Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » চিড়িয়াখানা – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 2

চিড়িয়াখানা – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

বৈকালে ব্যোমকেশ বলিল,–’তোমাদের লব্ধপ্ৰতিষ্ঠ সাহিত্যিকেরা তো আজকাল সিনেমার দলে ভিড়ে পড়েছেন। তা তোমার চেনাশোনা কেউ ওদিকে আছেন নাকি?’

অবস্থাগতিকে সাহিত্যিক মহলে আমার বিশেষ মেলামেশা নাই। যাঁহারা উন্নলাট সাহিত্যিক তাঁহারা আমাকে কলকে দেন না‌, কারণ আমি গোয়েন্দা কাহিনী লিখি; আর যাঁহারা সাহিত্য-খ্যাতি অর্জন করিবার পর শিং ভাঙিয়া বাছুরের দলে ঢুকিয়া পড়িয়াছেন তাঁহাদের সহিত ঘনিষ্ঠতা করিবার আগ্রহ আমার নাই। কেবল চিত্র-নাট্যকার ইন্দু রায়ের সহিত সদ্ভাব ছিল। তিনি সিনেমার সহিত সংশ্লিষ্ট থাকিয়াও সহজ মানুষের মত বাক্যালাপ ও আচার-ব্যবহার করিতেন।

ব্যোমকেশকে ইন্দু রায়ের নামোল্লেখ করিলে সে বলিল,–’বেশ তো। ওঁর বোধ হয় টেলিফোন আছে‌, দেখ না। যদি সুনয়নার খবর পাও।’

প্রশ্ন শুনিয়া বলিলেন,–’সুনয়নী! কৈ‌, নামটা চেনা-চেনা মনে হচ্ছে না তো। আমি অবশ্য ওদের বড় খবর রাখি না।–’

বলিলাম,–’ওদের খবর রাখে এমন কারুর খবর দিতে পারেন?’

ইন্দুবাবু ভাবিয়া বলিলেন,–’এক কাজ করুন। রমেন মল্লিককে চেনেন?’

‘না। কে তিনি? সিনেমার লোক?’

‘সিনেমার লোক নয়। কিন্তু সিনেমার এনসাইক্লোপিডিয়া‌, চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে এমন লোক নেই যার নাড়িনক্ষত্ৰ জানেন না। ঠিকানা দিচ্ছি‌, তাঁর সঙ্গে গিয়ে দেখা করুন। অতি অমায়িক লোক‌, তার শিষ্টতায় মুগ্ধ হবেন।’ বলিয়া রমেন মল্লিকের ঠিকানা দিলেন।

সন্ধ্যার পর ব্যোমকেশ ও আমি মল্লিক মহাশয়ের ঠিকানায় উপস্থিত হইলাম। তিনি সাজগোজ করিয়া বাহির হইতেছিলেন‌, আমাদের লইয়া বৈঠকখানায় বসাইলেন। দেখিলাম‌, রমেনবাবু ধনী ও বিনয়ী্‌্‌, তাঁহার বয়স চল্লিশের আশেপাশে‌, হৃষ্টপুষ্ট দীর্ঘ আকৃতি; মুখখানি পেঁপে। ফলের ন্যায় চোয়ালের দিকে ভারি‌, মাথার দিকে সঙ্কীর্ণ; গোঁফজোড়া সূক্ষ্ম ও যত্নলালিত; পরিধানে শৌখিন দেশী বেশ-কোঁচান। কাঁচ ধুতির উপর গিলে-করা স্বচ্ছ পাঞ্জাবি; পায়ে বার্নিশ পাম্প।

ব্যোমকেশের নাম শুনিয়া এবং আমরা ইন্দুবাবুর নির্দেশে আসিয়াছি জানিতে পারিয়া রমেনবাবু যেন স্বৰ্গ হাতে পাইলেন। তৎক্ষণাৎ বরফ দেওয়া ঘোলের সরবৎ ও সন্দেশ আসিয়া উপস্থিত হইল।

আদর-আপ্যায়নের ফাঁকে ব্যোমকেশ কাজের কথা পাড়িল‌, বলিল,–’আপনি শুনলাম চলচ্চিত্রের বিশ্বকোষ‌, সিনেমা জগতে এমন মানুষ নেই। যার নাড়ির খবর জানেন না।’

রমেনবাবু সলজ্জ বিনয়ে বলিলেন,–’ওটা আমার একটা নেশা। কিছু নিয়ে থাকা চাই তো। তা বিশেষ কারুর কথা জানতে চান নাকি?’

‘হ্যাঁ‌, সুনয়না নামে একটি মেয়ে বছর দুই আগে—’

রমেনবাবু চকিত চক্ষে চাহিলেন,–’সুনয়না। মানে-নেত্যকালী?’

‘নেত্যকালী!’ ‘সুনয়নার আসন নাম নৃত্যকালী। তার সম্বন্ধে কোনও নতুন খবর পাওয়া গেছে নাকি?’

ব্যোমকেশ বলিল,–’সুনয়নার কথা আমরা কিছুই জানি না-নামটা ছাড়া। আপনার কাছে খবর পাব এই আশায় এসেছি।’

রমেনবাবু বলিলেন,–’ও-আমি ভেবেছিলাম। আপনি পুলিসের পক্ষ থেকে–। যা হোক্‌, নেত্যকালীর অনেক খবরই আমি জানি, কেবল ল্যাজা মুড়োর খবর পাইনি।’

‘সেটা কি রকম?’

‘নেত্যকালী কোথা থেকে এসেছিল জানি না‌, আবার কোথায় লোপাট হয়ে গেল তাও জানি না।‘

‘ভারি রহস্যময় ব্যাপার দেখছি। এর মধ্যে পুলিসের গন্ধও আছে!—আপনি যা যা জানেন দয়া করে বলুন।’

রমেনবাবু আমাদের সিগারেট দিলেন এবং দেশলাই জ্বালিয়া ধরাইয়া দিলেন। তারপর বলিতে আরম্ভ করিলেন,–’ঘটনাচক্ৰে নেত্যকালীর সিনেমালীলা প্রস্তাবনা থেকেই তাকে দেখবার সুযোগ আমার হয়েছিল; আর যবনিকা পতন পর্যন্ত সেই লীলার খবর যে রেখেছিলাম তার কারণ মুরারি আমার বন্ধু ছিল। মুরারি দত্তর নাম বোধ হয় আপনারা জানেন না। তার কথা পরে আসবে।

‘আজ থেকে আন্দাজ আড়াই বছর আগে একদিন সকালের দিকে আমি গৌরাঙ্গ স্টুডিওর মালিক গৌরহরিবাবুর অফিসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। একটি নতুন মেয়ে দেখা করতে এল। গৌরহরিবাবু তখন ‘বিষবৃক্ষ ধরেছেন‌, প্রধান ভূমিকায় অ্যাকটর-অ্যাকট্রেস নেওয়া হয়ে গেছে‌, কেবল মাইনর পার্টের লোক বাকি।

‘সেই নেত্যকালীকে প্রথম দেখলাম। চেহারা এমন কিছু আহা-মারি নয়; তবে বয়স কম‌, চটক আছে। গৌরহরিবাবু ট্রাই নিতে রাজী হলেন।

‘ট্রাই নিতে গিয়ে গৌরহরিবাবুর তাক লেগে গেল। ভেবেছিলেন। ঝি চাকরানীর পার্ট দেবেন‌, কিন্তু অভিনয় দেখার পর বললেন‌, তুমি কুন্দনন্দিনীর পার্ট কর। নেত্যকালী। কিন্তু রাজী হল না‌, বললে‌, বিধবার পার্ট করবে না। গৌরহরিবাবু তখন তাকে কমলমণির পার্ট দিলেন। নেত্যকালী নাম সিনেমায় চলে না‌, তার নতুন নাম হল সুনয়না।’

ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল,–’বিধবার পার্ট করবে না কেন?’

রমেনবাবু বলিলেন,–’কম বয়সী অভিনেত্রীরা বিধবার পার্ট করতে চায় না। তবে নেত্যকালী অন্য ওজর তুলেছিল; বলেছিল‌, সে সধবা‌, গোরস্ত ঘরের বৌ‌, টাকার জন্যে সিনেমায় নেমেছে‌, কিন্তু বিধবা সেজে স্বামীর অকল্যাণ করতে পারবে না। যাকে বলে নাচতে নেমে ঘোমটা।’

‘আশ্চর্য বটে! তারপর?’

‘গৌরহরিবাবু তাকে মাইনে দিয়ে রেখে দিলেন। শুটিং চলল। তারপর যথা সময় ছবি বেরুল। ছবি অবশ্য দাঁড়াল না‌, কিন্তু কমলমণির অভিনয় দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে গেল। সবচেয়ে আশ্চর্য তার মেক-আপ। সে নিজে নিজের মেক-আপ করত; এত চমৎকার মেক-আপ করেছিল যে পদায় তাকে দেখে নেত্যকালী বলে চেনাই গেল না।’

‘তাই নাকি; আর অন্য যে সব ছবিতে কাজ করেছিল-?’

‘অন্য আর একটা ছবিতেই সে কাজ করেছিল‌, তারক গাঙ্গুলির ‘স্বৰ্ণলতায়। শ্যামা ঝি’র পার্ট করেছিল। সে কী অপূর্ব অভিনয়! আর শ্যামা ঝিাঁকে দেখে কার সাধ্য বলে সে-ই বিষবৃক্ষের কমলমণি। একেবারে আলাদা মানুষ!—এখন মনে হয় নেত্যকালীর আসল চেহারাও হয়তো আসল চেহারা নয়‌, মেক-আপ।’

‘তার আসল চেহারার ফটো বোধ হয় নেই?’

‘না। থাকলে পুলিসের কাজে লাগত।’

‘হুঁ। তারপর বলুন।’

রমেনবাবু আর একবার আমাদের সিগারেট পরিবেশন করিয়া আরম্ভ করিলেন—

‘এই তো গেল সুনয়নার সিনেমা-জীবনের ইতিহাস। ভেতরে ভেতরে‌, আর একটা ব্যাপার ঘটতে শুরু করেছিল। সুনয়না সিনেমায় ঢোকবার মাস দুই পরে স্টুডিওতেই মুরারির সঙ্গে তার দেখা হল। মুরারিকে আপনারা চিনবেন না‌, কিন্তু দত্ত-দাস কোম্পানির নাম নিশ্চয় শুনেছেন-বিখ্যাত জহরতের কারবার; মুরারি হল গিয়ে দত্তদের বাড়ির ছেলে। অগাধ বড়মানুষ।

‘মুরারি। আমার বন্ধু ছিল‌, এক গেলাসের ইয়ার বলতে পারেন। আমাদের মধ্যে‌, যাকে স্ত্রীদোষ বলে তা একটু আছে‌, ওটা তেমন দোষের নয়। মুরারিরও ছিল। পালে-পার্বণে একটু-আধটু আমোদ করা‌, বাঁধাবাঁধ কিছু নয়। কিন্তু মুরারি সুনয়নাকে দেখে একেবারে ঘাড় মুচড়ে পড়ল। সুনয়না এমন কিছু পরী-অন্সরী নয়‌, কিন্তু যার সঙ্গে যার মজে মন! মুরারি সকাল-বিকেল গৌরাঙ্গ স্টুডিওতে ধর্না দিয়ে পড়ল।

‘মুরারির বয়স হয়েছিল আমারই মতন। এ বয়সে সে যে এমন ছেলেমানুষী আরম্ভ করবে তা ভাবিনি। সুনয়না কিন্তু সহজে ধরা দেবার মেয়ে নয়। তার বাড়ি কোথায় কেউ জানত না‌, ট্রামে বাসে আসত‌, ট্রামে বাসে ফিরে যেত; কোনও দিন স্টুডিওর গাড়ি ব্যবহার করেনি। মুরারি অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে বার করতে পারেনি তার বাসা কোথায়।

‘মুরারি। আমাকে মনের কথা বলত। আমি তাকে বোঝাতাম‌, সুনয়না ভদ্রঘরের বেী্‌্‌, ভয়ানক পতিব্ৰতা; ওদিকে তাকিও না। মুরারি কিন্তু বুঝত না। তাকে তখন কালে ধরেছে‌, সে বুঝবে কেন?

‘মাস ছয়-সাত কেটে গেল। সুনয়ন মুরারিকে আমল দিচ্ছে না‌, মুরারিও জোঁকের মত লেগে আছে। এইভাবেই চলছে।

‘স্বৰ্ণলতায় সুনয়নার কাজ শেষ হয়ে গেল। সে স্টুডিও থেকে দু’মাসের মাইনে আগাম নিয়ে কিছুদিনের ছুটিতে যাবে কাশ্মীর বেড়াতে‌, এমন সময় একদিন মুরারি এসে আমাকে বললে‌, সব ঠিক হয়ে গেছে। আশ্চর্য হলাম‌, আবার হলাম না। স্ত্রীজাতির চরিত্র‌, বুঝতেই পারছেন। সুনয়না যে অন্য মতলবে ধরা দেবার ভান করছে তা তখন জানব কি করে?

‘দত্ত-দাস কোম্পানির বাগবাজারের দোকানটা মুরারি দেখত। দোকানের পেছনদিকে একটা সাজানো ঘর ছিল। সেটা ছিল মুরারির আড়-ঘর‌, অনেক সময় সেখানেই রাত কাটাতো।

‘পরদিন সকালে হৈ হৈ কাণ্ড। মুরারি তার আডডা-ঘরে মরে পড়ে আছে। আর দোকানের শো-কেস থেকে বিশ হাজার টাকার হীরের গয়না গায়েব হয়ে গেছে।

‘পুলিস এল‌, লাস পরীক্ষার জন্যে চালান দিলে। কিন্তু কে মুরারিকে মেরেছে তার হদিস পেলে না। সে-রত্রে মুরারির ঘরে কে এসেছিল তা বোধ হয়। আমি ছাড়া আর কেউ জানত না। মুরারি। আর কাউকে বলেনি।

‘আমি বড় মুস্কিলে পড়ে গেলাম। খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়বার ইচ্ছে মোটেই ছিল না‌, অথচ না বললেও নয়। শেষ পর্যন্ত কর্তব্যের খাতিরে পুলিসকে গিয়ে বললাম।

‘পুলিস অন্ধকারে হ্যাঁ করে বসে ছিল‌, এখন তুড়ে তল্লাস শুরু করে দিলে। সুনয়নার নামে ওয়ারেন্ট বেরুল। কিন্তু কোথায় সুনয়না! সে কাপুরের মত উবে গেছে। তার যে সব ফটোগ্রাফ ছিল তা থেকে সনাক্ত করা অসম্ভব। তার আসল চেহারা স্টুডিওর সকলকারই চেনা ছিল‌, কিন্তু এই ব্যাপারের পর আর কেউ সুনয়নাকে চোখে দেখেনি।

‘তাই বলেছিলাম সুনয়নার ল্যাজা-মুড়ো দুই-ই আমাদের চোখের আড়ালে রয়ে গেছে। সে কোথা থেকে এসেছিল‌, কার মেয়ে কার বৌ কেউ জানে না; আবার ভোজবাজির মত কোথায় মিলিয়ে গেল তাও কেউ জানে না।’

রমেনবাবু চুপ করিলেন। ব্যোমকেশও কিছুক্ষণ চিন্তামগ্ন হইয়া রহিল‌, তারপর বলিল,–’মুরারিবাবুর মৃত্যুর কারণ জানা গিয়েছিল?’

রমেনবাবু বলিলেন,–’তার পেটে বিষ পাওয়া গিয়েছিল।’

‘কোন বিষ জানেন?’

‘ঐ যে কি বলে-নামটা মনে পড়ছে না–তামাকের বিষ।’

‘তামাকের বিষ! নিকোটিন?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ‌, নিকোটিন। তামাক থেকে যে এমন দুদন্তি বিষ তৈরি হয় তা কে জানত?—আসুন।’ বলিয়া সিগারেটের টিন খুলিয়া ধরিলেন।

ব্যোমকেশ হাস্যমুখে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল,–’ধন্যবাদ‌, আর না। আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম। আপনি কোথাও বেরুচ্ছিলেন–’

‘সে কি কথা! বেরুনো তো রোজই আছে‌, আপনাদের মতো সজনদের সঙ্গ পাওয়া কি সহজ কথা–আমি যাচ্ছিলাম একটি মেয়ের গান শুনতে। নতুন এসেছে‌, খাসা গায়। তা এখনও তো রাত বেশি হয়নি‌, চলুন না। আপনারাও দুটো ঠুংরি শুনে আসবেন।’

ব্যোমকেশ মুচকি হাসিয়া বলিল,–’আমি তো গানের কিছুই বুঝি না‌, আমার যাওয়া বৃথা; আর অজিত ধ্রুপদ ছাড়া কোনও গান পছন্দই করে না। সুতরাং আজ থাক। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আবার যদি খবরের দরকার হয়‌, আপনার শরণাপন্ন হব।’

‘একশ’বার। —যখনই দরকার হবে তলব করবেন।’

‘আচ্ছা‌, আসি তবে। নমস্কার।’

নমস্কার। নমস্কার।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *