Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জগ্যিদাসের মামা || Jogyidaser Mama by Sukumar Ray

জগ্যিদাসের মামা || Jogyidaser Mama by Sukumar Ray

তার আসল নামটি যজ্ঞদাস। সে প্রথম যেদিন আমাদের ক্লাশে এল পণ্ডিতমশাই তার নাম শুনেই ভ্রূকুটি করে বললেন, “যজ্ঞের আবার দাস কি? যজ্ঞেশ্বর বললে তবু না হয় বুঝি।” ছেলেটি বলল, “আজ্ঞে, আমি তো নাম রাখিনি, নাম রেখেছেন খুড়োমশাই।”
এই শুনে আমি একটু ফিক করে হেসে ফেলেছিলাম, তাই পণ্ডিতমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বানান কর যজ্ঞদাস।” আমি থতমত খেয়ে বললাম, “বর্গীয় জ”- পণ্ডিতমশাই বললেন, “দাঁড়িয়ে থাক।” তারপর একটি ছেলে ঠিক বানান বললে পর তিনি আরেকজনকে বললেন, “সমাস কর।” সে বেচারা ভয় পেয়ে বলল, “যোগ্য ছিল দাস– হল যোগ্যদাস– অর্থাৎ–” পণ্ডিতমশাই বললেন, “থাক থাক আর বলতে হবে না।”
দুদিন না যেতেই বোঝা গেল যে, জগ্যিদাসের আর কোনো বিদ্যে থাকুক আর নাই থাকুক আজগুবি গল্প বলবার ক্ষমতাটি তার অসাধারণ। একদিন সে ইস্কুলে দেরি করে এসেছিল, কারণ জিগ্‌‌গেস করাতে সে বলল, “রাস্তায় আসতে পঁচিশটা কুকুর হাঁ হাঁ করে আমায় তেড়ে এসেছিল। ছুটতে ছুটতে হাঁপাতে হাঁপাতে সেই কুণ্ডুদের বাড়ি পর্যন্ত চলে গিয়েছিলম।” পঁচিশটা দূরের কথা, দশটা কুকুরও আমরা এক সঙ্গে চোখে দেখিনি, কাজেই কথাটা মাস্টারমশাইও বিশ্বাস করেননি। তিনি জিগ্‌‌গেস করলেন, “এত মিছে কথা বলতে শিখলে কার কাছে?” জগ্যিদাস বলল, “আজ্ঞে মামার কাছে।” সেদিন হেডমাস্টারের ঘরে জগ্যিদাসের ডাক পড়েছিল, সেখানে কি হয়েছিল আমরা জানি না, কিন্তু জগ্যিদাস যে খুশি হয়নি সেটা বেশ বোঝা গেল।
কিন্তু সত্যি হোক আর মিথ্যে হোক, তার গল্প বলার বাহাদুরি ছিল। সে যখন বড় বড় চোখ করে গম্ভীর গলায় তার মামাবাড়ির ডাকাত ধরার গল্প বলত, তখন বিশ্বাস করি আর না করি শুনতে শুনতে আমাদের মুখ আপনা হতেই হাঁ হয়ে আসত। জগ্যিদাসের মামার কথা আমাদের ভারি আশ্চর্য ঠেকত। তার গায়ে নাকি যেমন জোর তেমনি অসাধারণ বুদ্ধি। তিনি যখন ‘রামভজন’ বলে চাকরকে ডাক দিতেন, তখন ঘর বাড়ি সব থরথর করে কেঁপে উঠত। কুস্তি বল, লাঠি বল, ক্রিকেট বল, সবটাতেই তাঁর সমান দখল। প্রথমটা আমরা বিশ্বাস করিনি, কিন্তু একদিন সে তার মামার ফটো এনে দেখাল। দেখলাম পালোয়ানের মতো চেহারা বটে! এক-একবার ছুটি হত আর জগ্যিদাস তার মামার বাড়ি যেত, আর এসে সে সব গল্প বলত তা কাগজে ছাপবার মতো। একদিন স্টেশনে আমার সঙ্গে জগ্যিদাসের দেখা, একটা গাড়ির মধ্যে মাথায় পাগড়ি বাঁধা চমৎ‌কার জাঁদরেল চেহারার একটি কোন দেশী ভদ্রলোক বসে। আমি ইস্কুলে ফিরতে ফিরতে জগ্যিদাসকে জিগ্‌‌গেস করলাম, “ঐ পাগড়ি বাঁধা লোকটাকে দেখেছিলি?” জগ্যিদাস বলল, “ঐ তো আমার মামা।” আমি বললাম, “ফটোতে তো কালো দেখেছিলম।” জগ্যিদাস বলল, “এবার সিমলে গিয়ে ফরসা হয়ে এসেছেন।” আমি ইস্কুলে গিয়ে গল্প করলাম, “আজ জগ্যিদাসের মামাকে দেখে এলুম।” জগ্যিদাসও খুব বুক ফুলিয়ে মুখখানা গম্ভীর করে বলল, “তোমরা তো ভাই আমার কথা বিশ্বাস কর না। আচ্ছা, না হয় মাঝে মাঝে দুটো একটা গল্প ব’লে থাকি। তা ব’লে কি সব‌‌ই আমার গল্প। আমার জলজ্যান্ত মামাকে সুদ্ধ তোমরা উড়িয়ে দিতে চাও?” এ-কথায় অনেকেই মনে মনে লজ্জা পেয়ে, ব্যস্ত হয়ে বারবার বলতে লাগল, “আমরা কিন্তু গোড়া থেকেই বিশ্বাস করেছিলম।”
তারপর থেকে মামার প্রতিপত্তি ভয়ানক বেড়ে গেল। রোজ‌‌ই সব ব্যস্ত হয়ে থাকতাম মামার খবর শুনবার জন্য। কোনোদিন শুনতাম মামা গেছেন হাতি গণ্ডার বাঘ মারতে। কোনোদিন শুনতাম, একাই তিনি পাঁচটা কাবুলীকে ঠেঙিয়ে ঠিক করেছেন, এরকম প্রায়‌‌ই হত। তার পর একদিন সবাই আমরা টিফিনের সময় গল্প করছি, এমন সময় হেডমাস্টার মশাই ক্লাশে এসে বললেন, “যজ্ঞদাস, তোমার মামা এসেছেন।” হঠাৎ‌ যজ্ঞদাসের মুখখানা আমসির মতো শুকিয়ে গেল- সে আম্‌‌তা আম্‌‌তা ক’রে কি যেন বলতে গিয়ে আর বলতে পারল না। তারপর লক্ষ্মী ছেলেটির মতো চুপচাপ মাস্টার মশায়ের সঙ্গে চলল। আমরা বললাম, ভয় হবে না? জানো তো কি রকম মামা!” সবাই মিলে উৎ‌সাহ আর আগ্রহে মামা দেখবার জন্য একেবারে ঝুঁকে পড়লাম। গিয়ে দেখি, একটি রোগা কালো ছোকরা গোছের ভদ্রলোক, চশমা চোখে গোবেচারার মতো বসে আছেন। জগ্যিদাস তাঁকেই গিয়ে প্রণাম করল।
সেদিন সত্যিসত্যি‌‌ই আমাদের রাগ হয়েছিল। এম্নি করে ফাঁকি দেওয়া। মিথ্যে করে মামা তৈরি! সেদিন আমাদের ধমকের চোটে জগ্যিদাস কেঁদেই ফেলল। সে তখন স্বীকার করল যে, ফটোটা কোনো এক পশ্চিমা পালোয়ানের। আর সেই ট্রেনের লোকটাকে সে চেনেই না। তারপরে কোনো আজগুবি জিনিসের কথা বলতে হলেই আমরা বলতাম, “জগ্যিদাসের মামার মতো।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *