Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

আশ্চর্য রকমের ঝকঝকে আকাশ, আর থালার মতো সেই চাঁদ। অবাক হয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে। আভাস পেয়েছে, আজ বিশেষ একটা কিছু হবে। ক্লান্ত যাত্রীদল চটিতে চটিতে। আজকের মতো চলা শেষ। ধাবায় আজ একটু বেশি লোক। অনেক পাগড়িধারী। সম্ভবত রাজস্থানের যাত্রী। গেরুয়া আলখাল্লা পরা কয়েকজন। একজনের কোলে সারেঙ্গির মতো একটি বাদ্যযন্ত্র। আমি অন্যদিনের মতো সহজ হতে পারছি না। কুংকুকে আজ ভীষণ সুন্দরী, অনেক বেশি প্রাণচঞ্চল দেখাচ্ছে। সে কি জানতে পেরেছে, আজ বিশেষ কিছু হবে! একবার মাত্র তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি। বেশ ভয় করছে। এক দিকে এত প্রাণ, আর আমি একেবারেই নিষ্প্রাণ। কী যে আমার জীবনদর্শন! কি যে আমি চাই! নিজের জীবন নিয়ে খেলা। বোবা প্যাঁচার মতো চুপ করে বসে আছি।

চাঁদ যেন তরতর করে উঁচু পাহাড়টার মাথায় চড়তে যাচ্ছে। দুটি শৃঙ্গ, একটির নাম জয়, আর একটি বিজয়। চাঁদের অনেকটা কাছে আছি, তাই এত ভালো। গলা কাঁচের মতো চারপাশে থইথই করছে। জায়গাটা ক্রমশই নির্জন হয়ে আসছে। পাতার ফাঁকে ফাঁকে বাতাসের হুসহুস শব্দ। কোন তলানিতে পড়ে আছে উত্তর কলকাতার জীবন! অথর্ব জমিদার, পাগল, আধপাগল সব বংশধর। শ্যাওলা-ধরা বিভিন্ন বয়েসের মেয়েরা। চোখ দিয়ে শরীর লেহন। যৌন বিকৃতি। খালি হয়ে আসা সিন্দুক। যক্ষপুরীর গয়না। সব গঙ্গার গ্রাসে চলে যাক না।

কাঁধে হাত রেখে প্রবধবাবা বললেন, এইবার চলো।

কোথায় যাব?

পেছনের ঘরে।

একটা হাত আমার কাঁধে, আর একটা হাত কুংকুর কাঁধে। পেছন দিকে বেশ বড় একটা ঘর। পাথর ধাপে ধাপে নেমে গেছে খরস্রোতা নদীতে। তারপর পাহাড়। ঘরের মাঝখানে পুরু কম্বলের ওপর বসে আছেন, মা জগদ্ধাত্রী না কি?কী রূপ! পেতলের মতো ঝকঝকে। দু চোখে বিদ্যুৎ। ছুরির মতো গলার স্বর, এসো শঙ্কর, তোমার জন্যেই বসে আছি।

ভয়ে ভয়ে প্রণাম করলুম। মাথার পেছনে একটা হাত রাখলেন। বেশ বুঝতে পারলুম, একটা ঘোর নামছে। পশমের চাদরটা কুংকুকে জড়িয়ে দিলুম। প্রবোধবাবা বললেন, শঙ্কর, তোমার সামনে বসে আছেন পার্বতী মা। কুংকু আজই প্রথম জানতে পারবে সে কে? আমাদের। মেয়ে।

মাতাজি আমাদের বাঁদিকে, আমরা দুজনে মুখোমুখি। আমার দুটো হাতের ওপর কুংকুর দুটো হাত। লাল কাপড় দিয়ে ঢেকে রুদ্রাক্ষের মালা রেখে বেশ কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়ে বসে থাকলেন। তারপর মালা ও কাপড় তুলে নিলেন। ছোট্ট একটা রুপোর কৌটো থেকে ছোট্ট ছোট্ট দুটো গুলি বের করে দুজনের জিভে ফেলে দিলেন। অপূর্ব সুগন্ধ। সারা শরীরে অদ্ভুত এক উত্তাপ। কুংকুর ফরসা মুখে লাল আভা স্পষ্ট হচ্ছে। ভয়ংকর একটা আবেগ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। কুংকু দু-হাত দিয়ে আমার হাত দুটো চেপে ধরেছে। তার মুঠো ক্রমশ বজ্ৰমুঠো হয়ে উঠছে। মাতাজি বলছেন, তোমার মধ্যে ভালোবাসা আছে, তাই কুংকুও তোমাকে ভালোবাসবে। তোমরা অনেক অনেক দিন সুখে-আনন্দে বেঁচে থাকবে। একহাজার ফুটের নীচে নেমো না। বাতাস সেখানে ভারী। দূষিত। চিন্তার স্তর জট পাকানো। প্রেম নেই শুধু হিংসা। পবিত্র গঙ্গা যেন একটা নর্দমা।

মাতাজি দুটো কাঠের মালা আমাদের গলায় পরিয়ে দিয়ে বললেন, বদলাবদলি করো। পরের নির্দেশ চন্দন কাঠের মালা। নিজেদের জীবনের মতো যত্ন করবে। হাজার হাজার জপ ধরে রাখবে। একদিন ওই মালা নিজের শক্তিতেই ঘুরতে থাকবে। তোমাদের নিজেদের শক্তিই তোমাদের ঠিক পথে, ঠিক লক্ষ্যে নিয়ে যাবে। অন্য সব শক্তি তুচ্ছ। এইবার ওই পরদাটা সরিয়ে ভেতরে যাও। আড়ালে একটা সুড়ঙ্গ আছে। ঢুকে যাও। কিছুটা গেলেই চওড়া একটা জায়গা। শিব আছেন। কিছুক্ষণ বসে থাকো। এক সময় ওপরের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঠিক লিঙ্গের মাথার ওপর পড়বে। তখন পুজো করবে। জল দেবে, কর্পূর দেবে। শ্বেত আকন্দ দেবে। সব সাজানো আছে। প্রদীপ জ্বলছে।

আশ্চর্য একটা পথ। প্রথমে সরু, তারপর প্রশস্ত, তারপর গর্ভমন্দিরের মতো একটা স্থান। স্বয়ম্ভুলিঙ্গ শিব। কর্পূরের গন্ধ। শ্বেত, শুভ্র। কুংকু আমার পাশে না বসে কোলে বসে পড়ল। মাথাটা হেলিয়ে আমার কাঁধে। চুল ছড়িয়ে পড়েছে আমার পিঠে। অর্ধনারীশ্বর। আমার হাত দুটো জোর করে তুলে দিয়েছে তার বুকে। তার সারা শরীরে একটা তরঙ্গ খেলছে। আমার হাতের ওপর গরম নিশ্বাস পড়ছে। সাপের মতো হিস হিস শব্দ। আর ঠিক তখনই ওপর থেকে চাঁদের আলোর একটা রেখা নেমে এল শিবলিঙ্গের মাথায়। চতুর্দিকে রূপ আর রুপো। কি হচ্ছে, আর কিনা হচ্ছে। আছি না নেই। একটু পরে থাকব কি-না তাও জানি না। কুংকু তার শরীরটা সম্পূর্ণ আমার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। কস্তুরির গন্ধ। এখন আমি কি করব মহাদেব? পুজো করব না ভালোবাসব! আমার কোলে এই কি আমার সাধনার সিদ্ধির ফল? এ যে ভীষণ ভালোবাসা ভোলানাথ! তুমি তো বিশ্বপ্রেম হরসুন্দর! এ কি আলো! আমার গৌরীর মুখে।

হঠাৎ আমার মুখ দিয়ে অনায়াসে বেরোতে লাগল শঙ্কারাচার্য রচিত সেই সব অনবদ্য শিব স্তোত্র–এই হিমালয়ের বদরিকাশ্রমে বসে লিখেছিলেন, গৌরীকুণ্ড তাঁরই অপার মহিমার প্রকাশ

হে পার্বতীহৃদয়বল্লভ চন্দ্রমৌলে,
ভূতাধিপ প্রমথনাথ গিরীশজমে
হে বামদেব ভব রুদ্র পিনাকপাণে,
সংসারদুঃখ গহনাভ জগদীশ রক্ষ।।
গৌরীবিলাসভুবনায় মহেশ্বরায়,
পঞ্চাননায় শরণাগত কল্পকায়।
শর্বায় সর্বজগতামধিপায় তস্মৈ
দারিদ্রদুঃখদহনায় নমঃ শিবায়।।

মা, মা, তুমি কোথায়–আমি শক্তিতত্ব বুঝতে পারছি, পুরুষ-প্রকৃতির অভিন্নতা, তোমার কৃপা।

আমি তোমার পেছনেই আছি, তোমার কোলে আনন্দ ভৈরবী, আজ তোমার পূর্ণাভিষেক হল।

আনন্দাসনে সিদ্ধিলাভ। এই নাও আমাদের ত্রিশূল। সযত্নে এই শক্তি রক্ষা কোরো। পুরুষ আর প্রকৃতির মিলন অনুভূতিতেই পূর্ণব্রহ্মের প্রকাশ। এখন বাইরে এসে দেখো, আজ কত সাধু-মহাত্মার সমাবেশ হয়েছে। আজ মহা-উৎসবের দিন। তোমাদের কল্যাণ হোক।

Pages: 1 2 3

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress