Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » চিড়িয়াখানা – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 14

চিড়িয়াখানা – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

পরদিন সকালবেলা বরাট ও বিজয় আসিল। বিজয়ের পা খালি‌, অশোচের বেশ। ক্লান্তভাবে চেয়ারে বসিল।

ব্যোমকেশ বরাটের দিকে হাত বাড়াইয়া বলিল,–’কৈ‌, পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট দেখি।’

বোতাম-অ্যাটা পকেট খুলিতে খুলিতে বরাট বলিল,–’পরিষ্কার রিপোর্ট; সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া যায়নি। রক্তে কোনও বিষ বা ওষুধের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। মাথার মধ্যে হেমারেজ হয়ে মারা গেছেন।’

‘হাইপোডারমিক সিরিঞ্জের দাগ নেই?’

‘কনুইয়ের কাছে শিরের ওপর ছুচ ফোটানোর কয়েকটা দাগ আছে কিন্তু সেগুলো দু’তিন মাসের পুরানো।’

‘আর পায়ের দাগ?’

‘ডাক্তার বলেন ও—দাগের সঙ্গে মৃত্যুর কোনও সম্বন্ধ নেই।’

বরাট রিপোর্ট বাহির করিয়া দিল। ব্যোমকেশ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে তাহা পড়িল। নিশ্বাস ফেলিয়া রিপোর্ট বরাটকে ফেরত দিয়া বলিল,–’দেহে কিছু পাওয়া যাবে আমার মনে করাই অন্যায় হয়েছিল।‘

বরাট বলিল,–’তাহলে কি সোজাসুজি ব্লাড-প্রেসার থেকে মৃত্যু বলেই ধরতে হবে?

‘কখনই না। হত্যাকারী ব্লাড-প্রেসারের সুযোগ নিয়েছে‌, তাই হত্যার কোনও চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘কিন্তু—কিভাবে সুযোগ নিয়েছে বুঝতে পারছি না। আমাকে যদি তদন্ত চালাতে হয় তাহলে ধরা-ছোঁয়া যায় এমন একটা কিছু চাই তো। আপনি কাল বলেছিলেন মোজা পরার কারণ বুঝতে পেরেছেন। কী বুঝতে পেরেছেন আমায় বলুন।’

বিজয় এতক্ষণ আঙ্গুল দিয়া কপালের দুই পাশ টিপিয়া নির্জীবভাবে বসিয়াছিল‌, এখন চোখ তুলিয়া ব্যোমকেশের পানে চাহিল। ব্যোমকেশও তাহার পানে চাহিয়া একটু যেন ইতস্তত করিল। তারপর বলিল,–’সব প্রমাণ আপনাদের চোখের সামনে রয়েছে। কিছু অনুমান করতে পারছেন না?’

বরাট বলিল,–’না‌, আপনি বলুন!’

‘চড়াই পাখির বাসা মেঝোয় পড়েছিল‌, তা থেকে কিছু ধরতে পারলেন না?’

‘না।‘

ব্যোমকেশ আবার একটু ইতস্তত করিল। ‘বড় বীভৎস মৃত্যু’ বলিয়া সে বিজয়ের দিকে সসঙ্কোচে দৃষ্টিপাত করিল।

বিজয় চাপা গলায় বলিল, —‘তবু আপনি বলুন।’

ব্যোমকেশ তখন ধীরে ধীরে বলিল,–’আপনাদের বলছি‌, কিন্তু কথাটা যেন চাপা। থাকে।–নিশানাথবাবুর পায়ে দড়ি বেঁধে কড়িকাঠের আংটা থেকে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। ব্লাড-প্রেসার ছিলই‌, তার ওপর শরীরের সমস্ত রক্ত নেমে গিয়ে মাথায় চাপ দিয়েছিল। মাথার শিরা ছিঁড়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে মৃত্যু হল। তারপর তাঁকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলে। কিন্তু আমাদের ভাগ্যবশে মোজা খুলে নিয়ে যেতে ভুলে গেল। চতুর অপরাধীরাও ভুল করে‌, নইলে তাদের ধরবার উপায় থাকত না।’

আমরা স্তম্ভিত হতবাক হইয়া রহিলাম। বিজয়ের গলা দিয়া একটা বিকৃত আওয়াজ বাহির হইল। দেখিলাম‌, তাহার মুখ ছাইবৰ্ণ হইয়া গিয়াছে।

বরাট প্রথম কথা কহিল,–’কী ভয়ানক! এখন বুঝতে পারছি‌, পাছে পায়ে দড়ির দাগ হয় তাই মোজা পরিয়েছিল। আংটায় দড়ি পরাবার সময় চড়াই পাখির বাসা খসে পড়েছিল—ঘরে একটা টুল আছে‌, তাতে উঠে আংটায় দড়ি পরাবার কোনই অসুবিধা নেই। কিন্তু ব্যোমকেশবাবু্‌, একটা কথা। এত ব্যাপারেও নিশানাথবাবুর ঘুম ভাঙল না?

ব্যোমকেশ বলিল,–’নিশানাথবাবু বোধহয় জেগেই ছিলেন। রাত্রি দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে এই ব্যাপার হয়েছিল। কাল ডাক্তার পাল তাই বলেছিলেন‌, রিপোর্ট থেকেও তাই পাওয়া যাচ্ছে।’

‘তবে?’

‘জানা লোক নিশানাথবাবুকে খুন করেছে এটা তো বোঝাই যাচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম হত্যাকারী ইনজেকশন দিয়ে প্রথমে তাঁকে অজ্ঞান করে তারপর ঝুলিয়ে দিয়েছে। আজকাল এমন অনেক ইনজেকশন বেরিয়েছে যাতে দু’ মিনিটের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে যায়। অথচ রক্তের মধ্যে ওষুধের কোনও চিহ্ন থাকে না-যেমন Sodium Pentiothal. কিন্তু শরীরে যখন ছুচ ফোটানোর দাগ পাওয়া যায়নি তখন বুঝতে হবে সাবেক প্রথা অনুসারেই নিশানাথবাবুকে অজ্ঞান করা হয়েছিল।’

‘অর্থাৎ?’

‘অর্থাৎ স্যান্ড ব্যাগ। ঘাড়ের উপর মোলায়েম হাতে এক ঘা দিলেই অজ্ঞান হয়ে যাবে‌, অথচ ঘাড়ে দাগ থাকবে না।’

কিছুক্ষণ সকলে নীরব রহিলাম। তারপর বিজয় পাংশু মুখ তুলিয়া বলিল,–’কিন্তু কে? কেন?’

তাহার প্রশ্নের মর্মার্থ বুঝিয়া ব্যোমকেশ মাথা নাড়িল—’তা এখনও জানি না। আর একটা কথা বুঝতে পারছি না‌, মিসেস সেন রাত্রি দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে নিশ্চয় পাশের ঘরে ছিলেন। তিনি কিছু জানতে পারলেন না?’

বিজয় নিজের অজ্ঞাতসারে উঠিয়া দাঁড়াইল‌, স্থলিতকণ্ঠে বলিল,–’কাকিমা! না না‌, তিনি কিছু জানেন না-তিনি নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন–’

আমরা অবাক হইয়া তাহার পানে চাহিয়া আছি দেখিয়া সে আবার বসিয়া পড়িল।

ব্যোমকেশ বলিল,–’ওকথা যাক। যথা-সময়ে সব প্রশ্নেরই জবাব পাওয়া যাবে। আপাতত একটা কথা বলুন তো‌, নিশানাথবাবুর উত্তরাধিকারী কে?’

বিজয় উদভ্ৰান্তভাবে বলিল,–’আমি আর কাকিমা–সমান ভাগ।’

ব্যোমকেশ ও বরাটের মধ্যে একবার দৃষ্টি বিনিময় হইল। বরাট উঠিবার উপক্ৰম করিয়া বলিল,–’আজ তাহলে ওঠা যাক। বিজয়বাবুর এখনও অনেক কাজ‌, মৃতদেহ সৎকার করতে হবে–’

সকলে উঠিলাম। ব্যোমকেশ বলিল,–’ওবেলা আমরা একবার কলোনীতে যাব। ভাল কথা‌, রসিক দে’র খবর পাওয়া গেল?’

বরাট বলিল,–’আমি লোক লাগিয়েছি। এখনও কোনও খবর পাওয়া যায়নি।’

ব্যোমকেশ বিজয়কে জিজ্ঞাসা করিল,–’ব্ৰজদাস বাবাজী ফিরে আসেনি?’

বিজয় মাথা নাড়িল। ব্যোমকেশ বলিল,–’ইন্সপেক্টর বিরাট‌, আপনার একজন খদের বাড়ল। ব্ৰজদাসেরও খোঁজ নেবেন।’

বরাট লিখিয়া লইতে লইতে বলিল, —’ওদিকে যখন যাবেন থানায় একবার আসবেন নাকি?’

‘যাব।’

তাহারা প্ৰস্থান করিলে ব্যোমকেশ প্ৰায় আধা ঘন্টা ঘাড় গুজিয়া চেয়ারে বসিয়া রহিল। আমি দুটা সিগারেট শেষ করিবার পর নীরবতার মৌন উৎপীড়ন আর সহ্য করিতে না পারিয়া বলিলাম,–’বিজয়কে কী মনে হয়? অভিনয় করছে নাকি?’

ব্যোমকেশ ঘাড় তুলিয়া বলিল,–’এ যদি ওর অভিনয় হয়‌, তাহলে ওর মত অভিনেতা বাংলা দেশে নেই।’

‘তাহলে কাকার মৃত্যুতে সত্যি শোক পেয়েছে। কাকিমাকেও ভালবাসে মনে হল।’

‘হুঁ। এবং সেজন্যেই ওর ভয় হয়েছে।’

কিছুক্ষণ কাটিবার পর আবার প্রশ্ন করিলাম,–’আচ্ছা‌, মোটরের টুকরো পাঠানোর সঙ্গে নিশানাথবাবুর মৃত্যুর কি কোনও সম্বন্ধ আছে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘থাকতেও পারে‌, না থাকতেও পারে।’

‘লাল সিং তো দু’ বছর আগে মরে গেছে। নিশানাথবাবুকে তবে মোটরের টুকরো পাঠাচ্ছিল কে?’

‘তা জানি না। কিন্তু একটা ভুল কোরো না। মোটরের টুকরোগুলো যে নিশানাথবাবুর উদ্দেশ্যেই পাঠানো হচ্ছিল তার কোনও প্রমাণ নেই। তিনি নিজে তাই মনে করেছিলেন বটে‌, কিন্তু তা না হতেও পারে।’

‘তবে কার উদ্দেশ্যে পাঠানো হচ্ছিল?’

ব্যোমকেশ উত্তর দিল না। দুই-তিন মিনিট অপেক্ষা করিয়া যখন দেখিলাম উত্তর দিবে না‌, তখন অন্য প্রশ্ন করিলাম,–’সুনয়না-উপাখ্যানের সঙ্গে নিশানাথবাবুর মৃত্যুর যোগাযোগ আছে নাকি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘থাকলেও কিছু দেখতে পাচ্ছি না। মুরারি দত্তকে মেরেছিল সুনয়না নিকোটিন বিষ খাইয়ে। নিশানাথবাবুকে মেরেছে পুরুষ।’

‘পুরুষ?’

‘হ্যাঁ। নিশানাথবাবু লম্বা-চওড়া লোক ছিলেন না‌, তবু তাঁকে দড়ি দিয়ে কড়িকাঠ থেকে বুলিয়ে দেওয়া একজন স্ত্রীলোকের কর্ম নয়।’

‘তা বটে। কিন্তু মোটিভ কি হতে পারে?’

ব্যোমকেশ উঠিয়া আলস্য ভাঙিল।

‘আমাকে নিশানাথবাবু ডেকেছিলেন‌, এইটেই হয়তো সবচেয়ে বড় মোটিভ!’ বলিয়া সে সিগারেট ধরাইয়া স্নানঘরের দিকে চলিয়া গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *