জীবনে যেমনটি হয়
চিত্তপ্রিয় চ্যাটার্জি অবসর নিয়েছেন বছর ছয়েক হল কিন্তু এখনও তাঁর শরীর-স্বাস্থ্য মজবুতই আছে। ভদ্রলোকের স্ত্রী গত হয়েছেন তিন বছর আগে। যাওয়ার আগে প্রায় তিন বছর ধরে শয্যাশায়ী ছিলেন। তাঁর চিকিৎসার কোনও ত্রুটি করেননি চিত্তপ্রিয়। কিন্তু তিন বছর ধরে একজন মৃতপ্রায় মানুষের সঙ্গে ক্রমাগত বাস করলে শোকের ধার কমে যায় বলেই স্ত্রী গত হওয়ার পর তিনি স্থির আছেন। এখন চিত্তপ্রিয়র সময় কাটে বই পড়ে এবং নিয়মিত ছেলেমেয়েদের চিঠি লিখে। বড়ছেলে অনুতোষ মাদ্রাজে আছে তার পরিবার নিয়ে। ভালো চাকরি করে সেখানে। মেয়ে অনন্যা দিল্লিতে। এরা সবই তাঁকে কলকাতার বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে তাদের কাছে চলে যেতে বলে। চিত্তপ্রিয় রাজি হননি। একটি চাকরের ওপর ভরসা করে দিব্যি আছেন তিনি।
যেহেতু বয়স বাড়া সত্বেও চিত্তপ্রিয় অশক্ত হয়ে পড়েননি, তাই তাঁর জীবনযাপনের ভঙ্গি একটু অন্যরকম। প্রত্যহ ভোরে তিনি কেডস পরে চার কিলোমিটার হাঁটেন। মদ অথবা সিগারেট ছেড়ে দিয়েছেন বছর কুড়ি হল। ইদানীং মাংস এবং ডিম খাচ্ছেন না। দীক্ষা নেওয়ার পর চিন্তাও করেননি, ওসব ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহও নেই। বাড়িতে ঠাকুর ও দেবতার কোনও ছবি নেই। ইদানীং তাঁর শখ হচ্ছে বেড়াতে যাওয়ার। ভারতবর্ষের বিভিন্ন দ্রষ্টব্যগুলোনা দেখে চলে যাওয়াটা ঠিক হবে না।
কিন্তু আজকাল চারধারে এত অব্যবস্থা যে, ইচ্ছা থাকা সত্বেও যেতে সাহস হয় না। ট্রেনের টিকিট নিয়েই তো কত ঝকমারি। শেষ পর্যন্ত চিত্তপ্রিয় ঠিক করলেন একটি বিখ্যাত স্পেশাল কোম্পানির সঙ্গী হবেন। হয়তো ইচ্ছেমতো ঘুরে দেখা হবে না কিন্তু টাকা দিয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত তো হওয়া যাবে।
সেইমতো ব্যবস্থা হল। দুন এক্সপ্রেসে হরিদ্বার। সেখান থেকে হৃষীকেশ হয়ে কেদার এবং বদ্রীনাথ। নামগুলোর গায়ে তীর্থের গন্ধ থাকায় একটু অস্বস্তি হয়েছিল প্রথমে, পরে ভেবে দেখলেন জায়গাগুলোর প্রাকৃতিক আকর্ষণ তো কম নয়। তিনি তো পুণ্য অর্জন করতে যাচ্ছেন না। প্রকৃতি দেখবেন প্রাণভরে। অতএব চাকরের হাতে সংসার ছেড়ে তিনি সুটকেস নিয়ে এক সন্ধেবেলায় হাজির হলেন স্টেশনে।
যে কামরায় তাঁদের যাওয়ার কথা তার সামনের প্ল্যাটফর্মে গিজগিজ করছে মানুষেরা। বেশির ভাগ বয়স্ক মানুষদের বিদায় জানাতে এসেছেন তাঁদের পরিবার। ব্যবস্থাপকদের বারংবার সাবধান করে দিচ্ছেন যাতে অযত্ন না হয়। কামরায় উঠে মেয়ে মায়ের জিনিসপত্র গুছিয়ে দিচ্ছে যাতে অসুবিধে না হয়, ছেলে বাবাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে সময়মতো ওষুধ খাওয়ার কথা। চিত্তপ্রিয় লক্ষ করলেন অধিকাংশ যাত্রীরই বয়স হয়েছে এবং কোনও আত্মীয়-সঙ্গী নেই। এতই যখন দুশ্চিন্তা তখন বিদায় জানাতে আসা আত্মীয়রা সঙ্গী হয়নি কেন?
চিত্তপ্রিয়র স্বভাব হল কারও সঙ্গে গায়ে পড়ে কথা না বলা। ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি লক্ষ করলেন, এতদিন অপরিচিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করেছেন এমন ভঙ্গিতে যে, অপরিচয়ের গন্ধটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
প্যাসেজের পাশে জানলার ধারে যে মুখোমুখি দুটো আসন থাকে তার একটি বরাদ্দ হয়েছিল চিত্তপ্রিয়র জন্যে। চিত্তপ্রিয় তাই চেয়েছিলেন। কারও সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে বসতে হবে না। কেউ গলা বাড়িয়ে কথা শুরু করতে পারবে না। ট্রেন ছাড়ার খানিক পরেই তিনি একটি বই খুলে বসলেন। ট্রেনে ওঠার আগে প্ল্যাটফর্ম থেকে ইংরেজি থ্রিলার কিনেছেন। কিন্তু আলোর তেজ এত কম যে ভালো করে পড়া যাচ্ছে না। নাকি চশমার পাওয়ার বদলাতে হবে! চিত্তপ্রিয় বই বন্ধ। করলেন। না, সত্যি তিনি এবার বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। শরীরে মেদ জমেনি বটে কিন্তু চামড়া শিথিল হয়েছে, কুঁচকে যাচ্ছে। চোখের নিচে বেশ ভাঁজ পড়েছে। এগুলো কখন অজান্তে এসে গেল। খেয়াল করেননি। চারতলায় উঠতে কষ্ট হয়। দৌড়াবার কথা ভাবতেও পারেন না। চোখের আর দোষ কী!
চিত্তপ্রিয়র উলটোদিকের আসনে যিনি বসেছিলেন তিনিও বৃদ্ধ। এই কামরা শেষ বয়সের মানুষে ঠাসাঠাসি। বৃদ্ধ বললেন, আমার শোওয়ার জায়গা পড়েছে ওপরে। বলুন তো, এই শরীর নিয়ে ওপরে উঠি কী করে? এত করে বললাম লোয়ার বার্থ দিতে, কানেই তুলল না। মশাই কি এই প্রথম?
চিত্তপ্রিয় মাথা নাড়লেন, না। মুখে কিছু বললেন না। কথা বললেই কথা বাড়বে। এবং সেসব কথা। যে অভিযোগের নামান্তর তাতে সন্দেহ নেই। বয়স হলে মানুষ সবসময় অসন্তুষ্ট থাকে!
এইসময় আর এক বৃদ্ধ ট্রেনের দুলুনি সামলে কোনওমতে এসে দাঁড়ালেন, ওহে হরিহর, উনি রাজি হয়েছেন।
হয়েছেন? উলটোদিকের বৃদ্ধ সোজা হয়ে বসলেন।
হবে না কেন? পাঁচটা দামড়া বুড়োর মধ্যে কোনও মেয়েছেলে একা বসে থাকতে চায়? বললাম, আপনার এখানে অসুবিধে হলে সিঙ্গল সিটে চলে যেতে পারেন। ওখানে হরিহর আছে, বললে চলে আসবে।
বৃদ্ধ বললেন, কিন্তু আমার শোওয়ার বার্থ যে ওপরে। ওঁর বয়স কত?
ষাটের মধ্যেই হবে। আগে এখানে পাঠিয়ে তো দিই তারপর দেখা যাবে। মালপত্র নিয়ে চলে এসো, জমিয়ে গপ্পো করতে-করতে যাওয়া যাবে।
দুই বৃদ্ধতে মিলে মালপত্র নিয়ে নড়তে-নড়তে চলে যেতে চিত্তপ্রিয় বেশ অস্বস্তিতে পড়লেন। উলটোদিকে একজন মহিলা বসে থাকলে অনেক ঝামেলা। তাঁকেই হয়তো নিজের লোয়ার বার্থ ছেড়ে ওপরে উঠতে হবে। না, তিনি উঠবেন না। টাকা দেওয়ার সময় পইপই করে বলেছিলেন বলে বার্থটা পেয়েছেন। এখন সেটা ছাড়তে রাজি নন। সবচেয়ে ভালো, কথা না বলা, প্রশ্রয় না দেওয়া, আর তাহলে ভদ্রতার মুখোশ পরতে হবে না। চিত্তপ্রিয় আবার বই খুললেন। ভালো। দেখতে না পাওয়া সত্বেও এমন ভাব করলেন যে, গভীর মনোযোগের সঙ্গে তিনি পড়ে চলেছেন। একটু বাদেই সুটকেস এল। সঙ্গে সাদা কাপড়। চিত্তপ্রিয় মুখ তুলে তাকালেন না।
উলটোদিকের আসনে কেউ বসলে কতক্ষণ না দেখে থাকা যায়? একসময় চিত্তপ্রিয়কে মুখ তুলতেই হল। মহিলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। যদিও এত রাতের অন্ধকারে। বাইরের কিছুই চোখে পড়ার কথা নয়। তবু তাকিয়ে থাকা। সাদা শাড়ির নীল পাড় কপালের একটু ওপর থেকে ঘোমটা হয়ে নেমেছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না স্পষ্ট, তবে বোঝা যায়, যৌবন পার হয়ে এসেছেন অনেককাল। আজকাল অনেক মহিলাই এইসব ভ্রমণ-কোম্পানিগুলোর ওপর ভরসা করে বাইরে যেতে পারছেন। ইনিও সেই দলের। নাক এবং হাত দেখে বোঝা যাচ্ছে। গায়ের রং একসময় খুবই উজ্জ্বল ছিল। চিত্তপ্রিয়র স্ত্রী সুস্বাস্থ্যবতী ছিলেন না, কিন্তু খুবই ফরসা। ছিলেন। মেয়ে অনন্যা তার মায়ের রং পেয়েছে। স্ত্রী-র সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কীরকম ছিল, তা আজও স্পষ্ট নয় চিত্তপ্রিয়র কাছে। কোনওদিন অমর্যাদা করেননি, কর্তব্যে অবহেলা হয়নি, রোগশয্যায় সেবা করেছেন, কিন্তু মারা যাওয়ার পর আবিষ্কার করলেন স্মৃতি ধূসর হয়ে আসছে। এখন তো তেমন করে মনেও পড়ে না। প্রেম-ভালোবাসার যে টানের কথা বইপত্রে পড়া যায়, তার। কোনওটাই জীবনে স্ত্রীর প্রতি অনুভব করেননি তিনি। উলটোদিকে বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত দ্বিতীয় কোনও মহিলার প্রতি তিনি আকর্ষণ বোধ করেননি। এখন পর্যন্ত শব্দদুটো মনে আসতেই। হেসে ফেললেন চিত্তপ্রিয় অন্যমনস্কভাবে। এই ষাটের ওপর পৌঁছে কোনও মহিলার প্রতি আকৃষ্ট হবেন তিনি?যাঁদের প্রতি হলে স্বাভাবিক দেখাবে তাঁদের তো বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। আর পঞ্চাশ ছাড়ালে বাঙালি মেয়েদের মন আর যাই হোক নতুন পুরুষের প্রেম গ্রহণের জন্যে বিন্দুমাত্র আকাঙ্ক্ষিত থাকে না। বাসনা আসে কিনা জানেন না, কিন্তু তা চেপে রাখতে রাখতে ও ব্যাপারে চৈত্রের দুপুরের মতো শুনশান হয়ে যান।
ভদ্রমহিলা মুখে ফেরালেন। তারপর দুটো হাত তুলে জানলার কাঁচ নামাবার চেষ্টা করলেন। ওঁর শক্তিতে কুলোচ্ছিল না। চিত্তপ্রিয় আর নিস্পৃহ থাকতে পারলেন না। বললেন, আমি দেখছি, আপনি একটু সরুন।
ভদ্রমহিলা তাকালেন। সামনের চুলে রুপোলি ছোপ, মুখের চামড়া বয়স হওয়া সত্বেও এখনও টানটান। চশমার ভেতর চোখদুটো। চিত্তপ্রিয় থমকে গেলেন। তাঁর মাথার মধ্যে যেন ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল। এইরকম ঘাড় বেঁকিয়ে বড় চোখে তাকানো, না হতে পারে না। মানুষের চেহারা বদলে যায়। ভঙ্গিও। সময় সবকিছু চমৎকার গিলে ফেলে। তাঁর নিজের কুড়ি বছরের চেহারার সঙ্গে এখনকার একটুও মিল নেই। ব্যাপারটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। শুধু চাহনি দেখে দুটো মানুষকে এক করে দেওয়া হঠকারিতা।
চিত্তপ্রিয় অনেকটা শক্তি প্রয়োগ করে জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে নিজের আসনে ফিরে এলেন। এসে দেখলেন ভদ্রমহিলা একইভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি এবার অস্বস্তিতে পড়লেন। সে ছিল ছিপছিপে, রোগা বলা ভালো। হলুদ শাড়ি আর হলুদ জামা পরতে খুব ভালোবাসত। কোঁচকানো চুল হাঁটুর কাছে নেমে থাকত ঝরনা হয়ে। ইচ্ছে করেই তাকে বন্দি করত না সে। আর ওই মুখ দেখে মনে হত পবিত্র শব্দটির বিকল্প আছে। তার সঙ্গে এর কোনও মিল নেই একমাত্র চাহনিটুকু ছাড়া।
চিত্তপ্রিয় মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আগ বাড়িয়ে কথা বলা তাঁর স্বভাবে নেই। মহিলাও পেছনে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। এখন আর বই পড়ার চেষ্টা করলেন না চিত্তপ্রিয়। অনেক, অনেকদিন। বাদে সেই অস্বস্তিটা আজ ফিরে এল তাঁর মনে। পেছন ফিরে তাকালে অনেক বছর পেরিয়ে যেতে হয় আর তার সংখ্যাটা মোটেই স্বস্তিজনক নয়। কিন্তু সত্য যা, তা চিরকালই সত্য।
জামসেদপুরে থাকতেন তখন। বাবা চাকরি করতেন টাটা কোম্পানিতে। কুলসি রোডের কোয়াটার্সে থেকে সদ্য কলেজে উঠছেন। ওই সময় সাকচিতে মানুষজন কম, সবাই সবাইকে। চেনে। স্কুলে থাকতেই চিত্তপ্রিয় ভালো ক্রিকেট খেলতেন, নামও হয়েছিল। সাকচির মাঠে শীতের ছুটির দিনগুলো কাটত। সেদিন ম্যাচ ছিল। ব্যাট করছিলেন তিনি। একটা ফুলটস পেয়ে সপাটে ঘুরিয়েছেন, এমন সময় চিৎকার উঠল। মাঠের ওপাশে বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার মাথায় গিয়ে পড়েছে বলটা। দু-হাতে মাথা চেপে ধরে বসে পড়েছে যে, তার পরনে চকোলেট রঙের শাড়ি, বয়স সতেরো কী আঠারো। সবাই ছুটে যেতে চিত্তপ্রিয়ও গিয়েছিলেন। মেয়েটার ফরসা আঙুলের ফাঁক গলে টকটকে লাল রক্ত বেরিয়ে আসছিল। সবাই মিলে মেয়েটাকে ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। মেয়েটির মা চিৎকার-কান্নাকাটি করে বকাঝকা শুরু করে দিলেন। ওভার বাউন্ডারির আনন্দ মুছে গিয়েছিল, নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল। ডাক্তার এল। আঘাত তেমন গুরুতর নয় কিন্তু স্টিচ করতে হল। সেদিন আর খেলেননি চিত্তপ্রিয়।
সেই মেয়ে, যার নাম সরমা তার সঙ্গে একদিন আলাপ হয়ে গেল চিত্তপ্রিয়র। আলাপ থেকে প্রেম। সরমার চুলের ফাঁকে তখনও ছোট্ট সাদা দাগ উঁকি মারত। জুবিলি পার্কে হাঁটতে-হাঁটতে সরমা বলেছিল, তুমি আমার মাথায় সারাজীবন থেকে গেলে।
সে বড় সুখের সময় ছিল। সুখের এবং আশঙ্কার। সপ্তাহে দু-দিন লুকিয়ে চুরিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে দেখা আর দিনরাত ভাবা। তারপর অবধারিতভাবে সেই দিনটা এল। সরমা কাতর গলায়। জানাল, তার বাবা বিয়ের ঠিক করেছেন, কিন্তু সে আত্মহত্যা করবে তবু অন্য কাউকে বিয়ে করবে না। এখন সবকিছু চিত্তপ্রিয়র হাতে। সে যেটা চায় তাই হবে। চিত্তপ্রিয় নাওয়া-খাওয়া ভুলে গেলেন। সরমাকে বাঁচাতে গেলে তখনই তাঁর একটি চাকরি দরকার। কিন্তু কে তাঁকে চাকরি দেবে? কলেজে পড়া এক তরুণ কোনও চাকরি করতে পারে? বাবা-মাকে বলে সাহায্য চাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না, কারণ তাঁরা প্রশ্রয় দেবেন না। বন্ধুরা পরামর্শ দিল সরমাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে। সেখানে চেষ্টাচরিত্র করে চাকরি জোগাড় করতে। আর সেই জায়গাটা কলকাতা হওয়া উচিত। অত লোকের ভিড়ে কেউ তাদের খুঁজে বের করতে পারবে না। সবাই মিলে চাঁদা তুলে হাজারখানেক টাকা জোগাড় করে দিল। সেই টাকা হাতে পেয়ে চিত্তপ্রিয়র মনে হয়েছিল পৃথিবীটা তার মুঠোয় এসে গেছে। সরমাকে প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন তিনি। জামসেদপুর থেকে। ট্রেনে কলকাতা। একটা সাধারণ হোটেলে থেকে চাকরির খোঁজখবর নেওয়া এবং সেটা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। সরমা বলেছিল, যদি না পাওয়া যায়? তিনি বলেছিলেন, পেতেই হবে। এ ঝুঁকি নিলে তোমাকে কখনও পাব না সরমা। তুমি আমার ওপরে ভরসা করতে পারছ না?
নিশ্চয়ই করি। আর চাকরি যদি না পাও ক্ষতি নেই, কোনওরকমে পেট চলার একটা কিছু জুটে যাবে। তোমার সঙ্গে বস্তিতে থাকতেও আমার আপত্তি নেই। শুধু–।
শুধু কী?
আমরা স্বামী-স্ত্রী না হয়ে একসঙ্গে যাই কী করে?
ব্যাপারটা মাথায় ছিল না চিত্তপ্রিয়র। তিনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছিলেন, সত্যি তো, সরমার সঙ্গে বিয়ে হবে কখন?কী করে? তারপরেই তাঁর খেয়াল হল। বললেন, আমরা কলকাতায় পৌঁছেই কালীঘাটের মন্দিরে চলে যাব। ওখানে শুনেছি গেলেই বিয়ে করা যায়। খোদ ঠাকুরের সামনে বিয়ে হলে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। কী, রাজি?
ওরা নিশ্চিন্ত হয়ে গল্প করছিল। একেবারে ভোরের ট্রেন ধরবে ওরা, যাতে বাড়ি থেকে সবার অলক্ষ্যে বেরিয়ে যেতে পারে। কয়েকটা জামাকাপড় ছাড়া সঙ্গে কিছু নেওয়ার দরকার নেই। চলন্ত ট্রেনের জানলার পাশে বসে দুজনে সূর্য ওঠা দেখবে। এখন এই মুহূর্তে শুধু বেড়াতে যাচ্ছি বললেও ওদের দুই পরিবারের কেউ ট্রেনে উঠতে দিতে রাজি হবে না। যেন ট্রেনে উঠলেই তরুণ তরুণী নষ্ট হয়ে যাবে। ওরা তখন স্বপ্নে ভাসছিল।
সরমা ধরা পড়ে গিয়েছিল। বাড়ি থেকে বেরুবার মুখে তার মা পথ আগলে ছিলেন। হয়তো চিত্তপ্রিয়র কোনও বন্ধুই ওই উপকার করেছিলেন, নয়তো মেয়ের স্বাভাবিক ভাবগতিক দেখে তাঁর সন্দেহ হয়েছিল। স্টেশনে অনেকটা বেলা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে এসেছিলেন চিত্তপ্রিয়। তখন তাঁর অবস্থা উন্মাদের মতো। বন্ধুরা বিকেলে খবর আনল সরমাকে নিয়ে তার বাবা-মা। কলকাতায় চলে গিয়েছেন।
তারপর আর কোনও যোগাযোগ নেই। সরমার বিয়ে হয়েছে এ খবর কানে এসেছিল। সে যে আত্মহত্যা করেনি জেনে স্বস্তি পেয়েছিলেন চিত্তপ্রিয়। সময় এমন একটা ওষুধ, যা সব দুঃখের স্মৃতি মুছে দেয় ধীরে-ধীরে। আরও পরে কলকাতায় চাকরি করতে গিয়ে তাঁর হাসি পেয়েছিল। সেদিন যদি সরমা ঠিকঠাক স্টেশনে আসত তাহলে দুজনের জীবন কীভাবে ভেসে যেত, তা। ভাবলে কষ্টের বদলে হাসি পায়। কারণ দুটো অপরিণত মস্তিষ্কের মানুষ শুধু আবেগ সম্বল করে জীবনের সঙ্গে লড়াই করতে চেয়েছিল, এটা হাস্যকর ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু একটু চাপা নিশ্বাস যে বুকের মধ্যে পাক খেত না তাই বা কে বলবে?নইলে অনেক পরে বাবার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করেও তিনি স্বাভাবিক হতে পারেননি কেন?কর্তব্য করা এক জিনিস আর ভেতর থেকে আসা ভালোবাসায় আঁকড়ে ধরা আর এক জিনিস। চিত্তপ্রিয় আবিষ্কার করেছিলেন সেই ভেতর থেকে আসার পথ সরমাকে হারানোর পর থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাপারটা তাঁর অজানা ছিল। বিয়ে পর্যন্ত। যে জাদুমন্ত্রে সেই দরজা খোলা সম্ভব হত, তা তাঁর স্ত্রী-র জানা ছিল না। অবশ্য এত বছর একসঙ্গে বাস করার পর তা নিয়ে আফশোশ করার কথা মনেও আসত না চিত্তপ্রিয়র। সরমার স্মৃতিতে ধুলো জমতে-জমতে কখন তা মনের আড়ালে চলে গিয়েছিল, তা টের পাননি তিনি। আজ হঠাৎই ওই চাহনির ঘূর্ণিঝড় এসে ধুলোর কিছুটা সরিয়ে দিতে অস্বস্তি শুরু হয়েছিল। চিত্তপ্রিয় উলটোদিকে বসা প্রৌঢ়ার দিকে তাকালেন। এই মেয়ে কি সরমা? তিনি মহিলার চুলের ফাঁকে দাগটা খোঁজার চেষ্টা করলেন দূর থেকে। ওই দাগ নাকি আজন্ম বহন করতে হবে সরমাকে! ছোট্ট একটা কাটা দাগ কি বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে মিলিয়ে যায়? ভালো করে চেহারাটা দেখলেন তিনি। না, তাঁর মনে একটুও উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে না। যে সরমাকে এক মাইল দূর থেকে আসতে দেখলেই হৃদয়ে কাঁপুনি আসত, তার বিন্দুমাত্র এখন নেই।
ট্যুর কোম্পানির কর্মচারীরা খাবার দিয়ে গেল। হালকা খাবার। ভালোই লাগল। রাত হচ্ছে। এবার শোওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। রাত নটার পরে যে-কোনও যাত্রী ইচ্ছে করলে তাঁর নিজস্ব জায়গায় শুতে পারেন। কিন্তু সেটা করতে হলে ভদ্রমহিলাকে বলা দরকার। ওঁকে ওপরে উঠে যেতে হবে।
কিন্তু কথাটা বলতে পারলেন না চিত্তপ্রিয়। তার বদলে নিজের বিছানা ওপরে করে নিলেন। টয়লেট থেকে ঘুরে এসে ওপরে উঠতে যাচ্ছেন, এমন সময় ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার নিচের বার্থ না?
হ্যাঁ, কিন্তু আপনার ওপরে উঠতে অসুবিধা হতে পারে ভেবে–।
ধন্যবাদ।
চিত্তপ্রিয় কোনও কথা না বলে ওপরে উঠে এলেন। বালিশে মাথা রেখে সরমার গলার স্বর মনে। করার চেষ্টা করলেন। চল্লিশের বেশি বছর আগে একটি তরুণীর কণ্ঠস্বর কীরকম ছিল আজ আর। কিছুতেই মনে এল না। তবে নিচে যিনি বসে আছেন, তিনি অবশ্যই সরমানন।
সকালবেলায় আবার মুখোমুখি। দু-একটা কথা হয়েছিল। প্ল্যাটফর্ম থেকে চা-ওয়ালাকে ডেকে ভাঁড়ে চা নিয়েছিলেন চিত্তপ্রিয়। মহিলাও চা চেয়েছিলেন। খুব সামান্য সাধারণ কথা এবং চিত্তপ্রিয়র আর কোনও সন্দেহ রইল না। তিনি স্বাভাবিক হলেন। ট্রেন দ্রুতগতিতে ছুটছিল। ক্রমশ আলাপ হল। ভদ্রমহিলা প্রতি বছরই বের হন। ছেলে টিকিট কেটে ট্রেনে চড়িয়ে যান। ট্যুরিস্ট কোম্পানির সঙ্গে ঘুরলে কোনও চিন্তা থাকে না। যতদিন স্বামী জীবিত ছিলেন ততদিনই নিজেরাই ঘুরেছেন। একমাত্র ছেলে, বড় চাকরি করে, তার সময়ের খুব অভাব। চিত্তপ্রিয় নিজের কথা বললেন। ভদ্রমহিলা হাসলেন, এবার দেখবেন এটাই আপনার নেশা হয়ে যাবে। আমার তো ভারতবর্ষ এদের সঙ্গে ঘুরে দেখা হয়ে গেল।
আপনি কি চিরকালই কলকাতায় আছেন? চিত্তপ্রিয় জিজ্ঞাসা করলেন।
না। বিয়ের পর এসেছি।
ও। বাবা বাইরে থাকতেন?
হ্যাঁ। জামসেদপুরে।
শোনামাত্র নড়ে-চড়ে বসলেন চিত্তপ্রিয়। জামসেদপুর! সেকি! তাহলে এই কি সরমা? তিনি। একটুও বুঝতে পারেননি?বুকের ভেতর বাতাস ধাক্কা মারছে। তিনি বললেন, আমিও একসময় জামসেদপুরের সাকচিতে থাকতাম।
আচ্ছা কবে?
অনেককাল আগে। কলেজে পড়ার সময়।
আমি স্কুল শেষ করেই শ্বশুরবাড়িতে চলে এসেছি।
ও। কিছু মনে করবেন না। আপনার নাম কি সরমা?
না তো। আমি কনক, কনকলতা মুখার্জি।
বাতাসটা বুক থেকে বেরিয়ে গেল এক নিমেষেই। চিত্তপ্রিয় বললেন, ও। আমার নাম চিত্তপ্রিয় দত্ত। একসময় সাকচিতে খুব ক্রিকেট খেলতাম।
ভদ্রমহিলার কপালে ভাঁজ পড়ল। যেন মনে করার চেষ্টা করলেন, আমার দাদাও খুব ক্রিকেট খেলত। অনিল ব্যানার্জি।
আরে, অনিল আপনার দাদা? আমরা দুজনে ওপেন করতাম।
তাই?
অনিল এখন কোথায়?
আমেরিকায়। ওখানেই সেটলড। দাঁড়ান, দাঁড়ান, আপনি কি একবার একটা মেয়ের মাথা বল মেরে ফাটিয়ে দিয়েছিলেন?
চিত্তপ্রিয় লজ্জা পেলেন, আমি ইচ্ছে করে ফাটাইনি। বলটা উড়ে গিয়ে পড়েছিল।
দাদার কাছে শুনেছি। তারপর মেয়েটির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায়, তাই না?
বাঃ এত কথা মনে রেখেছেন?
মনে যে ছিল, তা নিজেই জানতাম না। অল্পবয়সের ব্যাপার একটু খুঁচিয়ে দিলে আপনি উঠে আসে। দাদারা চাঁদা তুলেছিল আপনাদের জন্যে, এটা মনে আছে। কারণ আমাকে জমানো টাকা থেকে দশ টাকা দিতে হয়েছিল। সে সময় দশ টাকার প্রচুর দাম ছিল। কনকলতা হাসলেন, তা তিনিই আপনার সঙ্গে এতদিন–।
না। তার বিয়ে হয়েছিল অন্য জায়গায়।
সেকি! কেন?
সে সময় আমার রোজগার ছিল না।
আচ্ছা!
তখন মেয়েরা এভাবে ছেলেদের সঙ্গে বেরুতে সাহসও পেত না।
তা ঠিক। এই যে আমি একা যাচ্ছি, কতজনের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে, যেমন আপনার সঙ্গে গল্প করছি চলন্ত ট্রেনে বসে, তা নিয়ে কেউ কিছু ভাববেও না। কেন বলুন তো?
বোধহয় বয়সের জন্যে।
কনকলতা বললেন, তার মানে বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে মানুষের সবকিছু শেষ হয়ে যায়?
চিত্তপ্রিয় হাসলেন, মানুষ সেরকম ভাবতে পছন্দ করে। এই যে আপনি একা ট্রেনে যেতে-যেতে আমার সঙ্গে গল্প করছেন, কুড়ি বছর বয়সে পারতেন?
তখন ভালো-মন্দের তফাত তেমন করে বুঝতাম না। নিজের দায়িত্ব নিতে পারতাম না, তাই আড়ষ্টতা ছিল। এখন তো সেই সমস্যা নেই।
আপনার যুক্তি এটা। আত্মীয়স্বজন তখন যে আশঙ্কা করত এখন সেটা করবে না।
কনকলতা মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। বোঝা গেল তিনি এখন কথা বলতে চাইছেন না। কিন্তু তাঁর মুখের আদলের সঙ্গে খুব মিল খুঁজে পাচ্ছিলেন চিত্তপ্রিয়। একটা তরুণীর টানটান মুখে কতটা চর্বি এবং বয়স মিশিয়ে দিলে এই মুখ হয় জানা নেই, কিন্তু তাঁর মনে হত সরমাকে একদিন পরে দেখলে কি তিনি চিনতে পারতেন না? অসম্ভব।
হরিদ্বারে নামার পর ট্যুর কোম্পানির লোকেরা তাঁদের একটা ভালো হোটেলে নিয়ে গেল। চিত্তপ্রিয় আগেই বলে রেখেছিলেন তাঁর আলাদা ঘর চাই। সেই ব্যবস্থা হল। দু-রাত কনকলতার মুখোমুখি থাকার পর চিত্তপ্রিয়র একটু খারাপ লাগছিল এখন। যদিও সেই সংলাপগুলোর পর। তাঁদের আর তেমন কথাবার্তা হয়নি। তবু কনকলতার উপস্থিতি তাঁর ভালো লেগেছিল। কনকলতা এই হোটেলেই আছেন। তাঁর ঘর আলাদা। এ ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া অশোভন বলেই চিত্তপ্রিয় সেই চেষ্টা করলেন না।
সারাটা দিন একা-একাই ঘুরলেন তিনি। বিকেলে গঙ্গার ধারে হাঁটতে-হাঁটতে নানান রঙ্গ দেখলেন। রঙ্গ বলেই মনে হচ্ছিল। এক প্রৌঢ়া কপালে তিলক এঁকে বাজনা বাজিয়ে রামায়ণ গান করছেন, পাশেই গীতা পাঠ হচ্ছে। সর্বত্র বুড়োবুড়িদের ভিড়। গ্যাসের আলো জ্বলছে কথকদের সামনে। হাঁটতে-হাঁটতে ব্রিজের কাছে চলে এলেন তিনি। কনকলতাকে কোথাও দেখতে পেলেন না।
সন্ধে নাগাদ তাঁর শীত-শীত করতে লাগল। তারপরেই দুটো পা দুর্বল হয়ে পড়ল। শরীর ভালো বোধ না হওয়ায় হোটেলে ফিরে এলেন তিনি। হরিদ্বারে এখনও ঠান্ডা তেমনভাবে পড়েনি, তবু লেপের তলায় ঢুকেও শীত করছিল। চিত্তপ্রিয় বুঝতে পারছিলেন তাঁর জ্বর আসছে। অনেক অনেকদিন পরে অসুস্থ হচ্ছেন তিনি।
রাত্রে কোম্পানির লোক খাবার দিতে এসে জানল তাঁর অসুস্থতার কথা। তখনই ডাক্তার ডেকে আনা হল। জানা গেল চিত্তপ্রিয়র শরীরের তাপ তিন ছাড়িয়ে গেছে। ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। ঘুম ভাঙল যখন তখন সমস্ত শরীরে ব্যথা। মুখ বিস্বাদ। গায়ে জ্বালা। চোখ খুলতেই কয়েকটা মুখ। কোম্পানির ম্যানেজার জিজ্ঞাসা করল, কীরকম লাগছে?
ভালো না বলতে গিয়েও বললেন না চিত্তপ্রিয়। চোখ সরালেন। অবাক হয়ে দেখলেন কনকলতা রয়েছেন এ ঘরে। ম্যানেজার বললেন, ডাক্তারের মতে ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু আমরা তো কাল পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাব। এ অবস্থায় ওঁকে হাসপাতালে ভরতি করা ছাড়া কোনও পথ নেই। ওঁর পক্ষে একা ফিরে যাওয়া তো সম্ভব নয়।
চিত্তপ্রিয় তারপরের কথাবার্তা শোনেননি। ঢেউ-এর মতো ঘুম এসে ডুবিয়ে দিয়েছিল তাঁকে। বিকেল নাগাদ আবার সেই ঘুম ভাঙল। টয়লেট যাওয়া দরকার। উঠতে যেতেই বাধা পেলেন, কী হল?
কোনওরকমে মুখ ফেরাতে কনকলতার দেখা পেলেন। ঘরের কোণে চেয়ারে বসে আছেন কনকলতা। চিত্তপ্রিয় অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি?
আপত্তি আছে আমি থাকলে?
না, কিন্তু–। টয়লেট যাব।
পারবেন?
ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন চিত্তপ্রিয়। কাছে এসে তাঁর বাহু শক্ত করে ধরলেন কনকলতা, ইস, জ্বর দেখছি এখনও কমেনি। কী করে বাধালেন?
বেধে গেল।
টয়লেটের দরজা পর্যন্ত তাঁকে পৌঁছে দিলেন কনকতলা। সাবধান হতে বললেন। টয়লেট সেরে ফিরে আসার পর ভদ্রমহিলা আবার যত্ন করে তাঁকে শুইয়ে দিলেন, এবার একটু মুখে দিতে। হবে। তারপর ওষুধ।
আমাকে হাসপাতালে কখন নিয়ে যাবে?
কেন? সেখানে যাওয়ার খুব শখ আছে বুঝি?
তা নয়। আপনারা তো কাল চলে যাবেন?
যেতাম। কিন্তু এই অবস্থায় আমি যেতে পারছি না।
আপনি আমার জন্যে থেকে যাবেন?
কথা বলবেন না। নিন, এই ফলের রসটুকু খেয়ে নিন। কীরকম ডাক্তার এখানকার জানি না, দু দিনেও জ্বর কমাতে পারল না।
অনেক অনেকদিন পরে কারও সেবা পেলেন বলে মনে হল তাঁর। চিত্তপ্রিয় কনকলতার মুখের দিকে তাকালেন। কিন্তু তাঁর কথা বলার শক্তি কমে আসছিল। নিস্তেজ, দুর্বল হয়ে কনকলতার দিকে তাকাতে-তাকাতে মনে হল তিনি যেন সরমাকে দেখছেন। কিন্তু সরমা কি এরকম দেখতে হয়েছে এখন? চোখ বন্ধ করলেন চিত্তপ্রিয়।
তৃতীয় দিনে ডাক্তারের নির্দেশে চিত্তপ্রিয়কে হাসপাতালে যেতে হল। ট্যুরিস্ট কোম্পানি অন্যদের নিয়ে বেরিয়ে গেল তাদের প্রোগ্রামমতো। কনকলতা গেলেন না। হোটেল ছেড়ে তিনি একটি আশ্রমে উঠে গেলেন। দু-বেলা হাসপাতালে আসেন, ফল-ওষুধের ব্যবস্থা করেন। একেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে আসা-যাওয়া।
একদিন, চিত্তপ্রিয় যখন অপেক্ষাকৃত সুস্থ তখন সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি আমার জন্যে এত করছেন কেন?
কনকলতা হাসলেন, অনেকে দিতে কার্পণ্য করে বলে জানতাম, কেউ-কেউ নিতেও কুণ্ঠিত হয়, তা আপনাকে দেখে বুঝতে পারছি।
কুণ্ঠা কি অকারণে?
হ্যাঁ। আপনি আমার দাদার বন্ধু ছিলেন। বিদেশবিভূই-এ আপনি অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন দেখে
আমি মুখ ঘুরিয়ে চলে যাই কী করে? যদি আপনার পরিচয় না জানতাম তাহলে অন্য কথা ছিল।
কিন্তু আমার জন্যে আপনার বেড়ানো হল না যে।
অনেক কিছুই তো জীবনে হয়নি।
আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে।
কী?
আপনি সরমা।
পাগল! আমি সরমা হতে যাব কোন দুঃখে? আপনি তার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন, সে সেই স্মৃতি নিয়ে থাকুক, আমি কেন সরমা হব?
ট্যুরিস্ট কোম্পানি ফিরে আসার আগে সম্পূর্ণ সুস্থ হননি চিত্তপ্রিয়। ফেরার সময় এক ট্রেন, কিন্তু আগের মতো মুখোমুখি আসন নয়। কনকলতা বসেছেন তিনটে কুপের ও-পাশে। ব্যবস্থাটা কে করল তা চিত্তপ্রিয় জানেন না। তাঁর সামনে বসা বৃদ্ধকে তিনি জায়গা বদল করার কথা লজ্জায় বলতে পারলেন না।
হাওড়া স্টেশনে নামার পর কনকলতা কাছে এলেন, একা যেতে পারবেন?
পারব।
তাহলে চলি।
চিত্তপ্রিয় কিছু বলার আগে এগিয়ে আসা এক যুবককে দেখালেন কনকলতা, আমাকে নিয়ে যেতে এসে গিয়েছে। ভালো থাকবেন।
আমি কিন্তু ঠিকানাটা জানলাম না।
কনকলতা হাসলেন, কী দরকার! চলি।
কনকলতা চলে গেলেন, প্ল্যাটফর্মে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলেন চিত্তপ্রিয়। ঠিকানা তিনি ইচ্ছে করলে পেতে পারেন। ট্যুর কোম্পানির খাতায় নিশ্চয়ই ওঁর ঠিকানা লেখা রয়েছে। কিন্তু সত্যি তো, ঠিকানা নিয়ে তিনি কী করবেন? কনকলতা যদি সরমাই হয় তাহলেই বা কী করা যেতে পারে?
হ্যাঁ, তিনি প্রশ্নটা করতে পারেন, কেন সেই দিন স্টেশনে এল না?উত্তর যাই হোক তাতে তো এখন আর জীবন বদলাবে না।
গোমুখে যে জল পবিত্র, হরিদ্বারে যার স্পর্শে শান্তি সেই গঙ্গার জল কালীঘাটে শুধু দুর্গন্ধ ছড়ায়। বয়ে-আসা নদীকে কেউ আর ছেড়ে যাওয়া ঘাটে-ঘাটে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে না। এরই নাম জীবন। বেঁচে থাকতে হলে এই সত্যিটা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই।