Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » চিড়িয়াখানা – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 19

চিড়িয়াখানা – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

দুইদিন গোলাপ কলোনীর দিক থেকে কোনও সাড়াশব্দ আসিল না; প্রমোদ বরািটও খবর দিল। না। মৃত্যু-ছায়াচ্ছন্ন কলোনীর কথা যেন সকলে ভুলিয়া গিয়াছে। ব্যোমকেশ টেলিফোনের দিকে চোখ রাখিয়া অতৃপ্ত প্রেতাত্মার মত ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। দু’একবার আমরা দাবার ছক সাজাইয়া বসিলাম। কিন্তু ব্যোমকেশ অন্যমনস্ক হইয়া রহিল‌, খেলা জমিল না।

তৃতীয় দিন বিকালবেলা চা-পানের পর ব্যোমকেশ বলিল,–’আমি একটু বেরুব।’

আমারও মন চঞ্চল হইয়া উঠিল‌, বলিলাম,–’কোথায় যাবে?’

‘সেন্ট মার্থার স্কুলে খোঁজ-খবর নেওয়া দরকার। তুমি কিন্তু বাড়িতেই থাকবে। যদি টেলিফোন আসে।’

ব্যোমকেশ চলিয়া গেল। তারপর দুঘন্টা কড়িকাঠ গুনিয়া কাটাইয়া দিলাম।

ছটা বাজিতে পাঁচ মিনিটে টেলিফোন বাজিল। বুকের ভিতরটা ছাৎ করিয়া উঠিল।

বরাট টেলিফোন করিতেছে। বলিল,–’বেরিয়েছেন?–তাঁকে বলে দেবেন। ভুজঙ্গধরবাবু কোট-প্যান্ট পরে পৌঁনে ছাঁটার ট্রেনে কলকাতা গেছেন।–আর একটা খবর আছে‌, রসিক দে’র খতাপত্র পরীক্ষা করে দেখা গেছে তিন হাজার টাকার গরমিল। রসিকের নামে ওয়ারেন্ট বার করেছি।’

‘কলোনীর খবর কী?’

‘নতুন খবর কিছু নেই।’

বরাট টেলিফোন ছাড়িয়া দিবার পর মনটা আরও অস্থির হইয়া উঠিল। ভুজঙ্গধরবাবু কলিকাতায় আসিতেছেন এ সংবাদের গুরুত্ব কতখানি কিছুই জানি না। ব্যোমকেশ কখন ফিরিবে?

ব্যোমকেশ ফিরিল সওয়া ছাঁটার সময়। ভুজঙ্গধরবাবুর সংবাদ দিতেই তাহার মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল‌, সে হাতের ঘড়ি দেখিয়া বলিল, —’ট্রেন এসে পৌঁছতে এখনও আধা ঘন্টা। অনেক সময় আছে।’ বলিয়া নিজের শয়নকক্ষে গিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া দিল।

আমি দ্বারের নিকট হইতে বলিলাম,–’রসিক দে দোকানের তিন হাজার টাকা মেরেছে।’

ওপার হইতে আওয়াজ আসিল,–’বেশ বেশ।’

পাঁচ মিনিট পরে ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল একটি আধাবয়সী ফিরিঙ্গী। পরিধানে ময়লা জিনের প্যান্টুলুন ও রঙচটা আলপাকার কোট‌, মাথায় তেল-চিট নাইট ক্যাপ‌, ছাঁটা গোঁফের ভিতর হইতে আধ-পোড়া একটা চুরুট বাহির হইয়া আছে।

বলিলাম,–’এ কি গোয়াঞ্চি পিদ্রু সেজে কোথায় চললে?’

সাহেব কড়া সুরে বলিল, —’None of your business‌, young man.’ বলিয়া পা ঘষিয়া বাহির হইয়া গেল।

তারপর সাড়ে দশটার আগে আর তাহার দেখা পাইলাম না। একেবারে স্নান সারিয়া গরম চায়ের পেয়ালা হাতে বাহিরের ঘরে আসিয়া বসিল।

আমি বলিলাম,–’কোট-প্যান্টুলুনের আর একটা মহৎ গুণ‌, পরলেই মেজাজ। সপ্তমে চড়ে যায়। আশা করি মাথা ঠাণ্ডা হয়েছে।’

ব্যোমকেশ বলিল,–’কোট-প্যান্টুলুনের আর একটা মহৎ গুণ‌, বেশি ছদ্মবেশ দরকার হয় না।–তুমি বোধহয় খুবই উৎসুক হয়ে উঠেছ?’

‘তা উঠেছি। এবার তোমার হৃদয়ভার লাঘব কর।’

‘কোনটা আগে বলব? ভুজঙ্গধরবাবুর বৃত্তান্ত?’

‘হ্যাঁ।‘

ব্যোমকেশ চায়ে চুমুক দিয়া বলিল,–’বুঝতেই পেরেছ ফিরিঙ্গী সেজে শিয়ালদা স্টেশনে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল ভুজঙ্গধরবাবু কোথায় যান দেখা। স্টেশনে তাঁকে আবিষ্কার করে তাঁর পিছু নিলাম। তখন সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। তাঁকে অনুসরণ করা শক্ত হল না। তিনি ট্রামে চড়লেন‌, আমিও ট্রামে চড়লাম। মৌলালির মোড়ে এসে তিনি নামলেন‌, আমিও নোমলাম। তারপর ধর্মতলা দিয়ে কিছুদূর গিয়ে তিনি একটা গলির মধ্যে ঢুকে পড়লেন। গলির পর গলি‌, তস্য গলি। দেখলাম ফিরিঙ্গী পাড়ায় এসে পৌঁছেছি। ভালই হল। পাড়ার সঙ্গে আমার ছদ্মবেশ খাপ খেয়ে গেল। কোট-প্যান্টুলুনের ওই মাহাত্ম্য, যে পাড়াতেই যাও বেমানান হয় না।‘

‘তারপর?’

‘একটা এদোঁপড়া বাড়ির দরজার পাশে দুটো স্ত্রীলোক দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভুজঙ্গধরবাবু গিয়ে তাদের সঙ্গে খাটো গলায় কথা বললেন‌, তারপর বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেলেন। স্ত্রীলোক দুটো দাঁড়িয়ে রইল।’

জিজ্ঞাসা করিলাম,–’তাদের কি রকম মনে হল?’

ব্যোমকেশের মুখে বিতৃষ্ণা ফুটিয়া উঠিল‌, সে বলিল

‘দেবতা ঘুমালে তাঁহাদের দিন
দেবতা জাগিলে তাদের রাতি
ধরার নরক সিংহদুয়ারে
জ্বালায় তাহারা সন্ধ্যাবাতি!’

‘তারপর বল।’

‘আমি বড় মুস্কিলে পড়ে গেলাম। ভুজঙ্গধরবাবুর চরিত্র আমরা যতটা জানতে পেরেছি। তাতে আশ্চর্য হবার কিছু ছিল না। কিন্তু এই এঁদোপড়া বাড়িটাই তাঁর একমাত্র গন্তব্যস্থল কিনা তা না জেনে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া যায় না। আমি বাড়ির সামনে দিয়ে একবার হেঁটে গেলাম‌, দেখে নিলাম বাড়ির নম্বর উনিশ। তারপর একটা অন্ধকার কোণে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। মেয়ে দুটো দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে লাগল।

‘প্ৰায় চল্লিশ মিনিট পরে ভুজঙ্গধরবাবু বেরুলেন। আশেপাশে দৃকপাত না করে যে-পথে এসেছিলেন। সেই পথে ফিরে চললেন। আমি চললাম। তারপর সটান শেয়ালদা স্টেশনে তাঁকে নটা পঞ্চান্নর গাড়িতে তুলে দিয়ে আসছি।’

চায়ের পেয়ালা এক চুমুকে শেষ করিয়া ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইল। আমি বলিলাম‌, ‘তাহলে ভুজঙ্গধরবাবুর কার্যকলাপ থেকে কিছু ধরা গেল না?’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া রহিল‌, তারপর বলিল,–’কেমন যেন ধোঁকা লাগল। ভুজঙ্গধরবাবু যখন দরজা থেকে বেরুলেন তখন তাঁর পকেট থেকে কি একটা জিনিস মাটিতে পড়ল। বিনিৎ করে শব্দ হল। তিনি দেশলাই জ্বেলে সেটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিলেন। দেখলাম। একটা চাবির রিঙ‌, তাতে গোটা তিনেক বড়-বড় চাবি রয়েছে।’

‘এতে ধোঁকা লাগাবার কি আছে?’

‘হয়তো কিছু নেই‌, তবু ধোঁকা লাগছে।’

কিছুক্ষণ নীরবে কাটিবার পর বলিলাম,–’ওদিকে কী হল? সেন্ট মার্থা স্কুল?’

ব্যোমকেশ বলিল,–’দময়ন্তী দেবী মাস আষ্টেক স্কুলে যাতায়াত করেছিলেন। রোজ যেতেন না‌, ইংরেজি শেখার দিকেও খুব বেশি চাড় ছিল না। স্কুলে দু’ তিনটি পাঞ্জাবী মেয়ে পড়ত‌, তাদের সঙ্গে গল্প করতেন–’

‘পাঞ্জাবী মেয়েদের সঙ্গে?’

‘হ্যাঁ। দময়ন্তী দেবী পাঞ্জাবী ভাষা জানেন।’

এই সময়ে টেলিফোন বাজিল। ব্যোমকেশ টপ করিয়া ফোন তুলিয়া লইল,–’হ্যালো…ইন্সপেক্টর বিরাট! এত রাত্রে কী খবর?..রসিক দে ধরা পড়েছে! কোথায় ছিল.অ্যাঁ। শিয়ালদার কাছে ‘বঙ্গ বিলাসী হোটেলে! সঙ্গে টাকাকড়ি কিছু ছিল?…মাত্র ত্রিশ টাকা …আজ তাকে আপনাদের লক-আপে রাখুন‌, কাল সকালেই আমি গিয়ে হাজির হব। …আর কি! হ্যাঁ দেখুন‌, একটা ঠিকানা দিচ্ছি‌, আপনার একজন লোক পাঠিয়ে সেখানকার হালচাল সব সংগ্ৰহ করতে হবে…১৯ নম্বর মিজ লেন…হ্যাঁ‌, স্থানটা খুব পবিত্র নয়…কিন্তু সেখানে গিয়ে আলাপ জমাবার মতন লোক আপনাদের বিভাগে নিশ্চয় আছে…হাঃ হাঃ হাঃ…আচ্ছা‌, কাল সকালেই যাচ্ছি…নমস্কার।’

ফোন রাখিয়া ব্যোমকেশ বলিল,–’চল‌, আজ খেয়ে-দোয়ে শুয়ে পড়া যাক‌, কাল ভোরে উঠতে হবে।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *