তৃতীয় পর্ব : জাদু এবং অদ্ভুতের জগৎ
উপন্যাসটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল জাদু এবং অদ্ভুতের খেলা। ইউরোপের রেনেসাস মধ্যযুগের অন্ধকার ভেদ করে যুক্তির আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাতে চেয়েছিল। সেরভানতে তাঁর ‘দন কিহোতে’, উপন্যাসে দেখান যে মিথ্যে ফেলগুলোর সঙ্গে বিবাহ হচ্ছে পীঠকের যুক্তির, অসম্ভব কথা লেখা হয়েছে… অবাক হোন, বন্ধ করুন, নিন্দে করুন, উপভোগ করুন। জাদুর আশ্চর্য জগৎ লোকাঁচারের হাজারো বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং আজও তা টিকে আছে প্রধানত গ্রামীণ জীবনধারায়। ঝাড়ফুক, ওঝাগিরি, ভবিষ্যদ্বাণী মানুষের সংস্কৃতির অঙ্গ, যা মধ্যযুগে গজিয়ে উঠেছিল এবং এর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে ইনকুইজিশন। জাদুর অন্ধকার জগৎ জুড়ে রয়েছে নানাভাবে হিসপানিক সাহিত্যে, আদিবাসীদের ‘মিথ’-এর সঙ্গে লাতিন আমেরিকার মেস্তিসো’ (আদিবাসী ও বহিরাগত ইউরোপীয় রক্তেরসংকর) সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে দিব্যি টিকে রয়েছে। নতুন সাহিত্যধারায় তার অনুষঙ্গ এসেছে। আলেহো কার্পেনতিয়ের, মিগেল আনহেল আতুরিয়াস, হোর্হে লুইস বোর্হেস-প্রমুখ দিকপাল সাহিত্য স্রষ্টারা ঐতিহ্যানুসারী এই জাদুজগতের প্রভাবের সদ্ব্যবহার করেছেন। নাগরিক জীবনেও এর প্রভাব দেখেছেন হুলিও কোর্তাসার। কিন্তু গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস সচেতনভাবে জাদুর নতুন অর্থ আবিষ্কার করেছেন। প্রথম দিকের পাতায় ‘ম্যাসিডোনিয়ার প্রাজ্ঞ অপরসায়নবিদ’ এর উল্লেখ ছাড়াও অপরসায়ন এবং তার মিথ’ প্রসঙ্গত এসেছে এই উপন্যাসে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় অপরসায়নের প্রভাবে মেলকিয়াদে এর যৌবন ফিরে আসে, জরা লুপ্ত হয়। এই চোখধাঁধানো প্রতিক্রিয়াকে ব্যঙ্গ করেন লেখক। মেলকিয়াদে বাঁধানো দাঁত বের করে বিস্ময়বিমুগ্ধ দর্শকদের দেখিয়ে বাজিমাত করে। কোনো কোনো জায়গায় জাদু শুধুমাত্র লোক ঠকানো খেলা। এই প্রসঙ্গে নস্ত্রাদামুসের উল্লেখ আমাদের অবাক করে। এই কাহিনির অন্যতম মুখ্য চরিত্র উরসুলা বাস্তব জগতের সঙ্গে যুক্ত, জাদু কিংবা ব্যর্থ আবিষ্কারে তার তেমন আগ্রহ নেই, অপরসায়নবিদদের সঙ্গে সত্যিকারের বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব সে বেশ বুঝতে পারে যখন তার স্বামী বলে–”বিজ্ঞানের কোন আশীর্বাদ না পেয়ে আমাদের এখানেই পচে মরতে হবে। জীবিত মানুষদের পাশাপাশি মৃতরাও হাজির হয়, যেমন হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়ার তলোয়ারের আঘাতে মৃত দেনসিও আগিলারের উপস্থিতি। এরা ভূত নয়,(দৃশ্যটির রোমান্টিক চরিত্র স্মরণীয়) এসব মৃতরা রাতেও যেমন তেমনি দিনের আলোতেও আবির্ভূত হয়, কথা বলে। প্রদেনসিও’র আবির্ভাব ওদের গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করে। আউরেলিয়ানো অপরসায়ন বিদ্যার এক সূক্ষ্ম অনুভব লাভ করে। সেইজন্যে মৃতদের আসা যাওয়া, জীবিত মানুষদের মধ্যে ওদের মিশে যাওয়া তাকে বিস্মিত করে না। মেলকিয়াদেস-এর পুনরাবির্ভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। চরিত্রগুলো যখন যুক্তিহীনতা নিয়ে অভিযোগ করে তখন আমরা জাদুকরী পরিমণ্ডল দেখতে পাই। হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়া লাতিন ভাষায় কথা বলে এক ভাষাবিদের সঙ্গে। ধর্মীয় প্রসঙ্গে Lo Maravillo/ আশ্চর্য ঘটনা মনে হতেই পারে যখন পাদ্রি নিকানোর আকাশের দিকে উঠে যাওয়ার ক্ষমতা প্রদর্শন করে।কিন্তু বাস্তবও কম জাদুকরি নয়। আউরেলিয়ানো ত্রিতে যে ভূত দেখতে পায় সেটা রেবেকা ছাড়া অন্য কেউ নয়। ভবঘুরে ইহুদি শয়তানের রূপ ধরে আসে এবং তার উপদেশাবলীও জাদুকরি।
এই উপন্যাসটিতে গার্সিয়া মার্কেস দেখান যে, যা কিছু অদ্ভুত, যা আমাদের অবাক করে সবই দৈনন্দিন জীবনেরই অন্তর্ভুক্ত এবং প্রাঞ্জল ভাষায় তিনি অতিবাস্তবকে কাব্যময় সত্যরূপে পরিবেশন করেন। দৈনন্দিনতার সঙ্গে কবিতার মিলন ঘটানোই কাব্যের উদ্দেশ্য, ভাষার জাদু আছে বলে গদ্যতেও সেই স্বাদ পাওয়া যায়।
লোককথা, লোকাচার
পাঠক উপন্যাসটি পাঠ করার পর ভাবেন যে এটা ভিন্ন প্রকৃতির। এই ভিন্নতা শুধুমাত্র সম্পূর্ণতার জন্যে নয়, লিখিত ভাষায় এযাবৎ যত সাহিত্য রচিত হয়েছে তার চাইতে বাড়তি কিছু আছে এতে, যার জন্যে এই পার্থক্য ধরা যায়। Cien Anos de soledad/ “নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসটির বেশ কিছু সূত্র এসেছে লোককথা থেকে, যদিও তা বুদ্ধিসঞ্জাত এবং সঠিকভাবে ব্যবহৃত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কিছু চরিত্র এবং ঘটনা প্রথমে এসে উধাও হয়ে যায়, কিন্তু পরে তাদের ভূমিকা স্পষ্ট বোঝা যায়। কথক হিসেবে গার্সিয়া মার্কেস দেবার মতে; তার জগৎ কোথায় শুরু এবং কোখায় শেষ জানেন তিনি, কিন্তু পাঠকদের অংশবিশেষ বলে চলে যান অন্যত্র, পরে একটা সুতো দিয়ে গল্পের মালাটি সম্পূর্ণ করেন। ডিটেকটিভ কাহিনিতে এই প্রকরণটি ব্যবহৃত হয়। Cronica de una nuerte aunciada/পূর্বঘোষিত মৃত্যুর সমাচার’ উপন্যাসে এই আঙ্গিক সফলভাবে প্রয়োগ করেন লেখক। লোককথাকার প্রাচীন কাহিনির সঙ্গে নতুন গল্প বলে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন, সামগ্রিক স্মৃতি’-কে তারা ধরে রাখেন। গল্প, কবিতা, গান যা তারা ব্যবহার করেন সবই হারিয়ে যাওয়ার পর গবেষণাপত্র বা লেখার সাহায্যে উঠে আসে। এই কথকরা প্রাচীন কাহিনি, বীরত্বের গল্প ইত্যাদি বিস্মৃতির অন্ধকারে ডুবে যেতে দেন না। আফ্রিকার লোককথা হারিয়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই মহাদেশটির সাহিত্য। উন্নত দেশগুলোতে এইসব কাহিনি পরে উঠে আসে নানাভাবে নভেলে, সংবাদপত্রে অথবা নাটকে। মাকন্দোর এক বড়ো ট্রাজেডি স্মৃতিভ্রংশত। ওই মাকন্দোর কথা ভুলে গিয়েছিল পাখিরা, গরম আর ধুলোয় শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল কিংবা বিস্মৃতির অতলে ডুবে যাওয়া গ্রামে। মেলকিয়াসে এর সঙ্গে স্মৃতি ফিরে আসে। সে মৃত্যুরহস্য জানে এবং মান্দায় বাস করার সিদ্ধান্ত নেয়, কারণ সেখানে তখনও কেউ মৃত্যু দেখেনি।
কল্পনার ভেতর দিয়ে ওরা মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়াই করে লোককথার জানা পথ ধরে যেমন হাজার এক রাতের গল্প। এর পরিচয় পাওয়া যায় যখন সাহারাজাদ প্রতি রাতে একটা করে নতুন গল্প বানায়। প্রাচ্যের যেসব গল্প ধারাবাহিক জীবনের কথা বলে তার প্রভাব আছে ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসে, হাজার এক রাতের গল্প আছে জাদুর জগৎ, এখানেও এসেছে নতুন জিপসি এবং আরও সঠিকভাবে cl cofre magico অর্থাৎ জাদুবাক্স। মাকলো একটি জাদুগ্রস্ত স্থান। এখানে ঘটে চলে অন্দুতের খেলা, প্রকৃতিতে তার ব্যাখ্যা মেলে না, অতিলৌকিকতা আসে ধর্মীয় প্রসঙ্গে। লেখক সব উপাদানই সংগ্রহ করেছেন লোককথা থেকে। শেষের দিকে ঐতিহ্য অনুসারী প্রভাব দেখা যায় যখন লড়াকু মোরগের প্রসঙ্গে রসাশ্রিত গল্প বলা হয় আর ওদের কথাবার্তা চলে ঘন্টার পর ঘন্টা। লোকগল্পের প্রভাব পাই Francisco el hombre / মদ্দা ফ্রানসিসকো চরিত্রে। এ দৃশ্য স্মরণ করায় অন্ধ গায়কের কথা, লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে এমন গল্প চালু ছিল। মেক্সিকোর corrido (কোররিদো) গান থেকে আরজেনটিনার Gaucho (গাউচো)-দের গান–সবই লোক জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
অতিশয়োক্তি এই উপন্যাসের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য, এoliardesco সাহিত্যে প্রায়শই এটা দেখা যায়, অর্থহীন গান আর কার্নিভালের কবিতা–সবই অতিকথন। অতিরঞ্জন তো পরিশীলিত সাহিত্যের অঙ্গ, xpressionist সাহিত্যে এর ছড়াছড়ি, কিন্তু আদিম শিল্পরীতিতেও এর অনেক দুষ্টান্ত আছে। কতকগুলো চরিত্রের নাম যেমন হেরিনেলদো মার্কেস সম্ভবত হিস্পানিক লোকগাথার অবদান, এমন গাথা লাতিন আমেরিকায় বহুল প্রচলিত। একটি চরিত্র নিজের সমাধি দেখতে পায়–Expronceda-রচিত ‘সালামাঙ্কার ছাত্র’ শীর্ষক উপন্যাসে। এটি লোকসাহিত্যের অন্তর্গত। Fernanda del Carpio নামটির সঙ্গে মিল আছে এক গাথার নায়ক Bernardo del Carpioর সঙ্গে। এই প্রাচীন কাহিনির নায়কের নাম ‘দন কিহোতে’ উপন্যাসেও পাওয়া যায়। উপকাহিনিগুলি মূল কাহিনির বিস্তারে সাহায্য করে। হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়ার ভারী দেহ টানতে ‘সাতজন পুরুষ’ লাগে, বদল ঘটে চরিত্র এবং আবহাওয়ায়–এইসবের মধ্যে অতিকথন আছে। মেলকিয়াদে-এর ত্বক ঢাকা পড়ে যায় কচি শ্যাওলায়, বাড়াবাড়ি হিংসায়, যুদ্ধবাজ আউরেলিয়ানো বায়েনদিয়াকে ‘বত্রিশটি যুদ্ধে যোগ দিতে হয়। নারীর রূপবর্ণনায় অতিশয়োক্তি–রেমেদিওস মর্তলোকের মানুষ ন্য, ট্রপিক্যাল বৃষ্টি নিয়ে বাড়াবাড়ি–চারবছর এগারো মাস দুদিন ধরে চলে বৃষ্টিপাত; এমন সংখ্যার ধারণাটা আগেই এসেছে পরাবাস্তববাদী লেখায়। আমারানতা উরসুলা এবং আউরেলিয়ানোর দেহজ প্রেম কোনো বাঁধন মানে না, তার বর্ণনায় লেখক বলেন–un estado enfebrecido durante la cual destruyen cuanto los rodea/’HA ARTIGO এক অবস্থা যে ওরা চারপাশের সব পার্থিব বস্তু ধ্বংস করে ফেলে।
অনেক কাহিনির সমাহার এই উপন্যাস। এক জটিল পরিবারের গোলকধাঁধায় কথক হারিয়ে যায়, জাদুর এক বিচিত্র জগৎ, এখানে সবকিছুই সম্ভব। সবকিছুর সমন্বয় ঘটানোর জন্যে প্রয়োজন এমন এক কথক, যার স্মৃতিশক্তি অসীম। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস সময় সচেতন বলে মাকন্দোর সম্পূর্ণ গল্পটি বলতে পারেন। গোড়া থেকে শেষ যে বিচিত্র অবস্থায় চরিত্রগুলোর আনাগোনা তা লেখকের কল্পনায় ছবির মতো আঁকা। সময়, অদ্ভুত পরিস্থিতি, সামগ্রিক স্মৃতি–সবই লেখকের নখদর্পণে। গল্প বলার সব উপাদান একত্র হয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। লেখকেরও মনে হয় কোনো চরিত্র বোধ হয় হারিয়ে গেল, তার মনোমতোই এটা ঘটে। কিন্তু পরে তার আবির্ভাব ঘটে এবং নতুন করে তাকে আমরা আবিষ্কার করি। চেনা মাকন্দোর পরিমণ্ডল ছেড়ে কেউ বেরোতে পারে না। বেরোলে কী অবস্থা হয় দেখা যায় যখন হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়ার কিছু পরিকল্পনা নিয়ে পত্রবাহক যাত্রা করেছিল। পথ হারিয়ে সে যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না আর অনেক বছর কর্তৃপক্ষের উত্তরের আশায় ছিল। হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়া।
কলম্বিয়ার লোককথা জানা থাকায় লেখকসবকিছুই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসহ উপন্যাসে রাখতে পেরেছেন। এক সমালোচকের মতে সাংবাদিকতার পেশায় ছিলেন বলে লেখকের লোককাহিনি জানা সম্ভব হয়েছিল, তার উপন্যাসে খুব উজ্জ্বল হয়ে ওঠে লোককথার প্রভাব। ঐতিহ্যের প্রতি প্রগাঢ় টান থাকায় তার লেখায় স্পেনীয় মিথ আর আমেরিকি বিবেকের বন্ধন গড়ে ওঠে, একদিকে স্বর্ণ অন্বেষণ, ‘এল দোরাদো, স্পেনীয় জাহাজ। আর অন্যদিকে গ্রামীণ বিশ্বাস আর পুরাতন সংস্কার সব মিলেমিশে একাকার এই উপন্যাসে।
ধর্মীয় ও সাহিত্য সম্পর্কিত মৌল উপাদান
বিবিধ সাহিত্যধারায় লালিত এই উপন্যাস। প্রথম সূত্র বাইবেল, ‘পার্থিব স্বর্গের’ মিথ থেকে মাকন্দোর সৃষ্টি যেখানে মৃত্যু বলে কিছু জানত না কেউ। হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়া সর্বদা বিস্মরণের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে বস্তুর নামকরণ করে। সে বাইবেল বর্ণিত কর্তাব্যক্তি, patriarch. মাকন্দোর এক নির্বাচিত গ্রাম, অন্য গ্রাম বা জনপদ থেকে ভিন্ন, অন্যান্য অঞ্চলের ইতিহাসও আলদা। মধ্যযুগ কিংবা তার আগের লোককথায় কিংবা ইতিহাসে সৃষ্টিসংক্রান্ত ও অতি সম্পর্কিত যে বিবরণ পাওয়া যায় তা থেকে ভিন্ন চরিত্রের এক গ্রাম এটি। ঈশ্বরের শক্তির প্রতীক পাদ্রিবাবা নিকানোর ওপরে উঠে যাওয়ার ঘটনা, বিকারগ্রস্ত পাদ্রিবাবা আনতানিও ইসাবেল-এর মুরগির ডিম ফেটে বাচ্চা বেরোনোর কথা ও শয়তান সম্বন্ধে মন্তব্য ইত্যাদি ধর্মীয় বিশ্বাসের উপকরণ অনেক আছে নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসে। ক্যাথলিক আচার ও উপলক্ষ যেমন ‘ছাইয়ের বুধবার’, কর্নেল বোয়েনদিয়ার সন্তানদের চেনার উপায়, “ছাইয়ের ক্রস’ ইত্যাদি ধর্মীয় উপকরণ। মেমের ছেলেকে পাওয়া যায় এক ভাসমান জুড়িতে যেমন মোজেসকে পাওয়া গিয়েছিল। প্রচুর ভবিষ্যদ্বাণী, মৃত্যু বা অন্য ঘটনার সংকেত ইত্যাদি বাইবেল থেকে সংগৃহীত। জনপ্রিয় ধর্মানুষ্ঠান যার মাধ্যমে অদ্ভুত ঘটনা প্রত্যক্ষ করা যায় এবং মানবিক কাজকর্মের উন্নতি ঘটে এমন সংস্কারও এই উপন্যাসে এক ভূমিকা পালন করে। ‘সুন্দরী’ রেমেদিওস-এর স্বর্গারোহণের সঙ্গে তুলনীয় Asencion de la virgen/ ‘কুমারীর স্বর্গারোহণ’ (কুমারী মারি)। প্রধান নারীচরিত্রের নাম উরসুলা, তার মৃত্যু ঘটে ‘শুভ বৃহস্পতিবার’ পাদ্রি নিকানোর পরিচালিত সমবেত প্রার্থনার অভুক্ত ধর্মীয় আচার-আচরণের মধ্যে জাদু আছে, ফেরনানদার মেমেকে উদ্ধার করা এবং তাকে কনভেন্টে দিয়ে আসার ঘটনায় লেখক জাদুবাস্তবের আশ্রয় নেন। ধর্ম আর অলৌকিতা মিশে যায়।
‘নিসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসটি সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘আমাদিস’ এবং ‘শ্বেতাঙ্গ তিরানতের’ প্রভাব আছে। মারিও ভার্গাস ইয়োসা এই বিষয়টায় বেশ জোর দিয়েছেন। ‘আমাদিস’-এ বাস্তবের সঙ্গে মিশেছে আশ্চর্যের খেলা। তিনি বলেন ‘বোয়েনদিয়া পরিবারের ইতিহাসে (আমাদিস এবং শ্বেতাঙ্গ তিরানতের মতো) বাস্তবের নানা স্তর রয়েছে ব্যক্তিগত এবং সামগ্রিক, পুরাণ এবং ইতিহাস, সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক, দৈনন্দিন এবং ‘মিথ’ বশত এবং ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসের অন্যতম উদ্দেশ্য গল্প বলার এক শতাব্দীর পুরোনো পচাগলা পথ ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেউপন্যাসকে অপ্রত্যাশিত পুনর্জীবন দান করা, মধ্যযুগের দেবতাদের পরিত্যাগ করা উচ্চাকাঙ্ক্ষাভরা এক কাঠামো তৈরি করে; সব বাস্তবতার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ‘ফিকশনের অন্তর্ভুক্ত করা মানুষের জীবনে বা কল্পনায়, যা প্রবাহিত হয়ে চলে। “আমাদিস’-এর শৈলী ভিন্ন, ওটার সঙ্গে তুলনা চলে না এই উপন্যাসটির নির্মাণের আঙ্গিক। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস যে Goliardic ক্ষমতা দেখান তা ভ্রাম্যমাণ নাইট-এর কাহিনিকারদের ছিল না। মাকন্দোর শেষ জীবিত মানুষ গাব্রিয়েল খুব বই চরিত্র, সে “রিসে যায় বদল করে পরার মত দগ্রস্থ পোশাক, এক জোড়া জুতো আর Rahelais-এর রচনা সমগ্র নিয়ে। গার্সিয়া মার্কেস-এর প্যারোডি সেরভানতে অপেক্ষা Rabelais-এর কাছাকাছি।তিনি বলেন Rabelais প্যারিসে নিয়ে গিয়েছিল Daaniel Defoe রচিত ‘বছরভর প্লেগের ডায়েরি’,এর তেমন গুরত্ব নেই এবং বিকল্পটি সমালোচকদের ফাঁদে ফেলে। বরঞ্চ Rabelais–প্রসঙ্গ যথাযথ এবং Defoe-র নামটা গার্সিয়া মার্কেস-এর ভুল সম্ভবত। Rabelais-এর নাম প্রাসঙ্গিক কারণ নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’-এর পেছনে আছে তার অনুপ্রেরণা। এই প্রসঙ্গটি আলোচনা করব। পরাবাস্তববাদীরা যাকে পুরোধা বলে মানেন সেই Rabelais-এর রচনা সহজবোধ্য নয়। Rabelais-এর মতো গার্সিয়া মার্কেন্স খুব সহজে জনপ্রিয়তা লাভ করেন, যা সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের সমস্ত বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। জনপ্রিয়তার কারণ তাদের সাহিত্য নির্মাণের শৈলী। গার্সিয়া মার্কেস-এর রচনায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাস্তবের কার্নিভাল-রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। আউরেলিয়ানোর ইতিহাস আবিষ্কারের চেষ্টা সত্য সন্ধানের মত দুরুহ এক কাজ। এই উপন্যাসে আমরা সত্যের রূপ প্রত্যক্ষ করার অবিরাম চেষ্টা লক্ষ করি। দিন কিহোতের মধ্যে ঐতিহ্য অনুসারী সত্য উদ্ঘাটনের খেলা দেখা যায়। লেখক তার আশ্চর্য কল্পনার দ্বারা স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিকের ভেদরেখা মুছে ফেলেন। নান্দনিক তরে নতুন ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে এটা সম্ভব হয় এবং পরাববাদ সম্বন্ধে আধুনিক মনে পছন্দের ক্ষেত্রেও তা ঘটেছে। সৃজনশীলতার মুক্তির অভিযান আমরা পেরিয়ে এসেছি। আসরিয়াল থেকে কোর্তাসার সবাই লাতিন আমেরিকার উপন্যাসে পরাবাস্তবতার বিবর্তন-ধারা অনুসরণ করেছেন। আধ্যাত্মিক ভাবধারা অনুসরণ করেও বুর্জোয়া বাস্তবতার দেউলিয়াপনা ধরা পড়ে এবং তার ফলেই জন্ম নেয় অন্য এক ধারার উপন্যাস যার মধ্যে মধ্যযুগীয় ‘চারণকবির স্বাধীনতা দেখা যায় (Libertad Juglaresca)। গার্সিয়া মার্কেস-এর সময় বাস্তবতা বলতে নিত্যদিনের জীবনের খুঁটিনাটির বিবরণ বোঝাত যেন নিত্যকার চিত্রলিপি অঙ্কন করাই সাহিত্য এবং সেখান থেকে Rabelais-এর শরীরশিল্প অভিমুখে যাত্রা। নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ শরীর শিল্পকে অতিরঞ্জিত করে, প্রেম সার্থক হয় এক জটিল প্রতিক্রিয়ায় যখন পিতাদের হাড়গুলো ক্লক ব্লক শব্দ করে।
কার্নিভালের জনপ্রিয় উৎসব এই উপন্যাসে দেখা যায়, এই কার্নিভালের পাগলামো উচ্চগ্রামে পৌঁছোয় যখন আউরেলিয়ানো সেগুনদো (দ্বিতীয় আউরেলিয়ানো) স্বপ্নে দেখে সে বাঘের ছদ্মবেশ নিয়ে মানুষের মধ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছে, নাক ডাকছে, তখন জলাভূমি থেকে ছদ্মবেশধারী একদল লোক এমন অপরূপ এক সুন্দরীকে নিয়ে আসছে, যা স্বপ্নেও দেখা যায় না‘। উৎসবের পরিণতি বিয়োগান্ত, কিন্তু গোলমালের মধ্যেও কার্নিভালের সব উপকরণই ছিল, “প্লাজায় জড়ো হয় সবাই, মৃত ও আহতদের মধ্যে নজন ক্লাউন, চারজন কলম্বিয়ার মেয়ে, তাসের রাজা সতেরো জন, একটা শয়তান, তিনজন যন্ত্রশিল্পী, দুজন করে ফরাসি এবং তিনজন জাপানি সম্রাজ্ঞী রতিক্রীড়ার মধ্যেও মুখোশের খেলা, মেয়েটি আউরেলিয়ানোর পালিতা, পুতুল খেলছিল, ‘ওদের চোখে ক্লাউনের রং, লাল ঠোঁট, তুর্কিদের মতো গোঁফ, চোখের পাতায় কালো পেন্সিলের (আইব্রাউ) রং, টাইপরা, মাথায় রঙিন টুপি। বাখতিন এক অচেনা কার্নিভালের কথা বলেছেন, যেখানে এক ‘ধর্ষিতা গোরুকে নানারঙের ফিতে দিয়ে সাজানো হয়। D.H, Lawrence-এর ‘লেডি চ্যাটার্লির প্রেমিক-এর একটি দৃশ্যের প্যারোডি “ বলে গণ্য হতে পারে। ওই গ্রন্থটিতে এমন একটি দৃশ্য আছে। আউরেলিয়ানো সেগুনদোর হজমশক্তির প্রতিযোগিতা কার্নিভালের অন্তর্গত। আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়ার সঙ্গে মসকোতের বিবাহোৎসকের মাধ্যমে উপলক্ষটি শুধু নয়, আগের রীতিনীতিকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে।
সাহিত্যের সূত্র ধরে কিছু মিথ’ আসে, যেমন, সাইবেন কিংবা আমারাতা মৃত্যুর অপেক্ষায় চারবছর ধরে শবাচ্ছাদনবস্ত্র বোনে দুটোই এসেছে ‘ওডিসি থেকে। হোসে আরকাদিও বোয়েন দিয়া নতুন আবিষ্কারের নেশায় পাগলামো করে আর কত অচেনা মানুষ অবাস্তব কাজকর্ম করে, যেমন অপরসায়ন, পার্চমেন্ট ইত্যাদি। দন কিহোতের মিথ এখানে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। শৈশব যেন মানসিকতায় অসম্পূর্ণ’–এই ধারণা আসে রুশোর। প্রথম গ্রন্থ ‘এমিল থেকে এবং “উদাসীন রাত্রি কাদালসো থেকে যার মধ্যে মনুষ্যজীবনের। শুরুর কথা বলা হয় এইভাবে প্রথম বছরগুলো…অসুখ, রুগ্নতা, নির্বুদ্ধিতা, বিরক্তি, গা ঘিনঘিনে…। নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসে বেহেসীয় ভাবনার ছড়াছড়ি দেখতে পাই। হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়া এবং উরসুলার পরিবারের উৎপত্তির সঙ্গে মিল আছে বোর্হেস এর গল্পে। আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়ার জীবনচক্রের সংক্ষিপ্তসার বোর্হেস-এর কিছু গল্পের ছক গ্রহণ করেছে, বিশেষত সময় এবং ব্যর্থতার কথায়, তার নামে রাস্তা তৈরি করার মধ্যে মরণোত্তর খ্যাতি এবং পরিহাসে। গল্প বলার কাঠামোর সঙ্গে বোর্সে-এর নাম এসে যায়, যেমন, প্রতিবিম্ব নিয়ে খেলা (বাস্তব প্রতিবিম্বে ধরা পড়ে। যার বহু ব্যবহার আছে, আবার একই রকম ঘরের গোলকধাঁধা তারই আবিষ্কার।
আলেহা কারপেনতিয়ের-এরনামটি উল্লেখ করা উচিত। তার ‘আলোর শতাব্দী’ উপন্যাসের নায়ক ভিকতাউগেস-এর বীরত্বের সঙ্গে কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়ার সাদৃশ্য আছে। পুলিশের অত্যাচার; সন্ত্রাস এবং স্বেচ্ছাচারের একটি দৃষ্টান্তস্বরূপ এক দৃশ্য আছে নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসে, যখন সাত বছরের এক বালক তার পানীয় নিয়ে যাবার সময় এক পুলিশের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ইউনিফর্মে পানীয়ের সামান্য লেগে যায়, এই অপরাধে তাকে টুকরো করে কেটে ফেলে পুলিশ আর ছেলেটির দাদু বাধা দিতে গেলেও তার গলা কেটে ফেলা হয়। এমন একটি দৃশ্য পাওয়া যায় মিগেল আনহেল আতুরিয়াস-এর ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট উপন্যাসে। সেখানে দৃশ্যটা এইরকম–এক বৃদ্ধ সচিবের হাত থেকে দোয়াত পড়ে যায় প্রেসিডেন্ট-এর গায়ে, যার শাস্তি চলে জীবনভর। এক মার্কিন চরিত্রের আবির্ভাব এবং তার সঙ্গে মাকান্দার উন্নতি এবং ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে সাদৃশ্য পাওয়া যায় রোমুলো গাইয়েগোর ‘দন্যা বারগারা’ উপন্যাসের মিস্টার ডেনজার নামক চরিত্রের। কর্নেল লোরেনসো গাভিলান কার্লোস ফোয়েনতে-এর ‘আর্তেমিও ক্রুশের মৃত্যু’ উপন্যাসের এক চরিত্র এবং ‘রোকামাদুর’ হুলিও কোরতাসারের ‘রাইওয়েলা’ (এক্কা দোক্কা) উপন্যাসের চরিত্র।
বৃষ্টির জলে ডুবন্ত বাড়ির জল নিষ্কাশনের ঘটনাটি আগেই উল্লিখিত হয়েছে উরুগুয়ের ফেলিসবের্তো এরনানদেস-রচিত ‘ডুবে যাওয়া বাড়ি’ উপন্যাসে। হোসে আরকাদিও এবং রেবেকার অজাচার সম্পর্কের পটভূমি স্মরণ করিয়ে দেয় ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার আমমার এবং তামমোন’ কবিতায়, এর উৎস বাইবেল বর্ণিত একটি ঘটনায়, যদিও প্রাচীন স্পেনীয় গাথায় এমন কাহিনির উল্লেখ আছে। আমরা জানি যে, গার্সিয়া মার্কেস লেখক জীবনের গোড়ায় ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। লা হিরাফা’ (জিরাফ) পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে গার্সিয়া মার্কেস বলেন ‘আটলানটিকের উপকুলে যে-কোনো গ্রামে এমন অসহায় দুঃখী মহিলা অনেক দেখা যায় এবং গার্সিয়া লোরকা নাটকে তাদের জীবন ও মৃত্যুর করুণ কাহিনি বিবৃত করেন…। গার্সিয়া মার্কেস যে নাটকটির কথা বলেন তার শিরোনাম ‘বেরনার্দা আলবার বাড়ি। কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়ার সঙ্গে যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে উইলিয়াম ফকনারের সাররিসূচরিত্রটির সঙ্গে। ভবঘুরে ইহুদি চরিত্রটির মধ্যে মিথ’-এর বৈশিষ্ট্য আছে। এই বিষয়টি উনবিংশ শতাব্দীর সাহিত্যে বারবার এসেছে। কিন্তু এই উপন্যাসে মাকন্দোয় সে আসার পর এত গরম পড়ে যে পাখিরা বাড়ির তারের জানলা ভেদ করে শয়নকক্ষে প্রবেশ করে মরার জন্যে। একবার সে এক দানবের রূপ ধরে আসে, কিন্তু গ্রামবাসীরা তাকে হত্যা করে। দুই ক্ষেত্রে বাইবেল কথিত “Apocalypsis”-এর সঙ্গে মিল পাওয়া যায়।
বিভিন্ন সূত্র থেকে উপাদান নিয়ে এমনভাবে আত্মস্থ করে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস উপন্যাসটি নির্মাণ করেছেন যা নতুন হলেও পুরাতনের ছায়া সর্বত্র বিদ্যামান। কিন্তু তার শৈলী কোলাজ থেকে একেবারেই ভিন্ন। মারিও ভার্গাস ইয়োসার মতে তার ঈশ্বরদ্রোহী ক্ষমতা বলে এমন এক সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে যার অজানা কোনো সূত্র নেই। শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা বাস্তবের সঙ্গে সাহিত্যলোকের মিলন (আদিম ও জনপ্রিয়), এমন এক রীতিতে আখ্যান রচিত হয় যা অতল এক জলাশয়। এখানে কয়েকটিমাত্র বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হল, যা বিশ্লেষণ করার জন্যে বিস্তারিত আলোচনা করার অবকাশ আছে।