জাপানের সাহিত্য-সংস্কৃতির সংক্ষিপ্ত পরিচয়
জাপানি সাহিত্যের প্রাথমিক নিদর্শনগুলিতে চিন ও চিনা সাহিত্যের প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বহু ক্ষেত্রে ধ্রুপদী চিনা ভাষায় প্রাচীন জাপানে সাহিত্য সৃষ্টি হত। জাপানে বৌদ্ধধর্মের প্রসারের সময় থেকে ভারতীয় সাহিত্যের প্রভাবও দেখা যায়। ক্রমশ জাপানি সাহিত্যিকরা স্বদেশের সম্বন্ধে লেখালেখি আরম্ভ করলে জাপানি সাহিত্যের নিজস্ব ধাঁচ ও নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি তৈরি হয়, কিন্তু চিনের প্রভাব এদো যুগ অবধি কম-বেশি বজায় ছিল। উনবিংশ শতাব্দীতে জাপান পাশ্চাত্য বাণিজ্য ও কূটনীতির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলে পাশ্চাত্য ও জাপানি সাহিত্য একে অপরকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়া আজও অতিমাত্রায় সক্রিয়।
জাপানি সাহিত্যকে ঐতিহাসিকভাবে ছয় ভাগে ভাগ করা যায়, যথা – প্রাচীন, ধ্রুপদী, মধ্যযুগীয়, প্রাক্ আধুনিক (এদো যুগ), আধুনিক ও যুদ্ধোত্তর সাহিত্য।
প্রাচীন সাহিত্য (৭৯৪ সাল পর্যন্ত)
চিন থেকে কাঞ্জি চিত্রাক্ষর আত্তিকরণের আগে অবধি জাপানি ভাষার কোনও লিখিত রূপ ছিল না। প্রথমে জাপানি বাক্য গঠনের প্রক্রিয়াটি চিনা অক্ষরে লেখা হত। ফলে যে লেখন সম্পন্ন হত তাকে দেখতে লাগত চিনা লেখার মতো, কিন্তু পড়তে হত জাপানি উচ্চারণে। চিনা অক্ষরে ক্রমশ রদবদল হতে শুরু হয় মান্ইয়োগানা (万葉仮名?)। মান্ইয়োগানা ছিল আধুনিক কানা বা দল ভিত্তিক বর্ণের আদিরূপ। প্রথম সাহিত্যকর্মগুলি রচিত হয় নারা যুগে। এগুলোর মধ্যে আছে কোজিকি (古事記?,৭১২ সাল), একাধারে ইতিহাস, পুরাণ ও লোকগাথার একটি সংগ্রহ, নিহন শোকি (日本書紀?,৭২০ সাল), আরেকটি রচনাসংগ্রহ যা কোজিকির চেয়ে বেশি অনুপুঙ্খাণুপুঙ্খ, এবং মান্ইয়োশুউ (万葉集?,৭৫৯ সাল), যা একটি কাব্যসংগ্রহ।
ধ্রুপদী সাহিত্য (৭৯৪ সাল থেকে -১১৮৫ সাল পর্যন্ত)
ধ্রুপদী জাপানি সাহিত্য বলতে সাধারণত হেইআন যুগের সাহিত্যকে বোঝায়। এই যুগ শিল্পকলা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে জাপানের স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিত। ‘মুরাসাকি শিকিবু’ রচিত গেঞ্জির গল্প (源氏物語?, গেঞ্জি মোনোগাতারি) হল একাদশ শতাব্দীর জাপানি কল্প-সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কীর্তি ও নিঃসন্দেহে বিশ্বের প্রাচীনতম উপন্যাস। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ লেখার মধ্যে আছে ওয়াকা কাব্যসংকলন “কোকিন্ ওয়াকাশুউ’ (৯০৫ সালে) এবং মুরাসাকি শিকিবুর সমসাময়িক সেই শোনাগোন্ রচিত বালিশ-কথা (枕草子? , মাকুরা নো সোওশি, ৯৯০ সাল)। শেষোক্ত বইটি সমকালীন জাপানের রাজসভার সভাসদদের দৈনন্দিন জীবন বিষয়ক কাহিনি। বর্তমানে জাপানি বর্ণমালার অন্যতম প্রামাণ্য পদ্য ‘ইরোহা’ কাব্যও এই যুগের প্রথম পর্বে তৈরি হয়েছিল।
দশম শতাব্দীর জাপানি কাহিনী ‘বাঁশ কাঠুরের গল্প’ (竹取物語, তাকেতোরি মোনোগাতারি) জাপানের প্রাচীনতম ফ্যান্টাসি (কল্প-প্রবণ) গল্প। আরেকটি বৃহৎ গল্পসংগ্রহ হল ‘অতীতের গল্পসংকলন’ (今昔物語集, কোঞ্জাকু মোনোগাতারিশুউ), যার ৩১ টি খণ্ডে এক হাজারেরও বেশি কাহিনি নথিভুক্ত আছে। এতে জাপান ছাড়াও ভারত ও চিনের নানা কাহিনি পাওয়া যায়। এই যুগে জাপানের রাজসভাসদগণ কবিদের বিশেষ ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করত, যাঁদের মধ্যে অনেকে আবার নিজেরা ছিলেন সভাসদ বা তাদের সহকারী। কাব্য সংকলনের সম্পাদনা ছিল তাদের কাছে অন্যতম প্রিয় অবসর বিনোদনের বিষয়।
মধ্যযুগীয় সাহিত্য (১১৮৫ সাল থেকে – ১৬০৩ সাল পর্যন্ত)
মধ্যযুগে জাপানে বহু যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকার ফলে এক বিশেষ যোদ্ধা শ্রেণীর জন্ম হয়। সেইসঙ্গে যুদ্ধকেন্দ্রিক গল্প ও ইতিহাস-উপাখ্যান রচিত হতে থাকে। এই যুগের সাহিত্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে চিন্তা-প্রবণতা, সরল জীবনযাত্রার গুণগান ও প্রতিশোধ-স্পৃহা মূলক রস-রচনার আধিক্য। এই যুগের এক আদর্শ কাহিনি হল ‘হেইকের গল্প’ (平家物語, হেইকে মোনোগাতারি, ১৩৭১ সালে)। এর উপজীব্য বিষয় হল দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে জাপানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মিনামোতো ও তাইরা গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব। সমসাময়িক অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাহিনি হল ‘কামো নো চোওমেই’-এর রচিত ‘হোওজোওকি’ (方丈記, ১২১২ সালে) এবং ‘য়োশিদা কেঙ্কো’ রচিত ‘আলস্যের ফসল’ (徒然草, ৎসুরেযুরেগুসা, ১৩৩১ সালে)।
এই যুগে আবিষ্কৃত সাহিত্যধারার মধ্যে পড়ে শৃঙ্খলিত কাব্য রেঙ্গা এবং নাটক। এই দুটি ধারাই মুরোমাচি যুগের আরম্ভে – মধ্য চতুর্দশ শতাব্দীতে দ্রুত উন্নতি লাভ করে।
প্রাক্ আধুনিক সাহিত্য (১৬০৩ সাল থেকে – ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত) (এদো যুগ)
এই সাহিত্য প্রধানত শান্তিপূর্ণ তোকুগাওয়া যুগ বা এদো যুগে রচিত সাহিত্য। নতুন রাজধানী এদো নগরে (অধুনা তোকিও) শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থানের ফলে লোকপ্রিয় বিভিন্ন ধরনের নাটকের সৃষ্টি হয় যা পরবর্তীকালে কাবুকির জন্ম দেয়। জোওরুরি সঙ্গীতজ্ঞ ও কাবুকি নাট্যকার ‘চিকামাৎসু মোন্যাএমোন’ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাকে জাপানের শেক্সপিয়ার বলা হয়। ‘মাৎসুও বাশো’ রচনা করেন ভ্রমণকাহিনি ‘সরু গহন পথ’ (奥の細道, মূল সংস্করণে おくのほそ道, ওকু নো হোসোমিচি)। জিপ্পেন্শা ইক্কু ছিলেন বিখ্যাত রম্য রচনাকার। তলোয়ার যোদ্ধা, লেখক ও শিল্পী ছিলেন মিনামোতো মুসাশির (১৫৮৪ সাল থেকে – ১৬৪৫ সাল) ।
এদো যুগে জাপানিতে বহু নতুন সাহিত্যধারার জন্ম হয়। নগরমুখী ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাক্ষরতার ক্রমর্ধমান হার বৃদ্ধির ফলে এবং সর্বজনীন পাঠাগারের প্রচলন হওয়ার ফলে এটা সম্ভব হয়ে উঠেছিল। নাগাসাকির ওলন্দাজ ঘাঁটি থেকে যৎসামান্য পাশ্চাত্য প্রভাব দেখা দিলেও প্রাথমিক আধুনিক জাপানি কল্পসাহিত্যে মূল বাহ্যিক প্রভাব ছিল চিন থেকে আগত কল্প-সাহিত্য। ‘ইহারা সাইকাকু’-কে জাপানের আধুনিক উপন্যাসের রূপকার বলা যেতে পারে, যিনি তার লেখায় বিভিন্ন বর্ণনায় চলতি কথোপকথন ঢোকান। ‘জিপ্পেনশা ইক্কু’ লেখেন রম্য ভ্রমণকাহিনী ‘তোওকাইদোওচুউ হিযাকুরিগে’ (東海道中膝栗毛, ১৮০২ সাল থেকে – ১৮২২ সাল পর্যন্ত)। ‘ৎসুগা তেইশো’, ‘তাকেবে আয়াতারি’ এবং ‘ওকাজিমা কান্যান’-এর নিষ্ঠায় আত্মপ্রকাশ করে নতুন ধারা য়োমিহোন, যার অর্থ প্রায় সম্পূর্ণ গদ্যে লেখা ঐতিহাসিক রোমান্স। এর পিছনে চিনের তিন রাজ্য (三国志, জাপানিতে সাংগোকু শি), শুই হু ঝুয়ান (水滸伝, জাপানিতে সুইকোদেন) প্রভৃতি গদ্যকাহিনীর প্রভাব ছিল। ‘উয়েদা আকিনারি’ লেখেন অত্যন্ত জনপ্রিয় ‘য়োমিহোন উগেৎসু মোনোগাতারি’ এবং ‘হারুসামে মোনোগাতারি’। ১৭৯৯ সালে কান্সেই অধ্যাদেশে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার আগে অবধি ‘সান্তোও কিয়োদেন’ তার বিভিন্ন য়োমিহোনে সমকামিতার উল্লেখ করতেন। অধ্যাদেশের পর থেকে তিনি রম্যরচনা লিখতে আরম্ভ করেন। সমকালীন সাহিত্যধারার মধ্যে ছিল ভয়, অপরাধবোধ, নীতিকথা, রম্যরচনা ও পর্ণোগ্রাফি। গল্পের সাথে প্রায়ই কাঠের ফলকে মুদ্রিত ছবি থাকত।
এসব সত্ত্বেও এদো যুগে পূর্ববর্তী যুগের মত চিনাই ছিল বিদ্বৎসমাজের ভাষা, যেমন ছিল প্রাচীন ভারতে সংস্কৃত, সুলতানী ও মুঘল ভারতে ফার্সি বা মধ্যযুগীয় ইউরোপে লাতিন।
আধুনিক সাহিত্য (১৮৬৮ সাল থেকে – ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত)
মেইজি যুগে দীর্ঘ স্বেচ্ছা-বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটিয়ে জাপান বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং অতি দ্রুত শিল্পায়নের পথে অগ্রসর হয়। তখন ইউরোপীয় সাহিত্যের সাথে পরিচিত হওয়ার ফলে জাপানি সাহিত্যে মুক্ত পদ্যের (Free Verse) প্রবেশ ঘটে। তরুণ জাপানি সাহিত্যিক ও কবিরা অজস্র নতুন চিন্তার প্রকাশভঙ্গি ও আত্তিকরণের জন্য সচেষ্ট হন, কিন্তু ঔপন্যাসিকরাই এই কাজে প্রথম সাফল্য পান।
‘নাৎসুমে সোওসেকি’-র হাসির ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাস ‘আমি একটা বিড়াল’ (吾輩は猫である,ওয়াগাহাই ওয়া নেকো দে আরু, ১৯০৫ সালে) এক বিড়ালকে কথক হিসেবে আশ্রয় করে লেখা কাহিনি (বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর -এর কথা মনে পড়ে)। ঐ লেখকেরই অন্যান্য রচনার মধ্যে পড়ে ‘বোচ্চান’ (坊っちゃん, ১৯০৬ সাল) ও ‘কোকোরো’ (こころ, ১৯১৪ সালে)। ‘নাৎসুমে’ ও তার সমসাময়িক ‘মোরি ওওগাই’ ও ‘শিগা নাওয়্যা’ বিভিন্ন পাশ্চাত্য সাহিত্য-কৌশলের জাপানিকরণের কাজে মূল ভূমিকা নেন। ‘শিগা নাওয়্যা’ স্বদেশী সাহিত্যে উত্তম পুরুষে কথকের পরিচয় ঘটান এবং তাকে জাপানের ‘উপন্যাসের দেবতা’ আখ্যাও দেওয়া হয়।
জাপানি সাহিত্যে রোমান্টিকতাবাদের আগমন ঘটে ‘মোরি ওওগাইয়’-এর অনূদিত ‘কবিতা সংকলন’-এর (১৮৮৯ সালে) মাধ্যমে এবং তা সমৃদ্ধির শিখর স্পর্শ করে। ‘তোওসোন শিমাযাকি’ প্রমুখ লেখক ও ‘মিয়োজো’ ও ‘বুংগাকু-কাই’ ইত্যাদি সাময়িকী পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতায় বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সাহিত্যের প্রসার ঘটে।
১৯২০ সাল থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে সর্বহারার সাহিত্য আন্দোলনের মাধ্যমে ‘তাকিজি কোবায়াশি’, ‘দেঞ্জি কুরোশিমা’, ‘য়ুরিকো মিয়ামোতো’ এবং ‘ইনেকো সাতা’ প্রমুখেরা এক রাজনৈতিকভাবে স্বতন্ত্র সাহিত্যের জন্ম দেন যা সমাজের বঞ্চিত ও শোষিত শ্রেণীর মানুষের দুঃখ দুর্দশার কথা তুলে ধরে তারা সাহিত্যের মাধ্যমে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জাপানের ভাষার মাধুর্য ও প্রেম ও নিসর্গের উপর সাহিত্য সৃষ্টিকারী বেশ কিছু লেখকের আবির্ভাব হয়। এঁদের মধ্যে আছেন ‘জুন্ইচিরোও তানিযাকি’ এবং জাপানের প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ‘য়াসুনারি কাওয়াবাতা’, যিনি মনস্তাত্ত্বিক কল্পসাহিত্যের এক দিকপাল। ‘আশিহেই হিনো’ যুদ্ধের জয়গান করেন, আবার ‘তাৎসুযোও ইশিকাওয়া’ নান্জিং আক্রমণের অস্বস্তিকর স্পষ্ট বিবরণ দেন। যে সমস্ত সাহিত্যিক যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন তাদের মধ্যে আছেন ‘দেঞ্জি কুরোশিমা’, ‘মিৎসুহারো কানেকো’, ‘হিদেও ওগুমা’ এবং ‘জুন ইশিকাওয়া’।
যুদ্ধোত্তর সাহিত্য (১৯৪৫ সালের পর থেকে)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয় জাপানি সাহিত্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। অনেক লেখক – স্বপ্নভঙ্গ, উদ্দেশ্যহীনতা ও পরাজয়ের গ্লানির সাথে বোঝাপড়া করার কথা তাদের লেখায় প্রতিফলিত হতে থাকে। ‘হারুও উমেযাকি’-র উপন্যাস ‘সাকুরাজিমা-য় এক সংশয়ী নৌ আধিকারিকের বিষয়ে জানান যিনি যুদ্ধের সময় কিউশু দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে সাকুরাজিমা আগ্নেয় দ্বীপের এক নৌঘাঁটিতে কর্মরত ছিলেন। ‘ওসামু দাযাইয়’-এর উপন্যাস ‘অস্ত্যমান সূর্য’ কাহিনিতে মাঞ্চুকুও থেকে প্রত্যাবর্তনরত এক সৈনিকের কথা জানান। ‘শোওহেই ওওকা’ তাঁর উপন্যাস ‘সমতলে অগ্নিকাণ্ড’-এর জন্য য়োমিউরি পুরস্কার লাভ করেন। এই উপন্যাসে ফিলিপাইন্সের জঙ্গলে এক দলত্যাগী জাপানির উন্মাদ হয়ে যাওয়ার বর্ণনা আছে। বিখ্যাত ও বিতর্কিত লেখক ‘য়ুকিও মিশিমা’ যুদ্ধোত্তর পর্বে লেখালেখি শুরু করেন। ‘নোবুও কোজিমা’-র ছোটগল্প ‘মার্কিন স্কুল’-য়ে কয়েকজন জাপানি ইংরেজি শিক্ষকের কথা পাওয়া যায় যাঁরা যুদ্ধের অব্যবহিত পরে অধিগৃহীত জাপানের পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন।
১৯৭০ সাল ও ১৯৮০ সালের লেখকেরা বিভিন্নভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনসচেতনতা বাড়াতে সচেষ্ট হন। এঁদের একজন ‘কেন্যাবুরো ওওয়ে’ ১৯৬৪ সালে তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘ব্যক্তিগত ব্যাপার’ (個人的な体験, কোজিন্তেকিনা তাইকেন) প্রকাশ করেন এবং এই কাজের জন্য তিনি জাপানি হিসেবে সাহিত্যে ‘দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কার’ পান।
‘মিৎসুহারু ইনোওয়ে’ পরমাণু বোমা সম্পর্কে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং ১৯৮০ সাল পর্যন্ত পারমাণবিক যুগের নানা সংকট নিয়ে তিনি সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। ‘শুসাকো এন্দো’ সামন্ততান্ত্রিক জাপানের গুপ্ত খ্রিস্টান সম্প্রদায় কাকুরে কিরিশিতান-দের ধর্মসংকটকের পরিস্থিতিকে ভিত্তি করে বৃহত্তর আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনার দিকে মনোযোগ দেন। ‘ইয়াসুশি ইনোওয়ে’ ছিলেন আরও একজন অতীতচারী সাহিত্যিক যিনি এশিয়া ও প্রাচীন জাপানের বর্ণনার মধ্য দিয়ে বর্তমান মানবসমাজের নিয়তির মর্ম উদ্ধারের চেষ্টা করেন।
‘আঁভা-গার্দ’-য়ের প্রভাব যেসব সাহিত্যিকদের মধ্যে পড়েছিল, তাদের মধ্যে আছেন ‘কোওবো আবে’-র মত লেখক, যিনি ‘বালিয়াড়ির মহিলা’ (砂の女, সুনা নো ওন্না, ১৯৬০ সালে) ইত্যাদি উপন্যাসে আন্তর্জাতিক প্রভাবহীন আধুনিক জাপানি অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করতে চেষ্টা করেছেন। ‘য়োশিকিচি ফুরুই’, ‘শিৎযুকো তোওদোও’ প্রমুখ সাহিত্যিকদের রচনায় আধুনিক নগরবাসীদের জীবনযাত্রার ঘাত-প্রতিঘাতের বিবরণ পাওয়া যায়।
‘হারুকি মুরাকামি’ আধুনিক জাপানি সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় ও বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। তার পরাবাস্তব, রম্যরসাত্মক ও প্রচলিতধারা বহির্ভূত রচনা আদৌ উচ্চমার্গীয় সাহিত্য নাকি সস্তা জনপ্রিয়তা কুড়োনোর কৌশল, তা নিয়ে জাপানের পাঠকদের মনে বিতর্ক থাকলেও তাকে মোটেও উপেক্ষা করা যায়নি। ‘বানানা য়োশিমোতো’-র মাঙ্গাসুলভ রচনা প্রাথমিকভাবে (১৯৮০ সালের শেষভাগে) বিতর্কের জন্ম দিলেও বর্তমানে তাকে স্বতন্ত্র প্রতিভার অধিকারী হিসেবে গণ্য করা হয়।
১৯৮০ সালে জাপানে জনপ্রিয় কল্পসাহিত্য, বাস্তবানুগ সাহিত্য ও শিশুসাহিত্যের বিকাশ ঘটেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। জনপ্রিয় সাহিত্যের অনেক কাহিনির উদাহরণই “প্রকৃত সাহিত্য” ও “জঞ্জালের” মাঝামাঝি অবস্থান করে। এর মধ্যে আছে ঐতিহাসিক ধারাবাহিক, তথ্যবহুল তথ্যচিত্র-কাহিনি, কল্পবিজ্ঞান, রহস্য-রোমাঞ্চ, গোয়েন্দা গল্প, বাণিজ্যভিত্তিক কাহিনী, যুদ্ধের গল্প ও প্রাণীজগৎ-কেন্দ্রিক গল্প।
মাঙ্গা এখন জাপানের সর্বস্তরের পাঠকের কাছে পৌঁছেছে। জাপানের ইতিহাস থেকে শুরু করে অর্থনীতি ও পর্ণোগ্রাফি সমেত প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রের উপরেই মাঙ্গা সাহিত্য প্রভাব বিস্তার করেছে। ১৯৮০ সালেই জাপানের মোট বই বিক্রির পরিমাণ ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ছিল মাঙ্গা।
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে জাপানে মুদ্রিত বই ও অনলাইনে সেলফোন উপন্যাস দুই প্রকারেই অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ২০০৭ সালের শেষে কল্পসাহিত্যের সেরা পাঁচটি বেস্টসেলারের চারটিই ছিল সেলফোন উপন্যাস।
————————————————————–
[ সংগৃহীত ও সম্পাদিত। তথ্যসূত্র – উইকিপিডিয়া ]
Abe (১৯৯৯ সাল), পৃষ্ঠা – ৩৯২, ৩৯৮.
Earl, David Margery, Emperor and Nation in Japan; Political Thinkers of the Tokugawa Period, University of Washington Press, Seattle, ১৯৬৪ সাল,পৃষ্ঠা – ১২.
Goodyear, Dana (২২ শে ডিসেম্বর ২০০৮ সাল)। “Novels” – The New Yorker. ১লা ডিসেম্বর ২০১০ সালে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ই ডিসেম্বর ২০১০ সালে। ]