চিড়িয়াখানা (Chiriyakhana) : 12
হাতের ঘড়ি দেখিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘সাড়ে ন’টা। এখনও পুলিস আসতে অনেক দেরি। চল একটু ঘুরে আসা যাক।’
‘কোথায় ঘুরবে?’
‘কলোনীর মধ্যেই এদিক ওদিক। এস।’
দু’জনে বাহির হইলাম। দময়ন্তী দেবীর কান্নাকাটির শব্দ এখনও থামে নাই। বিজয় কাকিমার কাছেই আছে। ভুজঙ্গধরবাবুরাও বোধহয় উপস্থিত আছেন।
আমরা সদর দরজা দিয়া বাহির হইলাম। বাঁ-হাতি পথ ধরিয়াছি, কয়েক পা। যাইবার পর একটা দৃশ্য দেখিয়া থমকিয়া গেলাম। বাড়ির এ-পাশে কয়েকটা কামিনী ফুলের ঝাড় বাড়ির দু’টি জানালাকে আংশিকভাবে আড়াল, করিয়া রাখিয়াছে। দু’টি জানালার আগেরটি নিশানাথবাবুর ঘরের জানালা, পিছনেরটি দয়মন্তী দেবীর ঘরের। দেখিলাম, দয়মন্তী দেবীর জানালার ঠিক নীচে একটি স্ত্রীলোক সম্মুখদিকে ঝুকিয়া একাগ্ৰ ভঙ্গীতে দাঁড়াইয়া আছে। আমাদের দেখিয়া সে চকিতে মুখ তুলিল এবং সরীসৃপের মত ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়া বাড়ির পিছনে অদৃশ্য হইল।
মুস্কিলের বৌ নজর বিবি।
ব্যোমকেশ ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া চাহিয়া ছিল। বলিলাম,–’দেখলে?’
ব্যোমকেশ আবার চলিতে আরম্ভ করিয়া বলিল,–’জানালায় আড়ি পেতে শুনছিল।’
‘কি মতলবে?’
‘নিছক কৌতুহল হতে পারে। মেয়েমানুষ তো! নিশানাথবাবু মারা গেছেন। অথচ ওরা বিশেষ কোনও খবর পায়নি। সরাসরি জিজ্ঞেস করবারও সাহস নেই। তাই হয়তো–’
আমার মনঃপূত হইল না। মেয়েরা কৌতুহলের বশে আড়ি পাতিয়া থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে কি শুধুই কৌতুহল?
গোেহালের সম্মুখ দিয়া যাইবার সময় দেখিলাম পানুগোপাল নিজের কুঠির পৈঠায় বসিয়া হতাশা-ভরা চক্ষে আকাশের দিকে চাহিয়া আছে। আমাদের দেখিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল, দু’ হাতে নিজের চুলের মুঠি ধরিয়া কিছু বলিতে চাহিল। তাহার ঠোঁট কাঁপিয়া উঠিল, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বাহির হইল না। তারপর সে আবার বসিয়া পড়িল। এই অসহায় মানুষটি নিশানাথবাবুর মৃত্যুতে কতখানি কাতর হইয়াছে একটি কথা না বলিয়াও তাহা প্রকাশ করিল।
আমরা দাঁড়াইলাম না, আগাইয়া চলিলাম। সামনের একটা মোড় ছাড়িয়া দ্বিতীয় মোড় ঘুরিয়া নেপালবাবুর গৃহের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম।
নেপালবাবু অধোিলঙ্গ অবস্থায় তক্তপোশে বসিয়া একটা বাঁধানো খাতায় কিছু লিখিতেছিলেন, আমাদের দেখিয়া দ্রুত খাতা বন্ধ করিয়া ফেলিলেন। চোখ পাকাইয়া আমাদের দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া অপ্ৰসন্ন স্বরে বলিলেন,–’আপনারা!’
ব্যোমকেশ ঘরে প্রবেশ করিয়া তক্তপোশের পাশে বসিল, দুঃখিত মুখে মিথ্যা কথা বলিল,–’নিশানাথবাবু চিঠি লিখে নেমস্তন্ন করেছিলেন। আজ এসে দেখি–এই ব্যাপার।’
নেপালবাবু সতর্ক চক্ষে তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া গলার মধ্যে একটা শব্দ করিলেন এবং অর্ধদগ্ধ সিগার ধরাইতে প্ৰবৃত্ত হইলেন।
ব্যোমকেশ বলিল,—’আমরা তো একেবারে ঘাবড়ে গেছি। নিশানাথবাবু এমন হঠাৎ মারা যাবেন ভাবতেই পারিনি।’
নেপালবাবু ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিলেন,–’ব্লাডুপ্রেসারের রুগী ঐভাবেই মরে। নিশানাথ বড় একগুঁয়ে ছিল, কারুর কথা শুনতো না। কতবার বলেছি—’
‘আপনার সঙ্গে তো তাঁর খুবই সদ্ভাব ছিল?’
নেপালবাবু একটু দাম লইয়া বলিলেন,–’হ্যাঁ, সদ্ভাব ছিল বৈকি। তবে ওর একগুঁয়েমির জন্যে মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটি হত।’
‘কথা কাটাকাটির কথায় মনে পড়ল। সেদিন আমাদের সামনে আপনি ওঁকে বলেছিলেন, ভাঙব নাকি হাঁটে হাঁড়ি! তা থেকে আমার মনে হয়েছিল, আপনি ওঁর জীবনের কোনও গুপ্তকথা জানেন।‘
নেপালবাবুর এবার আর একটু ভাব-পরিবর্তন হইল, তিনি সৌহৃদ্যসূচক হাসিলেন। বলিলেন,–’গুপ্তকথা! আরে না, ও আপনার কল্পনা। রাগের মাথায় যা মুখে এসেছিল বলেছিলাম, ওর কোনও মানে হয় না।–তা আপনারা এসেছেন, আজ তো এখানে খাওয়া-দাওয়ার কোন ব্যবস্থাই নেই, হবে বলেও মনে হয় না। মুকুল—আমার মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’হবারই কথা। উনিই তো প্রথম জানতে পারেন। খুবই শক লেগেছে। —আচ্ছা নেপালবাবু্, কিছু মনে করবেন না, একটা প্রশ্ন করি। আপনার মেয়ের সঙ্গে কি বিজয়বাবুর কোনও রকম—‘
নেপালবাবুর সুর আবার কড়া হইয়া উঠিল,–’কোনও রকম কী?’
‘কোনও রকম ঘনিষ্ঠতা–?’
‘কারুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করবার মেয়ে আমার নয়। তবে-প্রথম এখানে আসার কয়েকমাস পরে বিজয়ের সঙ্গে মুকুলের বিয়ের কথা তুলেছিলাম। বিজয় প্রথমটা রাজী ছিল, তারপর উলটে গেল।’ কিছুক্ষণ গুম হইয়া থাকিয়া বলিলেন,–’বিজয়টা ঘোর নির্লজ্জ।’
ব্যোমকেশ সঙ্কুচিতভাবে প্রশ্ন করিল,–’বিজয়বাবুর কি চরিত্রের দোষ আছে?’
নেপালবাবু বলিলেন,–’দোষ ছাড়া আর কি। স্বভাবের দোষ। ভাল মেয়ে ছেড়ে যারা নষ্ট-কুলটার পেছনে ঘুরে বেড়ায় তাদের কি সচ্চরিত্র বলব?’
বিজয়-মুকুলঘটিত রহস্যটি পরিষ্কার হইবার উপক্রম করিতেছিল, কিন্তু বাধা পড়িল। ভুজঙ্গাধর বাবু প্ৰবেশ করিয়া বলিলেন,–’মুকুল এখন কেমন আছে?’
নেপালবাবু বলিলেন,–যেমন ছিল তেমনি। নেতিয়ে পড়েছে মেয়েটা। তুমি একবার দেখবে?’
‘চলুন। কোথায় সে?’
‘শুয়ে আছে।’ বলিয়া নেপালবাবু তক্তপোশ হইতে উঠিলেন।
ব্যোমকেশ বলিল,–’আচ্ছা, আমরাও তাহলে উঠি!’
নেপালবাবু উত্তর দিলেন না, ভুজঙ্গধরবাবুকে লইয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন।
খাতাটা তক্তপোশের উপর পড়িয়া ছিল। ব্যোমকেশ টপ করিয়া সেটা তুলিয়া লইয়া দ্রুত পাতা উল্টাইল, তারপর খাতা যথাস্থানে রাখিয়া দিয়া বলিল,–’চল।’
বাহিরে রাস্তায় আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম,–’খাতায় কী দেখলে?’
ব্যোমকেশ বলিল,–’বিশেষ কিছু নয়। কলোনীর সকলের নামের ফিরিস্তি। তার মধ্যে পানুগোপাল আর বনলক্ষ্মীর নামের পাশে ঢ্যারা।’
‘তার মানে?’
নেপালবাবু বোধহয় কালনেমির লঙ্কাভাগ শুরু করে দিয়েছেন। ওঁর ধারণা হয়েছে উনিই এবার কলোনীর শূন্য সিংহাসনে বসবেন। পানুগোপাল আর বনলক্ষ্মীকে কলোনী থেকে তাড়াবেন, তাই তাদের নামে ঢ্যারা পড়েছে। কিন্তু ওকথা যাক, মুকুল আর বিজয়ের ব্যাপার বুঝলে?’
‘খুব স্পষ্টভাবে বুঝিনি। কী ব্যাপার?’
‘নেপালবাবুরা কলোনীতে আসার পর মুকুলের সঙ্গে বিজয়ের মাখামাখি হয়েছিল, বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল। তারপর এল। বনলক্ষ্মী। বনলক্ষ্মীকে দেখে বিজয় তার দিকে বুকল, মুকুলের সঙ্গে বিয়ে ভেঙে দিলে।’
‘ও—তাই নষ্ট-কুলটার কথা। কিন্তু বিজয়ও তো বনলক্ষ্মীর ইতিহাস জানে। প্রেম হলেও বিয়ে হবে কি করে?’
‘বিজয় যদি জেনেশুনে বিয়ে করতে চায় কে বাধা দেবে?’
‘নিশানাথবাবু নিশ্চয় বাধা দিয়েছিলেন।’
‘সম্ভব। তিনি বনলক্ষ্মীকে স্নেহ করতেন। কিন্তু তার সঙ্গে ভাইপোর বিয়ে দিতে বোধহয় প্ৰস্তুত ছিলেন না। —বড় জটিল ব্যাপার অজিত, যত দেখছি ততাই বেশি জটিল মনে হচ্ছে। নিশানাথবাবুর মৃত্যুতে অনেকেরই সুবিধা হবে।’
‘নিশানাথবাবুর মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। এ বিষয়ে তুমি নিঃসংশয়?’
‘নিঃসংশয়। তাঁর ব্লাড-প্রেসার তাঁকে পাহাড়ের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছিল, তারপর পিছন থেকে কেউ ঠেলা দিয়েছে।’
নিশানাথবাবুর বাড়িতে ফিরিয়া আসিলে বিজয় বলিল,–’কাকিমাকে ভুজঙ্গধরবাবু্, মরফিয়া ইনজেকশন দিয়েছেন। কাকিমা ঘুমিয়ে পড়েছেন।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’ভাল। ঘুম ভাঙলে অনেকটা শান্ত হবেন। ইতিমধ্যে মৃতদেহ স্থানান্তরিত করা যাবে।’