চ্যানেল এক্স
রাত আটটা নাগাদ বাড়ি ফেরামাত্রই শাশুড়িমা বললেন, বাবাজীবন, আজ পঞ্চাশটাকা উপার্জন করিয়াছি। টিভি হইতে খসিয়া পড়িয়াছে।
আমি গা থেকে ঘামে ভেজা শার্টটা খুলতে যাচ্ছিলাম—ওঁর কথা শুনে স্ট্যাচু হয়ে গেলাম।
না, শাশুড়িমার সাধুভাষা শুনে আমি অবাক হইনি। কারণ তাপসীর সঙ্গে আমার বিয়ের পর থেকেই এই পিকিউলিয়ার সাধুভাষার চচ্চড়ি শুনে আসছি। আমি অবাক হয়েছি ওই পঞ্চাশটাকা উপার্জনের কেসটা শুনে।
টিভি হইতে টাকা খসিয়া পড়িয়াছে? এ তো বড় রঙ্গ জাদু!
আমার শাশুড়িমা রোগাপাতলা ছোটখাটো মানুষ। টকটকে ফরসা গায়ের রং। তবে বয়েসের জন্যে চামড়ায় অনেক ভাঁজ। ওঁর যখন চোদ্দো বছর বয়েস তখন ওঁর গা ঘেঁষে বাজ পড়েছিল। ঘোর বর্ষার রাতে দেশের বাড়িতে কুয়োতলায় জল তুলতে গিয়েছিলেন। তখনই ওই বাজ পড়ে। উনি ছিটকে গিয়ে পড়েছিলেন পাশের কলাগাছের ওপর। এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন।
একঘণ্টা পর যখন জ্ঞান ফেরে তখন তিনি দিব্যি সুস্থ মানুষ। গায়ে সেরকম কোনও কাটাছেঁড়া নেই। শুধু কথাবার্তা বলতে শুরু করেন সাধুভাষায়। আর মাথায় একটু মাটো হয়ে যান।
অনেক ডাক্তার-বদ্যি করেও এই সমস্যা সলভ করা যায়নি। সেকালের একজন নামকরা ডাক্তার নাকি বলেছিলেন, কুয়োতলায় যাওয়ার আগে পেশেন্ট বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ পড়ছিল। তারই একটা পারমানেন্ট সিগনেচার পেশেন্টের ব্রেনের ওপরে পড়ে গেছে।
বয়েসকালে আমার শাশুড়িমা দেখতে নাকি ব্যাপক সুন্দরী ছিলেন। এ-কথা তাপসীর মুখে শুনে-শুনে আমার কান পচে গেছে। একদিন আমি রাগের মাথায় বলেই বসেছি, তোমাকে দেখে সে-কথা কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না।
তবে তাপসীকে যা-ই বলি, শাশুড়িমা সত্যিই সুন্দরী ছিলেন। নইলে আঠেরো বছর বয়েসে ওই সাধুভাষার প্রবলেম থাকা সত্ত্বেও ওঁর সঙ্গে শ্বশুরমশাইয়ের বিয়ে হয়েছিল কেমন করে!
আমার শ্বশুরমশাই মারা গেছেন অনেক আগে। মানে, তাপসীর সঙ্গে আমার বিয়ের অন্তত দশ বছর আগে। তিনি বেশ জাঁদরেল উকিল ছিলেন। সেটা তাপসীকে দেখে বেশ বোঝা যায়। ওর মধ্যে ওকালতির অনেক গুণ আছে। শুধু আমরা দারিদ্র্যরেখার কাছাকাছি লোক বলে ওর গুণগুলো তেমন জ্বালাময়ী স্টাইলে প্রকাশিত হতে পারেনি।
আমি, তাপসী, আর আমার শাশুড়িমা—আমরা একসঙ্গে থাকি। একটা পুরোনো বাড়ির নোনাধরা আড়াইখানা ঘরে। ইংরেজিতে এরই নাম ‘ফ্ল্যাট’। বহুকাল ধরে এই আস্তানায় আছি বলে আজকের আগুন বাজারেও বাড়িভাড়াটা প্রতিমাসে ম্যানেজ করতে পারছি।
তাপসী খুব স্বপ্ন দ্যাখে যে, আমরা ভালো জায়গায় থাকছি, ভালো-মন্দ খাচ্ছি, এদিক-ওদিক উড়ে-ঘুরে বেড়াচ্ছি। এভাবে দুঃখে-কষ্টে চিরকাল যাবে না। দিন বদলাবেই।
আমি একসময় স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু এখন আর দেখি না। এখন মুখের ভেতরটা সবসময় টক-টক হয়ে থাকে। আর মেজাজটা তেতো।
শাশুড়িমার কথায় প্রথম অবাক হলাম, তারপর মাথার ভেতরটা চড়াং করে উঠল। টাকার টানাটানি নিয়ে তাপসীর সঙ্গে দিন-রাত খচরমচর করি বটে, কিন্তু তাই বলে এরকম হ্যাটা দেওয়া রসিকতা! তাও আবার শাশুড়ির কাছ থেকে!
ভেতরের খ্যাপা রাগটাকে কোঁত করে গিলে ফেললাম। তারপর মুখ এবং গলার স্বর যথেষ্ট মোলায়েম করে অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললাম, বলেন কী, মা! পঞ্চাশ টাকা…টিভি থেকে খসে পড়েছে?
চোখ গোল-গোল করলেন আমার রোগা তুলতুলে শাশুড়ি। তারপর সাধুভাষায় যা মেসেজ দিলেন তা ডিকোড করলে এইরকম দাঁড়ায়:
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আমার শাশুড়ি ঘণ্টাদুয়েক দিবানিদ্রা দেন। ওঁর একটু দুঃস্বপ্ন দেখার রোগ আছে। প্রায়ই ঘুমের ঘোরে চেঁচিয়ে ওঠেন, ধড়ফড় করে উঠে বসেন। আজ দুপুরে কী একটা বাজে স্বপ্ন দেখে উনি সাড়ে তিনটে নাগাদ জেগে ওঠেন। তারপর একচিলতে খাওয়ার ঘরে বসে ঘুমচোখে টিভি দেখার মহান কাজ শুরু করেন। তাপসী তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
টিভিতে কী একটা সিনেমা দেখাচ্ছিল। নামটা কী যেন। শাশুড়ি বেশ মনোযোগ দিয়েই দেখেছিলেন। হঠাৎই পরদায় বাজ পড়ার মতো শব্দ আর আলোর ঝলক দেখা গেল। চোদ্দো বছর বয়েসের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় শাশুড়ি এক প্রবল চিৎকার করে উঠেছিলেন। সেই চিৎকারে পাশের ঘরে তাপসীর ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙেই ও ‘চোর! চোর!’ বলে চেঁচাতে শুরু করে। কারণ, ওর মনে হয়েছিল, নির্জন দুপুরে বাড়িতে চোর ঢুকেছে।
এদিকে শাশুড়ি টিভির পরদার দিকে তাকিয়ে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ, ওই বার দু-তিনেক আলোর ঝলকের পরই টিভির চ্যানেলগুলো কীরকম যেন ওলটপালট হয়ে যায়। সিনেমাটা বদলে গিয়ে অন্য কী একটা ছবি শুরু হয়ে যায়। তখন শাশুড়িমা খেয়াল করেছিলেন যে, পরদার এককোণে লেখা রয়েছে ‘চ্যানেল এক্স’। অথচ এই নামে কোনও চ্যানেল আছে বলে তিনি কখনও শোনেননি বা দেখেননি।
এই নতুন সিনেমাটায় একজন মোটা কালোমতন লোক অনেকগুলো টাকা গুনছিল। সব পঞ্চাশটাকার নোট। তখনই একটা নোট সেখান থেকে খসে পড়ে যায়। সেই খসে-পড়া নোটটা হাওয়ায় লাট খেতে-খেতে টিভির পরদা ভেদ করে ঘরের মধ্যে এসে পড়ে। শাশুড়িমা সেটা বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে তুলে নেন। তখনই আবার বাজ পড়ার শব্দ হয় এবং টিভিতে চোখ ঝলসানো আলোর ঝিলিক দেখা যায়। একইসঙ্গে আগের সিনেমাটা আবার ফিরে আসে। সবকিছু আমার শান্তশিষ্ট এবং নরমাল হয়ে যায়।
তাপসী পাশের ঘর থেকে ছুটে এসে দ্যাখে ওর মায়ের হাতে পঞ্চাশটাকার একটা কড়কড়ে নোট। ওর মা ফ্যালফ্যাল করে টিভির দিকে তাকিয়ে আছেন।
এরপর মা ও মেয়ে অনেক আশা নিয়ে টিভির সামনে হা-পিত্যেশ করে বসে থেকেছে কিন্তু শিকে ছেঁড়েনি। সব চ্যানেল ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখেছে, চুলচেরা সূক্ষ্ম নানান পরীক্ষা করেছে, কিন্তু চ্যানেল এক্স আর দেখা দেয়নি।
সব কাজ ফেলে রেখে আমি একটা লজঝড়ে মোড়া টেনে নিয়ে শাশুড়িমার কাছে বসলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার খ্যাপা মনটাকে শান্ত করতে চাইলাম। তারপর বললাম, তপু কোথায়?
শাশুড়িমা বললেন, মম কন্যা নিকটেই এক সুহৃদের বাড়িতে গিয়াছে। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই চলিয়া আসিবে।
হুম। তা পঞ্চাশটাকার নোটটা কোথায়?
এই যে, বাবাজীবন—মম অঞ্চলে।—এ-কথা বলে শাশুড়ি শাড়ির আঁচলের গেঁট খুলতে শুরু করলেন। তখনই খেয়াল হল, অঞ্চল মানে আঁচল।
ছত্তিরিশ ভাঁজ করা পঞ্চাশটাকার নোটটা খুলে চোখের সামনে মেলে ধরলাম। আলোর দিকে উঁচিয়ে ধরে চোখ ছোট-বড় করে ব্যাপক পরীক্ষা চালালাম। কিন্তু কোনও লাভ হল না। মালটা স্রেফ একটা অর্ডিনারি পঞ্চাশটাকার নোট। কোনও স্পেশাল ব্যাপার নেই।
এটা আমার কাছে থাক, বলে নোটটা প্যান্টের পকেটে চালান করে দিলাম। তারপর নড়েচড়ে বসে শাশুড়িমা-কে প্রাণপণ জেরা শুরু করলাম।
কোনও লাভ হল না।
আমার শাশুড়ি একই বক্তব্যে অচল-অনড় রইলেন। মিনমিনে কাহিল গলায় একই কথা বারবার বলে চললেন। শেষে একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, যতই প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করো, বাবাজীবন—টিভি হইতে টাকা খসিয়া পড়িয়াছে। চন্দ্র-সূর্য যেরূপ সত্য, ইহাও তদ্রূপ—চূড়ান্ত সত্য।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি শাশুড়িকে ছেড়ে টিভি নিয়ে পড়লাম। ওটা নানানভাবে পরীক্ষা করতে লাগলাম। টিভির পেছনটা ভালো করে চেক করলাম। নাঃ, কিচ্ছু নেই।
সুতরাং এবার টিভিটা অন করে চ্যানেল সার্ফ করতে লাগলাম। একবার সামনে গেলাম, একবার পেছনে গেলাম।
না, চ্যানেল এক্স নামে কোনও চ্যানেল নেই।
তা হলে এই আজব কেসটার মানে কী?
ভেবে-ভেবে কোনও কূলকিনারা না পেয়ে লাস্টে মনে হল, শালা পঞ্চাশটাকার নোটটাতো রিয়েল! যদি এইভাবে মাঝে-মধ্যে টিভি থেকে নোটপানি পড়ে তা হলে খারাপ কী! দেখতে-দেখতে টিভির দামই উঠে যাবে।
আপনমনে মাথা ঝাঁকিয়ে জামা-প্যান্ট ছাড়তে শোওয়ার ঘরে গেলাম।
পাশের ঘর থেকে শাশুড়িমা চেঁচিয়ে জিগ্যেস করলেন, তুমি কি চা পান করিবে?
আমি বললাম, না, আপনার মেয়ে আসুক…তারপর।
জামা-প্যান্ট ছেড়ে পাজামা আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে নিলাম। চোখে-মুখে জল দিয়ে বিছানার একপাশে বসে নোনা ধরা দেওয়ালে হেলান দিলাম। চোখ বুজে গোটা ব্যাপারটা ভাবতে শুরু করলাম।
পাশের ঘরে টিভি চলছে। শাশুড়িমা ওঁর পুরোনো কাজে ফিরে গেছেন। তাপসী ওর আড্ডা সেরে কখন আসবে কে জানে!
কে যেন ডাকল, গায়ে ঠোকা দিল।
তন্দ্রায় চোখ লেগে গিয়েছিল। চোখ খুলেই দেখি তাপসী।
শুনেছ, আজ কী হয়েছে?
ঘাড় নেড়ে বললাম, হ্যাঁ, সব শুনেছি। মা বলেছে।
এতদিনে ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন।—হাতজোড় করে ঘরের সিলিং-এর দিকে তাকাল তাপসী। সেখানে কড়ি-বরগার মাঝে একটা বড়সড় টিকটিকি চুপচাপ সেঁটে আছে।
ওটার দিকে তাকিয়ে আমি ভাবলাম, কখন যে তিনি কী রূপে থাকেন!
তাপসী বাচ্চা মেয়ের মতো একগাল হেসে বলল, আমরা খুব লাকি, তাই না? এত লোকের বাড়িতে টিভি—কই কারও টিভি থেকে কখনও টাকা পড়েছে বলে তো শুনিনি। আমি সেই কথাটাই ছোটনের মা-কে বলছিলাম।
আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, কেন বলতে গেলে? ওরা যদি পুলিশ-টুলিশে খবর দেয় তা হলে কেলো হয়ে যাবে। ওরা এসে হয়তো টিভিটা-ই নিয়ে চলে যাবে—।
তাপসী ব্যাপারটা বুঝল। চোখ বড়-বড় করে বলল, ঠিকই বলেছ তো! আমি একটা কাঁচা কাজ করে ফেলেছি।—একটু ভেবে আরও বলল, যাকগে, কাল গিয়ে বলে দেব যে, আমি স্রেফ মজা করার জন্যে ও-কথা বলেছিলাম। আর মা-কেও বারণ করে দেব।
আমি ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম। তারপর চাপা গলায় জিগ্যেস করলাম, কিন্তু কেসটা কী বলো তো? এত লোকের টিভি থাকতে শেষকালে আমাদের টিভিতেই…।
ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যে।—কপালে আঙুল ঠেকাল তাপসী।
আমি ওকে বললাম, আমাকে একটু চা খাওয়াও। ভীষণ টায়ার্ড লাগছে।
চা খেতে-খেতে আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে ব্যাপারটা নিয়ে প্রচুর আলোচনা চালালাম, কিন্তু কোনও সমাধানে পৌঁছতে পারলাম না।
শেষ পর্যন্ত ঠিক হল যে, টিভিটা যথাসম্ভব চালু রাখতে হবে।
আমি ইতস্তত করে বললাম, ইলেকট্রিক বিলটা তো অনেক বেড়ে যাবে!
কারণ, এমনিতেই আমি ঘন-ঘন সবুজ রঙের বিলে অভ্যস্ত। তার ওপর চ্যানেল এক্স…।
তাপসী পালটা জবাব দিল, দু-তিনদিন দেখি না! যদি টাকাপয়সা কিছু না পাই তা হলে একটানা আর চালাব না।
ভেতরে-ভেতরে লোভের সুড়সুড়িটা আমিও টের পাচ্ছিলাম। সুতরাং রাজি হয়ে গেলাম। যদি কপাল ভালো থাকে তাহলে শুধু টিভির দাম কেন, ইলেকট্রিক বিলের পয়সাও এই চ্যানেল এক্স থেকে উশুল হয়ে যাবে।
কিন্তু হল না।
তবে তার বদলে যা হল সেটা অসভ্যরকমের মারাত্মক।
সকালবেলা চায়ের কাপে চুমুক দিতে না দিতেই শাশুড়িমার অভিযোগ: শোনো, বাবাজীবন—টিভি হইতে এক বেআক্কেলে যুবক আমাকে চক্ষু মারিয়েছে।
সঙ্গে-সঙ্গে বিষম খেলাম আমি। হাত থেকে চা-সমেত কাপ ছিটকে পড়ল মেঝেতে। আর কাশতে-কাশতে আমার দম বেরোনোর জোগাড়।
আমার বৃদ্ধা শাশুড়িমা-কে চোখ মেরেছে এক বেআক্কেলে যুবক!
তাপসী চায়ে চিনি মেশাতে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকেছিল। তাই ও মায়ের কথাটা ভালো করে শুনতে পায়নি। রান্নাঘর থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে জিগ্যেস করল, কী করেছে, মা—কী করেছে?
কী আর করিবে! চক্ষু মারিয়াছে।
শুনে তাপসী থ। আর আমার অবস্থা ‘ধরণী দ্বিধা হও’ টাইপের।
কী লজ্জা, কী লজ্জা!
আমি কোনওরকমে শোওয়ার ঘরে পালালাম। সেখান থেকে শুনতে পাচ্ছি, তাপসী ওর বৃদ্ধা মা-কে জেরা শুরু করেছে।
আমি খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। চ্যানেল এক্স-এর জ্বালাতন নিয়ে এখন কী করি! দু-তিন একটানা টিভি চালিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু তাতে কোনও ফায়দা হয়নি। তখন নরমাল স্টাইলে চলে এসেছি বটে কিন্তু টিভির দিকে কড়া নজর রেখে চলেছি। আমার মা তাপসীর চোখে সেরকম কিছু পড়েনি। কিন্তু পড়ল তো পড়ল গিয়ে ওর মায়ের চোখে!
তা হলে চ্যানেল এক্স-এর ভূত কি শুধু আমার বৃদ্ধা শাশুড়িমা-কে টার্গেট করেছে?
আমি যে ভুল ভেবেছি সেটা বোঝা গেল তিনদিনের মধ্যেই।
চ্যানেল এক্স-এর কীর্তি প্রথম দেখল তাপসী। আর তারপর আমি।
সেদিনটা ছিল রবিবার। আমি সন্ধেবেলা এই সাতটা-সাড়ে সাতটা নাগাদ মুদিখানা থেকে গুঁড়ো সাবান, আটা, বিস্কুট, ছোলা এইসব কয়েকটা টুকিটাকি কিনে ঘরে ঢুকেছি। তাপসী টিভিতে কী একটা সিরিয়াল দেখছিল। আমাকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে বলল, রান্নাঘরে রাখো—আমি একটু পরেই উঠছি—সব গুছিয়ে রাখব।
আমি ওর কথামতো জিনিসগুলো রান্নাঘরের এককোণে মেঝেতে নামিয়ে রেখে কলতলায় হাত-মুখ ধুতে গেলাম। দেখলাম বাথরুমে আলো জ্বলছে, দরজা বন্ধ। মানে, শাশুড়িমা ওখানে।
হঠাৎই তাপসীর চিৎকার শুনতে পেলাম: শিগগির এদিকে এসো—।
প্রায় ছুটে খাওয়ার ঘরে গিয়ে হাজির হলাম।
আমাকে দেখেই তাপসী টিভির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওই দ্যাখো! ওই দ্যাখো!
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে টিভির দিকে তাকালাম। সেখানে তখন গানের সঙ্গে উদ্দাম নাচ চলছে। রঙিন আঁটোসাঁটো পোশাক পরে বেশ কয়েকটা ছেলেমেয়ে ‘খাই-খাই’ স্টাইলে নেচে চলেছে।
আজকাল এসব নাচ-গান মুড়িমুড়কি হয়ে গেছে। তাই ভুরু কুঁচকে তাপসীর দিকে চোখ ফিরিয়ে বললাম, চেঁচালে কেন? কী হয়েছে?
তাপসী অবাক চোখে আমার দিকে তাকাল: চেঁচালাম কেন মানে? চ্যানেলের নামটা দেখেছ? আমার কানে…।
ওর কথায় কান না দিয়ে টিভির দিকে আবার ভালো করে তাকালাম।
সত্যিই তো! ওপরে বাঁ-দিকের কোণে সুন্দর ঢঙে ইংরেজিতে লেখা ‘চ্যানেল এক্স’।
আমি জিগ্যেস করলাম, শুধু চ্যানেলের নামটা দেখেই চেঁচালে?
তাপসী চোখ বড়-বড় করে বলল, না, না। নামটা তো পরে দেখলাম। এই যে সিরিয়ালটা এখন চলছে…।—টিভির দিকে আঙুল দেখিয়ে ও বলল, ওটা থেকে একটা লোক…ওই যে, বুড়োমতন কালো, মাথায় টাক…ওই লোকটা হঠাৎ আমার দিকে সোজা তাকিয়ে বলল, গোলাপি শাড়িটা আপনাকে হেভি মানিয়েছে। কিন্তু এককানের দুল কোথায় গেল?—ডানকানে দুল পরতে ভুলে গেছেন?—তক্ষুনি কানে হাত দিয়ে দেখি, সত্যিই তো! এককানে দুল পরতে ভুলে গেছি। আর গোলাপি শাড়িটা তো তুমি দেখতেই পাচ্ছ…।
আমি হতভম্ব হয়ে তাপসীর পাশে বসে পড়লাম। ওর কথাগুলো যে সত্যি সেটা বুঝতেই পারছি, কিন্তু এখন কী করা?
টিভির দিকে তাকিয়ে চ্যানেল এক্স-এর প্রোগ্রাম দেখতে লাগলাম:
হঠাৎই বিজ্ঞাপনের ব্রেক শুরু হল। বিজ্ঞাপনে এমন সব প্রোডাক্টের কথা বলতে লাগল যেগুলোর নাম আমি কখনও শুনিনি। তারই মাঝে চ্যানেল এক্স-এর প্রচার শুরু হল। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে চ্যানেলের গুণগান শুরু করল। ওরা বলতে লাগল: এরকম ইন্টারঅ্যাকটিভ চ্যানেল এই প্রথম। আপনাদের সামনে যেসব প্রোগ্রাম আমরা সবসময় পেশ করব সেগুলো ইউনিক এবং হাইলি ইন্টারঅ্যাকটিভ। আপনি সবসময় আমাদের প্রোগ্রামের একটা পার্ট। ইন ফ্যাক্ট, ইউ আর চ্যানেল এক্স! সো কিপ ওয়াচিং…।
এর পাঁচ-দশ সেকেন্ড পরেই আলোর ঝলকানি দিয়ে চ্যানেল এক্স উধাও।
সেদিন রাতে আমার কী যে মনে হল, খাওয়া-দাওয়ার পর টিভি দেখতে বসে গেলাম।
কতক্ষণ যে ঠায় টিভির সামনে বসেছিলাম জানি না। বোধহয় একটু তন্দ্রামতন এসে গিয়েছিল। হঠাৎই মনে হল কে যেন আমাকে ডাকছে: ও কাকু, শুনছেন? এই যে—।
চমকে উঠে চোখ খুললাম।
দেখি টিভির পরদায় বছরদশেকের একটা বাচ্চা ছেলে আমাকে ডাকছে।
আমাকে সজাগ হয়ে উঠতে দেখেই ছেলেটা বলল, কাকু, খেলতে-খেলতে বলটা পড়ে গেছে—একটু দিন না…আমার হাত যাচ্ছে না…।
ও মা! ছেলেটা টিভির পরদা থেকে হাত বাড়িয়ে দিল সামনে। ওর ফরসা রোগা হাতটা আমার চোখের সামনে বেরিয়ে এল টিভির বাইরে। বলের সন্ধানে হাতড়াতে লাগল আমার ঘরের মেঝেতে।
তখন খেয়াল করলাম, সত্যি-সত্যিই একটা নীল রঙের বল মেঝেতে পড়ে আছে। কিন্তু বহু চেষ্টায় কাঁধ ঝুঁকিয়েও ছেলেটার হাতের আঙুল বল পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে না।
আমি কেমন একটা ঘোরের মধ্যে উঠে দাঁড়ালাম। বলটার কাছে গিয়ে ওটা মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিলাম। তারপর আলতো করে টিভির পরদার দিকে ছুড়ে দিলাম। ছেলেটা চট করে বলটা লুফে নিল। হেসে বলল, থ্যাংক ইউ, আঙ্কল—।
টিভির পরদায় ছেলেটা বল নিয়ে লোফালুফির নানান কসরত দেখাতে লাগল। সেটাই তখনকার প্রোগ্রাম। দেখাচ্ছে চ্যানেল এক্স।
আমি কিন্তু মোটেই অবাক হলাম না কিংবা ভয়ও পেলাম না। মনে হল, ইন্টারঅ্যাকটিভ চ্যানেল এরকমটা হওয়াই স্বাভাবিক।
তখনই টিভি থেকে আমার নাম ধরে কে যেন ডাকল।
ঘুরে তাকিয়ে দেখি আমাদের পাড়ার ফণীবাবু—ফণীভূষণ পাত্র। আমার বাড়ি থেকে চারটে বাড়ি এগিয়ে বাঁ-দিকটায় ওঁর প্রেস ছিল। গতবছর ভদ্রলোক মিনিবাসের ধাক্কায় মারা গেছেন।
আমি এবার অবাক হয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি তখনও আমাকে নাম ধরে ডাকছেন। বলছেন, চলে এসো। এসো—এসো…।
তখনই দেখি ফণীবাবুর পাশে আমার মধুজ্যাঠা এসে দাঁড়িয়েছেন। মধুজ্যাঠা আমার দূরসম্পর্কের জ্যাঠামশাই ছিলেন। বসিরহাটে থাকতেন। তিনবছর আগে গলায় দড়ি দিয়ে সুইসাইড করেছেন।
মধুজ্যাঠাও আমাকে হাতছানি দিয়ে ফিসফিসে গলায় ডাকতে লাগলেন। বললেন, আয়, আয়—এখানে চলে আয়।
আমি এবার ভয় পেলাম। টিভির কাছ থেকে কয়েক পা দূরে সরে এলাম।
দেখি কোথা থেকে যেন আরও অনেক পুরুষ-মহিলা মধুজ্যাঠা আর ফণীবাবুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ওরা সবাই ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।
ফণীবাবু বললেন, জানো, এরা সবাই অপঘাতে মারা গেছে—সবাই। কী কষ্ট ওদের!
মধুজ্যাঠা হাতটা সামনে বাড়িয়ে দিলেন। ফিসফিস করে বললেন, আয়, চলে আয়। এদিকটাও খারাপ না…।
আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। চিৎকারটা ঠিকঠাক বেরোল না। কেমন যেন ভাঙাচোরা কর্কশ—সাপ ব্যাং গিলে খাওয়ার সময় ব্যাং যেরকম ডাকে সেইরকম।
হঠাৎ চার-পাঁচটা হাত টিভির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। হাতগুলো অস্বাভাবিক লম্বা হয়ে পৌঁছে গেল আমার কাছে। সাঁড়াশির মতো আমার হাত আঁকড়ে ধরল। এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক প্রচণ্ড টানে আমাকে নিয়ে গেল টিভির ভেতরে।
আমার কানে তখন ভেসে আসছিল চ্যানেল এক্স-এর প্রেজেন্টারের কথা: …বিশ্বাস করুন, এরকম সুপার-ডুপার ইন্টারঅ্যাকটিভ চ্যানেল আপনি আগে কখনও দেখেননি…।