Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জিয়োনো মাছ || Samaresh Majumdar

জিয়োনো মাছ || Samaresh Majumdar

চা চুরির জন্য চাকরিটা চলে গেল বংশীর। অথচ ব্যাপারটা এমন কিছু গুরুতর নয়, সবাই চুরি করে, কেউ সাধু নয়। মেয়েগুলোর সুবিধে একটু বেশি, আংরার তলায় পুঁটলি বেঁধে বেশ নিয়ে যায়, চৌকিদার শালা তখন চোখ বুজে থাকে। পোয়াতি মেয়েদের তো পোয়াবারো, তলপেটের সঙ্গে সাইজ মিলিয়ে ওপপেটে চা বেঁধে নেয়। বিরাট গুদামে পাহাড় করা চায়ের পাতা, কাঠি বাছাই চলছে দিনরাত। গাদাগাদা কামিন আর বুড়ো কুলিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। চারধার টাটকা চায়ের গন্ধে ম-ম করছে। বাছাই চায়ের প্যাকিং চলছে একধারে। ঠুকঠাক শব্দ হচ্ছে। পেরেকের। মাঝে-মাঝে গুদামবাবু টহল দিয়ে যাচ্ছে মশমশ করে পাতা ডিঙিয়ে। কামিনদের। কাঁখের বাচ্চাগুলো পা ছড়িয়ে সেই চায়ের ওপর গু-মুত ছড়াচ্ছে–তার বেলা কিছু নয়, শুধু বংশী যখন আর না পেরে কয় মুঠো পাতা চা কোঁচরে ভরে ছুটির ভোঁ বাজলে যেই বেরুতে গেল সঙ্গে সঙ্গে চৌকিদার শালা ওর পেট ধরল খামচে! এ্যাদ্দিন পাতা তুলত বংশী। পিঠে ঝুড়ি নিয়ে ট্রাকে চেপে চলে যেত খুঁটিমারী ডিমডিমার ধারে। সারাদিন পাতা তুলে সন্ধেয় ফিরে আসত গুদামে। পাতিবাবু ওজন করে পাতা নিত দেখেশুনে। ব্যস ছুটি। সেই কাঁচা পাতা কি করে চেহারা পালটে ম-ম গন্ধ ছড়ানো চা হয়ে যায়, কোনওদিন দেখার সুযোগ হয়নি। তাগড়া জোয়ানদের গুদামের কাজে নেওয়া হয় না। কিন্তু সেদিন আংরাভাসার গায়ে চা-পাতা তুলতে গিয়ে সেই শালা গোলাপটা এমন চোট দিল পায়ে যে তিনমাস হাসপাতালে ওষুধ গিলতে হল ওকে। বেরিয়ে আসার পর হাঁটতে গেলে খোঁড়াতে হয়। দগদগে ঘা শুকিয়ে গেলেও পা-টা হয়ে আছে কাঠির মতোন লিকলিকে। শরীরে তাগদ বলতে কিছু নেই। কোনওরকমে গুদামে কাজ মিলল ওর। আরামের চাকরি। হপ্তা গেলে পেটভরতি ভাতের টাকা মেলে, সুরজপ্রসাদের ভাঁটিখানায় এক বোতল করে হাঁড়িয়াও কুলিয়ে যায়। তিন নম্বর কুলি লাইনের শেষ ঘরটায় সারারাত নেশা করে শুয়ে থাকে বংশী। বউটা ছেলের বয়সি একটা মিস্ত্রির সঙ্গে ভেগে গেছে বিনাগুঁড়ি। বেশিদূর নয়, ইচ্ছে করলেই গিয়ে দেখে আসতে পারে। কিন্তু ইচ্ছেটাই হয় না। বউটা এ্যাদ্দিন ছিল বাঁজা, গতর টসকায়নি। উড়ো খবর আসে, এবার নাকি বিয়োবে। যারা খবর দেয় তারা বংশীর দিকে তাকিয়ে মুচকি-মুচকি হাসে। ভাবখানা এমন, তোমার কেরামতি ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু সেসব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায় না বংশী। মেয়েছেলের জাত পোষ মানে না কখনও। পুরুষমানুষ যদি পেট আর দিলে সুখ রাখতে পারে–চাই কি আর! পেট ভরলেই তো দিল ভরে। কিন্তু শালা সোনিরাম মুদি লোভ দেখাল, ওরে বংশী, শুনলাম গুদামে কাজ করছিস, নিয়ে আয় চামুঠি কতক দশ টাকা কিলো দেব। ব্যস, লোভ শালা হেলে সাপের মতো লিকলিকিয়ে উঠল সারা গায়ে। মাত্র তিন মুঠো চায়ের জন্য চাকরি খতম করে দিল গুদামবাবু। এক বোতল হাঁড়িয়ার দাম হতো চা-টায়। কপালে যা বাঁধা তার বেশি চাইতে গেলেই ফেঁসে যেতে হয়–কেউ যদি এ খবরটা আগে বলে দিত!

ধরা পড়ার পরই হয়ে গেল কেচ্ছাটা। চৌকিদার তো ওর কোঁচরে হাত রেখে চেঁচাচ্ছে প্রাণপণে, ছাড়াবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল বংশী। গেটের সামনেই নালি–সোজা চলে গেছে আংরাভাসায়। নালির ওপর সিমেন্টের বাঁকানো সাঁকোর ওপর চলছিল ধস্তাধস্তি। দৃশ্যটা দেশে আশেপাশের লোকজন ছুটে আসছে। মদেশিয়া কুলিকামিনের দল ভিড় করে মজা দেখছে। দাঁত বের করে মেয়েগুলো ঢলে পড়ছে। গুদামবাবু আর অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজারকে এদিকে আসতে দেখে পেটের গিঁট খুলে দিল বংশী। আর সঙ্গে-সঙ্গে ঝুরঝুর করে পাতাগুলো পড়ল নালিতে, পড়ে ভেসে চলল। যদি ডুবে যেত তলায় তাহলে গুদামবাবু দেখতে পেত না, প্রমাণ থাকত না কিছু। সঙ্গে-সঙ্গে নাম কাটা গেল খাতা থেকে। ছিচকেমির ব্যাপার বলে দশ মাইল দূরের থানায় খবরটা দিল না কেউ। ভিড় হালকা হয়ে গেলে বংশী দেখল বাবুরা ছুটি পেয়ে দল বেঁধে সাইকেলে চেপে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। কুলিকামিন চা-বাগানের হাঁটা পথে ফিরে যাচ্ছে লাইনে। আর সামনের শিরিষগাছের একটা নিচু ডালে বসে বুক ফুলিয়ে একটা ঘুঘু ওর দিকে তাকিয়ে শেষবার ডেকে নিচ্ছে।

সারাদিন ঘরে শুয়ে বসে কাটাল বংশী। সেই ভোরে ভোঁ বাজতেই লাইন খালি করে মেয়ে-পুরুষ বেরিয়ে গেছে কাজে। হাসপাতালে থাকতে এত কষ্ট হয়নি, আজ মটকা মেরে পড়ে থাকতে যেমনটা হয়েছিল। এই ঘর ছেড়ে দিতে হবে। আজ নয় কাল ওরা ছেড়ে দিতে বলবেই। বাগানে যারা কাজ করবে তাদের জন্য ঘর দেওয়া হয়। একবেলা রাঁধে লাইনের সবাই। রাত্তিরবেলায়। গরম-গরম ভাত খেয়ে বাকিটা জলিয়ে পরদিন কাজে নিয়ে যায়। কিন্তু কাল রান্না হয়নি কিছু। মেজাজ ছিল না। দু-একজন এসেছিল উপায় বাতলাতে, ম্যানেজার কিংবা বড়বাবুর কাছে। ধরাধরি করতে। একটা ইউনিয়ন আছে ওদের, কিন্তু হাতেনাতে ধরা পড়া চুরির কেস নিয়ে কিছু করবে না ইউনিয়ন।

ঠা-ঠা দুপুরে ঘরের বাইরে এল বংশী। বেশিক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকলে পায়ের ব্যথাটা বাড়ে। হাঁটাচলার মধ্যে থাকলে ঠিক হয়ে যায়। খালিগায়ে একটু জ্বরো-জ্বরো ভাব লাগছে। টানাটানিতে ধুতিটা কাল ফেঁসে-ফেঁসে গিয়েছিল। পাতি তোলার সময় যে ঢলঢলে খাঁকি হাফপ্যান্টটা পরত সেটাই গলিয়ে নিয়েছে এখন। প্যান্টে সুখ হয় না ওর। সুখ যে ছাই কীসে হয়, শুধু খাওয়া ছাড়া! গলাভরতি ভাতগুলো যখন পেটের মধ্যে বি জ্বর কাটে তখনই সুখ হয় জব্বর। খাওয়ার কথা মনে পড়তেই কষ্ট হল বংশীর। পেটের চামড়াটা শালা পিঠে লেগে যাবার ধান্দায় আছে! চাউল আছে ঘরে সেরখানেক, খেয়ে নিলেই তো শেষ হয়ে গেল। তিনদিন বাদে হপ্তা। বংশী শেষ পর্যন্ত উনুন ধরাবে বলে ঠিক করল। চারধার চুপচাপ, শুধু মাঝে গলা ছেড়ে মোরগগুলো চেঁচাচ্ছে। ওখানে সব ঘরেই মুরগির দঙ্গল। বংশীর বউ এককালে মুরগি পুষত। বউ পালাতে বংশী সেগুলোকে রোজ রাত্রে একটা-একটা করে কেটে খেয়েছে। আঃ, সেই দিনগুলোয় খাওয়াটা ছিল কী সুখের! মেয়েছেলের শরীরের চেয়ে মুরগির মাংস স্বাদে জিভ জুড়িয়ে দেয়।

আনমনে হাঁটছিল বংশী। একদম ন্যাংটাপোঁদা বাচ্চা আর থুথুরে বুড়োবুড়ি এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে। লাইনের শেষ প্রান্তে এসে খুঁটিমারী জঙ্গলের দিকে তাকাল ও। ঘন জঙ্গলটা ক্রমশনিচ থেকে আরও নিচে নেমে গিয়েছে। একটু এগোতে গিয়েই থমকে দাঁড়াল বংশী। তেমাথা বুড়ো সিরিন গুলতি হাতে বসে। নড়বড়ে মুঠোয় গুলতির বাঁট নিয়ে পানসে চোখে সামনের দিকে। তাকিয়ে আছে। বংশী ওর সামনে উবু হয়ে দাঁড়াতে বুড়ো চোখ তুলল, তারপর চিনতে পেরে বলল, নোকরি গেলাক রে তুর?

হুঁ। বংশী ওর হাত ধরে আস্তে-আস্তে বলল, কা করতিস রে?

বসে-বসে বুড়ো মনের জোর হারিয়ে ফেলেছিল বোধ হয়, বংশীকে পেয়ে ঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। বুড়োর যখন ষাট বছর বয়স তখন চামুর্চির এক বিধবাকে বিয়ে করে। প্রায় তিরিশ বছরের ছোট বউটাকে বিয়ে করার কারণ বুড়োর ছেলেরা সব বাপকে ছেড়ে আলাদা, বউ এসে বাগানে কাজ করে স্বামীকে খাওয়াবে। তা বলতে নেই বউটা বুড়োকে দেখাশুনা করছে। ঠিকমতন। মাঝে-মাঝে একবেলার জন্য চামুর্চিতে গিয়ে সৎ-মেয়েকে দেখে আসে এই পর্যন্ত। লোকে বলে অনেকের সঙ্গে নাকি ফস্টিনস্টি করে বউটা, চাঁদনী রাতে কেউ-কেউ চা-বাগানের মধ্যে দেখেছে পুরুষের সঙ্গে। তা কোন মেয়েটা এই লাইনের সতী হয়ে আছে বল? শুধু ফেসে না গেলেই হল আর বুড়োকে তো কোনও অযত্ন করছে না কারোর কিছু বলার নেই। তা সেই বউ আজ দু-দিন যেতে পারেনি কাজে। ম্যালেরিয়া জ্বর ধরেছে। আজ জ্বর নেই বটে কিন্তু শরীর কাহিল। সকাল থেকে মাংস-মাংস করছে। গুলতি দিয়ে বুড়োকে বলেছে একটা ঘুঘু মেরে আনতে। শুকনো ধানখেতে ঘুঘুরা ভিড় করে ভরদুপুরে। জোয়ান বয়স হলে বুড়ো দশটা ঘুঘু মেরে দিত কিন্তু এখন ঢোঙাগুলো হাত ফসকে এদিক-ওদিক চলে যায় যে!

ঘরের দরজায় এসে বুড়োর যেন সম্বিৎ এল। বংশী যত ওকে ভেতরে নিয়ে যেতে চায় ও ঘাড় নাড়ে। খড়ের ছাউনি অনেকটা নিচে নেমে এসেছে, ভেতরে ঢুকতে একটু হেঁট হতে হয়। ভেতরের খাঁটিয়ায় মচমচ শব্দ হয়, তারপর বুড়ো সিরিনের বউ-এর আংরার তলা দেখা যায়। বংশী বোঝে খালিহাতে বুড়ো ভেতরে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে। বুড়োর বউ-এর সঙ্গে ওর কথাবার্তা তেমন নেই। বউ পালাবার আগে মাঝেমধ্যে ওর ঘরে অবশ্য গেছে। বংশীর সন্দেহ, এরই। পাল্লায় পড়ে বউটার মন বিগড়েছে। না হলে এ মদেশিয়া মেয়ে হয়ে হিন্দি কথা বলে। চামুৰ্চিতে একটা হিন্দি সিনেমা হয় শুনেছে বংশী, তা বলে এত ঢংকীসের! আজকাল ওদের বাগানে মাসে দুমাসে একটা করে পিকচার দেখানো হয় বড়সাহেবের কুঠির সামনে–সিরিনের বউ-এর ঠাট ঠমক সেইরকম।

ভাগ গেলাক সব চিড়িয়া–না রে! সিরিনের বউ পাশে এসে দাঁড়াল। চুলগুলো রুক্ষ, চেহারাটা থমথমে। হঠাৎ বংশীর মনে হল সিরিনবুড়ো সত্যিই বুড়ো! স্বামী না হয়ে বড়া-বাপ হতে পারত সহজেই। হঠাৎ যেন বংশীকে দেখে বউটা চোখ কপালে তুলল, নোকরী খতম, মরদ হজম বলে হাসল।

প্রথম কথাটার মানে বুঝলেও পরেরটা কেমন রহস্য হয়ে থাকল বংশীর।

তুম জোয়ান আদমি, তুমারা ডর কিয়া, বোলো! বউ ঠোঁট টিপে বলল।

যা বুড়া ঘর যা। বংশী সিরিনের কাঁধে টোকা দিতে বুড়ো সিঁধিয়ে গেল ঘরে।

রুক্ষ চুলে হাত বোলাতে-বোলাতে বউ বলল, কা কাম করতিসে রে?

কুছ না, বংশী গুলতিটা নিয়ে হাত বোলাল।

দো চিড়িয়া মার দে, তুম ভি খায়গা হামরা ঘর মে। বউ বলল।

ঠিক হ্যায়। বলে বংশী পা চালাল। এই মেয়েটার সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলা যায় না। কেমন ঢিপঢিপ করে বুক।

বেছে-বেছে অনেকগুলো ঢোঙা পকেটে পুরে লাইন ছাড়িয়ে নিচে নামল বংশী। যেখানটায় চাল শুকুতে দেওয়া হয় সেখানে কয়েকটা কাক ছাড়া কিছু নেই। ফ্যাক্টরির সামনে গেলে নিশ্চয়ই কয়েকটা পাওয়া যেত কিন্তু ওদিকে যেতে মন চাইছে না। লাইন ছাড়িয়ে যেতেই জঙ্গলের শুরু। বাঁদিকের হাঁটা-পথ ধরে খানিকটা গেলেই আংরাভাসা নদী। এই ভরদুপুরে খাঁ-খাঁ করছে চারধার। নদী ধরে কয়েক পা হাঁটতেই ঘুঘু পাওয়া যাবে। এখন বড়জোর হাঁটু অবধি জল। জঙ্গলের পথ ধরতেই বংশী দেখল একটা মদেশিয়ার সঙ্গে বাবুমতো লোক এদিকে আসছে। মদেশিয়াটা হাত নেড়ে ওকে থামতে বলছে। অবাক হল বংশী। বাবুটাকে ও জীবনে দ্যাখেনি। মদেশিয়াটাকে চেনাচেনা মনে হলেও ঠিক বুঝতে পারছে না কোথায় দেখেছে। গুলতি হাতে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ওদের কাছে আসতে দেখল বংশী। বাবুটা মদেশিয়াকে ফিসফিসিয়ে কি বলতে সে সম্মতি জানাল ঘাড় নেড়ে। বাবুটা বলল, তোমার নাম বংশী?

ঘাড় নাড়ল সে।

কাল নোকরি চলা গিয়া তুমারা?

হ্যাঁ।

লেও সিগারেট পিয়ো। একটা দেশলাই আর হলদে রঙের সিগারেটের প্যাকেট ওর দিকে এগিয়ে দিল বাবুটা। বিড়ি খুব কম খায় বংশী, খইনি চলে। সিগারেট খাওয়ার পয়সা কোথায়? কিছু না বুঝে হাত বাড়িয়ে ওগুলো ধরল বংশী। ব্যাপারটা কী?

ঘাবড়াও মৎ, হামারা বাত শোন, বাবুটা হাসল, তুম রুপিয়া মাঙতা হ্যায়?

এ আবার কীরকম প্রশ্ন। টাকা কে না চায়? মুখে বলল, জি বাবু, পেটকে লিয়ে রুপিয়া জরুরত হ্যায়।

ঠিক বাত। খানেকে লিয়ে, আচ্ছা কাপড়াকে লিয়ে, ডেইলি হাঁড়িয়াকে লিয়ে সব কইকো রুপিয়া চাহিয়ে। মগর বংশী, তুমারা নোকরি তো খতম কর দিয়া সাহেব, আভি কেয়া করেগা? বাবুটা বলল।

শোচা নেহি বাবু। বংশী ফ্যালফ্যাল করে তাকাল।

ঠিক হ্যায়, হাম শুনা তোমারা বাত। উ সাহেব লোককা দিল দেখ, মুঠিভর পাতি নেহি ছোড়নে সেকতা। থু! ঘেন্নায় থুতু ছড়াল বাবুটা, এইসা বাগানমে তুম কাম মৎ করো। তুম হামারা কামমে লাগো।

আপকা কাম? একটা বাবু ওকে যেচে চাকরি দিচ্ছে ভাবা যায় না।

আরে ভাই হামারা চার পেটি পাতা চা চাহিয়ে। ও দারোয়ান শালা পয়চান্তা নেহি। তুম চললা, কোনঠু পাতা চা ও বাক্স ইয়ে হামারা আদমিকো বাতা দেও। সিরেফ চার পেটি, ব্যস।

কাঁহা? ফ্যাক্টরি পর? অবাক হয়ে গেল বংশী।

দুসরা কাঁহা মিলেগা ভাই! দশটাকার একটা নোট ওর হাতে গুঁজে দিল বাবু, কোই ডর নেহি।

আজ রাত দো বাজে ইহা চলা আনা, হামারা ইয়ে আদমি তুমকো সাথ লে যায়গা। কাম খতম হোনেসে আউর চালিস রুপিয়া মিলেগা। আরে দারোয়ান ভি রুপিয়া লিয়া কুছ নেহি বোলেগা।

আরি বাপু, হাম মর যায়েগা। ঠকঠক করতে লাগল বংশী। আরে কুছ ডর নেহি। উনলোক তুমকো ভাগায়া দিয়া আউর তুম লেড়কিকা মাফিক বাত করতা। আরে বদলা লেও। যাদা কুছ করনে নেহি পড়েগা তুমকো। ব্যস, জবান পাক্কা? শুন, ইয়ে বাত দুসরা কিসিকো মত বাতানা। বেইমানকো হাম জিন্দা নেহি রাখতা। কেমন রক্ত ঠান্ডা করা গলায় কথাটা বলে চলে গেল বাবুটা সঙ্গীকে নিয়ে।

বেশ কিছুক্ষণ পর যখন ধাতটা ফিরে এল তখন বংশীর খেয়াল হল ওর হাতে সিগারেট আর দেশলাই এবং টাকাটা রয়ে গেছে। আজ রাতে ওরা চুরি করবে পেটি-পেটি চা। নিয়ে যাবে। কীসে? নিশ্চয়ই ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এই চা-বাগানে এতকাল কাজ করে শেষপর্যন্ত ও এই কাজ করবে? মনের মধ্যে দুটো নোক অনেকক্ষণ পাঞ্জা কষে শেষ পর্যন্ত মাথা নাড়ল বংশী। দারোয়ান যখন ওদের দলে, কেউ টের পাচ্ছেনা যে বংশী এর মধ্যে আছে, ওরা যখন ফাঁকতালে কিছু টাকা ওকে পাইয়ে দিতে চায়–ও নেবে না কেন? শুধু তো পেটিগুলো চিনিয়ে দেওয়া–গুঁড়ো চা থেকে পাতা চা আলাদা করে দেওয়া–এটা এমন কি অপরাধ! আর নোকরি যখন খতম করে দিয়েছে। ওর এটা করলে তেমন পাপ হবে না। অনেকটা হালকা হয়ে পকেটে সিগারেট আর টাকা রেখে দিয়ে ও সামনের দিকে হেঁটে গেল। কুলকুল করে অল্প জলের স্রোত বইছে। নদীর ওপারে ঝুঁকে আসা একটা শালগাছের ডালে বুক চিতিয়ে বসে আছে একজোড়া ঘুঘু। চকিতে ঢোঙা পরিয়ে গুলতিটা টিপ করল বংশী। ডানহাতে রবারটা কানের কাছে টেনে এনে ফট করে ছেড়ে দিতেই ঝটপট শব্দ হল গাছটায়। বংশী চেয়ে দেখল মাদি ঘুঘুটা একপাক খেয়ে আংরাভাসার। জলে গিয়ে পড়ল ধপাস করে। সাধ্যের বাইরে দ্রুত হেঁটে জলের মধ্যে নেমে পড়ল বংশী। যা স্রোত, দেড় ঠ্যাঙে হাঁটা মুশকিল। কোনওরকমে পাখিটাকে ধরে ফেলল ও। জলে ডানা ভিজে গেলেও বুকের কাছটা কী গরম, ধোঁয়া ওঠা ভাতের মতো।

ঘুঘুটাকে একটা পাথরের ওপর ছুঁড়ে ফেলে শুকনো জায়গায় বসল বংশী। চারধারে ঝিঝি পোকা ডাকছে। পাকা কাঁঠালের গন্ধ আসছে যেন। এই বনের ধারে কয়েকটা গাছ আছে কাঁঠাল, আমের। মানুষের ফেলা আঁটিতে গজিয়ে গেছে। পেটজুড়ে খিদেটা চনমনিয়ে গেছে। শালা বনে ফল আছে পাখি আছে–ঠিকই চলে যাবে। আর আজ রাত্রে ধরা পড়লে নির্ঘাত সদরে পাঠাবে। দারোয়ানটার মুখ মনে পড়ল বংশীর। রামজিকে গানা করে দারোয়ান। রামজি কে? কে জানে! না, এই চুরি ঠিক চুরি না। ফোকটে পঞ্চাশ টাকা পকেটে এসে যাবে। আর এসে গেলেই পঁচিশ। সের চাউল কিনে রাখবে ও। একমাস নিশ্চিন্ত। না, তাতেই সব টাকা শেষ হয়ে যাবে। তার চেয়ে বিশ সের চাউল আর দশ বোতল হাঁড়িয়া। ব্যস, আর কি চাই! মনের সুখে চোখ বন্ধ করে সরুপায়ে হাত বোলাতে লাগল বংশী।

খুঁটিমারী রেঞ্জের এই জঙ্গলটা চলে গেছেনাথুয়া ডিঙিয়ে ভুটানের পাহাড়ের তলায়। এদিকে জঙ্গলের ঘনত্ব কম। পায়ে-হাঁটা পথে ফালি-ফালি করে জঙ্গল ছিঁড়ছে। হাতি ছাড়া ভয়ের কিছু জানোয়ার এদিকে আসে না। আর হাতি এলে খবর ছড়িয়ে পড়ে বাতাসের মুখে-মুখে। নিশ্চিন্তে বসে বংশী পাখির ডাক শুনছিল। আংরাভাসার জলের শব্দের সঙ্গে পাখির ডাকগুলো কেমন মিলে মিশে যায়। আজ রাত্রে যদি ও কাজটা করে তবে কাল একবার বিনাগুঁড়ি গেলে কেমন হয়। পেট হওয়া বউটাকে দেখে আসবে। বউটার সঙ্গে ওর ঝগড়াঝাঁটি হয়নি কোনওদিন, অথচ না। বলেকয়ে ফট করে কেমন চলে গেল। শুধু বউটাকে বাচ্চা দিতে পারল না বলে ভেগে গেল? কিন্তু ওর শরীর তো ঠিকঠাক কাজ করে। শরীরের মেশিনটায় ভগবান যদি জং ধরায় তাহলে ও কি করবে? গুলতিটা হাতে তুলে নিল বংশী। কি আশ্চর্য, আবার ওই শালগাছটার ডালে ঘুঘু এসে। বসেছে। অন্য ঘুঘুরা কি একে খবরটা দেয়নি? গুলতিতে টিপ করে ঢোঙা ছাড়ল বংশী। তড়াক করে ঘুঘুটা চেষ্টা করেই বোঁটা খসা আমের মতো নিচের জলে পড়ল। আর সঙ্গে-সঙ্গে পায়ের আওয়াজ পেল ও। বুঝতে-না-বুঝতে একটা শরীর তিরের মতো ওর পাশ দিয়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কোনওরকমে জল হাতড়ে ঘুঘুটাকে ধরে ওর দিকে ফিরে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে হাসল। ততক্ষণে সোজা হয়ে বসেছে বংশী। সিরিন বুড়োর বউ। ও এল কখন? কা দেখিস রে? দু-হাতে ঘুঘুটাকে ধরে ওপরে উঠে এল সে। নিচের আংরাটা ভিজে গেছে একদম, ওপরের ব্লাউজে জলের ছাপ। জলে ভিজে বুক যেন আরও ফুলে উঠেছে।

ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল বংশী। বউটা কাছে এসে আর একটা ঘুঘু দেখতে পেয়ে ঠোঁট ওলটাল, মোটে দুটা? হামারা চারটো চাহিয়ে।

বংশী বলল, তুমারা বোখার হুয়া, পানিমে মৎ নামো।

কিঁউ? চোখ তুলল বউটা, বোখার ঠান্ডা হো যাবেক! তুম একদম বুদ্ধ, এতনা তুমারা ঘরমে হাম গিয়া তুম হামকো নেহি দেখা। মেরা নাম জানতা?

ঘাড় নাড়ল বংশী। সিরিন বুড়োর বউ বলে কি!

সে-রা। টেনে-টেনে উচ্চারণ করল বউটা, সেরা মেরা নাম। প্যার করনা কাম। বলেই কপট ঘাড় নাড়ল, সবকো সাথ নেহি।

তু ঘর যা। বংশী বলল।

কিঁউ। জ তুলল সেরা, তুমারা পসন্দ নেহি হোতা?

উঠে দাঁড়াল বংশী। মেয়েটার মতলব খারাপ।

সেরা হাসল, ও বুড়া মরবেক। এতনা ডর উসকো, থু, তুম মরদ নেহি!

এ্যাই! বংশী ধমকে উঠল।

চোখে চোখ রেখে এগিয়ে এল সেরা। হাতের ঘুঘুটাকে ছুঁড়ে দিল অন্যটার পাশে। তারপর বুকের জামার সেফটিপিন টুক করে খুলে বংশীর হাত টেনে নিল সেখানে, দেখো হামকো, ক্যায়সা মরদ তুম? ঘুঘুর বুক কিংবা গরম ভাতের চেয়ে উষ্ণ দুটো তামাটে পাহাড় ছুঁয়ে দেখতে-দেখতে মাথা ঘুরে গেল বংশীর। মেয়েছেলের শরীর এত নরম হয়! ওর বউটার শরীরে এসব তো এমন করে ছিল না! কোমরে হাত রাখলে তো হাত এমন ডুবে যেত না! চুমু খাবার সময় জিভ দিয়ে টোকা। মারলে অন্ধ হয়ে যাওয়ার সুখটা তো জানা ছিল না! শেষপর্যন্ত সমস্ত শরীর নিংড়ে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল বংশী।

অনেক পরে সেরা নিজেকে ঠিকঠাক করে নিয়ে হাসল, তুহার বহুটা ঝুট কথা বলে। তুম বৃহৎ তেজী মরদ হ্যায়। লাও, একটু সিগারেট পিলাও।

চমকে উঠে বসল বংশী। হঠাৎ নেমে আসা শ্রান্তিটা চট করে চলে গেল। ওর কাছে সিগারেট আছে জানল কী করে সেরা! কিছু না বলে প্যাকেট আর দেশলাই এগিয়ে দিয়ে চোখের দিকে তাকাল বংশী। নিপুণ হাতে দুটো সিগারেট ধরিয়ে একটা ওর দিকে বাড়িয়ে নিজেরটা টানতে লাগল সেরা। ওর জিভের রসে ভেজা সিগারেটে টান দিতে দিতে বংশী শুনল, তুম হামকো শাদি করেগা?

চমকে তাকাল বংশী, হাম?

হাঁ। আজ রাতমে চল চামুর্চি, নেহি, হাসিমারা। উঁহা তুমারা কাম মিল যায়গা।

সিরিন– বংশী বলল।

ও বুড্ডা মর যায়গা আজকাল। হাম ইঁহা নেহি রহেগা।

কিঁউ।

হাসল সেরা, মেরা পেটমে বাচ্চা আ গিয়া। দোসরা আদমিকে বাচ্চা। লাইনকা আদমিলোক হামকো মার ডালেগা।

হাঁ হয়ে গেল বংশী। সেরার পেটে বাচ্চা আছে! তবু ওর সঙ্গে এমন মজা করল! নিশ্চয়ই কারও সঙ্গে ফেঁসে গিয়েছে, আর এখন ওকে শাদি করতে বলছে বাঁচবার জন্যে? বংশী বলল, হাম নেহি। যায়েগা।

কিঁউ, তুমকো সুখ নেহি দিয়া হাম? আদুরে গলায় বলল সেরা।

দুসরা আদমিকা বাচ্চা–বলতে গিয়ে থেমে গেল বংশী। খিলখিল করে হাসল সেরা, তো কেয়া! আরে বুদ্বু, জেনানালোক বাতানেসে তব তো মরদলোক সমঝতা বাচ্চা উসকো হ্যায়। সমঝ লেও ইয়ে তুমারা বাচ্চা, ব্যস! তুমারা বহুঁকো উপর বদলা লে লেও।

ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বংশী বউটার কথা ভাবল। সেরা যা বলছে তা করলে বউটা জব্দ হয়ে যাবে। কিন্তু সিরিন বুড়ো

আজ রাতকো কাম খতম করকে পুলকা পাস চলা আও। হাম সামান লেকে ভঁহা খাড়া রহেগা। উঠে দাঁড়াল সেরা।

রাতকো কাম? অবশ হয়ে গেল বংশী। রাতের কাজের কথা এ জানল কী করে? উঠে দাঁড়াল ও।

পঞ্চাশ রুপিয়ামে রফা হুয়া না? হাম সব শুনা। আরে ডর কিউ, হাম কিসিকো নেহি বাতায়গা। তুম মেরা বাচ্চাকো বাপ হ্যায়। বলে বংশীর চিবুক একহাতে নেড়ে দিয়ে হাঁটতে লাগল লাইনের দিকে। খানিকটা গিয়ে আবার ও ঘুরে দাঁড়াল, ইয়াদ রাখনা, পুলকা পাস হাম খাড়ারহেগা দো বাজে মে। তারপর রানীর মতো হাঁটতে-হাঁটতে চলে গেল আড়ালে। হঠাৎ বংশী টের পেল ওর ভালো পা-টা ঠাণ্ডা মেরে যাচ্ছে আর সরু পায়ে ব্যথাটা চাগাড় দিয়ে উঠছে। দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে। ওর। একটা হিম-ভয় বুকের মধ্যে পাক খাচ্ছে। সেরা নিশ্চয়ই ওর পেছনে-পেছনে এসেছিল। তারপর আড়ালে দাঁড়িয়ে বাবুটার কথা সব শুনেছে। শালা! মেয়েছেলেটা সাক্ষী থেকে গেল। ব্যাপারটার। ফাঁস করে দিলে আর রক্ষে থাকবে না। পা-দুটো যদি ভালো থাকত তবে থোড়াই কেয়ার করত বংশী। এখন ওর কথা না শুনলে! বংশীর কান্না পেয়ে গেল। কার সঙ্গে মজা লুটে ফেঁসে গিয়ে ওর ওপর ভর করতে চাইছে সেরা। এমনিতে মেয়েছেলেটা এমন জিনিস কোনওদিন টের পায়নি ও, তা বলে অন্য একটা বাচ্চার বাবা সেজে ওকে চলতে হবে? এও তো শালা এক ধরনের চুরি। চামুর্চি কিংবা হাসিমারা যেখানেই থাক, এই চুরিটাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। বসে পড়ল বংশী। ঘুঘু দুটো নিয়ে যায়নি সেরা! কাঠ হয়ে পড়ে আছে সে দুটো। হঠাৎ ওর মনে হল সেরাকে নিয়ে অন্য কোথাও গিয়ে তো একদিন ভেগে পড়তে পারে। সব যখন ঠান্ডা হয়ে যাবে তখন কে আর সেরাকে বিশ্বাস করবে? নিজের বউ-এর ওপর বদলা নেওয়া হল, চাকরি খতমের বদলা হল, আবার সেরাকেও টাইট দেওয়া হল। একটু খুশি-খুশি মন হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে পায়ের ব্যথাটা কমে গেল বংশীর। সামনের দিকে তাকাতে ও আশ্চর্য হয়ে। গেল। ব্যাপার কী! ঘুঘুগুলোর কি আজ মরতে ইচ্ছে করছে নাকি! না হলে শালগাছের সেই নিচু ডালটায় আবার একটা এসে বসেছে কেন? আর বসে অমন বুকই চিতায় কেন? গুলতিতে ঢোঙা পুরে টিপ করল বংশী।

চার-চারটে ঘুঘু কাঠের আগুনে ঝলসাচ্ছিল। গর্ত খুঁড়ে তিন ইটের উনুনের ওপর ছাল ছাড়ানো পাখিগুলোকে চেনা যাচ্ছিল না। লকলকে আগুনের তাতে সাবধানী হাতে ঝলসে নিচ্ছে সেরা। একটা পোড়া গন্ধ বেরুচ্ছে। আগুনের রং লেগেছে মেয়েছেলেটার গালে। বুড়া সিরিন চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। ওর দুটো পা ভাঁজ করে হাঁটু ওপরে তোলা। মাথার কাছে বসে বংশী দেখছিল সেরাকে। বুড়োর ঠ্যাং দুটোর মাঝখান দিয়ে সেরাকে দেখছে ও। ঠ্যাং দুটোকে হঠাৎ গুলতির বাঁটের মতো মনে হল ওর। ও নিজে যেন ঢোঙা, এক্ষুনি সাঁই করে ছুটে যাবে সামনে ওই আগুনে গাল লাল হওয়া ঘুঘুটার দিকে। খুকখুক করে হাসল বংশী। একটু-একটু নেশা হয়েছে। সেরা ঘুঘু চারটে পেয়ে লুকোনো বোতল বের করেছিল। নিজে খায়নি এক ফোঁটা। বুড়ো তো আধ বোতল খেয়ে চিৎ হয়ে গেছে। শালী ভাগবার জন্য বুড়োকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে সন্ধে থেকে। চোখে রং লাগছে বংশীর। মাথা নেড়ে নিজেকে ঠিক করল ও। মাথা সাফ রাখতে হবে। রাতের কাজটা গোলমাল না হয়।

আজ সন্ধেবেলায় সব মুশকিল হয়ে গেল। জঙ্গল থেকে আসবার সময় লাইনের লোকজন যারা বাগানে কাজ করতে গিয়েছিল তাদের সঙ্গে দেখা। সবাই ওকে দেখে হই-হই করে উঠল। অবাক বংশী শুনল ইউনিয়ন থেকে গিয়েছিল বড়সাহেবের কাছে। এক কথায় বড়সাহেব নাকি বংশীকে। চাকরি ফিরিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন। তবে গুদামে নয়, হাসপাতালের কাজে। কাল সকালে যেন বংশী ডাকদারবাবুর সঙ্গে দেখা করে। কী করবে বুঝতে পারছিল না বংশী। দেড় ঠ্যাঙে লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল। চাকরি আছে তার, এই বাগান এই কুলি লাইন ওই পাতির গন্ধ, যা সে ছেলেবেলা থেকে পেয়ে আসছে সেখানেই সে রাজার মতো থাকতে পারবে। আঃ! তারপর একটু একলা হয়ে চারটে ঘুঘু ঝুলিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে সবটুকু আনন্দধারায় মনটা হাওয়ার মতো বেরিয়ে গেল ভুস করে। আজ রাত্রে পেটি-পেটি চা চুরি করে ওকে সেরার সঙ্গে পালিয়ে যেতে হবে। ইস, যদি কয়েক ঘণ্টা আগে খবরটা সে জানত! বাবুটা বলে গেছে বেইমানি করলে লাশ ফেলে দেবে। কী করবে ও?

নেশার চোখে সবকিছু সুন্দর লাগে। গুলতির বাঁটের মধ্যে দিয়ে ও সেরাকে দেখল। কি নির্লিপ্তের মতো নুন-মরিচ ছড়াচ্ছে মাংসের ওপর। এখন গন্ধটা বেরুচ্ছে দারুণ। এই সেরা আর জঙ্গলের মধ্যে শুয়ে থাকা সেরার মধ্যে কোনও মিল নেই–এইরকম যখন ভাবতে শুরু করেছিল ও, ঠিক তখনই একটা কলাইকরা থালার ওপর মাংসগুলো রেখে ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল সেরা। ওর চাকরি ফিরে পাবার কথা শুনেছে সেরা। বংশী সিরিন বুড়োকে খবরটা দেবার সময় ওকে শুনিয়েছিল। বুড়ো খুশি হয়েছিল। কোনওরকম প্রতিক্রিয়া দেখায়নি সেরা।

রান্না হয়ে গেলে দু-হাতে বুড়োকে ঝাঁকাল সেরা, ওঠ ওঠ এ বুড়া, ওঠ। অনেক ঝাঁকুনির পর সিরিন চোখ খুলে ঢুলতে লাগল। উঠে বসে। মাংসের থালাটা সামনে ধরতে দু-একবার মুখ। থুবড়ে তার মধ্যে পড়ে যেতে সেরা এক টুকরো মাংস ছিঁড়ে বুড়োর মুখের মধ্যে গুঁজে দিল। বুড়ো কয়েকবার সেটাকে চিবোতে চেষ্টা করল। মাড়িতে জোর পাচ্ছে না, স-স করে রস টানছে, কপালের রগগুলো তিরতির করে কাঁপছে, চোয়াল নড়ছে না ইচ্ছেমতো। শেষপর্যন্ত প্রায় আস্ত। মাংসটা মাটিতে থুথু করে ফেলে দিয়ে নেশার ঘোরে কাঁদতে লাগল বুড়ো। তারপরই বংশী। একটা আজব ব্যাপার দেখল। সেরা আর একটা মাংস ছিঁড়ে নিজের মুখে পুরে সেটাকে চিবিয়ে চিবিয়ে কাদা করে আবার মুখ থেকে বের করে সেই কাদাটা বুড়োর মুখে গুঁজে দিল। চিবোতে হল না বুড়োকে, জিভ দিয়ে সেটাকে নেড়েচেড়ে কপাৎ করে গিলে ফেলল বুড়ো। আস্তে-আস্তে শুয়ে পড়ল একটা হাত বালিশ করে। মাংস খাওয়া হয়ে গেল বুড়োর।

মাংসের থালিটা সামনে রেখে সেরা বংশীর কাছে এসে বসল। দুরে সেই বটগাছটার তলায় কারা মাদল বাজাচ্ছে–ডিম ডিমা, ডিম, ডিম ডিম–তালটা এ ঘরে সোজা যেন চলে আসছে। খালে মাংস! সেরা বলল।

বোতল শেষ হয়ে গিয়েছিল বংশীর। মাংস খাওয়ার সময় ওরা কোনও কথা বলল না। শব্দ করে পাখির নরম হাড় চুষছিল সেরা। খাওয়ার সময় মেয়েদের চেহারায় কোনও গরমি থাকে না। খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে পা ছড়িয়ে বসল বংশী। কটা বাজে? একটার সময় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। লোকটার জন্যে। ও দেখল থালা সরিয়ে সেরা আর একটা বোতল বার করছে। বাঃ, মেয়েটার কাছে তো বেশ লুকোনো মাল থাকে! সেরা বলল, লে মৌজ কর।

ঘাড় নাড়ল বংশী, না। নেশা হো যাবে।

হোনে দে। সেরা সামনে এসে বসল আবার। বলে কি মেয়েটা? গুদামে অত বড় কাজ আছে, তারপর হেঁটে আজ রাত্রে চলে যেতে হবে হাসিমারার দিকে, নেশা করলে চলবে কী করে? ওর মনের কথা যেন বুঝতে পেরেই সেরা হাসল, তুম আদমিটু সাচ্চা হ্যায়। শুন, আজ রাতমে নেহি যানে পড়েগা তুমকো।

কিঁউ। থ হয়ে গেল বংশী।

পহেলে দেখি তুম ক্যায়সা মরদ হো। দো মাস বাদ হামলোগ যা শেকতা–বাকি ইসকা অন্দর তুমারা বাচ্চা হামারা ইহা আয়ে তো! বলে নিজের পেট দেখিয়ে হাসল সেরা।

হাসপাতালে থাকতেও শরীর এত অবশ হয়নি বংশীর। হাঁ হয়ে ব্যাপারটা শুনল ও। সেরা তখন স্রেফ মজাকি করেছে। ওর পেটে বাচ্চাটাচ্চা আসেনি। আজ অবধি কখনওই আসেনি। আগের স্বামী আর এইটে–দুটোই ক্ষমতা হারাবার পর বিয়ে করেছে। বংশীর ওপর ওর নজর ছিল। বংশীকে যাচাই করবার জন্য ও মিথ্যে বানিয়ে বলেছে। বলে দেখেছে বংশী সাচ্চা আদমি। এখন বংশীকে দুইমাস অপেক্ষা করতে হবে। যদি এর মধ্যে বাচ্চা আসে তবে দুই নম্বর থালি চাঁদের দিন ওরা পালিয়ে যাবে।

ফট করে যেন আর একটা গিঁট খুলে গেল বংশীর। কিন্তু মুক্তির আনন্দের চেয়ে অন্য একটা সুখের লোভ ওর সর্বাঙ্গ ঘিরে ফেলল সহসা। আঃ! একটা হাতে সেরার হাত ধরে বসে থাকল বংশী। সিরিন বুড়োর নাক ডাকছে সমানে।

হঠাৎ সেরা বলল, তুম আজ গুদামমে মৎ যাও।

এখন সত্যি আর যেতে ইচ্ছে করছে না ওর। এতগুলো সুখের খবর একসঙ্গে পেয়ে আর ভালো লাগছে না বিপদের মধ্যে পা বাড়াতে। বংশী বলল, উ শালা মার ডালেগা।

কী ভাবল সেরা। তারপর বলল, লে দম ভর পি লে হাঁড়িয়া। উসকা বাদ যা। মাতোয়ালা আদমিসে উনলোক কাম নেহি করায়গা।

*

দমভর খেয়ে যখন বংশী বাইরে বেরুল তখন ওর পায়ের ব্যথাটা কখন হাওয়া হয়ে গেছে। খোলা জায়গায় আসতেই ওর হঠাৎ মনে হল ঘর-বাড়ি-আকাশ কেমন উলটে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে সেগুলোকে ঠিক করল ও। ডিম ডিমা ডিম মাদল বাজছে। চোখে কেমন ঝাঁপসা লাগছে সব। চোখ তুলে ও সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। খুঁটিমারীর জঙ্গলটা যেন ক্যালেন্ডারে দেখা শিব ঠাকুরের মতো বসে আছে মাথায় একটা চাঁদ ঝুলিয়ে। আহা কী রূপ! দু-হাত জড়ো করে প্রণাম করার চেষ্টা করল বংশী। চোঁয়া জ্যোৎস্নায় চারধারে হালকা সাদা ছড়াচ্ছে। টলতে-টলতে বংশী মোড়ের দিকে এগোল। তামাম কুলি লাইন নিস্তব্ধ। শুধু মাদলটা বাজছে ধেউসির তো বৃহৎ দেরি।

নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে বংশী আর দাঁড়াতে পারল না। সবে হিম পড়া ঘাসে বসে পড়ে আশেপাশে তাকাল। জঙ্গল থেকে দলে-দলে জোনাকি এসে ছড়িয়ে পড়ছে মাঠে। ফিনিক-ফিনিক টিপ পরাচ্ছে অন্ধকারের গায়ে। কটা বাজে এখন? এখন সব ঠিকঠাক, চাকরি হল, সেরার মতো মেয়েছেলে ওর বাচ্চা পেটে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে, আর ওকে এখন চুরি করতে যেতে হবে। কান্নাটা হঠাৎই এসে গেল ওর।

অনেকক্ষণ পর সাইকেলের ঘণ্টি শুনতে পেয়ে তাকাল বংশী। অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে কেউ সাইকেলে চেপে আসছে। ঠিক ওর সামনে এসে ওর মুখে আলো ফেলল লোকটা। তারপরই আচমকা পেটে একটা লাথি খেল বংশী। ই শালা কুত্তাকা বাচ্চা–ফিন নোকরি মিলা তুমারা, আঁ? সেই মদেশিয়াটা।

হু-হু করে কেঁদে ফেলল বংশী, মু না জানলেক কুছ, সাচ, কিরায়া।

লোকটা একটা হাত বাড়িয়ে দিল সামনে, লে দশ রূপায়া ঘুমাকে দে।

পকেট থেকে টাকাটা বের করে বংশী ওর দিকে তাকাল, কাম?

ছোঁ মেরে টাকাটা নিয়ে লোকটা আবার সাইকেলে চাপল, শালা দারোয়ান ফাঁসায় দেলেক। বেইমান! জানসে খতম হোগা ও। বলে পাঁই-পাঁই করে চলে গেল সাইকেলটা।

পাঁজরে অসহ্য যন্ত্রণা কিন্তু মনে লক্ষ-লক্ষ চাঁদ ফুটে উঠল বংশীর। আঃ বেঁচে গেছে–ও বেঁচে গেছে। প্রচণ্ড একটা ভয়ের সাপ এতক্ষণ যেন জড়িয়ে রেখেছিল ওকে, হঠাৎ স্নান করে ওঠার মতো হালকা হয়ে গেছে যেন। আনন্দে ডিগবাজি খেতে গিয়ে টলে পড়ল বংশী। শালা মাতোয়ালা হো গিয়া।

লাফাতে-লাফাতে হাঁটছিল বংশী। চাঁদ আর জোনাকিগুলো যেন মিছিল করে ওর সঙ্গে আসছে। আর দুমাস–ব্যস! তারপর রাজা হো যায়গা। থালিচাঁদকো রাত আ যাও পেয়ারে।

হাঁটতে-হাঁটতে কখন ও পুলের ওপর এসে পড়েছে বুঝতে পারেনি। এখানেই দু-মাস পর সেরা আসবে।

হঠাৎ আর একটা চিন্তা মাথায় এল ওর। যদি নিজের বউটার মতো সেরার পেটেও ওর বাচ্চা না আসে? যদি ওর শরীরের ভিতর বাচ্চা আনার যন্ত্রটা খারাপ থাকে? নিজের বউটার তো বাচ্চা হবে এখন। প্রচণ্ড একটা ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল বংশী। তাহলে তো সেরা আসবে না। বরং ওর দিকে তাকিয়ে ফ্যালনা হাসি হাসবে। সারাজীবন এখানে চোরের মতো থাকতে হবে। পুলের বাঁশটা দু-হাতে ধরে ওপরদিকে তাকাল ও। হঠাৎ পায়ের যন্ত্রণাটা ফিরে এল বংশীর। নেশাটা কেটে যাচ্ছে। ওপরদিকে তাকিয়ে চাঁদটাকে দেখতে-দেখতে হাঁ করল ও। আয় চাঁদ–মেরা অন্তরমে আ যা। গলার ভিতর দিয়ে জ্যোৎস্নাকে গিলতে চেষ্টা করছিল বংশী। একটু-একটু করে সমস্ত চাঁদকে সারা শরীরে পুরে নিয়ে ওর মনে হল ও নিজেই থালি চাঁদ হয়ে গিয়েছে। শরীরটা হয়ে উঠেছে ফুলের মতো। কী আরাম-আঃ! কিন্তু থালি চাঁদ হয়ে গেলেই তো বিপদ, আস্তে আস্তে আবার ক্ষয়ে যেতে হয়–পনেরোদিন পর একদম শেষ। তখন শুধু অন্ধকার। তখন শুধু কোনওরকমে জিইয়ে রাখা নিজেকে। দ্রুত পা চালাল বংশী। নিজের কাছে চাঁদটাকে রাখা বড় বিপদ, বরং সেরার কাছে জমা করে দিলেই ভালো। রোজ-রোজ যদি জমা করে দেয় তাহলে হারাবার ভয় থাকে না। দু-মাসটাও যে একদিন করে বেড়ে-বেড়ে যায়। চাঁদটাকে উগরে দেওয়ার জন্য ঢোঙার মতো ছুটতে লাগল বংশী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress