চিড়িয়াখানা (Chidiyakhana)
–ইঃ বাবা রে। এই শালো মানুষ খায়। গেঁয়ো যুবকটি বলল।
—গতরখানা দেখেছিস? তার প্রৌঢ় কাকার চোখ পটপটাং হয়ে খুলে আছে। নথ-নাড়া বউটা কথা বলছে না। বাক্যহারা হয়ে গেছে। কুঁচো-কাঁচাদের মধ্যে একটা ছেলে ঘুষি পাকিয়ে লাফাচ্ছে—আয় বাঘ, লড়বি? এক ঘুষিতে মুখ ভেঙে দেব।
খাঁচার শিক-এর ওপাশে ভারী চকিত পায়ে অবিশ্রান্ত পায়চারি করছে বিশাল রাজকীয় বাঘ। বিরক্ত, রাগত, ক্ষুধার্ত এবং খানিকটা বুঝি উদাসীনও। রোজ কত মরণশীল মানুষ দেখতে আসে তাকে।
বাঘ। বাঘ। মানুষের সমাজে সবচেয়ে বেশি নামডাকের জানোয়ার। বাঘের নাম করলেই যেন একটা ‘গাঁক’ শব্দ শুনতে পায় মানুষ।
গেঁয়ো মানুষের দঙ্গলটা বাঘের খাঁচার সামনে অনেকক্ষণ কাটায়। খুব ভোরে তারা গাঁ ছেড়ে বেরিয়েছে। পাঁচ মাইল হেঁটে এসে গোসাবার লঞ্চ ধরেছে সকালে। ক্যানিং থেকে ট্রেনে বালিগঞ্জে। সেকেন্ড ক্লাস ট্রামে চেপে কালীঘাট। সেখানে এর-ওর কোমর ধরে মানুষের রেলগাড়ি হয়ে সার দিয়ে মন্দিরে ঢুকে পুজো দিয়েছে। কপালে সিঁদুর, হাতে শালপাতার ঠোঙায় প্রসাদ নিয়ে বেরিয়ে এসে খুব জিলিপি আর কচুরি দিয়ে উপোসভঙ্গ করেছে সবাই। তারপর চলো চিড়িয়াখানা।
যুবকটিই দলের পাণ্ডা। সে আরও বারদুই গেছে চিড়িয়াখানায়। তার পিছু পিছু একত্রিশ নম্বর ট্রাম ধরে দঙ্গলটা এসেছে চিড়িয়াখানার মজা দেখতে। ফের রেলগাড়ি হয়ে সার দিয়ে টিকিট কেটে ঘোরানো গেট-এ ঠেক-ঠোক্কর খেয়ে ঢুকেছে ভিতরে।
গায়ে লম্বা-লম্বা কালো দাগওয়ালা ঘোড়ার মতো জন্তু দেখে মেজবউঠান বলল,—এ বাঘ বুঝি?
—দূর। ও হল জেব্রা।
—সে কীরকম জন্তু গো।
যুবকটি দেখেশুনে বলে—ওই বিলিতি গাধা আর কি।
মেজবউঠান বুঝতে পারে। বিলেতে সব কিছুই আলাদা রকমের তো! বিলিতি আমড়া, বিলিতি বেগুন।
ঈগলের খাঁচার সামনে দলটা দাঁড়ায় বটে সময় নষ্ট করে না।
নথ-নাড়া বউটা বলে—ওঃ, বাজপাখি আবার খাঁচায় রাখবার কী? এ আমরা কত দেখিছি।
যুবকটি একটু দোটানায় পড়ে বলে—এ সেই বাজপাখি নয়।
মেজবউঠান জিগ্যেস করে—বিলিতি নাকি? ওমা, এ যে শেয়ালও রেখেছে দেখছি খাঁচায় পুরে।
কাকি বলে উঠল—মরণ! ও পতু, বেজি দেখছিস কি হাঁ করে দাঁড়িয়ে। পতু নামে বাচ্চা ছেলেটা ছুটে এসে বলল—ও ঠামা, বেজির ইংরেজি কি ম্যাংগোজ? দ্যাখো লেখা আছে। ম্যাংগো। তো আম।
যুবকটি সংশোধন করে বলল—ম্যাংগো নয়, মনগুজ।
শজারু বা বনমোরগ দেখে দঙ্গলটা তেমন অবাক হল না। কাকি বলেই ফেলল—এসব কী দেখাতে আনলি, ও কালীপদ?
নথ-নাড়া বউ বলে ওঠে—এসবই নাকি বিলেতের।
—বলছে?
যুবকটি মিইয়ে যায়। চাপা গলায় বলে—গাঁইয়া বলে লোকে টের পাবে। চুপ করো, লোকে তাকাচ্ছে।
পতুর দিদি দশ বছরের ফুলঝুরি হঠাৎ হাতে তালি দিয়ে বলে ওঠে—হরিণ! হরিণ!
চিড়িয়াখানার ফটকের মুখ থেকে প্রত্যেকে এক ঠোঙা করে ভেজানো ছোলা কিনে এনেছে জীবজন্তুকে খাওয়াবে বলে। ফুলঝুরি তার খানিকটা নিয়ে হরিণের চত্বরে ছুড়ে দিল। হরিণেরা গা করল না।
এমু দেখে সবাই একটু থতমত।
—এ কি পাখি নাকি? মেজবউঠান জিগ্যেস করে।
—পাখিই। যুবকটি বলে।
—উড়তে পারে? পাখনা তো দেখছি না।
যুবকটি বলে—পারে বোধহয়।
—বাবা, অত বড় গতর নিয়ে ওড়া কি চাট্টিখানি কথা? কী পাখি রে?
নথ-নাড়া বউ চিমটি কাটে—বিলিতি। যুবকটি সবাইকে তাড়া দেয়—চলো, চলো, এখনও ঢের দেখার আছে।
চাইনিজ সিলভার ফিসলেট দেখে ফুলঝুরির ছোট বোন বলে ওঠে—ও ঠামা, দ্যাখো, এ পাখিটার পুরুতমশাইয়ের মতো টিকি আছে গো!
লামা, ক্যাসোয়ারি, স্বর্ণমৃগ দেখে-দেখে রিন্টু রং-এর খাঁচার সামনে আসতেই ফুলঝুরির বোন রুপোঝুরি বলে—দিদি, একটা আতপ চাল আতপ চাল গন্ধ পাচ্ছিস?
—ঠিক রে। ফুলঝুরি শ্বাস টেনে বলে।
—আতপ চালের গন্ধ।
সান গ্লাস চোখে এক শহুরে সুন্দরী তার ইংরেজি বলা ছেলে আর পাইপটানা স্বামীর সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল। এই কথা শুনে হঠাৎ লিপস্টিক চিরে একটু হাসে।
ফুলঝুরি কাকিমার কানে-কানে বলে—শাড়িটা দেখেছ? সোনারপুরের কমলাদি এরকম একটা কিনেছে না? নথ-নাড়া বউ বলে—যাঃ, সেটা তো চাঁদেরি। এটা জর্জেট।
একটা দেড় হাত লম্বা ঠোঁটওয়ালা পাখি ঘেরা জায়গা থেকে লোভীর মতো মুখ বের করে বারবার হাঁ করছে। সেই হাঁয়ের মধ্যে পতু ছোলা ছুড়ে দিচ্ছিল ভয়ে-ভয়ে। কপাৎ করে পাখিটা ঠোঁট বন্ধ করে। সবক’টা ছোলা ভিতরে যায় না।
একটু বয়সের একটা মেয়ে এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি। কালীঘাটে সে একটা রঙিন মোড়া কিনতে চেয়ে বায়না করায় কাকির হাতে থাপ্পড় খেয়েছে। এতক্ষণ অনেকবার আঁচলে চোখ মুছতে হয়েছে তাকে। সামনে অঘ্রাণে তার বিয়ে, এত বড় মেয়েকে সবার সামনে মারা?
এবার সে হঠাৎ বলে ওঠে—এই পতু আমার ছোলার ঠোঙাটা নিলি যে বড়? তোরটা কই?
ফুলঝুরি বলে ওঠে—ও টিয়াদি, এতক্ষণ লুকিয়ে-লুকিয়ে পতু নিজের ঠোঙার ছোলা খাচ্ছিল। আমি দেখেছি।
—কী রাক্ষস বাবা। কাকি বলে ওঠে, পেট নামবে দেখিস।
মেজবউঠান যুবকটিকে বলে—ও ঠাকুরপো, এ-পাখিও কি বিলিতি?
কালীপদ এবার ঠেকে শিখেছে। বলে—না-না। ডিশি। সজনেখালির জলায় কত আসে।
—ওড়ে?
—তা ওড়ে।
—তবে এখান থেকেই বা উড়ে যাচ্ছে না কেন? ওপরে তো ঢাকা চাপা কিছু নেই।
কালীপদ ডানদিকে ঘুরে হাঁটতে-হাঁটতে বলে—দেরি হয়ে যাচ্ছে।
গয়াল, সারস, নীলগাই। একে-একে দেখে যেতে থাকে তারা। দুপুরের রোদে তেমন তেজ নেই। শীত আসছে। চিড়িয়াখানায় ঘন সবুজে আস্তরণ পড়েছে। জলের গন্ধ। ছুটিয়াল মানুষজনের মন্থর চলাফেরা।
—দ্যাখো, হরিণের জঙ্গল। রুপোঝুরি বলে। সে বরাবরই অদ্ভুত সব কথা বলে।
পতু আইসক্রিমওলার কাছে খানিক দাঁড়িয়ে রইল।
ডানধারের বিশাল ঘেরা জায়গায় অতিকায় কচ্ছপটা হাঁটছে। এত বড় যে কচ্ছপ বলে বিশ্বাস হয় না।
বাঁ-ধারে জলের কল দেখে সবাই আঁজলা ভরে পেটপুরে জল খেল। কুঁচো-কাঁচারা জল ছোড়াছুড়ি করল খানিক।
—হাতির পিঠে চড়বে নাকি? কালীপদ আস্তে করে জিগ্যেস করে।
নথ-নাড়া বউটা বলে—ও বাবা!
মেজবউঠান শুনতে পেয়ে হেসে বলে—চড় না। কালীপদ ধরে থাকবে’খন।
—মরণ!
ফুলঝুরি পাঁচটা পয়সা আর ছোলা ছুড়ল হাতির দিকে। হাতি ছোলা কুড়িয়ে খুঁড় দিয়ে নিখুঁত খেয়ে নিল, পয়সা তুলে পাশে বসা মাহুতের দিকে ছুড়ে দিল।
ছোটদের আলাদা একটা চিড়িয়াখানা দেখে ঢুকবে-কি-ঢুকবে না ভাবতে-ভাবতে অবশেষে ঢুকে পড়ারই সিদ্ধান্ত হল। কলকাতায় ফের কবে আসা হবে ঠিক তো নেই। মাথাপিছু পঁচিশ পয়সার টিকিট কাটতে হয় এখানে। গন্ডারকে এত কাছ থেকে দেখে সবাই অবাক মানে। পতু বাঁদরটা তো শিকের ভেতরে থেকে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়েও দিল একটু। কাকি বলে—এর চামড়াতেই ঢাল হয়?
এটা বেশ সাজানো জায়গা। ছোট একটা খালের মতো আছে। তার ওপর খেলাঘরের সাঁকো। একটা ছোট দুর্গ। চারধারে খুদে-খুদে সব প্রাণীর খাঁচা। হরেক খরগোশ, বাচ্চা হরিণ, মেছো কুমির, মাদা ইঁদুর।
সবচেয়ে অবাক লাগে ইঁদুরের মতো দেখতে হরিণ দেখে। কী ছোট, কী সুন্দর!
আর লজ্জাবতী বানর? না, তার কথা জীবনেও ভুলবে না যে একবার দেখেছে। দেড় বিঘৎ এর ছোট্ট একটু বানরটা তার একার খাঁচায় হাঁটু আর হাতের মধ্যে মুখ লুকিয়ে বসে আছে। শরীরটা গোল হয়ে আছে। যত তাকে ডাকো, ভ্যাঙাও, ঢিল মারো, সে মুখ তুলবে না। টিয়ার বুকটা দুঃখে ভরে গেল। জীবজন্তুর কত কষ্ট থাকে। সবুজ কচ্ছপ আর বাচ্চা কুমির বাস করছে এক জায়গায়। একটা কচ্ছপ কুমিরের গা বেয়ে উঠে গেল দিব্যি। আড়াল থেকে কথা-বলা ময়না ডাকছে মুহুর্মুহু। সে ডাকে বুক ঝনঝন করে বেজে ওঠে। কী মিষ্টি ডাক!
শীতের স্পর্শ-লাগা বেলা পড়ন্ত হয়ে আসছে। চলো, চলো। আরও কত দেখার বাকি।
—সাপ দেখবে না?
–না বাবা, বড় গা ঘিনঘিন করে।
—সাপ আর দেখবার কী আছে? গাঁয়ে তো কত দেখছি।
—তবে চলো ওই বাঘ দেখি, তারপর লম্বা সাঁকো পেরিয়ে যাব জলের ওধারে।
–কী আছে ওখানে?
–জলের মধ্যে একটা দ্বীপ। তাতে হাজারো পাখি রাত কাটাতে আসে। কলকাতার পাখিদের গ্র্যান্ড হোটেল হল ওই দ্বীপ।
বাতাস কাঁপিয়ে বাঘ ডেকে ওঠে। ওংঘ-অ! ওংঘ-অ!
পতু প্রথমটায় সাপটে ধরেছিল ফুলঝুরিকে। তারপর ছেড়ে দিয়ে হিহি করে হাসতে থাকে।
—যা ভীতু না তুই! ফুলঝুরি বলে।
–বাঘ! বাঘ! বাঘ বলে রুপোঝুরি লাফাতে থাকে।
কালীপদ বলে সুন্দরবনে কত আছে।
—তুমি দেখেছ কখনও? নথ-নাড়া বউ খোঁটা দেয়।
–সুন্দরবনের বাঘ জীবনে একবারই দেখে মানুষ। যখন দেখে তখন আর ফেরে না। বউ মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে—দেখে তবে কাজ নেই।
—এবার মাঘ মাসে যাব দেখতে।
—যাওয়াচ্ছি।
অস্থির পায়চারি করছে সিংহ। তার বিশ্রাম নেই, ক্লান্তি নেই। চোখে কিছু হতাশার রাগ। হলদে মুলোর মতো দাঁত বের করে মুখোমুখি বাঘ একবার ডাকল। ত্রিভুবন কেঁপে ওঠে।
এই না হলে বাঘ!
সবুজ জলের ওপর দিয়ে লম্বা সাঁকো পার হয়ে যায় সবাই। জলের ধারে একটা বাঁধানো বসবার জায়গা। বড় সুন্দর। জলের মাঝখানে উঁচু মতো ছোট একটা দ্বীপ। গাছগাছালিতে ভরা। তাতে হাজার-হাজার পাখি এসে পড়ছে। স্থির জলে যমজ ছায়া ফেলে ময়ূরপঙ্খীর মতো ভেসে যায় সাদা আর কালো রাজহাঁস।
সন্ধের মুখে খাওয়ার সময়। ভালুকটা গপাগপ ডালভাত খাচ্ছিল তার খাঁচায় বসে। বড় খিদে।
সিংহ দেখবে না? কিংবা সিংঘ্র? সাদা বাঘ?
দেখব, দেখব।
ওমা! এর বাবা বুঝি বাঘ আর মা সিংহী? আর এর বুঝি বাপ সিংহ, আর মা বাঘিনী? বাবা রে, দুজনের তেজ কেমন এক হয়েছে দ্যাখো। খাঁচায় আঙুল ঢুকিয়ে দেখবে নাকি একটু চাটে না। কামড়ায়?
—ও পতু, সরে আয় দস্যি ছেলে।
সান গ্লাস পরা সেই সুন্দরী আর তার স্বামী আর ছেলে গাছতলায় বেঞ্চে বসে ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে খাচ্ছে। ছেলের হাতে একটা কেক। পতু চেয়ে থেকে একটা ঢোক গেলে।
ফুলঝুরি আর টিয়ার জানোয়ার দেখতে আর ভালো লাগছে না। তারা আশপাশের মেয়ে বউদের শাড়ি আর সাজ দেখে। গা টেপাটেপি করে হাসে।
নথ-নাড়া বউ বলে—আর পারি না। একটু বসলে হয়।
কালীপদ বলে—আজ তো আর গাঁয়ে ফেরা হবে না। সোনারপুরে কমলাদের বাড়িই থাকতে হবে। কিন্তু সে-ও একটু আগে যাওয়া দরকার। এতগুলো লোকের জন্য আয়োজন।
নথ-নাড়া বউ আস্তে-আস্তে বলে—তোমাতে আমাতে একবার আলাদা করে আসব, বুঝলে! কেমন জোড়ায়-জোড়ায় কতজনা ঘুরে বেড়াচ্ছে দ্যাখো তো!
–কাকা, বাদামভাজা কিনবে? পতু বলে।
সবাই সব ভুলে যায় ম্যাকাও পাখির খাঁচার সামনে এসে। পয়সা সার্থক। চোখ সার্থক। কষ্ট সার্থক।
—এত সুন্দর রামধনুর মতো পাখিও ছিল দুনিয়ায়? ও কালীপদ, এ কি রং করা পাখি?
—না, কাকি, এইরকমই হয়।
ম্যাকাও ঝুল খাচ্ছে খাঁচার গায়ে। কর্কশ স্বরে ডাকছে। খাঁচা কেটে বেরিয়ে যাওয়ার কত নিষ্ফল প্রয়াস তাদের।
—আহা, রে, ওদের কেন ছেড়ে দেয় না?
—ছেড়ে দিলে কি দেখতে পেতে?
বেলা গড়িয়ে যায়। রৌদ্রতপ্ত ঘাসে, নিবিড় গাছপালায় বনের গন্ধ ঘনিয়ে ওঠে। তাপ মরে আসে। ঘাসে-ভেজা শরীরে শীত-বাতাস এসে লাগে। ফেরার সময় হল।
মানুষ ফিরে যায়। তারপর কয়েকটা দিন হয়তো কলকাতার বুকে আশ্চর্য বনভূমির কথা মনে পড়ে। কাজের মধ্যে হঠাৎ-হঠাৎ বাঘের ডাক শোনে। রাতের ঘুমে ম্যাকাও পাখির সৌন্দর্য রঙের ফোয়ারা খুলে দেয় চোখে।