নোবেল-প্রাইজ প্রাপ্ত জার্মানীর সম-সাময়িক দু’জন লেখক
১).
গণমানুষের লেখক হাইনরিখ বোল
শংকর ব্রহ্ম
——————–
১৯১৭ সালে জন্ম হয় হাইনরিখ বোল -এর। জার্মানির বহুল পঠিত লেখকদের মধ্য অন্যতম একজন তিনি। ত্রিশটির বেশী ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর লেখা। বোল তাঁর বইয়ে পুঁজিবাদের অন্ধকার দিক তুলে ধরেন। সে কারণে তিনি পূর্ব ইউরোপে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। নোবেল কমিটির পক্ষে বলা হয়, ‘তাঁর লেখনীর মাধ্যমে নিজের সময়ের ওপর ব্যাপক পরিসরের দৃষ্টিভঙ্গি ও সংবেদনশীল দক্ষতার মিশেলে চরিত্র চিত্রায়ণ ও জার্মান সাহিত্যের নব-রূপায়ণে ভূমিকা রাখার জন্য’ তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো। ১৯৭২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান জার্মান কথাসাহিত্যিক হাইনরিখ বোল।
লেখালেখির আগে হাইনরিখ বোল বইয়ের দোকানে কেরানির কাজ করতেন। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে তিনি লেখায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ট্রেইন ওয়াজ অন টাইম’ প্রকাশ করেন ১৯৪৯ সালে। জার্মান লেখকদের সংগঠন ‘গ্রুপ-৪৭’ তাদের ওই বছরের সম্মেলনে তাঁকে আমন্ত্রণ জানায় এবং ১৯৫১ সালে তাঁর লেখাকে সর্বোত্তম বলে ঘোষণা করা হয়। তারপর থেকে তাঁর লেখার প্রবাহ পুরোদমে চলতে থাকে।
হাইনরিখ বোলের অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে—উপন্যাস : ‘হয়ার অয়ার ইউ, অ্যাডাম’ (১৯৫১), ‘অ্যান্ড নেভার সেইড আ ওয়ার্ড’ (১৯৫৩), ‘দ্য ব্রেড অব দোজ আর্লি ইয়ার্স’ (১৯৫৫), ‘দ্য সেফটি নেট’ (১৯৭৯), ‘আ সোলজার্স লেগ্যাসি’ (১৯৮২); ছোটগল্প : ‘ক্রিস্টমাস নট জাস্ট ওয়ান্স আ ইয়ার’ (১৯৫১), ‘দ্য বালেক স্কেলস’ (১৯৫২), ‘ইউ গো টু হাইদেলবার্গ টু অফেন’ (১৯৭৯); প্রবন্ধ : ‘মিসিং পারসনস’ (১৯৫৭) ইত্যাদি।
বিষয়বস্তু ও উপাদান সম্পর্কিত বৈচিত্র্য থাকলেও তাঁর লেখার উপস্থাপনায় কয়েকটি প্যাটার্ন বারবার এসেছে। অনেক উপন্যাস ও গল্পে ব্যক্তিগত জীবনের নিবিড় চিত্র তুলে ধরেছেন তিনি। যুদ্ধ, সন্ত্রাস, রাজনৈতিক বিভেদ এবং গভীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তরের বিপরীতে ব্যক্তির শক্ত অবস্থানের কথা বলা হয়েছে সেইসব লেখায়।
হাইনরিখ বোলের নিজের শহর কোলনের প্রতি ছিল তাঁর শিকড়ের সম্পর্ক। সেখানকার মানুষদের রোমান ক্যাথলিক বিশ্বাসের প্রতি টান এবং রসবোধের প্রতিও সচেতন ছিলেন তিনি। তাঁর লেখার মধ্যে ক্যাথলিক বিশ্বাসের গুরুত্ব ছিল এবং এ প্রসঙ্গে তাঁকে তুলনা করা হয়ে থাকে গ্রাহাম গ্রীনের সঙ্গে।
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের মানুষদের ওপর যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কেও তিনি সচেতন ছিলেন। তাঁর সমালোচনার লক্ষ্য হয়েছে ক্ষমতাধর মানুষদের আত্মতৃপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার।
লেখার জগৎ ছাড়াও বাস্তব জীবনে জন্মস্থান ছিল তাঁর কাছে প্রিয়তম জায়গা। যুদ্ধের সময় কোলন শহর নিসদের দখলে যাওয়ায় তিনি গভীরভাবে মর্মাহত হন। মিত্রশক্তির বোমার আঘাতে কোলন ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলে তিনি আজীবন সে দুঃখ ভুলতে পারেননি। এ ছাড়া আজীবন তিনি কোলনের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন।
ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়ে তাঁর উদারনৈতিক মনোভাবের জন্য জার্মানির রক্ষণশীল সমাজ তাঁকে পছন্দ করতে পারেনি। দেশের সংবাদপত্র তাঁর নোবেলপ্রাপ্তিতে অসন্তোষ প্রকাশ করে তারা। তাদের ব্যাখ্যা ছিল, নোবেল পুরস্কার শুধু উদারপন্থী ও বামদের মধ্যে যাঁরা চরমপন্থী তাঁদের দেওয়া হয় বলে তারা প্রচার করেছেন।
হাইনরিখ বোল বেশ কয়েকবার রাশিয়া ভ্রমণ করেন। সেখানকার অনেক লেখকের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। ভিন্নধর্মী সাহিত্য সৃষ্টিতে রাশিয়ার যে’সব লেখক অগ্রণী ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে বোলের মতের ঐক্য স্থাপিত হয়। রুশ সাহিত্যিক আলেকজান্ডার সোলঝেনেিসন তাঁর দেশের সরকারের কোপানলে পড়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলে পরে, তিনি প্রথমতঃ, তিনি আশ্রয় নেন বোলের আইফেল কটেজে।
হাইনরিখ বোলের নামে পুরস্কার ও স্কলারশিপ দেওয়া হয় জার্মানীতে। তাঁর নামে রাস্তাঘাট, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির নামকরণ করা হয়েছে। তিনি কিছুদিন আয়ারল্যান্ডের একাইল দ্বীপে ছিলেন। সেখানে তাঁর ব্যবহূত কটেজ ১৯৯২ সাল থেকে লেখক শিল্পীদের গেস্টহাউস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
২).
গুন্টার গ্রাস
গুন্টার গ্রাস দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে মুক্ত শহর ডানজিগে ( Free City of Danzig বর্তমান দানস্ক, পোল্যান্ড) ১৬ই অক্টোবর, ১৯২৭ সালে জন্ম গ্রহণ করেন।
তাঁর সন্তানেরা হলেন : হেলেনে গ্রাস, রাউল গ্রাস, ব্রুনো গ্রাস, লউরা গ্রাস, নেলে ক্রুগার, ফ্রাঞ্জ গ্রাস
তাঁর দুই স্ত্রী: প্রথম জন হলেন ‘আন্না মার্গারেতা শোয়ার্জ ‘(বিবাহ. ১৯৫৪–১৯৭৮)।
দ্বিতীয় স্ত্রী হলেন – ‘উতে গ্রুনার্ট’ (বিবাহ ১৯৭৯–২০১৫),
তিনি ছিলেন ঔপন্যাসিক কবি নাট্যকার ভাস্কর গ্রাফিক ডিজাইনার।
তাঁর জাতীয়তা- (জার্মান / কাশুবিয়ান)
নাগরিকত্ব – জার্মান
তাঁর সময়কাল – (১৯৫৬ সাল খেকে–২০১৫ সাল পর্যন্ত।)
সাহিত্য তাঁর আন্দোলন
Vergangenheitsbewältigung
তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাবলি –
Die Blechtrommel
Katz und Maus
Hundejahre
Im Krebsgang
“Was gesagt werden muss”
তাঁর উল্লেখযোগ্য পুরস্কার –
Georg Büchner Prize
(১৯৬৫)
Honorary Fellow of the Royal Society of Literature
(১৯৯৩)
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার
(১৯৯৯)
প্রিন্স অব আস্তুরিয়াস পুরস্কার
১৯৯৯ গুন্টার ভিলহেলম গ্রাস ছিলেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী জার্মান সাহিত্যিক, কবি, নাট্যকার, ভাস্কর এবং গ্রাফিক ডিজাইনার। গ্রাস ছিলেন কাশুবিয়ান আদিবাসী।
মে ১৯৪৫ সালে, ভাপেন এসএস-এ কিশোর সৈনিক হিসেবে সংক্ষিপ্ত পরিষেবা প্রদানের পর, মার্কিন বাহিনী কর্তৃক তাকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং এপ্রিল ১৯৪৬ সালে তিনি মুক্তি পান। একজন স্টোনম্যাসন এবং ভাস্কর হিসাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তির পর, তিনি ১৯৫০-এর দশকে লেখালেখি শুরু করেন। তার কথাসাহিত্যে, বারবার তার শৈশবের ড্যান্জিং শহরের উল্লেখ রয়েছে।
গ্রাস তার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য টিন ড্রাম’ (১৯৫৯)-এর জন্য পরিচিত হন, ইউরোপীয় জাদু বাস্তবতার যা একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখনী এবং দানজিগ ত্রয়ীর প্রথম অংশ যাতে ‘ক্যাট এ্যন্ড মাউস ও ডগ ইয়ার্স’ অর্ন্তভূক্ত রয়েছে। তার লেখা সবসময় বামপন্থী রাজনৈতিক লেখা হিসেবে ধরা হয়ে থাকে এবং তিনি সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ জার্মানির একজন সক্রিয় সমর্থনকারী। ‘দ্য টিন ড্রাম’ উপন্যাসটি নিয়ে একই নামের চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে যা ১৯৭৯ সালে পাম ডি’অর এবং সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্রের জন্য একাডেমি পুরস্কার অর্জন করে। সুয়েডীয় একাডেমি ১৯৯৯ সালে তাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে।
গ্রাস ১৩ এপ্রিল ২০১৫ সালে লুবেক শহরে ৮৭ বছর বয়সে ফুসফুসের সংক্রমণ জনিত কারণে মৃত্যু বরণ করেন।
—————————————
[ সংগৃহীত ও সম্পাদিত
ঋণস্বীকার – দুলাল আল মনসুর ]