Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ছকটা সুডোকুর || Suchitra Bhattacharya » Page 6

ছকটা সুডোকুর || Suchitra Bhattacharya

১১-১২. সদ্য কেনা ডিজিটাল ক্যামেরা

সদ্য কেনা ডিজিটাল ক্যামেরায় পটাপট ছবি তুলছিল পার্থ। ব্যালকনিতে বুমবুম আর টুপুরকে দাঁড় করিয়ে শাটার টিপল বারকয়েক। হোটেলরুমে বুমবুমকে নানা ভঙ্গিমায় বসিয়ে পরীক্ষা করল ফ্ল্যাশগান। টুপুর ড্রেসিংটেবিলের সামনে চুল আঁচড়াচ্ছে, বুমবুম ভেংচাচ্ছে টুপুরকে, চিরুনি উঁচিয়ে ভাইকে মার দেখাল টুপুর …একের পর এক দৃশ্য বন্দি হচ্ছে ক্যামেরায়। সঙ্গে-সঙ্গে খুদে মনিটরে ছবিগুলো দেখেও নিচ্ছে তিনজনে। মন্তব্য চলছে টুকটাক।

পাৰ্থ প্ৰসন্ন মেজাজে বলল, ছবির কোয়ালিটি তো ভালই মনে হচ্ছে।

টুপুর বলল, প্রিন্টারটাও একবার টেস্ট করে নাও।

ক্যামেরার সঙ্গে আস্ত একটা ছবিছাপাই যন্ত্র মুফতে পাওয়া গিয়েছে। সত্যি বলতে কী, প্রিন্টারের লোভেই ক্যামেরার এই মডেলখানা পছন্দ করেছে পার্থ। চকচকে মুখে সে বলল, এখনই প্যাকিং খুলব? না কলকাতায় গিয়ে?

কেমন প্রিন্ট হয় একবার দেখে নেবে না?

মহা উৎসাহে বাক্সটা সবে হাতে নিয়েছিল পাৰ্থ, মিতিন স্নান সেরে বেরিয়েছে। চোখ পাকিয়ে বলল, কী ছেলেমানুষি করছ? কোথায় এখন মালপত্র সুটকেসে ভরবে, তা নয়…

তুমি বড্ড বেরসিক তো!

বেশি রসিক হয়ে কাজ নেই। সাড়ে বারোটা বাজে, চলো, আগে খেয়ে আসি। দুপুরে বুমবুমকে একটু ঘুমিয়ে নিতে হবে। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফিরতে কত রাত হয় কে জানে?

টুপুর জিজ্ঞেস করল, আমরা দমদমে নামছি কটায়?

সাড়ে দশটা।

সে কী গো? মাত্র দেড় ঘণ্টায় পৌঁছে যাব? আসার সময় চার ঘণ্টা লেগেছিল না? বলেই টুপুর জিভ কাটল, সরি, সরি। কলকাতার ঘড়ি তো সিঙ্গাপুরের চেয়ে পিছিয়ে।

কারেক্ট। দ্রাঘিমারেখা পরিবর্তনের জন্য হারিয়ে যাওয়া আড়াই ঘণ্টা সময়টাকে ফেরত পেতে হবে তো।

পাৰ্থ নীচে যাওয়ার জন্য তৈরি। বুমবুমও। মার দেওয়া লম্বা তালিকা ধরে সকালে গাদাখানেক কেনাকাটা করেছে টুপুর, মালবোঝাই প্লাস্টিকব্যাগ নিজের সুটকেসের পাশে রেখে সে-ও বেরিয়ে পড়ল রুম ছেড়ে। সব শেষে দরজা বন্ধ করল মিতিন।

বুমবুম লিফট চড়তে বেজায় ভালবাসে। তাকে পার্থর সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়ে মিতিন আর টুপুর সিঁড়ি ধরল। লাউঞ্জ পেরোতে গিয়ে টুপুরের পা আটকে গিয়েছে সহসা। সুজিত দত্ত সোফায় বসে! সেই একই ছদ্মবেশ। তবে নাকের সাইজ আজ একটু ছোট। সেদিকে মিতিনমাসির দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই চাপা ধমক, তাকাস না। সোজা হাঁট। খেয়ে তাড়াতাড়ি রুমে ফিরতে হবে।

কেন গো। গোছগাছ তো মোটামুটি কমপ্লিট। শুধু যা দু চারটে…

প্রশ্ন নয় মাই ডিয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট। এখন শুধু দেখে যাওয়া।

বিদায়ী মধ্যাহ্নভোজনের এলাহি ব্যবস্থা করেছে পার্থ। চিনা আর ভারতীয় পদ মিলিয়েমিশিয়ে। ইন্ডিয়ান পোলাও আছে, চাইনিজ ফ্রায়েড রাইসও। চিকেন আর চিংড়ির সঙ্গে আছে এক অতিকায় কাঁকড়ার তন্দুর। শেষ পাতে ঢালাও আইসক্রিম। গলা অবধি টইটুম্বুর করে পার্থ যখন টেবিল ছাড়ল, সে রীতিমতো হাঁসফাঁস করছে। টুপুরেরও পেট আইঢাই।

অগত্যা এবার চারজনেই ফিরল লিফটে। ঘরে এসে পাৰ্থ বলল, বুমবুমের সঙ্গে আমিও একটু গড়িয়ে নিই?

সে সুযোগ পাবে কি?

কেন?

মন বলছে, এখনই কোনও অতিথি আসবেন।

মনকে চুপ করিয়ে রাখো।

হয়েছে কি হয়নি, অমনি মিতিনের বাক্যকে সত্যি করে দিয়ে দরজায় টকটক।

মিতিনই গিয়ে দরজা খুলেছে। একগাল হেসে বলল, আরে, মিস্টার নারায়ণ যে? আসুন, আসুন।

নামটা কানে যেতেই টুপুরের চক্ষুস্থির। পার্থও তোক উঠে বসেছে। তার মুখ দিয়ে প্রশ্ন ছিটকে এল, আপনি? আপনি কোত্থেকে?

নারায়ণ ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলেন। স্বভাবসুলভ বিনয়ী সুরে বললেন, আসতে বাধ্য হলাম স্যার।

মানে?

আমাদের হেড অফিসে আপনি মেল করেছিলেন… ওরাই আমায় নির্দেশ পাঠাল। বলল, মিস্টার মুখার্জিরা সিঙ্গাপুর ছাড়ার আগে তাদের সঙ্গে মনোমালিন্য মিটিয়ে নাও।

পাৰ্থ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না না, মনোমালিন্যের কী আছে। জাস্ট একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল মাত্ৰ।

একদম ঠিক কথা স্যার। আমিও আপনার কথায় কিছুই মনে করিনি। কাল আর কনট্যাক্ট করতে পারিনি, কারণ এক জাপানি কাপলকে নিয়ে বিশ্রীভাবে ব্যস্ত ছিলাম। মর্নিং টু নাইট ওদের গাইড হয়ে ঘুরতে হচ্ছে। আপনারা মেল না করলেও হোটেল ছাড়ার আগে আমি তো একবার আসতামই।

মিতিন স্মিতমুখে নারায়ণের কথা শুনছিল। হাত বাড়িয়ে বলল, দাঁড়িয়ে কেন? বসুন।

থ্যাঙ্কস। সোফায় বসে সুটের পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন নারায়ণ। রুমাল যথাস্থানে রেখে বললেন, হেড অফিস বলল, অরিজিনাল লেটারটা কলকাতা অবধি আপনাদের ক্যারি করার দরকার নেই। স্বচ্ছন্দে ওটা আমাকে দিয়ে দিতে পারেন।

পার্থ জিজ্ঞেস করল, কী মিতিন, ওঁকে দেওয়া যাবে তো?

অবশ্যই। উনি কষ্ট করে এসেছেন… মিতিন ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে পেঙ্গুইন রিসর্টসের প্যাডে লেখা চিঠিটা বের করল। নারায়ণকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, দেখে নিন, এটাই আসল তো?

নারায়ণ চোখ বোলালেন, হ্যাঁ, ঠিক আছে।

না না, ভাল করে দেখুন। যদি চান, তো আমার ম্যাগনিফায়িং গ্লাসটাও দিতে পারি। খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে নিন, যা চাইছেন তাই পেলেন কিনা।

ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে আমার কী হবে? নারায়ণের মুখে ফ্যাকাশে হাসি। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, অল রাইট, চলি তা হলে?

কিন্তু আপনাকে যে এখনই ছাড়তে ইচ্ছে করছে না মিস্টার নারায়ণ, মিতিনের স্বর সহসা কঠিন, তা ছাড়া চাইলেও বোধ হয় এখন আর যেতে পারবেন না।

মানে?

বাইরে আপনার শুভাকাঙক্ষীরা অপেক্ষা করছে যে! সঙ্গীসাথী নিয়ে, বলতে বলতে মিতিন গিয়ে দরজা খুলেছে, আপনারা এবার আসতে পারেন স্যার।

প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই সুজিত দত্ত ঢুকেছেন ঘরে। সঙ্গে জনাচারেক সিঙ্গাপুরি পুলিশ। বিনা বাক্যব্যয়ে তারা হাতকড়া পরিয়ে দিল নারায়ণকে।

ক্ষণিকের জন্য নারায়ণ হতভম্ব। পরক্ষণে চেঁচিয়ে উঠলেন, এটা কী হল? এটা কী হল?

বুঝতে পারছেন না, মিস্টার নারায়ণ? সরি, মিস্টার শঙ্করন? ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোপন তথ্য পাচার করার অভিযোগে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হল। আপনার সিঙ্গাপুরের সহকারীরাও এখন পুলিশের জিন্মায়। ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট ট্র্যাভেল এজেন্সি সিল করে দেওয়া হয়েছে।

এটা একেবারেই মিথ্যে অভিযোগ। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, নারায়ণ আরও গলা চড়ালেন, আমি একজন নিতান্ত নিরীহ মানুষ। সিঙ্গাপুরে খেটে খেতে এসেছি।

আপনি আত্মপক্ষ সমর্থনের ঢের সুযোগ পাবেন, মিস্টার নারায়ণ, এতক্ষণ পর সুজিত দত্ত মুখ খুললেন, তবে তার আগে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বদেশে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করি। হয়তো জেনে আহ্লাদিত হবেন, আজ একই সঙ্গে দিল্লিতেও আপনার দুজন কর্মচারী ধরা পড়েছেন। রাজেশ শ্ৰীবাস্তব। এবং অরুণ মাত্রে। আশা রাখি, তাঁরা আপনার কীর্তিকলাপের বিস্তৃত বিবরণ দিতে পারবেন।

যেন জোঁকের মুখে নুন পড়ল। পলকে মিইয়ে গেলেন নারায়ণ। অথবা শঙ্করন। ল্যাগব্যাগে লোকটা প্রায় টলে পড়ে যাচ্ছিলেন, পুলিশ অফিসার তাঁকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। এখনও নারায়ণের হাতে ধরা আছে পেঙ্গুইনের সুদৃশ্য চিঠিখানা।

ছোঁ মেরে চিঠিটা নিয়ে নিল মিতিন। নারায়ণ কটমট চোখে ঘুরে দেখলেন তাকে। মিতিন গ্রাহ্য করল না।

বাকরুদ্ধ হয়ে পার্থ এতক্ষণ দেখছিল জমজমাট নাটকখানা। নারায়ণকে বগলদাবা করে পুলিশ রওনা দেওয়ার পর সুজিত দত্ত ছদ্মবেশ ছেড়ে ফেললেন। দেখে পাৰ্থ বিমোহিত। কোনওক্রমে তোতলাতে-তোতলাতে বলল, ও। আ-আমি তা হলে ভুল করিনি। আপনি ক্রিমিনাল নন। পুলিশের লোক।

উহুঁ। এক ডিগ্রি উপরে, মিতিন শুধরে দিল, উনি মিলিটারি।

ইয়েস, আমি লেফটেনান্ট কর্নেল সুজিত দত্ত, পার্থর সঙ্গে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন সুজিত, এখন আমি মিলিটারির সিক্রেট সার্ভিসে আছি। একটা অর্গানাইজড গ্যাং বেশ কিছুদিন যাবৎ আমাদের অনেক গোপন খবর বিদেশে পাচার করছিল। খবরগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে নিয়মিত কেনাবেচা হয়। আমাদের কাছে ইনফরমেশন ছিল, ওই গ্যাং এখন সিঙ্গাপুর থেকেই অপারেশন চালাচ্ছে। কিন্তু তাদের কাজের পদ্ধতি এত সরল এবং এমনই নিখুঁত যে, কিছুতেই আমরা তাদের হাতেনাতে ধরতে পারছিলাম না। আপনার মিসেসের উপস্থিত বুদ্ধির জোরে, কেসটার আজ সমাধান হল।

কুষ্ঠিত স্বরে মিতিন বলল, না না, আমার তেমন কৃতিত্ব নেই। নারায়ণ, ওরফে শঙ্করন, যদি কয়েকটা বেসিক ভুল না করতেন, তা হলে হয়তো ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভাবতামই না।

কী রকম?

প্রথমেই আমার খটকা লেগেছিল প্রাইজের ব্যাপারটায়। সাধারণত এ ধরনের বিদেশ ভ্রমণের অফার যারা দেয়, তারা ট্র্যাভেল ভাউচার পাঠায়। তাদের প্রতিনিধি সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে, এটাও যেন কেমন অস্বাভাবিক লেগেছিল আমার। তারপর যখন এয়ারপোর্টে নামলাম, লোকটা তখন আগে থেকেই হাজির ছিল। আমি তাকে নোটিশও করেছি। কিন্তু লোকটা আমাদের নেহাতই বুরবক ভেবে দেরি হওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করল। আসলে ও তখন একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আমাদের বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। এই লুকোচুরিটা আমার খটকাটাকে আরএকটু উসকে দেয়, মিতিন গলা ঝেড়ে নিল, এর পর তো চিঠি এপিসোড। নারায়ণ অরিজিনাল চিঠির জন্য ছটফট করতে লাগল। আর আমিও শিওর হয়ে গেলাম, ইনভিটেশন লেটারেই কোনও গণ্ডগোল আছে। কিন্তু গড়বড়ের নেচারটা কী বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ভাবতে-ভাবতে হঠাৎই মনে হল, পেঙ্গুইন রিসর্টস প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তো কোনও না-কোনও ফ্যামিলিকে সিঙ্গাপুরে পাঠায়। এবং নারায়ণ মেটিকুলাসলি তাদের কাছ থেকে একটি চিঠি কালেক্ট করে। তাহলে কি সব চিঠিতেই গণ্ডগোল থাকে? নাকি শুধু আমাদেরটাতেই? ভাবছি… ভাবছি… হঠাৎই মিস্টার দত্ত আমায় খানিকটা সাহায্য করে দিলেন।

পার্থ অবাক মুখে বলল, কীভাবে?

সেন্টোসায় মিস্টার দত্ত আমাদের ফলো করছিলেন। যদিও তখন আমি মিস্টার দত্তকে ছদ্মবেশে দেখে ঠিক চিনতে পারিনি। এও বুঝিনি, আমি ঠিক যতটা ওঁকে সন্দেহ করছি, উনিও ঠিক ততটাই আমাদের সন্দেহ করছিলেন।

হান্ড্রেড পারসেন্ট কারেক্ট, ম্যাডাম, সুজিত দত্ত হাসলেন, কারণ আমাদের সোর্স খবর দিয়েছিল, পেঙ্গুইন রিসর্টস ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি ভুয়ো কোম্পানি ক্যারিয়ারের মাধ্যমে সিক্রেট ইনফরমেশন চালান করছে। কিন্তু ওই চালান করার পদ্ধতিটা আমরা কিছুতেই ধরতে পারছিলাম না। আপনাদের আগে যাঁরা পেঙ্গুইনের সৌজন্যে সিঙ্গাপুর সফর করে গিয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কে ডিটেলে খবর নিয়েছি। তারা সকলেই একেবারে সাদামাটা নিরীহ ফ্যামিলি। বেআইনি কাজকারবার থেকে তাঁরা শত হস্ত দুরে থাকেন। তাই এবার ঠিক করি, যে পরিবারকেই সিঙ্গাপুরে পাঠানো হোক, আমরা খোদ সিঙ্গাপুরেই তাঁদের গতিবিধির উপর নজর রাখব। কার্লটন হোটেলেও আমি সেই উদ্দেশ্যেই উঠেছিলাম।

বুঝেছি, পার্থ বলল, আমার সঙ্গে সারা সন্ধে আড্ডা দিয়ে যখন বুঝলেন আমরা বদ লোক নই, তখন আপনি আমাদের ছাড়ান দিলেন।

কিছুটা তাই। বিশেষ করে নারায়ণ চিঠির জন্য ঝুলোঝুলি করার সময় আপনি ফোনে যেভাবে রিঅ্যাক্ট করলেন, তাতে বোঝাই যায় আপনাদের ওই দলের সঙ্গে কোনও যোগ নেই।

গোমড়া গলায় মিতিন বলল, এটাই তো নারায়ণের ট্রিক মিস্টার দত্ত। ওরা এমন পরিবারকে বেছে নিয়ে পাঠায়, যারা নিজেদের অজ্ঞাতেই দুষ্কর্মের সহযোগী হয়ে যায়। চিঠিটা পাৰ্থর ব্যাগ থেকে মিসপ্লেন্ড না হলে আমরাও তাই হতাম। কিন্তু আমাদের মতো ভুল আগে কেউ করেনি। নারায়ণের কাজও তাই স্মুথলি চলছিল। প্রথম এরকম একটা পরিস্থিতিতে পড়ে নারায়ণ মারাত্মক এক ভুল করে ফ্যালে। কোনও এক অনুচরকে পাঠিয়ে ১০৪ নম্বর ঘরে তন্নতন্ন করে তল্লাশি চালায়। কার্লটন হোটেলের নিরাপত্তা বেশ ঢিলেঢালা। পেশাদার বজ্জাতদের পক্ষে হোটেলের ঘর খুলে ফেলা আদৌ কোনও সমস্যা নয়। রিসেপশনের মেয়েগুলো তো খেয়ালই করে না, কে আসছে, কে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিন আর-একটা ঠোক্কর খেল নারায়ণ। আমরা যে স্রেফ একটু প্রকৃতি দর্শনের জন্য রুম পালটে ফেলব, এটা ওর হিসেবেই ছিল না। ফলে লোকটা আরও খানিকটা এক্সপোজড হয়ে গেল। এবং সঙ্গে-সঙ্গে, হয়তো কিছুটা নার্ভাস হয়েই, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগটা ছিঁড়ে ফেলল। এত পাকা মাথা, অথচ এটুকু ওর মগজে আসেনি, এতে মানুষের সন্দেহ আরও গাঢ় হয়।

আহা, এর জন্য আপনি নারায়ণকে দোষ দিতে পারেন না, সুজিত দত্ত হাসতে হাসতে বললেন, ও বেচারার কারবার একেবারে সাধারণ লোকদের নিয়ে। হঠাৎ তার মধ্যে আস্ত একটা গোয়েন্দা ঢুকে পড়বে, এটা ও আন্দাজ করবে কী করে? তাও মিস্টার মুখার্জি যদি ডিটেকটিভ হতেন… নারায়ণ আগেই সাবধান হয়ে যেত। এবং এই বেড়ানোর অফারটা আপনারা পেতেনই না।

বটেই তো বটেই তো, পার্থ গাল ছড়িয়ে হাসল, বায়োডেটা পাঠানোর সময় আমার মিসেসের অকুপেশন তো গৃহবধূ লিখেছিলাম। রোজগার-টোজগার করে জানালে যদি ব্যাটারা অফারটাকে কমিয়ে দেয়। হয়তো হোটেল ভাড়া মাইনাস করে দিল। কিংবা এক পিঠের প্লেনফেয়ার…

অজান্তেই মোক্ষম চালটা দিয়েছিলেন মশাই। ওই চালেই নারায়ণের ঘটিবাটি চাঁটি হয়ে গেল, সুজিত হো-হো হাসছেন। হাসতে হাসতে বললেন, আপনার ই-মেলের প্ল্যানটাও কিন্তু জব্বর ম্যাডাম। নারায়ণ যে এত সহজে টোপ গিলবে, এটা সত্যিই বিশ্বাস করা কঠিন।

লোভ। লোভ। এই চিঠিটার আশা যদি ছেড়ে দিত, তা হলে হয়তো ও বেঁচে যেত। একসময় তো দিয়েওছিল। কিন্তু ই-মেলটা পেতেই আবার লোভটা চাগিয়ে উঠল। একটা চিঠি বেচে ও হয়তো লক্ষ ডলার কামায়। তাই না গুটিগুটি ফের পা বাড়াল।

অনেকক্ষণ ধৈর্য ধরে কথার পিঠে কথা শুনছিল টুপুর। এবার প্রায় মরিয়া হয়ে বলে ফেলল, কিন্তু একটা সিম্পল চিঠির কী এমন মহিমা? যার থেকে লক্ষ ডলার ইনকাম হয়?

মিতিন চিঠিটা বাড়িয়ে দিল, পড়। পড়ে দ্যাখ!

আদ্যোপান্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ল টুপুর, তুৎ, এ তো সাধারণ এক আমন্ত্রণলিপি। এর মধ্যে রহস্য কোথায়?

পার্থও ঝুঁকে দেখছিল চিঠিটা। জিজ্ঞেস করল, ভাষাতেই কোনও সংকেত আছে, তাই না? উই মানে হয়ত হান্ড্রেড! প্লিজড মানে হয়তো ব্যাটেলিয়ান। কিংবা সাবমেরিনা।

ঘোড়ার মাথা। সাংকেতিক ভাষার অর্থ উদ্ধারের জন্য মিলিটারিতে আলাদা একটা বিভাগ আছে। ঠিক কি না, মিস্টার দত্ত?

আছে বইকী। তবে এদের সংকেত পাঠানোর পদ্ধতি একেবারেই নতুন। এই ধরনের কেস আমরা এই প্রথম পেলাম।

মিতিন বলল, অথচ ভেবে দেখলে পদ্ধতিটা অতি সিম্পল। চিঠির ভাষা আপনারা নানানভাবে খতিয়ে দেখবেন। কিন্তু সেখানে কিসসু নেই। চিঠির মাথায়, কোম্পানির প্রতীক পেঙ্গুইনের গায়ে, অতি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম লেখা বসিয়ে নারায়ণ যে সবাইকে বুদ্ধ বানাচ্ছিল, কে-ই বা ধারণা করবে? এভাবে খবর পাচার করাটাকে বলে স্টেগানোগ্রাফি।

জানি, সুজিত দত্ত মাথা নাড়লেন, তবে এভাবে কারিকুরি করে প্রতি সপ্তাহেই যে দেশের বাইরে গোপন খবর চলে যাচ্ছে, এটা অনুমান করা কি সম্ভব? বিশেষ করে সংবাদবাহকরা যেখানে গোটা ব্যাপারটা সম্পৰ্কে একেবারেই অন্ধকারে?

তা ঠিক, মিতিন চিঠিটা নিয়ে সুজিত দত্তর হাতে দিল, এই চিঠি আপনাদেরই সম্পত্তি। আপনিই রাখুন। তবে নারায়ণের লোকজনের এলেম আছে। চালের উপর আস্ত রামায়ণ লেখার মতো খুদি-খুদি অক্ষরে দিব্যি কেমন লিখে দিয়েছে। ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়েও পরিষ্কার পড়তে পারলাম না। সম্ভবত সিয়াচেনটিয়াচেন গোছের কিছু লেখা আছে। সঙ্গে কিছু সংখ্যাও। আপনাদের শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপের নীচে নিশ্চয়ই পুরোটা পড়া যাবে।

মৃদু হাসলেন সুজিত দত্ত। চিঠিটা পকেটে পুরে উঠে দাঁড়ালেন। মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, আপনাকে আবার একবার ধন্যবাদ জানাই ম্যাডাম। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক অভিনন্দন।

থ্যাঙ্ক ইউ। মিতিনও মাথা নোওয়াল, আপনি কি আজকের ফ্লাইটে ফিরছেন?

না ম্যাডাম। নারায়ণ আর তার শাগরেদদের দেশে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে। প্রচুর ফর্মালিটি আছে। সেনাবাহিনী প্রতিরক্ষা মন্ত্রককে জানাবে, সেখান থেকে সিঙ্গাপুর সরকারের কাছে অনুরোধ আসবে …এ এক লম্বা প্রসেস। শেষ পর্যন্ত হয়তো আমি থাকব না। তবে শুরুটা তো করে যেতে হবে।

সুজিত দত্ত বেরিয়ে গেলেন। এতক্ষণ গমগম করছিল ঘরটা, হঠাৎই নিশ্চুপ। তখনই টুপুরের নজরে পড়ল, এত কিছু ঘটে গেল, অথচ তার মধ্যেও কী নিশ্চিন্তে নিদ্ৰা যাচ্ছে বুমবুম!

টুপুর ঝুঁকে ধাক্কা দিল ভাইকে, অ্যাই কুম্ভকৰ্ণ, ওঠ। জাগ।

পার্থ ফোড়ন কাটল, উহুঁ, কুম্ভকৰ্ণ নয়। কুম্ভকনম। ঘুমের জালে ধরা পড়েছে।

.

১২.

আবার আকাশে উড়ল বিমান। চলেছে কলকাতা অভিমুখে। এবারও মাঝের সিটে মিতিন, পাৰ্থ, বুমবুম আর টুপুর। সিটবেল্ট খোলার পরেই আচমকা খিদে পেয়ে গেল পার্থর। জুলজুল চোখে দেখছে কখন স্ন্যাক্স-ট্যাক্স আসে। নৈশাহারের এখনও একটু দেরি, বেত যতক্ষণ না আসে কানমলা তো চলুক।

টুপুরের এখনও সিঙ্গাপুরের ঘোর কাটেনি। আপন মনে বলল, জীবনে প্রথম বিদেশ বেড়াতে এসে জোর একটা অভিজ্ঞতা হল যা হোক।

পার্থ ঠাট্টার সুরে বলল, হ্যাঁ। একে বলে শিক্ষামুলক ভ্ৰমণ।

মিতিন বসেছে বুমবুমের ওপারে। ঘাড় হেলিয়ে বলল, কী কী শিক্ষা পেলে শুনি?

অনেক। অনেক। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি! এক নম্বর, সুডোকু একটি বিপজ্জনক খেলা। নয় বাই নয় ঘরের ছক মিলিয়ে যে প্রাইজ মেলে, সেটি গ্রহণ করলে হাতে হাতকড়া পরা অসম্ভব নয়। দুনম্বর, বিনি পয়সায় বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পেলে নাচতে নাচতে রাজি হতে নেই। কে যে কীভাবে গাড্ডায় ফেলে দেবে, টেরও পাওয়া যাবে না। তিন নম্বর, অজানা অচেনা কোম্পানির চিঠি থেকে শত হস্ত দূরে থাকা উচিত। চার নম্বর, যারা শুধু ই-মেলের মাধ্যমে যোগাযোগ করে, তারা লোক মোটেই সুবিধের নয়।

টুপুর হিহি হেসে উঠল, তুমি তো বেশ লম্বা তালিকা বানিয়ে ফেলেছ!

এ তো গেল শিক্ষার ফৰ্দ। এর পর যদি কৌতূহলের লিস্টটা পেশ করি, তোর মাসি আঁতকে উঠবে।

কেন?

দুপুরে অপরাধীকে ধরার পর যা সুচারু যুক্তিজাল বিস্তার করে দিল, তারপর আর কি কোনও প্রশ্নের উত্তর দেবে?

মিতিন হেসে ফেলল, আহা, শোনাই যাক।

হয়তো খুবই বোকার মতো প্রশ্ন …তবু পার্থ টেরিয়ে তাকাল, নারায়ণ আর শঙ্করন যে একই লোক, তুমি বুঝলে কী করে?

শাস্ত্রে পড়োনি, সব দেবতাই তো এক। যিনি শিব, তিনিই বিষ্ণু। যিনি নারায়ণ, তিনিই দেবাদিদেব শঙ্কর।

মগজে সেঁধোল না। মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। একটু বাংলা করে বলবে কি?

স্ট্র্যাভেল এজেন্সি থেকে ভাড়া করা গাড়ি কি কেউ নিজে চালায়?

দ্যাখো কাণ্ড। এই সরল ব্যাপারটা মাথায় আসেনি।

আর কী জিজ্ঞাস্য আছে?

অরিজিনাল চিঠিখানা তুমি ঠিক কখন খুঁজে পেয়েছিলে?

এই জবাবটা দেওয়া যাবে না।

অর্থাৎ সিঙ্গাপুর রওনা হওয়ার আগেই অরিজিনালটা আমার ব্যাগ থেকে হাতিয়ে তার জায়গায় স্ক্যান করা কপিটা পুরে দিয়েছিলে?

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

মা আর বাবার প্রশ্নোত্তরের খেলা মন দিয়ে শুনছিল বুমবুম। হঠাই সে হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠেছে, আমি একটা কোয়েশ্চেন করতে পারি?

কাকে জিজ্ঞেস করবি? মাকে? না আমাকে?

তোমাদের তিনজনকেই।

বলে ফ্যালো।

সিঙ্গাপুরে একটাও সিঙ্গাপুরি কলা দেখলাম না কেন?

টুপুর, মিতিন আর পার্থ শব্দ করে হেসে উঠল। সত্যি, এও এক রহস্য বটে। হয়তো এই রহস্যের সন্ধানেই হয়তো তাদের আসতে হবে সিঙ্গাপুর। আরও একবার।

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 6 of 6 ): « পূর্ববর্তী1 ... 45 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *