Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

ছন্দের মাত্রা – ১

বহুকাল পূর্বে একটি গান রচনা করেছিলেম। “সবুজপত্রে’ সেটি উদ্‌ধৃত হয়েছিল।

               আঁধার রজনী পোহালো,
                         জগৎ পুরিল পুলকে,
               বিমল প্রভাতকিরণে
                         মিলিল দ্যুলোক ভূলোকে।

তাছাড়া এই ছন্দে পরবর্তী কালে দুই-একটি শ্লোক লিখেছিলুম। যথা–

               গোড়াতেই ঢাক বাজনা,
                         কাজ করা তার কাজ না।

আরেকটি–

               শকতিহীনের দাপনি
                         আপনারে মারে আপনি।

বলা বাহুল্য এগুলি নয় মাত্রার চালে লেখা।

“সবুজপত্রে’র প্রবন্ধে তার পরে দেখিয়েছিলুম ধ্বনিসংখ্যার কতরকম হেরফের করে এই ছন্দের বৈচিত্র্য ঘটতে পারে, অর্থাৎ তার চলন কত ভঙ্গির হয়। তাতে যে-দৃষ্টান্ত রচনা করেছিলেম তার পুনরুক্তি না করে নতুন বাণী প্রয়োগ করা যাক।

এইখানে বলে রাখা ভালো এই প্রবন্ধে ব্যবহৃত উদাহরণগুলিতে প্রত্যেক ভাগে তাল দিলে ছন্দের পার্থক্য ধরা সহজ হয়।

উপরের ছন্দে ৩+৩+৩এর লয়। নিচের ছন্দে ৩+২+৪এর লয়।

           আসন ।  দিলে ।  অনাহূতে,
                     ভাষণ ।  দিলে ।  বীণাতানে,
           বুঝি গো।  তুমি ।  মেঘদূতে ।
                     পাঠায়ে ।  ছিলে ।  মোর পানে।
           বাদল রাতি এল যবে
                     বসিয়াছিনু একা একা,
           গভীর গুরু গুরু রবে
                     কী ছবি মনে দিল দেখা।
           পথের কথা পুবে হাওয়া
                     কহিল মোরে থেকে থেকে;
           উদাস হয়ে চলে যাওয়া,
                     খ্যাপামি সেই রোধিবে কে।
           আমার তুমি অচেনা যে
                     সে কথা নাহি মানে হিয়া,
           তোমারে কবে মনোমাঝে
                     জেনেছি আমি না জানিয়া।
           ফুলের ডালি কোলে দিনু,
                     বসিয়াছিলে একাকিনী,
           তখনি ডেকে বলেছিনু,
                     তোমারে চিনি, ওগো চিনি॥

তার পরে ৪+৩+২ —

           বলেছিনু ।  বসিতে ।  কাছে,
                     দেবে কিছু ।  ছিল না ।  আশা,
           দেব ব'লে ।  যেজন ।  যাচে
                     বুঝিলে না ।  তাহারো ।  ভাষা।
           শুকতারা চাঁদের সাথি
                     বলে, "প্রভু, বেসেছি ভালো,
           নিয়ে যেয়ো আমার বাতি
                     যেথা যাবে তোমার আলো।"
           ফুল বলে, "দখিনাহাওয়া,
                     বাঁধিব না বাহুর ডোরে,
           ক্ষণতরে তোমারে পাওয়া
                     চিরতরে দেওয়া যে মোরে।"

তার পরে ৩ + ৬ —

           বিজুলি ।  কোথা হতে এলে,
                     তোমারে ।  কে রাখিবে বেঁধে।
           মেঘের ।  বুক চিরি গেলে
                     অভাগা ।  মরে কেঁদে কেঁদে।
           আগুনে গাঁথা মণিহারে
           ক্ষণেক সাজায়েছে যারে,
           প্রভাতে মরে হাহাকারে
                     বিফল রজনীর খেদে।

দেখা যাক ৪ + ৫ —

           মোর বনে ।  ওগো গরবী,
                     এলে যদি ।  পথ ভুলিয়া,
           তবে মোর ।  রাঙা করবী
                     নিজ হাতে ।  নিয়ো তুলিয়া।

আরেকটা–

           জলে ভরা । নয়নপাতে
                     বাজিতেছে ।  মেঘরাগিণী,
           কী লাগিয়া ।  বিজনরাতে
                     উড়ে হিয়া, ।  হে বিবাগিনী।
           ম্লানমুখে ।  মিলালো হাসি,
                     গলে দোলে ।  নবমালিকা।
           ধরাতলে ।  কী ভুলে আসি
                     সুর ভোলে ।  সুরবালিকা।

তার পরে ৪ + ৪ + ১। বলে রাখা ভালো এই ছন্দটি পড়াবার সময় সবশেষ ধ্বনিটিকে বিচ্ছন্ন করতে হবে।–

           বারে বারে ।  যায় চলি ।  য়া,
                     ভাসায় ন ।  য়ননীরে ।  সে,
           বিরহের ।  ছলে ছলি ।  য়া
                     মিলনের ।  লাগি ফিরে ।  সে।
           যায় নয়নের আড়া লে,
                     আসে হৃদয়ের মাঝে গো।
           বাঁশিটিরে পায়ে মাড়া লে
                     বুকে তার সুর বাজে গো।
           ফুলমালা গেল শুকা য়ে,
                     দীপ নিবে গেল বাতা সে,
           মোর ব্যথাখানি লুকা য়ে
                     মনে তার রহে গাঁথা সে।
           যাবার বেলায় দুয়া রে
                     তালা ভেঙে নেয় ছিনি য়ে,
           ফিরিবার পথ উহা রে
                     ভাঙা দ্বার দেয় চিনি য়ে॥

৩ + ২ + ৪এর লয় পূর্বে দেখানো হয়েছে। ৫ + ৪এর লয় এখানে দেওয়া গেল।

           আলো এল যে ।  দ্বারে তব,
                     ওগো মাধবী ।  বনছায়া।
           দোঁহে মিলিয়া ।  নবনব
                     তৃণে বিছায়ে ।  গাঁথ মায়া।
           চাঁপা, তোমার            আঙিনাতে
                     ফেরে বাতাস              কাছে কাছে;
           আজি ফাগুনে             একসাথে
                     দোলা লাগিয়ো            নাচে নাচে॥
               বধূ, তোমার              দেহলিতে
                     বর আসিছে               দেখিছ কি।
           আজি তাহার              বাঁশরিতে
                     হিয়া মিলায়ে              দিয়ো, সখি।

৬ + ৩এর ঠাটেও নয় মাত্রাকে সাজানো চলে। যেমন–

               সেতারের তারে ।  ধানশী
                         মিড়ে মিড়ে উঠে ।  বাজিয়া।
               গোধূলির রাগে ।  মানসী
                         সুরে যেন এল ।  সাজিয়া।        

আরেকটা–

               তৃতীয়ার চাঁদ ।  বাঁকা সে,
               আপনারে দেখে ।  ফাঁকা সে।
                         তারাদের পানে ।  তাকিয়ে
                         কার নাম যায় ।  ডাকিয়ে,
               সাথি নাহি পায় ।  আকাশে।

এতক্ষণ এই যে নয় মাত্রার ছন্দটাকে নিয়ে নয়-ছয় করছিলুম সেটা বাহাদুরি করবার জন্যে নয়, প্রমাণ করবার জন্যে যে এতে বিশেষ বাহাদুরি নেই। ইংরেজি ছন্দে এক্‌সেন্‌টের প্রভাব; সংস্কৃত ছন্দে দীর্ঘহ্রস্বের সুনির্দিষ্ট ভাগ। বাংলায় তা নেই, এইজন্যে লয়ের দাবিরক্ষা ছাড়া বাংলা ছন্দে মাত্রা বাড়িয়ে-কমিয়ে চলার আর-কোনো বাধা নেই। “জল পড়ে পাতা নড়ে’ থেকে আরম্ভ করে পাঁচ ছয় সাত আট নয় দশ মাত্রা পর্যন্ত বাংলা ছন্দে আমরা দেখি। এই সুযোগে কেউ বলতে পারেন, এগারো মাত্রার ছন্দ বানিয়ে নতুন কীর্তি স্থাপন করব। আমি বলি, তা করো কিন্তু পুলকিত হোয়ো না, কেননা কাজটা নিতান্তই সহজ। দশ মাত্রার পরে আর-একটা মাত্রা যোগ করা একেবারেই দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়। যেমন–

               চামেলির ঘনছায়া বিতানে
               বনবীণা বেজে ওঠে কী তানে।
               স্বপনে মগন সেথা মালিনী
               কুসুমমালায় গাঁথা শিথানে॥

অন্যরকমের মাত্রাভাগ করতে চাও সেও কঠিন নয়। যেমন–

               মিলনসুলগনে ।  কেন বল্‌,
               নয়ন করে তোর ।  ছল্‌ছল্‌।
               বিদায়দিনে যবে ।  ফাটে বুক,
               সেদিনো দেখেছি তো ।  হাসিমুখ।

তারপরে তেরো মাত্রার প্রস্তাবটা শুনতে লাগে খাপছাড়া এবং নতুন, কিন্তু পয়ার থেকে একমাত্রা হরণ করতে দুঃসাহসের দরকার হয় না। সে কাজ অনেকবার করেছি, তা নিয়ে নালিশ ওঠে নি। যথা–

               গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।

এক মাত্রা যোগ করে পয়ারের জ্ঞাতিবৃদ্ধি করাও খুবই সহজ। যথা–

               হে বীর, জীবন দিয়ে মরণের জিনিলে,
               নিজেরে নিঃস্ব করি বিশ্বেরে কিনিলে।

ষোলো মাত্রার ছন্দ দুর্লভ নয়। অতএব দেখা যাক সতেরো মাত্রা–

               নদীতীরে দুই ।  কূলে কূলে ।
                         কাশবন দুলি ।  ছে ।
               পূর্ণিমা তারি ।  ফুলে ফুলে ।
                         আপনারে ভুলি ।  ছে ।

আঠারো মাত্রার ছন্দ সুপরিচিত। তার পরে উনিশ —

               ঘন মেঘভার গগনতলে,
                         বনে বনে ছায়া তারি,
               একাকিনী বসি নয়নজলে
                         কোন্‌ বিরহিণী নারী।

তারপরে কুড়ি মাত্রার ছন্দ সুপ্রচলিত। একুশ মাত্রা, যথা–

               বিচলিত কেন মাধবীশাখা,
                         মঞ্জরি কাঁপে থরথর।
               কোন্‌ কথা তার পাতায় ঢাকা
                         চুপিচুপি করে মরমর।

তারপরে– আর কাজ নেই, বোধ হয় যথেষ্ট প্রমাণ করতে পেরেছি যে, বাংলায় নতুন ছন্দ তৈরি করতে অসাধারণ নৈপুণ্যের দরকার করে না।

সংস্কৃত ভাষায় নূতন ছন্দ বানানো সহজ নয়, পুরানো ছন্দ রক্ষা করাও কঠিন। যথানিয়মে দীর্ঘহ্রস্ব স্বরের পর্যায় বেঁধে তার সংগীত। বাংলায় সেই দীর্ঘধ্বনিগুলিকে দুইমাত্রায় বিশ্লিষ্ট করে একটা ছন্দ দাঁড় করানো যেতে পারে, কিন্তু তার মধ্যে মূলের মর্যাদা থাকবে না। মন্দাক্রান্তার বাংলা রূপান্তর দেখলেই তা বোঝা যাবে।

যক্ষ সে কোনো জনা আছিল আনমনা, সেবার অপরাধে প্রভুশাপে
হয়েছে বিলয়গত মহিমা ছিল যত, বরষকাল যাপে দুখতাপে।
নির্জন রামগিরি শিখরে মরে ফিরি একাকী দূরবাসী প্রিয়াহারা
যেথায় শীতল ছায় ঝরনা বহি যায় সীতার স্নানপূত জলধারা।
মাস পরে কাটে মাস, প্রবাসে করে বাস প্রেয়সীবিচ্ছেদে বিমলিন;
কনকবলয়-খসা বাহুর ক্ষীণ দশা, বিরহদুখে হল বলহীন।
একদা আষাঢ় মাসে প্রথম দিন আসে, যক্ষ নিরখিল গিরি’পর
ঘনঘোরে মেঘ এসে লেগেছে সানুদেশে, দন্ত হানে যেন করিবর।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *