Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনের এমন দুর্দিন বুঝি আগে কখনও আসেনি।

কী হয়েছে? কারুর অসুখ-বিসুখ?

বালাই ষাট! বাহাত্তর নম্বরে ওসব জ্বালা নেই! শত্তুরেরও ও-সব যেন না হয়।

তাহলে কি অবস্থা খারাপ? চাকরি-বাকরি সব গেছে? মেস চলছে না?

উহুঁ, সে সব কিছু নয়! ভালমন্দ পাঁচজনের শুভেচ্ছায় হিংসেয় মেসের লক্ষ্মী আমাদের অচলা।

তবে হয়েছেটা কী, যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে তাহলে বলতে হয়, হয়েছে আমাদের আহাম্মকির সাজা!

তাতেও না বুঝলে, আর একটু ব্যাখ্যা করে হিতোপদেশের গল্প বলতে হয়।

সেই যে, কে যেন, কোথায়, কাকে যেন কখন, কীভাবে, কেমন করে…

যাক গে! সে গল্প তো সকলেই জানে। সুতরাং দুবার করে বলার মানে হয় না।

আমাদের দুঃখের কথাই বলি।

সাত নম্বর সিট ভর্তি হওয়া থেকেই আমাদের দুঃসময় শুরু। কী কুক্ষণে যে ওই সিটে নতুন বোর্ডার নেবার কুমতি হয়েছিল!

সাত নম্বর সিট ছিল সেই বিখ্যাত বাপি দত্তের—আমাদের মাস কয়েক যে বিগড়ি হাঁসে অরুচি ধরিয়ে শেষে নিজেই বিগড়ে জন্মের মতো মেস ছেড়ে গেছে। বাপি দত্ত আমাদের বাংলা ভাষায় অনেকগুলো নতুন নতুন গালমন্দ শাপমন্যির শব্দ শিখিয়ে চলে যাবার পর ও সিটটা খালিই পড়ে ছিল অনেকদিন। ভেবেছিলাম যেমন আছে, থাক। বাইরের কাউকে আর আমাদের মধ্যে ঢোকাব না।

কিন্তু নিজেদের কপাল দোষে সেই আহাম্মকিই করে ফেললাম।

যাকে-তাকে হট করে ঢুকতে দিইনি। বলতে গেলে বেশ দেখেশুনে বাজিয়েই বোডার নিয়েছিলাম। বাপি দত্তের মতো গোঁয়ারগগাবিন্দ নয়। চেহারায় কথাবার্তায় বেশ নিরীহ ভালমানুষই মনে হয়েছিল। নামেও যেমন ব্যবহারেও তেমনই সুশীল ভেবেছিলাম।

কিন্তু সেই কেঁচোই যে কেউটে হয়ে দাঁড়াবে কে জানত!

প্রথম কয়েকটা দিন সুশীলের স্বরূপ বুঝতেই পারিনি। রোগাপটকা ছোট্টখাট্ট মানুষ, চোখে ঠুলির মতো মোটা কালো ফ্রেমের চশমাটাই যা নজরে পড়ে। সারাক্ষণ মুখ বুজেই থাকে। বিশেষ কারুর সঙ্গে আলাপ-টালাপের চেষ্টা করে না। আমরা সুশীল চাকীকে গ্রাহের মধ্যেই ধরিনি তাই।

ক-দিন বাদে প্রথম কুটুস কামড়টিতেই তাই হকচকিয়ে গেলাম।

সেদিনও শনিবারের সকাল। ঘনাদা আমাদের সঙ্গেই কৃপা করে খাবার ঘরে খেতে বসেছেন। আমাদের ঠাকুর রামভুজ যথারীতি রুই মাছের কালিয়ার জামবাটিটা তাঁর পাতের কাছেই নামিয়ে দিচ্ছে, এমন সময় খুক খুক হাসির শব্দে চমকে উঠলাম।

হাসে কে?

হপ্তার আর পাঁচদিন যা-ই করি, শনি-রবিবারে ঘনাদার কোনও ব্যাপারে হাসা তো কুষ্ঠিতে লেখেনি। হাসির বদলে নেহাত নিরুপায় হলে কাশি একটু-আধটু শোনা যায় বটে!

সন্ত্রস্ত হয়ে এ ওর মুখের দিকে তাকালাম। এমন বেয়াক্কেলে বেয়াদবি কার পক্ষে করা সম্ভব?

ঘনাদার কালিয়ার বাটিও তখন একটুখানি কাত হয়ে থমকে গিয়েছে। আমাদের মুখগুলোর ওপর তাঁর চোখের দৃষ্টি যেন সার্চলাইট বুলিয়ে গেল।

সে-সার্চলাইট যেখানে গিয়ে থামল আমাদের সকলের চোখ সেখানে পৌঁছে একসঙ্গে ছানাবড়া। শ্রীমান সুশীল থালার উপর মাথা নিচু করে নিবিষ্ট মনে খেয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার এঁটো ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসির ঝিলিক তখনও মেলায়নি।

যাকে বলা যায় সংকটজনক মুহূর্ত। আমরা সবাই রুদ্ধশ্বসে অপেক্ষা করছি কী হয় কী হয় ভেবে।

ফাঁড়াটা সে যাত্রা অবশ্য কেটে গেল। ঘনাদা একটা নাসিকাধ্বনি করে তাঁর জামবাটিতে মনোযোগ দিলেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

ব্যাপারটা ওইখানেই চুকে গেলে ভাবনার কিছু ছিল না। কিন্তু সুশীল চাকীকে তখনও আমাদের চিনতে বাকি।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবাই উঠতে যাচ্ছি এমন সময় ছাদের কড়িকাঠগুলোকেই যেন উদ্দেশ করে সে বললে, আমার কাছে ভাল চূরণ আছে। একেবারে লকড়ি হজম পখর হজম। কারুর দরকার হলে দিতে পারি।

দরকার কারুর অবশ্য হল না, কিন্তু তাঁর তেতলার ঘরে উঠবার সিঁড়িতে ঘনাদার বিদ্যাসাগরি চটির যেরকম আওয়াজ শুনলাম, তাতেই বোঝা গেল আমাদের শনি-রবির আসরের দফারফা।

শুধু সেই শনি-রবিই নয়, সেই থেকে সব কটা ছুটির দিনই আমাদের মাঠে মারা যাচ্ছে।

তোড়জোড় করে ঘনাদাকে তাঁর মৌরসি আরামকেদারায় যদি বা কোনও দিন এনে বসাই, শিশিরের সাগ্রহে ধরিয়ে দেওয়া সিগারেটের দুটো টান দিয়েই তিনি উঠে পড়েন।

কারণটা পিছন ফিরেই দেখতে পাই। শ্রীমান সুশীল চাকী ঠোঁটের সেই বাঁকা হাসিটি নিয়ে আমাদের আড্ডা ঘরে ঢুকছে।

উঠছেন কেন ঘনাদা? আমাদের কারুর না কারুর গলা থেকে আর্তনাদ বেরোয়।

ঘনাদার হয়ে সুশীল চাকীই মিছরির ছুরির মতো গলায় জবাব দেয়, আলজিরিয়া কি আইসল্যান্ড যেতে হবে বোধহয়!

আমরা যোবা হয়ে যাই রাগে দুঃখে মনের জ্বালায়।

ঘনাদা সুশীলের দিকে একবার অগ্নিদৃষ্টি হেনে সোজা তাঁর তেতলার ঘরে গিয়ে উঠেন।

এরপর তাঁর ধারে কাছে ঘেঁসে কার এত বড় বুকের পাটা।

এমনই করেই দিন যাচ্ছে। সুশীল চাকী যেন সত্যিকার শনি হয়েই বাহাত্তর নম্বরে ঢুকেছে। সে এ মেসে থাকতে ঘনাদাকে নিয়ে জমিয়ে বসবার আর কোনও আশা নেই।

শনিই তোক আর যা-ই হোক, নিজে থেকে মেস না ছাড়লে মেরে ধরে তো আর তাড়ানো যায় না। আমরা তাই হাল ছেড়ে দিয়ে মেস তুলে দেব কি না তা-ই ভাবতে শুরু করেছি।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা এই রকম মনমরা হয়েই আড্ডা ঘরে নেহাত আর কিছু করবার নেই বলে লুডো খেলতে বসেছিলাম। লুডো অবশ্য নামে। কার পাকা খুঁটি কে কেটে দিল তাতে ক্ষেপও নেই।

আসলে আমাদের মন পড়ে আছে তেতলার সিঁড়িতে। হতভাগা সুশীল চাকী এখনও মূর্তিমান অভিশাপের মতো দেখা দেয়নি। ঘনাদাও নামেননি তাঁর তেতলার টঙ থেকে।

সারাদিন কখনও ঝিরঝির কখনও মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। এমন একটা অপরূপ বাদলার সন্ধ্যায় সুশীল চাকী যদি বাইরে কোথাও ট্রাম বাস বন্ধ হয়ে আটকে পড়ে আর ঘনাদা যদি দৈবাৎ নেমে আসেন এই ক্ষীণ দুরাশায় এক ধামা মশলা-মুড়ি টেবিলের ওপর ধরে রেখেও আমরা লোভ সামলে আছি।

মনে মনে সবারই এক চিন্তা।

গৌরই মুখ ফুটে সেটা প্রকাশ করে ফেললে, বৃষ্টিটা খুব জোরে পড়ছে, কী বলিস? নির্ঘাত রাস্তাঘাটে জল দাঁড়িয়ছে!

হ্যাঁ, ট্রাম বাস কিছুই চলছে না। শিশির দু ছক্কা পঞ্জা ফেলেও আমার দু-দুটো কাটবার খুঁটিকে অকাতরে রেহাই দিয়ে বললে, একবার বাইরে বেরুলে এখন আর ফেরা অসম্ভব।

শিবু নিজের দান ফেলে গৌরেরই একটা খুঁটি চেলে দিয়ে বললে—সুশীল চাকী তখন বেরিয়ে গেল না ছাতা নিয়ে?

একথার উত্তর না দিয়ে সবাই তখন আমরা কান খাড়া করে ফেলেছি। ঘনাদার চটির আওয়াজই পাওয়া যাচ্ছে না সিড়িতে?

হ্যাঁ, ঘনাদাই তো নামছেন!

চট করে মশলা-মুড়ি এক এক মুঠো মুখে দিয়ে আমরা সুড়োয় যেন তন্ময় হয়ে

গেলাম।

কিন্তু ঘনাদার পায়ের আওয়াজ নীচে পর্যন্ত নামবার আগেই মশলা-মুড়ির গ্রাস আমাদের গলায় যেন আটকে গেল। ঘনাদার আগেই ভিজে ছাতাটা বারান্দায় শুকোতে দিয়ে ঘরে ঢুকল স্বয়ং সুশীল চাকী।

সেই বাঁকা হাসি নিয়ে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পরমানন্দে মুড়ির ধামায় হাত ড়ুবিয়ে বললে, আরে ছোঃ! লুডো খেলছেন আপনারা! এ তো নাবালকের খেলা! গোঁফ কামাবার পর কেউ এ-খেলা খেলে!

ভিজে বেড়ালের মতো যে এ মেসে ঢুকেছিল সেই মুখচোরা সুশীল চাকী যে এক মাসেই মুখফোড় মাতব্বর হয়ে উঠেছে তা বোধ হয় আর বলে বোঝাতে হবে না।

খেলায় যেন তন্ময় হয়ে আমরা তার কথাটা গায়েই মাখলাম না। লুডোর ছকের ওপর ঝুঁকে পড়েও আমরা তখন কান রেখেছি সেই বাইরে। ঘনাদা নামতে নামতে থামলেন টের পেলাম। তারপর আমাদের সব আশা চুরমার করে তাঁর পায়ের শব্দ নীচে নেমে মিলিয়ে গেল।

সুশীল চাকীকে এরপর যদি আমরা চাঁদা করে চাঁটি লাগাতাম খুব অন্যায় হত কি?

কিন্তু তা আর পারলাম কই? তার বদলে মুড়ির ধামাতেই হাত লাগাতে হল। সুশীল যে-রেটে হাত আর মুখ চালাচ্ছে তাতে আমাদের সাহায্য ছাড়াই ধামা খালি হয়ে এল বলে।

তুচ্ছ মুড়ি-মশলার প্রতি আমাদের হঠাৎ এই উৎসাহে সুশীল বেশ একটু ক্ষুণ্ণ। বললে, খেলা ছেড়ে দিলেন যে!

আপনি বসে থাকবেন আর আমরা খেলতে পারি! হাতে এক মুঠো আর গালে এক গ্রাস নিয়ে কোনওরকমে জানালাম।

শুন্যপ্রায় ধামাটা আমাদের চারজনের হাতের নাগাল থেকে চট করে সরিয়ে নিয়ে সুশীল বললে, কেন পারেন না! আমি তো খেলি না। শুধু দেখি!

ওঃ, দেখেন! খেলা শুধু দেখেন আর মশলা-মুড়ি সামনে থাকলে খান! শিশিরের কথাগুলো দাঁতে দাঁতে চিপটে যেন চাবুক হয়ে বেরুল।

সুশীল চাকীর তাতে ভ্রক্ষেপ নেই।

খাওয়া আর হল কই! ধামাটা উবুড় করে তবু অম্লানবদনে সে বললে, দাঁতে একটু সুড়সুড়ি না লাগতেই তো ফুরিয়ে গেল! আর এক ধামা আনান!

আনাচ্ছি। শিবু হাত বাড়িয়ে দিলে, একটা আধুলি ছাড়ুন দেখি?

আধুলি! সুশীল চাকী প্রথমে হেসেই খুন। তারপর বললে, আমার মন্তর কী জানেন? আজ ধার কাল নগদ। ট্রাম ভাড়ার বেশি একটি ফুটো পয়সা নিয়ে কখনও বেরোই না। আর আমি বার করব আধুলি আপনাদের ভূত ভোজন করাবার জন্যে! আপনাদের ওই ঘনাদা যাতে এসে ভাগ বসাতে পারেন!

চাপা রাগে তোতলা হয়ে যাবার ভয়ে যখন একথার জবাব দিতে দ্বিধা করছি ঠিক সেই মুহূর্তে নীচের সিঁড়িতে ও কার পায়ের আওয়াজ?

হ্যাঁ, ঘনাদারই! ঘনাদার পায়ের আওয়াজ নীচে থেকে বারান্দায় এসে থামল।

তারপর? সে আওয়াজ কি আবার তেতলার দিকেই উঠবে?

না, ঘনাদা সশরীরে ঘরের ভেতরেই ঢুকলেন। কিন্তু এবার? শ্রীমান সুশীল চাকীকে কোনও মন্তর পড়ে যদি অদৃশ্য করে দিতে পারতাম!

কিন্তু তার দরকার হল না। এ আরেক ঘনাদা যেন! সুশীল চাকীর মতো তুচ্ছ। একটা মশা কি মাছি যাঁর নজরেই পড়ে না।

ঘরে ঢুকে তাঁর আরাম-কেদারাটিতে নিজে থেকে বিনা অনুরোধে গা এলিয়ে দিয়ে বললেন, একটু ভিজে গেলাম হে!

ঘনাদার জামাকাপড়ে জলের ছিটেফোঁটা থাক বা না থাক, আমরা শশব্যস্ত হয়ে উঠলাম।

অ্যাঁ! ভিজে গেলেন!

ঠাকুর, শিগগির গরম গরম চা এক কেটলি।

একটা অ্যাসপিরিন খেয়ে নেবেন?

শিশিরের বাড়িয়ে ধরা টিন থেকে সিগারেট তুলে নিতে নিতে ঘনাদা আমাদের আপ্যায়নে খুশি হয়ে কী বলতে যাচ্ছেন এমন সময়ে আবার সুশীলের সেই ভিমরুলের হুল!

একটা অ্যাম্বুলেন্স ডাকলে হত না? আপনার জন্যেই ডাকাতে বোধ হয় হবে! বলতে পারলে খুশি হতাম। তার বদলে অতিকষ্টে নিজেকে সামলে বললাম, অ্যাম্বুলেন্স? কেন?

বাঃ, বৃষ্টিতে এ রকম ভিজলে হাসপাতাল ছাড়া গতি আছে! হাড় জ্বালানো সেই বাঁকা হাসির সঙ্গে সুশীল চাকী সহানুভূতি জানালে, কী গেরো এখন দেখুন তো! শুধু একটা ছাতা যদি নিতেন!

নিয়েছিলাম। একজনকে দান করতে হল।

আমরা সবিস্ময়ে ঘনাদার দিকে তাকালাম। না, স্বপ্ন নয় সত্যি? ঘনাদা খেপে উঠে। তেতলায় রওনা হননি। নির্বিকার ভাবে সুশীল চাকীর কথার জবাব দিয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছাড়ছেন!

ছাতা আপনি দান করে এলেন! সুশীলের দাঁতে তখনও বিষ আহা কী দয়ার শরীর! নিজের ছাতা পরকে দিয়ে ভিজে আসা..

নিজের ছাতা নয়।ঘনাদার সংক্ষিপ্ত প্রতিবাদে সুশীলের সঙ্গে আমরাও হতভম্ব।

নিজের ছাতা নয়, মানে? এবার সুশীলের গলায় বিষের চেয়ে বিস্ময়ই বেশি, সেই সঙ্গে কেমন একটু সন্দিগ্ধ ভাব।

মানে নিজের ছাতা আমার নেই। বুকিত বরিসানের সিংগালান টাণ্ডিকাট থেকে বিশ বছর আগে একটা লিম্যাক্স ফ্ল্যাভাস বেঁধে ফেলে দেবার পর আর ছাতা কিনিনি।

সুশীল ভ্যাবাচাকা খেয়ে যতক্ষণে মুখের হাঁ বন্ধ করেছে তার আগেই আমরা ঘনাদাকে ঘিরে বসে গেছি।

ছাতাটা তাহলে ফেলে দিতেই হল? গৌর উসকে দেবার ত্রুটি করলে না।

সিগন্যাল ডাউন না কী বললেন! শিশির বোকা সাজল ঘনাদার উৎসাহ বাড়াতে, তাই রেলের লাইনেই ফেলতে হল বুঝি ছাতাটা?

রেলের লাইন নয়, সিংগালান টাণ্ডিকাট! ঘনাদা করুণাভরে সকলের দিকে চেয়ে বললেন, সুমাত্রার একপেশে শিরদাঁড়ার মতো যে-পর্বতমালার নাম বুকিত বরিসান তারই এক বিশাল আগ্নেয়গিরির চুড়ো।

ওঃ, আগ্নেয়গিরি! শিবু এতক্ষণে বুঝদারের ভঙ্গিতে বললে, ওই ছাতা ফেলেই আগ্নেয়গিরির আগুন নিবিয়ে ফেললেন বুঝি??

অন্য দিন হলে এরকম বেয়াদবিতে সব ভেস্তে যেত। কিন্তু ঘনাদা তখন একেবারে মাটির মানুষ।

স্নেহের হাসি হেসে বললেন, না, আগুন নেবাবার দরকার ছিল না। সেটা মরা আগ্নেয়গিরি। ছাতা ফেলেছিলাম…

এতক্ষণে জিভের সাড় ফিরে পেয়ে শ্রীমান চাকী কড়া গলায় জানতে চাইলে, তার আগে একটা কথা বলুন দিকি..

ছাতায় কী যেন একটা বেঁধেছিলেন বললেন? সুশীল চাকীর কথাটাকে তাড়াতাড়ি চাপা দিলাম!

লিম্যাক্স ফ্ল্যাভাস! ঘনাদা যেন চাকীকেই উদ্দেশ করে ওই বিদঘুটে শব্দের পটকাটি ছাড়লেন।

প্রথমে চমকে উঠে চাকী তারপর মুখ চোখ লাল করে বললে, আমায় যদি কিছু বলবার থাকে তো বাংলায় বলবেন।

ওর বাংলা হয় না। ঘনাদার নির্বিকার জবাব, খোলসহীন এক জাতের শামুক দেখেছ কখনও? ভিজে স্যাঁতসেঁতে জায়গায় বড় পাথর কি কাটা গাছের গুঁড়ির তলায় থাকে। ও হল সেই বস্তু। ।

যে বস্তুই হোক ও-সব প্রাণিতত্ত্বের বিদ্যে আপনার কাছে শিখতে আসিনি। আমি জানতে চাই…

চাকীর কথাটাকে আবার চটপট সাইড লাইনে শানটিং করে দিতে হল। ব্যস্ত হয়ে উজবুকের মতো জিজ্ঞাসা করলাম, ওখানে ওইরকম ছাতায় শামুক বেঁধে ফেলতেই বুঝি গেছলেন?

না, গেছলাম ওরাং পেকে খুঁজতে!

চাকী কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঘনাদা তাকে আর সে সুযোগ দিলেন না। আমাদের প্রশ্নটা নিজেই অনুমান করে নিয়ে বলে চললেন, ওরাংওটাং-এর নাম শুনেছ, চিড়িয়াখানাতে দেখেও থাকবে। ওরাংওটাং ওই সুমাত্রা আর বোর্নিও ছাড়া কোথাও পাওয়া যায় না। পৃথিবীতে এখনও যে-চার জাতের এপ বা নরবানর আছে, তার দুটির বাস আফ্রিকায় আর দুটির যাকে ইন্দোনেশিয়া বলে সেই সুদূর দক্ষিণ-পূর্ব প্রাচ্যে। আফ্রিকায় পাওয়া যায় শিম্পাজি আর গোরিলা, আর এই ইন্দোনেশিয়ায় ওরাংওটাং আর গিবন বা উকু। এ চারটি ছাড়া আর কোনও জীবন্ত এপ পৃথিবীতে এখনও পাওয়া যায়নি। কিন্তু অনেক বৈজ্ঞানিকের ধারণা মানুষের এপ জাতীয় অন্য সুদুর জ্ঞাতি এখনও পৃথিবীর কোথাও না কোথাও লুকিয়ে আছে। যেমন আমাদের হিমালয়ের দুর্গম তুষার রাজ্যে ইয়েতি আর সুমাত্রার গহন পাহাড়ি জঙ্গলে ওরাং পেন্ডেক।

ইয়েতির মতো ওরাং পেণ্ডেকও প্রাণী হিসেবে প্রায় লুপ্ত হয়ে এসেছে। জ্যান্ত বা মরা একটা নমুনা কেউ এখনও পায়নি, কিন্তু তারা যে এখনও আছে তার প্রমাণ অজস্র। সুমাত্রার গায়ো, লামপঙ, জাম্বি প্রভৃতি জংলি জাতিদের কাছে ওরাং পেণ্ডেকের বর্ণনা এখনও শোনা যায়। একশো বছর আগেও সুমাত্রার তখনকার প্রভু ওলন্দাজেরা অনেকে এ প্রাণী চাক্ষুষ দেখেছেন বলেছেন।

ওরাং পেণ্ডেক জীবিত কি মৃত একটা পেলে বিজ্ঞানের জগতে হুলুস্থুল পড়ে যাবে সত্যি, কিন্তু যে-অঞ্চলে ও-প্রাণীটিকে পাওয়া সম্ভব সেখানে প্রাণ হাতে নিয়ে ছাড়া তখন যাওয়া যেত না। বিশ-বাইশ বছর আগের কথা। ওলন্দাজেরা তখনও সুমাত্রার রাজা। বুকিত বরিসান, অর্থাৎ সুমাত্রার পর্বতমালার কাছাকাছি অধিকাংশ জায়গাই, তখন দুর্গম বিপদসংকুল। বাঘ হাতি গণ্ডার সাপ তো আছেই। তারপর দুর্দান্ত সব জংলি জাত, যাদের হাতে বিদেশি কারুর নিস্তার নেই।

আমার ও-অঞ্চলে যাবার বছরখানেক আগেই বিখ্যাত নৃতাত্ত্বিক ড. সাপিয়রা ওই অঞ্চলেই নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তিনি ওরাং পেণ্ডেক খুঁজতে ওখানে গেছলেন কি না কেউ জানে না, তবে সেই মহাযুদ্ধের সময়েও ইউরোপের বৈজ্ঞানিক মহলে তাঁর এই অন্তর্ধান নিয়ে বেশ একটু সাড়া পড়েছিল। রথ দেখার সঙ্গে কলা বেচার মতো আমার সুমাত্রার যাওয়ার পেছনে ওরাং পেণ্ডেক খোঁজার সঙ্গে ড. সাপিরোর সন্ধান করার অগিদও ছিল। তার কারণ এই অভিযানে যাবার আগে ড. সাপিয়রা আমায় গোপনে একটি পার্সেল পাঠিয়ে এমন একটি চিঠি লিখেছিলেন যা অগ্রাহা করা আমার পক্ষে অসম্ভব।

নানা জায়গায় খোঁজ করতে করতে তখন রাকান নদী যেখান থেকে বেরিয়েছে সেই পাহাড়ি জঙ্গলে ক-দিনের জন্যে ডেরা বেঁধে আছি। সঙ্গে শুধু তাঁবু বইবার দুজন গায়ো অনুচর। শ্রাবণ মাসের প্রায় মাঝামাঝি। সুমাত্রায় সর্বত্রই সারা বছর যেমন বৃষ্টি আর তেমনই গরম। এই অঞ্চলে শুধু এই সময় মাস দুয়েক গরম থাকলেও বৃষ্টি থাকে না।

রাত তখন বেশি নয়। আলো নিবিয়ে তাঁবুর বাইরে বসে জোনাকির বাহার দেখছি। সুমাত্রার এই জোনাকির তুলনা নেই। রাত্রের আকাশে ঝাঁক বেঁধে তারা যেন রাশি রাশি উড়ন্ত ফুলঝুরি ছড়িয়ে ছড়িয়ে যায়।

হঠাৎ পেছনে দড়ি-দড়া ছিঁড়ে তাঁবুর ওপর কী একটা পড়ে যাবার শব্দ পেলাম।

চমকে উঠে দাঁড়ালাম। সুমাত্রার দু-শিঙওয়ালা গণ্ডারই তাঁবুর ওপর পড়ল নাকি!

টর্চটা জ্বেলে দেখলাম, গণ্ডার নয়, তবে প্রায় সেই রকমই বিশাল যা চেহারার একটি মানুষ! এদেশি কেউ নয়। সাদা চামড়ার সাহেব।

আমার টর্চের আলোয় অত্যন্ত অপরাধীর মতো কুণ্ঠিতভাবে হেঁড়া তাঁবুর ওপর থেকে দাঁড়িয়ে উঠে তিনি বললেন, মাপ করবেন। আপনার তাঁবুটা বোধহয় ছিঁড়ে ফেলেছি।

তা বেশ করেছেন! কিন্তু আপনি কে, আর এখানে আমার তাঁবুর ওপর কী করে ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন জানতে পারি?

আমার নাম বোথা, ভদ্রলোক আমতা আমতা করে জানালেন, আমি ড. সাপিয়োর খোঁজে…

ড. সাপিয়োর খোঁজে! দাঁড়ান। দাঁড়ান! বলে তাঁকে থামিয়ে আমি অনুচরদের ডেকে তাঁবুটা আবার খাটিয়ে আলো জ্বালার হুকুম দিলাম।

তাঁবু আবার খাড়া করে আলো জ্বেলে বোথার সমস্ত বিবরণই তারপর শুনলাম। বোথা আমার মতোই ড. সাপিয়োর খোঁজ করতে এই অঞ্চলের বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বললেন। মজার কথা এই যে, ড. সাপিরোর সঙ্গে তাঁর সহকারি হিসেবেই এ-অঞ্চলে তিনি এসেছিলেন। তারপর এক জায়গা থেকে চলে আসবার সময় দুজনের ছাড়াছাড়ি হয়। সেই থেকে ড. সাপিরোকে বোথা আর দেখেননি। ড. সাপিরোও হয়তো বোথাকে খুঁজে না পেয়ে একা একাই ইউরোপে ফিরে গেছেন মনে করে বোথা তাঁর দেশে ফিরে যান। কিন্তু সেখানে অনেকদিন অপেক্ষা করেও ড. সাপিয়োকে ফিরতে না দেখে আবার সুমাত্রায় এসেছেন খোঁজ করতে।

কিন্তু ড. সাপিয়োর সঙ্গে যেখানে আপনার ছাড়াছাড়ি হয় সে জায়গাটা খুঁজে দেখেছেন তো? আমি একটু অধৈর্যের সঙ্গেই জিজ্ঞাসা করলাম।

সে জায়গাটা পেলে তো খুঁজে দেখব। বোথা অসহায় ভাবে জানালেন।

তার মানে?

তার মানে সেটা সাধারণ কোনও জায়গা নয়, একটা মরা আগ্নেয়গিরির এমন একটা বিরাট গভীর গহ্বর ভেতর থেকে যার চারদিকের খাড়া পাহাড়ে ওঠা মানুষের অসাধ্য! বাইরে থেকে মাথা পর্যন্ত ওঠা গেলেও সেখান থেকে খাড়া ন হাজার ফুট নামা অসম্ভব। বছরের মাত্র ক-টি দিন একটা সংকীর্ণ আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গপথে সেখানে যাওয়া-আসা যায়।

বছরের মাত্র কটা দিন কেন?

কারণ সেটা একটা পাহাড়ি ঝরনার উৎসমুখ। সারা বছর সেখান দিয়ে প্রচণ্ড বেগে জলের ধারা বেরিয়ে আসে। আগস্ট মাসের প্রথম ক-টি দিন মাত্র সে সুড়ঙ্গপথ শুকনো থাকে।

আগস্টের তো আর দেরি নেই। এখনও সুড়ঙ্গপথ আপনি খুঁজে পাননি?

সে-পাহাড়টা না পেলে সুড়ঙ্গটা খুঁজব কী করে! বোথা হতাশ ভাবে বললেন, এখানে সমস্ত বুকিত বরিসনেই ও-রকম বহু মরা আগ্নেয়গিরি আছে বাইরে থেকে যা দেখতে একরকম। কোথায় কোনটা দিয়ে বেরিয়েছি তখন তাড়াহুড়োতে কি অত খেয়াল করেছি! ড. সাপিয়ো যে তার ভেতরে আটকে থাকতে পারেন তা-ও ভাবিনি। অবশ্য ড. সাপিয়রা সেখানেই আছেন কি না এখনও জানি না।

একটু হেসে বললাম, আপনার ভাবনা নেই। তিনি সেখানেই আটকে আছেন। আজই খবর পেয়েছি।

খবর পেয়েছেন! বোথা হতভম্ব হয়ে বললেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে রেডিয়ো-টেডিয়ো কিছু তো নেই!

রেডিয়োর চেয়ে নিশ্চিত খবরই তিনি পাঠিয়েছেন। ওই তাঁর খবর এল আবার।

বাতিটার কাছেই রাখা একটা ছোট কাঁচের বাটির ওপরে দুটো মথ পোকা ঘুর ঘুর করে পাখা নাড়ছিল। তারই একটা ধরে বোথাকে দেখালাম।

একবার মথটার আর একবার আমার মুখের দিকে যেভাবে বোথা তাকালেন, তাতে বুঝলাম, আমার মাথা কতখানি খারাপ, তিনি আন্দাজ করবার চেষ্টা করছেন।

হেসে তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বললাম, এটা কী মথ জানেন? রেশম যারা তৈরি করে সেই বম্বি মোরির চিনে শাখা। সুমাত্রার এই জঙ্গলে ও-মথ কোথাও নেই। সুতরাং নিশ্চিন্ত থাকুন। ড. সাপিয়রা যেখানে বন্দী সে-পাহাড় কাছেই আছে নিশ্চয়। কালই তা খুঁজে বার করব।

কিন্তু, চাকীকে মুখিয়ে থাকতে দেখেও গৌর আমাদের সকলের হয়ে প্রশ্নটা করেই ফেলল, ওই বোম্বে মেরি না কী বললেন, ওই মথ ড. সাপিরোর পোষা বুঝি?

বোম্বে মেরি নয়, বম্বি মোরি। আর পোষা-টোষা কেন হবে! ঘনাদা ধৈর্য ধরেই বোঝালেন, মেয়ে-মথের গায়ে এমন একটা গন্ধ থাকে পুরুষ-মথ সাত মাইল দূর থেকেও যা পেয়ে ছুটে আসে। ওই কাঁচের বাটিতে মেয়ে-মথের সেই গন্ধ জমানো ছিল। ও-গন্ধ এমন যে তার একটি অণু-ই ঠিক বিশেষ জাতের পুরুষ-মথকে টেনে আনবে। ড. সাপিয়রা আমায় তাঁর শেষ পার্সেলে এই রেশমি মথের গন্ধ-জমানো আঁটা শিশি পাঠিয়ে চিঠিতে তার ব্যবহার লিখে জানিয়েছিলেন। সুমাত্রায় জংলিদের হাতে কোথাও বন্দী হবার ভয়ই তাঁর ছিল। তাই কোথায় আছেন জানাবার এমন ফন্দি তিনি করেছিলেন যা জংলিরা ধরতে পারবে না। বছরখানেক তাঁর খবর না পেলে ওই গন্ধসার নিয়ে সুমাত্রায় তিনি আমায় খুঁজে দেখতে অনুরোধ করেছিলেন। তাঁর নিজের সঙ্গে সেই জন্য শুধু রেশমি পোকার গুটি নিয়েছিলেন বেশি করে, যা ফেটে ওই বম্বিস্ মোরি বার হবে।

বোম্বাই বাহাদুরি তো খুব শুনলাম, এখন আমার—ঘনাদা একটু থামতেই চোখ মুখ পাকিয়ে চাকী তাঁকে চেপে ধরবার চেষ্টা করলে।

কিন্তু তার কথা আর শেষ করতে হল না।

তারপর সেই পাহাড়ও পেলাম, সেই সুড়ঙ্গপথও—ঘনাদা গলার জোরেই চাকীকে চেপে দিয়ে শুরু করলেন, জলের শুধু একটু ঝিরঝিরে ধারা তলায় থাকলেও সে আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গপথ যেমন অন্ধকার তেমনই পেছল। কোনও রকমে পা টিপে টিপে দেওয়াল হাতড়াতে হাতড়াতে সে সুড়ঙ্গ পার হতেই এক দিন এক রাত লেগে গেল। অন্ধকারে ওইরকম সুড়ঙ্গে বেশিক্ষণ থাকলে মানুষের মেজাজ বোধ হয় বিগড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। বোথার সঙ্গে অন্ধকারে একবার ঠোকাঠুকি হওয়ার পর তিনি তো খিঁচিয়েই উঠলেন, একটা টর্চ সঙ্গে নিতে পারলেন না। তার বদলে কী সব ছাতা পুঁটলি আজেবাজে জিনিস নিয়ে চলেছেন।

টর্চ তো আপনিও নিতে পারতেন!অন্ধকারে অদৃশ্য বোথার উদ্দেশেই ঝাঁঝিয়ে বললাম, পথ হারিয়ে তো সেদিন আমার তাঁবুতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন। বলেছিলেন, সঙ্গের মালপত্র সব খোয়া গেছে। কিন্তু ওই কী সব সসপ্যান ঝাঁঝরি হাতা গোছের সরঞ্জাম তো ঠিক সঙ্গে আছে দেখছি। ওখানে যজ্ঞির রান্না রাঁধবেন নাকি?

সুড়ঙ্গপথে বোথার একটু মেজাজই শুধু দেখেছিলাম। সেখান থেকে ভেতরে গিয়ে পৌঁছোবার পর তাঁর একেবারে মারমূর্তি।

অপরাধের মধ্যে আমি শুধু বলেছিলাম, আপনি তো এখন ড. সাপিয়োর খোঁজেই ঘুরবেন, আমি তাহলে সোনাদানা যা পাই ততদিনে বাগিয়ে ফেলি।

সোনাদানা! বোথা প্রথমে চমকে উঠে কেমন হতভম্ব হয়ে গেলেন।

বললাম, হ্যাঁ, কুবেরের গুপ্ত ভাঁড়ারের মতো এখানে যে সোনার ছড়াছড়ি মনে হচ্ছে। বালি কাঁকর চালাচালি করে যা বার করবার জন্যে ওই সব প্যান-ট্যান অত কষ্ট করে বয়ে এনেছেন। ওগুলো আমাকেই দিয়ে যান।

তোকে দিয়ে যাব! মরা আগ্নেয়গিরি যেন বোথার ভেতর দিয়েই জ্বলে উঠল, কালা গুবরে পোকা! তোকে দেবার জন্যই এগুলো বয়ে এনেছি।

বাঃ, আমায় দেবেন না! আমি যেন কাঁদো কাঁদোআমি তাহলে কী করতে এখানে এলাম?

শোন তাহলে, আরশোলা, তোকে সঙ্গে এনেছি অন্তত বছর-ভোর এখানে কয়েদ রাখতে। কালই এখান থেকে পালাবার শেষ দিন। আজই না পারি, সোনা জোগাড় করে কাল আমি তোকে ফেলে চলে যাব। বছরভোর যদি টিকে থাকিস আর দিন গুনতে ভুল না করিস, তাহলে আর বছরে আবার এখান থেকে বেরুতে পারবি। ততদিনে এ জায়গায় সোনা তোলবার দখল আমি সুমাত্রার সরকারের কাছে পাকা করে ফেলেছি। তোর জন্যই এ-পাহাড়টা চিনতে পেরেছি বলে তোকে এই প্রাণে বাঁচবার সুবিধেটুকু দিলাম, নইলে তোর মতো ছারপোকাকে এখানে টিপে মেরে যাওয়াই আমার উচিত ছিল।

খুব মন দিয়ে কথাগুলো শুনে কাতর ভাবে বললাম, কিন্তু আমি যে আপনাকেই এখানে এক বছর বন্দী রাখবার ফন্দি এঁটে এলাম। রিখ দেওয়া আপনার ডায়েরিটা সরিয়ে ফেললাম যাতে দিনের হিসেব রাখতে আপনার অসুবিধে হয়..

তুই! তুই আমার ডায়েরি চুরি করেছিস! বোথার মুখ দিয়ে তখন ফেনা উঠছে।

নিজের ঝোলাটা পাগলের মতো খুঁজতে খুঁজতে সে বললে, ডায়েরি যদি না পাই তাহলে তোর হাত-পা আমি একটা একটা করে ছিঁড়ব, তোকে পা বেঁধে ওপর থেকে ঝুলিয়ে আগুনে ঝলসাব। কালা কেন্নো, তোকে…

আহা, সামলে সামলে! বোথাকে ঠাণ্ডা করবার চেষ্টা করলাম, এক বছর এখানে থেকে আরও সব ভাল ভাল শাস্তি কল্পনা করবার অঢেল সময় পাবেন। তারপর বেরিয়ে এসে আমায় খবর দেবেন। তখন আপনার সঙ্গে না হয় আপনার দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন কি জোহান্নেসবার্গে যাব। অন্য কোথাও কালা আদমির ওপর এ এমন সুবিচার করবার সুবিধে তো আর পাবেন না। আপনি যে আসল ওলন্দাজ নন, দক্ষিণ আফ্রিকার–

বোথার ঝোলা খোঁজা তখন শেষ হয়েছে।

আমার ডায়েরি তুই-তুই বলে রাগে তোতলাতে তোতলাতে তিনি খ্যাপা হাতির মতো আমার দিকে তেড়ে এলেন।

আরে! আরে মারবেন নাকি! বলে ছুটে খানিকটা নীচে নেমে গেলাম। তারপর চলল শিকার আর শিকারীর খেলা। তিনি আমাকে ধরার জন্যে তেড়ে আসেন, আমি একটু ছুটে পালাই বা চট করে সরে গিয়ে তাকে পাশ কাটাই।

হাতের কাছে পেয়েও ধরতে না পেরে বোথা তখন রাগে উন্মাদ হয়ে গেছে। কিন্তু উন্মাদের দম আর কতক্ষণ থাকে। বিশাল শরীর নিয়ে আমার পেছনে ছুটে ছুটে ঘণ্টাখানেক বাদে হাপরের মতো হাঁফাতে হাঁফাতে তিনি ক্লান্তিতেই লুটিয়ে পড়লেন।

কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, বড্ড পরিশ্রম হয়েছে, না? একটু জিরিয়ে নিন! কেন যে মিছিমিছি ছোটাছুটিটা করলেন?

বিরাট থাবার মতো হাত দিয়ে খপ করে আমার হাতটা ধরে ফেলে প্রাণপণে টানবার চেষ্টা করে তিনি হিংস্র উল্লাসে এবার বলে উঠলেন, এইবার?

তাঁর হাতটাই তাঁর মাথার ওপর টেনে রেখে বললাম, এবার মাথা ঠাণ্ডা করে যা বলছি শুনুন। কাল নয়, আজই আমি চলে যাচ্ছি। কারণ সুড়ঙ্গপথ কাল আর খোলা থাকবে না। গত দুবছর ধরে বছরে মাত্র দুটি দিন ও সুড়ঙ্গপথ শুকনো থাকে। এখুনি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রওনা হতে না পারলে ওই সুড়ঙ্গে জলের তোড়ে ড়ুবে মরতে হবে।

মিথ্যা কথা! আমার হাতটা হয়রান হয়ে ছেড়ে দিয়ে বোথা গর্জে উঠলেন, তুই! তুই এসবের কী জানিস?

আমি কিছু জানি না। তবে ড. সাপিরো দুবছরে যা জেনেছেন তা-ই বলছি!

ড. সাপিরা! বোথার ফ্যাকাশে মুখ এবার দেখবার মতো।

হ্যাঁ, যাঁর সহকারি হয়ে এসে এখানে সোনার সন্ধান পেয়ে লোভে একেবারে পিশাচ হয়ে উঠেছিলেন।

পকেট থেকে একটা দড়ি বার করে আচমকা বোথার হাত দুটো ধরে ফেলে পিছমোড়া করে বাঁধতে বাঁধতে তারপর বললাম, যাঁকে এমনই করে পিছোড়া করে বেঁধে রেখে সোনার নমুনা নিয়ে একা সুড়ঙ্গপথে পালিয়ে গেছলেন।

কে? কে এসব কথা বলেছে? বোথার গলায় আর যেন তেজ নেই। হাতের বাঁধন খোলবার চেষ্টা করতেও তিনি ভুলে গেছেন।

কে আর বলতে পারে। ড, সাপিরো ছাড়া! হেসে বললাম, আপনার সঙ্গে দেখা হবার আগের দিনই ওই মথ-এর খবর পেয়ে তাঁকে আমি এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে গেছি। তারপর আপনার জন্যই তাঁবু পেতে অপেক্ষা করছিলাম।

আমার জন্য?

হ্যাঁ, আপনি যে সোনার নমুনা নিয়ে দেশে গিয়েছিলেন যাচাই করাতে, তারপর এই কুবেরের ভাণ্ডার ঠিকমতো চিনতে না পেরে এক বছর যে এই অঞ্চলে পাগলের মতো ঘোরাঘুরি করেছেন, সবই আমার জানা। আমার ওপর সন্দিগ্ধ নজর রেখে আমায় একবার বাজিয়ে নিতে আপনি আসবেনই আমি জানতাম। তাই অপেক্ষা করে ছিলাম ড. সাপিয়োকে যা করেছেন তার উপযুক্ত শাস্তি আপনাকে দেবার জন্যে। তবে শাস্তি আর এমন কী! যে সোনার জন্য আপনি সব করতে পারেন, সেই সোনার রাজ্যেই আপনাকে রেখে গেলাম। আশ মিটিয়ে এখন বালি কাঁকর হেঁকে সোনা বার করুন। পিছমোড়া করে যে বাঁধন দিয়েছি ওই ওখানকার পাথরের ধারে ঘণ্টা দুয়েক ঘসলেই সেটা ছিঁড়ে যাবে। ততক্ষণে আমি অবশ্য সুড়ঙ্গপথে অনেক দূর চলে গেছি! আপনার কিন্তু বেরুবার আর তখন সময় থাকবে না।

কথাগুলো বলে চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই বোথা হাঁকুপাকু করে কোনওরকমে উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় ককিয়ে উঠলেন, কিন্তু আমার ডায়েরি নেই। হিসেবে ভুল হলে এক বছর বাদে আমি বার হব কী করে?

বার হবেন না। আর এক বছর না হয় এইখানেই থাকবেন। ড. সাপিরো দু বছর এইখানে কাটিয়েছেন আপনারই শয়তানিতে।

না, না, বোথা যেন ড়ুকরে উঠলেন, আমি সোনা চাই না, কিছু চাই না, আমায়। শুধু এখান থেকে বেরুতে দাও।

বেশ, বেরুতেই পারবেন। আমি হেসে বললাম, কিন্তু এক বছরের আগে তো হয় না। ও শাস্তি আপনার পাওনা। এক বছর বাদেই যাতে বার হতে পারেন তার ব্যবস্থা করছি।

কী ব্যবস্থা? বোথা হতাশভাবে জিজ্ঞাসা করলেন।

এই ছাতাটা দেখছেন? ছাতাটা খুলে ধরে বললাম, আর ওই পাহাড়ের দেওয়ালের পুব দিকের মাথাটা দেখুন।

আমি যেন তাঁর সঙ্গে নির্মম পরিহাস করছি এইভাবে বোথা একবার ছাতাটা আর একবার পাহাড়ের মাথার দিকে চাইলেন।

হেসে আবার বললাম, ভয় নেই, আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করছি না। এ পাহাড়ের ভেতর দিকটা এমন খাড়া যে ওঠা অসাধ্য, কিন্তু বাইরের দিকটা ঢালু। সেখান দিয়ে উঠে ওই পুব দিকের মাথা থেকে এই খোলা ছাতাটা নীচে ফেলব। সেই ছাতায় বাঁধা থাকবে বছর হিসেব করবার নির্ভুল জ্যান্ত ঘড়ি।

বছর হিসেব করবার জ্যান্ত ঘড়ি! বোথা হতভম্ব।

হ্যাঁ, লিম্যাক্স ফ্ল্যাভাস-খোলসহীন এক জাতের শামুক। পৃথিবীতে প্রলয় হতে পারে, তবু ওই প্রাণীটি বছরে একবার ঠিক পয়লা কি দোসরা আগস্ট ডিম পাড়বেই। ছাতা থেকে খুলে নিয়ে ওই শামুকের ওপর নজর রাখবেন। তারিখ ভুল আর হবে না।

বোথা যত বড় শয়তানই হোক, তাকে যা কথা দিয়েছিলাম তা রেখেছিলাম। কুড়ি বছর আগে পাহাড়ের চূড়া থেকে লিম্যাক্স ফ্ল্যাভাস বেঁধে সেই যে নিজের ছাতাটা মরা আগ্নেয়গিরির তলায় ফেলে দিয়েছিলাম তারপর আর ছাতা কিনিনি।

কথা শেষ করেই ঘনাদা শিশিরের সিগারেটের টিনটা অন্যমনস্কভাবে হাতে নিয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ালেন।

চাকী ফাঁক পেয়ে পেছন থেকে চিৎকার করে উঠল, নিজের তো নেই, আজ কার ছাতা তাহলে দান করে এলেন শুনি?

জানি না। ঘনাদা তেতলার সিঁড়িতে উঠতে উঠতে বলে গেলেন।

তারপর হুলুস্থুল ব্যাপার। চাকী সঙ্গে সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে আর্তনাদ করে উঠল, আমার ছাতা! আমার ছাতা এখানে শুকোতে দিয়েছিলাম!

সবাই মিলে তাকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে গেলাম।

ওঃ, আপনার ছাতাটাই গেছে বুঝি? কার যে কখন কী যাবে কিছু ঠিক নেই। এখানে।

তার মানে?চাকী চিড়বিড়িয়ে উঠল, যে যারটা যখন খুশি নিয়ে যাবে! আবার দান করেও আসবে!

দুঃখের সঙ্গে জানালাম, এ মেসে ও-ই নিয়ম!

চাকী দুমাসের অগ্রিম টাকা রিফান্ড নিয়ে মেস ছেড়ে গেছে।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *