Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

নিখিলেশের আত্মকথা

আমার নামে কাগজে প্যারাগ্রাফ এবং চিঠি বেরােতে শুরু হয়েছে। শুনছি, একটা ছড়া এবং ছবি বেরােবে, তারও উদ্‌যােগ হচ্ছে। রসিকতার উৎস খুলে গেছে, সেইসঙ্গে অজস্র মিথ্যেকথার ধারাবর্ষণে সমস্ত দেশ একেবারে পুলকিত। জানে যে, এই পঙ্কিল রসের হােরিখেলায় পিচকিরিটা তাদেরই হাতে; আমি ভদ্রলােক রাস্তার একপাশ দিয়ে চলেছি, আমার গায়ের আবরণখানা সাদা রাখবার উপায় নেই।

লিখেছে, আমার এলেকায় আপামর সাধারণ সকলেই স্বদেশীর জন্যে একেবারে উৎসুক হয়ে রয়েছে, কেবল আমার ভয়েই কিছু করতে পারছে না। দুই-একজন সাহসী যারা দিশি জিনিস চালাতে চায় জমিদারি চালে আমি তাদের বিধিমতে উৎপীড়ন করছি। পুলিসের সঙ্গে আমার তলে তলে যােগ আছে, ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে আমি গােপনে চিঠি চালাচালি করছি এবং বিশ্বস্তসূত্রে খবরের কাগজ খবর পেয়েছে যে, পৈতৃক খেতাবের উপরেও স্বােপার্জিত খেতাব যােগ করে দেবার জন্য আমার আয়ােজন ব্যর্থ হবে না। লিখেছে: স্বনামা পুরুষাে ধন্য; কিন্তু দেশের লােক বিনামার ফরমাশ দিয়েছে, সে খবরও আমরা রাখি।

আমার নামটা স্পষ্ট করে দেয় নি, কিন্তু বাইরের অস্পষ্টতার ভিতর থেকে সেটা খুব বড়াে করে ফুটে উঠেছে।

এ দিকে মাতৃবৎসল হরিশ কুণ্ডুর গুণগান করে কাগজে চিঠির পর চিঠি বেরােচ্ছে। লিখেছে, মায়ের এমন সেবক দেশে যদি বেশি থাকত তা হলে এতদিনে ম্যাঞ্চেস্টারের কারখানা-ঘরের চিমনিগুলাে পর্যন্ত বন্দে মাতরমের সুরে সমস্বরে রামশিঙে ফুঁকতে থাকত।

এ দিকে আমার নামে লাল কালিতে লেখা একখানি চিঠি এসেছে; তাতে খবর দিয়েছে কোথায় কোন্ কোন্ লিভারপুলের নিমকহালাল জমিদারের কাছারি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বলেছে: ভগবান পাবক এখন থেকে এই পাবনের কাজে লাগলেন, মায়ের যারা সন্তান নয় তারা যাতে মায়ের কোল জুড়ে থাকতে না পারে তার ব্যবস্থা হচ্ছে।

নাম সই করেছে: মায়ের কোলের অধম শরিক, শ্রীঅম্বিকাচরণ গুপ্ত।

আমি জানি, এ-সমস্তই আমার এখানকার সব ছাত্রদের রচনা। আমি ওদের দুই-একজনকে ডেকে সেই চিঠিখানা দেখালুম। বি. এ. গম্ভীরভাবে বললে, আমরাও শুনেছি, দেশে একদল লােক মরিয়া হয়ে রয়েছে, স্বদেশীর বাধা দূর করতে তারা না পারে এমন কাজ নেই।

আমি বললুম, তাদের অন্যায় জবরদস্তিতে দেশের একজন লােকও যদি হার মানে তা হলে সেটাতে সমস্ত দেশের পরাভব।

ইতিহাসে এম. এ. বললেন, বুঝতে পারছি নে।

আমি বললুম, আমাদের দেশ দেবতাকে থেকে পেয়াদাকে পর্যন্ত ভয় করে করে আধমরা হয়ে রয়েছে; আজ তােমরা মুক্তির নাম করে সেই জুজুর ভয়কে ফের আর-এক নামে যদি দেশে চালাতে চাও, অত্যাচারের দ্বারা কাপুরুষতাটার উপরে যদি তােমাদের দেশের জয়ধ্বজা রােপণ করতে চাও, তা হলে দেশকে যারা ভালােবাসে তারা সেই ভয়ের শাসনের কাছে এক-চুল মাথা নিচু করবে না।

ইতিহাসে এম. এ. বললেন, এমন কোন্ দেশ আছে যেখানে রাজ্যশাসন ভয়ের শাসন নয়?

আমি বললুম, এই ভয়ের শাসনের সীমা কোন পর্যন্ত সেইটের দ্বারাই দেশের মানুষ কতটা স্বাধীন জানা যায়। ভয়ের শাসন যদি চুরি ডাকাতি এবং পরের প্রতি অন্যায়ের উপরেই টানা যায় তা হলে বােঝা যায় যে, প্রত্যেক মানুষকে অন্য মানুষের আক্রমণ থেকে স্বাধীন করবার জন্যেই এই শাসন। কিন্তু মানুষ নিজে কী কাপড় পরবে, কোন দোকান থেকে কিনবে, কী খাবে, কার সঙ্গে বসে খাবে, এও যদি ভয়ের শাসনে বাঁধা হয় তা হলে মানুষের ইচ্ছাকে একেবারে গােড়া ঘেঁষে অস্বীকার করা হয়। সেটাই হল মানুষকে মনুষ্যত্ব থেকে বঞ্চিত করা।

ইতিহাসে এম. এ. বললেন, অন্য দেশের সমাজেও কি ইচ্ছাকে গােড়া ঘেঁষে কাটবার কোথাও কোনাে ব্যবস্থা নেই?

আমি বললুম, কে বললে নেই? মানুষকে নিয়ে দাস-ব্যাবসা যে দেশে যে পরিমাণে আছে সে পরিমাণেই মানুষ আপনাকে নষ্ট করছে।

এম. এ. বললেন, তা হলে ঐ দাস-ব্যাবসাটা মানুষেরই ধর্ম, ওটাই মনুষ্যত্ব।

বি. এ. বললেন, সন্দীপবাবু এ সম্বন্ধে সেদিন যে দৃষ্টান্ত দিলেন সেটা আমাদের খুব মনে লেগেছে। এই যে ও পারে হরিশ কুণ্ডু আছেন জমিদার, কিংবা সানকিভাঙার চক্রবর্তীরা, ওদের সমস্ত এলেকা ঝাঁট দিয়ে আজ এক ছটাক বিলিতি নুন পাবার জো নেই। কেন? কেননা, বরাবরই ওঁরা জোরের উপরে চলেছেন। যারা স্বভাবতই দাস, প্রভু না থাকাটাই হচ্ছে তাদের সকলের চেয়ে বড়াে বিপদ।

এফ. এ. প্লাক্‌ড্ ছােকরাটি বললে, একটা ঘটনা জানি। চক্রবর্তীদের একটি কায়স্থ প্রজা ছিল। সে তার একটা হাট নিয়ে চক্রবর্তীদের কিছুতে মানছিল না। মামলা করতে করতে শেষকালে তার এমন দশা হল যে খেতে পায় না। যখন দুদিন তার ঘরে হাঁড়ি চড়ল না তখন স্ত্রীর রুপাের গয়না বেচতে বেরােলাে; এই তার শেষ সম্বল। জমিদারের শাসনে গ্রামের কেউ তার গয়না কিনতেও সাহস করে না। জমিদারের নায়েব বললে, আমি কিনব, পাঁচ টাকা দামে। দাম তার টাকা ত্রিশ হবে। প্রাণের দায়ে পাঁচ টাকাতেই যখন সে রাজি হল তখন তার গয়নার পুঁটুলি নিয়ে নায়েব বললে, এই পাঁচ টাকা তােমার খাজনা-বাকিতে জমা করে নিলুম।— এই কথা শুনে আমরা সন্দীপবাবুকে বলেছিলুম, চক্রবর্তীকে আমরা বয়কট করব! সন্দীপবাবু বললেন, এই সমস্ত জ্যান্ত লােককেই যদি বাদ দাও তা হলে কি ঘাটের মড়া নিয়ে দেশের কাজ করবে? এরা প্রাণপণে ইচ্ছা করতে জানে; এরাই তাে প্রভু। যারা যােলাে-আনা ইচ্ছে করতে জানে না, তারা হয় এদের ইচ্ছেয় চলবে নয় এদের ইচ্ছেয় মরবে। তিনি আপনার সঙ্গে তুলনা করে বললেন, আজ চক্রবর্তীর এলেকায় একটি মানুষ নেই যে স্বদেশী নিয়ে টুঁ শব্দটি করতে পারে, অথচ নিখিলেশ হাজার ইচ্ছে করলেও স্বদেশী চালাতে পারবেন না।

আমি বললুম, আমি স্বদেশীর চেয়ে বড়াে জিনিস চালাতে চাই, সেইজন্যে স্বদেশী চালানাে আমার পক্ষে শক্ত। আমি মরা খুঁটি চাই নে তাে, আমি জ্যান্ত গাছ চাই। আমার কাজে দেরি হবে।

ঐতিহাসিক হেসে বললেন, আপনি মরা খুঁটিও পাবেন না, জ্যান্ত গাছও পাবেন না। কেননা, সন্দীপবাবুর কথা আমি মানি— পাওয়া মানেই কেড়ে নেওয়া। এ কথা শিখতে আমাদের সময় লেগেছে, কেননা এগুলাে ইস্কুলের শিক্ষার উলটো শিক্ষা। আমি নিজের চোখে দেখেছি, কুণ্ডুদের গােমস্তা গুরুচরণ ভাদুড়ি টাকা আদায় করতে বেরিয়েছিল— একটা মুসলমান প্রজার বেচে-কিনে নেবার মতাে কিছু ছিল না। ছিল তার যুবতী স্ত্রী। ভাদুড়ি বললে, তাের বউকে নিকে দিয়ে টাকা শােধ করতে হবে। নিকে করবার উমেদার জুটে গেল, টাকাও শােধ হল। আপনাকে বলছি, স্বামীটার চোখের জল দেখে আমার রাত্রে ঘুম হয় নি। কিন্তু যতই কষ্ট হােক, আমি এটা শিখেছি যে, যখন টাকা আদায় করতেই হবে তখন যে মানুষ ঋণীর স্ত্রীকে বেচিয়ে টাকা সংগ্রহ করতে পারে মানুষ-হিসাবে সে আমার চেয়ে বড়াে— আমি পারি নে, আমার চোখে জল আসে, তাই সব ফেঁসে যায়। আমার দেশকে যদি কেউ বাঁচায় তবে এই-সব গােমস্তা, ঐ-সব কুণ্ডু, এই-সব চক্রবর্তীরা।

আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলুম; বললুম, তাই যদি হয় তবে এই-সব গােমস্তা, এই-সব কুণ্ডু, এই-সব চক্রবর্তীদের হাত থেকে দেশকে বাঁচাবার কাজই আমার। দেখাে, দাসত্বের যে বিষ মজ্জার মধ্যে আছে সেইটেই যখন সুযােগ পেয়ে বাইরে ফুটে ওঠে তখনই সেটা সাংঘাতিক দৌরাত্মের আকার ধরে। বউ হয়ে যে মার খায় শাশুড়ি হয়ে সেই সব চেয়ে বড়াে মার মারে। সমাজে যে মানুষ মাথা হেঁট করে থাকে সে যখন বরযাত্র হয়ে বেরােয় তখন তার উৎপাতে মানী গৃহস্থের মান রক্ষা করা অসাধ্য। ভয়ের শাসনে তােমরা নির্বিচারে কেবলই সকল-তাতেই সকলকে মেনে এসেছ, সেইটেকেই ধর্ম বলতে শিখেছ, সেইজন্যেই আজকে অত্যাচার করে সকলকে মানানােটাকেই তােমরা ধর্ম বলে মনে করছ। আমার লড়াই দুর্বলতার ঐ নিদারুণতার সঙ্গে।

আমার এ-সব কথা অত্যন্ত সহজ কথা— সরল লােককে বললে বুঝতে তার মুহূর্তমাত্র দেরি হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে যে-সব এম. এ. ঐতিহাসিক বুদ্ধির প্যাঁচ কষছে, সত্যকে পরাস্ত করবার জন্যেই তাদের প্যাঁচ।

এ দিকে পঞ্চুর জাল মামীকে নিয়ে ভাবছি। তাকে অপ্রমাণ করা কঠিন। সত্য ঘটনার সাক্ষীর সংখ্যা পরিমিত, এমন-কি, সাক্ষী না থাকাও অসম্ভব নয়। কিন্তু যে ঘটনা ঘটে নি, জোগাড় করতে পারলে তার সাক্ষীর অভাব হয় না। আমি যে মৌরসি স্বত্ব পঞ্চুর কাছ থেকে কিনেছি সেইটে কাঁচিয়ে দেবার এই ফন্দি।

আমি নিরুপায় দেখে ভাবছিলুম পঞ্চুকে আমার নিজ এলাকাতেই জমি দিয়ে ঘরবাড়ি করিয়ে দিই। কিন্তু মাস্টারমশাই বললেন, অন্যায়ের কাছে সহজে হার মানতে পারব না। আমি নিজে চেষ্টা দেখব।

আপনি চেষ্টা দেখবেন?

হাঁ, আমি।

এ-সমস্ত মামলা-মকদ্দমার ব্যাপার— মাস্টারমশাই যে কী করতে পারেন বুঝতে পারলুম না। সন্ধ্যাবেলায় যে সময়ে রােজ আমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয় সেদিন দেখা হল না। খবর নিয়ে জানলুম তিনি তাঁর কাপড়ের বাক্স আর বিছানা নিয়ে বেরিয়ে গেছেন; চাকরদের কেবল এইটুকু বলে গেছেন, তাঁর ফিরতে দু-চার দিন দেরি হবে। আমি ভাবলুম সাক্ষী সংগ্রহ করবার জন্য তিনি পঞ্চুদের মামার বাড়িতেই-বা চলে গেছেন। তা যদি হয় আমি জানি, সে তাঁর বৃথা চেষ্টা হবে। জগদ্ধাত্রীপুজো মহরম এবং রবিবারে জড়িয়ে তাঁর ইস্কুলের কয়দিন ছুটি ছিল, তাই স্কুলেও তার খোঁজ পাওয়া গেল না।

হেমন্তের বিকেলের দিকে দিনের আলাের রঙ যখন ঘােলা হয়ে আসতে থাকে তখন ভিতরে ভিতরে মনেরও রঙ বদল হয়ে আসে। সংসারে অনেক লােক আছে যাদের মনটা কোঠাবাড়িতে বাস করে। তারা ‘বাহির’ বলে পদার্থকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে চলতে পারে। আমার মনটা আছে যেন গাছতলায়। বাইরের হাওয়ার সমস্ত ইশারা একেবারে গায়ের উপর এসে পড়ে, আলাে-অন্ধকারের সমস্ত মিড় বুকের ভিতরে বেজে ওঠে। দিনের আলাে যখন প্রখর থাকে তখন সংসার তার অসংখ্য কাজ নিয়ে চার দিকে ভিড় করে দাঁড়ায়; তখন মনে হয়, জীবনে এ ছাড়া আর-কিছুরই দরকার নেই। কিন্তু যখন আকাশ ম্লান হয়ে আসে, যখন স্বর্গের জানলা থেকে মর্তের উপর পর্দা নেমে আসতে থাকে, তখন আমার মন বলে, জগতে সন্ধ্যা আসে সমস্ত সংসারটাকে আড়াল করবার জন্যেই; এখন কেবল একের সঙ্গ অনন্ত অন্ধকারকে ভরে তুলবে এইটেই ছিল জলস্থল-আকাশের একমাত্র মন্ত্রণা। দিনের বেলা যে প্রাণ অনেকের মধ্যে বিকশিত হয়ে উঠবে সন্ধ্যার সময়ে সে প্রাণই একের মধ্যে মুদে আসবে, আলাে-অন্ধকারের ভিতরকার অর্থটাই ছিল এই। আমি সেটাকে অস্বীকার করে কঠিন হয়ে থাকতে পারি নে। তাই সন্ধ্যাটি যেই জগতের উপর প্রেয়সীর কালাে চোখের তারার মতাে অনিমেষ হয়ে ওঠে তখন আমার সমস্ত দেহমন বলতে থাকে: সত্য নয়, এ কথা কখনােই সত্য নয় যে কেবলমাত্র কাজই মানুষের আদি অন্ত। মানুষ একান্তই মজুর নয়, হােক-না সে সত্যের মজুরি, ধর্মের মজুরি। সেই তারার- আলােয়-ছুটি-পাওয়া কাজের-বাইরেকার মানুষ, সেই অন্ধকারের অমৃতে-ডুবে মরবার মানুষটিকে তুই কি চিরদিনের মতাে হারালি, নিখিলেশ? সমস্ত সংসারের অসংখ্যতাও যে-জায়গায় মানুষকে লেশমাত্র সঙ্গ দিতে পারে না সেইখানে যে লােক একলা হয়েছে সে কী ভয়ানক একলা!

সেদিন বিকেলবেলাটা ঠিক যখন সন্ধ্যার মােহনাটিতে এসে পৌঁচেছে তখন আমার কাজ ছিল না, কাজে মনও ছিল না, মাস্টারমশায়ও ছিলেন না; শূন্য বুকটা যখন আকাশে কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছিল তখন আমি বাড়ি-ভিতরের বাগানে গেলুম। আমার চন্দ্রমল্লিকা ফুলের বড়াে শখ। আমি টবে করে নানা রঙের চন্দ্রমল্লিকা বাগানে সাজিয়েছিলুম; যখন সমস্ত গাছ ভরে ফুল উঠত তখন মনে হত, সবুজ সমুদ্রে ঢেউ লেগে রঙের ফেনা উঠেছে। কিছু কাল আমি বাগানে যাই নি; আজ মনে মনে একটু হেসে বললুম, আমার বিরহিণী চন্দ্রমল্লিকার বিরহ ঘুচিয়ে আসি গে।

বাগানে যখন ঢুকলুম তখন কৃষ্ণ-প্রতিপদের চাঁদটি ঠিক আমাদের পাঁচিলের উপরটিতে এসে মুখ বাড়িয়েছে। পাঁচিলের তলাটিতে নিবিড় ছায়া, তারই উপর দিয়ে বাঁকা চাঁদের আলাে বাগানের পশ্চিম দিকে এসে পড়েছে। ঠিক আমার মনে হল, চাঁদ যেন হঠাৎ পিছন দিক থেকে এসে অন্ধকারের চোখ টিপে ধরে মুচকে হাসছে।

পাঁচিলে যে ধারটিতে গ্যালারির মতাে করে থাকে থাকে চন্দ্রমল্লিকার টব সাজানাে রয়েছে সেই দিকে গিয়ে দেখি, সেই পুষ্পিত সােপানশ্রেণীর তলায় ঘাসের উপরে কে চুপ করে শুয়ে আছে। আমার বুকের মধ্যে ধড়াস্ করে উঠল। আমি কাছে যেতেই সেও চমকে তাড়াতাড়ি উঠে বসল।

তার পর কী করা যায়! আমি ভাবছি, আমি এইখান থেকে ফিরে যাব কিনা। বিমলাও নিশ্চয় ভাবছিল, সে উঠে চলে যাবে কিনা। কিন্তু থাকাও যেমন শক্ত চলে যাওয়াও তেমনি। আমি কিছু-একটা মনস্থির করার পূর্বেই বিমলা উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় কাপড় দিয়ে বাড়ির দিকে চলল।

সেই একটুখানি সময়ের মধ্যেই বিমলার দুর্বিষহ দুঃখ আমার কাছে যেন মূর্তিমান হয়ে দেখা দিল। সেই মুহূর্তে আমার নিজের জীবনের নালিশ কোথায় দূরে ভেসে গেল। আমি তাকে ডাকলুম, বিমলা!

সে চমকে দাঁড়ালাে। কিন্তু তখনাে সে আমার দিকে ফিরল না। আমি তার সামনে এসে দাঁড়ালুম। তার দিকে ছায়া, আমার মুখের উপর চাঁদের আলাে পড়ল। সে দুই হাত মুঠো করে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললুম, বিমলা, আমার এই পিঁজরের মধ্যে চারি দিক বন্ধ, তােমাকে কিসের জন্যে এখানে ধরে রাখব? এমন করে তাে তুমি বাঁচবে না!

বিমলা চোখ বুজেই রইল, একটি কথাও বললে না।

আমি বললুম, তােমাকে যদি এমন জোর করে বেঁধে রাখি তা হলে আমার সমস্ত জীবন যে একটা লােহার শিকল হয়ে উঠবে। তাতে কি আমার কোনাে সুখ আছে?

বিমলা চুপ করেই রইল।

আমি বললুম, এই আমি তােমাকে সত্য বলছি, আমি তােমাকে ছুটি দিলুম। আমি যদি তােমার আর-কিছু না হতে পারি, অন্তত আমি তােমার হাতের হাত-কড়া হব না।

এই বলে আমি বাড়ির দিকে চলে গেলুম। না, না, এ আমার ঔদার্য নয়, এ আমার ঔদাসীন্য তাে নয়ই। আমি যে ছাড়তে না পারলে কিছুতেই ছাড়া পাব না। যাকে আমার হৃদয়ের হার করব তাকে চিরদিন আমার হৃদয়ের বোঝা করে রেখে দিতে পারব না। অন্তর্যামীর কাছে আমি জোড়হাতে কেবল এই প্রার্থনাই করছি, আমি সুখ না পাই নাই পেলুম, দুঃখ পাই সেও স্বীকার, কিন্তু আমাকে বেঁধে রেখে দিয়াে না। মিথ্যাকে সত্য বলে ধরে রাখার চেষ্টা যে নিজেরই গলা চেপে ধরা। আমার সেই আত্মহত্যা থেকে আমাকে বাঁচাও।

বৈঠকখানার ঘরে এসে দেখি মাস্টারমশায় বসে আছেন। তখন ভিতরে ভিতরে আবেগে আমার মন দুলছে। মাস্টারমশায়কে দেখে আমি অন্য কোনাে কথা জিজ্ঞাসা করবার আগে বলে উঠলুম, মাস্টারমশায়, মুক্তিই হচ্ছে মানুষের সব চেয়ে বড়াে জিনিস। তার কাছে আর-কিছুই নেই, কিছুই না।

মাস্টারমশায় আমার এই উত্তেজনায় আশ্চর্য হয়ে গেলেন। কিছু না বলে আমার দিকে চেয়ে রইলেন।

আমি বললুম, বই পড়ে কিছুই বােঝা যায় না। শাস্ত্রে পড়েছিলুম ইচ্ছাটাই বন্ধন; সে নিজেকে বাঁধে, অন্যকে বাঁধে। কিন্তু শুধু কেবল কথা ভয়ানক ফাঁকা। সত্যি যেদিন পাখিকে খাঁচা থেকে ছেড়ে দিতে পারি সেদিন বুঝতে পারি, পাখিই আমাকে ছেড়ে দিলে। যাকে আমি খাঁচায় বাঁধি, সে আমাকে আমার ইচ্ছেতে বাঁধে, সেই ইচ্ছের বাঁধন যে শিকলের বাঁধনের চেয়ে শক্ত। আমি বলছি, পৃথিবীতে এই কথাটি কেউ বুঝতে পারছে না। সবাই মনে করছে, সংস্কার আর-কোথাও করতে হবে। আর-কোথাও না, কোথাও না, কেবল ইচ্ছের মধ্যে ছাড়া।

মাস্টারমশায় বললেন, আমরা মনে করি, যেটা ইচ্ছে করেছি সেটাকে হাতে করে পাওয়াই স্বাধীনতা। কিন্তু আসলে যেটা ইচ্ছে করেছি সেটাকে মনের মধ্যে ত্যাগ করাই স্বাধীনতা।

আমি বললুম, মাস্টারমশায়, অমন করে কথায় বলতে গেলে টাকপড়া উপদেশের মতাে শােনায়। কিন্তু যখনই চোখে ওকে আভাসমাত্রও দেখি তখন যে দেখি, ঐটেই অমৃত। দেবতারা এইটেই পান করে অমর। সুন্দরকে আমরা দেখতেই পাই নে যতক্ষণ না আমরা তাকে ছেড়ে দিই। বুদ্ধই পৃথিবী জয় করেছিলেন, আলেক্‌জান্ডার করেন নি— এ কথা যে তখন মিথ্যেকথা যখন এটা শুকনাে গলায় বলি। এই কথা কবে গান গেয়ে বলতে পারব? বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই-সব প্রাণের কথা ছাপার বইকে ছাপিয়ে পড়বে কবে, একেবারে গঙ্গোত্রী থেকে গঙ্গার নির্ঝরের মতাে?

হঠাৎ মনে পড়ে গেল, মাস্টারমশায় কদিন ছিলেন না, কোথায় ছিলেন তা জানিও নে। একটু লজ্জিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, আপনি ছিলেন কোথায়?

মাস্টার-মশায় বললেন, পঞ্চুর বাড়িতে।

পঞ্চুর বাড়িতে? এই চারদিন সেখানেই ছিলেন?

হ্যাঁ, মনে ভাবলুম, যে মেয়েটি পঞ্চুর মামী সেজে এসেছে তার সঙ্গেই কথাবার্তা কয়ে দেখব। আমাকে দেখে প্রথমটা সে একটু আশ্চর্য হয়ে গেল। ভদ্রলােকের ছেলে হয়েও যে এত বড়াে অদ্ভুত কেউ হতে পারে, এ কথা সে মনে করতেও পারে নি। দেখলে যে আমি রয়েই গেলুম। তার পরে তার লজ্জা হতে লাগল। আমি তাকে বললুম, মা, আমাকে তাে তুমি অপমান করে তাড়াতে পারবে না। আর আমি যদি থাকি তা হলে পঞ্চুকেও রাখব। ওর মা-হারা সব ছােটো ছােটো ছেলেমেয়ে, তারা পথে বেরােবে, এ তাে আমি দেখতে পারব না। দুদিন আমার কথা চুপ করে শুনলে; হাঁও বলে না, নাও বলে না; শেষকালে আজ দেখি পোঁটলাপুঁটলি বাঁধছে। বললে, আমরা বৃন্দাবনে যাব, আমাদের পথ-খরচ দাও। বৃন্দাবনে যাবে না জানি, কিন্তু একটু মােটারকম পথ-খরচ দিতে হবে। তাই তােমার কাছে এলুম।

আচ্ছা, সে যা দরকার তা দেব।

বুড়িটা লােক খারাপ নয়। পঞ্চু ওকে জলের কলসী ছুঁতে দেয় না, ঘরে এলে হাঁ-হাঁ করে ওঠে, তাই নিয়ে ওর সঙ্গে খুঁটিনাটি চলছিল। কিন্তু ওর হাতে আমার খেতে আপত্তি নেই শুনে আমাকে যত্নের একশেষ করেছে। চমৎকার রাঁধে। আমার উপরে পঞ্চুর ভক্তিশ্রদ্ধা যা একটুখানি ছিল তাও এবার চুকে গেল। আগে ওর ধারণা ছিল, অন্তত আমি লােকটা সরল। কিন্তু এবার ওর ধারণা হয়েছে, আমি যে বুড়িটার হাতে খেলুম সেটা কেবল তাকে বশ করবার ফন্দি। সংসারে ফন্দিটা চাই বটে, কিন্তু তাই বলে একেবারে ধর্মটা খােওয়ানাে! মিথ্যে সাক্ষিতে আমি বুড়ির উপর যদি টেক্কা দিতে পারতুম তা হলে বটে বােঝা যেত। যা হােক, বুড়ি বিদায় হলেও কিছুদিন আমাকে পঞ্চুর ঘর আগলে থাকতে হবে— নইলে হরিশ কুণ্ডু কিছু একটা সাংঘাতিক কাণ্ড করে বসবে। সে নাকি ওর পারিষদদের কাছে বলেছে, আমি ওর একটা জাল মামী জুটিয়ে দিলুম, ও বেটা আমার উপর টেক্কা মেরে কোথা থেকে এক জাল বাবার জোগাড় করেছে; দেখি ওর বাবা ওকে বাঁচায় কী করে।

আমি বললুম, ও বাঁচতেও পারে, মরতেও পারে, কিন্তু এই-যে এরা দেশের লোকের জন্যে হাজার-রকম ছাঁচের ফাঁস-কল তৈরি করছে, ধর্মে, সমাজে, ব্যবসায়ে, সেটার সঙ্গে লড়াই করতে করতে যদি হারও হয় তা হলেও আমরা সুখে মরতে পারব।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress