না।
তা হলে?
তোর ওই পরদার ওপাশে ওকে রেখে দিবি না হয়। এই নে, দুশো টাকা রাখ। আজই ডাক্তার ডাকবি। কালোমানিক এসে আবার তোকে টাকা দিয়ে যাবে। কিন্তু খবরদার, পাড়ার কেউ এলে ওর কথা বলবি না, মনে থাকে যেন। সুনীল শাসাল।
*
টিবি হাসপাতালে জগন্ময় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। তাকে বাঁচাবার জন্যে উদার হাতে অর্থসাহায্য করুন। জগন্ময় জীবনরক্ষা প্রকল্পের শরিক হন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটানা মাইকে ওরা যে আবেদন করে যাচ্ছিল তাতে দ্বিতীয় সপ্তাহের পরে আর তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। বড়জোর তিরিশ-চল্লিশ উঠেছিল। মাইকটা সুনীলের নিজের তাই হাল ছেড়ে দেয়নি ওরা। এই টাকাই বা কে দেয়! তৃতীয় সপ্তাহের সকালে ওরা মাইকে আবেদন করছে তখন দেখা গেল রিকশা থেকে সুধা নামছে। নেমেইে তেড়ে এল। আবেদন বন্ধ করে কালোমানিক রেগে কাঁই, তুই এখানে এসেছিস কেন?
আসব না? তোমরাঠগ, জোচ্চোর, আমাকে মেরে ফেলতে চাও?
মহিলা কন্ঠের চিৎকার শুরু হলে বস্তির মানুষ পুলকিত হয়ে শুনতে আসে। আজও সবাই ভিড় জমাল। কালোমানিক বেগতিক দেখে সুধাকে সরাতে চাইল, ঠিক আছে, কি বলতে চাস আমাকে আলাদা বল। ওঠ রিকশায়।
প্রায় জোর করেই ওকে রিকশায় তুলল কালোমানিক। পাড়ার বাইরে আসতেই রিকশাদাঁড় করাল সুধা, তোমরা আমাকে ঠকিয়েছ। জগার শুধু আমাদের অসুখ হয়নি, ওর মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। ডাক্তারবাবু বলল টিবি। তোমরা চেপে গিয়েছিলে।
আঃ, টিবি তো কি হয়েছে!
কী হয়েছে মানে? কী ছোঁয়াচে রোগ! খবর শুনে সব্বাই আমাকে দুষতে লাগল। কারও যদি টিবি হয় তো নির্ঘাৎ মেরে ফেলবে আমাকে।
বাঃ, টিবি কি সিফিলিসের চেয়ে খারাপ অসুখ?
ওসব জানি না। ওকে নিয়ে এসেছি। ওই রিকশায় পড়ে আছে। তুমি নামো, আমি চললাম। ডাক্তারবাবু বলেছে ফিনাইল দিয়ে ঘর ধুতে। এই জন্যে বলে, কারও উপকার করতে নেই।
কালোমানিককে নামিয়ে সুধা রিকশা নিয়ে চলে গেল। ফাঁপড়ে পড়ল কালোমানিক। সুনীলটা ধারেকাছে নেই। মুখে গামছা জড়িয়ে রিকশায় পড়ে আছে জগা। শালা আর রক্ত তোলার সময় পেল না। হাসপাতালের ওষুধে যে কাজ হয়েছিল তাতেই এতদিন চাপা ছিল। কিন্তু ওকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার নইলে ফান্ড বন্ধ হয়ে যাবে। রিকশাওয়ালাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে সে পাড়ায় এল। মাইক বন্ধ। সে সোজা কমলার ঘরে পৌঁছে গেল, একটা ব্যাপার হয়েছে!
মরে গেছে?কমলা আঁতকে উঠল। না, না।
হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিয়েছে।
হাসি ফুটল কমলার মুখে, সত্যি?
হ্যাঁ। কালোমানিক বাচ্চাগুলোর দিকে তাকাল। ওর যৌন রোগ হয়েছে।
কমলা বোকা হয়ে গেল, মানে?
কালোমানিক চোখ সরাল, জগা খারাপ পাড়ায় যেত। সেখানে রোগ পেয়েছে।
কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেল কমলা। তার দশ মিনিটের মধ্যে জগন্ময়কে প্রায় পাঁজাকোলা করে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হল ওর নিজের ঘরে। মাইক বন্ধ হল, ক্যাশবাক্স উধাও। আর হাওয়ার আগে খবর ছড়িয়ে গেল মহল্লায়। ছি-ছি শব্দ ছিটকে বেরুতে লাগল মানুষের মুখ থেকে। তত্ত্বাপোশে শুয়ে মুখে গামছা চাপা দিয়ে ছিল জগন্ময়, এবার কাতরাতে লাগল। বোঝা যাচ্ছিল তার যন্ত্রণা বাড়ছে। বাচ্চাদের নিয়ে ঘরের কোণে দাঁড়ানো কমলা স্বামীকে দেখছিল, হঠাৎ সে প্রশ্ন করল, তুমি এদের বাপ?
জগন্ময় জবাব দিল না।
মুখ ঢাকা। তুমি যে এদের বাপ তা বুঝব কী করে?
চিঁচিঁ গলায় কথা শোনা গেল, কমলি আমাকে বাঁচা।
বাঁচাব?যারা এতদিন আহা বলত তারা ছ্যা-ছ্যা করছে। মদ গিলে সে পাড়ায় যাওয়ার সময় মনে ছিল না?কী খেয়েছ সকাল থেকে?
কিছু না।কথা শুনতে হলে কান পাততে হয়।
বাচ্চাদের জন্যে একটু মুড়ি ছিল, খাবে?
কদিন ধরে গাছতলায় খুব গুলতানি চলল। একইসঙ্গে টিবি আর সিফিলিসের রুগিকে বস্তির মধ্যে রাখা ঠিক কিনা। এতদিন ধরে যে টাকা উঠেছে তার কি হবে। এই অর্থনৈতিক অব্যবস্থার। শিকার একটি মানুষকে বাঁচাবার জন্যে সবাই উদার হাতে দান করেছিল, কিন্তু সেই মানুষই এমন ঘৃণ্য রোগ বাঁধিয়ে বসে আছে যখন তখন আর কোনও সহানুভূতি পেতে পারে না। কিছু একটা করা দরকার। কেউ-কেউ বলছে টাকাগুলো কমলাকে দেওয়া হোক বাচ্চাদের বাঁচাবার জন্যে। জগা তো আজ নয় কাল মারা যাবেই।
সুনীলরা গেল তারকদার কাছে। তারকদা বললেন, এই হল ভবিতব্য। মানুষ লড়বে কার জন্যে? ঠিক সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া অভ্যাস কিলবিলিয়ে ঢুকে যাবে।
সুনীল বলল, ওই রোগ তত গরিবদেরই হয়।
কিন্তু এনেছিল বড়লোকরা। এই দ্যাখো জগন্ময়ের লড়াইয়ের সূত্র ধরে জনগণকে এক করলে তোমরা সেই ঐক্যে ভাঙন ধারনোর জন্যে এই রোগ চলে এল। তা এখন কী করতে চাও?
খুব বদনাম হয়ে যাচ্ছে। লোকে ফান্ডের টাকা ফেরত চাইছে।
ফেরত চাইলেই হল?
চাইছে তো। বলছে টিবির জন্যে দিয়েছি সিফিলিসের জন্যে নয়।
তা ঠিক।
আপনি একটা উপায় বলুন। জগাকে সামনে রেখে তো আর কিছু করা যাবে না।
তারকা সুনীলের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, কে বলল?
ওর নাম শুনলেই পাবলিক খেপে যাচ্ছে! বস্তিতে রাখতে চাইছে না।
ঠিকই তো। ওকে বাইরে বের করে আনো।
মানে?
ওর চেহারা কেমন এখন?
মুখ ঢেকে রাখে। হাঁটতে পারে না। সুনীল জানাল।
কালোমানিক বলল, মুখজুড়ে ঘা হয়ে গেছে।
তারকা খুশি হলেন, খুব ভালো। জগার টিবি তোমাদের সেলিং প্রোডাক্ট ছিল। যেমন ধরো আঙুর। বিক্রি হয়। শুকিয়ে গেলে কিসমিস। তাও বিক্রি হচ্ছে। তোমরা জগাকে অস্বীকার করো। বলো ও তোমাদের প্রতারণা করেছে। শুধু তোমাদের নয়, বউ ছেলেমেয়ে থেকে আরম্ভ করে। দরিদ্র জনসাধারণকে প্রতারণা করেছে। এরকম করলে শাস্তি পেতেই হবে। সেই শাস্তি কি তা সাধারণ মানুষ নিজের চোখে দেখে যাক। দেখে শিক্ষা নিক। আর এই দেখার জন্যে তোমরা। মাথাপিছু কুড়ি পয়সা চাঁদা নিতে পারো যা ওর পরিবারকে দেওয়া হবে। বুঝলে?
কালোমানিক মাথা নাড়ল, সে বুঝতে পারেনি।
তোমাদের গাছতলায় ডেকোরেটারকে দিয়ে একটা টেম্পোরারি ঘর বানিয়ে তার ভেতরে মাচা তৈরি করে জগাকে শুইয়ে দাও। পয়সা দিয়ে লোকে একদিক দিয়ে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে যাবে।
কিন্তু ওর চিকিৎসা?
টিবির ওষুধ খাওয়াও। কয়েকমাসের বেশি কোনও ফসলের সিজন থাকে না।
সুনীল হাতজোড় করল, ওর বউ যদি না আনতে দেয়?
সেটা তোমাদের কপাল।
তারকদা, আপনি–আপনি গ্রেট! সুনীল বলে ফেলল।
পাড়ার মানুষ প্রথমে বুঝতে পারেনি। ডেকোরেটারের লোকজন বাঁশ পুঁততে হরিপদ আপত্তি করছিল। নিবারণও। কেউ ওদের কথা শোনেনি। সুনীল এসে বলেছিল, হরিদা, এখন তোমার যা বিক্রি তার চারগুণ হবে, তোমার দোকান আড়াল করছি না।
বেশ মজবুত ব্যবস্থা হয়ে গেলে সুনীল কমলাকে ডেকে বোঝাল, সবাই আপত্তি করছে। পঞ্চাশ টাকা রাখো। জগাকে একটু খোলা হাওয়ায় রাখদরকার। অবশ্য পাড়ায় যদি না থাকতে চাও তো ওকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে পারো।
কালোমানিক বলেছিল, ডেইলি দশ করে পাবে কথা শুনলে।
অতএব আর আপত্তি ওঠেনি। মাঝরাত্রে ওরা বাঁশের খাঁটিয়ায় চাপিয়ে জগন্ময়কে গাছতলার ঘরে নিয়ে এল। জগন্ময় চিঁচিঁ করে আপত্তি জানাল। সুনীল গম্ভীর গলায় বলল, একদম চুপ। তুই বিখ্যাত হয়ে গেছিস এখন। হাজার-হাজার মানুষ তোকে দেখতে আসবে। উত্তমকুমার মরে গেলে যেমন দেখতে গিয়েছিল।
পরদিন ভোর থেকে মাইক বাজল। আসুন-আসুন, দলে-দলে আসুন, পাপের বেতন কি তা নিজের চোখে দেখে যান। ভগবান কাউকে ছেড়ে কথা বলেন না। এই জীবনে পাপের শাস্তি মরার আগেই পেতে হয়। নিজের ছেলেমেয়ে বউকে বঞ্চিত করে শুধু লালসা মেটাতে গিয়ে মানুষের কি হাল হয় নিজের চোখে দেখে যান। দর্শনমূল্য মাত্র কুড়ি পয়সা। আসুন, আসুন, মরে যাওয়ার আগে দেখে যান।
একটু-একটু করে ভিড় জমল। সন্ধের মুখে বিশাল লাইন। চার হাত দূর থেকে জনসাধারণ দেখল সারা গায়ে দগদগে ঘা নিয়ে জগন্ময় পড়ে আছে। উঃকী বীভৎস! রাত দশটায় দরজা বন্ধ হলে দেখা গেল আটশো টাকা উঠেছে। কালোমানিক হাসতে-হাসতে দশ টাকা পৌঁছে দিয়ে এল কমলার হাতে।
লিফলেট ছাপানো হল। তাতে একটি বীভৎস ছবি। ওপরে লেখা পাপের শাস্তি নিজের চোখে দেখে যান।
মানুষের ভিড় কমছে না। কমলা বা তার বাচ্চাদের এদিকে আসতে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় রাত্রে কমলা আর পারল না। চারধার ফাঁকা হয়ে গেলে সে কালোমানিকের পায়ে পড়ে গেল, আমাকে একবারটির জন্যে ওকে দেখতে দাও।
কী হবে দেখে? ওরকম বীভৎস স্বামীকে দেখার কী দরকার?
আমি ওর মুখে থুতু ফেলব।
কী?কালোমানিক চমকে উঠল।
হ্যাঁ। বেঁচে থেকে আমাকে জ্বালিয়েছে, এখন আধমরা হয়ে জ্বালাচ্ছে।
শুধু থুতু ফেলবে আর চলে আসবে, এই তো?
হ্যাঁ।
ঠিক আছে, রাত একটার সময় এসো। তখন হরিদার সিগারেটের দোকানও বন্ধ হয়ে যাবে।
কমলা গেল না, দূরের রকে বসে রইল। তার হাড়জিরজিরে শরীর নুয়ে পড়েছিল। কিন্তু একটা বাজতে না বাজতেই সে উঠে দাঁড়াল। সময় আন্দাজে ধরে নেওয়ার ক্ষমতা এখন তার আয়ত্তে। সে পা বাড়াল।
চারপাশ নিস্তব্ধ। পাড়ার মানুষজন ঘুমোতে গিয়েছে। কালোমানিকরা দরজা বন্ধ করে একজনকে পাহারায় রেখে গিয়েছিল। সে কমলাকে দেখে বলল, পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে আসবে।!
কমলা মাথা নাড়ল। ছেলেটা দরজা খুলে দিল। ভেতরটা অন্ধকার।
আলো নেই? কমলা দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করল।
আলোর কি দরকার? যা শরীরের অবস্থা, আলোয় দেখলে তুমিই কষ্ট পাবে। ছেলেটি ছোট্ট করে হাসল। তারপর একটা টর্চ এগিয়ে দিল, নাও, এটা নিয়ে যাও।
কমলা টর্চ জ্বালাল। সামনে দর্শকদের বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা। বাঁ-দিকে মোটা বাঁশের রেলিং। রেলিং-এর দুহাত দূরে মাচার ওপর জগন্ময় শুয়ে আছে। পেটের নিচ থেকে হাঁটুর ওপর পর্যন্ত একটা কাপড় ছড়ানো। কমলা ধীরে-ধীরে রেলিং-এর নিচ দিয়ে উবু হয়ে পাশে গিয়ে দাঁড়াল। হঠাৎ তার সর্বাঙ্গে কাঁপুনি এল। এই তার স্বামী?নাক মুখ বীভৎস রকমের ফোলা। লালচে দাগ কানের পাশে। চোখ বন্ধ। আলো নিচে নামাল কমলা। সারা গায়ে চাকা-চাকা দাগ। খুব খিদে পেয়েছে। জগন্ময়ের মুখ থেকে চিঁচিঁ শব্দ বের হল।
এরা খেতে দেয় না?
দুবারের বেশি দেয় না।
দুবার? তোমার ছেলেমেয়ের তো একবারও জোটে না!
কমলি, আমাকে বাঁচা। আমি মরে যাব। এত থুতু দেয় লোকে! কমলি রে!
থুতু দেয়?
হ্যাঁ। উঃ মরে গেলাম, কি ব্যথা! গোঙাতে লাগল জগন্ময়।
কমলা ওর বুকে আলো ফেলল। এত ঘা এই কদিনে কী করে বের হল? সে জগন্ময়ের শরীরে। চাপা দেওয়া কাপড়টার কোণ দিয়ে ঘায়ের ওপর চাপ দিতে সেটা উঠে গেল। একটু-একটু করে সারা শরীরের নকল ঘা তুলে ফেলল কমলা। পরিষ্কার চামড়া বেরিয়ে এসেছে। এবার মুখের। দাগ মুছতে যেতেই কাশির দমকে মাথা তুলল জগন্ময়। তারপর ছিটকে রক্ত বেরিয়ে এল তার গলা থেকে। সেই রক্তে সর্বাঙ্গ লাল হয়ে গেল তার। রক্ত পড়ল কমলার শাড়িতে, পায়ে।
টর্চটাঠক করে পড়ে গেল মাটিতে। দুহাত বাড়িয়ে শূন্য ধরার চেষ্টা করতে-করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল কমলা।
মিনিট পনের বাদে পাহারাদার ছেলেটি দেরি হচ্ছে দেখে ভেতরে পা বাড়াল। মাটির সমান্তরাল টর্চের আলো ধাক্কা মারছিল কমলার অজ্ঞান হয়ে থাকা দুই পায়ে। জোড়া পাদুটো টকটকে লাল, আলোয় আরও লাল হয়ে উঠেছে।
এমন দৃশ্য ছেলেটি কখনও দেখেনি। সে লাফিয়ে উঠল। তারপর পাঁই-পাঁই করে ছুটল সুনীলকে খবর দিতে। এই দৃশ্য দেখালে আরও বেশি দর্শক আসবে। একজনের জন্যে কৌতূহল বেশিদিন থাকে না। সে মনে-মনে আগামীকালের মাইকের ঘোষণার খসড়া তৈরি করছিল, আসুন, আসুন, জোড়া মানুষ লালে লাল, পতির পাপে সতীর শাস্তি দেখে যান, কুড়ি পয়সা, কুড়ি পয়সা!