বেলা দেড়টার সময়
বেলা দেড়টার সময়, শিকার-শ্রান্ত চারিজন মোটরের কাছে ফিরিয়া আসিলাম। হরিনাথ মাস্টারের খাতা চুরির কাহিনী চাপা পড়িয়া গিয়াছিল। হিমাংশুবাবুরও কি জানি কেন, ব্যোমকেশের সাহায্য লইবার আর বিশেষ আগ্রহ ছিল না। বোধহয় এরূপ তুচ্ছ ব্যাপারে সদ্য পরিচিত একজন লোককে খাটাইয়া লইতে তিনি কুষ্ঠিত হইতেছিলেন; হয়তো তিনি ভাবিতেছিলেন যে পুলিসই শীঘ্র এই ব্যাপারে একটা সমাধান করিয়া ফেলিবে। সে যাহাই হোক, ব্যোমকেশই প্রসঙ্গটা পুনরুত্থাপন করিল, বলিল, ‘আপনার হরিনাথ মাস্টারের গল্পটা ভাল করে শোনা হল না।’
হিমাংশুবাবু মােটরের ফুট-বোর্ডে পা তুলিয়া দিয়া বলিলেন, ‘আমি যা জানি সবই প্রায় বলেছি, আর বিশেষ কিছু জািনবার আছে বলে মনে হয় না।’
ব্যোমকেশ আর কিছু বলিল না। কুমার ত্রিদিব বলিলেন, ‘চল হিমাংশু, তোমাকে মোটরে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাই। তুমি বোধ হয় হেঁটেই এসেছি।’
হিমাংশুবাবু বলিলেন, ‘হ্যাঁ। তবে রাস্তা দিয়ে ঘুর পড়ে বলে ওদিক দিয়ে মাঠে মাঠে এসেছি। ওদিক দিয়ে মাইলখানেক পড়ে।’ বলিয়া দক্ষিণ দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিলেন।
কুমার ত্রিদিব বলিলেন, ‘রাস্তা দিয়ে অন্তত মাইল দুই। চল, তোমাকে পৌঁছে দিই।‘ তারপর হাসিয়া বলিলেন, ‘আর যদি নেমস্তন্ন কর তাহলে না হয় দুপুরের স্নানাহারটা তোমার বাড়িতেই সারা যাবে। কি বলেন। আপনারা?’
আমাদের কোনো আপত্তিই ছিল না, আমোদ করিতে আসিয়াছি, গৃহস্বামী যেখানে লইয়া যাইবেন সেখানে যাইতেই রাজী ছিলাম। আমরা ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইলাম। হিমাংশুবাবু বলিয়া উঠিলেন, ‘নিশ্চয় নিশ্চয়-সে। আর বলতে। তোমরা তো আজ আমারই অতিথি—এতক্ষণ এ প্রস্তাব না করাই আমার অন্যায় হয়েছে। যা হোক, উঠে পড়ুন গাড়িতে, আর দেরি নয়; খাওয়া দাওয়া করে। তবু একটু বিশ্রাম করতে পারেন। তারপর একেবারে বৈকালিক চা সেরে বাড়ি ফিরলেই হবে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘এবং পারি। যদি, ইতিমধ্যে আপনার পলাতক মাস্টারের একটা ঠিকানা করা যাবে।’
‘হ্যাঁ, সেও একটা কথা বটে। আমার দেওয়ান হয়তো তার সম্বন্ধে আরো অনেক কথা বলতে পারবেন।’ বলিয়া তিনি নিজে অগ্রবর্তী হইয়া গাড়িতে উঠিলেন।
হিমাংশুবাবু খুবই সমাদর সহকারে আমাদের আহ্বান করিলেন বটে কিন্তু তবু আমার একটা ক্ষীণ সন্দেহ জাগিতে লাগিল যে তিনি মন খুলিয়া খুশি হইতে পারেন নাই।
সম্মুখে দাঁড়াইল। গাড়ির শব্দে একটি প্রৌঢ় গোছের ব্যক্তি ভিতর হইতে বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইলেন; তপর হিমাংশুবাবুকে গাড়ি হইতে নামিতে দেখিয়া তিনি খড়ম পায়ে তাড়াতাড়ি নামিয়া আসিয়া বিচলিত স্বরে বলিয়া উঠিলেন, ‘বাবা হিমাংশু, যা ভেবেছিলুম তাই। হরিনাথ মাস্টার শুধু খাতাই চুরি করেনি, সঙ্গে সঙ্গে তহবিল থেকে ছ হাজার টাকাও গেছে।’
বেলা তিনটা বাজিয়া গিয়াছিল। শীতের অপরাহু ইহারই মধ্যে দিবালোকের উজ্জ্বলতা স্নান করিয়া আনিয়াছিল।
‘এবার ভট্টাচার্যি মশায়ের মুখে ব্যাপারটা শোনা যাক।’ বলিয়া ব্যোমকেশ মোটা তাকিয়ার উপর কনুই ভর দিয়া বসিল।
গুরু ভোজনের পর বৈঠকখানায় গদির উপর বিস্তৃত ফরাসের শয্যায় এক একটা তাকিয়া আশ্রয় করিয়া আমরা চারিজনে গড়াইতেছিলাম। হিমাংশুবাবুর কন্যা বেবি ব্যোমকেশের কোলের কাছে বসিয়া নিবিষ্ট মনে একটা পুতুলকে কাপড় পরাইতেছিল; এই দুই ঘণ্টায় তাহাদের মধ্যে ভীষণ বন্ধুত্ব জন্সিয়া গিয়াছিল। দেওয়ান কালীগতি ভট্টাচার্য মহাশয় একটু তফাতে ফরাসের উপর মেরুদণ্ড সিধা করিয়া পদ্মাসনে বসিয়াছিলেন-যেন একটু সুবিধা পাইলেই ধ্যানস্থ হইয়া পড়িবেন।
বস্তুত তাঁহাকে দেখিলে জপতপ ধ্যানধারণার কথাই বেশি করিয়া মনে হয়। আমি তো প্রথম ‘দর্শনে তাঁহাকে জমিদার বাড়ির পুরোহিত বলিয়া ভুল করিয়াছিলাম। শীর্ণ গৌরবর্ণ দেহ, মুণ্ডিত মুখ, গলায় বড় বড় রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে আধুলির মত একটি সিন্দূরের টিকা। মুখে তপঃকৃশ শান্তির ভাব। বৈষয়িকতার কোনো চিহ্নই সেখানে বিদ্যমান নাই। অথচ এক শিকার-পাগল সংসার-উদাসী জমিদারের বৃহৎ সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা যে এই লোকটির তীক্ষ্ণ সতর্কতার উপর নির্ভর করিতেছে তাহাতে সন্দেহ নাই। মান্য অতিথির সংবর্ধনা হইতে আরম্ভ করিয়া জমিদারীর সামান্য খুঁটিনাটি পর্যন্ত ইহারি কটাক্ষ ইঙ্গিতে সুনিয়ন্ত্রিত হইতেছে।
ব্যোমকেশের কথায় তিনি নড়িয়া চড়িয়া বসিলেন। ক্ষণকাল মুদিত চক্ষে নীরবে থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, ‘হরিনাথ লোকটা আপাতদৃষ্টিতে এতই সাধারণ আর অকিঞ্চিৎকর যে তার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে মনে হয় বলবার কিছুই নেই। ন্যালা-ক্যাবলা গোছের একটা ছোঁড়া-অথচ তার পেটে যে এতখানি শয়তানী লুকোনো ছিল তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। আমি মানুষ চিনতে বড় ভুল করি না, এক নজর দেখেই কে কেমন লোক বুঝতে পারি। কিন্তু সে-ছোঁড়া আমার চোখেও ধুলো দিয়েছে। একবারও সন্দেহ করিনি যে এটা তার ছদ্মবেশ, তার মনে কোনো কু-অভিপ্ৰায় আছে।
‘প্রথম যেদিন এল সেদিন তার জামাকাপড়ের দুরবস্থা দেখে আমি ভাণ্ডার থেকে দু’জোড়া কাপড় দুটো গেঞ্জি দুটো জামা আর দু’খানা কম্বল বার করে দিলুম। একখানা ঘর হিমাংশু। বাবাজী তাকে আগেই দিয়েছিলেন—ঘরটাতে পুরনো খাতপত্র থাকত, তা ছাড়া বিশেষ কোনো কাজে লাগত না; সেই ঘরে তক্তপোেশ ঢুকিয়ে তার শোবার ব্যবস্থা করে দেওয়া হল। ঠিক হল, বেবি দু’বেলা ঐ ঘরেই পড়বে। তার খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে আমি স্থির করেছিলুম, অনাদি সরকারের কিম্বা কোনো আমলার বাড়িতে গিয়ে খেয়ে আসবে। আমলারা সবাই কাছেপিঠেই থাকে। কিন্তু আমাদের মা-লক্ষ্মী সে প্রস্তাবে মত দিলেন না। তিনি অন্দর থেকে বলে পাঠালেন যে বেবির মাস্টার বাড়িতেই খাওয়া-দাওয়া করবে। সেই ব্যবস্থাই ধাৰ্য হল।
‘তারপর সে বেবিকে নিয়মিত পড়াতে লাগল। আমি দুদিন তার পড়ানো লক্ষ্য করলুম-দেখলুম ভালই পড়াচ্ছে। তারপর আর তার দিকে মন দেবার সুযোগ পাইনি। মাঝে মাঝে আমার কাছে এসে বসত-ধর্ম সম্বন্ধে দু’চার কথা শুনতে চাইত। এমনিভাবে দু’মাস কেটে গেল।
‘গত শনিবার আমি সন্ধ্যের পরই বাড়ি চলে যাই। আমি যে-বাড়িতে থাকি দেখেছেন বোধ হয়–ফটকে ঢুকতে ডান দিকে যে হলদে বাড়িখানা পড়ে সেইটে। কয়েক মাস হল আমি আমার স্ত্রীকে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছি।—একলাই থাকি। স্বপাক খাই-আমার কোনো কষ্ট হয় না। শনিবার রাত্রে আমার পুরশ্চরণ করবার কথা ছিল—তাই সকাল সকাল গিয়ে উদ্যোগ আয়োজন করে পুজোয় বসলুম! উঠতে অনেক রাত হয়ে গেল।
‘পরদিন সকালে এসে শুনলুম মাস্টারকে পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রমে বেলা বারোটা বেজে গোল তখনো মাস্টারের দেখা নেই। আমার সন্দেহ হল, তার ঘরে গিয়ে দেখলুম রাত্রে সে বিছানায় শোয়নি। তখন, যে আলমারিতে জমিদারীর পুরনো হিসেবের খাতা থাকে সেটা খুলে দেখলুম–গত চার বছরের হিসেবের খাতা নেই।
‘গত চার বছর থেকে অনেক বড় বড় প্রজাদের সঙ্গে মামলা মোকদ্দমা চলছে; সন্দেহ হল এ তাদেরই কারসাজি। জমিদারীর হিসেবের খাতা শত্রুপক্ষের হাতে পড়লে তাদের অনেক সুবিধা হয়; বুঝলুম, হরিনাথ তাদেরই গুপ্তচর, মাস্টার সেজে জমিদারীর জরুরী দলিল চুরি করবার জন্যে এসে ঢুকেছিল।
‘পুলিসে খবর পাঠলুম। কিন্তু তখনো জানি না যে সিন্দুক থেকে ছ হাজার টাকাও লোপাট হয়েছে।’
এ পর্যন্ত বলিয়া দেওয়ানজী থামিলেন, তারপর ঈষৎ কুষ্ঠিতভাবে বলিলেন, ‘নানা কারণে কিছুদিন থেকে তহবিলে টাকার কিছু টানাটানি পড়েছে। সম্প্রতি মোকদ্দমার খরচ ইত্যাদি বাবদ কিছু টাকার দরকার হয়েছিল, তাই মহাজনের কাছ থেকে ছ হাজার টাকা হাওলাত নিয়ে সিন্দুকে রাখা হয়েছিল। টাকাটা পুটলি বাঁধা অবস্থায় সিন্দুকের এক কোণে রাখা ছিল। ইতিমধ্যে অনেকবার সিন্দুক খুলেছি। কিন্তু পুটলি খুলে দেখবার কথা একবারও মনে হয়নি। আজ সদর থেকে উকিল টাকা চেয়ে পাঠিয়েছেন। পুটলি খুলে টাকা বার করতে গেলুম; দেখি, নোটের তাড়ার বদলে কতকগুলো পুরনো খবরের কাগজ রয়েছে।’
দেওয়ান নীরব হইলেন।
শুনিতে শুনিতে ব্যোমকেশ আবার চিৎ হইয়া শুইয়া পড়িয়াছিল, কড়িকাঠে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া বলিল, ‘তাহলে সিন্দুকের তালা ঠিকই আছে? চাবি কার কাছে থাকে?’
দেওয়ান বলিলেন, ‘সিন্দুকের দুটো চাবি; একটা আমার কাছে থাকে্্, আর একটা হিমাংশু। বাবাজীর কাছে। আমার চাবি ঠিকই আছে, কিন্তু হিমাংশু বাবাজীর চাবিটা শুনছি। ক’দিন থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।’
হিমাংশুবাবু শুষ্কমুখে বলিলেন, ‘আমারই দোষ। চাবি আমার কোনোকালে ঠিক থাকে না, কোথায় রাখি ভুলে যাই। এবারেও কয়েকদিন থেকে চাবিটা খুঁজে পাচ্ছিলুম না, কিন্তু সেজন্যে বিশেষ উদ্বিগ্ন হইনি-ভেবেছিলুম কোথাও না কোথাও আছেই—’
‘হুঁ’–ব্যোমকেশ উঠিয়া বসিল, হাসিয়া বেবিকে নিজের কোলের উপর বসাইয়া বলিল, ‘মা-লক্ষ্মীর মাস্টারটি জুটেছিল ভাল। কিন্তু তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই আশ্চর্য। ভাল করে খোঁজ করা হচ্ছে তো?’
দেওয়ান কালীগতি বলিলেন, ‘যতদূর সাধ্য ভাল করেই খোঁজ করানো হচ্ছে। পুলিস তো আছেই, তার ওপর আমিও লোক লাগিয়েছি। কিন্তু কোনো সংবাদই পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘কবে ফিরে আসবেন?’
ব্যোমকেশ মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘জানি না। বোধ হয়। আর আসবেন না।’
বেবির চোখ দুটি ছলছল করিয়া উঠিল; তাহা দেখিয়া ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুমি মাস্টারমশাইকে খুব ভালবাস–না?’
বেবি ঘাড় নীড়িল—’হ্যাঁ-খুব ভালবাসি। তিনি আমাকে কত অঙ্ক শেখাতেন।—আচ্ছা, বল তো, সাত-নাম কত হয়?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ক’ত? চৌষট্টি?’
বেবি বলিল, ‘দ্যুৎ! তুমি কিছু জান না। সাত-নাম তেষট্টি! আচ্ছা, তুমি মা কালীর স্তব জানো?’
ব্যোমকেশ হতাশভাবে বলিল, ‘না। মা কালীর স্তবও কি তোমার মাস্টারমশায় শিখিয়েছিলেন নাকি?’
‘হ্যাঁ–শুনবে?’ বলিয়া বেবি সুর করিয়া আরম্ভ করিল—
‘নমস্তে কালিকা দেবী করল বদনী—‘
কালীগতি ইষদহাস্যে তাহাকে বাধা দিয়া বলিলেন, ‘বেবি, তোমার কালীস্তব আমরা পরে শুনিব, এখন তুমি বাগানে খেলা কর গে যাও।’
বেবি একটু ক্ষুন্নভাবে পুতুল লইয়া প্ৰস্থান করিল। কালীগতি আস্তে আস্তে বলিলেন, ‘লোকটা মাস্টার হিসেবে মন্দ ছিল না-বেশ যত্ন করে পড়াত—অথচ—‘
ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল, ‘চলুন, মাস্টারের ঘরটা একবার দেখে আসা যাক।’
বাড়ির সম্মুখস্থ লম্বা বারান্দার একপ্রান্তে একটি প্রকোষ্ঠ; দ্বারে তালা লাগানো ছিল, দেওয়ানজী কষি হইতে চাবির গুচ্ছ বাহির করিয়া তালা খুলিয়া দিলেন। আমরা ঘরে প্রবেশ করিলাম।
ঘরটি আয়তনে ছোট। গোটা-দুই কাঠের কবাটযুক্ত আলমারি; টেবিল চেয়ার তক্তপোশেই এমনভাবে ভরিয়া উঠিয়াছে যে মনে হয় পা বাড়াইবার স্থান নাই। দ্বারের বিপরীত দিকে একটা ছোট জানোলা ছিল, সেটা খুলিয়া দিয়া ব্যোমকেশ ঘরের চারিদিকে একবার চোখ ফিরাইল। তক্তপোশের উপর বিছানাটা অবিন্যস্তভাবে পাট করা রহিয়াছে; টেবিলের উপর সূক্ষ্ম একপুরু ধূলার প্রলেপ পড়িয়াছে; ঘরের অন্ধকার একটা কোণে দড়ি টাঙাইয়া কাপড়-চোপড় রাখিবার ব্যবস্থা। একটা আলমারির কবাট ঈষৎ উন্মুক্ত। দেওয়ালে লন্বিত একখানি কালীঘাটের পটের কালীমূর্তি হরিনাথ মাস্টারের কালীপ্রীতির পরিচয় দিতেছে।
ব্যোমকেশ তক্তপোশের নীচে উঁকি মারিয়া একজোড়া জুতা টানিয়া বাহির করিল, বলিল, ‘তাই তো জুতোজোড়া যে একেবারে নূতন দেখছি। ও—আপনারাই কিনে দিয়েছিলেন বুঝি?’
কালীগতি বলিলেন, ‘হ্যাঁ।’
‘আশ্চর্য! আশ্চর্য!’ জুতা রাখিয়া দিয়া ব্যোমকেশ দড়ির আলনাটার দিকে গেল। আলনায় কয়েকটা কাচা আকাচা কাপড় জামা বুলিতেছিল, সেগুলিকে তুলিয়া তুলিয়া দেখিল, তারপর আবার বলিল, ‘ভারি আশ্চর্য!’
হিমাংশুবাবু কৌতুহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি হয়েছে?’
জবাব দিবার জন্য মুখ ফিরাইয়া ব্যোমকেশ থামিয়া গেল, তাহার দৃষ্টি ঘরের বিপরীত কোণে একটা কুলুঙ্গির উপর গিয়া পড়িল। সে দ্রুতপদে গিয়া কুলুঙ্গির ভিতর হইতে কি একটা তুলিয়া লইয়া জানালার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল, সবিস্ময়ে বলিল, ‘মাস্টার কি চশমা পরত?’
কালীগতি বলিলেন, ‘ওটা বলতে ভুল হয়ে গেছে–পরত বটে। চশমা কি ফেলে গেছে নাকি?’
চশমার কাচের ভিতর দিয়া একবার দৃষ্টি প্রেরণ করিয়া সহাস্যে সেটা আমার হাতে দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ–আশ্চর্য নয়?’
কালীগতি ভুকুঞ্চিত করিয়া কিয়ৎকাল চিন্তা করিয়া বলিলেন, ‘আশ্চর্য বটে। কারণ যার চোখ খারাপ তার পক্ষে চশমা ফেলে যাওয়া অস্বাভাবিক। এর কি কারণ হতে পারে আপনার মনে হয়?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘অনেক রকম কারণ থাকতে পারে। হয়তো তার সত্যি চোখ খারাপ ছিল। না, আপনাদের ঠকাবার জন্যে চশমা পরীত।’
ইত্যবসরে আমি আর কুমার ত্রিদিব চশমাটা পরীক্ষা করিতেছিলাম। স্টীল ফ্রেমের নড়বড়ে বাহুযুক্ত চশমা, কাচ পুরু। কাচের ভিতর দিয়া দেখিবার চেষ্টা করিলাম। কিন্তু ধোঁয়া ছাড়া কিছুই দেখিতে পাইলাম না।
কুমার ত্রিদিব বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু্, আপনার অনুমান বোধহয় ঠিক নয়। চশমাটা অনেকদিনের ব্যবহারে পুরনো হয়ে গেছে আর কাচের শক্তিও খুব বেশি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমার ভুলও হতে পারে। তবে, মাস্টার আর কারুর পুরনো চশমা নিয়ে এসেছিল এটাও তো সম্ভব। যা হোক, এবার আলমারিটা দেখা যাক।’
খোলা আলমারিটার কবাট উদঘাটিত করিয়া দেখা গেল, তাহার মধ্যে থাকে থাকে খেরো-বাঁধানো স্থূলকায় হিসাবের খাতা সাজানো রহিয়াছে—বোধহয় সবসুদ্ধ পঞ্চাশ-ষাটখানা। ব্যোমকেশ উপরের একটা খাতা নামাইয়া দুহাতে ওজন করিয়া বলিল, ‘বেশ ভারী আছে, সের চারেকের কম হবে না। প্রত্যেক খাতায় বুঝি এক বছরের হিসেব আছে?’
কালীগতি বলিলেন, ‘হ্যাঁ।’
ব্যোমকেশ খাতার গোড়ার পাতা উল্টাইয়া দেখিল, পাঁচ বছর আগেকার খাতা, ইহার পর হইতে শেষ চার বছরের খাতা চুরি গিয়াছে। আরো কয়েকখানা খাতা বাহির করিয়া ব্যোমকেশ হিসাব রাখিবার প্রণালী মোটামুটি চোখ বুলাইয়া দেখিল। প্রত্যেকটি খাতা দুই অংশে বিভক্ত-অর্থাৎ একাধারে জাবদা ও পাকা খাতা। এক অংশে দৈনন্দিন খুচরা আয়-ব্যয়ের হিসাব লিখিত হইয়াছে—অন্য অংশে মোট দৈনিক খরচ তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে। সাধারণত জমিদারী খাতা এরূপভাবে লিখিত হয় না, কিন্তু এরূপ লেখার সুবিধা এই যে অল্প পরিশ্রমে জাবদা ও পাকা খাতা মিলাইয়া দেখা যায়।
গোড়া হইতে ব্যোমকেশ ব্যাপারটাকে খুব হাল্কাভাবে লইয়াছিল। অতি সাধারণ গতানুগতিক চুরি ছাড়া ইহার মধ্যে আর কোনো বৈশিষ্ট্য আছে তাহা বোধহয় সে মনে করে নাই। কিন্তু ঘর পরীক্ষা শেষ করিয়া যখন সে বাহিরে আসিল তখন দেখিলাম তাহার চোখের দৃষ্টি প্রখর হইয়া উঠিয়াছে। ও দৃষ্টি আমি চিনি। কোথাও সে একটা গুরুতর কিছুর ইঙ্গিত পাইয়াছে; হয়তো যত তুচ্ছ মনে করা গিয়াছিল ব্যপার তত তুচ্ছ নয়। আমিও মনে মনে একটু উত্তেজিত হইয়া উঠিলাম।
ঘরের বাহিরে আসিয়া ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ ভু কুঞ্চিত করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর হিমাংশুবাবুর দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘আমি এ ব্যাপারে তদন্ত করি আপনি চান?’
মুহুর্তকালের জন্য হিমাংশুবাবু যেন একটু দ্বিধা করিলেন, তারপর বলিলেন, ‘হ্যাঁ-চাই বই কি। এতগুলো টাকা, তার একটা কিনারা হওয়া তো দরকার।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাহলে আমাদের দু’জনকে এখানে থাকতে হয়।’
হিমাংশুবাবু বলিল, ‘নিশ্চয় নিশ্চয়। সে আর বেশি কথা কি—’
ব্যোমকেশ কুমার ত্ৰিদিবের দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘কিন্তু কুমার বাহাদুর যদি অনুমতি দেন তবেই আমরা থাকতে পারি। আমরা ওঁর অতিথি।’
কুমার ত্রিদিব লজ্জায় পড়িলেন। আমাদের ছাড়িবার ইচ্ছা তাঁহার ছিল না। কিন্তু ব্যোমকেশের ইচ্ছাটাও তিনি বুঝিতে পারিতেছিলেন। ব্যোমকেশ হিমাংশুবাবুর কাজ করিয়া কিছু উপার্জন করিতে চায় এরূপ সন্দেহও হয়তো তাঁহার মনে জাগিয়া থাকিবে। তাই তিনি কুষ্ঠিতভাবে বলিলেন, ‘বেশ তো, আপনারা থাকলে যদি হিমাংশুর উপকার হয়—’
ব্যোমকেশ মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘তা বলতে পারি না। হয়তো কিছুই করে উঠতে পারবো না। হিমাংশুবাবু্, আপনার যদি এ বিষয়ে আগ্রহ না থাকে তো বলুন-চক্ষুলজ্জা করবেন না। আমরা কুমার ত্ৰিদিবের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি, বিষয়চিন্তাও কলকাতায় ফেলে এসেছি। তাই, আপনি যদি আমাদের সাহায্য দরকার না মনে করেন, তাহলে আমি বরঞ্চ খুশিই হব।’
ব্যোমকেশ কুমার বাহাদুরের ভিত্তিহীন সন্দেহটার আভাস পাইয়াছে বুঝিতে পারিয়া তিনি আরো লজ্জিত হইয়া উঠিলেন, তাড়াতাড়ি বলিলেন, ‘না না ব্যোমকেশবাবু্, আপনারা থাকুন। যতদিন দরকার থাকুন। আপনারা থাকলে নিশ্চয় এ ব্যাপারে। কিনারা করতে পারবেন। আমি রোজ এসে আপনাদের খবর নিয়ে যাব।’
হিমাংশুবাবুঘাড় নাড়িয়া সমর্থন করিলেন। আমাদের থাকাই স্থির হইয়া গেল।
অতঃপর চায়ের ডাক পড়িল; আমরা বৈঠকখানায় ফিরিয়া গেলাম। প্ৰায় নীরবেই চা-পান সমাপ্ত হইল। কুমার ত্রিদিব ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন, ‘সাড়ে চারটে বাজে। হিমাংশু, আমি তাহলে আজ চলি। কাল আবার কােনো সময় আসব।’ বলিয়া উঠিয়া পড়িলেন।
কম্পাউন্ডের বাহিরে মোটর অপেক্ষা করিতেছিল। আমি এবং ব্যোমকেশ কুমারের সঙ্গে ফটক পর্যন্ত গেলাম। কুমার বাহাদুর নিজের জমিদারীতে আমাদের জন্য অনেক আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা করিয়া রাখিয়াছিলেন-পুকুরে মাছ ধরা, খালে নীে বিহার প্রভৃতি বহুবিধ ব্যসনের আয়োজন হইয়াছিল। সে সব ব্যর্থ হইয়া যাওয়ায় তিনি একটু ক্ষুব্ধ হইয়াছিলেন। মোটরের কাছে পৌঁছিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এ কাজটায় আপনার কতদিন লাগবে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কিছুই এখনো বলতে পারছি না-আপনি আমাকে ঘোর অকৃতজ্ঞ মনে করছেন, মনে করাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখানকার ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুতর—আমোদ-আহ্বাদের অছিলায় একে উপেক্ষা করলে অন্যায় হবে।’
কুমার বাহাদুর সচকিত হইয়া বলিলেন, ‘তই নাকি! কিন্তু আমার তো অতটা মনে হল না। অবশ্য অনেকগুলো টাকা গেছে—‘
‘টাকা যাওয়াটা নেহাৎ অকিঞ্চিৎকর।’
‘তবে?’
ব্যোমকেশ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, ‘আমার বিশ্বাস হরিনাথ মাস্টার বেঁচে নেই।’
আমরা দুজনেই চমকিয়া উঠিলাম। কুমার বলিলেন, ‘সে কি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাই মনে হচ্ছে। আশা করি একথা শোনবার পর আমাকে সহজে ক্ষমা করতে পারবেন।’
কুমার উদ্বিগ্নমুখে বলিলেন, ‘না না, ক্ষমার কোনো কথাই উঠছে না। আপনাকে ছেড়ে দেওয়া আমার কর্তব্য। একটা লোক যদি খুন হয়ে থাকে—’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘খুনই হয়েছে এমন কথা আমি বলছি না। তবে সে বেঁচে নেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। যা হোক, ও আলোচনা আরও প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত মুলতুবি থাক। আপনি কাল আসবেন তো? তাহলে আমাদের সুটকেসগুলোও সঙ্গে করে আনবেন। আচ্ছা—আজ বেরিয়ে পড়ুন–পৌঁছুতে অন্ধকার হয়ে যাবে।’
কুমারের মোটর বাহির হইয়া যাইবার পর আমরা বাড়ির দিকে ফিরিলাম। ফটক হইতে বাড়ির সদর প্রায় একশত গজ দূরে, মধ্যের বিস্তৃত ব্যবধান নানা জাতীয় ছোট বড় গাছপালায় পূর্ণ। মাঝে মাঝে লোহার বেঞ্চি পাতিয়া বিশ্রামের স্থান করা আছে।
দেওয়ানের ক্ষুদ্র দ্বিতল বাড়ি দক্ষিণে রাখিয়া আমরা বাগানে প্রবেশ করিলাম। শীতকালের দীর্ঘ গোধূলি তখন নামিয়া আসিতেছে। অবসন্ন দিবার শেষ রক্তিম আভা পশ্চিমে জঙ্গলের মাথায় অলক্ষ্যে সঙ্কুচিত হইয়া আসিতেছে।
ব্যোমকেশ চিন্তিত নতমুখে পকেটে হাত পুরিয়া ধীরে ধীরে চলিয়াছিল; চিন্তার ধারা তাহার কোন সর্পিল পথে চলিয়াছে বুঝিবার উপায় ছিল না। হরিনাথ মাস্টারের ঘরে সে এমন কি পাইয়াছে যাহা হইতে তাহার মৃত্যু অনুমান করা যাইতে পারে-এই কথা ভাবিতে ভাবিতে আমিও একটু অন্যমনস্ক হইয়া পড়িলাম। নিঃকুম পাড়াগাঁয়ের নিস্তরঙ্গ জীবনযাত্রার মাঝখানে এতবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে, অন্তর হইতে যেন গ্ৰহণ করিতে পারিতেছিলাম না। কিন্তু তবু কিছুই বলা যায় না— গুঢ়নক্র হ্রদের উপরিভাগ বেশ প্রসন্নাই দেখায়। ব্যোমকেশের সঙ্গে অনেক রহস্যময় ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট থাকিয়া একটু বুঝিয়েছিলাম যে, মুখ দেখিয়া মানুষ চেনা যেমন কঠিন, কেবলমাত্র বহিরাবয়ব দেখিয়া কোনো ঘটনার গুরুত্ব নির্ণয় করাও তেমনি দুঃসাধ্য।
একটা ইউক্যালিপ্টাস গাছের তলায় দাঁড়াইয়া ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইল, তারপর উর্ধর্বমুখে চাহিয়া কতকটা আত্মগতভাবেই বলিল, ‘জুতো পরে না যাবার একটা কারণ থাকতে পারে, জুতো পরে হাঁটলে শব্দ হয়। যে লোক দুপুর রাত্রে চুপি চুপি করে পালাচ্ছে তার পক্ষে খালি পায়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সে জামা পরবে না কেন? চশমাটাও ফেলে যাবে কেন?
আমি বলিলাম, চশমা সম্বন্ধে তুমি বলতে পার, কিন্তু জামা পরেনি একথা জানলে কি করে?
ব্যোমকেশ বলিল, গুণে দেখলুম সবগুলো জামা রয়েছে। কাজেই প্রমাণ হল যে জামা পরে যায়নি।
আমি বলিলাম, তার কতগুলো জামা ছিল তার হিসাব তুমি পেলে কোথেকে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘দেওয়ানজীর কাছ থেকে। তুমি বোধহয় লক্ষ্য করনি, ভাণ্ডার থেকে মাস্টারকে দুটো গেঞ্জি আর দুটো জামা দেওয়া হয়েছিল। তা ছাড়া সে নিজে একটা ছেড়া কামিজ পরে এসেছিল। সেগুলো সব আলনায় টাঙানো রয়েছে।’
আমি একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলাম, তাহলে তুমি অনুমান কর যে–’
ব্যোমকেশ পশ্চিম আকাশের ক্ষীণ শশিকলার দিকে তাকাইয়া ছিল, হঠাৎ সেইদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিয়া উঠিল, ‘ওহে, দেখেছ? সবে মাত্ৰ শুক্লপক্ষ পড়েছে। সে রাত্রে কি তিথি ছিল বলতে পারো?’
তিথি নক্ষত্রের সঙ্গে কোনো দিনই সম্পর্ক নাই, নীরবে মাথা নাড়িলাম। ব্যোমকেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাঁদকে পর্যবেক্ষণ করিয়া বলিল, ‘বোধহয়–অমাবস্যা ছিল। না, চল পাঁজি দেখা যাক।’ তাহার কণ্ঠস্বরে একটা নূতন উত্তেজনার আভাস পাইলাম।
চাঁদের দিকে চাহিয়া কবি এবং নবপ্রণয়ীরা উত্তেজিত হইয়া উঠে জানিতাম; কিন্তু ব্যোমকেশের মধ্যে কবিত্ব বা প্রেমের বাস্পটুকু পর্যন্ত না থাকা সত্ত্বেও সে চাঁদ দেখিয়া এমন উতলা হইয়া উঠিল কেন বুঝিলাম না। যা হোক, তাহার ব্যবহার অধিকাংশ সময়েই বুঝিতে পারি না-ওটা অভ্যাস হইয়া গিয়াছে। তাই সে যখন ফিরিয়া বাড়ির অভিমুখে চলিল, তখন আমিও নিঃশব্দে তাহার সহগামী হইলাম।
আমরা বাগানের যে অশংটায় আসিয়া পৌঁছিয়ছিলাম, সেখান হইতে বাড়ির ব্যবধােন পঞ্চাশ গজের বেশি হইবে না। সিধা। যাইলে মাঝে কয়েকটা বড় বড় ঝাউয়ের ঝোপ উৰ্ত্তীর্ণ হইয়া যাইতে হয়। ঝাউয়ের ঝোপগুলা বাগানের কিয়দংশ ঘিরিয়া যেন পৃথক করিয়া রাখিয়াছে।
ঘাসের উপর দিয়া নিঃশব্দপদে আমরা প্ৰায় ঝাউ ঝোপের কাছে পৌঁছিয়াছি, এমন সময় ভিতর হইতে একটা চাপা কান্নার আওয়াজ পাইয়া আমাদের গতি আপনা হইতেই রুদ্ধ হইয়া গেল। ব্যোমকেশের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, সে ঠোঁটের উপর আঙুল রাখিয়া আমাকে নীরব থাকিবার সঙ্কেত জানাইতেছে।
কান্নার ভিতর হইতে একটা ভাঙা গলার আওয়াজ শুনিতে পাইলাম— বাবু্, এই অনাদি সরকার আপনাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে–পুরনো চাকর বলে আমাকে দয়া করুন। মা-ঠাকরুণ ভুল বুঝেছেন। আমার মেয়ে অপরাধী—কিন্তু আপনার পা ছুঁয়ে বলছি, ও মহাপাপ আমরা করিনি।’
কিছুক্ষণ আর কোনো শব্দ নাই, তারপর হিমাংশুবাবুর কড়া কঠিন স্বর শুনা গেল–’ঠিক বলছ? তোমরা মারোনি?’
‘ধর্ম জানেন হুজুর। আপনি মালিক–দেবতা, আপনার কাছে যদি মিথ্যে কথা বলি। তবে যেন আমার মাথায় বজ্ৰাঘাত হয়।’
আবার কিছুক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ নাই, তারপর হিমাংশুবাবু বলিলেন, ‘কিন্তু রাধাকে আর এখানে রাখা চলবে না। কালই তাকে অন্যত্র পাঠাবার ব্যবস্থা কর। একথা যদি জানাজানি হয়। তখন আমি আর দয়া করতে পারব না–এমনিতেই বাড়িতে অশাস্তির শেষ নেই।’
অনাদি ব্যগ্ৰকণ্ঠে বলিল, ‘আজ্ঞে হজুর, কালই তাকে আমি কাশী পাঠিয়ে দেব; সেখানে তার এক মাসী থাকে–’
‘বেশ–যদি খরচ চালাতে না পারো—’ ব্যোমকেশ আমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইল। পা টিপিয়া টিপিয়া আমরা সরিয়া গেলাম।
মিনিট পনেরো পরে অন্য দিক দিয়া ঘুরিয়া বাড়ির সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। বারান্দার উপরে দাঁড়াইয়া কালীগতিবাবু একজন নিম্নতন কর্মচারীর সহিত কথা বলিতেছিলেন, বেবি তাঁহার হাত ধরিয়া আব্দারের সুরে কি একটা উপরোধ করিতেছিল—তাহার কথার খানিকটা শুনিতে পাইলাম, ‘একবারটি ডাকো না–’
কালীগতি একটু বিব্রত হইয়া বলিলেন, ‘আঃ পাগলি–এখন নয়।’
বেবি অনুনয় করিয়া বলিল, ‘না দেওয়ানদাদু, একবারটি ডাকো, ঐ ওঁরা শুনবেন।’ বলিয়া আমাদের নির্দেশ করিয়া দেখাইল।
কালীগতি আমাদের দেখিয়া অগ্রসর হইয়া আসিলেন, যে আমলাটি দাঁড়াইয়া ছিল তাহাকে চলিয়া যাইতে ইঙ্গিত করিয়া, প্রশান্ত হাস্যে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বাগানে বেড়াচ্ছিলেন বুঝি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ–বেবি কি বলছে? কাকে ডাকতে হবে?’
কালীগতি মুখের একটা ভঙ্গী করিয়া বলিলেন, ‘ওর যত পাগলামি। এখন শেয়াল-ডাক ডাকতে হবে।’
আমি সবিস্ময়ে বলিলাম, ‘সে কি রকম?’
কালীগতি বেবির দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘এখন কাজের সময়, এখন বিরক্ত করতে নেই। যাও-মা’র কাছে গিয়ে একটু পড়তে বসো গে।’
বেবি কিন্তু ছাড়িবার পাত্রী নয়, সে তাঁহার আঙুল মুঠি করিয়া ধরিয়া বলিতে লাগিল, ‘না দাদু, একবারটি—‘
অগত্যা কালীগতি চুপি চুপি তাহার কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া বলিলেন, ‘তুমি যখন ঘুমুতে যাবে তখন শোনাব–কেমন? এখন যাও লক্ষ্মী দিদি আমার।’
বেশি খুশি হইয়া বলিল, ‘নিশ্চয় কিন্তু! তা না হলে আমি ঘুমুব না।’
‘আচ্ছা বেশ।’ বেবি প্ৰস্থান করিলে কালীগতি বলিলেন, ‘এইমাত্র থানা থেকে খবর নিয়ে লোক ফিরে এল–মাস্টারের কোনো সন্ধানই পাওয়া যায়নি।’
‘ও’ ব্যোমকেশ একটু থামিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘অনাদি বলে কোনো কর্মচারী আছে কি?’
‘আছে। অনাদি জমিদার বাড়ির সরকার।’ বলিয়া কালীগতি উৎসুক নেত্ৰে তাহার পানে চাহিলেন।
ব্যোমকেশ যেন একটু চিন্তা করিয়া বলিল, ‘তাকে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না। সে কি আমলাদের পাড়াতেই থাকে?’
কালীগতি বলিলেন, ‘না। সে বহুকালের পুরনো চাকর। বাড়ির পিছন দিকে আস্তাবলের লাগাও কতকগুলো ঘর আছে, সেই ঘরগুলো নিয়ে সে থাকে।’
‘একলা থাকে?’
‘না, তার এক বিধবা মেয়ে আর স্ত্রী আছে। মেয়েটি কদিন থেকে অসুখে ভুগছে; অনাদিকে বললুম কবিরাজ ডাকো, তা সে রাজী নয়। বললে, আপনি সেরে যাবে।–কেন বলুন দেখি?’
‘না–কিছু নয়। কাছে পিঠে করা থাকে তাই জানতে চাই। অন্যান্য আমলারা বুঝি হাতার বাইরে থাকে?’
‘হ্যাঁ, তাদের জন্যে একটু দূরে বাসা তৈরি করিয়া দেওয়া হয়েছে—সবসুদ্ধ সাত-আট ঘর আমলা আছে। শহর থেকে যাতায়াত করলে সুবিধা হয় না, ভাই কর্তার আমলেই তাদের জন্যে একটা পাড়া বসানো হয়েছিল।’
‘শহর এখান থেকে কতদূর?’
‘মাইল পাঁচেক হবে। সামনের রাস্তাটা সিধা পুব দিকে শহরে গিয়েছে।’
এই সময় হিমাংশুবাবু বাড়ির ভিতর হইতে আসিয়া সহাস্যমুখে বলিলেন, ‘আসুন ব্যোমকেশবাবু্, আমার অস্ত্রাগার আপনাদের দেখাই।’
আমরা সাগ্রহে তাঁহার অনুসরণ করিলাম। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল, দেওয়ান আহিক করিবার সময় উপস্থিত বলিয়া খড়ম পায়ে অন্য দিকে প্রস্থান করিলেন।
হিমাংশুবাবু একটি মাঝারি আয়তনের ঘরে আমাদের লইয়া গেলেন। ঘরের মধ্যস্থলে টেবিলের উপর উজ্জ্বল আলো জ্বলিতেছিল। দেখিলাম, মেঝোয় বাঘ ভালুক ও হরিণের চামড়া বিছানো রহিয়াছে; দেওয়ালের ধারে ধারে কয়েকটি আলমারি সাজানো। হিমাংশুবাবু একে একে আলমারিগুলি খুলিয়া দেখাইলেন, নানাবিধ বন্দুক পিস্তল ও রাইফেলে আলমারিগুলি ঠাসা। এই হিংস্ৰ অস্ত্রগুলির প্রতি লোকটির অদ্ভুত স্নেহ দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেলাম। প্রত্যেকটির গুণাগুণ-কোনটির দ্বারা কবে কোন জন্তু বধ করিয়াছেন, কাহার পাল্লা কতখানি, কোন রাইফেলের গুলি বামদিকে ঈষৎ প্রক্ষিপ্ত হয়-এ সমস্ত তাঁহার নখদর্পণে। এই অস্ত্রগুলি তিনি প্ৰাণান্তেও কাহাকেও ছুইতে দেন না; পরিষ্কার করা, তেল মাখানো সবই নিজে করেন।
অস্ত্ৰ দেখা শেষ হইলে আমরা সেই ঘরেই বসিয়া গল্পগুজব আরম্ভ করিলাম। নানা বিষয়ের কথাবাত হইল। বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকের মধ্যে একই মানুষকে এত বিভিন্ন রূপে দেখা যায় যে তাহার চরিত্র সম্বন্ধে একটা অভ্রান্ত ধারণা করিয়া লওয়া কঠিন হইয়া পড়ে। কিন্তু কাচিৎ স্বভাবছদ্মবেশী মানুষের মন অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে আত্মপরিচয় দিয়া ফেলে। এই ঘরে বসিয়া আয়াসহীন অনাড়ম্বর আলোচনার ভিতর দিয়া হিমাংশুবাবুর চিত্তটিও যেন স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ধরা দিল। লোকটি যে অতিশয় সরল চিত্ত-মনটিও তাঁহার বন্দুকের গুলির মত একান্ত সিধা পথে চলে, এ বিষয়ে অন্তত আমার মনে কোনো সন্দেহ রহিল না।
আমাদের সঞ্চরমান আলোচনা নানা পথ ঘুরিয়া কখন অজ্ঞাতসারে বিষয় সম্পত্তি পরিচালনা, দেশের জমিদারের অবস্থা ইত্যাদি প্রসঙ্গের মধ্যে গিয়া পড়িয়াছিল। হিমাংশুবাবু এই সূত্রে নিজের সম্বন্ধে অনেক কথা বলিলেন। প্রজাদের সঙ্গে গত কয়েক বৎসর ধরিয়া নিয়ত সঙঘর্ষে তাঁহার মন তিক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। জমিদারীর আয় প্ৰায় বন্ধ হইয়া গিয়াছে অথচ মামলা মোকদ্দমায় খরচের অন্ত নাই; ফলে, এই কয় বছরে ঋণের মাত্রা প্ৰায় লক্ষের কোঠায় ঠেকিয়াছে। নিজের বিষয় সম্পত্তির সম্বন্ধে এই সব গুহ্য কথা তিনি অকপটে প্রকাশ করিলেন। দেখিলাম, জমিদারী সংক্রান্ত আঁশান্তি তাঁহাকে বিষয় সম্পত্তির প্রতি আরো বিতৃষ্ণ করিয়া তুলিয়াছে। বিপদের গুরুত্ব অনভিজ্ঞতাবশত ঠিক বুঝিতে পারিতেছেন না, তাই মাঝে মাঝে অনির্দিষ্ট আতঙ্কে মন শঙ্কিত হইয়া উঠে; তখন সেই শঙ্কাকে তাড়াইবার জন্য প্রিয় ব্যসন শিকারের প্রতি আরো আগ্রহে ঝুঁকিয়া পড়েন। তাঁহার মনের অবস্থা বর্তমানে এইরূপ।
কথায়বাতায় রাত্রি সাড়ে আটটা বাজিয়া গেল। অতঃপর অন্দর হইতে আহারের ডাক আসিল। এই সময় অনাদি সরকারকে দেখিলাম; সে আমাদের ডাকিতে আসিয়াছিল। লোকটির বয়স বছর পঞ্চাশ হইবে; অত্যন্ত শীর্ণ কোলকুঁজা চেহারা। গালের মাংস চুপসিয়া অভ্যস্তরের কোন অতল গহ্বরে অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে, ঝাঁকড়া গোঁফ ওষ্ঠাধর লিঙঘন করিয়া চিবুকের কাছে আসিয়া পড়িয়ছে। চোখে একটা অস্বচ্ছন্দ উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি-যেন কোনাে দারুণ দুস্কৃতি করিয়া ধরা পড়িবার ভয়ে সর্বদা সশঙ্ক হইয়া আছে।
ব্যোমকেশ তাহাকে একবার তীক্ষ্মদৃষ্টিতে আপাদমস্তক দেখিয়া লইল। তারপর আমরা তিনজনে তাহাকে অনুসরণ করিয়া অন্দর মহলে প্রবেশ করিলাম।
আহারাদির পর একজন ভৃত্য আমাদের পথ দেখাইয়া শয়নকক্ষে লইয়া গেল। ভূত্যটির নাম ভুবন-সেই হিমাংশুবাবুর খাস বেয়ারা। শয়নকক্ষে ইজিচেয়ারে বসিয়া আমরা সিগারেট ধরাইলাম; ভুবন মশারি ফেলিয়া, জলের কুঁজা হাতের কাছে রাখিয়া, ঘরের এটা ওটা ঝাড়িয়া ঝাড়ন স্কন্ধে প্রস্থান করিতেছিল, ব্যোমকেশ তাহাকে ডাকিয়া বলিল, ‘তুমি তো হরিনাথ মাস্টারকে ছমাস ধরে দেখেছ, সে কি সব সময় চশমা পরে থাকত?’
আমরা যে চুরির তদন্তু করিতে আসিয়াছি তাহা ভুবন বোধকরি জানিত, তাই কথা কহিবার সুযোগ পাইয়া সে উৎসুকভাবে বলিল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, চব্বিশ ঘণ্টাই তো চশমা পরে থাকতেন। একদিন চশমা না পরে স্নান করতে যাচ্ছিলেন, হোঁচটি খেয়ে পড়ে গেলেন। বিনা চশমায় তিনি এক-পা চলতে পারতেন না বাবু।‘
ব্যোমকেশ বলিল, “হুঁ। আচ্ছা, তার জুতো ক’জোড়া ছিল বলতে পার?’
ভুবন হাসিয়া বলিল, “জুতো আবার ক’জোড়া থাকবে বাবু, এক জোড়া। তাও সরকার থেকে কিনিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যে-জোড়া পরে তিনি এসেছিলেন সে তো এমন ছেড়া যে কুকুরেও খায় না। আমরা সেই দিনই জুতো টান মেরে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিয়েছিলুম।‘
‘বটে! আচ্ছা, মাস্টারের ঘরের দেয়ালে যে একটি মা কালীর ছবি টাঙানো রয়েছে সেটা কি মাস্টার সঙ্গে করে এনেছিল?”
‘আজ্ঞে না হুজুর, মাস্টারবাবু একটি খড়কে কাঠিও সঙ্গে করে আনেননি। ও ছবি দেওয়ানজীর কাছ থেকে মাস্টারবাবু একদিন এনে নিজের ঘরে টাঙিয়েছিলেন।‘
‘বুঝেছি।‘ ব্যোমকেশ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, “আচ্ছা, তুমি এখন যেতে পার।
ভুবন জিজ্ঞাসা করিল, ‘আর কিছু চাই না হুজুর?’
‘না। ভাল কথা, একটা কাজ করতে পার? বাড়িতে পাঁজি আছে নিশ্চয়, একবার আনতে পার?’
ভুবন বোধকরি মনে মনে একটু বিস্মিত হইল। কিন্তু সে জমিদার বাড়ির লেফাফাদুরস্ত চাকর, সে ভাব প্রকাশ না করিয়া বলিল, ‘এখনি কি চাই হুজুর?
‘এখনি হলে ভাল হয়।‘
‘যে আজ্ঞে–এনে দিচ্ছি।‘
ভুবন বাহির হইয়া গেল। আমরা নীরবে ধূমপান করিতে লাগিলাম। পাঁচ মিনিট কাটিয়া গেল।
তারপর, হঠাৎ অতি সন্নিকটে একটানা বিকট একটা আর্তনাদ শুনিয়া আমরা ধড়মড় করিয়া সোজা হইয়া বসিলাম। কিন্তু তখনি বুঝিলাম, অনৈসৰ্গিক কিছু নয়-শেয়াল ডাকিতেছে। পাঁচ-ছয়টা শৃগাল একত্র হইয়া নিকটেরই কোনো স্থান হইতে সম্মিলিত উর্ধর্বস্বরে যাম ঘোষণা করিতেছে। এত নিকট হইতে শব্দটা আসিল বলিয়া হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়াছিলাম।
এই সময় ভুবন পাঁজি হাতে ফিরিয়া আসিল। আমি বলিয়া উঠিলাম, ‘ও কি হে! বাড়ির এত কাছে শেয়াল ডাকছে?’
শেয়ালের ডাক তখন থামিয়াছে, ভুবন হাসি চাপিয়া বলিল, ‘আসল শেয়াল নয় হুজুর। বেবিদিদি আজ সন্ধ্যে থেকে বায়না ধরেছিলেন দেওয়ান ঠাকুরের কাছে শেয়াল ডাক শুনবেন। তাই তিনিই ডাকছেন।’
আমি বলিলাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আজ সন্ধ্যেবেলা বেবি বলছিল বটে। কিন্তু আশ্চর্য ক্ষমতা তো দেওয়ানজীর! একেবারে অবিকল শেয়ালের ডাক, কিছু বোঝবার জো নেই।’
ভুবন বলিল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর। দেওয়ান ঠাকুর চমৎকার জন্তু-জানোয়ারের ডাক ডাকতে পারেন।‘ বলিয়া পাঁজি ব্যোমকেশের পাশে টেবিলের উপর রাখিল।
ব্যোমকেশের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, সে যেন হঠাৎ পাথরের মূর্তিতে পরিণত হইয়া গিয়াছে; চোখের দৃষ্টি স্থির, সর্বাঙ্গের পেশী টান হইয়া শক্ত হইয়া আছে। আমি সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিলাম, ‘কি হে?’
ব্যোমকেশের চমক ভাঙিল। চোখের সম্মুখ দিয়া হাতটা একবার চালাইয়া বলিল, ‘কিছু না।–এই যে পাঁজি এনেছ? বেশ, তুমি এখন যেতে পারো।’
ভুবন প্রস্থান করিল। ব্যোমকেশ পাঁজিটা তুলিয়া লইয়া তাহার পাতা উল্টাইতে লাগিল। খানিক পরে একটা পাতায় আসিয়া তাহার দৃষ্টি রুদ্ধ হইল। সেই পাতাটা পড়িয়া সে পাঁজি আমার দিকে অগ্রসর করিয়া দিয়া বলিল, ‘এই দ্যাখা।’
মনে হইল, তাহার গলার স্বর উত্তেজনায় ঈষৎ কাঁপিয়া গেল। পাঁজির নির্দিষ্ট পাতাটা পড়িলাম। দেখিলাম, যে-রাত্রে মাস্টার নিরুদ্দেশ হইয়া যায় সে-রাত্রিটা ছিল অমাবস্যা।