Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গুপি গাইন ও বাঘা বাইন || Upendrakishore Ray Chowdhury

গুপি গাইন ও বাঘা বাইন || Upendrakishore Ray Chowdhury

তোমরা গান গাইতে পার? আমি একজন লোকের কথা বলব, সে একটা গান গাইতে পারত। তার নাম ছিল গুপি কাইন, তার বাবার নাম ছিল কানু কাইন। তার একটা মুদীর দোকান ছিল। গুপি কিনা একটা গান গাইতে পারত, আর সে গ্রামের আর কেউ কিছু গাইতে পারত না, তাই তারা তাকে খাতির ক’রে বলত, গুপি ‘গাইন’।

গুপি যদিও একটা বই গান জানত না, কিন্তু সেই একটা গান সে খুব ক’রেই গাইত। সেটা না গেয়ে সে তিলেকও থাকতে পারত না, তার দম আটকে আসত। যখন সে ঘরে বসে গাইত, তখন তার বাবার দোকানের খদ্দের সব ছুটে পালাত। যখন সে মাঠে গিয়ে গান গাইত, তখন মাঠের যত গরু সব দড়ি ছিঁড়ে ভাগত। শেষে আর তার ভয়ে তার বাবার দোকানে খদ্দেরই আসে না, রাখালেরাও মাঠে গরু নিয়ে যেতে পারে না। তখন একদিন কানু কাইন তাকে এই বড় বাঁশ নিয়ে তাড়া করতে সে ছুটে মাঠে চ’লে গেল। সেখানে রাখালের দল লাঠি নিয়ে আসতে বনের ভিতর গিয়ে খুব ক’রে গলা ভাঁজতে লাগল।

গুপিদের গ্রামের কাছেই আরেকটা গ্রামে একজন লোক থাকত, তার নাম ছিল পাঁচু পাইন। পাঁচুর ছেলেটির বড্ড ঢোলক বাজাবার শখ ছিল। বাজাতে বাজাতে সে বিষম ঢুলতে থাকত, আর পা নাড়ত আর চোখ পাকাত, আর দাঁত খিঁচোত, আর ভ্রুকুটি করত। তার গ্রামের লোকেরা তা দেখে হাঁ ক’রে থাকত আর বলত, ‘আহা! আ-আ-আ!! অ-অ-অ-হ-হ- হ!!!’ শেষে যখন ‘হাঃ, হাঃ, হা-হা!’ বলে বাঘের মত খেঁকিয়ে উঠত, তখন সকলে পালাবার ফাঁক না পেয়ে চিৎপাত হয়ে পড়ে যেত। তাই থেকে সকলে তাকে বলত ‘বাঘা বাইন।’ তার এই বাঘা নামই রটে গিয়েছিল। আসল নাম যে তার কি, তা কেউ জানত না।

বাঘা ঢোলক বাজাত আর রোজ একটা ক’রে ঢোলক ভাঙত। শেষে আর পাঁচু তার ঢোলকের পয়সা দিয়ে উঠতে পারে না! কিন্তু বাঘার বাজনা বন্ধ হবে, তাও কি হয়? গ্রামের লোকেরা পাঁচুকে বলল, ‘তুমি না পার, না হয় আমরাই সকলে চাঁদা করে ঢোলকের পয়সাটা দি। আমাদের গ্রামে এমন একটা ওস্তাদ হয়েছে, তার বাজনাটা বন্ধ হয়ে যাবে!’ শেষে ঠিক হল যে গ্রামের সকলে চাঁদা করে বাঘাকে ঢোলক কিনে দেবে, আর সেই ঢোলকটি আর তার ছাউনি খুব মজবুত হবে, যাতে বাঘার হাতেও সেটা আর সহজে না ছেঁড়ে।

সে যা ঢোলক হল! তার মুখ হল সাড়ে-তিন হাত চওড়া, আর ছাউনি মোষের চামড়ার। বাঘা সেটা পেয়ে যার পর নাই খুশি হয়ে বলল, ‘আমি দাঁড়িয়ে বাজাব।’

তখন থেকে সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই ঢোলক লাঠি দিয়ে বাজায়। দেড় মাস দিনরাত বাজিয়েও বাঘা সেটাকে ছিঁড়তে পারল না। ততদিনে তার বাজনা শুনে শুনে তার বাপ মা পাগল হয়ে গেল, গ্রামের লোকের মাথা ঘুরতে লাগল। আর দিনকতক এইভাবে চললে কি হত বলা যায় না। এর মধ্যে একদিন গ্রামের সকলে মিলে মোটা মোটা লাঠি নিয়ে এসে বাঘাকে বললে, ‘লক্ষ্মী, দাদা! তোমাকে দশ হাঁড়ি মিঠাই দিচ্ছি, অন্য কোথাও চলে যাও, নইলে আমরা সবাই পাগল হয়ে যাব!’

বাঘা আর কি করে? কাজেই তখন তাকে অন্য একটা গ্রামে যেতে হল। সেখানে দুদিন না থাকতে সেখানকার সকলে মিলে তাকে গ্রাম থেকে বার করে দিল। তারপর থেকে সে যেখানেই যায়, সেখান থেকেই তাকে তাড়িয়ে দেয়। তখন সে করল কি, সারাদিন মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ায়, ক্ষুধার সময় তার নিজের গ্রামে গিয়ে ঢোলক বাজাতে থাকে, আর গ্রামের লোক তাড়াতাড়ি তাকে কিছু খাবার দিয়ে বিদায় করে বলে, ‘বাঁচলাম!’

তারপর এমন হল যে আর কেউ তাকে খেতে দেয় না। আর তার ঢোলকের আওয়াজ শুনলেই আশপাশের সকল গ্রামের লোক লাঠি নিয়ে আসে। তখন বেচারা ভাবল, ‘আর না! মূর্খদের কাছে থাকার চেয়ে বনে চলে যাওয়াই ভাল। না হয় বাঘে খাবে, তবু আমার বাজনা চলবে!’ এই বলে বাঘা তার ঢোলকটিকে ঘাড়ে ক’রে বনে চ’লে গেল।

এখন বাঘার বেশ মজাই হয়েছে। এখন আর কেউ তার বাজনা শুনে লাঠি নিয়ে আসে না। বাঘে খাবে দূরে থাক, সে বনে বাঘ-ভালুক কিছু নেই। আছে খালি একটা ভয়ানক জানোয়ার। বাঘা আজও তাকে দেখতে পায় নি, শুধু দূর থেকে তারি ডাক শুনে ভয়ে থরথরিয়ে কাঁপে আর ভাবে, ‘বাবা গো। ওটা এলেই ত ঢোলক-সুদ্ধ আমাকে গিলে খাবে!’

সে ভয়ানক জানোয়ার কিন্তু কেউ নয়, সে গুপি গাইন। বাঘা যে হাক শুনে কাঁপে, সে গুপির গলা ভাঁজা। গুপিও বাঘার বাজনা শুনতে পায়, আর বাঘারই মত ভয়ে কাঁপে। শেষে একটু ভাবল, ‘এ বনে থাকলে কখন প্রানটা যাবে, তার চেয়ে এই বেলা এখান থেকে পালাই।’ এই ভেবে গুপি চুপিচুপি বন থেকে বেরিয়ে পড়ল। বেরিয়েই দেখে, আর-একটি লোকও এক বিশাল ঢোল মাথায় ক’রে সেই বনের ভিতর থেকে আসছে। তাকে দেখেই ভারি আশ্চর্য হয়ে গুপি জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কে হে?’

বাঘা বললে, ‘আমি বাঘা বাইন; তুমি কে?’

গুপি বললে, ‘আমি গুপি গাইন; তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

বাঘা বললে, ‘যেখানে জায়গা জোটে, সেইখানেই যাচ্ছি। গ্রামের লোকগুলো গাধা, গানবাজনা বোঝে না, তাই ঢোলটি নিয়ে বনে চলে এসেছিলাম। তা ভাই, এখানে যে ভয়ঙ্কর জানোয়ারের ডাক শুনেছি, তার সামনে পড়লে আর প্রাণটি থাকবে না। তাই পালিয়ে যাচ্ছি।’

গুপি বললে, ‘তাই ত! আমিও যে একটা জানোয়ারের ডাক শুনেই পালিয়ে যাচ্ছিলাম। বলো ত, তুমি জানোয়ারটাকে কোথায় বসে ডাকতে শুনেছিলে?’

বাঘা বললে, ‘বনের পূর্বধারে, বটগাছের তলায়।’

গুপি বললে, ‘আচ্ছা, সে যে আমারই গান শুনেছ। সে কেন জানোয়ারের ডাক হবে? সেই জানোয়ারটা ডাকে বনের পশ্চিম ধারে, হরতুকীতলায় ব’সে।’

বাঘা বললে, ‘সে ত আমার ঢোলকের আওয়াজ, আমি যে ঐখানে থাকতাম।’

এতক্ষণে তারা বুঝতে পারল যে, তারা তাদের নিজেদের গান আর বাজনা শুনেই ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। তখন যে দুজনার কি হাসি! অনেক হেসে তারপর গুপি বললে, ‘ভাই, আমি যেমন গাইন, তুমি তেমনি বাইন! আমরা দুজনে জুটলে নিশ্চয় একটা কিছু করতে পারি।’

এ কথায় বাঘারও খুবই মত হল। কাজেই তারা খানিক কথাবার্তার পর ঠিক করল যে, তারা দুজনায় মিলে রাজামশাইকে গান শোনাতে যাবে। রাজা মশাই যে তাতে খুব খুশি হবেন, তাতে ত আর ভুলই নেই। চাই কি অর্ধেক রাজ্য বা মেয়ের সঙ্গে বিয়েও দিয়ে ফেলতে পারেন।

গুপির আর বাঘার মনে এখন খুবই আনন্দ, তারা রাজাকে গান শোনাতে যাবে। দুজনে হাসতে হাসতে আর নাচতে নাচতে এক প্রকাণ্ড নদীর ধারে এসে উপস্থিত হল। সেই নদী পার হয়ে রাজবাড়ি যেতে হয়।

নদীতে খেয়া আছে, কিন্তু নেয়ে পয়সা চায়। বেচারারা বন থেকে এসেছে, পয়সা কোথায় পাবে! তারা বলল ‘ভাই, আমাদের কাছে ত পয়সা-পয়সা’ নেই, আমরা না হয় তোমাদের গেয়ে বাজিয়ে শোনাব, আমাদের পার করে দাও।’ তাতে খেয়ার চড়নদারেরা খুব খুশি হয়ে নেয়েকে বলল, ‘আমরা চাঁদা ক’রে এদের পয়সা দেব, তুমি এদের তুলে নাও।’

বাঘার ঢোলটি দেখেই নেয়েরও বাজনা শুনতে ভারি সাধ হয়েছিল, কাজেই সে এক কথায় আর কোনো আপত্তি করল না। গুপিকে আর বাঘাকে তুলে নিয়ে নৌকো ছেড়ে দেওয়া হল। নৌকো-ভরা লোক, ব’সে বাজাবার জায়গা কোথায় হবে? অনেক কষ্টে সকলের মাঝখানে খানিকটা জায়গা হতে হতে নৌকোও নদীর মাঝখানে এসে পড়ল। তারপর খানিকটা একটু গুনগুনিয়ে গুপি গান ধরল, বাঘা তার ঢোলকে লাঠি লাগাল, আর অমনি নৌকোসুদ্ধ সকল লোক বিষম চমকে গিয়ে গড়াগড়ি আর জড়াজড়ি করে দিল নৌকোখানাকে উলটে।

তখন ত আর বিপদের অন্ত নেই। ভাগ্যিস বাঘার ঢোলকটি এত বড় ছিল, তাই আঁকড়ে ধরে দুজনার প্রাণরক্ষা হল। কিন্তু তাদের আর রাজবাড়ি যাওয়া ঘটল না। তারা সারাদিন সেই নদীর স্রোতে ভেসে শেষে সন্ধ্যাবেলায় এক ভীষণ বনের ভিতর গিয়ে কূলে ঠেকল। সে বনে দিনের বেলায় গেলেই ভয়ে বয়ে প্রাণ উড়ে যায়, রাত্রির ত আর কথাই নেই। তখন বাঘা বলল, ‘গুপিদা, বড়ই ত বিষম দিখছি! এখন কি করি বলত।’ গুপি বলল, ‘করব আর কি?’ আমি গাইব, তুমি বাজাবে। নিতান্তই যখন বাঘে খাবে, তখন আমাদের বিদ্যোটা তাকে না দেখিয়ে ছাড়ি কেন?

বাঘা বলল, ‘ঠিক বলেছ দাদা। মরতে হয় ত ওস্তাদলোকের মতন মরি, পাড়াগেঁয়ে ভূতের মত মরতে রাজি নই!’

এই ব’লে দুজনায় সেই ভিজা কাপড়েই প্রাণ খুলে গান বাজানা শুরু করল। বাঘার ঢোলটি সেদিন কিনা ভিজা ছিল, তাইতে তার আওয়াজটি হয়েছিল যার পর নাই গম্ভীর। আর গুপিও ভাবছিল, এই তার শেষ গান, কাজেই তার গলার আওয়াজটিও খুবই গম্ভীর হয়েছিল। সে গান যে কি জমাট হয়েছিল, সে আর কি বলব? এক ঘণ্টা দু ঘণ্টা ক’রে দুপুর রাত হয়ে গেল, তবু তাদের সে গান থামছেই না।

এমন সময় তাদের দুজনারই মনে হল, যেন চারিদিকে একটা কি কাণ্ড হচ্ছে। ঝাপসা ঝাপসা কালো কালো, এই বড় বড় কি যেন সব গাছের উপর থেকে উঁকি মারতে লেগেছে। তাদের চোখগুলো জ্বলছে যেন আগুনের ভাঁটা, দাঁতগুলো বেরুচ্ছে যেন মুলোর সার। তা দেখে তখনই আপনা হতে বাঘার বাজানা থেমে গেল, তার সঙ্গে সঙ্গে দুজনার হাত-পা গুটিয়ে, পিট বেঁকে, ঘাড় বসে, চোখ বেরিযে মুখ হাঁ করে এল। তাদের গায়ে এমনি কাঁপুনি আর দাঁতে এমনি ঠকঠকি ধ’রে গেল যে, আর তাদের ছুটে পালাবারও জো রইল না।

ভূতগুলি কিন্তু তাদের কিছু করল না। তারা তাদের গান বাজনা শুনে ভারি খুশি হয়ে এসেছে, তাদের রাজার ছেলের বিয়েতে গুপির আর বাঘার বায়না করতে। গান থামতে দেখে তারা নাকিসুরে বলল, ‘থামলি কেন বাপ? বাজা, বাজা, বাজা!’

এ কথায় গুপির আর বাঘার একটু সাহস হল। তারা ভাবল, ‘এ ত মন্দ মজা নয়, তবে একটু গেয়েই দেখি না।’ এই ব’লে যেই তারা আবার গান ধরেছে, অমনি ভূতেরা একজন দুজন ক’রে গাছ থেকে নেমে এসে তাদের ঘিরে নাচতে লাগল।

সে যে কি কাণ্ডকারখানা হয়েছিল, সে কি না দেখলে বোঝবার জো আছে! গুপি আর বাঘা তাদের জীবনে আর কখনো এমন সমজদারে দেখা পায় নি। সে রাত এমনি ভাবেই কেটে গেল ভোর হলে ত আর ভূতেদের বাইরে থাকবার জো নেই, কাজেই তার একটু আগেই তারা বলল, ‘চল্‌ বাবা মোদের গোদার বেটার বে’তে! তোদের খুশি ক’রে দিব।’

গুপি বলল, ‘আমরা যে রাজাবাড়ি যাব! ভূতেরা বলল, ‘সে যাবি এখন, আগে মোদের বাড়ি একটু গানবাজনা শুনিয়ে যা! তোদের খুশি করে দিব!’ কাজেই তখন তারা দুজনে ঢোল নিয়ে ভূতেদের বাড়ি চলল। সেখান গান-বাজনা যা হল, সে আর বলে কাজ নেই।‌ তারপর তাদের বিদায় করবার সময় ভূতেরা বলল, ‘তোরা কি চাস্‌?

গুপি বলল, ‘আমরা এই চাই যে, আমরা যেন গেয়ে বাজিয়ে সকলকে খুশি করতে পারি।’ ভূতেরা বলল, ‘তাই হবে, তোদের গানবাজনা শুনলে আর সে গান শেষ হওয়ার আগে কেউ সেখান থেকে উঠে যেতে পারবে না। আর কি চাস্‌?

গুপি বলল, ‘আমরা এই চাই যে আমাদের যেন খাওয়া-পরার কষ্ট না হয়।’ এ কথায় ভূতেরা তাদের একটি থলে দিয়ে বলল, ‘তোরা যখন যা খেতে বা পরতে চাস, এই থলের ভিতরে হাত দিলেই তা পাবি। আর কি চাস্‌?’

গুপি বলল, ‘আর কি চাইব, তা ত বুঝতে পারছি না!’ তখন ভূতেরা হাসতে হাসতে তাদের দুজনকে দুজোড়া জুতো এনে দিয়ে বলল, ‘এই জুতো পায়ে দিয়ে তোরা যেখানে যেতে চাইবি, অমনি সেখানে গিয়ে হাজির হবি।’

তখন ত আর কোনো ভাবনাই রইলো না। গুপি আর বাঘা ভূতদের কাছে বিদায় হয়ে সেই জুতো পায়ে দিয়েই বলল, ‘তবে আমরা এখন রাজবাড়ি যাব।’ অমনে সেই ভীষণ বন কোথায় যেন মিলিয়ে গেল গুপি আর বাঘা দেখল, তারা দুজনে একটা প্রকাণ্ড বাড়ির ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এত বড় আর সুন্দর বাড়ি তারা তাদের জীবনে কখনো দেখে নি। তারা তখনই বুঝতে পারল যে, এ রাজবাড়ি।

কিন্তু এর মধ্যে ভারি একটা মুশকিল হল্‌ রাজাবাড়ির ফটকে যমদূতের মত কতকগুলো দারোয়ান দাঁড়িয়ে ছিল, তারা গুপি আর বাঘাকে সেই ঢোল নিয়ে আসতে দেখেই দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ‘এইয়ো! কাঁহা যাতা হ্যায়?’ গুপি থতমত খেযে বলল, ‘বাবা, আমরা রাজামশাইকে গান শোনাতে এসেছি।’ তাতে দারোয়ানগুলো আরো বিষম চটে গিয়ে লাঠি দেখিয়ে বলল, ‘ভাগো হিঁয়াসে।’ গুপিও তখন নাক সিঁটকিয়ে বলল, ‘ঈস্‌! আমরা ত রাজার কাছে যাবই।’ বলতেই অমনি সেই জুতোর গুণে, তারা তৎক্ষণাৎ গিয়ে রাজামশায়ের সামনে উপস্থিত হল।

রাজবাড়ির অন্দর মহলে রাজামহাশয় ঘুমিয়ে আছেন, রানী তাঁর মাথার কাছে বসে তাঁকে হাওয়া করছেন, এমন সময় কথা নেই বার্তা নেই, গুপি আর বাঘা সেই সর্বনেশে ঢোল নিয়ে হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হল। জুতোর এমনি গুণ, দরজা জানালা সব ব রয়েছে, তাতে তাদের একটুও আটকায় নি। কিন্তু আসবার বেলা আটকাক, আর নাই আটকাক, আসবার পরে খুবই আটকাল। রানী তাদের দেখে বিষম ভয় পেয়ে, এক চিৎকার দিয়ে তখনই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। রাজামশাই লাফিয়ে উঠে পাগলের মত ছুটাছুটি করতে লাগলেন। রাজবাড়িময় হুলস্থুল পড়ে গেল। সিপাই সান্ত্রী সব খাঁড়া ঢাল নিয়ে ছুটে এল।

বেগতিক দেকে গুপি আর বাঘার মাথায় গোল লেগে গেল। তারা যদি তখন শুধু বলে, ‘আমরা এখান থেকে অমুক জায়গায় চলে যাব, ‘তবেই তাদের জুতোর গুণে সকল ল্যাঠা চুকে যায়্‌ কিন্তু সে কথা তাদের মনেই হল না।‌ তারা গেল ছুটে পালাতে, আর দু-পা যেতে না যেতে না যেতেই বেচারারা যে মারটা খেল! জুতো, লাঠি, চাবুক, কিল, চড়, কানমলা- কিছুই তাদের বাকি রইল না। শেষে রাজামশাই হুকুম দিলেন, ‘বেটাদের নিয়ে তিন দিন হাজতে ফেলে রাখো। তারপর বিচার করে, হয় এদের মাথা কাটব, না হয় কুত্তা দিয়ে খাওয়াব।’

হায় গুপি! হায় বাঘা! বেচারারা এসেছিল রাজাকে গান শুনিয়ে কতই বকশিশ পাবে ভেবে, তার মধ্যে একি বিপদ? পেয়াদারা বেঁধে মারতে মারতে একটা অন্ধকার ঘরে নিয়ে ফেলে রাখল। সেখানে পড়ে বেচারারা একদিন আর গায়ের ব্যাথায় নড়তে চড়তে পারল না। তাতে তেমন দুঃখ ছিল না, কিন্তু বাঘার ঢোলটি যে গেল, সেই হল সর্বনাশের কথা! বাঘা বুক মাথা চাপড়িয়ে ভেউ ভেউ ক’রে কাঁদছে, কাঁদছে আর বলছে, ‘ও গুপিদা।-ওঃ-ওঃ-হ-হ-হ-অ-অ! আরে ও গুপিদা! মার খেলাম, প্রাণ যাবে, তাতে দুঃখ নেই কিন্তু দাদা, আমার ঢোলকটি যে গেল!’

গুপির কিন্তু ততক্ষণে মাথা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। সে বাঘার গায় মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘ভয় কা দাদা? ঢোল গিয়েছে, জুতো আর থলে তো আছে। আমরা নিতান্ত বেকুব, তাই এতগুলো মার খেলাম।’ যা হোক, যা হবার হয়ে গিয়েছে, এখন এর ভিতর থেকে একটা মজা ক’রে নিতে হবে।’ বাঘা এ কথায় একটু শান্ত হয়ে বলল, কি মজা হবে দাদা?’ গুপি বলল, আগে ত খাবার মজাটা ক’রে নিই, তারপর অন্য মজার কথা ভেবে দেখব এখন।

এই ব’লে সেই ভূতের দেওয়া থলির ভিতরে হাত দিয়ে বলল, ‘দাও ত দেখি, এক হাঁড়ি পোলাও।’ অমনে একটা সুগন্ধ যে বেরুল! তেমন পোলাও রাজরাও সচরাচর খেতে পান না। আর সে কি বিশাল হাঁড়ি! গুপি কি সেটা থলির ভিতর তেকে তুলে আনতে পারে? যা হোক, কোনমতে সেটাকে বার ক’রে এনে তারপর থলিকে বলর, ‘ভাজা ব্যঞ্জন, চাটনি, মিঠাই, দই, রাবড়ি, শরবত। শিগগির দাও।’ দেখতে দেখতে খাবার জিনিসে আর সোনা-রূপোর বাসনে ভ’রে গেল। দুজন লোকে আর কত খাবে? সে অপূর্ব খাবার খেয়ে তাদের গায়ের ব্যথা কোথায় চলে গেল তার আর ঠিক নেই।

তখন বাঘা বলল, ‘দাদা চলো এই বেলা এখান থেকে পালাই, নইলে শেষে কুত্তা দিয়ে খাওয়াবে? দেখাই যাক-না, কি হয়।’ এ কথায় বাঘা খুব খুশি হল। সে বুঝতে পারল যে, গুপিদা একটা-কিছু মজা করবে।

দুদিন চ’লে গেল, আর একদিন পরেই রাজা তাদের বিচার করবেন। বিচারের দিন রাত থাকতে উঠে গুপি থলের ভিতর হাত দিয়ে বলল, ‘আমাদের দুজনের রাজপোশাক চাই।’ বলতেই তার ভিতর থেকে এমন সুন্দর পোশাক বেরুল যে, তেমন পোশাক কেউ তয়েরই করতে পারে না। সেই পোশাক তারা দুজনে পরে তাদের পুরনো কাপড় আর বাসন কখানি পুঁটলি বেঁধে নিয়ে জুতো পায় দিযে তার বলল, ‘এখন আমরা মাঠে হাওয়া খেতে যাব।’ অমনি দেখে, রাজবাড়ির বাইরের প্রকাণ্ড মাঠে চ’লে এসেছে। সে মাঠের এক জায়গায় তাদের পুঁটুলিটি লুকিয়ে রেখে, তারা বেড়াতে এরে রাজবাড়ির সামনে উপস্থিত হল।

দূর থেকে তাদের আসতে দেখেই রাজার লোক ছুটে গিয়ে তাঁকে খবর দিয়েছিল যে, ‘মহারাজ, দুজন রাজা আসছেন।’ রাজাও তা শুনে তাঁর ফটকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বাঘা আর গুপি আসতেই তিনি তাদের যার পর নাই আদর দেখিয়ে বাড়ির ভিতর নিয়ে গেলেন। চমৎকার একটি ঘরে তাদের বাসা দেওয়া হল। কত চাকর, বামুন, পেয়াদা, পাইক তাদের সেবাতে লেগে গেল, তার অন্ত নেই।

তারপর গুপি আর বাঘা হাত-পা ধুয়ে জলযোগ করে একটু ঠাণ্ডা হলেই রাজামশাই তাদের খবর নিতে এলেন। তাদের পোশাক দেখে অবধিই তিনি ভেবে নিয়েছেন যে, ‘না জানি এঁরা কত বড় রাজাই হবেন।’ তারপর শেষে যখন তিনি গুপিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা কোন দেশের রাজা?’ তখন গুপি হাত জোড় ক’রে তাঁকে বলল, ‘মহারাজা! আমরা কি রাজা হতে পারি? আমরা আপনার চাকর!’

গুপি সত্য কথাই বলেছিল, কিন্তু রাজার তাতে বিশ্বাস হল না। তিনি ভাবলেন,‘কি ভাল মানুষ, কেমন নরম হয়ে কথা বলে। যেমন বড় রাজা, তেমনি ভদ্রলোকও দেখছি!’ তিনি তখন আর বিশেষ কিছু না বলে তাদের দুজনকে তাঁর সভায় নিয়ে এলেন। সেখানে সেদিন সে দুটো লোকের বিচার হবে-তিনদিন আগে যারা গিয়ে তাঁর শোবার ঘরে ঢুকেছিল। বিচারের সময় উপস্থিত, আসামী দুটোকে আনতে পেয়াদা গিয়েছে। কিন্তু তাদের আর কোথায় পাবে? এ তিন দিন তাদের ঘরে তালা বন্ধ ছিল, সেই তালা খুলে দেখা হল, সেখানে কেই নেই, খালি ঘর প’ড়ে আছে।

তখন ত ভারি একটা ছুটোছুটি হাঁকাহাঁকি পড়ে গেল। দারোগামশাই বিষম ক্ষেপে গিয়ে পেয়াদা গুলোকে বকতে লাগলেন। পেয়াদারা তাহ জোড় করে বলল, ‘হুজুর! আমাদের কোনো কসুর নেই। আমরা তালা দিয়ে রেখেছিলা, তার উপর আবার আগাগোড়া দরজার সামনে দাড়িয়েছিলা,। ও দুটো ত মানুষ ছিল না, ও দুটো ছিল ভুত; নইলে এর ভিতর থেকে কি ক’রে পালাল?’

এ কথায় সকলেরই বিশ্বাস হল। রাজামশাইও প্রথমে দারোগার উপর রেগে তাকে কেটেই ফেলতে গিয়েছিলেন, শেষে ঐ কথা শুনে বললেন, ‘ঠিক, ও দুটো নিশ্চয় ভূত। আমার ঘরও ত বন্ধ ছিল, তার ভিতর এত বড় ঢোল নিয়ে কি করে ঢুকেছিল?’

তা শুনে সকলেই বলল, ‘হাঁ হাঁ, ঠিক ঠিক, ও দুটো ভূত!’ বলতে বলতেই তাদের শরীর শিউরে উঠল, গা বেয়ে ঘাম পড়তে লাগল। তখন তারা বাঘার সেই ঢোলকটির কথা মনে করে বলল, ‘মহারাজ! ভূতের ঢোল বড় সর্বনেশে জিনিস! ওটাকে কখনো আপনার ঘরে রাখবেন না। ওটাকে এখুনি পুড়িয়ে ফেলুন।’

রাজামশাইও বললেন, ‘বাপ্‌ রে! ভূতের ঢোল ঘরে রাখব? এক্ষুনি ওটাকে এনে পোড়াও! যেই এ কথা বলা, অমনি বাঘা দুহাতে চোখ ঢেকে ‘হাউ- হাউ-হাউ-হাউ-হাউ’ ক’রে কেঁদে গড়াগড়ি দিতে লাগল!

সেদিন বাঘাকে নিয়ে গুপির কি মুশকিলই হয়েছিল। ঢোল পোড়াবার নাম শুনেই বাঘা কাঁদতে আরম্ভ করেছে, ঢোল এনে তাতে আগুন ধরিয়ে দিলে না-জানি সে কি করবে। তখন, সেটা যে তারই ঢোল, সে কথা কি আর বাঘা সামলে রাখতে পারবে? সর্বনাশ! এখন বুঝি ধরা প’ড়ে প্রাণটাই হারাতে হয়।

গুপির বড়ই ইচ্ছা হচ্ছিল যে বাঘাকে নিয়ে ছুটে পালায়। কিন্তু তার ত আর জো নেই। সভায় বসবার সময় যে সেই জুতোগুলো পা থেকে খুলে রাখা হয়েছে।

এদিকে কিন্তু বাঘার কাণ্ড দেখে সভাময় এক বিষম হুলুস্থুল প’ড়ে গেছে। সবাই ভাবছে, বাঘার নিশ্চয় একটা ভারি অসুখ হয়েছে, আর সে বাঁচবে না। রাজবাড়ির বদ্যিঠাকুর এসে বাগার নাড়ী দেখে যার পর নাই গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন। বাঘাকে খুব ক’রে জোলাপের ওষুধ খাইয়ে তার পেটে বেলেস্তারা লাগিয়ে দেওয়া হল। তারপর বদ্যিঠাকুর বললেন, ‘এতে যদি বেদনা না সারে, তবে পিঠে আর-একটা, তাতেও না সারলে দুপাশে আর দুটো বেলেস্তারা লাগাতে হবে।’

এ কথা শুনেই বাঘার কান্না তৎক্ষণাৎ থেমে গেল। তখন সকলে বালল যে, বদ্যিঠাকুর কি চমৎকার ওষুধই দিয়েছেন, দিতে বেদনা সেরে গেছে।

যা হোক, বাঘা যখন দেখল যে তার কান্নাতে ঢোল পোড়াবার কথাটা চাপা প’ড়ে গেছে, তখন সেই বেলেস্তারার বেদনার ভিতরেই তার মনটা কতক ঠাণ্ডা হল। রাজামশাই তখন তাকে খুব যত্নের সহিত তার ঘরে শুইয়ে রেখে এলেন। গুপি তার কাছে ব’সে তার বেলেনস্তারায় হাওয়া করতে লাগল।

তারপর সকলে ঘর থেকে চলে গেলে গুপি বাঘাকে বলল, ‘ছি ভাই, যেখানে-সেখানে কি এমন করে কাঁদতে আছে। দেখ দেখি, এখন কি মুশকিলটা হল।’ বাগা বলল, ‘আমি যদি না কাঁদতুম, তা হলে ত এতক্ষণে আমার ঢোলকটি পুড়িয়ে শেষ করে দিত। এখন না হয় একটু জ্বলুনি সইতে হচ্ছে, কিন্তু আমার ঢোলকটা ত বেঁচে গেছে!’

বাঘা আর গুপি এমনি কথাবার্তা বলছে। এদিকে রাজামশাই সভায় ফিরে এলে দারোগামশাই তাঁর কানে কানে বললেন, ‘মহারাজ, একটা কথা আছে, অনুমতি হয় ত বলি।’ ‘রাজা বললেন, ‘কি কথা?’ দারোগা বললেন, ‘মহারাজ, ঐ যে লোকটা গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদল, সে আর তার সঙ্গের ঐ লোকটা সেই দুই ভূত। আমি চিনতে পেরেছি।’ রাজা বললেন, ‘তাই ত হে, আমারও একটু যেন সেইরকম ঠেকছিল। তা হলে ত বড় মুশকিল দেখছি। বলো ত এখন কি করা যায়?’

তখন এ কথা নিয়ে সভার ভারি একটা কানাকানি শুরু হল। কেউ বলল, ‘রোজা ডাকো, ও দুটোকে তাড়িয়ে দিক।’ আর-একজন বলল, ‘রোজা গদি তাড়াতে না পারে, তখন ত সে দুটো কে পুড়িয়ে মারুন না।’

এ কথাটা সকলেরই খুব পছন্দ হল, কিন্তু এর মধ্যে একটু মুশকিল এই দেখা গেল যে, ভূতদের পোড়াতে গেলে রাজবাড়িতেও তখন আগুন ধরে গেদে পারে। শেষে অনেক যুক্তির পর এই স্থির হল যে, একটা বাগানবাড়িতে তাদের বাসা দেওয়া হবে। বাগানবাড়ি পুড়ে গেলেও বিশেষ ক্ষতি হবে না। রাজামশাই বললেন, ‘সেই ঢোলকটাকেও তা হলে সেই বাগানবাড়িতে নিয়ে রাখা যাক। বাগানবাড়ি পোড়াবার সময় একসঙ্গে সকল আপদ চুকে যাবে।’

বাগানবাড়ি যাবার কথা শুনে গুপি আর বাঘা খুব খুশি হল। তারা ত জানে না যে এর ভিতর কি ভয়ানক ফন্দি রয়েছে। তারা খালি ভাবল যে বেশ আরামে নিরিবিলি থাকা যাবে, সংগীত চর্চার সুবিধা হতে পারে। জায়গাটি খুবই নিরিবিলি আর সুন্দর। বাড়িটি কাঠের, কিন্তু, দেখতে চমৎকার। সেখানে গিয়ে দেখতে দেখতে বাঘা ভাল হয়ে গেল। তখন গুপি তাকে বলল, ‘ভাই, আর এখানে থেকে কাজ কি? চলো আমরা এখান থেকে চ’লে যাই।’ বাঘা বলল, ‘দাদা, এমন সুন্দর জায়গায় ত আর থাকতে পাব না, দুদিন এখানে রইলামই বা। আহা, আমার ঢোলকটি যদি থাকত!’

সেদিন বাঘা বাড়ির এঘর-ওঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে, গুপি বাগানের এক জায়গায় ব’সে গুনগুন করছে, এমন সময় হঠাৎ বাঘা ভয়ানক চেঁচামেচি ক’রে উঠল। তার সকল কথা বোঝা গেল না, খালি ‘ও গুপিদা। ও গুপিদা!’ হাকটা খুবই শোনা যেতে লাগল। গুপি তখন ছুটে এসে দেখল যে, বাঘা তার সেই ঢোলকটা মাথায় ক’রে পাগলের মত নাচছে, আর যা-তা আবোল-তাবোল বলতে বলতে ‘গুপিদা গুপিদা চেঁচাচ্ছে! ঢোলক পেয়ে তার এত আনন্দ হয়েছে যে, সে আর কিছুতেই স্থির হতে পারছে না, গুছিয়ে কথাও বলতে পারছে না। এমনি ক’রে প্রায় আধঘণ্টা চলে গেলে পর বাঘা একটু শান্ত হয়ে বলল, ‘গুপিদা, দেখছ কি, এই ঘরে আমার ঢোলকটি-আর কি মজা-হাঃ-হাঃ’ বলে আবার সে মিনিট দশেক খুব নেচে নিল। তারপর সে বলল, ‘দাদা, এত দুঃখের পর ঢোলকটি পেয়েছে। খাওয়া দাওয়ার পর রাত্রে বারান্দায় ব’সে দুজনায় খুব ক’রে গানবাজনা করা যাবে।’

রাজামশাই কিন্তু ঠিক করেছেন, সেই রাত্রেই তাদের পুড়িয়ে মারবেন। দারোগার উপর হুকুম হয়েছে যে, সেদিন সন্ধ্যার সময় সেই বাগানবাড়িতে মস্ত ভোজের আয়োজন করতে হবে।‌ দারোগামশায় পঞ্চাশ-ষাট জন লোক নিয়ে সেই ভোজে উপস্থিত থাকবেন। খাওয়াদাওয়ার পর গুপি আর বাঘা ঘুমিয়ে পড়লে, তাঁরা সকলে মিলে একসঙ্গে সেই কাঠের বাড়ির চারদিকে আগুন দিয়ে তাদের পালাবার পথ বন্ধ করবেন।

সেদিনকার খাওয়া বেশ ভালমতই হল। গুপি আর বাঘা ভাবল যে, লোকজন চ’লে গেলেই তারা গান বাজনা আরম্ভ করবে। দারোগামশাই ভাবলেন যে গুপি আর বাঘা ঘুমোলেই ঘরে আগুন দেবেন। তিনি তাদের ঘুম পড়াবার জন্য বড়ই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তাঁর ভাব দেখে যখন স্পষ্টই বোঝা গেল যে, তারা না ঘুমোলে তিনি সেখান থেকে যাবেন না, তখন গুপি বাঘাকে নিয়ে গিয়ে বিছানায় প’ড়ে নাক ডাকাতে লাগল।

একটু পরেই গুপি আর বাঘা দেখল যে লোকজন সব চ’লে গেছে, আর কারু সাড়াশব্দ নেই। তারপর আর একটু দেখে যখন মনে হল যে, বাগান একেবারে খালি হয়ে গেছে, তখন তারা দুজনে বারান্দায় এসে ঢোল বাজিয়ে গান জুড়ে দিল।

এদিকে দারোগামশাই তাঁর লোকদের বলে দিয়েছেন, ‘তোরা প্রত্যেক দরজায় বেশ ভাল ক’রে আগুন ধরাবি। খবরদার, আগুন ভাল ক’রে ধরলে চ’লে যাস নি যেন!’ তিনি নিজে গিয়েছেন সিঁড়িতে আগুন ধরাতে। আগুন বেশ ভাল মতই ধরেছে, দারোগামশাই ভাবছেন, ‘এই বেলা ছুটে পালাই’। এমন সময় বাঘার ঢোল বেজে উঠল, গুপিও গান ধ’রে দিল। তখন আর দারোগামশাই বা তাঁর লোকদের কারু সেখান থেকে গড়বার জো রইল না, সকলেই পুড়ে মরতে হল। ততক্ষণে গুপি আর বাঘাও আগন দেখতে পেয়ে তাদের জুতোর জোরে, তাদের ঢোল আর থলেটি নিয়ে সেখান থেকে চম্পট দিল।

সেদিনকার আগুনে দারোগামশাই ত পুড়ে মারা গিয়েছিলেন, তাঁর দলের অতি অল্প লোকই বেঁচেছিল। সেই লোকগুলো গিয়ে রাজামশাইকে এই ঘটনার খবর দিতে তাঁর মনে বড়ই ভয় হল। পরদিন আর দু-চার জন লোক রাজসভায় এস বলল যে, তারা সেই আগুনের তামাশা দেখতে সেখানে গিয়েছিল। তারা তখন ভারি আশ্চর্যরকমের গান-বাজনা শুনেছে, আর ভূত দুটোকে শূন্যে উড়ে পালাতে স্বচক্ষে দেখেছে। তখন যা রাজামশায়ের কাঁপুনি! সেদিন তাঁর সভা করা হল না।‌ তুনি তাড়াতাড়ি বাড়ির ভিতরে এসে ভূতের ভয়ে দরজা এঁটে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলেন, এক মাসের ভিতরে আর বাইরে এলেন না।

এদিকে গুপি আর বাঘা সেই আগনের ভিতর থেকে পালিয়ে একেবারে তাদের বাড়ীর কাছের সেই বনে এসে উপস্থিত হয়েছে, যেখানে প্রথমে তাদের দেখা হয়েছিল। তাদের বড় ইচ্ছা যে এত ঘটনার পর একবার তাদের মা-বাপকে দেখে যায়। বনে এসেই বাঘা বলল, ‘গুপিদা, এইখানে না তোমার আমায় দেখা হয়েছিল? গুপি বলল, ‘হ্যাঁ!’ বাঘা বলল, ‘গুপিদা, ‘তবে এমন জায়গায় এসে কি একটু গান-বাজনা না ক’
রে চলে যেতে আছে?’ গুপ বলল, ‘ঠিক বলেছ ভাই, তবে আর দেরি কেন? এই বেলা আরম্ভ ক’রে দাও।’ এই বলে তারা প্রাণ খুলে গান-বাজনা করতে লাগল।

এর মধ্যে এক আশ্চর্য ঘটনা হয়েছে। এক দল ডাকাত হাল্লার রাজার ভাণ্ডার লুটে, তার ছোট ছেলে দুটিকে সুদ্ধ চুরি করে নিয়ে পালিয়ে এসেছিল। রাজা অনেক সৈন্য নিয়ে তাদের পিছু পিছু প্রাণপণে ছুটেও ধরতে পারছিলেন না। গুপি আর বাঘা যখন গান ধরেছে, ঠিক সেই সময়ে সেই ডাকাতগুলো সেই বনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে গান একবার শুনলে ত আর তার শেষ অবধি না শনে চ’লে যাবার জো নেই। কাজেই ডাকাতদের তখনি সেখানে দাঁড়াতে হল। সারা রাত্রের ভিতরে আর সে গান-বাজনাও থামল না, ডাকাতদেরও সেখান থেকে যাওয়া ঘটল না। সকালে হাল্লার রাজা এসে অতি সহজেই তাদের ধ’রে ফেললেন। তারপর যখন তিনি জানলেন যে, গুপি আর বাঘার গানের গুণেই তিনি ডাকাত ধরতে পেরেছেন, তখন আর তাদের আদর দেখে কে? রাজকুমারেরাও বললেন, ‘বাবা, এমন আশ্চর্য গান আর কখখনো শোন নি। এদের সঙ্গে নিয়ে চলো!’ কাজই রাজা গুপি আর বাঘাকে বললেন, ‘তোমারা আমার সঙ্গে চলো! তেমাদের পাঁচশো টাকা ক’রে মাইনে হল।’

এ কথায় গুপি জোড়হতে রাজমশাইকে নমস্কার ক’রে বলল, ‘মহারাজ, দয়া ক’রে দুদিনের ছুটি দিতে আজ্ঞা হোক। আমরা আমাদের পিতা- মাতাকে দেখে তাঁদের অনুমতি নিয়ে আপনার রাজধানীতে গিয়ে উপস্থিত হব।’ রাজা বললেন, ‘আচ্ছা, এ দুদিন আমরা এই বনেই বিশ্রাম করছি। তোমারা তোমাদের মা-বাপকে দেখে দু’দিন পরে এসে এই খানেই আমাদের পাবে।’

গুপিকে তাড়িয়ে অবধি তার বাবা তার জন্য বড়ই দুঃখিত ছিল, কাজেই তাকে ফিরে আসতে দেখে তার বড় আনন্দ হল। কিন্তু বাঘা বেচারার ভাগ্যে সে সুখ মেলে নি। তার মা-বাপ এর বললে, ‘ঐ রে! সেই বাঘা বেটা আবার আমাদের হাড় জ্বালিয়ে মারবে। মার বেটাকে!’ বাঘা বিনয় ক’রে বলল, ‘আমি কালি আমার মা-বাবাকে দেখতে এসেছি, দুদিন থেকেই চ’লে যাব, রাজাব-টাজাব না।’ সে কথা কি তারা শোনে? তারা দাঁত খিচিয়ে তার মা-বাপের মৃত্যুর কথা বলে এই বড় লাঠি নিয়ে তাকে মারতে এল। সে প্রাণপণে ছুটে পালাতে পালাতে ইঁট মেরে তার পা ভেঙ্গে মাথা ফাটিয়ে রক্তরক্তি ক’রে দিল।

গুপি তাদের ঘরির দাওয়ায় ব’সে তার বাপের সঙ্গে কথা বলছিল। এমন সময় সে দেখন যে, বাঘা পাগলের মত হয়ে খোঁড়াতে ছুটে আসছে। তার কাপড় ছিঁড়ে ফালি ফালি আর রক্তে লাল হয়ে গেছে। অমনি সে তাড়াতাড়ি বাঘার কাছে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছে? তোমার এ দশা কেন?’ গুপিকে দেখেই বাঘা একগাল হেসে ফেলেছে। তারপর সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘দাদা, বড্ড বেঁচে এসেছি! মূর্খগুলো আর একটু হলেই আমার ঢোলটি ভেঙে দিয়েছিল! গুপিদের বাড়ি এসে গুপির যত্নে আর তার মা-বাপের আদরে বাঘার দুদিন যতটা সম্ভব সুখেই কাটল। দুদিন পর গুপি তার মা-বাপের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় ব’লে গেল, ‘তোমরা তয়ের হয়ে থাকবে। আমি আবার ছুটি পেলেই এসে তোমাদের নিয়ে নিয়ে যাব।’

তারপর কয়েক মাস চ’লে গিয়েছে। গুপি আর বাঘা এখন হাল্লার রাজার বাড়িতে পরম সুখে বাস করে। দেশ বিদেশে তাদের নাম রটে গিয়েছে- ‘এমন ওস্তাদ আর কখনো হয় নি, হবেও না।’ রাজামশাই তাদের ভারি ভালোবাসেন; তাদের গান না শুনে একদিনও থাকতে পারেন না।‌ নিজের দুঃখ সুখের কথা সব গুপির কাছে বলেন। একদিন গুপি দেখল, রাজামশায়ের মুখখানি বড়ই মলিন। তিনি ক্রমাগতই যেন কি ভাবছেন, যেনতাঁর কোনো বিপদ হয়েছে।শেষে একবার তিনি গুপিকে বললেন, ‘গুপি, মুশকিলে পড়েছি, কি হবে জানি না। শুণ্ডীর রাজা আমার রাজ্য কেড়ে নিতে আসছে।’

শুণ্ডীর রাজা হচ্ছেন সেই তিনি, যিনি গুপি আর বাঘাকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন্‌ তাঁর নাম শুনেই গুপির মনে একটা চমৎকার মতলব এল। সে তখন রাজামশাইকে বলল, ‘মহারাজ! এর জন্য কোন চিন্তা করবেন না। আপনার এই চাকরকে হুকুম দিন, আমি এ থেকে হাসির কাণ্ড ক’রে দেব। রাজা হেসে বললেন, ‘গুপি, তুমি গাইয়ে বাজিয়ে মানুষ, যুদ্ধের ধারও ধার না, তার কিছু বোঝও না। শুণ্ডীর রাজার বড় ভারি ফৌজ, আমি কি তার কিছু করতে পারি?’ গুপি বলল, ‘মহারাজ, হুকুম পেলে একবার চেষ্টা ক’রে দেখতে পারি। ক্ষতি ত কিছু হবে না।’ রাজা বললেন, ‘তোমার যা ইচ্ছা তাই তুমি করতে পার।’ এ খথায় গুপি যার পর নাই খুশি হয়ে বাঘাকে ডেকে পরামর্শ করতে লাগল।

গুপি আর বাঘা সেদিন অনেকক্ষণ ধরে পরামর্শ করেছিল্‌ বাঘার তখন কতই উৎসাহ! সে বলল, ‘দাদা, এবারে আমরা দুজনে মিলে একটা কিছু করবই করব। আমার শুধু এক কথায় একটু ভয় হচ্ছে। হঠাৎ যদি প্রাণ নিয়ে পালাবার দরকার হয়, তবে হয়ত আমি জুতোর কথা ভুলে গিয়ে সাধারণ লোকের মত কষে ছুট দিতে যাব, আর মার খেয়ে সারা হব। এমনি করে দেখ-না সেবারে আমাদের গাঁয়ে মূর্খগুলোর হাতে আমার কি দশা হ’ল!’

যা হোক, গুপি কথায় বাঘার সে ভয় কেটে গেল, আর পরদিন থেকেই তারা কাজে লাগল। দিনকতক ধরে রোজ রাত্রে তারা শুন্ডী চলে যায়, আর রাজবাড়ির আশেপাশে ঘুরে সেখানকার খবর নেয়। যুদ্ধের আয়োজন যা দেখতে পেল, সে বড়ই ভয়ঙ্কর। এ আয়োজন নিয়ে এরা হাল্লায় গিয়ে উপস্থিত হলে আর রক্ষা নেই। রাজার ঠাকরবাড়িতে রোজ মহাধুমধামে পুজো হচ্ছে। দশ দিন এমনিতর পুজো দিয়ে, ঠাকরকে খুশি ক’রে তারা হল্লায় রওনা হবে।

গুপি আর বাঘা এর সবই দেখল, তারপর একদিন তাদের ঘরে ব’সে,দরজা এঁটে,সেই ভুতের দেওয়া থলিটিকে বলল, ‘নতুন ধরনের মিঠাই চাই, খুব সরেস।’ সে কথায় থলির ভিতর থেকে মিঠাই যা বেরুল, সে আর বলবার নয়। তেমনি মিঠাই কেউ কায় নি, চোখেও দেখে নি। সেই মিঠাই নিয়ে বাঘা আর গুপি শুন্ডীর রাজার ঠাকুরবাড়ীর বিশাল মন্দিরের চূড়োয় গিয়ে বসল নীচে খুব পুজোর ধুম-ধূপধুনো শঙ্খঘন্টা কোলাহলের সীমা নেই, আঙিনায় লোকে লোকারণ্য। সেই সব লোকের মাথার উপরে ঝড়াৎ ক’রে মিঠাইগুলো ঢেলে দিয়ে বাঘা আর গুপি মন্দিরের ভিতর দিয়ে চুড়ো আঁকড়ে ধরে তামাশা দেখতে লাগল। অন্ধকারের মধ্যে সেই ধূপধূনা আর আলোর ধোঁয়ায় কেউ তাদের দেখতে পেল না।

মিঠাইগুলো আঙিনায় পড়তেই অমনি কোলাহল থেমে গেল। অনেকেই লাফিয়ে উঠল,কেউ কেই চেঁচিয়ে ছুটও দিল। তারপর দু-চার জন সাহসী লোক কয়েকটা মিঠাই তুলে, আলোর কাছে নিয়ে ভয়ে ভয়ে দেখতে লাগল। শেষে তাদের একজন চোখ বুজে তার একটু মুখে পুরে দিল।

দিয়েই আর কথাবার্তা নেই-সে দুহাতে আঙিনা থেকে মিঠাই তুলে খালি মুখে দিচ্ছে আর নাচছে আর আহাদে চেঁচাচ্ছে। তখন সেই আঙিনা-সুদ্ধ লোক মিঠাই খাবার জন্য পাগলের মত কাড়াকাড়ি আর কিচিরমিচির করতে লাগল।

এদিকে কয়েকজন ছুটে গিয়ে রাজামশাইকে বলছে, ‘মহারাজ! ঠাকুর আজ পুজোয় তুষ্ট হয়ে স্বর্গ থেকে প্রসাদ পাঠিয়ে দিয়েছেন। সে যে কি অপূর্ব প্রসাদ, সে কথা আমরা বলতেই পারছি না।’ সে কথা শুনবামাত্রই রাজামশাই প্রাণপণে কাছা গুঁজতে গুঁজতে ঊর্ধ্বশ্বাসে এস ঠাকুরবাড়িতে উপস্থিত হলেন।

কিন্তু হায়! ততক্ষণে সব প্রসাদ শেষ হযে গিয়েছিল্‌ সমস্ত উঠোন ঝাঁট দিয়েও রাজামশাইয়ের জন্য একটু প্রসাদের গুঁড়ো পাওয়া গেল না। তখনি তিনি ভারি চটে গিয়ে বললেন, ‘তোমাদের কি অন্যায়। পুজো করি আমি,আর প্রসাদ খেয়ে শেষ কর তোমরা! আমার জন্যে একটু গুঁড়োও রাখ না! তোমাদের সকলকে ধ’রে শুলে চড়াব।’ এ কথায় সকলে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জোড়াহাতে বলল, ‘দোহাই মাহরাজ! আপনার প্রসাদ কি আমরা খেয়ে শেষ করতে পারি? বাপ্‌ রে! আমরা খেতে না খেতেই ঝাঁ করে কোনখান দিয়ে ফুরিয়ে গেল।! আজ আমাদের প্রসাদগুলো আপনি মাপ করুন; কালতকের যত প্রসাদ, সব মহারাজ একাই খাবেন।’ রাজা তাতে বললেন, ‘আচ্ছা তাই হবে। খবরদার ! মনে তাকে যেন।’

পরদিন রাজামশাই প্রসাদ খাবেন, তাই একপ্রহর বেলা থাকতেই তিনি ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় এসে আকাশের পানে তাকিয়ে বসে আছেন। আর সকলে ভযে ভয়ে একটু দূরে বসে তাঁকে ঘিরে তামাশা দেখছে। আজ পুজোর ঘটা অন্যদিনের চেয়ে শতগুণ্‌ সবাই ভাবছে, দেবতা তাতে খুশি হয়ে রাজামশাইকে আরো ভাল প্রসাদ দেবেন।

রাত-দুপুরের সময় গুপি আর বাঘা আরো আশ্চর্যরকমের মিঠাই নিয়ে এসে মন্দিরের চুড়োয় বসল। আজ তাদের পরনে খুব জমকালো পোশাক, মাথায় মুকুট, গলায় হার, হাতে বালা, কানে কুণ্ডল। তারা দেবতা সেজে এসেছে। ধোঁয়ার জন্য কিছুই দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তবু রাজামশাই আকাশের পানে তাকিয়ে আছেন। এমন সময় গুপি আর বাঘা হাসতে হাসতে তাঁর উপরে সেই মিঠাইগুলো ফেলে দিল। তাতে রাজামশাই প্রথমে একটা চিৎকার দিয়ে তিন হাত লাফিয়ে উঠলেন, তারপর তাড়াতাড়ি সামলিয়ে নিয়ে,হাতে মিঠাই তুলে মুখে দিতে লাগলেন, আর ধেই ধেই ক’রে নাচনটা যে নাচলেন!

এমন সময় গুপি আর বাঘা হঠাৎ মন্দিরের চুড়ো থেকে নেমে এসে রাজার সামনে দাঁড়াল। তাদের দেখে সকলে ‘ঠাকুর এসেছেন’ বলে কে আগে গড় করবে ভেবে ঠিক পায় না। রাজামশাই ত লম্বা হয়ে মাটিতে পড়েই রয়েছেন, আর খালি মাথা ঠুকছেন। গুপি তাঁকে বলল, ‘মহারাজ! তোমার নাচ দেখে আমরা বড়ই তুষ্ট হয়েছি। এসো তোমার সঙ্গে কোলাকুলি করি।’ রাজা তা শুনে যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। দেবতার সঙ্গে কোলাকুলি, সে কি কম সৌভাগ্যের কথা?

কোলাকুলি আরম্ভ হল। সকলে ‘জয় জয়’ বলে চেঁচাতে লাগল। সেই অবসরে গুপি আর বাঘা রাজামশাইকে খুব ক’রে জড়িয়ে বলল, ‘এখন তবে আমাদের ঘরে যাব!’ বলতে বলতেই তারা তাঁকে সুদ্ধ একেবারে এসে তাদের নিজের ঘরে উপস্থিত। ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় সেই লোকগুলো অনেকক্ষন ধরে হাঁ করে আকাশের পানে চেয়ে রইল। তারপর তখন রাজামশাই আর ফিরলেন না, তখন তারা যে যার ঘরে এসে বলল, ‘কি আশ্চর্যই দেখলাম! রাজামশাই সশরীরে স্বর্গে গেলেন! দেবতারা নিজে তাঁকে নিতে এসেছিলেন!’

এদিকে রাজামশাই গুপি আর বাঘার কোলে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন, তাদের ঘরে এসেও অনেকক্ষণ তাঁর জ্ঞান হয় নি। ভোরের বেলায় তিনি চোখ মেলে দেখলেন যে, সেই দুটো ভূত তাঁর মাথার কাছে ব’সে আছে। অমনি তিনি তাদের পায়ে প’ড়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘দোহাই বাবা! আমাকে খেয়ো না! আমি দুশো মোষ মেরে তোমাদের পুজো করব।’

গুপি বলল, ‘মহারাজ, আপনার কোনো ভয় নেই। আমরা ভূতও নই, আপনাকে খেতেও যাচ্ছি না।’ রাজামশাইয়ের কিন্তু তাতে একটুও ভরসা হল না। তিনি আর কোনো কথা না ব’লে মাথা গুঁজে বসে কাঁপতে লাগলেন।

এদিকে বাঘা এসে হাল্লার রাজাকে বলল, ‘কার রাত্রে আমরা শুণ্ডীর রাজাকে ধ’রে এনেছে। একন কি আজ্ঞা হয়?’ হাল্লার রাজা বললেন, ‘তাঁকে নিয়ে এসো!’

দুই রাজার যখন দেখ হল, তখন শুণ্ডীর রাজা বুঝতে পারলেন যে তাঁকে ধ’রে এনেছে । হাল্লা জয় করা ত তাঁর ভাগ্যে ঘটলই না, এখন প্রাণটিও যাবে। কিন্তু হাল্লার রাজা তাঁকে প্রাণে না মেরে শুধু তাঁর রাজ্যই কেড়ে নিলেন। তারপর তিনি গুপি আর বাঘাকে বললেন, ‘তোমরাই আমাকে বাঁচিয়েছ, নইলে হয়ত আমার রাজ্যও যেত, প্রাণও যেত। শুন্ডীরাজ্যের অর্ধেক আর আমার দুটি কন্যা তোমাদের দুজনকে দান করলাম’। তখন খুবই একটা ধুমধাম হল। গুপি আর বাঘা হাল্লার জামাই হয়ে আর শুণ্ডীর অর্ধেক রাজ্য পেয়ে পরম আনন্দে সঙ্গীতের চর্চা করতে লাগল। গুপির মা- বাপের মান্য আর সুখ তখন দেখে কে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress