Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

সুরেশ মনে মনে অসংশয়ে অনুভব করিতেছিল যে, কথাটা মহিম যেমন করিয়াই উড়াইয়া দিক, সে তাহারই একান্ত অনুরোধ উপেক্ষা করিতে না পারিয়াই এতদিন অচলার সহিত দেখা করিতে পারে নাই। সে যত ভালই বাসুক, এখন পর্যন্ত সে একটা ব্রাহ্মমেয়ের কাছে তাহার শৈশবের বন্ধুকে খাটো করিতে পারে না, এমন কথা কাল শুনিলেও সুরেশের বুকখানা গর্বে দশ হাত ফুলিয়া উঠিত। আজ কিন্তু তাহার নির্জন শয্যায় এ চিন্তা তাহাকে লেশমাত্র আনন্দ দিল না। তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল, একদিন-না-একদিন হাসি-গল্পে উপহাসে-পরিহাসে বিচিত্র হইয়া সমস্ত কথা অচলার কানে উঠিবে। সেদিন সুখের ক্রোড়ে বসিয়া সে তাহার স্বামীর এই অপদার্থ বন্ধুটার নিষ্ফল ঈর্ষার কোন তাৎপর্যই খুঁজিয়া পাইবে না, অথচ হাসির ছলেও সে স্বল্পভাষিণী কোনদিন কোন প্রশ্নই তাহাকে করিবে না। হয়ত-বা, শুধু মনে মনে একটুখানি হাসিয়া বলিবে, এই লোকটা বন্ধুত্বের অতি-অভিমানে কত পণ্ডশ্রমই না করিয়াছে! ব্যর্থ আক্রোশে কত অন্তর্দাহেই না জ্বলিয়া পুড়িয়া মরিয়াছে!

রাত্রে তাহার সুনিদ্রা হইল না। যতবার ঘুম ভাঙ্গিল, ততবারই এই-সকল তিক্ত চিন্তা তাহাকে ধিক্কার দিয়া বলিয়া গেল—পরের জন্য এমন উৎকট মাথাব্যথার রোগ কবে সারিবে সুরেশ?

সকালবেলা উঠিয়া সে দিনের কোন কাজে মন দিতে পারিল না এবং বেলা বাড়িতে না বাড়িতেই গাড়ি করিয়া কেদারবাবুর বাটীতে উপস্থিত হইল। বেহারা জানাইল, বাবু আলিপুর আদালতে বাহির হইয়া গিয়াছেন—ফিরিতে তিন-চার ঘণ্টা দেরি হইতেও পারে।

সুরেশ ফিরিতে উদ্যত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, দুইজনেই বেরিয়ে গেছেন?

প্রশ্নটা বেহারা বুঝিতে পারিল না। ঘাড় নাড়িয়া কহিল, সে ত আমি জানিনে বাবু।

সুরেশ মুশকিলে পড়িল। গৃহস্বামীর অবর্তমানে তাঁহার যুবতী কন্যার সম্বন্ধে কোনপ্রকার প্রশ্ন করা ব্রাহ্ম-পরিবারের মধ্যে শিষ্টতা-বিরুদ্ধ কি না, তাহা স্থির করিতে পারিল না, অথচ এই কন্যাটিকেই তাহার একমাত্র প্রয়োজন। চিন্তা করিয়া কহিল, তোমার বাবুর ফিরতে এত দেরি নাও হতে পারে ত? আমি এক-আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করেই দেখি।

বেহারা সুরেশকে বসিবার ঘরে আনিয়া বসাইয়া বলিল, দিদিঠাকরুন বাড়ি আছেন, তাঁকে খবর দেব কি? বলিয়া উত্তরের জন্য চাহিয়া রহিল। অচলা এই ভদ্রলোকটির সুমুখে যে বাহির হন তাহা সে কালই দেখিয়াছিল।

সুরেশ অন্তরের আগ্রহাতিশয্য প্রাণপণে নিবারণ করিয়া নিস্পৃহভাবে কহিল, তাঁকে আবার খবর দেবে? আচ্ছা দাও, ততক্ষণ না হয় তাঁর সঙ্গে দুটো কথা কই।

বেহারা চলিয়া গেল এবং অনতিকাল পরেই অচলা পার্শ্বের দরজার পর্দা সরাইয়া প্রবেশ করিল।

সুরেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, মহিম যে বাড়ি চলে গেল। এত করে বললুম আপনার সঙ্গে একবার দেখা করে যেতে—কিন্তু কোনমতেই কথা শুনলে না, এমন একটা—

অচলার মুখ মুহূর্তের জন্য সাদা হইয়া গেল। কিন্তু নমস্কার করিয়া একটা চৌকিতে উপবেশন করিয়া মৃদুকণ্ঠে কহিল, যাওয়া বোধ করি খুব বেশি দরকার, বাড়িতে কারও অসুখ-বিসুখ করেনি ত?
নমস্কার করিতে দেখিয়া সুরেশ অপ্রতিভ হইয়া প্রতি-নমস্কার করিল; এবং নিজের অনাবশ্যক উত্তেজনার সঙ্গে অচলার শান্ত ধীর কথাগুলি ওজন করিয়া শতগুণ লজ্জিত ও কুণ্ঠিত হইয়া উঠিল। কণ্ঠস্বর যথাসাধ্য সহজ ও স্বাভাবিক করিয়া বলিল, দরকার যাই হোক—সে এমন কি ভয়ানক হতে পারে যে, অন্তত: দু’ মিনিটের জন্য এসেও একবার আপনাকে সে বলে যেতে পারে না? আর যখন কবে ফিরবে, তার কোন ঠিকানা নেই, আপনিই বলুন, বাড়িতেই বা তার আছে কে—যার অসুখের জন্যে তাকে এভাবে যেতে হয়? আমি ত মরে গেলেও এমন করে চলে যেতে পারতুম না।

অচলার মুখের উপর দিয়া একটা সলজ্জ স্নিগ্ধ হাসি খেলিয়া গেল। কহিল, আপনার এখনও কেউ হয়নি বলেই এ কথা বললেন ; কিন্তু হলে ঠিক ওঁর মতই অবহেলা করে চলে যেতেন—এ আমি নিশ্চয় বলচি।

সুরেশ তাহার বসিবার চৌকির হাতলের উপর সজোরে একটা চপেটাঘাত করিয়া কহিল, কখ্‌খনো না। আমাকে আপনি চেনেন না, তাই এ কথা বলতে পারলেন; কিন্তু চিনলে পারতেন না।

অচলা কহিল, বেশ ত, এখন থেকে ত চিনতে পারব, আর কেউ হলে জানতেও পারব। কি বলেন?

সুরেশ কহিল, নিশ্চয়। এক শ’বার। তা ছাড়া মহিমের মত আমি বন্ধুর কাছে কোন কথা গোপন করে রাখতেও পারিনে, রাখা ভালও মনে করিনে; বলিয়া হঠাৎ উত্তেজিত হইয়া বলিয়া উঠিল, আপনি বলচেন, হলে জানতে পারবেন, কিন্তু আমি বলচি যে, আপনাকে না জানিয়ে, আপনার মত না নিয়ে এ-সব কখনো হবেই না; কারণ আপনাকে মহিমের সঙ্গে পৃথক করে দেখবার সাধ্য আর আমার নেই। আপনারা আমার কাছে আজ অভিন্ন।

অচলা সলজ্জ হাসিমুখে মাথা নাড়িয়া বলিল, আচ্ছা, সে তখন দেখা যাবে। কিন্তু আপনাকে যাচাই করার শুভদিন না আসা পর্যন্ত আমি কিন্তু আপনার বন্ধুকে দোষী করতে পারব না সুরেশবাবু।

সুরেশ সহসা গম্ভীর হইয়া কহিল, সে আপনার ইচ্ছে। কিন্তু আমাকে যাচাই করবার শুভদিন এ জন্মে ঘটবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু সে যাক। আজ সকালেই কেন আপনাদের কাছে এসেছি জানেন? কাল রাত্রে আমি ঘুমুতে পারিনি—না এলে আজও পারব না তাও জানতুম। আমি অনেক অপরাধ করেছি—তার সমস্ত একটি একটি করে আজ আপনার কাছে স্বীকার করে আমি যাব। আমি তাই এসেছি।

তাহার প্রবল বিরুদ্ধতা অচলার অবিদিত ছিল না। তাই সে শঙ্কিত-মুখে চুপ করিয়া চাহিয়া রহিল। সুরেশ বলিতে লাগিল, কাল সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে গিয়ে দেখি মহিম বসে আছে। ভাল কথা, আপনি নিশ্চয়ই জানেন—আমি ব্রাহ্মদের দু’চক্ষে—অর্থাৎ কিনা, ব্রাহ্মসমাজটাকে আমি তেমন ভাল মনে করিনে।

অচলা ঘাড় নাড়িয়া কহিল, হাঁ, আমি জানি।

সুরেশ বলিতে লাগিল, জানবেন বৈ কি। কিন্তু এ কথাটাও ভুলবেন না যে, আমি তখন আপনাকে চিনতুম না। তাই মহিমকে অনুরোধ করি, সে যেন অন্তত: একটা মাস এখানে না আসে। কেন জানেন?

অচলা পুনরায় মাথা নাড়িয়া বলিল, না। তবে বোধ হয়, আপনি ভেবেছিলেন পুরুষমানুষের ভুলতে একটা মাসই যথেষ্ট সময়। তবে বেশি বিলম্ব হওয়া সঙ্গত নয়।
আঘাতটা সুরেশ বিনীতভাবে গ্রহণ করিয়া বলিল, আমি চিরদিনই নির্বোধ। হয়ত এমনই কিছু একটা মনে করে থাকব। তা ছাড়া আরও একটা সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র আপনার বিরুদ্ধে আমার ছিল। আমি শপথ করেছিলুম, এই একটা মাসের মধ্যেই আর কোথাও পাত্রী স্থির করে মহিমের বিয়ে দেব। যেমন করেই হোক তাকে আটকাতে হবে। আমার বন্ধু হয়ে সে যে একটা নারীর মোহে নিজেদের সমাজ ছেড়ে চলে যাবে, এ যেন কিছুতেই না ঘটতে পায়।

অচলা রুদ্ধ-নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিল, তার পরে?

তাহার পাংশু মুখের পানে চাহিয়া সুরেশ একটুখানি হাসিল; কহিল, তার পরে আর ভয় নেই। এ পাপ-সঙ্কল্প ত্যাগ করেছি, আজ সেই কথাই আমি স্বীকার করে যাব। আপনাকে দেখা দেবার জন্যে কাল রাত্রে তাকে অনেক অনুরোধ করেচি। একদিন আমার অনুরোধটা সে রেখেছিল, কিন্তু কালকের অনুরোধটা রাখলে না—আপনাকে দেখা না দিয়েই সে কলকাতা ছেড়ে চলে গেল।

অচলা জিজ্ঞাসা করিল, যাবার কোন কারণ দেখিয়েছিলেন?

সুরেশ কহিল, না। দরকার আছে—এই মাত্র।

অচলা আর একটা নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া যেন আপনাকে আপনি বলিতে লাগিল—দরকার! দরকার! চিরকাল তাঁর মুখে এই কথাই শুনে আসছি—চিরদিন প্রয়োজনই তাঁর সর্বস্ব!

সুরেশ কহিল, একটা চিঠি লিখেও ত সে আপনাকে জানাতে পারত।

অচলা ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া বলিল, না। চিঠি তিনি লেখেন না।

সুরেশ ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া মুখ তুলিয়া চাহিল; বলিল, কি প্রয়োজন, তাও কখনো বলে না। তার সুখ-দুঃখ ভাল-মন্দ সমস্তই তার একার। স্বার্থপর! কখনো কাউকে তার ভাগ দিলে না। এই নিয়ে কত দুঃখ সে যে ছেলেবেলা থেকে আমাকে দিয়ে এসেছে, বোধ করি, তার সীমা নেই। নিষ্ঠুর! দিনের পর দিন নিজে উপোস করে, আমার প্রতিদিনের খাওয়া-পরা তিক্ত বিষাক্ত করেচে—কিন্তু কখনো কোনদিন আমার মুখ চেয়েও আমার হাত থেকে কিছু নেয়নি। আমার ভয় হয়, যে পাষাণকে নিয়ে আমি কখনো সুখ পাইনি, তাকে নিয়ে আপনিই কি সুখী হতে পারবেন? বলিতে বলিতেই অকস্মাৎ তাহার চোখ-দুটো অশ্রুজলে ঝকঝক করিয়া উঠিল। তাড়াতাড়ি মুছিয়া ফেলিয়া, জোর করিয়া একটুখানি হাসিয়া বলিল, দেখুন, আমার বাইরেটা ভারী শক্ত দেখতে, কিন্তু ভিতরটা তেমনি দুর্বল। মহিমের ঠিক তার উলটো—তবু আমাদের মত বন্ধুত্ব সংসারে বোধ করি খুব কমই ছিল।

অচলা নতমুখে মৃদুকণ্ঠে বলিল, সে আমি জানি সুরেশবাবু, এবং আরও জানি যে, সে বন্ধুত্ব আজও তেমনি অক্ষয় হয়ে আছে।

শৈশবের সমস্ত পূর্বস্মৃতি সুরেশের বুকের ভিতর আলোড়িত হইয়া উঠিল, সে অশ্রু-রুদ্ধকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, যখন জানেনই, তখন এই ভিক্ষা আজ আমাকে দিন যে, অজ্ঞানে যে শত্রুতা আপনাদের করেচি, সে অপরাধ আর যেন আমার বুকে না বেঁধে।

তাহার কণ্ঠস্বর আবেগে পুনরায় রুদ্ধ হইয়া আসিল এবং এই একান্ত ব্যাকুলতায় অচলার নিজের অন্তরটাও যেন দুলিয়া দুলিয়া উঠিল। সে উদ্গত অশ্রু গোপন করিতে অকস্মাৎ মুখ ফিরাইয়াই দেখিল, তাহার পিতা দ্বারের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন।

কেদারবাবু সুরেশকে দেখিয়া খুশি হইয়া বলিয়া উঠিলেন, এই যে সুরেশবাবু!
সুরেশ দাঁড়াইয়া নমস্কার করিল।

কেদারবাবু আসন গ্রহণ না করিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন, মহিমের খবর কি? তাকে ত দেখচি নে!

সুরেশ বলিল, মহিম অত্যন্ত প্রয়োজনে সকালের গাড়িতেই বাড়ি চলে গেল—এই খবর জানাবার জন্যেই আমি এলুম।

কেদারবাবু বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন, বাড়ি চলে গেল। বলিয়াই সহসা জ্বলিয়া উঠিয়া কহিতে লাগিলেন, সে বাড়ি যাক, থাক, আমাদের তাতে আর কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু তুমি বাবা সুরেশ যখন সময় পাবে বাড়ির ছেলের মত এখানে এসো, যেয়ো—আমার বড় আনন্দ হবে—কিন্তু তোমার সেই মিথ্যাচারী বন্ধুরত্নটি যেন আর কখন এ বাড়িতে মুখ না দেখায়। দেখা হলে বলে দিও তার আর কোন লজ্জা না থাকে—অন্ততঃ অপমানের ভয়টা যেন থাকে।

সুরেশ ঘাড় হেঁট করিয়া রহিল, তাহার মনের ভাব অনুমান করিবার চেষ্টা করিয়া কেদারবাবু সোৎসাহে বলিয়া উঠিলেন, না, না, সুরেশ তোমার লজ্জা বোধ করবার ত এতে কোনই কারণ নেই। বরঞ্চ কর্তব্য করবার গৌরব আছে। তুমি বুঝতে পারছ না যে, কি বিপদ থেকে আমাদের পরিত্রাণ করেছ এবং কতদূর পর্যন্ত আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।

মেয়ের দিকে চাহিয়া কহিলেন, আমি কাল থেকে এই বড় আশ্চর্য হচ্ছি অচলা, সে লোকটা সুরেশের মত ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল কি করে, আর কি করেই বা এতদিন ধরে সেটা বজায় রেখেছিল। একটুখানি থামিয়া বলিলেন, যে এ পারে, সে যে আমাদের মত দুটি নিরীহ মানুষকে ভুলিয়ে রাখবে, এ বেশি কথা নয়, মানি, কিন্তু এও বড় অদ্ভুত যে এই লোকটা বাস্তবিক কি, কেমন—এটুকু অনুসন্ধান করার কথাও আমার মত প্রবীণ বয়সের লোকের মনেও একটা দিন ওঠেনি। আশ্চর্য!

সুরেশ কথা কহিল না, কেদারবাবুর মুখের প্রতি মুখ তুলিয়া চাহিতে পর্যন্ত পারিল না।

কেদারবাবু ক্ষণকাল অপেক্ষা করিয়া নিজের পোশাকের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন, আমার অনেক কথা জিজ্ঞাসা করবার আছে বাবা; একটু বসো, আমি এইগুলো ছেড়ে আসি; বলিয়া প্রস্থানের উদ্যোগ করিতেই সুরেশ কহিল, আমার বেলা হয়ে গেছে। আজ যাই, আর একদিন আসব, বলিয়া ব্যস্ত হইয়াই উঠিয়া পড়িল এবং কোনমতে একটা নমস্কার সারিয়া লইয়া তাঁহার সঙ্গে সঙ্গেই বাহির হইয়া গেল।

কিন্তু পরদিন সকালেই আবার তাহাকে দেখিতে পাওয়া গেল এবং পরদিনও ঠিক এই সময়েই তাহার গাড়ির শব্দ আসিয়া থামিল।

কিন্তু ইহার পরদিনও আবার যখন তাহার গাড়ির শব্দ শুনা গেল, তখন বেলা হইয়াছে। পিতাকে স্নানাহারের তাগিদ দিয়া অচলা উঠিবার চেষ্টা করিতেছে—কিন্তু তাঁহার আর উঠা হইল না, তিনি সুরেশকে সানন্দে আহ্বান করিয়া লইয়া গল্প শুরু করিয়া দিলেন।

সুরেশ ইহা লক্ষ্য করিয়াছিল বলিয়াই দুই-চারিটা সাধারণ কথাবার্তার পরে যখন উঠিতে গেল, তখন তাহার শুষ্ক রুক্ষ মাথার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া আজ অকস্মাৎ একনিমেষেই কেদারবাবু ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। বলিলেন, এখনো ত তোমার স্নানাহার হয়নি সুরেশবাবু?

সুরেশ সহাস্যে কহিল, আমার আহার একটু বেলাতেই হয়।
কেদারবাবু তাহা কানেই লইলেন না, বলিতে লাগিলেন, এবং একনিমিষেই একেবারে ব্যস্তসমস্ত হইয়া উঠিলেন—অ্যাঁ, এখনও নাওয়া-খাওয়া হয়নি? না, আর এক মিনিট দেরি নয় সুরেশ! এইখানেই স্নান করে যা পারো খেয়ে নাও। মা অচলা, একটু তাড়া দাও—বেলা বারোটা বেজে গেছে। বেয়ারা,—ইত্যাদি উচ্চকণ্ঠে ডাকাডাকি করিতে করিতে তিনি নিজেই বাহির হইয়া গেলেন।

অচলা এতক্ষণ স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল। এখনও কোনপ্রকার চাঞ্চল্য প্রকাশ করিল না। পিতা চলিয়া যাইবার পর আস্তে আস্তে বলিল, আপনি আমাদের এখানে কি কিছু খেতে পারবেন?

সুরেশ মুখ তুলিয়া অচলার মুখের পানে কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিল, আপনি কি বলেন?

আপনি কখনই ত ব্রাহ্ম-বাড়িতে খান না।

না, খাইনে। কিন্তু আপনি এনে দিলে খাবো। একটুখানি থামিয়া বলিল, আপনি বোধ হয় ভাবছেন, আমি তামাশা করছি; কিন্তু তা নয়। আপনি হাতে করে দিলে আমি সত্যি খাবো; বলিয়া চাহিয়া রহিল।

এইবার অচলা একটুখানি মুখ নিচু করিয়া হাসি গোপন করিল; কহিল, যথার্থই আমি ভেবেছিলুম আপনি ঠাট্টা করচেন। কাল পর্যন্তও যাদের বাড়িতে খেতে আপনার ঘৃণার অবধি ছিল না, আজ তাদেরই একজনের ছোঁয়া খেতে কি করে আপনার প্রবৃত্তি হবে, আমি ত ভেবে পাচ্ছিনে সুরেশবাবু।

সুরেশ ম্লানমুখে ব্যথিতস্বরে কহিল, তবে এতক্ষণ পরে কি এই ভেবে পেলেন যে, আপনার হাতে খেতে আমার ঘৃণা হবে?

অচলা বলিল, কিন্তু এই ভাবনাই ত স্বাভাবিক সুরেশবাবু। আপনার মত একজন উচ্চশিক্ষিত ভদ্রলোকের চিরদিনের বদ্ধমূল সামাজিক সংস্কার হঠাৎ একদিনে অকারণে ভেসে যাবে, এইটেই কি ভাবতে পারা সহজ?

সুরেশ কহিল, না, সহজ নয়। কিন্তু অকারণে ভেসে যাচ্ছে—তাই বা ভাবচেন কেন? কারণ থাকতেও ত পারে, বলিয়া এমনি করিয়াই চাহিয়া রহিল যে, জবাব দিতে গিয়া অচলা একেবারে বিস্মিত হইয়া গেল। তাহার কথাটায় সে যে আঘাত পাইয়াছে, তাহা সে মুখ দেখিয়াই বুঝিয়াছিল, এবং একপ্রকারের হিংস্র আনন্দও উপভোগ করিতেছিল। কিন্তু সে বেদনা যে অকস্মাৎ একমুহূর্তে তাহার সমস্ত মুখখানাকে একেবারে ছাইয়ের মত শুষ্ক করিয়া দিতে পারে—তা সে ভাবেও নাই, ইচ্ছাও করে নাই। তাই নিজেও ব্যথা পাইয়া কথাটাকে সহজ রহস্যালাপে পরিণত করিতে, জোর করিয়া একটুখানি হাসিয়া বলিল, ভেবেই দেখুন আপনার মত কঠোরপ্রতিজ্ঞ লোকও—

সুরেশ বলিল হাঁ, ভেসে যায়। তাহার গলার স্বর কাঁপিতে লাগিল; কহিল, আপনি একটা দিনের কথা বলছিলেন—কিন্তু জানেন আপনি, একদিনের ভূমিকম্পে অর্ধেক দুনিয়াটা পাতালের মধ্যে ডুবে যেতে পারে? একটা দিন কম সময় নয়। বলিয়া আবার নির্নিমেষ-চক্ষে চাহিয়া রহিল। অচলা ভীত হইয়া উঠিল। সুরেশের মুখের উপর কি একপ্রকার শুষ্ক পাণ্ডুরতা—কপালের শির-দুটো রক্তে স্ফীত, চোখ-দুটো জ্বলজ্বল করিতেছে—যেন কি একটা সে ছোঁ মারিয়া ধরিতে চায়!

একে এই গরম, তাহাতে এত বেলা পর্যন্ত স্নানাহার নাই—গতরাত্রে এতটুকু ঘুমাইতে পারে নাই—তাহার পায়ের নীচের মাটিটা পর্যন্ত যেন অকস্মাৎ দুলিয়া উঠিল। আরক্ত দুই চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিল, ব্রাহ্মদের ঘৃণা করি কি না সে জবাব ব্রাহ্মদের দেব, কিন্তু আপনি আমার কাছে তাদের অনেক, অনেক উপরে—
তাহার উন্মাদ ভঙ্গীতে অচলা ভয়ে কাঠ হইয়া উঠিল। কোনমতে প্রসঙ্গটা চাপা দিবার জন্য সভয়ে কহিতে গেল, বেহারাটা—

কিন্তু সে অস্ফুট মৃদুস্বর সুরেশের উত্তপ্ত উচ্চকণ্ঠে ঢাকা পড়িয়া গেল। সে অমনি তীব্রস্বরে কহিতে লাগিল, দুটো দিনের পরিচয়! তা বটে! কিন্তু জানো অচলা, দিন, ঘণ্টা, মিনিট দিয়ে মহিমকে মাপা যায়—কিন্তু সুরেশের যায় না। সে স্থানকালের অতীত। তুমি ভূমিকম্প দেখেচ? যা পৃথিবী গ্রাস করে—

অচলা ব্যাধভীত হরিণীর মত চক্ষের পলকে উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, আপনার স্নানের যোগাড়—, বলিয়া পা বাড়াইতে সুরেশ সহসা সম্মুখে ঝুঁকিয়া পড়িয়া অচলার ডান হাত ধরিয়া টান দিল। সেই উন্মত্ত ও আকস্মিক আকর্ষণ সহ্য করে স্ত্রীলোকের সাধ্য নয়। সে উপুড় হইয়া সুরেশের গায়ের উপর আসিয়া পড়িল। ভয় ও বিস্ময় অতিক্রম করিয়া তাহার আর্তকণ্ঠের ‘মা গো!’ আহ্বান তাহার কম্পিত ওষ্ঠপুট ত্যাগ করিতে না করিতে সুরেশ তাহার দুই হাত নিজের বুকের উপর সজোরে টানিয়া লইয়া ডাকিল, অচলা!

অচলা চোখ তুলিয়া মূর্ছিত মায়ামুগ্ধের মত চাহিয়া রহিল এবং সুরেশও ক্ষণকালের জন্য কথা কহিতে পারিল না—শুধু তাহার অপরিমেয়, পিপাসা-দগ্ধ ওষ্ঠাধর হইতে কেমন যেন একটা স্তব্ধ তীব্র জ্বালা ছড়াইয়া পড়িতে লাগিল।

কয়েক মুহূর্ত এইভাবে থাকিয়া সুরেশ আর একবার অচলার দুই হাত বুকের উপর চাপিয়া ধরিয়া উচ্ছ্বসিত হইয়া বলিতে লাগিল, অচলা, একটিবার ভূমিকম্পের এই প্রচণ্ড হৃৎস্পন্দন নিজের দুটি হাতে অনুভব করে দেখ—কি ভীষণ তাণ্ডব এই বুকের ভেতরটায় তোলপাড় করে বেড়াচ্চে! এ কি পৃথিবীর কোন ভূমিকম্পের চেয়ে ছোট? বলতে পার অচলা, পৃথিবীতে কোন্‌ জাত, কোন্‌ ধর্ম, কোন্‌ মতামত আছে, যা এই বিপ্লবের মধ্যে পড়েও ডুবে রসাতলে তলিয়ে যাবে না।

ছেড়ে দিন—বাবা আসচেন, বলিয়া জোর করিয়া নিজেকে মুক্ত করিয়া লইয়া অচলা তাহার চৌকিতে ফিরিয়া গিয়া শান্ত হইয়া বসিল এবং পরক্ষণেই কেদারবাবু ব্যস্তভাবে ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন, তাইত, একটু দেরি হয়ে গেল—আর এই বেয়ারা ব্যাটা যে থেকে থেকে কোথায় যায় তার ঠিকানা নেই। মা অচলা—ও কি রে, তোর কি কোন অসুখ করেছে? মুখ শুকিয়ে যেন একেবারে—

অচলা কোনমতে একটুখানি হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, না বাবা, অসুখ করবে কেন?

তবু মাথাধরা-টরা? যে গরম পড়েছে, তা—

না, আমি বেশ আছি বাবা, আমার কিছুই হয়নি।
কেদারবাবু নিশ্চিন্ত হইয়া বলিলেন, তবু ভাল। মুখ দেখে আমার ভয় লেগে গিয়েছিল, তবে, তুমি একটু দেখ দেখি মা, যদি—

অচলা বলিল, বেশ ত বাবা, আমি এক মিনিটে সমস্ত যোগাড় করে দিচ্চি। কিন্তু এইমাত্র আমি জিজ্ঞাসা করছিলুম সুরেশবাবুকে—আমাদের এখানে নাওয়া-খাওয়া করতে তাঁর ত আপত্তি নেই?

কেদারবাবু আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, আপত্তি কেন থাকবে? না না সুরেশ, আমি ত তোমাকে বলেইছি যে, একদিনেই তোমাকে আমি ঘরের ছেলে মনে করেচি। এ বাড়ি তোমার নিজের বাড়ি। মেয়ের দিকে চাহিয়া সগর্বে কহিলেন, আর তাই যদি না হবে অচলা, আমাদের উদ্ধার করবার জন্য ভগবান ওঁকে পাঠাবেন কেন? কিন্তু আর দেরি ভাল হবে না বাবা, এসো আমার সঙ্গে—স্নানের ঘরটা তোমাকে দেখিয়ে দিই গে।

কিন্তু সেই যে সুরেশ, কেদারবাবু প্রবেশ করা পর্যন্ত মাথা হেঁট করিয়াছিল, কিছুতেই আর সে মাথা সোজা করিয়া তুলিয়া ধরিতে পারিল না।

অচলা বলিল, কাজ কি বাবা পীড়াপীড়ি করে! আমাদের ব্রাহ্ম-বাড়িতে খেতে হয়ত ওঁর বিশেষ বাধা আছে। তা ছাড়া অপ্রবৃত্তির ওপর খেলে অসুখ করতেও পারে।

কেদারবাবু একেবারে মুষড়িয়া গেলেন। সুরেশ বড়লোকের ছেলে—স্বাধীন। ঘরের গাড়ি করিয়া যাতায়াত করে। তাহাকে খাওয়াইয়া মাখাইয়া যেমন করিয়া হোক আত্মীয় করা যে তাঁহার চাই-ই; হঠাৎ তাহার আনত মুখের একাংশে নজর পড়ায় কেদারবাবু বিস্ময়ে একেবারে চমকিয়া উঠিলেন—অ্যাঁ! একি হয়েছে সুরেশ? শুকিয়ে সমস্ত মুখখানা যে একেবারে কালিবর্ণ হয়ে গেছে! ওঠো, ওঠো—মাথায় মুখে জল দিতে আর এক মিনিট বিলম্ব করো না। বলিয়া হাত ধরিয়া একপ্রকার জোর করিয়া তুলিয়া লইয়া গেলেন।

সপ্তম পরিচ্ছেদ

আহারাদির পর কোনমতেই কেদারবাবু এই রৌদ্রের মধ্যে সুরেশকে ছাড়িয়া দিলেন না। বিশ্রামের নামে সমস্ত দুপুরটা একটা ঘরে কয়েদ করিয়া রাখিলেন। সে চোখ বুজিয়া কৌচের উপর পড়িয়া রহিল, কিন্তু কিছুতেই ঘুমাইতে পারিল না। ঘরের বাহিরে মধ্যাহ্ন-সূর্য আকাশে জ্বলিতে লাগিল, ভিতরে আত্মসংযমের আত্মগ্লানি ততোধিক ভীষণ তেজে সুরেশের বুকের ভিতর প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। এমনি করিয়া সমস্ত বেলাটা অন্তরে-বাহিরে পুড়িয়া আধমরা হইয়া যখন সে উঠিয়া বসিয়া সুমুখের জানালাটা খুলিয়া দিল, তখন বেলা পড়িয়া গিয়াছে। কেদারবাবু প্রসন্নমুখে ঘরে ঢুকিয়া জোর করিয়া একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আঃ—গরমটা একবার দেখচ সুরেশ! আমার এতটা বয়সে কলকাতায় কস্মিনকালেও এমন দেখিনি। বলি, ঘুমটুম একটু হয়েছিল কি?

সুরেশ ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না, দিনের বেলায় আমি ঘুমোতে পারিনে।

কেদারবাবু তৎক্ষণাৎ বলিলেন, আর পারা উচিতও নয়। ভয়ানক স্বাস্থ্যহানি হয়। তবুও আমি তিন-চারবার উঠে উঠে দেখি, তোমার পাখাওয়ালা টানচে, না ঘুমোচ্চে। এরা এত বড় শয়তান যে, যে মুহূর্তে তুমি একটু চোখ বুজবে, সেই মুহূর্তেই সেও চোখ বুজবে। যে হোক, একটু সুস্থ হতে পেরেচ ত? আমি নিশ্চয় জানতুম—এ রোদে বাইরে বেরুলে আর তুমি বাঁচতে না।

সুরেশ চুপ করিয়া রহিল। কেদারবাবু ঘরের অন্যান্য জানালাগুলা একে একে খুলিয়া দিয়া, বসিবার চৌকিখানা কাছে টানিয়া লইয়া কহিলেন, আমি ভাবচি সুরেশ, আর গড়িমসির প্রয়োজন নেই। সমস্ত স্পষ্ট করে মহিমকে একখানা চিঠি লিখে দিই। কি বল?

প্রশ্নটা সুরেশের পিঠের উপর যেন মর্মান্তিক চাবুকের বাড়ি মারিল। সে এমনি চমকিয়া উঠিল যে, কেদারবাবু দেখিতে পাইয়া বলিলেন, নিষ্ঠুর কর্তব্য যে কি করে করতে হয়, সে শিক্ষা ত তুমিই আমাকে এতকাল পরে দিলে সুরেশ; এখন তোমার ত পেছুলে চলবে না বাবা।

এ ত ঠিক কথা। সুরেশ কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া বলিল, কিন্তু আপনার কন্যারও এ সম্বন্ধে মতামত নেওয়া চাই।

কেদারবাবু অল্প হাসিয়া কহিলেন, চাই বৈ কি।

তিনি কি স্পষ্ট করে চিঠি লিখে দিতেই বলেন?

কেদারবাবু ইহার সোজা জবাবটা না দিয়া কহিলেন, তা একরকম তাই বৈ কি। এ-সব বিষয়ে মুখোমুখি সওয়াল-জবাব করাটা সকলের পক্ষেই কষ্টকর। কিন্তু সে ত বড় হয়েছে, রীতিমত শিক্ষাও পেয়েছে; এ-সকল ব্যাপার দিন থাকতে পরিষ্কার করে না নিলে এর পাগলামিটা যে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, এ ত সে বোঝে। তাই ভাবচি, আজ রাত্রেই কাজটা সেরে ফেলব।

সুরেশ ম্লান হইয়া কহিল, এত তাড়াতাড়ি কেন? দু’দিন চিন্তা করাও ত উচিত।

কেদারবাবু বলিলেন, এর ভেতরে চিন্তা করব আর কোন্‌খানে? ওর হাতে মেয়ে দিতে পারব না, সে নিশ্চয়—তখন এই বিশ্রী ব্যাপারটা যত শীঘ্র শেষ হয়, ততই মঙ্গল।

সুরেশ জিজ্ঞাসা করিল, আমার উল্লেখ করাও কি প্রয়োজন?

কেদারবাবু হাসিয়া বলিলেন, বুড়ো হয়েচি, এইটুকু বিবেচনাও কি আমার নেই মনে কর? তোমার নাম কোনদিনও কেউ তুলবে না।
সুরেশের মুখ দিয়া একটা আরামের নিশ্বাস পড়িল, কিন্তু সে আর কোন কথা কহিল না, চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। এই নিশ্বাসটুকু কেদারবাবুর দৃষ্টি এড়াইল না। তিনি সুরেশের আরও দু-একটা আচরণ ইতিমধ্যে লক্ষ্য করিয়া মনে মনে একটা অনুমান খাড়া করিয়া লইয়াছিলেন। তাহার সত্যমিথ্যা যাচাই করিবার উদ্দেশ্যে অন্ধকারে একটা ঢিল ফেলিলেন; কহিলেন, মস্ত উপকার আমাদের যেমন তুমি করলে বাবা, কিন্তু এর চেয়েও বড় উপকার তোমার কাছে আমরা দু’জন প্রত্যাশা করচি। আমরা ব্রাহ্ম বটে, কিন্তু সে-রকম ব্রাহ্ম নয়। আর আমার মেয়ে ত তার মায়ের মত মনে মনে হিন্দুই রয়ে গেছে। সে আমাদের ব্রাহ্মগিরি-টিরি একেবারেই পছন্দ করে না।

সুরেশ বিস্ময়াপন্ন হইয়া মুখ তুলিয়া চাহিল। তাহার এই নীরব ঔৎসুক্য কেদারবাবু বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করিয়া কহিতে লাগিলেন, তাই, মেয়েকে আমি কিছুতেই চিরকাল আইবুড়ো রাখতে পারি না। এ বিষয়ে আমি তোমাদের মতই সম্পূর্ণ হিন্দুমতাবলম্বী। একটি সম্বন্ধ যেমন তোমা হতে ভেঙ্গে গেল সুরেশ, তেমনই আর একটি তোমাকেই গড়ে তুলতে হবে বাবা।

সুরেশ কহিল, যে আজ্ঞে; আমি প্রাণপণে চেষ্টা করব।

তাহার মুখের ভাব পড়িতে পড়িতে কেদারবাবু সন্দিগ্ধস্বরে কহিলেন, সমাজে এই নিয়ে যথেষ্ট গোলযোগ হবে দেখতে পাচ্চি। কিন্তু যত শীঘ্র পারা যায়, অচলার বিয়ে দিয়ে এই-সব আলোচনা থামিয়ে ফেলতে হবে। তবে একটা শক্ত কথা আছে, সুরেশ। বলিয়া একবার দরজার বাহিরে চাহিয়া, আরও একটু কাছে সরিয়া আসিয়া, গলা খাটো করিয়া বলিলেন, শক্ত হচ্চে এই যে, পাত্র রূপে-গুণে ভাল হলেই যে হিন্দুসমাজের মত তাকে ধরে এনে বিয়ে দিতে পারব, তা নয়। ও চিরকাল যে শিক্ষা-সংস্কারের মধ্যে বড় হয়ে উঠেছে, তাতে ওর অমতে কিছুই করা যাবে না। কিন্তু মত সে কোন মতেই দেবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না দু’জনের মধ্যে এমন একটা কিছু—বুঝলে না সুরেশ?

কথাবার্তার মধ্যেই সুরেশ কতকটা যেন বিমনা হইয়া পড়িয়াছিল, এই প্রণয়-ইঙ্গিতটা যেন আর একবার নূতন করিয়া আঘাত করিয়া তাহাকে অচেতন করিয়া দিল। দুপুরবেলায় তাহার নিজের সেই উচ্ছৃঙ্খল প্রণয়-নিবেদনের বীভৎস উৎকট আচরণ স্মরণ হওয়ায় নিদারুণ লজ্জায় সমস্ত মুখখানা রাঙ্গা না হইয়া একেবারে কালিবর্ণ হইয়া গেল; এবং সকালের যে খবরের কাগজখানা এতক্ষণ পায়ের কাছে মেজেতে পড়িয়াছিল, সেইখানা তুলিয়া লইয়া তাহার বিজ্ঞাপনের পাতাটার প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল।

কেদারবাবু ইহা দেখিতে পাইলেন, এবং এই আকস্মিক ভাবপরিবর্তনের সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থ কল্পনা করিয়া মনে মনে অত্যন্ত পুলকিত হইলেন, এবং সুযোগ বুঝিয়া একটা বড়রকম চাল চালিয়া দিলেন; কহিলেন, আমি বরাবর এই বড় একটা আশ্চর্য জিনিস দেখে আসচি সুরেশ, যে, কেন জানিনে, একটা লোককে আজন্ম কাছে পেয়েও একতিল বিশ্বাস হয় না, আর একটা মানুষকে হয়ত দু’ ঘণ্টা মাত্র কাছে পেয়েই মনে হয়, এর হাতে নিজের প্রাণটা পর্যন্ত সঁপে দিতে পারি। মনে হয়, যেন জন্মজন্মান্তরের আলাপ,—শুধু দু’ ঘণ্টার নয়। এই যেমন তুমি। কতক্ষণেরই বা পরিচয় বল দেখি?

ঠিক এমনি সময় অচলা ঘরে প্রবেশ করিল। সুরেশ মুহূর্তের জন্য চোখ তুলিয়াই আবার সংবাদপত্রের প্রতি মনঃসংযোগ করিল।
বাবা, তুমি এ বেলা চা, না কোকো খাবে?

আমি কোকোই খাব মা।

সুরেশবাবু, আপনি চা খাবেন ত?

সুরেশ কাগজের দিকে চোখ রাখিয়াই অস্ফুটস্বরে বলিল, আমাকে চা-ই দেবেন।

আপনার পেয়ালায় চিনি কম দিতে হবে না ত?

না, আর পাঁচজন যেমন খায় আমিও তেমনি খাই।

অচলা চলিয়া গেল। কেদারবাবু তাঁহার ছিন্ন প্রসঙ্গের সূত্র যোজনা করিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, এই দেখ না সুরেশ, আমার এই মা-টির জন্যেই এই বুড়োবয়সে আমি বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েচি, এ কথা তোমার কাছে ত গোপন রাখতে পারলুম না। নইলে, নিজের দুর্দশা-দুরবস্থার কাহিনী সহজে কি কেউ কখনো অপরের কানে তুলতে পারে! কখনও যা পারিনি, এত বন্ধুবান্ধব থাকতে সে কথা শুধু তোমার কাছেই বলতে কেন সঙ্কোচবোধ হচ্ছে না? এর কি কোন গূঢ় কারণ নেই মনে কর?

সুরেশ বিস্মিত হইয়া মুখ তুলিয়া চাহিয়া রহিল। কেদারবাবু বলিতে লাগিলেন, এ ভগবানের নির্দেশ—সাধ্য কি গোপন করি? আমাকে বলতেই হবে যে! বলিয়া চৌকির হাতলের উপর তিনি একটা চাপড় মারিলেন।

কিন্তু তাঁহার এই বিস্তৃত ভূমিকা সত্ত্বেও তাঁহার দুর্দশা-দুরবস্থাটা যে মেয়ের জন্য কিরূপ দাঁড়াইয়াছে, তাহা সুরেশ আন্দাজ করিতে পারিল না। কেদারবাবু তখন সবিস্তারে বর্ণনা করিতে লাগিলেন, কি করিয়া তাঁহার অমন অর্ডার সাপ্লায়ের ব্যবসাটা নিছক প্রবঞ্চনা ও কৃতঘ্নতার আগুনে পুড়িয়া খাক হইয়া গেলেও তিনি অবিচলিত ধৈর্যের সহিত দাঁড়াইয়াছিলেন, এবং ঋণের পরিমাণ উত্তরোত্তর বাড়িয়া গেলেও একমাত্র কন্যার শিক্ষাসম্বন্ধে কিছুমাত্র ব্যয়সঙ্কোচ করেন নাই। তিনি বলিতে লাগিলেন, গুটি-পাঁচছয় ডিক্রীজারির ভয়ে তাঁহার আহার-বিহার বিষময় এবং খুচরা ঋণের তাগাদায় জীবন দুর্ভর হইয়া উঠিলেও তিনি মুখ ফুটিয়া কাহাকেও কিছু বলিতে পারেন না। অথচ এই কলিকাতা শহরেই এমন অনেক আছেন যাঁহারা টাকাটা অনায়াসেই ফেলিয়া দিতে পারেন।

একটুখানি থামিয়া কি যেন চিন্তা করিয়া বলিয়া উঠিলেন, কিন্তু তোমাকে যে জানালুম—একটুকু দ্বিধা-সঙ্কোচ হল না—একি শ্রীভগবানের সুস্পষ্ট আদেশ নয়? বলিয়া পরম ভক্তিভরে দুই হাত কপালে ঠেকাইয়া নমস্কার করিলেন।
সুরেশের ভগবানে বিশ্বাস ছিল না—সে বৃদ্ধের উচ্ছ্বাসে যোগ দিল না, বরঞ্চ তাহার মনটা কেমন যেন ছোট হইয়া গেল। ধীরভাবে জিজ্ঞাসা করিল, আপনার ঋণ কত?

কেদারবাবু বলিলেন, ঋণ? আমার ব্যবসাটা বজায় থাকলে কি এ আবার একটা ঋণ! বড়জোর হাজার তিন-চার। তিনি আরও কি একটা বলিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু এমনি সময়ে অচলা বেহারার হাতে চায়ের সরঞ্জাম এবং নিজের হাতে জলখাবারের থালা লইয়া প্রবেশ করিল।

কেদারবাবু গরম কোকো এক চুমুকে খানিকটা খাইয়া, হর্ষসূচক একটা অব্যক্ত নিনাদ করিয়া পেয়ালাটা টেবিলের উপর রাখিয়া দিয়া বলিলেন, দেখ সুরেশ, আমার ওপর ভগবানের এই একটা আশ্চর্য কৃপা আমি বরাবর দেখে আসচি যে, তিনি কখনো আমাকে অপ্রস্তুত করেন না। মহিমকে কথাটা বলি-বলি করেও যে কেন বলতে পারতুম না—তিনি বরাবর আমার যেন মুখ চেপে ধরতেন—এতদিনে সেটা বোঝা গেল। বলিয়া আর একবার কপালে হাত ঠেকাইয়া তাঁহার অসীম দয়ার জন্য নমস্কার করিলেন।

সুরেশ তাহার পেয়ালাটার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া কহিল, টাকাটা কবে আপনার প্রয়োজন?

কেদারবাবু মুখ হইতে কোকোর পেয়ালাটা পুনরায় নামাইয়া রাখিয়া বলিলেন, প্রয়োজন আমার ত নয় সুরেশ, প্রয়োজন তোমাদের। বলিয়া একটুখানি উচ্চ-অঙ্গের হাস্য করিলেন।

হেঁয়ালিটা বুঝিতে না পারিয়া সুরেশ মুখ তুলিয়া চাহিতেই দেখিল, অচলা জিজ্ঞাসুমুখে পিতার মুখের পানে চাহিয়া আছে। তিনি একবার কন্যার মুখে, একবার সুরেশের মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া কহিলেন, এর মানে বোঝা ত শক্ত নয়। বাড়িটা আমি ত সঙ্গে নিয়ে যাব না! যায় তোমাদেরই যাবে, আর থাকে তোমাদেরই দু’জনের থাকবে। বলিয়া মৃদু হাসিতে লাগিলেন।

দু’জনের চোখাচোখি হইল, এবং চক্ষের পলকে উভয়েই আরক্তমুখে মাথা হেঁট করিয়া ফেলিল।

পেয়ালা-দুই কোকো নিঃশেষ করিয়া কেদারবাবু একখানা জরুরি চিঠি লেখার কথা স্মরণ হইল। অবিলম্বে উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, আজ তোমার খাওয়ার ভারী কষ্ট হল সুরেশ, কাল দুপুরবেলা এখানে খাবে, বলিয়া নিমন্ত্রণ করিয়া পশ্চিম দিকের দরজা খুলিয়া তাঁহার নিজের ঘরে চলিয়া গেলেন।

খোলা দরজা দিয়া অস্তোন্মুখ সূর্যের এক ঝলক রাঙ্গা আলো সুরেশের মুখের উপর আসিয়া পড়িল। সে ঘাড় ফিরাইয়া দেখিতে পাইল, অচলা তাহার প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া আছে—সেও দৃষ্টি অবনত করিল। মিনিট-দুই বড় ঘড়িটার খটখট শব্দ ছাড়া সমস্ত ঘরটা নিস্তব্ধ হইয়া রহিল।

অষ্টম পরিচ্ছেদ

ঘরে নীরবতা ভঙ্গ করিল সুরেশ, কহিল, হঠাৎ আচ্ছা একটা কাণ্ড করে বসলুম।

অচলা কথা কহিল না।

সুরেশ পুনরায় কহিল, আপনার নিশ্চয়ই আমাকে একটা রাক্ষস বলে মনে হচ্চে। একলা বসে থাকতে বোধ করি আপনার সাহস হচ্চে না, না? বলিয়া টানিয়া টানিয়া হাসিতে লাগিল। অচলা এখনও মুখ তুলিল না; কিন্তু তুলিলে দেখিতে পাইত, সুরেশের ওই একান্ত চেষ্টার নিষ্ফল হাসিটা শুধু তাহার নিজের মুখখানাকেই বারংবার অপমানিত করিয়া লজ্জায় বিকৃত হইয়া উঠিতেছে।

আবার সমস্ত ঘরটা নিস্তব্ধ হইয়া রহিল, এবং সেই দেওয়ালের গায়ের ঘড়িটাই শুধু খটখট করিয়া স্তব্ধতার পরিমাণ করিতে লাগিল। কিছুক্ষণে এই কঠিন নীরবতা যখন একেবারেই অসহ্য হইয়া উঠিল, তখন সুরেশ তাহার সমস্ত দেহটাকে ঋজু এবং শক্ত করিয়া কহিল, দেখুন যা হয়ে গেছে, তার পরে আমাদের মধ্যে চক্ষুলজ্জার স্থান নেই। বেলা গেল—আমি এবার যাব। কিন্তু তার আগে গোটা-দুই কথার জবাব শুনে যেতে চাই, দেবেন?

অচলা মুখ তুলিল। তাহার চোখ-দুটি ব্যথায় ভরা। কহিল, বলুন।

সুরেশ ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া বলিল, আপনার বাবার দেনাটা পরিশোধ করে দিতে কাল-পরশু একবার আসব; কিন্তু আপনার সঙ্গে দেখা হবার প্রয়োজন নেই। আমি জানতে চাই, আমাদের দু’জনের সম্বন্ধে তাঁর অভিপ্রায় কি আপনি জানেন?

অচলা কহিল, আমাকে তিনি স্পষ্ট করে কিছুই বলেন না।

সুরেশ বলিল, আমাকেও না। তবুও বিশ্বাস, তিনি আমাকেই—কিন্তু আপনি বোধ করি রাজি হবেন না?

অচলা কহিল, না।

কোনদিন না?

অচলা দৃষ্টি অবনত করিয়া কহিল, না।

কিন্তু, মহিমের আশা যদি না থাকে?

অচলা অবিচলিত-স্বরে কহিল, সে আশা ত নেই-ই।

সুরেশ প্রশ্ন করিল, বোধ করি, তবুও না?

অচলা মুখ তুলিল না, কিন্তু তেমনি শান্ত দৃঢ়স্বরে কহিল, তবুও না।

সুরেশ কৌচের পিঠে ঢলিয়া পড়িয়া একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, যাক, এ দিকটা পরিষ্কার হয়ে গেল। বাঁচা গেল। বলিয়া খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া পুনরায় সোজা হইয়া বসিয়া বলিল, কিন্তু আমি এই একটা মুশকিলের কথা ভাবচি যে, আপনার বাবার দেনাটা তা হলে শোধ হবে কি করে?

অচলা ভয়ে ভয়ে একটুখানি মুখ তুলিয়া অত্যন্ত সঙ্কোচের সহিত কহিল, আর ত আপনি দিতে পারবেন না?

পারব না? কেন? প্রশ্ন করিয়া সুরেশ তীক্ষ্ণ ব্যগ্র-দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। সে চাহনির সম্মুখে অচলা পুনরায় মাথা হেঁট করিয়া ফেলিল।

কয়েক মুহূর্ত উত্তরের প্রতীক্ষা করিয়া সুরেশ হাসিল। কিন্তু এবার তাহার হাসিতে আনন্দ না থাক, কৃত্রিমতাও ছিল না। কহিল, দেখুন, আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়া পর্যন্ত আমার কোন আচরণকেই যে ভদ্র বলা যেতে পারে না, সে আমি নিজেও জানি; কিন্তু আমি অত ছোটও নই। আপনার বাবাকে আমি এই টাকাটা ঘুষ দিতে চাইনি, তাঁর বিপদে সাহায্য করতেই চেয়েছিলাম। সুতরাং আপনার মতামতের ওপর আমার দেওয়াটা নির্ভর করচে না। নির্ভর করচে তাঁর নেওয়াটা। এখন কি করে যে তিনি নেবেন, আমি তাই ভাবচি। বরং আসুন, এ সম্বন্ধে আমরা একটা পরামর্শ করি।
অচলা মুখ তুলিয়া কহিল, বলুন।

সুরেশ বলিতে লাগিল, দৈবাৎ অনেক টাকার মালিক আমি। অথচ টাকাকড়ির উপর কোনদিন কোন মায়াই আমার নেই। হাজার-চারেক টাকা আমি স্বচ্ছন্দে হাতছাড়া করতে পারি। আর আপনার সুখের জন্য ত আরও ঢের বেশি পারি। তা যাক। এখন কথা এই যে, আপনার বাবার ধারণা, এ টাকাটা শোধ দেবার আর আবশ্যক হবে না, অথচ সে একরকম শোধ দেওয়াই হবে। বুঝলেন না?

অচলা মাথা নাড়িয়া অস্ফুটে কহিল, হাঁ।

সুরেশ বলিতে লাগিল, কথাটা স্পষ্ট বলছি বলে মনে কিছু করবেন না। বুঝতে পারচি, টাকাটা তাঁর চাই-ই, অথচ এত টাকা ধার নিয়ে শোধ করবার অবস্থা তাঁর নেই। যদিচ, আমার নিজের তরফ থেকে তার আবশ্যকও কিছুমাত্র নেই—আচ্ছা, এ ত সহজেই হতে পারে। পরশু পর্যন্ত আপনার মনের ভাব তাঁকে না জানালেই ত আর কোন গোল থাকে না। কেমন, পারবেন ত?

অচলা তেমনি অধোমুখে স্থির হইয়া বসিয়া রহিল। সুরেশ কহিল, টাকার লোভে আপনি যে মত দিলেন না, এতে আমার ঢের বেশি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। বরঞ্চ মত দিলেই হয়ত আমি শেষে ভয়ে পেছিয়ে দাঁড়াতুম। আমার দ্বারা কিছুই অসম্ভব নয়। আমি চললুম। বলিয়া সুরেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া একটু হাসিয়া বলিল, আমার বলবার আর মুখ নেই—তবু যাবার সময় একটা ভিক্ষা চেয়ে যাচ্ছি যে, আমার দোষ-অপরাধগুলো মনে করে রাখবেন না। একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, নমস্কার। খারাপ কাজের জাহাজ বোঝাই করে নিয়ে বিদায় হলুম—কিন্তু বাস্তবিক, পিশাচও আমি নই। যাক—বিশ্বাস করবার যখন এতটুকু পথ রাখিনি, তখন বলা বৃথা। বলিয়াই দুই হাত তুলিয়া নমস্কার করিয়া সুরেশ দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেল।

ধীরে ধীরে তাহার পদশব্দ সিঁড়িতে মিলাইয়া গেল, অচলা শুনিতে পাইল; এবং তাহার পরেই নিতান্ত অকারণে তাহার দুই চোখ দিয়া টপটপ করিয়া জল পড়িতে লাগিল।

কেদারবাবু ঘরে ঢুকিতে ঢুকিতে বলিলেন, সুরেশ?

অচলা তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছিয়া ফেলিয়া বলিল, এইমাত্র চলে গেলেন।

কেদারবাবু আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, সে কি, আমার সঙ্গে দেখা না করেই চলে গেল? কাল এখানে খাবার কথাটা তুমি যাবার সময় স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলে ত?

অচলা অপ্রতিভ হইয়া কহিল, আমার মনে ছিল না বাবা।

মনে ছিল না! বেশ! বলিয়া কেদারবাবু নিকটস্থ চৌকিটার উপর নিশ্চেষ্টভাবে বসিয়া পড়িলেন। মেয়ের চাপা কণ্ঠস্বরে তাঁহার মনের মধ্যে একবার একটা খটকা বাজিল বটে, কিন্তু সন্ধ্যার আঁধারে মুখের চেহারাটা দেখিতে না পাইয়া সেটা স্থায়ী হইতে পারিল না। বলিলেন, এ বুড়ো বয়সে যা নিজে না করব, যেদিকে না চাইব, তাতেই একটা-না-একটা গলদ থেকে যাবে—তাই হবে না। যাই বেয়ারাটাকে দিকে এখ্‌খুনি একটা চিঠি পাঠিয়ে দিই গে। সুরেশের বাড়ির ঠিকানাটা কি? বলিয়া উঠিতে উদ্যত হইলেন।

আমি ত জানিনে বাবা!
তাও জান না! বল কি? বলিয়া বৃদ্ধ চেয়ারের উপর পুনরায় হেলান দিয়া পড়িলেন। কিন্তু তৎক্ষণাৎ আবার উঠিয়া বসিয়া রুক্ষভাবে বলিতে লাগিলেন, তোমরা নিজের হাত-পা যদি নিজেই কেটে ফেলতে চাও, ত কাটো গে মা, আমার ঠেকাবার দরকার নেই। ভাল, এটা ত একবার ভাবতে হয়, যে এককথায় এতগুলো টাকা দিতে চায়, সে লোকটা কি দরের? তার বাড়ির ঠিকানাটাও কি জিজ্ঞাসা করে রাখতে নেই? তুমি যত বড় হচ্চ, ততই যেন কি-রকম হয়ে যাচ্ছ অচলা। বলিয়া দীর্ঘশ্বাস মোচন করিলেন।

ঋণ-জাল-বিজড়িত বিপন্ন পিতা তাঁহার যে-সকল অসত্য ও হীনতার মধ্য দিয়া সম্প্রতি আত্মরক্ষার চেষ্টা করিতেন, সে-সমস্তই অচলা দেখিতে পাইত। এ-সকল তাহার মর্মভেদ করিত, কিন্তু নীরবে সহ্য করিত। এখনও সে কথা কহিয়া তাঁহার অকারণ বিরক্তির প্রতিবাদ করিল না। কিন্তু সে যেন মনে মনে অতিশয় লজ্জিত এবং অনুতপ্ত হইয়াছে, কেদারবাবু ইহাই নিশ্চিত অনুমান করিয়া প্রীত হইলেন।

বেয়ারা আলো জ্বালিয়া দিয়া গেল। তিনি সস্নেহ তিরস্কারের স্বরে বলিতে লাগিলেন, মহিমের সম্বন্ধে কোন খোঁজ কোনদিনই তুমি নিলে না। আচ্ছা, সে না হয় ভালই হয়েচে। ভগবান যা করেন, মঙ্গলের জন্যই করেন। কিন্তু সুরেশের সম্বন্ধে ত এ-সব খাটতে পারে না। দেখলে না—ঈশ্বর স্বয়ং যেন হাত ধরে এঁকে দিয়ে গেলেন।

অচলা মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, সুরেশবাবুর কাছ থেকে কি তুমি টাকা ধার নেবে বাবা?

কেদারবাবু ভগবদ্ভক্তি হঠাৎ বাধা পাইয়া বিচলিত হইয়া উঠিল। মেয়ের দিকে চাহিয়া বলিলেন, হাঁ—না, ঠিক ধার নয়; কি জান মা, সুরেশ নাকি বড় ভাল ছেলে—একালে অমন একটি সৎ ছেলে লক্ষর মধ্যে একটি মেলে। তার মনের ইচ্ছে যে, বাড়িটা ধারের জন্য না নষ্ট হয়। থাকলে তোমাদেরই থাকবে—আমি আর কতদিন—বুঝলে না, মা?

অচলা চুপ করিয়া রহিল। কেদারবাবু উৎসাহভরে বলিতে লাগিলেন, জান ত, আমি চিরকাল স্পষ্ট কথা ভালবাসি। মুখে এক, ভিতরে আর—আমার দ্বারা হবার নয়। কাজেই খুলে বলে দিলাম যে, এখন সমস্ত জেনেশুনে মহিমের হাতে মেয়ে দেবার চেয়ে তাকে জলে ফেলে দেওয়া ভাল। সুরেশেরও যখন তাই মত, তখন বলতেই হল যে, তার বন্ধুর সঙ্গে বিয়ের কথাটা অনেক দূর জানাজানি হয়ে গেছে, তখন সম্বন্ধ ভাঙলেই চলবে না—একটা গড়ে তুলতেও হবে; না হলে সমাজে মুখ দেখানো যাবে না। কিন্তু যাই বল, ছেলে বটে এই সুরেশ! আমি মঙ্গলময়কে তাই বার বার প্রণাম জানাচ্ছি।

পিতার প্রণাম জানানো আর একবার নির্বিঘ্নে সমাধা হইবার পর অচলা ধীরে ধীরে কহিল, এঁর কাছ থেকে এত টাকা না নিলেই কি নয় বাবা?

কেদারবাবু শঙ্কায় চকিত হইয়া উঠিলেন; বলিলেন, না নিলেই যে নয় মা!

বেশ! কিন্তু আমরা ত শোধ দিতে পারব না।

শোধ দেবার কথা কি সুরেশ—কথাটা উদ্বিগ্ন-সংশয়ে বৃদ্ধ শেষ করিতেই পারিলেন না। তাঁহার সমস্ত মুখ সাদা হইয়া গেল। অচলা সে চেহারা দেখিয়া হৃদয়ে ব্যথা পাইল। তাড়াতাড়ি বলিল, তিনি বলছিলেন, পরশু এসে টাকা দিয়ে যাবেন।
শোধ দেবার কথা—

না, তা তিনি বলেন নি।

লেখাপড়া-টড়া—

না, সে ইচ্ছে বোধ হয় তাঁর একেবারে নেই।

ঠিক তাই! বলিয়া পরিতৃপ্তির রুদ্ধশ্বাস বৃদ্ধ ফোঁস করিয়া ত্যাগ করিলেন এবং চেয়ারে হেলান দিয়া পড়িয়া চক্ষু মুদিয়া পা-দুটা সুমুখের টেবিলের উপর তুলিয়া দিলেন। আনন্দে এবং আরামে তাঁহার সর্বাঙ্গ যেন ক্ষণকালের জন্য শিথিল হইয়া গেল। কিছুক্ষণ এইভাবে থাকিয়া পা নামাইয়া উদ্দীপ্ত-স্বরে কহিলেন, একবার ভেবে দেখ দিকি মা, কোত্থেকে কি হল! এই সর্বশক্তিমানের হাত কি এতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছ না? অচলা নীরবে পিতার মুখপানে চাহিয়া রহিল। তিনি উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করিয়াই বলিতে লাগিলেন, আমি চোখের উপর দেখতে পাচ্চি, এ শুধু তাঁর দয়া। তোমাকে বলব কি মা, এই দুটো বৎসর একটা রাত্রিও আমি ভাল করে ঘুমাতে পারিনি—শুধু তাঁকে ডেকেচি। আর সুরেশকে দেখবামাত্রই মনে হয়েছে, সে যেন পূর্বজন্মে আমার সন্তান ছিল।

অচলা চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। পিতার সাংসারিক দুরবস্থার কথা সে জানিত বেশ, কিন্তু তাহা এতটা দূর পর্যন্ত ভিতরে ভিতরে অগ্রসর হইয়া পড়িয়াছিল, ইহাই জানিত না। আজ দুই বৎসরের একাগ্র আরাধনায় তাঁহার দুঃখের সমস্যা যদি বা মঙ্গলময়ের আশীর্বাদে অকস্মাৎ লঘু হইয়া গেল বটে, কিন্তু তাহার নিজের সমস্যা একেবারে ভীষণ জটিল হইয়া দেখা দিল। সুরেশের কাছে টাকা লওয়া সম্বন্ধে সে এইমাত্র মনে মনে যে-সকল সঙ্কল্প করিয়াছিল, তাহা আবার তাহাকে পরিত্যাগ করিতে হইল। লেশমাত্র বাধা দিবার কথা সে আর মনে করিতে পারিল না। যাই হোক, টাকাটা তাহাদের গ্রহণ করিতেই হইবে।

সান্ধ্য-উপাসনার জন্য কেদারবাবু উঠিয়া গেলেন। অচলা সমস্ত ব্যাপারটা গোড়া হইতে শেষ পর্যন্ত মনের মধ্যে স্পষ্ট করিয়া উপলব্ধি করিবার জন্য সেখানেই স্তব্ধ হইয়া রহিল।

যে দুই বন্ধু আজ অকস্মাৎ তাহার জীবনের এই সন্ধিস্থলে এমন পাশাপাশি আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহাদের একজনকে যে আজ ‘যাও’ বলিয়া বিদায় দিতেই হইবে, তাহাতে বিন্দুমাত্র সংশয় নাই; কিন্তু কাহাকে? কে সে? যে মহিম তাহার অসন্দিগ্ধ বিশ্বাসে, কে জানে কোন্‌ কর্তব্যের আকর্ষণে, নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগে বসিয়া আছে, তাহার শান্ত স্থির মুখখানা মনে করিতেই একটা প্রবল বাষ্পোচ্ছ্বাসে অচলার দুই চক্ষু পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। কোনদিন যে কোন অপরাধ করে নাই, অথচ, ‘যাও’ বলিতেই সে নিঃশব্দে বাহির হইয়া যাইবে। এ জীবনে, কোন সূত্র, কোন ছলেই আর তাহাদের পথে আসিবে না। অচলা স্পষ্ট দেখিতে লাগিল, সেই অভাবনীয় চির-বিদায়ের ক্ষণেও তাহার অটল গাম্ভীর্য এক তিল বিচলিত হইবে না, কাহাকেও দোষ দিবে না, হয়ত কারণ পর্যন্তও জানিতে চাহিবে না—নিগূঢ় বিস্ময় ও তীব্র বেদনার একটা অস্পষ্ট রেখা হয়ত বা মুখের উপর দেখা দিবে, কিন্তু সে ছাড়া আর কাহারো তাহা চোখেও পড়িবে না।

তাহার পরে একদিন সুরেশের সঙ্গে বিবাহের কথা তার কানে উঠিবে। সেই মুহূর্তের অসতর্ক অবসরে হয়ত বা একটা দীর্ঘশ্বাস পড়িবে, না হয়, একটু মুচকিয়া হাসিয়াই নিজের কাজে মন দিবে। ব্যাপারটা কল্পনা করিয়া এই নির্জন ঘরের মধ্যেও তাহার চোখ-মুখ লজ্জায়, ঘৃণায় রাঙ্গা হইয়া উঠিল।

নবম পরিচ্ছেদ

দিন দশ-বারো কাটিয়া গিয়াছে। কেদারবাবুর ভাবগতিক দেখিয়া মনে হয়, এত স্ফূর্তি বুঝি তাঁহার যুবা বয়সেও ছিল না, আজ সন্ধ্যার প্রাক্কালে বায়স্কোপ দেখিয়া ফিরিবার পথে গোলদীঘির কাছাকাছি আসিয়া তিনি হঠাৎ গাড়ি হইতে নামিতে উদ্যত হইয়া বলিলেন, সুরেশ, আমি এইটুকু হেঁটে সমাজে যাব বাবা, তোমরা বাড়ি যাও; বলিয়া হাতের ছড়িটা ঘুরাইতে ঘুরাইতে বেগে চলিয়া গেলেন।

সুরেশ কহিল, তোমার বাবার শরীরটা আজকাল বেশ ভাল বলে মনে হয়।

অচলা সেই দিকেই চাহিয়াছিল, বলিল, হাঁ, সে আপনার দয়ায়।

গাড়ি মোড় ফিরিতে আর তাঁহাকে দেখা গেল না। সুরেশ অচলার ডান-হাতটা নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া কহিল, তুমি জানো এ কথায় আমি কত ব্যথা পাই! সেই জন্যেই কি তুমি বার বার বল অচলা?

অচলা একটুখানি ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল, এত বড় দয়া পাছে ভুলে যাই বলেই যখন তখন স্মরণ করি। আপনাকে ব্যথা দেবার জন্য বলিনে।

সুরেশ তাহার হাতের উপর একটুখানি চাপ দিয়া বলিল, সেই জন্যই ব্যথা আমার বেশী বাজে।

কেন?

আমি বেশ বুঝতে পারি, শুধু এই দয়াটা স্মরণ করেই তুমি মনের মধ্যে জোর পাও। এ-ছাড়া তোমার আর এতটুকু সম্বল নেই, সত্যি কি না বল দিকি?

যদি না বলি?

ইচ্ছে না হয় বলো না। কিন্তু আমাকে ‘তুমি’ বলতেও কি কোনদিন পারবে না?

অচলার মুখ মলিন হইয়া গেল। আনত-মুখে ধীরে ধীরে বলিল, একদিন বলতেই হবে, সে ত আপনি জানেন।

তাহার ম্লান মুখ লক্ষ্য করিয়া সুরেশ নিশ্বাস ফেলিল। কহিল, তাই যদি হয়, দুদিন আগে বলতেই বা দোষ কি?

অচলা জবাব দিল না। অন্যমনস্কের মত পথের দিকে চাহিয়া রহিল।

মিনিট-খানেক নিঃশব্দে থাকিয়া সুরেশ হঠাৎ বলিয়া উঠিল, আমার মনে হয়, মহিম সমস্তই জানতে পেরেছে।

অচলা চমকাইয়া মুখ ফিরাইল। তাহার একটা হাত এতক্ষণ পর্যন্ত সুরেশের হাতের মধ্যেই ধরা ছিল, সেটা টানিয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি করে জানলেন?

তাহার ব্যগ্র কণ্ঠ সুরেশের কানে খট্‌ করিয়া বাজিল। কহিল, নইলে এতদিনে সে আসত। পনর-ষোল দিন কেটে গেল ত!

অচলা মাথা নাড়িয়া কহিল, আজ নিয়ে উনিশ দিন। আচ্ছা, বাবা কি তাঁকে কোন চিঠিপত্র লিখেছেন, আপনি জানেন?

সুরেশ সংক্ষেপে কহিল, না, জানিনে।

তিনি বাড়ি থেকে ফিরে এসেছেন কি না, জানেন?

না। তাও জানিনে।

অচলা গাড়ির বাহিরে পুনরায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া মৃদুকণ্ঠে কহিল, তাহলে খোঁজ নিয়ে একখানা চিঠিতে তাঁকে সমস্ত কথা জানানো বাবার উচিত। হঠাৎ কোনদিন আবার না এসে উপস্থিত হন।

আবার কিছুক্ষণের জন্য উভয়ে নীরব হইয়া রহিল। সুরেশ আর একবার তাহার শিথিল হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে লইয়া ধীরে ধীরে বলিতে লাগিল, আমার সবচেয়ে কষ্ট হয় অচলা, যখন মনে হয়, আমাকে কোনদিন শ্রদ্ধা পর্যন্ত করতে পারবে না। তোমার চিরকাল মনে হবে, শুধু টাকার জোরেই তোমাকে ছিঁড়ে এনেচি। আমার দোষ।
অচলা তাড়াতাড়ি মুখ ফিরাইয়া বাধা দিয়া বলিল, এমন কথা আপনি বলবেন না—আপনার কোন দোষ দিতে পারিনে। একটু থামিয়া বলিল, টাকার জোর সংসারে সর্বত্রই আছে, এ ত জানা কথা; কিন্তু সে জোরে আপনি ত জোর খাটান নি। বাবা না জানতে পারেন, কিন্তু আমি সমস্ত জেনেশুনে যদি আপনাকে অশ্রদ্ধা করি, ত আমার নরকেও স্থান হবে না।

চিরদিন সামান্য একটু করুণ কথাতেই সুরেশ বিগলিত হইয়া যায়। অচলার এইটুকু প্রিয়বাক্যেই তাহার চোখে জল আসিয়া পড়িল। সে জল, সে অচলার হাত দুখানি তুলিয়া ধরিয়া তাহাতেই মুছিয়া ফেলিয়া বলিল, মনে করো না, এ অপরাধ, এ অন্যায়ের পরিমাণ আমি বুঝতে পারিনে। কিন্তু আমি বড় দুর্বল বড় দুর্বল! এ আঘাত মহিম সইতে পারবে—কিন্তু আমার বুক ফেটে যাবে। বলিয়া একটা কঠিন ধাক্কা যেন সামলাইয়া ফেলিয়া রুদ্ধস্বরে কহিল, তুমি যে আমার নও, আর একজনের, এ কথা আমি ভাবতেই পারিনে। তোমাকে পাব না মনে হলেই আমার পায়ের নীচে মাটি পর্যন্ত যেন টলতে থাকে।

সেইমাত্র পথের ধারে গ্যাস জ্বালা হইতেছিল। গাড়ি তাহাদের গলিতে ঢুকিতেই একটা উজ্জ্বল আলো সুরেশের মুখের উপর পড়িয়া তাহার দুই চক্ষের টলটলে জল অচলার চোখে পড়িয়া গেল। মুহূর্তের করুণায় সে কোনদিন যাহা করে নাই, আজ তাহাই করিয়া বসিল। সম্মুখে ঝুঁকিয়া পড়িয়া হাত দিয়া তাহার অশ্রু মুছাইয়া দিয়া বলিয়া ফেলিল, আমি কোনদিনই বাবার অবাধ্য নই। তিনি আমাকে ত তোমার হাতেই দিয়েছেন।

সুরেশ অচলার সেই হাতটি নিজের মুখের উপর টানিয়া লইয়া বারংবার চুম্বন করিতে করিতে বলিতে লাগিল, এই আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার অচলা, এর বেশি আর চাইনে। কিন্তু, এটুকু থেকে যেন আমাকে বঞ্চিত ক’রো না।

গাড়ি বাটীর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। সহিস দ্বার খুলিয়া সরিয়া গেল, সুরেশ নিজে নামিয়া সযত্নে সাবধানে অচলার হাত ধরিয়া তাহাকে নীচে নামাইয়া উভয়েই একসঙ্গে চাহিয়া দেখিল, ঠিক সম্মুখে মহিম দাঁড়াইয়া এবং সেই নিমিষের দৃষ্টিপাতেই এই দুটি নর-নারী একেবারে যেন পাথরে রূপান্তরিত হইয়া গেল।

পরক্ষণেই অচলা অব্যক্ত আর্তস্বরে কি একটা শব্দ করিয়া সজোরে হাত টানিয়া লইয়া পিছাইয়া দাঁড়াইল।

মহিম বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া কহিল, সুরেশ, তুমি যে এখানে?

সুরেশের গলা দিয়া প্রথমে কথা ফুটিল না। তার পরে সে একটা ঢোক গিলিয়া পাংশুমুখে শুষ্ক হাসি টানিয়া আনিয়া বলিল, বাঃ—মহিম যে! আর দেখা নেই। ব্যাপার কি হে? কবে এলে? চল চল, ওপরে চল। বলিয়া কাছে আসিয়া তাহার হাতটা নাড়িয়া দিয়া হাসির ভঙ্গীতে কহিল, আচ্ছা মজা করলেন কিন্তু আপনার বাবা। তিনি গেলেন সমাজে, আর পৌঁছে দেবার ভার পড়ল এই গরীবের ওপরে। তা একরকম ভালই হয়েচে—নইলে মহিমের সঙ্গে হয়ত দেখাই হত না। বাড়িতে এতদিন ধরে করছিলে কি বল ত শুনি?

মহিম কহিল, কাজ ছিল। বিস্ময়ের প্রভাবে তাহার অচলাকে একটা নমস্কার করিবার কথাও মনে হইল না।
সুরেশ তাহাকে একটা ঠেলা দিয়া বলিল, আচ্ছা লোক যা হোক আমরা ভেবে মরি, একটা চিঠি পর্যন্ত দিতে নেই? দাঁড়িয়ে রইলে কেন? ওপরে চল। বলিয়া তাহাকে একরকম জোর করিয়াই উপরে ঠেলিয়া লইয়া গেল। কিন্তু বসিবার ঘরে আসিয়া যখন সকলে উপবেশন করিল, তখন অত্যন্ত অকস্মাৎ তাহার অস্বাভাবিক প্রগল্‌ভতা একেবারে থামিয়া গেল। গ্যাসের তীব্র আলোকে মুখখানা তাহার কালিবর্ণ হইয়া উঠিল। মিনিট দুই-তিন কেহই কথা কহিল না।

মহিম একবার বন্ধুর প্রতি একবার অচলার প্রতি শূন্য দৃষ্টিপাত করিয়া তাহাকে শুষ্ককণ্ঠে প্রশ্ন করিল, সব ভাল?

অচলা ঘাড় নাড়িয়া জবাব দিল, কিন্তু মুখ তুলিয়া চাহিল না।

মহিম কহিল, আমি ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে গেছি—কিন্তু সুরেশের সঙ্গে তোমাদের আলাপ হল কি করে?

অচলা মুখ তুলিয়া ঠিক যেন মরিয়া হইয়া বলিয়া উঠিল, উনি বাবার চার হাজার টাকা দেনা শোধ করে দিয়েছেন। তাহার মুখ দেখিয়া মহিমের নিজের মুখ দিয়া শুধু বাহির হইল—তার পরে?

তার পরে তুমি বাবাকে জিজ্ঞাসা করো, বলিয়া অচলা ত্বরিতপদে উঠিয়া বাহির হইয়া গেল। মহিম কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিয়া অবশেষে বন্ধুর প্রতি চাহিয়া কহিল, ব্যাপার কি সুরেশ?

সুরেশ উদ্ধতভাবে জবাব দিল, তোমার মত আমার টাকাটাই প্রাণ নয়। ভদ্রলোক বিপদে পড়ে সাহায্য চাইলে আমি দিই—বাস্‌, এই পর্যন্ত। তিনি শোধ দিতে না পারেন ত আশা করি, সে দোষ আমার নয়। তবু যদি আমাকেই দোষী মনে কর ত এক শ-বার করতে পার, আমার কোন আপত্তি নেই।

বন্ধুর এই অসংলগ্ন কৈফিয়ত এবং তাহা প্রকাশ করিবার অপরূপ ভঙ্গী দেখিয়া মহিম যথার্থই মূঢ়ের মত চাহিয়া থাকিয়া শেষে বলিল, হঠাৎ তোমাকেই বা দোষী ভাবতে যাব কেন, তার কোন তাৎপর্যই ত ভেবে পেলুম না সুরেশ। দয়া করে আর একটু খুলে না বললে বুঝতে পারব না।

সুরেশ তেমনি রুক্ষস্বরে কহিল, খুলে আবার বলব কি। বলবার আছেই বা কি।

মহিম কহিল, তা আছে। আমি সেদিন যখন বাড়ি যাই, তখন এদের তুমি চিনতে না। এর মধ্যে এমন ঘনিষ্ঠ পরিচয় হলই বা কি করে, আর একটা ব্রাহ্ম-পরিবারের বিপদে চার হাজার টাকা দেবার মত তোমার মনের এতখানি উদারতা এল কোথা থেকে, আপাততঃ এইটুকু বুঝিয়ে দিলেই আমি কৃতার্থ হব সুরেশ

সুরেশ বলিল, তা হতে পারে। কিন্তু আমার গল্প করবার এখন সময় নেই—এখুনি উঠতে হবে। তা ছাড়া, কেদারবাবুকেই জিজ্ঞাসা করো না, তিনি সমস্ত বলবার জন্যেই ত অপেক্ষা করে আছেন।

তাই ভাল, বলিয়া মহিম উঠিয়া দাঁড়াইল। কহিল, শোনবার ভারী কৌতূহল ছিল, কিন্তু তবু এখন তাঁর অপেক্ষায় বসে থাকবার সময় নেই। আমি চললুম—

সুরেশ স্থির হইয়া বসিয়া রহিল—কোন কথা কহিল না।

মহিম বাহিরে আসিতে দেখিতে পাইল, সুমুখের রেলিং ধরিয়া, এই দিকে চাহিয়াই অন্ধকারে অচলা দাঁড়াইয়া আছে। কিন্তু সে কাছে আসিবার বা কথা কহিবার কিছুমাত্র চেষ্টা করিল না দেখিয়া সে-ও নীরবে সিঁড়ি বাহিয়া ধীরে ধীরে নীচে নামিয়া গেল।

দশম পরিচ্ছেদ

কয়েকটা অত্যন্ত জরুরী ঔষধ কিনিতে মহিম কলিকাতায় আসিয়াছিল, সুতরাং রাত্রের গাড়িতেই বাড়ি ফিরিয়া গেল। সুরেশ সন্ধান লইয়া জানিল, মহিম তাহার বাসায় আসে নাই, দিন-চারেক পরে বিকালবেলায় কেদারবাবুর বসিবার ঘরে বসিয়া এই আলোচনাই বোধ করি চলিতেছিল। কেদারবাবু বায়স্কোপে নূতন মাতিয়াছিলেন; কথা ছিল, চা-খাওয়ার পরেই তাঁহারা আজও বাহির হইয়া পড়িবেন। সুরেশের গাড়ি দাঁড়াইয়াছিল—এমনি সময়ে দুর্গ্রহের মত ধীরে ধীরে মহিম আসিয়া অকস্মাৎ দ্বারের কাছে দাঁড়াইল।

সকলেই মুখ তুলিয়া চাহিল এবং সকলের মুখের ভাবেই একটা পরিবর্তন দেখা দিল।

কেদারবাবু বিরস-মুখে, জোর করিয়া একটু হাসিয়া অভ্যর্থনা করিলেন, এস মহিম। সব খবর ভাল?

মহিম নমস্কার করিয়া ভিতরে আসিয়া বসিল। বাড়িতে এতদিন বিলম্ব হইবার কারণ জিজ্ঞাসার প্রত্যুত্তরে শুধু জানাইল যে, বিশেষ কাজ ছিল।

সুরেশ টেবিলের উপর হইতে সেদিনের খবরের কাগজটা হাতে লইয়া পড়িতে লাগিল এবং অচলা পাশের চৌকি হইতে তাহার সেলাইটা তুলিয়া লইয়া তাহাতে মনোনিবেশ করিল। সুতরাং কথাবার্তা একা কেদারবাবু সঙ্গেই চলিতে লাগিল।

হঠাৎ এক সময়ে অচলা বাহিরে উঠিয়া গিয়া মিনিট-খানেক পরেই ফিরিয়া আসিয়া বসিল এবং ক্ষণেক পরেই মাথার উপরে টানা-পাখাটা নড়িয়া দুলিয়া ধীরে ধীরে চলিতে লাগিল। হঠাৎ বাতাস পাইয়া কেদারবাবু খুশি হইয়া বলিয়া উঠিলেন, তবু ভাল। পাখাওয়ালা ব্যাটার এতক্ষণে দয়া হল।

সুরেশ তীক্ষ্ণ বক্রদৃষ্টিতে দেখিয়া লইল, মহিমের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দিয়াছে। কেন অচলা উঠিয়া গিয়াছিল, কেন পাখাওয়ালার অকারণে দয়া প্রকাশ পাইল, সমস্ত ইতিহাসটা তাহার মনের মধ্যে বিদ্যুদ্বেগে খেলিয়া গিয়া, যে বাতাসে কেদারবাবু খুশি হইলেন, সেই বাতাসেই তাহার সর্বাঙ্গ পুড়িয়া যাইতে লাগিল। সে হঠাৎ ঘাড় তুলিয়া তিক্তকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, পাঁচটা বেজে গেছে—আর দেরি করলে চলবে না কেদারবাবু।

কেদারবাবু আলাপ বন্ধ করিয়া চায়ের জন্য হাঁকাহাঁকি করিতেই বেয়ারা সমস্ত সরঞ্জাম আনিয়া হাজির করিয়া দিল। সেলাই রাখিয়া দিয়া অচলা পেয়ালা-দুই চা তৈরি করিয়া সুরেশ ও পিতার সম্মুখে আগাইয়া দিতেই, তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি খাবে না মা?

অচলা ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না বাবা, বড় গরম।

হঠাৎ তাঁহার মহিমের প্রতি দৃষ্টি পড়ায় ব্যস্তসমস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, ও কি, মহিমকে দিলে না যে! তুমি কি চা খাবে না মহিম?

সে জবাব দিবার পূর্বেই অচলা ফিরিয়া দাঁড়াইয়া তাহার মুখপানে চাহিয়া স্বাভাবিক মৃদুকণ্ঠে কহিল, না, এত গরমে তোমার খেয়ে কাজ নেই। তা ছাড়া এবেলা ত তোমার চা সহ্য হয় না।
মহিমের বুকের উপর হইতে কে যেন অসহ্য গুরুভার পাষাণের বোঝা মায়ামন্ত্রে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিল। সে কথা কহিতে পারিল না, শুধু অব্যক্ত বিস্ময়ে নির্নিমেষ চক্ষে চাহিয়া রহিল।

অচলা কহিল, একটুখানি সবুর কর, আমি লাইম-জুস দিয়ে শরবত তৈরি করে আনচি। বলিয়া সম্মতির অপেক্ষা না করিয়াই ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল।

সুরেশ আর একদিকে মুখ ফিরাইয়া কলের পুতুলের মত ধীরে ধীরে চা খাইতে লাগিল বটে, কিন্তু তাহার প্রতি বিন্দু তখন তাহার মুখে বিস্বাদ ও তিক্ত হইয়া উঠিয়াছিল।

চা-পান শেষ করিয়া কেদারবাবু তাড়াতাড়ি কাপড় পরিয়া তৈরি হইয়া আসিয়া দেখিলেন, অচলা নিজের জায়গায় বসিয়া একমনে সেলাই করিতেছে। ব্যস্ত এবং আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, এখনো বসে কাপড় সেলাই করচ, তৈরি হয়ে নাওনি যে?

অচলা মুখ তুলিয়া শান্তভাবে কহিল, আমি যাব না বাবা।

যাবে না! সে কি কথা?

না বাবা, আজ তোমরা যাও—আমার ভাল লাগচে না। বলিয়া একটুখানি হাসিল।

সুরেশ অভিমান ও গূঢ় ক্রোধ দমন করিয়া কহিল, চলুন কেদারবাবু, আজ আমরাই যাই। ওঁর হয়ত শরীর ভাল নেই, কাজ কি পীড়াপীড়ি করে?

কেদারবাবু তাহার প্রতি চাহিয়াই তাহার ভিতরের ক্রোধ টের পাইলেন। মেয়েকে কহিলেন, তোমার কি কোনোরকম অসুখ করেচে?

অচলা কহিল, না বাবা, অসুখ করবে কেন, আমি ভাল আছি।

সুরেশ মহিমের দিকে সম্পূর্ণ পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইয়াছিল। তাহার মুখের ভাব লক্ষ্য করিল না, বলিল, আমরা যাই চলুন কেদারবাবু! ওঁর বাড়িতে কোনোরকম আবশ্যক থাকতে পারে—জোর করে নিয়ে যাবার দরকার কি?

কেদারবাবু কঠোরস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, বাড়িতে তোমার কাজ আছে?

অচলা মাথা নাড়িয়া বলিল, না।

কেদারবাবু অকস্মাৎ চেঁচাইয়া উঠিলেন, বলচি চল। অবাধ্য একগুঁয়ে মেয়ে!

অচলার হাতের সেলাই স্খলিত হইয়া নীচে পড়িয়া গেল। সে স্তম্ভিত-মুখে দুই চক্ষু ডাগর করিয়া প্রথমে সুরেশের, পরে তাহার পিতার প্রতি চাহিয়া থাকিয়া, অকস্মাৎ মুখ ফিরাইয়া দ্রুতবেগে উঠিয়া চলিয়া গেল।

সুরেশ মুখ কালি করিয়া কহিল, আপনার সব-তাতেই জবরদস্তি। কিন্তু আমি আর দেরি করতে পারিনে—অনুমতি করেন ত যাই।

কেদারবাবু নিজের অভদ্র আচরণে মনে মনে লজ্জিত হইতেছিলেন—সুরেশের কথায় রাগিয়া উঠিলেন। কিন্তু রাগটা পড়িল মহিমের উপর। সে নিরতিশয় ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হইয়া উঠি-উঠি করিতেছিল। কেদারবাবু বলিলেন, তোমার কি কোন আবশ্যক আছে মহিম?
মহিম আত্মসংবরণ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, না।

কেদারবাবু চলিতে উদ্যত হইয়া বলিলেন, তা হলে আজ আমরা একটু ব্যস্ত আছি, আর একদিন এলে—

মহিম কহিল, যে আজ্ঞে, আসব। কিন্তু আসার কি বিশেষ প্রয়োজন আছে?

কেদারবাবু সুরেশকে শুনাইয়া কহিলেন, আমার নিজের কোন প্রয়োজন নাই। তবে যদি দরকার মনে কর, এসো—দু-একটা বিষয় আলোচনা করা যাবে।

তিনজনেই বাহির হইয়া পড়িলেন। নীচে আসিয়া মহিমকে লক্ষ্যমাত্র না করিয়া সুরেশ কেদারবাবুকে লইয়া তাহার গাড়িতে উঠিয়া বসিল। কোচম্যান গাড়ি ছাড়িয়া দিল। মহিম খানিকটা পথ আসিয়াই পিছনে তাহার নাম শুনিতে পাইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া দেখিল, কেদারবাবুর বেহারা। সে বেচারা হাঁপাইতে হাঁপাইতে কাছে আসিয়া একটুকরা কাগজ হাতে দিল। তাহাতে পেনসিল দিয়া শুধু লেখা ছিল, অচলা। বেহারা কহিল, একবার ফিরে যেতে বললেন।

ফিরিয়া আসিয়া সিঁড়িতে পা দিয়াই দেখিতে পাইল—অচলা সুমুখে দাঁড়াইয়া আছে। তাহার আরক্ত চক্ষুর পাতা তখনও আর্দ্র রহিয়াছে। কাছে আসিতেই বলিল, তুমি কি তোমার কসাই বন্ধুর হাতে আমাকে জবাই করবার জন্যে রেখে গেলে? যে তোমার ওপর এত বড় কৃতঘ্নতা করতে পারলে, তার হাতে আমাকে ফেলে যাচ্ছো কি বলে? বলিয়াই ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।

মহিম স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। মিনিট-দুই পরে আঁচলে চোখ মুছিয়া কহিল, আমার লজ্জা করবার আর সময় নেই। দেখি তোমার ডান হাতটি। বলিয়া নিজেই মহিমের দক্ষিণ হস্ত টানিয়া লইয়া নিজের আঙুল হইতে সোনার আংটিটি খুলিয়া তাহার আঙুলে পরাইয়া দিতে দিতে কহিল, আমি আর ভাবতে পারিনে। এইবার যা করবার তুমি করো। বলিয়া গড় হইয়া পায়ের কাছে একটা নমস্কার করিয়া ধীরে ধীরে ঘরে চলিয়া গেল।

মহিম ভাল-মন্দ কোন কথা কহিল না। অনেকক্ষণ পর্যন্ত রেলিংটার উপর ভর দিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া, পুনরায় ধীরে ধীরে নামিয়া বাটীর বাহির হইয়া গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress