Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ঘুম ভাঙার রাত || Nihar Ranjan Gupta » Page 4

ঘুম ভাঙার রাত || Nihar Ranjan Gupta

পরের দিন নির্দিষ্ট সময়ে

পরের দিন নির্দিষ্ট সময়ে আমরা সচ্চিদানন্দ-ভবনে গিয়ে পৌঁছলাম। মহিমারঞ্জন আমাদের অপেক্ষাতেই বাইরের ঘরে ছিলেন। আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানালেন।

কিরীটী মহিমারঞ্জনকে জিজ্ঞাসা করলে, যেমন যেমন বলেছিলাম, সব ঠিক আছে তো মহিমাবাবু?

হ্যাঁ। দোতলার অফিস-ঘরেই সকলে উপস্থিত আছেন।

ঠিক আছে। আপনি তাহলে ওপরে যান। ঠিক রাত দশটায় প্রথমেই আনন্দবাবুকে কাঁচঘরে পাঠাবেন। তার মিনিট পনেরো পরে যাবেন আপনি ও মণিকাদেবী।

তাই হবে।

মহিমারঞ্জন ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।

একটু পরেই একটা গাড়ি এসে সদরে থামল। কিরীটী বললে, ওঁরা বোধ হয় এলেন।

কিরীটী দরজা-পথে বের হয়ে গেল এবং একটু পরেই বলীন সোম, সুশীল রায় ও সর্বাঙ্গে চাদর আবৃত কে একজন সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে এসে প্রবেশ করলেন।

সকলে আমরা অতঃপর সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম। এবং দোতলা অতিক্রম করে সোজা একেবারে সিঁড়ি দিয়ে উঠে তিনতলার কাঁচঘরে গিয়ে প্রবেশ করলাম।

কাঁচঘরের মধ্যে একটা স্বল্প শক্তির বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলছে। চারিদিকে অর্কিড গাছ তার উপরে সেই স্বল্পালোক পড়ে কেমন যেন একটা বিচিত্র আলো-ছায়ার সৃষ্টি করেছে।

গা-টার মধ্যে কেমন যেন ছমছম করে।

এদিক-ওদিক প্রত্যেককে পৃথক পৃথক ভাবে দাঁড়াবার নির্দেশ দিল কিরীটী, কেবল সর্বাঙ্গ চাদরে আবৃত ভদ্রলোককে বসাল নিয়ে গিয়ে বেঞ্চটার উপরে।

গা থেকে চাদরটা সরাতেই সেই মৃদু আলোকে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে যেন চমকে উঠলাম, কে?

অবিকল হুবহু সচ্চিদানন্দ সান্যাল যেন।

কি রে, চিনতে পেরেছিস সচ্চিদানন্দ সান্যালকে, সুব্রত?

বিস্ময়ে যেন আমার বাকরোধ হয়ে গিয়েছিল। এমন নিখুঁত মেকআপ যে, সত্যিই বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। এবং এতক্ষণে যেন কিরীটীর পরিকল্পনাটা আমার কাছে সবটাই পরিষ্কার হয়ে আসে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, আর পাঁচ মিনিট আছে। এইবার আনন্দবাবু আসবেন সুব্রত। চল, আমরা ঐ লতানো অর্কিডটার পিছনে গিয়ে দাঁড়াই।

আমরা লতানো অর্কিডের পিছনে গিয়ে আত্মগোপন করে অপেক্ষা করতে লাগলাম। স্তিমিতালোকিত কাঁচঘরের মধ্যে একটা অদ্ভুত স্তব্ধতা ঘনিয়ে আসে। এক একটা মুহূর্ত যেন এক একটা যুগ বলে মনে হয়। তারপর একসময় পায়ের শব্দ শোনা গেল। বুঝলাম আনন্দ সান্যাল প্রবেশ করছেন কাঁচঘরে। পায়ের শব্দ এগিয়ে চলেছে বেঞ্চের দিকে।

হঠাৎ পদশব্দ থেমে গেল। তারপরই একটা অর্ধস্ফুট চীৎকার: কে? কে ওখানে? এবং সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুত পদবিক্ষেপে আনন্দ সান্যাল ফিরে যাবার চেষ্টা করতেই কিরীটী সামনে এগিয়ে বিদ্যুৎগতিতে তার পথরোধ করে দাঁড়াল, দাঁড়ান আনন্দবাবু!

না না, কে–কে তুমি? প্রবল কণ্ঠে প্রতিবাদ জানায় আনন্দ সান্যাল।

কিরীটীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে আনন্দবাবু যেন কতকটা ধাতস্থ হয়। ফ্যালফ্যাল করে ওর মুখের দিকে তাকাল। কিছুটা ধাতস্থ হলেও তখনও পুরোপুরিভাবে সে যেন আকস্মিক পরিস্থিতিটা সম্যক উপলব্ধি করতে পারেনি!

আনন্দবাবু!

কিন্তু ওখানে কে? কে ওখানে বেঞ্চের ওপরে বসে আছেন?

আপনার কাকার প্রেতাত্মা। বজ্রকঠিন কণ্ঠে যেন কিরীটী জবাব দেয়।

প্রেতাত্মা! বোকার মতই প্রশ্নটা করে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় আনন্দ সান্যাল।

হ্যাঁ। এমনি করে প্রতি রাত্রে উনি ওখানে এসে বসেন তাঁর হত্যাকারীর প্রতীক্ষ্ণয়। এখন বুঝতে পারছেন তো হত্যাকারীকে ধরা দিতেই হবে।

কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন—বিশ্বাস করুন কিরীটীবাবু, আমি—আমি কাকাকে হত্যা করিনি।

তা আমি জানি। কিন্তু সে-রাত্রে নিশ্চয়ই টের পেয়েছিলেন, বারান্দা দিয়ে কে হেঁটে গিয়েছিল?

না, না, আপনি বিশ্বাস করুন—

কিন্তু আপনি যে মরীচিকার পিছনে ছুটছেন, তা কি জানেন?

মরীচিকা?

হ্যাঁ।

ঠিক এমনি সময়ে একসঙ্গে দুজোড়া পদশব্দ শুনতে পাওয়া গেল। কাঁচঘরের দিকেই এগিয়ে আসছে সে পদশব্দ।

চুপ। এপাশে সরে দাঁড়ান।

কথাটা বলে সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটী যেন আনন্দবাবুকে একপ্রকার জোর করে টেনেই আমাদের পিছনে পূর্বের জায়গায় এসে দাঁড়াল।

অস্পষ্ট আলোতে চোখে পড়ল, মহিমারঞ্জন ও তাঁর পিছনে মণিকাদেবী এগিয়ে আসছেন।

এবং তাঁরাও বেঞ্চের কাছাকাছি এসে আনন্দবাবুর মতই ভুল করে থমকে দাঁড়ালেন: কে? কে? যুগপৎ একই সময়ে দুজনার কণ্ঠ থেকে প্রশ্নটা নির্গত হয়, কে? কে?

আর ঠিক সেই মুহূর্তে দপ করে কাঁচঘরের একটিমাত্র আলো নিভে গেল। নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে মুহূর্তে সমস্ত কাঁচঘরটা থমথমে হয়ে উঠল।

এবং মুহূর্ত পরে যেই আলোটা আবার জ্বলে উঠল, দেখলাম ক্ষণপূর্বে সামনের বেঞ্চে সচ্চিদানন্দবাবুর প্রতিকৃতির মেকআপ নিয়ে যে সরলবাবু বসেছিলেন, তিনি তখন আর সেখানে নেই। বেঞ্চ খালি।

হতভম্ব নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে মহিমারঞ্জন ও মণিকাদেবী।

কিরীটী এগিয়ে গেল এবারে। ডাকল, মহিমাবাবু?

কিরীটীর ডাকে মহিমাবাবু ফিরে তাকালেন, কে?

একটু আগে কিছু বেঞ্চের ওপরে দেখলেন?

হ্যাঁ। নিম্নকণ্ঠে জবাব এল।

এখন বুঝতে পারছেন বোধ হয় সচ্চিদানন্দবাবু মারা যাননি?

কি বলছেন আপনি কিরীটীবাবু? বিস্ময়-বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকালেন মহিমারঞ্জন প্রশ্নটা করে কিরীটীর মুখের দিকে।

ঠিকই বলছি। তিনি আজও বেঁচে আছেন। এবং আপনারা দুজনেই যে আপনাদের জবানবন্দিতে সেদিন অনেক সত্য কথাই গোপন করে গিয়েছিলেন, তাও আমরা জানি।

এমনি অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে জীবনে আগে কখনও মহিমারঞ্জন বা মণিকাদেবী হয়তো পড়েননি। তাঁরা যেন একেবারে বিস্ময়ে বোবা বনে গিয়েছেন।

এখন বলবেন কি মহিমাবাবু, সে-রাত্রে আপনার পাশের ঘরে কার সঙ্গে সচ্চিদানন্দবাবুকে কথা বলতে শুনেছিলেন?

মহিমারঞ্জন নির্বাক।

তাহলে সুব্রত, নিচে যা–মিসেস্ সান্যালকে ডেকে আন।

সহসা আর্তকষ্ঠে মণিকাদেবী প্রতিবাদ জানালে, না-না তাঁকে কেন? তাঁকে নয়!

সুব্রত, যা—

আমি এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে।

.

রাধারাণীদেবীকে সঙ্গে করে ফিরে এলাম কাঁচঘরে।

এসে দেখি, পূর্ববৎ দাঁড়িয়ে আছেন মণিকাদেবী ও মহিমারঞ্জন এবং আনন্দবাবুও তাঁদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন।

আসুন মিসেস্ সান্যাল, বসুন।

নিঃশব্দে রাধারাণী এগিয়ে গিয়ে বেঞ্চের উপরে বসলেন। চোখে তাঁর সেই অসহায় দৃষ্টি।

সচ্চিদানন্দবাবু বের হয়ে আসুন।

কিরীটীর ডাকে সরলবাবু আবার যন্ত্রচালিতের মতই আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর কোন দিকে দৃষ্টিপাত না করে রাধারাণীর একটু কাছে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ যেন বৈদ্যুতিকশখাওয়ার মতই চমকেসম্মুখেদণ্ডায়মানসচ্চিদানন্দবেশীসরলবাবুর দিকে তাকালেন রাধারাণী।

চিনতে পারছেন ওঁকে রাধারাণীদেবী? ভালকরে চেয়ে দেখুন–দেখুন—

স্থির অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন রাধারাণী সরলবাবুর মুখের দিকে। কাঁচঘরের মৃদু আলোকেও তাঁর মুখের প্রত্যেকটি রেখা যেন পড়তে পারছি। কুঞ্চিত কপাল, স্থির পাথরের মত দুটি চক্ষুর তারা। গলার শিরা দুটো ফুলে উঠেছে।

ক্রমে সমস্ত শরীরটা তাঁর যেন মৃদু মৃদু কাঁপতে শুরু করে।

রাধারাণী! এই সর্বপ্রথম মূক অভিনয়ের মধ্যে সরলবাবু কথা বললেন কতকটা চাপা গলায়।

বার-দুই সমস্ত শরীরটা কেঁপে উঠল রাধারাণীর বেত-লতার মত।

তারপরই তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার করে রাধারাণী বেঞ্চটার উপরে টলে পড়লেন। কিরীটী প্রস্তুতই ছিল। ক্ষিপ্রপদে এগিয়ে গিয়ে রাধারাণীকে ধরে বেঞ্চটার উপরে শুইয়ে দিলে।

রাধারাণীর তখন আর জ্ঞান নেই!

সরলবাবুকে পুনর্বার চোখের ইঙ্গিত করতেই কিরীটী তিনি সোজা এবারে কাঁচঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

.

চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিতে দিতে প্রায় পনেরো মিনিট পরে রাধারাণী চোখ মেললেন। মিসেস্ সান্যাল! স্নিগ্ধ কণ্ঠে ডাকল কিরীটী।

একটা দীর্ঘশ্বাস রাধারাণীর বুকটা কাঁপিয়ে বের হয়ে এল শুনতে পেলাম। চারপাশে আমরা নির্বাক স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে।

উঠে বসবার চেষ্টা করলেন রাধারাণী। কিরীটী বাধা দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই দৃঢ় শান্ত পদে মণিকা এগিয়ে গেল রাধারাণীর কাছে।

কিন্তু রাধারাণী মণিকার দিকে তাকিয়েই তীক্ষ্ণ বিরক্তিভরা কণ্ঠে বলে উঠলেন, ছুঁস না—ছুঁস না তুই আমাকে!

থমকে দাঁড়িয়ে গেল মণিকা।

মুখ নীচু করে কয়েকটা মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে মুখ তুলে কিরীটীর দিকে তাকাল, কিরীটীবাবু!

বলুন।

আমার কিছু কথা ছিল আপনাকে বলবার।

বলুন।

না, এখানে নয়। অনুগ্রহ করে যদি নীচে আমার ঘরে আসেন।

এক মুহূর্ত কি যেন ভাবল কিরীটী। তারপর মৃদু কণ্ঠে বললে, বেশ, তাই চলুন।

সুশীলবাবু, বলীনবাবু আপনারা এখানে অপেক্ষা করুন। আমি শুনে আসি, উনি কি বলতে চান।

কিরীটী ও মণিকা কাঁচঘর থেকে বের হয়ে গেল।

.

পরে কিরীটীর মুখে শুনেছিলাম, কি বলেছিল মণিকা সে-রাত্রে তাকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে।

যেমন যেমন বলেছিল তেমনি বলে যাচ্ছি।

ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে মণিকা কিরীটীকে বললে, বসুন মিঃ রায়।

কিরীটী ঘরের একটিমাত্র চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।

কি ভাবে আমার বক্তব্য শুরু করব বুঝতে পারছি না—একটু ইতস্তত করে মণিকা বলে।

যেখান থেকে যেভাবে বললে আপনার সুবিধা হয় সেইভাবেই বলুন।

একটা দীর্ঘশ্বাস মণিকার বুকটা কাঁপিয়ে বের হয়ে গেল।

হ্যাঁ, বলতে আমাকে হবেই। আর কোন কথা গোপন করলে চলবে না। কারণ আমি না বললেও আর একজন বেঁচে আছে—সে বলবেই। কিন্তু পাছে সে সব সত্য কথা না বলে, তাই আমিই বলব স্থির করেছি।

মণিকার স্থির বিশ্বাস হয়েছিল সচ্চিদানন্দ বেঁচেই আছেন।

সব কথা সেদিন আপনাকে আমি বলিনি, তার কারণ রাধারাণীকেই আমি বাঁচাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারও আর যখন কোন প্রয়োজন নেই, তখন সত্যি কথা যা আপনাকে তা বলব। তারপর একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে, জানি না কতদিনের আলাপ আপনার সচ্চিদানন্দর সঙ্গে, ওকে আপনি কতটুকু চেনেন জানি না, তবে আমি চিনি। ও মানুষ নয়, মানুষের শরীরে আস্ত একটা শয়তান! এ দুনিয়ায় ওর অসাধ্য কাজ কিছু ছিল না। অনেক সময় স্বার্থের জন্য মানুষ অনেক জঘন্য কাজ করে, কিন্তু বিনা স্বার্থে কেবলমাত্র স্বভাবে ও পারে না এমন কোন নীচ বা জঘন্য কাজ নেই।

কথা বলতে বলতে কি অবিমিশ্র ঘৃণাই না ঝরে পড়ছিল মণিকার কণ্ঠস্বরে।

ওর প্রথম স্ত্রীর কথা জানেন কি?

হ্যাঁ, শুনেছি ওঁর মুখেই। বিবাহের পর মাত্র বছর তিনেক বেঁচে ছিলেন, তারপর মারা যান।

বিকৃত একটা ঘৃণার হাসি ফুটে ওঠে মণিকার ওষ্ঠপ্রান্তে, মারা গেছে! তাই বলেছিল বুঝি?

হ্যাঁ।

তা এক পক্ষে মিথ্যা বলেনি। মৃত্যুই বৈকি! মৃত্যু ছাড়া আর কি! তারপর একটু থেমে আবার বললে, আর শিবাণী? শিবাণীর কথা কিছু বলেনি?

বলেছিলেন তাঁর এক বন্ধুর মেয়ে—

আপনি সে-কথা বিশ্বাস করেছিলেন?

না।

না? কিন্তু কেন বলুন তো?

আপনার শিবানী পরিচয়টা যেমন বিশ্বাস করিনি, তেমনি তাঁর সে-কথাও বিশ্বাস করিনি।

কেন? আমার শিবানী পরিচয়টা আপনি বিশ্বাস করেননি কেন?

তার কারণ সত্যিকারের শিবানী আপনি নন বলে।

কে বললে আমি সত্যিকারের শিবানী নই?

এতদিন সংশয় থাকলেও প্রমাণ পাইনি, তবে গত পরশু সকালে সে-প্রমাণও আমি পেয়েছি।

প্রমাণ পেয়েছেন! কি প্রমাণ?

আপনার ও সত্যিকারের শিবানীর লেখা চিঠি দুখানা দেখে। যদিও দীর্ঘ বৎসরের ব্যবধানে লেখা দুখানা চিঠি, তথাপি হাতের লেখার মধ্যে প্রচুর পার্থক্য ছিল। মানুষের হাতের লেখা বদলায়, কিন্তু ঢংটা একেবারে বদলায় না। এবং দুটো চিঠিই handwriting expert-কে দিয়ে বিচার করিয়েছি আমি। তারও অভিমত, দুটো চিঠি কদাপি এক হাতের লেখা নয়।

তাহলে আমি কে?

আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে আপনার আসল নাম সুধা!

সুধা? কেমন করে জানলেন আপনি! চমকে প্রশ্ন করে মণিকা।

কিরীটী মৃদু হেসে জবাব দেয়, সেও বলতে পারেন আমার অনুমান। এবং আরো একটা অনুমান যদি আমার মিথ্যা না হয়ে থাকে তো আপনারই মেয়ের নাম শিবানী।

অতঃপর মণিকা স্তব্ধ বিস্ময়ে কয়েক মুহূর্ত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিরীটীর মুখের দিকে। তারপর মৃদুকণ্ঠে বলে, আপনার কথাই ঠিক। শিবানী আমারই মেয়ে। আমিই তার হতভাগিনী মা।

আপনার যদি আপত্তি না থাকে তো সব কথা আমাকে খুলে বলুন সুধা দেবী। কিরীটী মৃদু কষ্ঠে অনুরোধ জানায়।

বলব। আর বলব বলেই তো আপনাকে ডেকে আনলাম। ওর মুখে নিশ্চয়ই যতীন চাটুয্যের নাম শুনেছেন আপনি?

শুনেছি।

তিনিই আমার আপন সহোদর ভাই। আমি তাঁর একমাত্র বোন। গ্রামে আমাদের বাড়ি। আমার দুর্ভাগ্যের সুত্রপাত হয় আমাদের গ্রামেই।

.

বছর চোদ্দ-পনের বয়স তখন সুধার।

একদিন সন্ধ্যার সময় নদীর ঘাট থেকে সুধা যখন জল নিয়ে ফিরছে, হঠাৎ একদল মুসলমান এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়।

তারপর তিনদিন ধরে তার দেহের উপর দিয়ে চলে অকথ্য অত্যাচার। এবং সে অত্যাচার সুধা সহ্য করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত অজ্ঞান হয়ে যায়।

জ্ঞান হবার পর দেখলে, একটা পাটক্ষেতের মধ্যে সে পড়ে আছে। সর্বাঙ্গে বেদনা। পরের দিন প্রত্যুষে এক চাষা তাকে ঐ অবস্থায় ক্ষেতের মধ্যে দেখতে পেয়ে বুকে করে তুলে এনে তার নিজের ঘরে তোলে।

এদিকে সুধার দাদা সর্বত্র পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছে তখন তার বোনকে।

চাষী ও চাষী-বৌ ওকে অনেক করে সুস্থ করে তোলে এবং সাতদিনের দিন সেই চাষীটাই গিয়ে সঙ্গে করে পৌঁছে দিল সুধাকে তার দাদার ঘরে।

কিন্তু বৌদি বললেন, তাকে আর ঘরে স্থান দেওয়া যেতে পারে না। ধর্ষিতা মেয়ে, তার জাত-ধর্ম নেই। শুধু বৌদিই নয়, গ্রামের মাতব্বররাও একসঙ্গে সেই কথা বললেন।

যতীন কিন্তু সম্মত হতে পারলেন না তাঁদের বিচারে।

তিনি বললেন, দোষ তো ওর নয়। দোষ আমাদের সমাজব্যবস্থার। দোষ আমার নিজের। কেন আমি পারিনি আমার বয়স্থা বোনকে রক্ষা করতে? আমাদের অপরাধে ও কেন শাস্তি পাবে?

একবাক্যে সকলেই তখন বললেন, এ তুমি কি বলছ যতীন?

ঠিকই বলছি। ঘর আমার শক্ত ছিল না, সেই সুযোগে চোর ঘরে সিঁধ কেটেছে। সেক্ষেত্রে কেবল চোরকেই দোষ দিলে হবে কেন? আমারও দোষ আছে এবং শাস্তি যদি কারো প্রাপ্য থাকে সে আমারই।

তাহলে তুমি কি করতে চাও শুনি? মাতব্বররা জিজ্ঞাসা করলেন।

ওকে আমি ত্যাগ করতে পারব না।

কি বলছ তুমি যতীন? তোমার কি মাথা খারাপ হল?

তা যা বলেন, মোদ্দা কথা আমার বোনকে আমি ত্যাগ করতে পারব না।

ঐ ম্লেচ্ছ কর্তৃক অপহৃতা ধর্মচ্যুতাকে তুমি ঘরে স্থান দেবে? এই তাহলে তোমার শেষ কথা যতীন?

হ্যাঁ কাকা, এই আমার শেষ কথা। ওকে আমি ত্যাগ করতে পারব না বিনা দোষে।

বিনা দোষে?

নিশ্চয়ই। ওর উপরে যে অত্যাচার হয়েছে, তার মধ্যে ওর অপরাধটা কোথায়?

তোমাকে আমরা একঘরে করব।

করবেন।

এ গ্রাম ছাড়তে হবে তোমাকে।

সে আপনাদের বলবার আগেই স্থির করে রেখেছি। অতঃপর আর যেখানেই বাস করি, এখানে আর বাস করা যে চলবে না আমার তা আমি জানি।

যতীন, এখনও ব্যাপারটা আর একবার ভেবে দেখ। এ গোঁয়ারতুমির ব্যাপার নয়।

মিথ্যে আপনি কথা বাড়াচ্ছেন কাকা। আমি আমার কর্তব্য স্থির করে রেখেছি ওকে ফিরে পাবার সঙ্গে-সঙ্গেই।

.

স্ত্রী ও বোনকে নিয়ে যতীন গ্রাম ত্যাগ করলেন। শহরে এসে বাসা বাঁধলেন। শিক্ষকতার কাজ নিলেন সেখানকার স্কুলে। সে স্কুলের সেক্রেটারী ছিলেন সচ্চিদানন্দবাবুর বাবার এক বন্ধু। এবং যতীনের সৎসাহসের প্রশংসা করে নিজেই তিনি বন্ধুকে বলে তাঁর স্কুলে পুত্রের বন্ধু যতীনকে চাকরি দিয়ে আশ্রয় দিলেন।

এই সময় থেকেই সচ্চিদানন্দর সঙ্গে যতীনের মেলামেশাটা একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে নতুন করে। সচ্চিদানন্দ ঘন ঘন যাতায়াত করতে লাগলেন যতীনের গৃহে। কিন্তু ঐ ঘনঘন যাতায়াতের মধ্যে ছিল বন্ধুপ্রীতির চাইতেও বন্ধুর ভগ্নীর উপরে প্রীতিটাই বেশী। যদিচ যতীন সেটা বুঝতে পারেননি। এদিকে যতীন দু-চার জায়গায় ভগ্নীর বিবাহ দেবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হতে লাগলেন। গ্রাম ত্যাগ করে এলেও দেখলেন কলঙ্ক তাঁকে ত্যাগ করেনি। আর ভগ্নীকে নিজগৃহে স্থান দিলেও স্ত্রী পরিচয়ে অন্য কেউই তাকে তাদের গৃহে স্থান দিতে রাজী নয়।

এমন সময় সচ্চিদানন্দ একদিন বন্ধুকে বললেন, যতীনের যদি অমত না থাকে তো সে সুধাকে বিবাহ করতে রাজী আছে।

এ প্রস্তাব শুধু অভাবিতই নয়, অবিশ্বাস্য সৌভাগ্য। দুহাতে যতীন সচ্চিদানন্দের দুটি হাত ধরে বললেন, সত্যি বলছ ভাই?

হ্যাঁ যদি তুমি রাজী থাক।

রাজী! কি বলছ তুমি? সুধা যদি তোমার পায়ে স্থান পায় তো জানবসে সত্যিই ভাগ্যবতী!

কিন্তু এর মধ্যে একটা কথা আছে সচ্চিদানন্দ বললেন।

কথা!

হ্যাঁ, সুধাকে আমি বিবাহ করব বটে, তবে জানই তো আমি বাবার অমতে বিবাহ করলে তিনি জীবনে আমাকে ক্ষমা করবেন না। তাই মনে করেছি, সকলকে জানাজানি করে নয়, কলকাতায় নিয়ে গিয়ে গোপনে ওকে আমি বিবাহ করব। তারপর একদিন ধীরে-সুস্থে বাবাকে জানালেই হবে সব কথা।

কিন্তু ভাই–যতীন ইতস্তত করে।

সচ্চিদানন্দ বলে, তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না?

না ভাই, তা নয়। তবে—

কিছু ভেবো না তুমি।

চিরদিনের সরলপ্রকৃতির যতীন মানুষের প্যাঁচোয়া মনের কথা জানবেন কি করে! বিশেষ করে সচ্চিদানন্দ তাঁর একপ্রকার বাল্যবন্ধু।

স্ত্রী নারায়ণী একটুও কিন্তু বাধা দিলেন না। এত বড় একটা আপদ যদি সহজে ঘাড় থেকে নেমে যায় তো যাক না!

সুধা তো রাজী ছিলই। সমস্ত প্রাণ দিয়ে যে হতভাগিনী সুধা সচ্চিদানন্দকে ভালবেসেছিল!

তারপর একদিন কলকাতায় গঙ্গাস্নানে যাবার নাম করে সচ্চিদানন্দর হাতে নিশ্চিন্তে তুলে দিয়ে এলেন যতীন সুধাকে।

ফিরে এসে রটিয়ে দিলেন, বর্ধমানে সে তার মাসীর বাড়িতে রয়ে গেল!

শহরের বাসিন্দারা এ ব্যাপার নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাল না।

সুধাকে সচ্চিদানন্দর হাতে তুলে দিয়ে আসবার পর দীর্ঘ আট মাস যতীন কোন খবরই আর তাদের পেলেন না।

দীর্ঘ এক বছর আট মাস পরে এলাহাবাদ থেকে সচ্চিদানন্দের এক চিঠি পেলেন যতীন, তার স্ত্রী সুধা মাত্র তিন দিনের জ্বরে মারা গিয়েছে একটি পাঁচ মাসের শিশুকন্যা রেখে। কন্যাটিকে নিয়ে সত্যিই সে একা বড় বিব্রত হয়ে পড়েছে অথচ বাবা তার বিবাহের সংবাদ পেয়ে তাকে ইতিমধ্যে ত্যাজ্যপুত্র করতে মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ তার স্ত্রী-বিয়োগ হওয়ায় এবং তার স্ত্রীর কোন সন্তানাদি নেই শুনে ক্ষমা করেছেন। তাই এখন যদি ব্যাপারটা গোপন রেখে তার পিতার জীবিতকাল পর্যন্ত তার কন্যাটিকে নিজের সন্তান বলে প্রতিপালন করে তো সকল দিক রক্ষা হয়। সে অবশ্য আর বিবাহ করবে না এবং তার একমাত্র সন্তান শিবানী যাতে তার পিতৃ-সম্পত্তি হতে বঞ্চিত না হয়, সেই কারণেই সে শিবানীকে আপাতত তাদের কাছে রাখতে চায় তাদের সন্তান পরিচয়ে। অবশ্য কন্যার ভরণপোষণের সমস্ত খরচা সেই বহন করবে, মাসে মাসে তিনশো করে টাকা পাঠাবে রেজিস্ট্রী করে তার নামে।

সচ্চিদানন্দর এ প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান জানাতে পারলেন না যতীন। আহা, সুধার মাতৃহারা সন্তান!

সুধার কন্যাটিকে তিনি সন্তান-পরিচয়ে নিতে রাজী আছেন জানালেন, কিন্তু তার পরিবর্তে ভরণপোষণ বাবদ কোন টাকাই তিনি নিতেই পারবেন না জানিয়ে দিলেন। সুধার সন্তান তো তাঁরই সন্তান।

যতীন ও নারায়ণী এক বৎসরের জন্যে কাশীতে গিয়ে রইলেন। সেই সময়েই সচ্চিদানন্দ শিবানীকে তাঁদের হাতে তুলে দিয়ে গেলেন।

এবং চোখের জলের ভিতর দিয়ে বার বার অনুরোধ জানিয়ে গেলেন, টাকা না নিলে সে বড় ব্যথা পাবে। আর তাছাড়া টাকা তো সে অন্য কাউকে দিচ্ছে না, দিচ্ছে তার নিজের সন্তানের ভরণপোষণের জন্যেই। সে-টাকায় শিবানীর যে সত্যিকারের ন্যায্য অধিকার আছে।

কি করেন, যতীনকে রাজী হতেই হল শেষ পর্যন্ত।

মায়ের দুধ না পাওয়ায় শিবানী একটু রোগাই ছিল, তাই দেড় বছরের শিশুঁকে নিয়ে প্রায় এক বছর সাত মাস বাদে যতীন সস্ত্রীক যখন শহরে ফিরে এলেন, লোকে জানল শিবানী তাঁদেরই সন্তান এবং সেই পরিচয়েই শিবানী তার মামা-মামীর কাছে মানুষ হতে লাগল।

মাসে মাসে নিয়মিত সাত তারিখে সচ্চিদানন্দর নিকট হতে তিনশো করে টাকা রেজিস্টার্ড কভারে করে আসতে লাগল যতীনের নামে।

কিন্তু তিন বছরও গেল না, যতীন সংবাদ পেলেন সচ্চিদানন্দ আবার বিবাহ করেছেন। সংবাদটা পেয়ে তিনি দুঃখ পেলেন না, কেবল একটু হাসলেন।

শিবানী তাঁদের কাছেই কন্যা-পরিচয়ে মানুষ হতে লাগল।

.

কিন্তু সুধা কি সত্যিই মারা যায়নি?

না।

তবে?

আসলে কোন দিনও সে সুধাকে বিয়ে করেনি।

বিয়ে করেনি!

না, সুধাকে নিয়ে এসে সচ্চিদানন্দ চেতলায় একটা বাড়িভাড়া নিলেন এবং প্রথম থেকেই সুধাকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মত বসবাস করতে লাগলেন।

সুধা বিবাহের কথা তুললেই নানা অজুহাতে কালক্ষেপ করতে লাগলেন সচ্চিদানন্দ।

সুধা যখন বুঝতে পারল, সচ্চিদানন্দ কোনদিনই তাকে বিবাহ করে স্ত্রীর সম্মান দেবে এবং এভাবেই তাকে তার রক্ষিতা হয়ে থাকতে হবে, তখন সে মা হতে চলেছে।

শিবানী তার গর্ভে তখন। পাঁচ মাস।

সুধা স্পষ্টই বুঝতে পারলে, ধনী-সন্তান সচ্চিদানন্দ প্রেমের অভিনয়ে তাকে ভুলিয়ে তার সর্বনাশই করেছে। কোনদিনই তাকে সে বিবাহ করবে না। সে চিরদিনই সচ্চিদানন্দের রক্ষিতা হয়েই থাকবে।

আক্রোশে ও আকণ্ঠ ঘৃণায় তখন তার অন্তরাত্মা যেন পাথর হয়ে গেল।

এবং সেই মুহূর্ত থেকেই সর্বতোভাবে সচ্চিদানন্দকে সুধা এড়িয়ে চলতে লাগল। পালাবার ইচ্ছা থাকলেও কিন্তু সুধা সচ্চিদানন্দের আশ্রয় হতে পালাতে পারল না। গর্ভে তার সন্তান। আক্রোশ শুধু তার সচ্চিদানন্দের উপরেই নয়, তার গর্ভের অনাগত সন্তানের উপরেও বিতৃষ্ণায় মন তার ভরে গেল। ঐ শয়তানটারই আত্মজ তার গর্ভে!

যথাসময়ে শিবানী ভূমিষ্ঠ হল। কিন্তু তিল তিল করে যে ঘৃণা ও আক্রোশ পিতা ও তার আত্মজের উপরে সুধার মনের মধ্যে পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছিল, তাতে সে ফিরেও তাকালে না নিজের গর্ভের সন্তানের দিকে।

এবং সন্তানের জন্মের পর থেকেই সুধা সুযোগ খুঁজতে লাগল সচ্চিদানন্দর আশ্রয় ত্যাগ করে চলে যাবার জন্যে।

সুধার শরীরটাও খারাপ যাচ্ছিল। সচ্চিদানন্দ কন্যা ও সুধাকে নিয়ে এলাহাবাদ গেলেন।

এলাহাবাদ পোঁছবার দিনতিনেক বাদেই এক রাত্রে সুধা সচ্চিদানন্দর গৃহ ত্যাগ করে চলে গেল।

চার মাস এলাহাবাদে থেকে সচ্চিদানন্দ সর্বত্র খুঁজলেন সুধাকে কিন্তু তার কোন সন্ধানই পেলেন না। অবশেষে হতাশ হয়ে পত্র দিলেন যতীনকে।

.

কিন্তু কোথায় গেল সুধা!

ভরা যৌবন! গা-ভরা রূপ! কোথায় যাবে এখন সুধা।

স্টেশনে এসে কলকাতার একখানা টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে বসল সুধা।

গাড়িতেই এক মুসলমান সেতারীর সঙ্গে আলাপ হল। সুধার বয়সী একটি মেয়ে ছিল ওস্তাদ মেহেরা খাঁর। বছর দুই আগে সেই মেয়ে জুবেদা মারা গিয়েছে। সেই মৃতা জুবেদার হারানো মুখখানিই যেন খুঁজে পেলেন ওস্তাদজী কুড়িয়ে পাওয়া সুধার মুখের মধ্যে।

সুধাকে নিরাশ্রয় জেনে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে তুললেন মেহেরা খাঁ। সুধা তার নাম বলেছিল রেখা, আসল নাম গোপন করে।

সুধা পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, এল রেখা।

মেহেরা খাঁর যত্নে ও চেষ্টায় সুধা গীত-বাদ্যে পারদর্শিনী হয়ে উঠতে লাগল ক্রমে ক্রমে এবং তার মধ্যেই খুঁজে পেল তার দুঃখের সান্ত্বনা।

সুধা তার অতীত জীবনকে পুরোপুরিই ভুলেছিল, কেবল ভুলতে পারে নি একখানি কচি নিষ্পাপ শিশুর মুখ যাকে সে ঘৃণাভরে ফেলে চলে এসেছিল।

অবসর সময়ে তো বটেই, কাজের মধ্যেও থেকে থেকে সহসা একখানি কচি মুখ যেন মনের মাঝখানে ভেসে উঠত। যেন অদৃশ্য দুটি কচি বাহু কণ্ঠ বেষ্টন করে ধরত। হঠাৎ আনমনা হয়ে পড়ত রেখা। হয়ত সেতার বাজাতে বাজাতে তাল কেটে গেল, সেই কচি মুখখানা মনের মধ্যে ভেসে উঠেছে।

মেহেরা খাঁ জিজ্ঞাসা করত, কি হল বেটি?

কিছু না আব্বাজান।

দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে গেল। মধ্যে মধ্যে রেখার মনে হয়, এখন হয়ত সে নরম তুলতুলে দুটি পা ফেলে এ-ঘর ও-ঘর করে বেড়াচ্ছে। আবো-আধো ভাষা ফুটেছে মুখে। কতদিন ঘুমের ঘোেরে স্বপ্নে মনে হয়েছে, কচি কচি দুটি হাত যেন তার গলাটা জড়িয়ে ধরে ডাকছে সুধাঝরা কঠে, মা! মাগো! আমার মা-মণি!

ঘুম ভেঙে গেছে। চিৎকার করে উঠেছে হয়ত সুধা, খুকী–সোনামণি আমার!

কিন্তু কোথায় খুকী! শূন্য অন্ধকার ঘর।

ভরা যৌবন সুধার। রূপ যেন দেহে ধরে না। মেহেরা খাঁর গৃহে বহু গুণী-জ্ঞানীর পদার্পণ ঘটে, কিন্তু সুধা কোন পুরুষের সামনেই আর বের হয় না।

সচ্চিদানন্দ তার সমস্ত বুকে ভরে দিয়েছেযেন সমগ্র পুরুষ জাতটার উপরেই একটা অবিমিশ্র ঘৃণা। একটা সুকঠিন বিতৃষ্ণা।

পুরুষের ছায়ামাত্র দেখলেও যেন ঘৃণায় তার শরীর সঙ্কুচিত হয়ে ওঠে। কোন পুরুষকেই সে সহ্য করতে পারে না।

দীর্ঘ মোল বৎসর মেহেরা খাঁর গৃহেই কেটে গেল সুধার। তারপর একদিন মেহেরা খাঁর মৃত্যু হল। আবার সুধা সংসারে একা।

মেহেরা খাঁর মৃত্যুর পর তিনটে বছর সুধা ভারতের সর্বত্র ঘুরে ঘুরে বেড়ালো। তারপর হঠাৎ একদিন কি তার খেয়াল হল, চিত্রজগতে একজন অভিনেত্রীর বিজ্ঞাপন দেখে সে ডিরেকটারের সঙ্গে দেখা করল।

ডিরেকটার তাকে পছন্দ করলেন। নাম লেখাল সে চিত্রজগতের খাতায়। আবার নতুন করে নাম নিল সেমণিকা।

কে জানত অমন অদ্ভুত অভিনয়-প্রতিভা ছিল মণিকার মধ্যে। বিদ্যুতের শিখার মতই মণিকার অপূর্ব অভিনয়-প্রতিভায় চিত্রজগৎ যেন আলোকিত হয়ে গেল। অকস্মাৎ তার রূপালী পর্দায় প্রথম আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই।

সকলের মুখে-মুখেই মণিকার নাম।

অভিনেত্রী মণিকা!

তারকা! বহুবল্লভ মণিকা!

এবারে আশেপাশে ভিড় করে এল পুরুষ-অভিনেতার দল, কিন্তু কাউকেই কাছে ঘেঁষতে দিল না মণিকা।

আশ্চর্য দেহের গঠন মণিকার, আশ্চর্য বাঁধুনী! পঁয়ত্রিশ বছর বয়স তখন মণিকার, কিন্তু দেখেবোঝবার উপায় ছিলনা। দেখে মনে হবে, বড়জোর আঠারো কি উনিশ! মন-পাগল-করা দেহ-সৌন্দর্য! পর্যাপ্ত যৌবন-শ্রীতে যেন ঢলঢল শ্বেতপদ্ম!

এই পর্যন্ত বলে সুধা থামল। কিরীটী প্রশ্ন করলে, তারপর?

তারপর সুধার জীবনের তৃতীয় অধ্যায়। বেশ ছিলাম। দিন কেটে যাচ্ছিল। কেবল মধ্যে মধ্যে মনে পড়ত একখানি কচি মুখ। আজ যদি সে বেঁচে থাকে তো সতের-আঠার বছর বয়স হয়েছে। যাক সেকথা, যা বলছিলাম তাই বলি। কোন একটি বইতে অভিনয় করবার জন্য ব্ৰজেনবাবুর ডাইরেকশনে ফ্লোরে গিয়ে একটি সতের আঠার বছরের মেয়েকে দেখে যেন চমকে উঠলাম। নতুন অভিনেত্রী। এ বইতেই তার প্রথম কনট্রাই। শুনলাম মেয়েটির নাম বনলতা। কেন জানি না বনলতাকে দেখে আমার মনে হল ও যেন আমার কতকালের চেনা, বড় আপনার। স্বপ্নের মধ্যে যে কচি মুখটা আজও আমার চোখে জল আনে, ও মুখখানিতে যেন তারই আদল। সুটিং-এর ফাঁকে একসময় ডেকে নিয়ে এলাম তাকে আমার সাজঘরে নিভৃতে। যতই তাকে দেখছি, ততই যেন মনে হচ্ছে নিজেকেই নিজে আয়নার মধ্যে দেখছি নতুন করে। হুবহু যেন আমারই প্রতিচ্ছবি। প্রথম যৌবনের সেই আমিই যেন আমার চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। বললাম, বস। সে বসল। জিজ্ঞাসা করলাম নানা কথার মধ্যে দিয়ে, কেন সে এ লাইনে এল? কোথায় তার বাড়ি? কি তার পরিচয়? কিন্তু কোন পরিচয়ই সে তার দিতে রাজী নয়। বাড়ি ফিরে এলাম। কিন্তু সারাটা রাত চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। বার বার বনলতার মুখখানিই মনের মধ্যে আনাগোনা করতে লাগল।

কেন, তাকে দেখেও চিনতে পারলেন না যে সে আপনারই আত্মজা?

না। চিনেও যেন চিনতে পারিনি মিঃ রায়।

কিন্তু আমি তো তাকে না দেখেও তার ফটো দেখেই চিনেছিলাম প্রথম দিনই যে সে সচ্চিদানন্দবাবুর সন্তান।

সত্যি চিনেছিলেন? কিন্তু কেমন করে বলুন তো মিঃ রায়।

তার ডান চোখের পাতার উপরে একটা ছোট্ট তিল দেখে। যেটা সে তার বাপের কাছ থেকেই পেয়েছিল। এবং তারে বাপের ওষ্ঠের মতই তারও যে দৃঢ়বদ্ধ ওষ্ঠ ছিল। সচ্চিদানন্দবাবু প্রথম পরিচয়ের দিন সেকথা না বললেও বুঝতে আমার বাকি ছিল না ফটোটা দেখেই, শিবানী তাঁর কে। কি তার সম্পর্ক সচ্চিদানন্দবাবুর সঙ্গে। তাছাড়া আরো একটা কারণ অবশ্য ছিল, বন্ধুর মেয়েকে অমন করে খুঁজে বেড়াতে কেউ কি পারে, না তাই সম্ভব কখনো দীর্ঘ আট বছর ধরে। আর আপনিও হয়ত শুনে আশ্চর্য হবেন যে, আপনাকেও আমি সেই তিল দিয়েই চিনেছিলাম। চোখের পাতার তিল এঁকে আপনি সচ্চিদানন্দবাবুকে যেমন ধোঁকা দিতে পারেননি, আমাকেও তেমনি পারেননি সুধা দেবী। প্রথম দিনই আপনাকে আমি দেখেই বুঝেছিলাম, আপনি শিবানী নন—শিবানীর মা।

আশ্চর্য! কিন্তু সে আপনার কাছে গিয়েছিল বুঝি শিবানীর খোঁজ করে দিতে?

হ্যাঁ। আপনার এখানে আসবার পর হারানো শিবানীর কথা হয়ত তাঁর বেশী করেই মনে পড়েছিল, আপনাকে বার বার চোখের সামনে দেখে দেখে। তাছাড়া আমার মনে হয়, সচ্চিদানন্দবাবু যতই খারাপ হোন, আপনার সঙ্গে যে দুর্ব্যবহারই করুন, শিবানীকে তিনি সত্যিকারের ভালবাসতেন। হয়ত তার আরো একটা কারণ ছিল, প্রথমত হাজার হোক শিবানী তো তাঁরই রক্ত হতে জাত সন্তান এবং দ্বিতীয়ত তাঁর আর কোন সন্তান না হওয়ায়।

বিশ্বাস করি না আমি। তাই যদি হবে তবে অমন করে নিজের সন্তানকে কেউ গভীর রাত্রে বাড়ি থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারে?

আপনি হয়ত ঘটনার একটা দিকইদেখেছেনসুধাদেবী। অন্য দিকটা দেখে বিচার করেননি। তাঁর বিকৃত-মস্তিষ্কা স্ত্রীর কথাটাও আপনার ভাবা উচিত ছিল।

অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাসচেপেসুধাদেবী আবার বলতে লাগলেন, অথচ দেখুন বিধাতার কি আশ্চর্য বিধান! পাপ করল একজন, কিন্তু যন্ত্রণা ভোগ করল সারাটা জীবন ধরে অন্য একজন। তাই তো যে সংকল্প নিয়ে এ বাড়িতে শিবানীর পরিচয়ে একদিন এসে উঠেছিলাম, হতভাগিনী রাধারাণীকে দেখে সে সংকল্প আমার স্রোতের মুখে অসহায় কুটোর মতই কোথায় ভেসে গেল! আমি যেন সত্যি-সত্যিই একেবারে বোকা বনে গেলাম।

কি বলছেন আপনি সুধাদেবী?

ঠিক তাই। কিন্তু সুধা নামে আর ডাকবেন না আমাকে মিঃ রায়। সুধা মরে গেছে। মণিকা বলেই ডাকবেন। হ্যাঁ, সত্যিই তাই। শুনে হয়ত চমকে উঠবেন কিন্তু সত্যিই শেষ বোঝাপড়া করে আমার ও আমার নিরপরাধ নিষ্পাপ মেয়ের দুর্ভাগ্যের প্রতিশোধ নেবার জন্যেই এ গৃহে আমি পা দিয়েছিলাম।

অবাক বিস্ময়ে কিরীটী তাকিয়ে থাকে সুধার মুখের দিকে।

.

যাক যা বলছিলাম, বনলতাকে একদিন জোর করে আমার বাড়িতে নিয়ে এলাম সোজা স্টুডিও থেকে। সুধাদেবী আবার বলতে লাগলেন, বনলতা প্রথমটায় আসতে চায়নি, কিন্তু আমি আমার ভিতরের উদ্বেগকে আর যেন কিছুতেই দমন করে রাখতে পারছিলাম না। কিন্তু বনলতা দেখলাম ঠিক আমারই প্রকৃতি পেয়েছে। প্রচণ্ড একগুঁয়ে অভিমানিনী, জেদী ও চাপা। কিছুতেই মুখ খুলতে চায় না। সে একটা ইতিহাস। সব কথা গুছিয়ে আপনাকে বলতে পারব না। তবে এইটুকু জানুন, শেষ পর্যন্ত বনলতা আমার কাছে স্বীকার করল চোখের জলের মধ্যে দিয়ে। সে রাত্রে এ-বাড়ি থেকে তাকে গলাধাক্কা দিয়ে রাধারাণী বের করে দেবার পর প্রচণ্ড অভিমানে সে যেদিকে দুচোখ যায় হাঁটতে শুরু করে। এখানে একটা কথা বলে রাখি, বড় হবার পর সে একদিন তার মামা-মামীর কথাবার্তা শুনেই বুঝেছিল, সে তাদের মেয়ে নয়। কিন্তু জানত না, আমার ভাই ও ভাই-বৌয়ের সঙ্গে তার কি সম্পর্ক আছে। এবং জানবারও চেষ্টা করেনি সে সম্পর্কের কথা। এবং তাদেরও কখনও ঘুণাক্ষরে জানতে দেয়নি যে, সব কথা সে জানতে পেরেছে। তাই এ-বাড়ি থেকে সে-রাত্রে রাধারাণী যখন গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিল, সে ফিরেও তাকায়নি পিছনের দিকে। হনহন করে শিবানী সেই মধ্যরাত্রের অন্ধকারে নির্জন শহরের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় গঙ্গার ধারে গিয়ে পৌঁছয়। তখন পূবের আকাশ রাঙা হয়ে এসেছে। এক বৃদ্ধ গঙ্গাস্নান করতে এসেছিলেন, ঐ সময় গঙ্গায় তিনি একাকী শিবানীকে সিঁড়ির ধারে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করেন, এখানে একা চুপটি করে বসে কে মা তুমি?

শিবানী জবাব দেয় না।

কি গো, কথা বলছ না কেন?

শিবানী তবু নিরুত্তর।

কি নাম তোমার? কাদের মেয়ে তুমি? আবার বৃদ্ধ প্রশ্ন করেন।

শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ তাকে একপ্রকার জোর করেই নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। শিবানীও ভাবে, আপাতত বৃদ্ধের ওখানেই ওঠা যাক। তারপর নিজের একটা পথ বেছে নিলেই চলবে।

বৃদ্ধের সংসারে এক পুত্র ছাড়া কেউ ছিল না। পুত্রটিও বৃদ্ধের কাছে থাকত না। কাঁচরাপাড়া ওয়ার্কসপে কাজ করত। কচিত কখনো আসত কালেভদ্রে। বৃদ্ধ শিবানীকে আশ্রয় দিল। কিন্তু বৃদ্ধের ছেলেটি ছিল একটি সাক্ষাৎ শয়তান। মাস দুয়েক পরে একদিন বাপের সঙ্গে দেখা করতে এসে শিবানীকে দেখে তার প্রতি তার লোভ জাগল। এবং তারপর থেকেই মধ্যে মধ্যে সে বাপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতে লাগল। এবং নানা ছল-ছুতো করে শিবানীর সঙ্গে মেশবার চেষ্টা করতে লাগল। শিবানীর তখন উচিত ছিল বৃদ্ধকে সব জানিয়ে দেওয়া, কিন্তু ভয়ে ও লজ্জায় সে সব কথা চেপে যেতে লাগল। তার ফলে হল সেই ছেলেটি ক্রমে দুর্বার ও বেপরোয়া হয়ে উঠতে লাগল। অবশেষে এসব ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত যা ঘটবার তাই ঘটল। এক রাত্রে কৌশলে ঘরের দরজা খুলে সেই পশু শিবানীর শয়নকক্ষে প্রবেশ করে শিবানীকে ঘুমন্ত অবস্থায় আক্রমণ করল। অতএব শিবানীর সে আশ্রয়ও গেল। শিবানী আবার রাস্তায় এসে দাঁড়াল। তারপরের আটটা বছরের ইতিহাস আর নাই বা শুনলেন। শুধু জেনে রাখুন, চরম দুর্দশা, লাঞ্ছনা, অপমান তাকে দিনের পর দিন যে কত সহ্য করতে হয়েছে! পুরুষের লোভের চক্রে পড়ে তাকে ক্ষত-বিক্ষত, জর্জরিত হতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এক সহৃদয় যুবকের আশ্রয় পায় সে। এবং তারই সাহায্যে সে অভিনয়-জগতে প্রবেশ করবার সুযোগ পায়। শিবানীর মুখে তার গত আট বছরের জীবনের লাঞ্ছনা ও অপমানের কথা শুনতে শুনতে আমি পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। তাকে গভীর সান্ত্বনা দিয়ে আমি বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ওরে, আমিই তোর হতভাগিনী মা। উঃ, কি কুক্ষণেই যে মেয়ের কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছিলাম। আমার পরিচয় পেয়ে সহসা যেন সে শক্ত পাথরের মত হয়ে গেল। চোখের জল তার গেল শুকিয়ে। সেই রাত্রে শেষের দিকে প্রচণ্ড কাঁপুনি দিয়ে এল তার জ্বর। সাতদিন একনাগাড়ে জ্বরের পর দেখা গেল মস্তিষ্ক-বিকৃতির লক্ষণ তার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। এক মাস ধরে অনেক চেষ্টা করে, বহু চিকিৎসা করেও তাকে ভাল করতে পারলাম না। প্রচণ্ড উন্মাদ সে এখন। রাঁচীর পাগলা গারদে তাকে রেখে কলকাতায় ফিরে এলাম একা একা। ভাবতে পারেন মিঃ রায়, আমার তখনকার মনের অবস্থা! একমাত্র মেয়ে যার পাগল হয়ে যায় এবং তার জন্য দায়ী যে, তাকে সে যদি ক্ষমা না করতেই পারে, তাহলে সে সত্যিই কি আপনাদের বিচারের চোখে অপরাধী হবে? যদি সে সেই শয়তানকে তার জীবনের সেই দুঃস্বপ্নকে হত্যা করেই, তবে কি তাকে আপনারা হত্যাকারী বলবেন? এই যদি আপনাদের বিচার হয়, তবে জানবেন, সে বিচার আমি মানতে রাজী নই। না–না–না–!

একটু থেমে আগুন-ঝরা চোখে সুধা তাঁর কাহিনী আবার বলে যেতে লাগলেন।

একেবারে উন্মাদ একমাত্র মেয়েকে রাঁচীর পাগলা গারদে রেখে কলকাতায় ফিরে এলাম। বুকের মধ্যে হাহাকার আর প্রতিহিংসার আগুন নিয়ে। অসহ্য সেই আগুনের তাপে দিবারাত্র আমার সর্বশরীর ঝলসে যেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত প্রতিজ্ঞা করলাম, যেমন করে হোক, যে আমার একমাত্র মেয়ের জীবনটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে এমনি করে ছারখার করে দিল, তাকে কোনমতেই ক্ষমা করব না। শিবানীর বাপের ঠিকানা আমার জানাই ছিল, তাকে শিবানীর নাম দিয়ে চিঠি দিলাম। আমার পরিকল্পিত ফাঁদে সে সহজেই ধরা দিল। তারপর শিবানীর পরিচয়ে এই বাড়িতে একদিন এসে উঠলাম। কিন্তু এখানে এসে যখন আর এক উন্মাদিনী নারীকে দেখলাম, যে বিনা দোষে তার স্বামীর পাপের ফল ভোগ করছে এবং সে যখন পরম বিশ্বাসে আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিল, কি জানি কে সেই মুহূর্ত থেকেই সমস্ত সংকল্প আমার শিথিল হয়ে আসতে লাগল। যত মনে মনে সংকল্পকে দৃঢ় করে তোলবার। চেষ্টা করি, ততই যেন নিজেকে কেমন অসহায় মনে হয়, দুর্বল পঙ্গু মনে হয়। মনে পড়ে আর এক হতভাগিনী উন্মাদিনীর কথা।

এদিকে তখন শুরু হয়েছে এক বিচিত্র অভিনয় এই বাড়িতে।

অভিনয়!

হ্যাঁ, অভিনয়। সচ্চিদানন্দ আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। সে স্পষ্টই বুঝতে পারছে আমি শিবানী নই, শিবানীর মা, তবু মুখ ফুটে কোন কথা বলতে পারছে না। ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে ছটফট করে বেড়াচ্ছে। এদিকে প্রতি মুহূর্তে আমি আমার সকল্প থেকে চ্যুত হয়ে বুঝতে পারছি, এতকাল সমস্ত পুরুষ জাতটাকে প্রচণ্ড ঘৃণা করলেও তাকে কিছুতেই ঘৃণার দ্বারা অস্বীকার করতে পারছি না। একদিকে আমার একমাত্র উন্মাদিনী মেয়ের সেই মুখখানা, অন্যদিকে অসহায় দৈব কর্তৃক জর্জরিত হতভাগ্য এক পুরুষ—একদা যাকে সমস্ত প্রাণ ঢেলে ভালবেসেছিলাম। দুয়ের মধ্যে দিবানিশি এক মর্মান্তিক অন্তর্দ্বন্দ্ব! আর তারই মাঝে চলছে তখন এক বিকৃতমস্তিষ্কা নারীর মনে আমাকে কেন্দ্র করে তার স্বামীকে নিয়ে ভয়ঙ্কর এক সন্দেহের ঝড়! অথচ মুখ ফুটে সেও কিছু বলতে পারছে না। প্রত্যেকে আমরা প্রত্যেকের সঙ্গে যেন অভিনয় করে চলতে লাগলাম। শেষ পর্যন্ত সে-অভিনয় শেষ হল এক মর্মান্তিক নৃশংস হত্যাপ্রচেষ্টায়। অভিনয়ের সেটা বলতে পারেন শেষ রাত্রি বা শেষ রজনী।

অভিনয়ের শেষ অঙ্কের শেষ দৃশ্য।

আমরা তিনজনে প্রত্যেকেই বোধ হয় অভিনয় করতে করতে গত এক মাস ধরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই প্রত্যেকেই আমরা তখন এসে পৌঁছেছি ধৈর্যের শেষ সীমায়। সুধাদেবী আবার বলতে লাগলেন।

সে-রাত্রে সে ফিরে এসে আমাকে কিছু খাবে না বলে সবে যখন তার শোবার ঘরে গিয়ে প্রবেশ করেছে, রাধারাণী গিয়ে তার ঘরে প্রবেশ করল।

.

সুধার বিবৃতি।

চমকে ওঠেন সচ্চিদানন্দ এত রাত্রে রাধারাণীকে তাঁর ঘরে প্রবেশ করতে দেখে।

কে? রাধা? এ কি, এখনও ঘুমোওনি?

এই ফটোটা দিতে এলাম তোমাকে। তোমার প্রেয়সীর ফটো। বিকৃত উন্মাদ আক্রোশে চেঁচিয়ে উঠলেন রাধারাণী।

তখনও সুধা জানত না তার প্রথম যৌবনের ঐ ফটোটা তার সুটকেস থেকে তার অজ্ঞাতে সচ্চিদানন্দ চুরি করে নিয়ে গিয়ে নিজের শোবার ঘরে বালিসের তলায় রেখে দিয়েছিলেন। এবং এক সময় রাধারাণী সেই ঘরে এসে বালিসের তলায় ফটোটা দেখতে পেয়ে নিয়ে

যান।

কোথায় পেলে এ ফটো? দাও—

দেব বৈকি? এই নাও বলে দুমড়ে মুচড়ে ফটোটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন রাধারাণী স্বামীর গায়ের উপরে।

বাইরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছে, সব শুনছে সুধা তখন।

হনহন করে রাধারাণী ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। চট করে আগেই দরজার পাশ থেকে সরে গিয়েছিল সুধা। তাকে দেখতে পেলেন না রাধারাণী দরজার পাশে। অবশ্য মনের সে অবস্থাও তাঁর ছিল না।

এদিকে রাধারাণী চলে যাবার পর সচ্চিদানন্দ তাঁর অফিস-ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। আলমারী থেকে মদের বোতল ইত্যাদি বের করে ঢক ঢক্‌ করে দুটো পেগ খেলেন।

তারপর ড্রয়ার থেকে কাগজ বের করে কি যেন লিখতে লাগলেন।

আবার কি ভেবে কাগজটা ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে আবার খানিকটা মদ্যপান করলেন।

এমন সময়ে সুধা গিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।

চমকে তাকাতে গিয়ে সচ্চিদানন্দর হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে চূর্ণ হয়ে গেল ঝন ঝন শব্দ তুলে।

কে! ফিরে তাকালেন সচ্চিদানন্দ।

চিনতে পারছ না? সুধা প্রশ্ন করে।

চিনতে পেরেছি। কিন্তু এসবের মানে কি?

তার আগে আমার প্রশ্নের জবাব দাও। আমার মেয়ে কোথায়?

তোমার মেয়ে?

হ্যাঁ।

কি ভেবে সচ্চিদানন্দ বললেন, চল, ছাদে কাঁচঘরে চল, সব কথা তোমাকে বলব। এখানে নয়, পাশের ঘরে মহিমা রয়েছে।

চল।

কাঁচঘরে গিয়ে বসল সচ্চিদানন্দ বেঞ্চটার উপরে, বোসো সুধা।

না। কি বলতে চাও তুমি বল। সুধা দাঁড়িয়ে থাকে।

বসবে না?

না। কি বলবার আছে তোমার, বল।

কাঁচঘরে আলো জ্বালা ছিল না। শুধু কাঁচের ছাদ ভেদ করে ক্ষীণ চাঁদের আলো একটাঅস্পষ্ট আলো-ছায়া গড়ে তুলেছে।

কি চাও তুমি? কেন আবার এসেছ এখানে মিথ্যা পরিচয়ে? সচ্চিদানন্দ প্রশ্ন করলেন।

যদি বলি প্রতিহিংসা নিতে এসেছি? জবাব দেয় সুধা।

হঠাৎ এমন সময় নিঃশব্দে একটা ছায়া এসে কখন সচ্চিদানন্দের পশ্চাতে দাঁড়িয়েছে, উনি তা টেরও পাননি এবং সুধাও দেখতে পায়নি।

সেই ছায়ামূর্তি হঠাৎ যেন পশ্চাৎ দিক থেকে হুঁমড়ি খেয়ে পড়ে সচ্চিদানন্দের উপরে। এবং সঙ্গে সঙ্গেই সামনের দিকে যেন ছিটকে গিয়ে পড়লেন অর্ধস্ফুট একটা আর্ত-চিৎকার করে সচ্চিদানন্দ।

ঘটনার আকস্মিকতায় সুধা স্তম্ভিত বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন। হঠাৎ চমক ভাঙল সুধার আর একটা ভারী বস্তু পতনের শব্দে।

ঠিক সেই সময়ে কাঁচঘরের আলো জ্বলে উঠল দপ করে।

বিহ্বল ভাবটা কেটে যাবার পর সুধা তাকিয়ে দেখলো, তার অল্পদূরে সামনে দাঁড়িয়ে নির্বাক মহিমারঞ্জন। আর তার কিছু দূরে চিৎ হয়ে পড়ে নিশ্চল সচ্চিদানন্দের দেহটা এবং বেঞ্চের পাশে পড়ে নিশ্চল রাধারাণীর দেহটাও।

রাধারাণী মারা যাননি, কেবল জ্ঞান হারিয়েছিলেন। কপালে শুধু লেগেছিল তাঁর সামান্য।

কিন্তু সচ্চিদানন্দ তখন মৃত। কিন্তু তখন যদি জানতাম, সত্যি-সত্যিই সে মরেনি মিঃ রায়–বলতে বলতে সুধা দুহাতে মুখ ঢাকল।

তাহলে কি করতেন? কিরীটী প্রশ্ন করে।

বিহ্বল কণ্ঠে সুধা বললে, কি করতাম জানি না। তবে তবে সত্যিই যদি সে মারা যেত মিঃ রায় সেইটাই হয়ত ভাল হত!

আক্রোশের বশে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য রাধারাণী নিজের নিদ্রার জন্য প্রত্যহ যে মরফিন নিতেন, তাই পিছন থেকে এসে সচ্চিদানন্দকে ইনজেক্ট করতে, অতর্কিতে সচ্চিদানন্দ অর্ধস্ফুট চিৎকার করে লাফিয়ে উঠতে গিয়ে পড়ে যান বিষাক্ত অর্কিডের উপরে এবং সম্ভবত ছুঁচের ক্ষতস্থান-পথে সেই অর্কিডের বিষাক্ত রস তাঁর শরীরে প্রবেশ করে অতর্কিতেই তাঁর মৃত্যু ঘটায়।

কিন্তু কিভাবে যে বিকৃতমস্তিষ্কা রাধারাণীর দ্বারা সেটা সম্ভব হয়েছিল, সেটাই বোধগম্যের ও বিচারশক্তির বাইরে।

অতর্কিতে শরীরে উঁচ বিদ্ধ হওয়ায় বোধ হয় ঘুরে রাধারাণীকে দেখতে পেয়ে তাঁর শাড়ির আঁচলটা ধরে ফেলেছিলেন, তাতেই আঁচলের খানিকটা লাল সূতো পড়ে যাবার সময় হাতের মুঠোর মধ্যে সচ্চিদানন্দর থেকে যায়।

যা থেকে পরের দিন কিরীটী রাধারাণীর পরনে লালপাড় শাড়ি দেখে বুঝেছিল, মৃত্যুর সময়ে রাধারাণী ঘটনাস্থলে ছিলেন।

এবং রাধারাণীর স্মৃতি হঠাৎ লোপ পাওয়ায় কিরীটীর প্রথম থেকে সন্দেহ হয়েছিল,রাধারাণীই হয়ত হত্যাকারী। স্বামীকে হত্যা করার দুঃসাহসিক প্রচেষ্টাই তাঁর দুর্বল বিকৃত মস্তিষ্ক সহ্য করতে পারেনি। যার ফলে তাঁর স্মৃতিলোপ ঘটেছে।

.

কাঁচঘরে কিরীটী যখন ফিরে এল, রাধারাণী তখন কখনো হাসছেন, কখনো কাঁদছেন হাউ হাউ করে।

মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ বিকৃতি ঘটেছে তাঁর।

মহিমারঞ্জন কিছুতেই তাঁকে যেন সামলাতে পারছেন না।

সুধাও কিরীটীর সঙ্গে এসেছিল, নিঃশব্দে সে এগিয়ে গেল উন্মাদিনী রাধারাণীর দিকে। তখনও বেচারী সুধা জানে না যে, সত্যিসত্যিই সচ্চিদানন্দর মৃত্যু ঘটেছে।

ক্ষণপূর্বে যা দেখে সে কিরীটীর কাছে সমস্ত কথা অকপটে স্বীকার করেছে, তা সত্যিসত্যিই অভিনয় ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু কিছুতেই ঐ মুহূর্তে কিরীটী মুখ ফুটে সত্য কথাটা বলতে পারল না। মর্মান্তিকভাবে করুণ ও বিয়োগান্ত ঐ ঘটনার পর কেবলই তার মনে হতে লাগল, বিধাতা নিজেই যখন নিজের হাতে ওদের মাথায় বিচারের দণ্ড তুলে দিয়েছেন, তখন তার ওখান থেকে সরে যাওয়াই ভাল।– তাই নিঃশব্দে সে সুব্রত, সুশীল রায় ও বলীন ঢোমকে ইঙ্গিতে ডেকে কাঁচঘরের দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

কাঁচঘরে রইলেন তিনটি প্রাণী। একটি উন্মাদিনী, একটি হৃতসর্বস্ব ও অন্যজন তার দর্শক।

রাধারাণী, সুধা ও মহিমারঞ্জন।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *