গারো পাহাড়ের নীচে – কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ আমার বাংলা ‘ গ্রন্থের একটি নিবন্ধ ‘ গারো পাহাড়ের নীচে’। এই রচনায় গারোপাহাড়ের মৌলিক যে রূপ, যে ছবি কবি এঁকেছেন তা প্রকাশের অতি ক্ষুদ্র প্রয়াস করেছি মাত্র। উনার লেখার পর্যালোচনা বা টিপ্পনী লেখার দুঃসাহস আমার নেই,তবু লেখাটি যেহেতু গারোপাহাড় নিয়ে তাই কিছুটা ভাললাগা থেকেই এই নিবন্ধের দিকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। গারোপাহাড়ে জন্ম নেওয়ায় এবং অপরূপ প্রকৃতির সাথে বেড়ে ওঠায় গারোপাহাড়ের সরল পাহাড়ি মানুষ, বন-জঙ্গল, পাহাড়,খরস্রোতা ঝরণা, নদী, জীব জন্তু, পাখি প্রভৃতি আমার মনের গভীরে অজান্তেই রেখাপাত করেছে।
কবি খুব কাছ থেকে গারোপাহাড়ের মানুষের জীবন যাত্রা দেখেছেন এবং জীবন সংগ্রামের কঠিন বাস্তব রূপকেও উপলব্ধি করেছেন। লেখাটি সম্ভবত অখণ্ড বাংলার সময়ের। তখনও বাংলাদেশ আলাদা রাষ্ট্র হয় নাই। ময়মনসিংহের উত্তরে চৈত্র মাসের কোনো রাতে দূর থেকে গারোপাহাড়কে দেখে উনি লিখেছেন – “দেখবে একরাশ ধোঁয়াটে মেঘে কারা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, ভয় পাবার কিছু নেই ; আসলে ওটা মেঘ নয় গারোপাহাড়।…”
এই পাহাড়ের আগুনকে গারোভাষায় যাকে ‘ আদাং’ বলে থাকি,পাহাড়ের গায়ের শুষ্ক ঘাস, ঝোপঝাড় আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে উর্বরতা বৃদ্ধি করা হয় আর পরবর্তীতে ‘ জুম’ বা ‘ ঝুম’ চাষের জন্য পাহাড়গুলোকে প্রস্তুত করা হয়। তাঁর লেখায় বন জঙ্গলে ঝোপঝাড়ে এই যে আগুন লাগানো তা ছোটবেলা থেকেই দেখে আমরা অভ্যস্ত, আমাদের দেখা সেই ছবি হুবুহু তুলে ধরেছেন এই লেখায়।যেন চোখ খুললেই দেখতে পাই সেই আগুন যা তিনি রাবণের চিতার সাথে তুলনা করেছেন। তিনি আরো লিখেছেন – ” জঙ্গলে যখন আগুন লাগে তখন হয় মজা। বনের যত দুর্ধর্ষ জানোয়ার প্রাণ নিয়ে পালাই পালাই করে। বাঘ-অজগর, হরিণ, শুয়োর যে যেদিকে পারে ছোটে। আর পাহাড়ী মেয়ে- পুরুষরা সেই সুযোগে মনের সুখে হরিণ আর শুয়োর মারে। তারপর সন্ধ্যেবেলা শিকার সেরে গোল হয়ে ঘিরে নাচ আর গান।..” লেখাতে যে সব পশুদের কথা উল্লেখ করেছেন, গারোপাহাড়ে সে সব পশু এবং অজগর সাপ প্রায়ই দেখা যেত।বিশেষ করে হরিণ ও শুয়োর শিকারের যে কথা উনি লিখেছেন তা অনেক কাছ থেকে আমরা দেখেছি। শীতকালেও বিশেষত হরিণ, খরগোশ শিকার হত। আর এও সত্য এই হরিণ শিকারে ছোটবেলায় দুয়েকটা পাহাড় অভিযানে যে যাই নাই তা অস্বীকার করতে পারব না।তিনি শেষে উল্লেখ করেছেন ‘পাহাড়ী মেয়ে- পুরুষরা ‘ শিকার সেরে সন্ধ্যে বেলায় নাচ গান করে থাকে।উনার লেখাতে মেয়ে শব্দটা আগে চলে এসেছে, গারো জাতি মাতৃতান্ত্রিক। মেয়েদের প্রাধান্য বেশি, আর মেয়েরা খুব কর্মঠ হয়।চাষ বাসেও মেয়েরা সমান দক্ষতায় কাজ করে থাকে।কবি হয়ত খুব কাছ থেকে গারোদের এই জীবন যাত্রা, জীবন সংগ্রাম পর্যবেক্ষণ করেছেন তাই বাস্তব চিত্রটা অতি সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এই নিবন্ধে।
উনি লিখেছেন, – ” পাথরের ওপর পুরু হয়ে পড়ে কালো ছাইয়ের পলেস্তারা, তার ওপর বীজ ছড়াতে যা সময়। দেখতে দেখতে সেই পোড়া জমির ওপর সবুজ রঙ ধরে- মাথা চাড়া দেয় ধান, তামাক আরোও কত ফসল।..” আসলে আগুনে ঝোপঝাড় পোড়ানোর পর সেই মাটি খুব উর্বর হয় এবং খুব সুন্দর ফসল ফলে।জুম চাষের পদ্ধতিতে গারোরা সেই চাষ করে থাকে।সেই শস্যের মধ্যে ধান যেমন প্রধান চাষ তেমন তিনি আরেকটা চাষের উল্লেখ করেছেন সেটা হল তামাক।মূলত পাহাড়ি গারোরা হাতে বানানো তামাক তখন বেশি ব্যবহার করত। ছোটবেলায় দেখেছি হাট বাজারে বেশ বড় বড় তামাকের দোকান বসত, তামাক কেটে বেশ উপাদেয় মিশ্রণ তৈরী করে বিক্রি করা হত। সে সময় হাট করতে আসা প্রায় সবাই অন্যান্য সামগ্রীর সাথে এই মিশ্রণও ক্রয় করে বাড়ি নিয়ে যেত। তামাক তাই তাদের চাষ বাসের মধ্যেও অগ্রধিকার পেত।তাছাড়া সেই উর্বর পাহাড়ে প্রচুর চাষ হয়ে থাকে মিষ্টি কুমোড়, শশা, শিমুল আলু,আদা,আনারস প্রভৃতি। বর্তমানে কমলা লেবু এবং কাজু চাষও ব্যপক ভাবে প্রসার ফেলেছে গারোপাহাড়ে। তাঁর লেখায় আরো উঠে এসেছে সোমেশ্বরী নদীর কথা। বাঘমারার কূল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া সেই সোমেশ্বরী নদী। সেই সোমেশ্বরী নদী শীতকালে তিনি হয়ত পার হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তাই ত তাঁর লেখায় উঠে এসেছে সোমেশ্বরীর প্রবল স্রোতের কথা। তিনি লিখেছেন, -” শীতকালে ভারী শান্ত শিষ্ট- কোথাও কোথাও মনে হবে হেঁটেই পার হই। কিন্তু সেই জলে পা দিলে,তখনি মনে হবে যেন পায়ে দড়ি দিয়ে কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে।স্রোত ত নয় যেন কুমীরের দাঁত।পাহাড়ী নদী সোমেশ্বরী, সর্বদা যেন রেগে টং হয়ে আছে!..” কাছ থেকে হৃদয় দিয়ে যা উপলব্ধি করেছেন তাই প্রস্ফুটিত হয়েছে উনার লেখায়।সোমেশ্বরী নদী একদা খুব বিখ্যাত ছিল সুস্বাদু মাছের জন্য।বেশ বড় বড় চিতল, কাতল, রুই পাওয়া যেত এই নদীতে, তন্মধ্যে আট – দশ কিলো ওজনের চিতলের কদর সবচেয়ে বেশি ছিল।
উনার লেখাতে পাহাড়ের পাদদেশের মানুষের কথাও উঠে এসেছে।উনি লিখেছেন-” পাহাড়ের নীচে যারা থাকে, তারা আমাদের মতই হাল বলদ নিয়ে চাষ-আবাদ করে।মুখে চোখে তাদের পাহাড়ী ছাপ। হাজং-গারো-কোচ-বানাই-ডালু-মার্গান এমনি সব নানা ধরনের জাত।গারোদের আলাদা ভাষা; হাজং-ডালুদের ভাষা যদিও বাংলা, কিন্তু তাদের উচ্চারণ আমাদের কানে একটু অদ্ভুত ঠেকে।’ত’ কে তারা ‘ট’ বলে,’ট’ কে ‘ত’ আবার ‘ ড’ কে তারা ‘দ’ বলে, ‘দ’ কে ‘ড’।….” এতে বোঝা যায় উনি কতটুকু আন্তরিক ভাবে মিশেছেন এই পাহাড়ি মানুষদের সাথে,তাদের ভাষার ব্যবহার, তদের কথা বলার ধরন অনেক কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন না হলে লেখায় এমন ভাবে প্রস্ফুটিত হত না।তাঁর লেখায় উঠে এসেছে সমতলের হাজংদের চাষ আবাদের কথা। হাজং শব্দের অর্থ নাকি পোকা। মানে চাষের পোকা। তাদের চাষ বাসের জুড়ি সেই সমতলে কেউ ছিল না, তাই গারোরা তাদের চাষের পোকা বলত।কবি লিখেছেন,- ” ধানের খেত দেখলে কথাটা না বিশ্বাস করে উপায় নেই,একটু কষ্ট করে যদি পাহাড়ে না হোক একটা টিলার ওপরেও ওঠো, নীচের দিকে তাকালে দেখবে পৃথিবীটা সবুজ। যতদূর দেখা যায় শুধু ধান আর ধান- একটা সীমাহীন নীল সমুদ্র যেন হঠাৎ সবুজ হয়ে গেছে।…” লেখাটিতে স্পষ্ট হয়েছে হাজংদের তৎকালীন চাষবাসের সোনালি অধ্যায়। অতি সুন্দর ভাবে এই নিবন্ধে গারো পাহাড়ের নীচের সমতলের অন্য সম্প্রদায়ের কথা এবং তাদের সামাজিক দিকটাও সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন। তাছাড়া ডালু, বানাই, কোচ সম্প্রদায় এখনো আগের মতই একসাথে মিলে মিশে গারোপাহাড়ে বাস করছে।
গারোদের সম্বন্ধে উনি লিখেছেন গারোদের ঘর দূর থেকে দেখলেই চেনা যায় । মাচা করে ঘর বাঁধা।অনেকটা টিলার ওপরে, জন্তু জানোয়ারের ভয়েই এই ব্যবস্থা।গারো পাহাড়ের মানুষের জীবন যাত্রার যে সুন্দর ছবি এঁকেছেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় নিসন্দেহে তা মনকে সাড়া দেয় ।ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা এই পাহাড়ে । সহজ সরল মানুষদের জীবন যাত্রা আজ শহরে অনেকটাই বদলে গেছে, কিন্তু গ্রাম বা পাহাড়ের জীবন যাত্রায় সেই সময়ের ছাপ এখনো বিদ্যমান। কবির গারোপাহাড় নিয়ে এই যে চিন্তন ,যে ছবি ফুটে উঠেছে নিসন্দেহে তা গারোপাহাড় ঘোরার প্রেরণা জোগাবে।প্রকৃতির সাথে জীবনের যে নিবিড় সম্পর্ক সেটা এখানে এলে বোঝা যায়। শেষে কবি লিখেছেন ,-” একটা কথা আগে থেকে বলে রাখি ও অঞ্চলে যদি কখনো যাও , ওরা তোমাকে ‘ বাঙাল ‘ বলবে। চটে যেয়ো না যেন। ‘ বাঙাল’ মানে ‘বাঙালী’।..” কবির ভাবনায় ,কবির চেতনায় এক অনন্য ইতিহাসের দলিলের সাক্ষী রয়ে গেল যেন এই লেখা। সহজ সরল পাহাড়িদের জীবন যাত্রার আশ্চর্য মেলবন্ধনের এক উন্মুক্ত দিক উঠে এসেছে এ লেখায়। নিবন্ধটিতে আরো কিছু ঘটনার উল্লেখ রয়েছে, তৎকালীন জমিদারদের ‘ হাতি বেগার ‘ আইন এবং তাদের অত্যাচারের কথা।সেটা অন্য পরিসরে লেখার চেষ্টা করব।