মাঝারি সাইজের বৈঠকখানা
তিনজনে ঢুকলাম ভিতরে। একটা মাঝারি সাইজের বৈঠকখানা। দরজার উলটো দিকে একটা সোফা, তার কাপড়ের ঢাকনির তিন জায়গায় ফুটা দিয়ে নারকোলের ছোবড়া বেরিয়ে আছে। সোফার সামনে একটা শ্বেতপাথরের টেবিল;-এখন শ্বেত বললে ভুল হবে, কিন্তু এককালে তাই ছিল। বাঁয়ে একটা কালো প্রাচীন বুক কেস, তাতে গোটা পনেরো প্রাচীন বই। বুক কেসের মাথায় একটা পিতলের ফুলদানিতে ধুলো জমা প্লাস্টিকের ফুল, সে ফুলের রং বোঝে কার সাধ্যি। দেয়ালে একটা বাঁধানো ছবি, সেটা ঘোড়াও হতে পারে, রেলগাড়িও হতে পারে, এত ধুলো জুমেছে তার কাচে। যে ফিলিপস রেডিওটা সোফার পাশের টেবিলের উপর রাখা রয়েছে সেন্টার মডেল নিৰ্ঘাত ফেলুদার জন্মেরও আগের। আশ্চর্য এই যে সেটা এখনও চলে, কারণ সেটা থেকেই গানের শব্দ আসছিল। এখন একটা শিরা-বার-করা ফ্যাকাসে হাত নব ঘুরিয়ে গানটা বন্ধ করে দিল। যার হাত, তিনি সোফার এক কোণে একটা কুশন কোলে নিয়ে বাঁ পা-টা, একটা মোড়ার উপর তুলে দিয়ে বসে মিটমিট করে আমাদের দিকে চাইছেন। এর শরীরে যে সাহেবের রক্ত আছে সেটা চামড়ার রং থেকে বোঝা যায়, আর চুলের যেটুকু পাকা নয় তার রং কটা। চোখটা যে কীরকম সেটা বুঝতে পারছি না, কারণ ছাত থেকে ঝোলানো যে বাতিটা জুলছে সেটার পাওয়ার পচিশের বেশি নয়।
আমি গাউটে ভুগছি, তাই চলাফেরা করতে পারি না, ইংরিজিতে বললেন সাহেব। আই হ্যাভ ঢুঁ টেক দ্য হেল্প অফ মাই সারভেন্ট। সে শুয়োরটা আবার ফাঁক পেলেই সিটকায়।
ফেলুদা এবার পরিচয়ের ব্যাপারটা সেরে নিল। ভদ্রলোক আমরা আসতে বিরক্ত হলেও সেটা এখনও প্রকাশ করেননি। ফেলুদা কাজের কথায় চলে গেল।
আমি শুধু একটা খবর জানতে এসেছি। আপনি কি টমাস গডউইনের বংশধর-যিনি উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ভারতবর্ষে এসেছিলেন?
সাহেব মাথাটা আর একটু তুললেন। এবারে বুঝলাম তার চোখের রং ঘোলাটে নীল। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টে ফেলুদার দিকে চেয়ে থেকে বললেন, নিউ হাও দ্য হেল ডিড ইউ নো অ্যাবাউট মাই গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার?
তা হলে আমার অনুমান ঠিক?
শুধু তাই নয়; আমার কাছে এমন একটা জিনিস আছে। যেটা খোদ টমাস গড়উইনের সম্পত্তি। অন্তত আমার ঠাকুমা তাই বলতেন। দেড়শো বছরের-ও হেল!
কী হল?
দ্যাট স্কাউন্তের্ভুল অ্যারাকিস–ঠক, জোচোর! কালই রাত্রে ওটা চেয়ে নিয়ে গেছে। বলেছে। আজ ফেরত দেবে। আজই ওদের মিটিং বসবে। আজ বিষ্যুদবার তো? একটু পরেই শুনতে পাবে মাথার উপরে সব উদ্ভট আওয়াজ।
মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছে বলেই বোধ হয়। ঘরটা আরও অন্ধকার লাগছে; কিংবা হয়তো সত্যি করেই রাত হয়ে আসছে। না, মেঘ ডাকল। আকাশে মেঘ করেছে, তাই অন্ধকার।
ফেলুদা মিঃ গডউইনের সামনে একটা হাতলভাঙী চেয়ারে বসেছে। তার ডান পাশে আরামকেদারায় জটায়ু। আরাম খুব হচ্ছে না, কারণ উসখুসে ভাব দেখে মনে হয় ছারপোকার কামড় খাচ্ছেন। আমি বসেছি বাঁয়ে একটা চেয়ারে। ফেলুদা চেয়ে আছে একদৃষ্টে সাহেবের দিকে; ভাবটা-তুমি যা বলতে চাও বলো, আমি শুনতে এসেছি।
ইটস অ্যান আইভরি কাসকেট, বললেন মিঃ গডউইন।ভেতরেও জিনিস আছে। দুটো পুরনো পাইপ, একটা রুপোর নাস্যির কোটা, একটা চশমা, আর সিন্ধে মোড়া একটা প্যাকেট।
ভেতরে বইটই আছে বলে মনে হয়; কোনওদিন খুলিনি। আরও সব ছিল বাড়িতে পুরনো জিনিস; আমার বাউণ্ডুলে ছেলেটা সব বেচে দিয়েছে। পড়াশুনোয় জলাঞ্জলি দিয়ে গাঁজা ধরল, আর তারপরেই ঘর থেকে এটা-ওটা সরিয়ে ফেলতে শুরু করল। বাক্সটা যে কেন নেয়নি জানি না। হয়তো নিত; কপাল ফিরে গেল তাই নেবার দরকার হয়নি। বাজনার দল করেছে একটা। তার রোজগারেই চলছে এখন—যদি চলা বলো এটাকে। ছেলেকে আর দোষ দিই। কী করে? আমারই কি কম দোষ? শুনেছি টম গডউইন জুয়ো খেলে সর্বস্ব খুইয়েছিলেন। আমারও তাই।…
ভদ্রলোক একটু থামলেন। হাঁপাচ্ছেন। বোধহয় একটানা এত কথা বলে। বাতের যন্ত্রণাতেই বাধ হয় একবার মুখটা বেঁকে গেল। তারপর আবার কথা।–
একবার বিলেত গিয়েছিলাম। ইয়ং বয়সে। ছোট কাকা ছিল লন্ডনে, মিডল্যান্ড ব্যাঙ্কে ক্যাশিয়ারি করত। তিন মাসের বেশি থাকতে পারিনি। শীত সহ্য হয়নি। খানা সহ্য হয়নি। ডালভাতের অভ্যোস। ফিরে এলাম ক্যালকাটা। বিয়ে করলাম। বউ মরেছে। দশ বছর আগে। এখন আছে ক্রিস্টোফার। মুখ দেখি দিনে একটিবার হয়তো; কি তাও না। পাশের ঘরে বসে গিটারে ট্যাং ট্যাং করে। হাত ভাল।
মাথার উপরে সত্যিই একটা অদ্ভুত আওয়াজ শুরু হয়েছে। খটখট—খটখট। হচ্ছে আবার থামছে, ঘরের ছায়াগুলো দুলছে, কারণ খাট খটের সঙ্গে সঙ্গে সিলিং-এর বাতিটা দুলতে আরম্ভ করেছে। এখন আর শুধু লালমোহনবাবু না; আমারও ভয় করছে। এরকম বাড়িতে, এরকম ঘরে কখনও আসিনি; এরকম মানুষের মুখে এরকম কথা কখনও শুনিনি। কী ব্যাপার হচ্ছে ওপরের ঘরে?
গডউইন সাহেব ওপরে না তাকিয়েই বললেন, টেবিলটা লাফাচ্ছে। চার ব্যাটা ভণ্ড টেবিলটাকে ঘিরে বসেছে। বলে মরা লোকের আত্মা নামায় ওরা, আর যেই সে আত্মা আসে অমনি টেবিলটা ছটফট করতে শুরু করে।
ওরা কারা? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
অ্যারাকিসের দল। প্ৰেতচৰ্চা সমিতি। দুটো ইহুদি, একটা পার্শি, আর অ্যারাকিস। আমাকে দলে টানতে চেয়েছিল, আমি যাইনি। এক’দিন অ্যারাকিসের কাছে টমাস গডউইনের কথা বলেছিলাম। বললে, তোমাকে তার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেব। আমি বললাম—নো, সার্টেনলি নট। আজ বাদে কাল এমনিতেই তার সঙ্গে দেখা হবে। তারপর কাল এসে বললে—
ভদ্রলোক থামলেন। খট খট খট। আবার টেবিল লাফাচ্ছে।
কিন্তু বাক্সটা কেন নিল আপনার কাছ থেকে? প্রশ্ন করল ফেলুদা।
সেটাই তো বলছি। বললে, আমরা তোমাকে ছাড়াই গডউইনের আত্মা নামাব। তার নিজের জিনিস কিছু থাকলে দাও, সেটা টেবিলের উপর রাখলে আত্মা সহজে নামবে। আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে তিনি নেমেছেন।
খট খট খট…আবার টেবিল লাফাল।
ব্যাপারটা কি অন্ধকারে হয়? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
সব বুজরুকিই তো অন্ধকারে হয়।—গডউইনের গলার স্বরে বিদ্রুপ।
একবার উপরে যাওয়া যায়?
লালমোহনবাবু প্রশ্নটা শুনেই চেয়ারের হাতল খামচে তাঁর আপত্তি জানিয়ে দিয়েছিলেন। গডউইন সাহেবের উত্তরে তিনি অনেকটা আশ্বস্ত হলেন।
ও ঘরে তামায় ঢুকতে দেবে না, বললেন মিঃ গডউইন। ফর মেমবারসওনলি। ওর চাকর পাহারা দেয়। তবে কেউ যদি কারুর আত্মা নামাতে চায় ওদের সাহায্যে, তো সে আলাদা কথা। আগাম বিশ টাকা, আত্মা নামলে আরও একশো।
আই সি…
ফেলুদা উঠে পড়ল।আচ্ছা, মিস্টার গডউইন। অনেক ধন্যবাদ। আপনাকে বিরক্ত করে গেলাম, কিছু মনে করবেন না।
গুড নাইট।
গডউইন সাহেবের শীর্ণ হাত আবার রেডিওর দিকে চলে গেল।
ল্যান্ডিং-এ এসে ফেলুদা যেটা করল সেটা আমাকে হকচাকিয়ে দিল, লালমোহনবাবুর যে কী দশা হল সেটা অন্ধকারে বুঝতে পারলাম না। ফেলুদা নীচে না গিয়ে সটান তিনতলায় রওনা দিল।
আপ-ডাউন গুলিয়ে ফেললেন নাকি? ব্যস্তভাবে প্রশ্ন করলেন জটায়ু। উত্তর এল, চলে আসুন, ঘাবড়াবেন না।
উপরে উঠেই সামনে লুঙ্গি পরা দারোয়ান।
আপ কিসকো মাংতে হ্যায়?
আমি শুধু তোমার প্রয়োজন মেটাতে এসেছি ভাই!
ফেলুদা অ্যারাকিস সাহেবের দারোয়ানের দিকে একটা পাঁচ টাকার নোট এগিয়ে দিয়েছে। লোকটা থাতমত। ফেলুদা তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, তোমার মনিব যে-ঘরে বসেছেন। সেটা এখন চারদিক থেকে বন্ধ কি না সেটা আগে বলো।
ওষুধ ধরেছে বোধহয়। চাকর বলল কারান্দার দিক থেকে বন্ধ, কিন্তু শোবার ঘর দিয়ে দরজা আছে ঢোকার; সেটা খোলা।
তোমার কোনও চিন্তা নেই—কিছু করতে হবে না—শুধু একবারটি শোবার ঘরটা দেখিয়ে দাও। নইলে বিপদ হবে। আমরা পুলিশের লোক। ইনি দারোগা।
লালমোহনবাবু পায়ের বুড়ো আঙুলে দাঁড়িয়ে হাইটটা ঝাঁট করে দু ইঞ্চি বাড়িয়ে নিলেন। এ ল্যান্ডিং-এ বাতি আছে। ফেলুদা নোটটা আর একটু এগিয়ে একেবারে দারোয়ানের হাতের তেলোতে ঠেকিয়ে দিল। তেলোটা আপনা থেকেই নোটের উপর মুঠো হয়ে গেল।
আইয়ে—লেকিন…
লের্কিন-টেকিন ছাড়ো ভাই! তোমার মনিবের বন্ধুদের একজনের ওপর পুলিশের সন্দেহ, তাই যাওয়া দরকার। তোমার সাহেবের বা তোমার কিচ্ছু হবে না।
আইয়ে।
শোবার ঘর অন্ধকার, আর তার একটা খোলা দরজার ওদিকে যে ঘর, সেও অন্ধকার। আমরা তিনজনে সেই দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলাম।
প্ল্যানচেটের ঘর থেকে এখন কোনও শব্দ নেই। তবে একটু আগে পর পর তিনবার টেবিলের পায়ের শব্দ পেয়েছি। বুঝতে পারছি ভূত নামানোর ক্লাবের সদস্যরা সব দম বন্ধ করে টমাস গডউইনের আত্মার জন্য অপেক্ষা করছেন। লালমোহনবাবু এত জোরে আর এত দ্রুত নিশ্বাস ফেলছেন যে ভয় হচ্ছে তাতেই পাশের ঘরের সবাই আমাদের অস্তিত্ব টের পেয়ে যাবে। ফেলুদা ইতিমধ্যে বোধহয় দরজার আরও কাছে এগিয়ে গেছে। কোথেকে যেন কেরোসিন তেলের গন্ধ আসছে। একবার শুনলাম একটা বেড়াল ম্যাও করল। বোধহয় দোতলার সেই কালো হুলোটা।
ট—মাস গডউইন! ট—মাস গডউইন।
গোঙানির মতো স্বরে নামটা দুবার উচ্চারিত হল। বুঝলাম। এইভাবেই এরা আত্মাকে ডাকে।
আর ইউ উইথ আস? আর ইউ উইথ আস?
কোনও সাড়া নেই, কোনও শব্দ নেই। প্রায় আধ মিনিট হয়ে গেল। তারপর আবার সেই কাতর প্রশ্ন–
টমাস গডউইন.আর ইউ উইথ আস?
ইয়ে-স! ইয়ে-স!
আমার ডান পাশেও পায় ঠক ঠক করে কাঁপছে। টেবিলের নয়, মানুষের। লালমোহনবাবুর হাঁটু।
ইয়েস। আই হ্যাভ কাম! আই অ্যাম হিয়ার!
হিয়ার বললেও মনে হয় বহু দূর থেকে আসছে গলার স্বরটা।
প্ল্যানচেটের দল আবার প্রশ্ন করল।
তুমি কি সুখে আছ? শান্তিতে আছ?
উত্তর এল-নো-ও!
কী দুঃখ তোমার?
প্রায় আধ মিনিট সব চুপ। তারপর আবার প্রশ্ন করল অ্যারাকিসের দল।
কী দুঃখ তোমার?
আই…আই…আই…ওয়ন্ট মাই…আই ওয়ন্ট মাই…কাসকেট।
এর পরেই একসঙ্গে কতকগুলো অদ্ভুত ব্যাপার। পাশের ঘর থেকে এক ভয়াবহ চিৎকার, আতঙ্কের শেষ অবস্থায় যেটা হয়—আর পরমুহূর্তেই আমার হাতে একটা হ্যাঁচকা টান আর কানের কাছে ফিসফিস—চলে আয়, তোপ্সে!
অ্যারাকিসের চাকর আমাদের তিনজনকে ছুটে বেরোতে দেখে যেন আরও হতভম্ব হয়ে কিছুই করল না। এক মিনিটের মধ্যে তিনজনে রিপন লেন পেরিয়ে রয়েড ষ্ট্রিটে রাখা আমাদের গাড়িটার দিকে এগোতে লাগলাম।এ এক খেল দেখালেন মশাই বললেন লালমোহনবাবু। এ জিনিস ফিল্মে দেখালে সুপারহিট।
লালমোহনবাবুর তারিফের কারণ আর কিছুই না; ফেলুদার হাতে এসে গেছে সাদত আলির দেওয়া টমাস গডউইনের আইভরি কাসকেট।