প্রভাসরঞ্জন
আমার জীবন শুরু হয়েছে কয়েকবার। শৈশবে যে-জীবন শুরু করেছিলাম দেশভাগের পর তা শেষ হয়ে যায়। নতুন এক রুক্ষ ভিখিরির স্নেহহীন জীবন শুরু করেছিলাম। মধ্যে যৌবনে বিদেশে গেলাম নতুন আর একরকম জীবন শুরু করতে।
কতবার কতভাবে শুরু হল, আবার শেষও হয়ে গেল। এখনও আয়ু অনেকটা পড়ে আছে, কতবার আরও নিজের জন্ম ও মৃত্যু দেখতে হবে কে জানে?
ফেরার সময়ে সেই এরোপ্লেনেই যেমন, গেরিলারা যদি প্লেন হাইজ্যাক করে নিয়ে যেত, যদি মুক্তিপণ হিসেবে বন্দি করত আমাদের এবং যদি প্রতি ছ ঘণ্টা অন্তর এক-একজন যাত্রীকে গুলি করে মেরে ফেলত তাদের দাবির বিজ্ঞপ্তি হিসেবে? না, সে সব কিছুই হয়নি। না হলেও সেই কয়েকটা মুহূর্তের আকণ্ঠ মৃত্যুভয় আমাকে একেবারে শেষ করে ফেলল।
সেই রূপসী তরুণীটি দৈত্যকার লোকটির সঙ্গে দুর্বোধ্য ভাষায় চেঁচিয়ে কী বলছিল তা বোঝার সাধ্য আমার ছিল না। চোখের পলক না ফেলে হাঁ করে চেয়ে দেখছি দৃশ্যটা, আমার পাশে বসা বুড়োর নাকে বশির শব্দ হচ্ছে, বুড়ি অস্পষ্ট স্বরে কেঁদে কী যেন বলছে বুড়োকে। প্লেনসুদ্ধ যাত্রীরা আতঙ্কে চেয়ে আছে দৃশ্যটার দিকে।
মেয়েটা কথা বলতে বলতে এক পা দু পা করে এগিয়ে গেল লোকটার দিকে। লোকটা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে, চোখ দুখানায় বাদামি আগুন ঝলসাচ্ছে। তারা দুজন চারদিকে যাত্রীদের চোখকে গ্রাহ্য করছে না, যেন আর কেউ যে উপস্থিত আছে এ তারা জানেই না।
মেয়েটা খুব কাছাকাছি এগিয়ে গেলে দৈত্য লোকটার চোখ-মুখ হঠাৎ খুব নরম হয়ে গেল। দুটো প্রকাণ্ড গাছের গুঁড়ির মতো হাতে লোকটা সেই পলকা মেয়েটাকে বুকের মধ্যে টেনে নিল। তারপর চকাস চকাস করে চুমু খেতে লাগল।
ঠিক এরকমটার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। ডানদিকে একটা লোক হেসে উঠল। পাশের বুড়ি বুড়োকে বলেছে–ও গড, হি উইল ব্রেক দ্য গালর্স ব্যাক। পিছন থেকে একটা হাততালির শব্দ আসে। একজন বলে ওঠে–হ্যাপি এন্ডিং। পিছনের ইটালিয়ান বাচ্চাটা বিস্মিত স্বরে বলে ওঠে–ওরা কখন মারবে? চুমু খাওয়ার পর?
দুজন সুন্দরী হোসটেস এতক্ষণ সামনের দিকে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিল এদিকে চেয়ে। এবার তারা প্রাণ পেয়ে হাসিমুখে এগিয়ে আসে। দৈত্যটির পিঠে টোকা দিয়ে একজন জার্মান ভাষায় বলে-ইচ্ছে হলে আপনি বসতে পারেন। সামনের দিকে একটা টুইন সিট আছে।
লোকটা মেয়েটাকে খানিক নিষ্পিষ্ট করে মুখ তুলে বলেড্রিঙ্ক আনন, আমার তেষ্টা পেয়েছে।
পিছনে যেখানে আলিজা বসেছিল তার পাশের সিটে একজন দীর্ঘকায় সুপুরুষ মধ্যপ্রাচ্যের তরুণ ছিল। তাকে কেউ লক্ষ করিনি এতক্ষণ। সবাই ঘাড় ঘোরাচ্ছে দেখে আমিও পিছু ফিরে ছেলেটাকে দেখতে পাই। একটা বাদামি শার্ট গায়ে, গলার টাইটা আলগা, মুখটা অসম্ভব লাল, দাঁড়িয়ে আছে। মনে হল, সে এই প্রেমের দৃশ্যটা সহ্য করতে পারছে না, অসম্ভব রেগে গেছে এবং এক্ষুনি সে একটা কিছু করবে।
কী সে করত জানি না, তবে দৈত্যকায় লোকটির বুকে সেঁটে থেকেই মেয়েটা একবার পিছু ফিরে চেয়ে চোখের একটা ইশারা করল তাকে! সে বসে পড়ল ধীরে ধীরে।
দৈত্য লোকটা সেই মেয়েটিকে নিয়ে আরও সামনের দিকে কোথাও গিয়ে বসল।
আমি হোসটেসকে ডেকে একটু ড্রিংকস চাইলাম। আর সেটি পরিবেশনের সময়ে জিজ্ঞেস করতেই সুন্দরী হোসটেসটি মৃদু স্বরে বললভ ট্র্যাংগল।
কিন্তু একটু বাদে পিছনের ছেলেটি হোসটেসকে ডেকে নিচু স্বরে কী যেন বলল অনেকটা সময় ধরে। তারপর দেখি, তরুণী হোসটেস ছাইরঙ এক আতঙ্কিত মুখে খুব তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে বেতার-ঘরের দিকে। কিছু বুঝতে পারছিলাম না। হোসটেসের মুখের ভাব অনেকেই লক্ষ করেনি। তাই বেশির ভাগ লোক নিশ্চিন্তে বসে আছে। আমি স্বস্তি পাচ্ছিলাম না।
বেইরুটে প্লেন থামতে দরজা খুলে কয়েকজন বিশালদেহী যাত্রী উঠল। তাদের চেহারা হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর। উঠে মুহূর্তের মধ্যে তারা প্লেনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল চোখের পলকে দেখি তাদের হাতে হাতে উঠে এসেছে এল.এম.জি. কারবাইন, থাপন অটোম্যাটিক। চারজন সেই দৈত্যের মতো লোকটা আর তার বিশ্রিত বান্ধবীকে ঘিরে ফেলল। দুজন গিয়ে ধরল পিছনের ছেলেটিকে।
বাচ্চা হাতির মতো লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে পিছু ফিরে চাইল। রাগে তার মুখ টকটকে লাল। চেঁচিয়ে সে তার দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন গালাগাল করছিল পিছনের ছেলেটিকে। আর সেই ছেলেটিও কী যেন জবাব দিচ্ছে বেপরোয়া মুখে।
ছদ্মবেশী আর্মড গার্ড তিনজনকেই নামিয়ে নিয়ে গেল মেশিনগান আর অটোম্যাটিকের নল গায়ে ঠেকিয়ে। তারপর ঘণ্টাখানেক ধরে সার্চ করা হল প্লেন। গুঞ্জন শোনা গেল, ওই তিনজনই ছিল গেরিলা। বেইরুটের পর তারা প্লেন হাইজ্যাক করত। প্রেমের ত্রিকোণ বাধা হয়ে না দাঁড়ালে কী হত বলা মুশকিল। প্রেমে ব্যর্থ পিছনের ছেলেটি হোসটেসকে ডেকে তাদের সব গুপ্তকথা বলে দিয়েছিল।
গেরিলাদের ক্ষেত্রে এরকম বড় একটা হয় না, আমি জানি। সর্বত্রই আমি মৃত্যুণ গেরিলাদের লক্ষ করে দেখেছি। প্রেম তাদের কাছে কোনও সমস্যাই নয়। আমার এখনও মনে হয় ওরা গেরিলা ছিল না। পিছনের ছেলেটি নিজেদের গেরিলা বলে পরিচয় দিয়ে ইচ্ছে করেই গণ্ডগোল পাকিয়েছিল। কিন্তু সত্যিকারের ঘটনা কী তা আমি আজও জানি না। কিন্তু প্লেন বেইরুট থেকে উড়লে মনে হয়েছিল, আমরা আবার জীবন ফিরে পেলাম। আমি যে-জীবন ফিরে পেলাম সেটা কেমন? সে-জীবন শেষ হলেই বা কী ক্ষতি ছিল?
দমদমের দরিদ্র বাড়িটিতে এসে যখন পৌঁছোলাম তখন আমার বাবা-মা যথাসাধ্য আনন্দ প্রকাশ করলেন। ইতিমধ্যে আমার ছোট ভাই একটা বিয়ে করেছে। আমার ভাই, ভ্রতৃবধূও যথাসাধ্য খুশির ভাব দেখাল। ভাইয়ের সদ্য একটি ছেলে হয়েছে। আমি বিদেশ থেকে কিছু লোভনীয় জিনিস এনেছিলাম। সেগুলো বাড়ির লোকদের বিলিয়ে দিলাম। সবাই অসম্ভব খুশি হল তাতে। একেই তারা ভাল জিনিস চোখে দেখেছে কম, তার উপরে এত সব হরেক রকম মহার্ঘ দ্রব্য দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ল।
এই উত্তেজনা বাড়াতে আমার বোনেরা তাদের বাচ্চাকাচ্চা আর স্বামী নিয়ে চলে এল বেড়াতে। খুবই হতাশ হই তাদের দেখে। দুই ভগ্নিপতির মধ্যে একজনকে দেখলেই মনে হয় লোফার। অন্যজন কিছুটা ভদ্রলোক আর সুপুরুষ হলেও নির্বোধ। কারওরই সংসারের অবস্থা ভাল নয়। মা আমাকে চুপি চুপি জানাল, ছোট জামাই নাকি গুণ্ডামি, চুরি, ছিনতাই করে। বড়জন একটা প্রাইভেট ফার্মে কেয়ারটেকার।
এরা সব এক জায়গায় জুটতে খুব হট্টগোল হল। ঝগড়াঝাঁটিও প্রায়ই লেগে যায় দেখলাম। একদিন বাবা খুব গম্ভীরভাবে আমাকে গোপনে ডেকে নিয়ে বললেন–শোনো বাবা প্রভাস, তোমার ছোট ভাই আর তার বউ এখন চায় আমি আর তোমার মা আলাদা হয়ে অন্যত্র গিয়ে থাকি।
আমি অবাক হয়ে বললাম-আপনি আর মা যাবেন কেন? এ বাড়ি তো আপনার, দরকার হলে ওরা চলে যাবে।
-সে সব আইনের কথা শুনছে কে? আমাদের বুড়ো বয়সে আব তেমন তেজ নেই যে গলাবাজি করে গায়ের জোরে দখল রাখব। তার উপর নিজের সন্তান যদি শত্রুতা করে, তবে আর কী করার আছে? ওরা দুজনে মিলে আমাদের প্রাণ অতিষ্ঠ করে তুলছে দিন-রাত। তোমার মা অবশ্য ওদের দিকে টেনে চলেন, কিন্তু তাতেও সুরাহা হবার নয়। যদিওবা তোমার মাকে ওরা আশ্রয় দেয় আমাকে থাকতে দেবে না।
কথাটা শুনে আমি ভয়ঙ্কর রেগে যেতে পারি। হঠাৎ কেন যেন নিজের ছেলেবেলার কথা আদ্যন্ত মনে পড়ে! ভাবি, আমাদের নিষ্ঠুর ছেলেবেলা আমাদের স্বার্থপরতা ছাড়া আর কী শোবে! আমার ভাই তার নিজের জীবন ও পরিবেশ থেকে সেই শিক্ষাটাই নিয়েছে। ওর বউও খুব উঁচু পরিবারের মেয়ে নয়। কথায় কথায় মা একদিন বলে ফেলেছিলেন, বউমার মা নাকি ঝিগিরি করত। তবে আগে ওরা ভদ্রলোক ছিল, অবস্থার ফেরে এই দশা। সে যাই হোক, আমার ভাইয়ের বউ নিমি খুব খোঁপায় চোপায় মেয়ে। টকাটক কথা বলে, মেজাজ দেখাতে ভয় পায় না, কাউকে তোয়াক্কার ভাব নেই। এ ধরনের মেয়েরা সহজেই স্বামীকে বশ করতে পারে। মা বাবাকে আলাদা করার প্রস্তাবটি হয়তো তার মাথাতেই প্রথম এসে থাকবে। যথাসময়ে আমার ভাই সেই ভাবনায় ভাবিত হয়েছে।
বাবাকে বললাম–বোঝাপড়া করে নিন। আমিও বলবখন।
বাবা বললেন–এ বাড়ির অর্ধেক স্বত্ব তোমারও। আমি বলি কী, তুমি যখন এসেই গেছ ভাল সময়ে, তখন বাড়িটা ভাগ করে নাও। আমি তোমার ভাগে থাকব, তোমার মা না হয় তাঁর ছোট ছেলের কাছে ইচ্ছে হলে থাকবেন।
শুনেই আমার গা রি-রি করে ওঠে। এই ঘিঞ্জি কলোনির তিন কাঠা জায়গায় দীনদরিদ্র একটুখানি দরমার বাড়ি–এর আবার ভাগবাটোয়ারা! তার উপর এখানে স্থায়ী ভাবে থাকার ইচ্ছেও আমার কখনওই হয়নি। নিজের আত্মীয়স্বজন আমার এখন আর সহ্য হয় না।
আমি বললাম-ভাগ-বাঁটোয়ারা করার ইচ্ছে হয় না। এইটুকু জায়গা ভাগ করলে থাকবে কী?
বাবা বলেন–তবে বাবা, তুমি আলাদা কোথাও বাড়ি করো, বুড়ো বয়সে আমি গিয়ে তোমার কাছে শান্তিতে মরি।
আমি সামান্য ক্রুদ্ধ হয়ে বলি বরাবরই কি আপনাদের বোঝা আমাকে বইতে হবে না কি? একটা জীবন সংসারের পিছনে অপচয় করেছি। এখনও কি আমাকে স্বাধীনভাবে থাকতে দেবেন না?
বাবা খুব অবাক হয়ে বললেন–তোমাকে কোন কাজে কবে বাধা দিলাম বলো তো! ঠিক কথা তোমার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া হয়নি, কিন্তু অত ভাল সরকারি চাকরি ছেড়ে বিদেশে গেলে, আমরা তো বাধা দিইনি। এত বছর তো আমরা তোমার গলগ্রহ হয়ে থাকিনি। এই বুড়ো বয়সে এখন আর তোমরা ছাড়া আমাদের অভিভাবক কে আছে।
আমার নিষ্ঠুর মন এখন আর সহজে গলে না। খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললাম, আচ্ছা, সুহাসের সঙ্গে কথা বলে বাড়ি ভাগ করে দেব, আপনারা আমার ভাগেই থাকবেন। কিন্তু আমি এ বাড়িতে থাকব না।
বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলেন।
বাসায় খুব ভাল লাগে না। কারণ, এখানে আমার আপনজন বলতে কেউ নেই, সারা পৃথিবীতে কেউ নেই, একমাত্র নীলু ছাড়া। বোন ভগ্নিপতিরা চলে গেল, তবু বাড়িতে গণ্ডগোল থামে না। প্রায় সারাদিনই সুহাসের বউ নিমি বাবাকে বকাবকি করে। মা খুব একটা পালটা ঝগড়া করে না, কিন্তু ছেড়েও দেয় না। বাবা মাঝে মাঝে লাঠি হাতে তেড়ে ছেলের বউকে মারতে যায়। অমনি নিমি বেরিয়ে এসে কোমরে হাত রেখে ই-ইঃ মারবে! মারুক তো দেখি! বলে চেঁচায়। বাবা ভয়ে পিছিয়ে আসে, আর নিমি তখন এক নাগাড়ে যাচ্ছেতাই বলে যায়। আমি যে বিদেশ-ফের ভাসুর বাড়িতে আছি তা গ্রাহ্য করে না। ঝিয়ের মেয়েই বটে। সুহাস কোথায় কাজ করে তা আমি এখনও ভাল জানি না, তবে যা-ই করে, তা যে খুব উঁচু ধরনের কাজ নয় তা ওর আচার-আচরণ থেকেই বোঝা যায়। ওর সহকর্মীরা যে নিচুতলার লোক তা সুহাসের কথা শুনলেও টের পাই। কথায় কথায় মুখ খারাপ করে ফেলে। একটু আড়াল হয়ে বিড়ি টানে দেখি। বউকে নিয়ে সপ্তাহে দুবার নাইট শো দেখতে যায়।
বাড়ির খাওয়াদাওয়া অত্যন্ত নিচু মানের। আমি এসে অবধি বাড়িতে বেশ কিছু সংসার খরচ দিয়েছি, তবু খাওয়ার মান ওঠেনি তেমন। তবে মাঝে মাঝে আমার মুখরক্ষা করতে মুরগি বান্না হয়। প্রথম দিন আমাকে খাওয়ার সময়ে কাঁটা-চামচ দেওয়া হয়েছিল দেখে হেসে ফেলেছিলাম।
বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকতে পারিনি। বাইরে বাইরে খামোকা ঘুরে ঘুরে বেড়াই। কোথাও যাওয়ার ঠিক থাকে না। চাকরি-বাকরি করব, না ব্যবসা করব, তা নিয়ে ভাবি না। বেশ একটা ছুটি-ছুটি মনের ভাব নিয়ে আছি।
বিদেশে আমার যে টাকা জমেছিল তা নেহাত কম নয়। এ দেশের মুদ্রামানে প্রায় লাখ চারেক টাকা। তাই এখনই চাকরির জন্য ব্যস্ত হয়ে লাভ নেই। পাঁচুদার সঙ্গে খাতির ছিল। তার খোঁজ করতে গিয়ে শুনলাম ভদ্রলোক মরতে চলেছেন।