Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » চিত্রচোর – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 4

চিত্রচোর – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

দিন পাঁচ ছয় কাটিয়া গিয়াছে।

ব্যোমকেশের শরীর এই কয়দিনে আরও সারিয়াছে। তাহার আহার্যের বরাদ্দ বৃদ্ধি পাইয়াছে; সত্যবতী তাহাকে দিনে দুইটা সিগারেট খাইবার অনুমতি দিয়াছে। আমি নিত্য গুরুভোজনের ফলে দিন দিন খোদার খাসী হইয়া উঠিতেছি, সত্যবতীর গায়েও গত্তি লাগিয়াছে। এখন আমরা প্রত্যহ বৈকালে ব্যোমকেশকে লইয়া রাস্তায় রাস্তায় পাদচারণ করি, কারণ হাওয়া বদলের ইহা একটা অপরিহার্য অঙ্গ। সকলেই খুশি।

একদিন আমরা পথ-ভ্রমণে বাহির হইয়াছি, অধ্যাপক সোম আসিয়া আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন, বলিলেন, ‘চলুন, আজ আমিও আপনাদের সহযাত্রী।’

সত্যবতী একটু উৎকণ্ঠিত হইয়া বলিল, ‘মিসেস সোম কি—?’

সোম প্রফুল্ল স্বরে বলিলেন, ‘তাঁর সর্দি হয়েছে। শুয়ে আছেন।’

সোম মিশুক লোক, কেবল স্ত্রী সঙ্গে থাকিলে একটু নির্জীব হইয়া পড়েন। আমরা নানা কথার আলোচনা করিতে করিতে পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম।

ছবি চুরির প্রসঙ্গ আপনা হইতেই উঠিয়া পড়িল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আচ্ছা বলুন দেখি, ঐ ছবিখানা কাগজে বা পত্রিকায় ছাপানোর কোনও প্রস্তাব হয়েছিল কি?’

সোম চকিতে একবার ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন, তারপর ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া ভাবিতে ভাবিতে বলিলেন, ‘কৈ, আমি তো কিছু জানি না। তবে নকুলেশবাবু মাঝে কলকাতা গিয়েছিলেন বটে। কিন্তু আমাদের না জানিয়ে তিনি ছবি ছাপতে দেবেন কি? মনে হয় না। বিশেষত ডেপুটি ঊষানাথবাবু জানতে পারলে ভারি অসন্তুষ্ট হবেন।’

‘ঊষানাথবাবু অসন্তুষ্ট হবেন কেন?’

‘উনি একটু অদ্ভুত গোছের লোক। বাইরে বেশ গ্রাম্ভারি, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভীরু প্রকৃতি। বিশেষত ইংরেজ মনিবকে* যমের মত ভয় করেন। সাহেবরা বোধ হয় চান না যে একজন হাকিম সাধারণ লোকের সঙ্গে ফটো তোলাবে, তাই ঊষানাথবাবুর ফটো তোলাতে ঘোর আপত্তি। মনে আছে, পিক্‌নিকের সময় তিনি প্রথমটা ফটোর দলে থাকতে চাননি, অনেক বলে-কয়ে রাজী করাতে হয়েছিল। এ ছবি যদি কাগজে ছাপা হয় নকুলেশবাবুর কপালে দুঃখ আছে।’

ব্যোমকেশের মুখ দেখিয়া বুঝিলাম সে মনে মনে উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে। সে জিজ্ঞাসা করিল, ‘ঊষানাথবাবু কি সব সময়েই কালো চশমা পরে থাকেন?’

সোম বলিলেন, ‘হ্যাঁ। উনি বছর দেড়েক হল এখানে বদলি হয়ে এসেছেন, তার মধ্যে আমি ওঁকে কখনও বিনা চশমায় দেখিনি। হয়তো চোখের কোনও দুর্বলতা আছে; আলো সহ্য করতে পারেন না।’

ব্যোমকেশ ঊষানাথবাবু সম্বন্ধে আর কোনও প্রশ্ন করিল না। হঠাৎ বলিল, ‘ফটোগ্রাফার নকুলেশ সরকার লোকটি কেমন?’

সোম বলিলেন, ‘চতুর ব্যবসাদার, ঘটে বুদ্ধি আছে। মহীধরবাবুকে খোসামোদ করে চলেন, শুনেছি তাঁর কাছে টাকা ধার নিয়েছেন।’

‘তাই নাকি! কত টাকা?’

‘তা ঠিক জানি না। তবে মোটা টাকা।’

এই সময় সামনে ফট্‌ফট্ শব্দ শুনিয়া দেখিলাম একটি মোটর-বাইক আসিতেছে। আরও কাছে আসিলে চেনা গেল, আরোহী ডি.এস.পি. পুরন্দর পাণ্ডে। তিনিও আমাদের চিনিয়াছিলেন, মোটর-বাইক থামাইয়া সহাস্যমুখে অভিবাদন করিলেন।

কুশল প্রশ্ন আদান-প্রদানের পর ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘ফাল্গুনী পাল আপনার ছবি এঁকেছে?’

পাণ্ডে চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিলেন, ‘তাজ্জব ব্যাপার মশাই, পর দিনই ছবি নিয়ে হাজির। একেবারে হুবহু ছবি এঁকেছে। অথচ আমার ফটো তার হাতে যাবার কোনই সম্ভাবনা নেই। সত্যি গুণী লোক। দশ টাকা খসাতে হল।’

ব্যোমকেশ সহাস্যে বলিল, ‘কোথায় থাকে সে?’

পাণ্ডে বলিলেন, ‘আর বলবেন না। অতবড় গুণী কিন্তু একেবারে হতভাগা। পাঁড় নেশাখোর—মদ গাঁজা গুলি কোকেন কিছুই বাদ যায় না। মাসখানেক এখানে এসেছে। এখানে এসে যেখানে সেখানে পড়ে থাকত, কোনও দিন কারুর বারান্দায়, কোনও দিন কারুর খড়ের গাদায় রাত কাটাত। মহীধরবাবু দয়া করে নিজের বাগানে থাকতে দিয়েছেন। ওঁর বাগানের কোণে একটা মেটে ঘর আছে, দু’দিন থেকে সেখানেই আছে।’

হতভাগ্য এবং চরিত্রহীন শিল্পীর যে-দশা হয় ফাল্গুনীরও তাহাই হইয়াছে। তবু কিছুদিনের জন্যও সে একটা আশ্রয় পাইয়াছে জানিয়া মনটা আশ্বস্ত হইল।

পাণ্ডে আবার গাড়িতে স্টার্ট দিবার উপক্রম করিলে সোম বলিলেন, ‘আপনি এদিকে চলেছেন কোথায়?’

পাণ্ডে বলিলেন, ‘মহীধরবাবুর বাড়ির দিকেই যাচ্ছি। নকুলেশবাবুর মুখে শুনলাম তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই বাড়ি যাবার পথে তাঁর খবর নিয়ে যাব।’

‘কি অসুখ?’

‘সামান্য সর্দিকাশি। কিন্তু ওঁর হাঁপানির ধাত।’

সোম বলিলেন, ‘তাই তো, আমারও দেখতে যাওয়া উচিত। মহীধরবাবু আমাকে বড়ই স্নেহ করেন—’

পাণ্ডে বলিলেন, ‘বেশ তো, আমার গাড়ির পিছনের সীটে উঠে বসুন না, একসঙ্গেই যাওয়া যাক। ফেরবার সময় আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাব।’

‘তাহলে তো ভালই হয়।’ বলিয়া সোম মোটর-বাইকের পিছনে গদি-আঁটা আসনটিতে বসিয়া পাণ্ডের কোমর জড়াইয়া লইলেন।

ব্যোমকেশ বলিল, ‘আচ্ছা, মহীধরবাবুকে বলে দেবেন আমরা কাল বিকেলে যাব।’

‘আচ্ছা। নমস্কার।’

মোটর-বাইক দুইজন আরোহী লইয়া চলিয়া গেল। আমরাও বাড়ির দিকে ফিরিলাম। লক্ষ্য করিলাম ব্যোমকেশ আপন মনে মুখ টিপিয়া টিপিয়া আসিতেছে।

বাড়ি ফিরিয়া চা পান করিতে বসিলাম। ব্যোমকেশ একটু অন্যমনস্ক হইয়া রহিল। দরজা খোলা ছিল; সিঁড়ির উপর ভারী পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। ব্যোমকেশ চকিত হইয়া খাটো গলায় বলিল, ‘অধ্যাপক সোম কোথায় গেছেন এ প্রশ্নের যদি জবাব দেবার দরকার হয়, বলো তিনি মিস্টার পাণ্ডের বাড়িতে গেছেন।’

কথাটা ভাল করিয়া হৃদয়ঙ্গম করিবার পূর্বেই প্রশ্নের উত্তর দিবার প্রয়োজন উপস্থিত হইল। মালতী দেবী দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন। সর্দিতে তাঁহার মুখখানা আরও ভারী হইয়া উঠিয়াছে, চক্ষু রক্তাভ; তিনি ঘরের চারিদিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি প্রেরণ করিলেন। সত্যবতী উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘আসুন মিসেস সোম।’

মালতী দেবী ধরা-ধরা গলায় বলিলেন, ‘না, আমার শরীর ভাল নয়। উনি আপনাদের সঙ্গে বেরিয়েছিলেন, কোথায় গেলেন?’

ব্যোমকেশ দ্বারের কাছে আসিয়া সহজ সুরে বলিল, ‘রাস্তায় পাণ্ডে সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তিনি প্রোফেসর সোমকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন।’

মালতী দেবী বিস্ময়ভরে বলিলেন, ‘পুলিসের পাণ্ডে? ওঁর সঙ্গে তাঁর কি দরকার?’

ব্যোমকেশ সরলভাবে বলিল, ‘তা তো কিছু শুনলাম না। পাণ্ডে বললেন, চলুন আমার বাড়িতে চা খাবেন। হয়তো কোনও কাজের কথা আছে।’

মালতী দেবী আমাদের তিনজনের মুখ ভাল করিয়া দেখিলেন, একটা গুরুভার নিশ্বাস ফেলিলেন, তারপর আর কোনও কথা না বলিয়া উপরে চলিয়া গেলেন। আমরা ফিরিয়া আসিয়া বসিলাম।

ব্যোমকেশ আমাদের পানে চাহিয়া একটু লজ্জিতভাবে হাসিল, বলিল ‘ডাহা মিথ্যে কথা বলতে হল। কিন্তু উপায় কি? বাড়িতে দাম্পত্য-দাঙ্গা হওয়াটা কি ভাল?’

সত্যবতী বাঁকা সুরে বলিল, ‘তোমাদের সহানুভূতি কেবল পুরুষের দিকে। মিসেস সোম যে সন্দেহ করেন সে নেহাত মিছে নয়।’

ব্যোমকেশেরও স্বর গরম হইয়া উঠিল, ‘আর তোমাদের সহানুভূতি কেবল মেয়েদের দিকে। স্বামীর ভালবাসা না পেলে তোমরা হিংসেয় চৌচির হয়ে যাও, কিন্তু স্বামীর ভালবাসা কি করে রাখতে হয় তা জান না। —যাক, অজিত, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে ভাই; বাইরের বারান্দায় পাহারা দিতে হবে। সোম ফিরলেই তাঁকে চেতিয়ে দেওয়া দরকার, নৈলে মিথ্যে কথা যদি ধরা পড়ে যায় তাহলে সোম তো যাবেই, সেই সঙ্গে আমাদেরও অশেষ দুর্গতি হবে।’

আমার কোনই আপত্তি ছিল না। বাহিরের বারান্দায় একটা চেয়ার পড়িয়া থাকিত, তাহাতে বসিয়া মনের সুখে সিগারেট টানিতে লাগিলাম। বাহিরে একটু ঠাণ্ডা বেশি, কিন্তু আলোয়ান গায়ে থাকিলে কষ্ট হয় না।

সোম ফিরিলেন প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে। পাণ্ডের মোটর ফট্ ফট্ শব্দে ফটকের বাহিরে দাঁড়াইল, সোমকে নামাইয়া দিয়া চলিয়া গেল। তিনি বারান্দায় উঠিলে আমি বলিলাম, ‘শুনে যান। কথা আছে।’

বসিবার ঘরে ব্যোমকেশ একলা ছিল। সোমের মুখ দেখিলাম, গম্ভীর ও কঠিন। ব্যোমকেশ বলিল, ‘মহীধরবাবু কেমন আছেন?’

সোম সংক্ষেপে বলিলেন, ‘ভালই।’

‘ওখানে আর কেউ ছিল নাকি?’

‘শুধু ডাক্তার ঘটক।’

ব্যোমকেশ তখন মালতী-সংবাদ সোমকে শুনাইল। সোমের গম্ভীর মুখে একটু হাসি ফুটিল। তিনি বলিলেন, ‘ধন্যবাদ।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *