Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গোমুখ্যু গরু || Sanjib Chattopadhyay

গোমুখ্যু গরু || Sanjib Chattopadhyay

গোমুখ্যু গরু

বড়মামার ডাক্তারি এবার মাথায় উঠবে। রুগিরা ভীষণ অসন্তুষ্ট। যার পরপর তিনটে ইঞ্জেকশান পড়ার কথা তিনি একটা নিয়ে দিনের পর দিন আসছেন আর ফিরে ফিরে যাচ্ছেন। চেম্বারে ডাক্তারবাবু নেই। সেদিন একজন স্পষ্টই বললেন, কুলপুরোহিত আর পরিবারের ডাক্তারকে যদি সময়মতো পাওয়া না যায় তাহলে অন্য ব্যবস্থার কথা ভাবতেই হয়।

মেজোমামা বললেন, ‘অ্যাদ্দিন ছিল ডাকসাইটে ডাক্তার, শেষ বয়েসে হয়ে গেল জেলে। কার। বরাতে কখন কী যে হয়ে যায়! তাও যদি দু-একটা মাছের মুড়ো পাতে দেখা যেত! এমন নিরামিষ বৈষ্ণব জেলে খুব কমই দেখা যায়!’

যে যাই বলুন, আমার ভীষণ মজা। দিন বেশ কাটছে। বড়মামাকে ওই জন্যই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। যখন যা মাথায় ঢোকে তখন তাই করে ফেলেন। কারুর পরোয়া করেন না। ঠিক আমার। মতো। লাটু ঘোরাব তো সারাদিন লাটুই ঘোরাব। অঙ্কে গোল্লা। দুটো দিক তো একসঙ্গে সামলানো যায় না। সেবার গুলিতে পেয়েছিল। ইতিহাসে কোনওরকমে টায়ে-টোয়ে তিরিশ। মেজোমামা রেজাল্ট দেখে ধেই-ধেই করে নাচতে লাগলেন। বড়মামা বললেন, ‘ব্যাটা আমার সাচ্চা ভাগনে।’ এবারের পরীক্ষায় কী হবে মা সরস্বতীই জানেন! বড়মামা যেভাবে নাচাচ্ছেন, আমি কী করব! গুরুজনের কথা কি অমান্য করা চলে! সকলে বলবে, বড় অবাধ্য! উঠোনের এক পাশে মামা-ভাগনে থেবড়ে বসে আছি। ভীষণ কেরামতি চলেছে। দু-পাউন্ড রুটি পিঁপড়ের ডিম দিয়ে চটকানো হয়ে গেছে। বিশু রান্নাঘরে কুঁড়ো আর খোল ভাজছে। গন্ধে বাড়ি ম-ম করছে। এক বোতল তাড়ি ভীষণ অসুবিধেয় ফেলেছে। গন্ধটা তেমন সুবিধের নয়। নারকেলের মালায় কেঁচো কিলবিল করছে। আস্ত একটা বোলতার চাক ডিমসুদ্ধ খবরের কাগজে শুয়ে আছে। কাগজটা মনে হয় আজকের। কারণ মেজোমামা অনেকক্ষণ দোতলায় ‘কাগজ কাগজ’ করে অস্থির হচ্ছেন। মেজাজ ক্রমশই চড়ছে। মাসিমা শান্ত করার চেষ্টা করছেন; বলছেন, ‘আজকাল কাগজ দিতে খুব দেরি করে। লোডশেডিং হয় তো।’

বড়মামা বলছেন, ‘আমার নাকে রুমালটা বেঁধে দে তো, তাড়ি ঢালব।’ বিশুদার কুঁড়োভাজা এসে গেছে। গন্ধে আমার জিভেই জল এসে যাচ্ছে, মাছের যে আজ কী অবস্থা হবে! মেজোমামা ঠিকই বলেন, ডাক্তারের ভিটামিনযুক্ত টোপ খেয়ে মাছেরা স্বাস্থ্যবান হচ্ছে, এর পর ডাক্তারকে আর মাছ ধরতে হবে না, মাছেরাই ডাক্তার ধরবে। তাড়িপর্ব শেষ হল। বিশুদা বাইরে থেকে এসে বললে, ‘একজন রুগি খুব হম্বিতম্বি করছেন, বলছেন, স্ত্রী মরো মরো, না গেলে ঠেঙাবে।’

বড়মামা বললেন, ‘ঠেঙাবে কী রে?’

‘হ্যাঁ বাবু, ঠেঙাতেও পারে। আজকাল রুগিরা ডাক্তারদের কথায় কথায় দ্যাখ-মার করছে।’ ‘কী

হবে বিশে! আমার তো আর দেরি করা চলে না। তুই বরং এক কাজ কর, আমার জামার। বুকপকেট থেকে দশটা টাকা নিয়ে ওকে দিয়ে বল, ভোলা ডাক্তারকে ধরে নিয়ে যেতে। আমার হার্ট-অ্যাটাক হয়েছে।’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।

‘আমার কী হয়েছে বিশু?

‘আজ্ঞে হার্ট অ্যাটাচ।’

‘গর্দভ, অ্যাটাচ নয়, অ্যাটাক।’

বিশু চলে যেতেই বড়মামা বললেন, ‘নে নে, তৈরি হয়ে নে। মাছের খাবার তো হল। এবার আমাদের সারাদিনের ব্যবস্থা। কুসি, কুসি।’

বড়মামা মাসিমার খোঁজে ভেতরে চলে গেলেন। ন’টার সাইরেন বাজতে না বাজতেই আমাদের যাত্রা শুরু হল।

বড়মামার মাথায় শোলার টুপি। কাঁধে বিলিতি ছিপ। সে ছিপ আবার ইচ্ছেমতো বড় ছোট করা যায়। মোটরবাইকে যাওয়া চলবে না। শব্দে রুগিরা টের পেয়ে যাবেন। ডাক্তার বেশ ভালোই আছে। সাইকেলই আমাদের বাহন। নিঃশব্দে পাড়া ছেড়ে একবার বড় রাস্তায় পড়তে পারলে। আমাদের আর পায় কে! বড়মামার সাইকেল চালানোর ভঙ্গি দেখলে মনে হবে, আমরা যেন কুখ্যাত আলকাট্রাজ জেল ভেঙে পলাতক দুই আসামী।।

পুকুর না বলে দিঘি বলাই ভালো। বলা নেই কওয়া নেই বড়মামা ইজারা নিয়ে বসে আছেন।। ফাঁকা মাঠের মাঝখানে বেওয়ারিশ পড়ে আছে। পাঁচিল-টাচিল দিয়ে কোনওদিনই ঘেরা যাবে না, এত বিশাল ব্যাপার। চারপাশে গাছপালা আছে। আম, জাম, কাঁঠাল, জামরুল, তাল, খেজুর, সুপারি। মেজোমামা বলেছিলেন, ‘জমা নিচ্ছ নাও, তবে মাছ আর আমাদের চোখে দেখতে হবে না, পাবলিকেই ফাঁক করে দেবে!’

বড়মামা বলেছিলেন, ‘নিজের জন্যে তো অনেকদিন বাঁচা গেল, এবার না-হয় পরের জন্যে কিছুদিন বাঁচি।’

সাইকেল থেকে জিনিসপত্র নেমে এল। শতরঞ্জি, জলের ফ্লাস্ক, মাছের খাবার, আমাদের খাবার, এক জোড়া ছিপ, জল থেকে মাছ তোলার জাল, একটা রংবেরঙের ছাতা, মোটা একটা লাঠি, একতাল দড়ি।

আমরা যে-জায়গায় বসব সেই জায়গায় লাঠি পুঁতে ছাতাটাকে বেশ করে দড়ি দিয়ে বাঁধা হল। একটু ছায়া চাই। চারপাশে রোদ খাঁ-খাঁ করছে। ভিজে ভিজে ঘাসের ওপর ডোরাকাটা শতরঞ্জি পড়ল। চারে মাছ না এলেও চোখে ঘুম এসে যাবে। কাল তাই হয়েছিল, একপাশে বড়মামা আর একপাশে ভাগনে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। তেঠেঙার ওপর ছিপও ঘুমোচ্ছে। স্থির ফাতনার ওপর ফড়িং ঝিমোচ্ছে। মাছেদেরও সেই এক অবস্থা, তাড়ি চটকানো চার খেয়ে বেহুশ শুয়ে রইল দিঘির তলায় পাঁকের বিছানায়।

বড়মামা বললেন, ‘নে, চা কর। আমি একটু চা খেয়ে নি। প্রকৃতি যেন হাসছে রে, প্রকৃতি যেন খিলখিল করে হাসছে, কাল থেকে একটা তাকিয়া আনতে হবে।’

‘সাইকেলে কি আর তাকিয়া আনা যাবে?

‘খুব যাবে। চিন দেশে সাইকেলে সংসার বয়ে বেড়ায়। সাহস চাই, কায়দা জানা চাই।’

কৌটো খুলে জলে চার ফেলতে লাগলুম। একটা ব্যাঙের তেমন পছন্দ হল না। তিড়িক করে লাফ মেরে জলে চলে গেল। ব্যাঙ ভালো সাঁতার জানে। মাঝ-পুকুরে কে ঘাই মারল।।

বড়মামা আনন্দে আটখানা হয়ে বললেন, ‘আসছে, আজ আমাদের ওইটাই টার্গেট। ঘাই দেখে মনে হচ্ছে কেজি-দশেক হবে। মৃগেল। মাথাটা মেজোকে দোব, কী বলিস? কুসিকে ন্যাজাটা। মেয়েরা ন্যাজা খেতে ভালোবাসে।’

‘আজ পর্যন্ত একটাও তো ধরতে পারলেন না বড়মামা?’

‘দাঁড়া। মাছেদের লজ্জা ভাঙুক। মাছেরা একটু লাজুক হয়। তাছাড়া জানিস তো, মনে হিংসে থাকলে জীবজগৎ দূরে সরে যায়। মাছভাজা খাব, মাছভাজা খাব—এই লোভ নিয়ে বসলে, মাছ কেন একটা ব্যাঙও তোমার চারে আসবে না।’

‘তাহলে আজ আমরা আলু-ভাতে খাব, আলু-ভাতে খাব—এই ভাব নিয়ে বসি।’

‘কোনওরকম খাবার চিন্তা মাথায় আনবি না। মনে কর আমরা উপবাসী ব্রাহ্মণ কিংবা রোজা করা মুসলমান।’ বড়মামা খুব কায়দা করে মাথার ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে ছিপ ফেলতে গেলেন। আমডালে বঁড়শি আটকে ছিপ হাতছাড়া হয়ে গেল। হাত-দুয়েক ওপরে ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো ছিপ দুলছে। হুইলটা তো কম ভারী নয়!

আমাদের হাইজাম্পের মহড়া চলেছে। নিতাই, গৌর, রাধেশ্যাম—দু-হাত তুলে মারো লাফ। আমপাতা, আমডাল সবসুদ্ধ নিয়ে ছিপ আবার ফিরে এল মালিকের হাতে।

বড়মামা বললেন, ‘বড় শুভ লক্ষণ। আম্রপল্লব শিকার করে উদ্বোধন। এবার যখন ছিপ ফেলব তুই তখন মাথার দিকটা একটু সামলে দিস তো। আকাশের ওপর আমাদের কোনও অধিকার নেই।’

‘তাহলে আপনি একটু বাঁ-পাশে সরে আসুন। মাথার ওপর একগাদা ডালপালা ঝুলছে। আবার আটকে যাবে।’

বড়মামা সরে আসতে আসতে বললেন, ‘গাছের স্বাধীনতা আকাশে।’

ঘুরিয়ে ছিপ ফেললেন। এবার বেশ ফেলেছেন। সুতোয় টান মেরে ফাতনাটা সোজা করে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একটা ফড়িং এসে বসে পড়ল।

বড়মামা আয়েস করে বসে পড়লেন, ‘নে আয়, এবার স্যান্ডউইচ খাওয়া যাক।’

‘এর মধ্যে খাওয়াখায়ি শুরু করলেন? সারাটা দিন পড়ে আছে।’

‘থাক না, এটা তো টেস্ট কেস। কুসি কেমন করেছে দেখতে হবে না! চোখের দেখা নয়, চেখে দেখা। বুঝলি, আমি ভাবছি—’

‘কী ভাবছেন বড়মামা?’

‘এই মাছধরা আর রুগি দেখাটা একসঙ্গে চালালে কেমন হয়? রথ দেখা আর কলা বেচার মতো।’

‘তাহলে এই দিঘিটাকে তো চেম্বারের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যেতে হয়।’

‘ধ্যার বোকা! চেম্বারটাকে এখানে তুলে আনব। ঘর বানাব না, একটা সাদা তাঁবু খাটাব। কিছু রোজগারও তো চাই। এই দ্যাখ না কখন মাছ ঠোকরাবে কেউ জানে না। তুই চোখ রাখলি ফাতনার দিকে, আমি দেখতে লাগলুম রুগি।’

‘আমি আবার অঙ্কও কষতে পারি।’

‘ওঃ, তাহলে তো তুই মেঘনাদ বধ হয়ে যাবি রে!’

‘আজ্ঞে মেঘনাদ সাহা।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ওটা আমার প্রায়ই গুলিয়ে যায়। নে, স্যান্ডউইচ নে, তাড়াতাড়িতে বেশ ভালোই বানিয়েছে। আজকে ওই বড় মাছটা পাবই। ওটা পেলে, কাল মাছের পুর দিয়ে কচুরি করিয়ে আনব! মাছ ধরার কম ধকল! রোগা না হয়ে যাস!’

বড়রা প্রায়ই বলেন, দুঃখের রাত শেষ হতে চায় না। এ দেখছি মাছ ধরার দুপুরও সহজে সন্ধে। হতে চায় না। বড়মামা মাঝে মাঝে বঁড়শি তুলে বলছেন, ‘যাঃ, টোপ খেয়ে গেছে। নে কৌটোটা খোল। টোপ দে। এবার একটু কেঁচো দে। এবার একটু বোলতার ডিম ছাড়। মাছেদেরও মুখ আছে। মাঝে-মাঝে মুখ পালটে দিতে হয়।’

গরমের দুপুরে ঝিম ধরছে। জল থেকে একটা গরম-ঠান্ডা ভাপ উঠছে। মাঝে মাঝে পানকৌড়ি ছোঁ মেরে জলের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। ওপারে গোটাকতক হাঁস প্যাঁকোর-প্যাঁকোর করছে। শরীর ভারী হয়ে আসছে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল।

হুইলের ভীষণ শব্দে তন্দ্রা ছুটে গেল। ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসলুম। বিরাট মাছ পড়েছে। যাক, এতদিনে বড়মামার হাতযশ দেখা গেল। মেজোমামা এবার কাত। উত্তেজনায় বড়মামার চোখ বড়-বড়। মাছ যেভাবে সুতো টানছে, হুইল শেষ হয়ে এল বলে।

পুকুরের দিকে তাকালুম। এ কী, জল স্থির। মাছ তো জলেই খেলবে! বড়মামার ছিপ কোথায়! ছিপ এরিয়েলের মতো শূন্যে খাড়া। পিঠের দিকে বেঁকে আছে ধনুকের মতো। মাছ কি তাহলে জল ছেড়ে ডাঙায় উঠে ছুটছে? কী মাছ রে বাবা!

মাঠের দিকে তাকিয়ে চক্ষুস্থির।

‘ও বড়মামা, আপনি কী ধরছেন?’

‘কেন, মাছ!’

‘মাছ তো আপনার পেছন দিকে মাঠ ভেঙে ছুটছে।’

‘সে কী রে? মেঠো মাছ নাকি?

‘আজ্ঞে না, একটা দামড়া গরু।’

আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটানে ছিপটা হাত থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল। গরু ছুটছে, ছিপ ছুটছে, আমরা ছুটছি।

সন্ধে হয়-হয়। আমরা বাড়ি ফিরে এলুম। দেখার মতো চেহারা হয়েছে আমাদের। লোকে মাছ ধরে বাড়ি ফেরে, আমরা ফিরলুম গরু ধরে। গরু আমাদের সঙ্গেই এসেছে। গরুর মালিকও আছেন। বঁড়শি কেটে বসে গেছে। অস্ত্রোপচার করে বের করতে হবে।

মেজোমামা বললেন, ‘কী কায়দায় এমন করলে?’

বড়মামা বললেন, ‘ফাতনাটা নড়তেই মেরেছি টান। গরুটা মনে হয় পেছনে চরে বেড়াচ্ছিল। বঁড়শি গেঁথে গেল পিঠে। গোমুখ মেরেছে ছুট। যত ছোটে, বঁড়শি তত পিঠে ঢোকে। বিশে, বিশে।’

বড়মামার হাঁকডাক শুরু হয়ে গেল।

গরু ধরে বড়মামার আবার সুমতি ফিরে এল। রুগিরা হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন। সকলেই বলাবলি করছেন, এ আমাদের সেই পুরোনো মুকুজ্যে-ডাক্তার, যাকে যমেও ভয় পায়।

যমে ভয় পেলে কী হয়, বড় দুঃখু মাছে ভয় পায় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *