Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস || Sankar Brahma

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস || Sankar Brahma

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের জন্ম হয় ৬ই মার্চ ১৯২৭ আরাকাতকা, মাগদালেনা, কলম্বিয়ায়।
যিনি ‘গাবো’ নামেও পরিচিত ছিলেন, তিনি ছিলেন একজন কলম্বীয় সাহিত্যিক, সাংবাদিক, প্রকাশক ও রাজনীতিবিদ। স্পেনীয় ভাষায় তার পূর্ণ নাম (Gabriel José de la Concordia García Márquez) গাব্রিয়েল্‌ খ়োসে দে লা কোঙ্কোর্দিয়া গার্সিয়া মার্কেস্‌।
জন্মের পর তাঁর শৈশব কাটে মা, দাদু ও দিদিমার সঙ্গে। তার আট বছর বয়সে দাদুর মৃত্যু হয়। ১৯১৫ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত আরাকাতাকায় কলা ব্যবসার প্রভূত শ্রীবৃদ্ধি ঘটে, সঙ্গে সঙ্গে স্থানটিরও উন্নতি হয়। পরবর্তী কালে লেখকের স্মৃতিতে বারবার ভেসে উঠবে জন্মস্থানের কথা, কিন্তু তার আর সেখানে ফেরার কোনো আশা থাকে না। ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসে পারিবারিক স্মৃতির ভূমিকা কম নয়, বলেছেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মারিও ভার্গাস ইয়োসা। ঝরাপাতার সামনে বসে থাকা নিশ্চল শিশুর ছবি ফিরে আসবে গার্সিয়া মার্কেস-এর ভবিষ্যতের লেখায় – ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষে’ আমারানতা উরসুলা নিজের শবাচ্ছাদন বস্ত্র বোনে–এই দৃশ্যের সঙ্গে হুবহু নিল ছিল তাঁর এক কাকিমার। আরাকাতাকায় ঠিক এমন ভাবে তিনি তাঁর শবাচ্ছাদন-বস্ত্রটি বুনতেন। চোখে দেখা দৃশ্য বা চরিত্র কি আশ্চর্যভাবে চলে আসে তার উপন্যাসে। সুন্দরী রেমেদিওস’–এর স্বর্গে উঠে যাওয়ার দৃশ্যটি সম্পর্কে তিনি বলেন– এটি খুব সাধারণ ব্যাপার, মানুষ যা ভাবে তার চেয়ে অনেক সহজ। ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসে ‘সুন্দরী রেমেদিওস’-এর যে চরিত্র আমি লিখেছি ঠিক এই রকম এক মেয়ে ছিল। আসলে সে বাড়ির এক পুরুষের সঙ্গে পালায়, লজ্জা আর সইতে পারে না তার পরিবার। একজন বলে যে বাগানে চাদর ভাঁজ করতে দেখা গেছে তাকে আর তারপর সে আকাশে উড়ে গেল…লেখার সময় পরিবারের গল্পটি আমি নিয়েছি… আসলে ঘটনাটা হল যে মেয়েটি এক পুরুষের সঙ্গে পালিয়েছিল, এ ঘটনা তো আকছার ঘটে, এর মধ্যে কোনো সাহিত্যের রস নেই’।
‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ বইয়ের লেখক হিসেবে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন তিনি। কলম্বিয়ার সন্তান গার্সিয়া মার্কেস জীবনের বেশিরভাগ সময় বসবাস করেছেন মেক্সিকো এবং ইউরোপের বিভিন্ন শহরে।
১৯৬৭ সালে উপন্যাসওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউড প্রকাশিত। ১৯৭৫-৭৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘অটাম অব দ্য প্যাট্রিয়ার্ক’।
এই বিশ্ব বিখ্যাত কলম্বীয়, স্প্যানিয় ভাষী ঔপন্যাসিক বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের সবচেয়ে আলোচিত, সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। জীবনের শেষ দুই যুগ তিনি ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচেছিলেন। এ সময় তার লেখালেখি কমে আসে। জনসংযোগ ও ভ্রমণ হয়ে পড়ে সীমিত। এমনকী ২০০২ সালে আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড ‘লিভিং টু টেল আ টেইল’ প্রকাশের পর পরিকল্পিত ২য় এবং ৩য় খণ্ড আর রচনা করা হয়ে ওঠেনি। তিনি দূরারোগ্য লিম্ফেটিক ক্যান্সারে ভুগছিলেন। ২০১২ সালের জুলাই থেকে তিনি স্মৃতি বিনষ্টিতে আক্রান্ত হন। মৃত্যুকালে তিনি একটি অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি রেখে গিয়েছেন।

সাহিত্যবিশারদদের মতে তিনি হোর্হে লুইস বোর্হেস এবং হুলিও কোর্তাসারের সাথে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দক্ষিণ আমেরিকান কথাসাহিত্যিক। একই সঙ্গে জনপ্রিয় এবং মহৎ লেখক হিসেবে চার্লস ডিকেন্স, লেভ তলস্তয় ও আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সঙ্গে তার নাম এক কাতারে উচ্চারিত হয়। ১৯৮২ সালে নোবেল পুরস্কার প্রদানের সময় সুইডিশ একাডেমি এমন মন্তব্য করেছিল যে তার প্রতিটি নতুন গ্রন্থের প্রকাশনা বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মতো। জনমানুষের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগের কারণে তিনি ছিলেন বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। ১৯৫৯ সালে বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো কিউবার ক্ষমতায় আসার পর তার আমন্ত্রণ পেয়ে কিউবায় যান। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল প্রবাদপ্রতীম।

স্কুলের মাধ্যমিক পাঠ শুরু ১৯৪০ সালে এবং ১৯৪৬ সালে সিপাকিরার (Zipaquira) কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ সমাপ্ত হলে তিনি কার্তাহেনার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন ১৯৪৭ সালে, যদিও পাঠ্য বিষয়ে তার আগ্রহ তেমন ছিল না। পেশায় চিকিৎসক এবং লেখক মানোয়েল সাপাতা ওলিভেইয়ার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। বন্ধুর মাধ্যমেই তিনি সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হন। সময়টা ছিল ১৯৪৮-এর মাঝামাঝি। কিছু দিন আগেই উদারপন্থী নেতা হোর্হে এলিয়েসের গাইতান বোগোতায় খুন হয়ে যান, ঘটনাটি ‘বোগোতাসো’ (বোগোতার কুখ্যাত ঘটনা) নামে পরিচিত, এরপর প্রতিবাদ মিছিলের ওপর নির্মম অত্যাচার নেমে আসে। সেই বছরই ‘এল্‌ উনিভের্সাল’ (বিশ্বজনীন) সংবাদপত্রটির প্রকাশনা শুরু হয় এবং তার সঙ্গে গার্সিয়া মার্কেস যুক্ত হন। পরে স্বাস্থ্যের কারণে সুক্রে নামক স্থানে বিশ্রাম নিতে যান এবং বাররানকিইয়ার এক বুদ্ধিজীবী মহলের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটে। সেখানেই একটি পুস্তক বিপণীর প্রাক্তন কর্ণধার রামোন ভিনিয়েস্-এর সঙ্গে তার আলাপ হয়; ১৯১০-১৯২০ পর্যন্ত বুদ্ধিজীবী মহলে এঁর খ্যাতি ছিল, তাকে বলা হত ‘এল কাতালান’ (কাতালুনিয়া অঞ্চলের মানুষ) এবং নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসের শেষ দিকে যে প্রাজ্ঞ কাতালান-কে পাই তা ওই ব্যক্তির আদলে গড়া এক চরিত্র। তার ‘নোটবই’ সত্যিই ছিল, বলেছেন ডি, গিলার্ড নামে এক লেখক।
বন্ধুরা সেই সময় গার্সিয়া মার্কেসকে সমকালীন লেখকদের কিছু বই পড়তে দিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে ছিলেন দোস পালসোস, ফকনার, ভার্জিনিয়া উলফ, স্টেইনবেক, হেমিংওয়ে, ক্যালওয়েল এবং হাক্সলি। ১৯৪৯ সালে গার্সিয়া মার্কেস বাররানকিইয়াতে বাস করতে শুরু করেন এবং ১৯৫০ সালের শুরু থেকে ‘এল এরান্দো’ (অগ্রদূত) সংবাদপত্রে যোগদান করেন। দৈনন্দিন যে কলাম তিনি লিখতে শুরু করেন তার। শিরোনাম (লা হিরাফা) ‘জিরাফ’। সঙ্গে সঙ্গে ‘ক্রোনিকা’ (ঘটনাক্রম) শীর্ষক একটি স্বল্পায়ু পত্রিকায় লেখাও শুরু করেন, সম্পাদনার দায়িত্বও তাকে পালন করতে হয়।
তার প্রথম ছোটগল্প ‘লা তের্সেরা রেসিগ্নাসিওন‌’ এল এসপেক্তাদোর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই সময় তার দুটি ছোট গল্প পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গার্সিয়া মার্কেস তার পেশাজীবন শুরু করেন আঞ্চলিক সংবাদপত্রে সাংবাদিকতার মাধ্যমে। তিনি বারানকিইয়া শহরের এল এরাল্‌দো পত্রিকায় রিপোর্টার এবং কার্তাহেনা শহরের এল উনিবের্সাল পত্রিকায় সম্পাদকের কাজ করেন। এই সময়েই তিনি অপ্রচলিত লেখক এবং সাংবাদিকদের দল হিসেবে পরিচিত বারানকিইয়া গ্রুপে যোগ দেন। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই তিনি তার পরবর্তী সাহিত্যজীবনের অনুপ্রেরণা লাভ করেন। পরবর্তীকালে তিনি কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোতায় আসেন এবং এল এস্পেক্তাদোর পত্রিকায় কাজ করেন। পরবর্তীকালে তিনি রোম, প্যারিস, বার্সেলোনা, ক্যানসাস এবং নিউ ইয়র্কে একজন বিদেশী সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন।
‘দর্শক’-এর সাংবাদিক হিসেবে ১৯৫৪ সালে তিনি যান রোমে। ১৯৫৭-তে তিনি কলম্বিয়ায় ফিরে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হলেন, ইউরোপের দুই জার্মানি চেকোশ্লোভাকিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ করার পর তিনি যান ভেনেজোয়েলা, সেখানে একটি গ্রন্থে তিনি সহযোগিতা করেন, গ্রন্থটির শিরোনাম ‘মুহূর্ত’, এলিট আর চিত্রময় ভেনেজোয়েলা। ১৯৫৫ সালে ‘ঝরাপাতা’ প্রকাশিত হল, কাকতালীয় ভাবে ওই সময় প্রকাশিত হল হুয়ান রুলফোর সুবিখ্যাত উপন্যাস ‘পেদ্রো পারামো’, পরের বছর প্রকাশিত হল গার্সিয়া মার্কেস-এর আর-একটা উপন্যাস ‘লা মালা ওরা ( মন্দ সময়’), এই গ্রন্থটির জন্যে তিনি পেলেন ‘এসো পুরস্কার’ (premio Esso)। গার্সিয়া মার্কেস ছোটো উপন্যাসটি প্রকাশ করে মাকান্দার নাটকীয় কিছু ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেন।
অবিশ্রান্ত বর্ষণ নিয়ে মানুষ বিরক্ত হয়ে তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হল ‘এল করোনেল নো তিয়েনে কিয়েন লে এসক্রিবা’/ ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না।’ এই উপন্যাসেও অনেক ঘটনার সঙ্গে থাকে বৃষ্টির ভূমিকা, কর্নেল নিঃসঙ্গ, তাঁর সঙ্গী বলতে স্ত্রী আর এক মোরগ, মনে পড়ে মৃত পুত্রের কথা, যুদ্ধের স্মৃতিকাতরতা; সবই মাকন্দো নামক স্থানে ঘটে। ১৯৬২ সালে বেশ কিছু গল্প নিয়ে সংকলন প্রকাশিত হয়, শিরোনাম ‘বড়মা’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া’ আরও যে আটটি গল্প ওখানে অন্তর্ভুক্ত হয় সেগুলি হল ‘উন দিয়া দে এসতোস’ / ‘হালের একটা দিন’, ‘এন এসতে পোয়েবলো নো আই লাদ্রোনেস’ / ‘এ গায়ে চোর নেই’ ‘লা প্রদিহিওসা তার্দে দে বালতাসার’ /  ‘বালতাসারের আশ্চর্য বিকেল’ / ‘লা ভিউদা দে মনতিয়েল’ / ‘মনতিয়েল এর বিধবা স্ত্রী’ ‘উন দিয়া দেসপোয়েস দেল সাবাদো’ / ‘শনিবারের পর একদিন’ ‘রোসাস আর্তিফিসিয়ালেস’ / ‘কৃত্রিম গোলাপ’। সমালোচকরা বলেছেন এবং লেখকও তা স্বীকার করেছেন যে এইসব গল্প লেখার সময় তাঁর মাথায় এসেছিল একটি বিশ্বজনীন উপন্যাস রচনার ভাবনা এবং সেটি সম্ভবত তার উচ্চাকাঙ্ক্ষী এক সৃষ্টি এবং রচিত হল ‘সিয়েন আন্যোস দে সোলেদাদ’। ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’। প্রকৃতপক্ষে যা ঘটল তা হল এইসব গল্প নতুন মাত্রা নিয়ে প্রবেশ করল উপন্যাসটিতে, কিন্তু আগের সব লেখা এই উপন্যাস রচনার ছকে আসেনি। পরিণত মনস্কতায় সমৃদ্ধ নতুন ধরনের স্বতন্ত্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসহ যে গল্পগুলি ছিল সেগুলি এসে মিলল এই উপন্যাসে–নদী, উপনদী, শাখানদী সব মিলল সাগরে।

১৯৫১ সালে গার্সিয়া মার্কেস ফিরে এলেন কার্তাহেনা শহরে, শুরু করলেন নিজস্ব এক পত্রিকা, নাম ‘কমপ্রিমিদো’ (ওষুধের বড়ি)। আবার বাস শুরু হল বাররানকিইয়াতে। সেখানেই আবার ‘জিরাফ’ নামের কলাম পুনর্জীবিত হল। তার প্রথম উপন্যাস ‘লা ও হারাসকা’ (ঝরাপাতা)-র পাণ্ডুলিপি ফেরত দিল বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা ‘লোসাদা।’ লেখক জীবনের শুরুতেই এক আঘাত। ‘এবালেদা’ (অগ্রদূত) যে গল্পটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশ করল তার শিরোনাম মান্দায় বৃষ্টি দেখে ইসাবেল-এর ‘স্বগতোক্তি’ কিন্তু প্রকাশিত হল ‘শীত’ নামে। সম্ভবত এই প্রথম ‘মাকন্দো’ নামটি শোনা গেল। পুস্তক বিক্রেতা হিসেবে পার্সিয়া মার্কেস কিছুদিন আটলান্টিক-এর উপকুলস্থিত নানা স্থানে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লাভ করেন। ১৯৫২ তে জেনারেল গুস্তাভো হোস পিনিইয়া কলম্বিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন যদিও দেশের অন্যান্য অঞ্চল অপেক্ষা কার্তাহেনা শহরে রাজনৈতিক দমন-পীড়নের আঁচ লাগে কম। ১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে বাররানকিয়ার সংবাদ পত্র ‘এল নাসিওনাল’ (জাতীয়তাবাদী)-এর সঙ্গে যুক্ত হলেন গার্সিয়া মার্কেস। তার লেখায় প্রকাশিত হতে থাকে মানুষের উদ্বেগ ও শঙ্কা, অভিনব শৈলীতে লেখা কলামে পাঠকের আগ্রহ বাড়ে; তিনি বলেন যে স্পেনের লেখক রামোন গোমেস দে লা সেরনার ‘গ্রেগেরিয়াস’ (পরমতাবলম্বী) দ্বারা অনুপ্রাণিত হন।

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস সাংবাদিক জীবনে যে প্রচুর লেখালেখি করতেন তা একদিকে যেন তার সাবলীল লেখার ক্ষমতা বৃদ্ধির সহায়ক হয়, তেমনি বিবিধ বিষয়ের সম্যক জ্ঞান পরবর্তীকালে তার গল্প-উপন্যাসের পটভূমি রচনার কাজে লাগে। যদিও তার কল্পনা সেইসব বিষয়কে অন্য মাত্রা এনে দেয়। সাংবাদিক হিসেবে লেখালেখির মধ্যেই মুদ্রার অন্য দিকটা ভেসে উঠতে থাকে, গল্প-লেখার অদম্য ইচ্ছে; ১৯৪৬ সাল থেকে ‘এল্‌ এসপেক্তাদোর’ (দর্শক) সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে থাকে তার গল্প। তার ক্ষুদ্রায়তন প্রথম উপন্যাস ‘লা ওহারাস্‌কা’ (ঝরাপাতা) প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে, যদিও সেটির সংশোধিত খসড়া প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল ১৯৫১ সালেই। ১৯০৩ থেকে ১৯২৮ (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর জন্মসাল) পর্যন্ত কিছু ঘটনা নিয়ে এই উপন্যাস। এখানেও ঘটনাস্থল মাকন্দো। এক চিকিৎসকের আত্মহত্যা নিয়ে আত্মকথনের মাধ্যমে তিন প্রজন্মের তিন চরিত্র বক্তব্য পেশ করে। এই গল্পে এক বৃদ্ধ কর্নেল-এর চরিত্র আছে, যা আমরা তার পরবর্তীকালের উপন্যাসে দেখতে পাব আর ‘ঝরাপাতা’ কলা ব্যবসায়ীদের এক কোম্পানির প্রতীক। ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসে ওই ব্যবসায়ীদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। সম্ভবত এই সময় থেকেই নিজের পরিবার এবং গল্পের বিষয়বস্তু সমূহ নিয়ে এক উপন্যাস রচনার ভাবনা আসে তার মাথায়। আসলে ‘বাড়ি’র পটভূমি নিয়ে একটি উপন্যাস লেখা হবে এমন ভাবনাই ছিল; উপন্যাসটির শিরোনাম ‘বাড়ি’ হতে পারত।
‘বাড়ি’ নিয়ে গার্সিয়া মার্কেস একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন, কিন্তু গ্রন্থাকারে সেটি প্রকাশিত হয়নি। শিরোনাম ছিল ‘বোয়েনদিয়ার বাড়ি’ (উপন্যাসের উপাদান ছিল); লেখা হয়েছিল ১৯৫০-এর মে-জুন মাসে আর কিছু অংশ ওই বছর নভেম্বরে। কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়ার বাড়ি ফিরে আসার ঘটনা দিয়ে উপন্যাসটির শুরু। পুরনো বাড়ির বিধ্বস্ত রূপ তিনি দেখেন এবং বৃষ্টি থামার পর নতুন নির্মাণ শুরু করেন। একটানা বর্ষণ ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসের এক প্রধান ঘটনা। গার্সিয়া মার্কেস কোন স্থানে তার গল্পগুলো প্রতিস্থাপন করবেন তা ঠিক করে ফেলেন কিন্তু সময় এবং কোন সুরে বাঁধবেন তা নিয়ে ধন্দে ছিলেন। ‘জিরাফ’ নামে সংবাদপত্রে যে কলাম লিখতেন তাতে সময় সম্পর্কে নতুন ভাবনা দেখা যায়। ‘ফ্যান্টাসির হাত কাটা কোট’ (১৯৫০) রচনায় সময় আর মিথ নিয়ে আলোচনা আছে, কিন্তু গার্সিয়া মার্কেস তার নতুন লেখা নিয়ে যে উচ্চাশা পোষণ করতেন তা কার্যকরী করার মত মনস্কতা তখন তার গড়ে ওঠেনি।
তাঁর প্রথম বৃহদাকার কাজ ছিল “দ্য স্টোরি অব এ শিপরেক্‌ড সেইলর” (রেলাতো দে উন্‌ নাউফ্রাগো), যা তিনি ১৯৫৫ সালে পত্রিকা ধারাবাহিক হিসেবে রচনা করেন। একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা এ বইয়ে ফুটে ওঠে কলম্বিয়ার নৌবাহিনীর একটি দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজের কাহিনী। জাহাজটি চোরাচালানির পণ্যের অতিরিক্ত ভারে ডুবে গিয়েছিল। বইটি নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়, কেননা এর কাহিনীর সাথে প্রকৃত ঘটনাটির সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বিবরণের মিল ছিল না। সরকারি বিবরণীতে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে ঝড়ের কথা বলা হয়েছিল এবং জীবিত নাবিকদের বীরের মর্যাদা দেয়া হয়েছিল। এর ফলশ্রুতিতেই মার্কেসের বিদেশী সংবাদদাতা জীবন শুরু হয় কেননা দেশে তখন তিনি জেনারেল গুস্তাবো রোহাস পিনিয়ার চক্ষুশূল হয়ে গিয়েছিলেন। এই সিরিজটি পরবর্তীকালে একটি ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় এবং অনেকে এটিকে উপন্যাস হিসেবেই গ্রহণ করেন।
মার্কেসের জীবনে সাফল্য আর খ্যাতির পেছনে সবচেয়ে বেশি যাঁর অবদান, তিনি হলেন মিশরীয় বংশজাত কলম্বিয়ান তার স্ত্রী মের্সেদেস বার্চা। কাছের লোকজন তাকে ডাকেন ‘গাবা’ নামে। মার্কেসের বয়স যখন মাত্র চোদ্দ বছর আর মের্সেদেসের বয়স আট। তখনই তাদের প্রথম দেখা হয়। প্রথম দেখা হয়েছিল উত্তর কলম্বিয়ার মাগদালেনা তীরবর্তী ছোট শহর মাগানগেতে। সেই দেখাতেই প্রেম পড়ে যান। আর সেদিনই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘এই বালিকাই একদিন আমার স্ত্রী হবে।’ ১৯৪৫ সালে তাকে নিয়ে কবিতাও লিখেছিলেন। সত্যিই সত্যি সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয় ১৯৫৮ সালে। দীর্ঘ দিনের প্রেমের পরিণত হয় বিয়ের বন্ধনে।
মার্কেসের স্ত্রীর নাম মের্সেদেস বার্চা। তার দুই ছেলে রোদ্রিগো আর গোন্সালো ও পাঁচ নাতি-নাতনি।

মারিও ভার্গাস ইয়োসা বলেন—’ঝরাপাতা’ উপন্যাসে ইসাবেল-এর চরিত্র মিলে যায় লুইসা সান্তিয়াগো নামে বাস্তব এক নারীর সঙ্গে, মাত্র চার কী পাঁচ বছর বয়সে গার্সিয়া মার্কেস এঁকে প্রথমবার দেখেন; ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসের চরিত্র মের্সেদেস্‌ এক কেমিস্ট; ‘বাররানকিয়াতে’ লেখক তাকে দেখেছিলেন, এই উপন্যাসের চরিত্র আমারানতা উরসুলা স্বপ্ন দেখে তার গর্ভে দুই ছেলের জন্ম হবে, তাদের নাম হবে রোদরিগো এবং গনসালো, এ তো গার্সিয়া মার্কেস-এর ছেলেদের নাম; ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ উপন্যাসে যুবক চক্রান্তকারীদের নাম এবং ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসে মাকন্দোর শেষ অবস্থায় আউরেলিয়োনো বোয়েনদিয়ার বন্ধুরা হল বাররানকিয়ার তিন সঙ্গীর দুজন; আলভারো (সেপেদা), আলফনসো (ফোয়েনমাইয়োর) এবং এরমান (ভার্গাস); ‘হস্তিনী’ (লা এলেফান্তা) এই উপন্যাসে ভক্ষক, তার পদবি সাগাসতুমের পদবির সঙ্গে এক, বাস্ক প্রদেশের ওই যাজক গার্সিয়া মার্কেস-এর শিক্ষক ছিলেন; উরসুলা ইগুয়ারানের দীর্ঘস্থায়ী বার্ধক্য, অন্ধত্ব এবং পাগলাটে ভাব মিলে যায় দন্যা ভ্রানকিলনার চরিত্রের সঙ্গে, যদিও উপন্যাসের চরিত্র চিত্রণে অতিশয়োক্তি আছে। কর্নেল বোয়েনদিয়ার ক্যাম্পে বাঘের ছদ্মবেশে এক অদ্ভুত যোদ্ধার উপস্থিতি এবং সংশ্লিষ্ট গল্প গার্সিয়া মার্কেস নিজেই বলতেন, এসব মার্লরোর ভিউক, ‘মামরু’র গল্প, দিদিমার মুখে তিনি শুনেছিলেন যে এই ব্যক্তি যুদ্ধে গিয়েছিলেন। ‘ঝরাপাতা’ উপন্যাসের কর্নেল শারীরিক প্রতিবন্ধী। গার্সিয়া মার্কেস্-এর দাদু দন নিকোলাস-এর এক চোখ ‘অন্ধ ছিল এবং তিনি বলতেন যে ‘হাজার দিনের যুদ্ধে’ উরিবে-র সেনাবাহিনীতে তার নাম নথিভুক্ত ছিল। ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ উপন্যাসের মুখ্য চরিত্রের মতো তিনিও নিরলান্দিয়ার শান্তি চুক্তিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসটিতে এবং বোয়েনদিয়া পরিবারটির বংশলতিকায় গার্সিয়া মার্কেস-এর পারিবারিক ইতিহাসের তথ্য বিপুলভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে। মারিও ভার্গস ইয়োসা তাই বলেন যে গার্সিয়া মার্কেস ভাবতেন যে ‘উপন্যাসটির প্রাথমিক প্রেরণা এসেছিল একটি নির্দিষ্ট ধারণা থেকে–দন নিকোলাসের স্মৃতি– তিনি হাত ধরে তাকে নিয়ে যেতেন সার্কাস দেখাতে, তার ছায়ায় নির্মিত চরিত্র আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়া, বালক বয়সে বাবার হাত ধরে বরফ দেখতে যাওয়ার কথা তার মনে পড়ে যায়। বোয়েনদিয়া পরিবারটির আদি নিবাস রিওয়াচায়, সেখানেই জন্মগ্রহণ করেন দন নিকোলাস এবং দন্যা ত্ৰাণকিলিনা। ওরা ছিল তুতো ভাইবোন, যেমন ভরসুলা ইগুয়ারান এবং হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়া (ইগুয়ারান পদবিটা সাহিত্য ও বাস্তবে একই) এবং প্রথম বোয়েলদিয়ার পিতৃপুরুষদের মতো তাদেরও শুয়োরের ল্যাজ নিয়ে জন্ম হয়েছিল। যে কারণে হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়া পৰ্বাঞ্চলের বাসভূমি পরিত্যাগ করে মান্দা নামক স্থানে স্থায়ী বাসস্থান গড়ে তুললেন তা হল প্রতিবেশী প্রুদেনসিও আগিলারকে তিনি হত্যা করার পর সেখানে তার মনে শান্তি ছিল না, বারবার মৃত মানুষটা তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। দন নিকোলাসও এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলেন এবং সেই জন্যে তিনি আরাকাতাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন; নিহত মানুষটির পদবিও ছিল এক। দন নিকোলাসের অভিধান-পাগলামো ছিল, শব্দার্থ নিয়ে তিনি মেতে থাকতে ভালোবাসতেন–বোয়েনদিয়া পরিবারের একটি বংশধারা গোপন অভিধানের শব্দগুলোর অর্থ উদ্ধার করার চেষ্টায় জীবন অতিবাহিত করে (মেলকিয়াদেস্‌-এর পাণ্ডুলিপি) কিন্তু মনে রাখা ভালো যে পরিবারের ছাপ পড়েছে অন্যান্য চরিত্রের মধ্যেও এসব তথ্য পেলেও গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এক চিরনতুন উপন্যাস নির্মাণ করেন, যা লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে একেবারে মৌলিক; বাস্তব তথ্যকে সাহিত্যের অনবদ্য সৃজনে কেমন করে রূপান্তরিত করতে হয় সেই জাদু লখক জানতেন।
জাদুবাস্তবতার যাদুকর ছিলেন গার্সিয়া মার্কেস। গার্সিয়া মার্কেসের অনেক কাজ কল্পকাহিনী এবং বাস্তবধর্মী সমবায় রচিত। “ক্রোনিকা দে উনা মুয়ের্তে আনুন্সিয়াদা” (Crónica de una muerte anunciada, ১৯৮১) পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিশোধমূলক খুনের ঘটনা অবলম্বনে রচিত এবং “এল আমোর এন লোস তিয়েম্পোস দেল কোলেরা” (El amor en los tiempos del cólera, ১৯৮৫) গল্পে তার অভিভাবকের আদালত জীবনের বর্ণনা রয়েছে। এই দুটি কাজ ছাড়াও তার অনেক কাজই “গাব্রিয়েল গার্সিয়ার বিশ্বে” সংঘটিত হয় যেখানে চরিত্র, স্থান এবং ঘটনাসমূহ বারবার বিভিন্ন বইয়ে পুনর্ঘটিত হতে দেখা যায়।
১৯৮১ সালে সামরিক বাহিনীর হাতে নিগ্রহের আশঙ্কায় দেশ ত্যাগ করেন তিনি।

তার সবচাইতে ব্যবসা সফল উপন্যাস “নিঃসঙ্গতার এক শতাব্দী” (Cien años de soledad সিয়েন আনিওস দে সোলেদাদ) সারা বিশ্বে ৪০টি ভাষায় অনূদিত হয়ে ১৯৬৭ থেকে ২০১৪ সাল এই ৪৫ বৎসরে প্রায় ৫ কোটি কপি বিক্রি হয়। এতে বুয়েনদিয়া পরিবারের বেশ কিছু প্রজন্মের কাহিনী চিত্রিত হয় যাদের বাস দক্ষিণ আমেরিকার কল্পিত গ্রাম মাকোন্দোতে। এই বইটির জন্য তিনি ১৯৭২ সালে রোমুলো গ্যালাওস পুরস্কার জিতে নেন। তিনি ১৯৮২ সালে নোবেল পুরস্কার জয়লাভ করেন যার ভিত্তি হিসেবে তার ছোট গল্প এবং উপন্যাসকে বিবেচনা করা হয়।
তাঁর গল্প উপন্যাসের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল – আইজ অব আ ব্লু ডগ (১৯৪৭ সালে), লিফ স্টর্ম (১৯৫৫ সালে), নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্নেল (১৯৫৮সালে), ইন ইভিল আওয়ার (১৯৬২ সালে), বিগ মামা’স ফিউনারেল (১৯৬২ সালে), ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচুড (১৯৬৭ সালে), ইনোসেন্ট এরেন্দিরা এ্যান্ড আদার স্টোরিজ (১৯৭২ সালে), দ্য অটাম অব দ্য প্যাট্রিয়ার্ক (১৯৭৫ সালে), ক্রনিকল অব আ ডেথ ফরটোল্ড (১৯৮১নসালে), লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা (১৯৮৫ সালে), দ্য জেনারেল ইন হিজ ল্যাবেরিন্থ (১৯৮৯ সালে), স্ট্রেঞ্জ পিলগ্রিমস (১৯৯২ সালে), অব লাভ এ্যান্ড আদার ডেমনস (১৯৯৪ সালে) এবং মেমোরিজ অব মাই মেলানকলি হোরস (২০০৫ সালে)।
১৯৯৯ সালে তার লিম্ফাটিক ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং চিকিৎসা শুরু হয়। এই ঘটনা তার মধ্যে স্মৃতিকথা লেখার অনুপ্রাণনা সৃষ্টি করে। ২০০০ সালে পেরুর দৈনিক লা রিপাবলিকা তার মৃত্যুর ভুল সংবাদ ছাপে।

২০০২ সালে তার তিন খণ্ডের আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড হিসাবে স্মৃতিগ্রন্থ ‘বিবির পারা কোন্ত্রালা’ প্রকাশিত হয় যা স্পেনীয় ভাষাভাষীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে এবং দ্রুত বেস্টসেলারে পরিণত হয়। ২০০৩ সালের নভেম্বরে এডিথ গ্রসম্যানের ইংরেজি অনুবাদ “লিভিং টু টেল দ্য টেল” প্রকাশিত হয় যা ছিল আরেকটি বেস্টসেলার। ২০০৪ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর বোগোতা দৈনিক এল তিয়েমপো মার্কেসের একটি নতুন উপন্যাসের কথা ঘোষণা করে, যার নাম ‘মেমোইরা দি মিস পুতাস ত্রিসতেস’। প্রেমের এই উপন্যাসটি অক্টোবরে প্রকাশিত হয় এবং এর প্রথম সংস্করণের দশ লক্ষ কপি নিঃশেষিত হয়ে যায়। উল্লেখযোগ্য যে ১৯৯৯ সালে তাঁর ক্যান্সার ধরা পড়ে, এবং চিকিৎসা শুরু হয়। ক্যান্সারের প্রকোপে মার্কেসের এতটাই শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন যে তাঁর পক্ষে আর লেখালিখি করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাঁর আত্মজীবনীর বাকী দুই অংশ রচনা করে প্রকাশ করার অবকাশ তিনি পান নি।

মৃত্যুকালে তিনি একটি অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি রেখে গিয়েছেন। এটি একটি নভেলা। ২০১৪ সালের আগস্টে এই উপন্যাসটির প্রকাশনার ব্যাপারে তার পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সম্ভবতঃ ২০০০ সালের শুরুতে তিনি এই রচনাটি লিখে থাকবেন।

তাঁর প্রিয় রং ছিল হলুদ। সাহিত্যিক প্রিয় চরিত্র ছিল কাউন্ট ড্রাকুলা আর গার্গানতুয়াগার্সিয়া। ঐতিহাসিক চরিত্রের মধ্যে প্রিয় ছিল জুলিয়ো সিজার। সংগীতস্রষ্টার প্রিয় বেলা বাতকের। আর সবচেয়ে অপছন্দ করতেন ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে। প্রিয় খাবার ছিল ফরাসি ‘কানা অ লরাঞ্জ’, এটি কমলার সসে রান্না করা হাঁসের রোস্ট। কলম্বিয়ার ক্যারিবীয় উপকূলের বাইয়েনাতো সংগীত ছিল তার জীবন ও লেখালেখিতে অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ।

১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘লা ওহারাস্কা’ (পাতার ঝড়)। কিন্তু রচনাশৈলী ধারাবহিকভাবে বদলে যেতে থাকে যতদিন ১৯৬৫-৬৭ কালপর্বে তিনি রচনা করেন সিয়েন আনিওস দে সোলেদাদ ( “নিঃসঙ্গতার এক শতাব্দী”)। এ উপনস্যাসে তিনি তার স্বকীয় লেখনীশৈলীটি খুঁজে পান। তাকে বলা হয় ‘জাদু বাস্তবতার’ রাজাধিরাজ। উপন্যাসের শৈলী হিসেবে জাদু বাস্তবতা তার আবিষ্কার নয় বটে কিন্তু এই রচনাশৈলীকে তিনি যেভাবে স্বকীয় করে নিয়েছিলেন তা আর কেউ করেন নি। তার উপন্যাসের কাহিনী প্রোথিত থাকে বাস্তবে কিন্তু এই ভিত্তির উপর কল্পনার ফানুস উড়য়ে দেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, যেদিন ইউনুস নবী (আ:) ত্রিশ বছর নিরুদ্দেশ থাকার পর বাসায় ফিরে তার স্ত্রীকে জানান দেন যে তিমি মাছ তাকে গিলে ফেলেছিল এবং এ কারণেই তিনি নিরুদ্দেশ ছিলেন, সেদিনই কথাসাহিত্যের গোড়াপত্তন হয়েছে। মার্কেস মনে করেন না যে পাঠক গল্প-উপন্যাসে বাস্তব পরিবেশের অনুপুঙ্খ বর্ণনা খুব বেশি আশা করে। এটা ঠিক যে মার্কেসের কল্পনাপ্রবণতা পাঠককে আনন্দ দেয়, কিন্তু একই সঙ্গে কাহিনীর রাজনৈতিক দিগদর্শন চিন্তায় আলোড়ন তোলে।

মার্কেসের গল্প সংলাপবহুল নয়, বর্ণনামূলক, যেখানে লেখক সবজান্তার ভূমিকা পালন করেন। তার গদ্য ঘনবুনোটে লেখা, দীর্ঘ ও জটিল বাক্যে তিনি অভিব্যক্ত করেন তার বক্তব্য। পাঠক পংক্তিতে-পংক্তিতে অনুভব করেন যে একজন গদ্যের জাদুকর অনায়াসে দৃঢ় গদ্যের গাঁথুনি রচনা করে চলেছেন। মানুষের মনস্তত্ত্ব তার উপজীব্য নয়, তিনি মানুষের আচরণ বর্ণনা করে চরিত্র ফুটিয়ে তোলেন। এই ক্ষেত্রে কখনো তিনি অতিশোয়াক্তির আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি বর্ণনাকালে বাস্তবতার সঙ্গে অকাতরে মিশের দেন কাল্পনিক ঘটনার।
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস মানুষের জীবনের আপাত কমিক দশা অন্বেষণ করতে গিয়ে লিখে ফেলেছেন ট্র্যাজেডি। তার ভাষা অনবদ্য, বড়ো বড়ো বাক্যের পাশে আচম্বিতে এসে পড়ে ছোটো বাক্য। মাঝে মাঝে ব্যাকরণের নিয়ম অতিক্রম করে যান লেখক। কিন্তু তাঁর বাক্যের মধ্যে চটুল ব্যঙ্গ খুবই কম।

মার্কেসের সঙ্গে কিউবার কমিউনিস্ট নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব এই ঔপন্যাসিকের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার অন্যতম স্বাক্ষর। এই বন্ধুত্ব কেবলই বহুল বিদিতই নয়, তার মার্কেসের জন্য বয়ে এনেছে দীর্ঘমেয়াদী সমালোচনা। মার্কেসের মৃত্যুতে দীর্ঘদিন যাবৎ রোগাক্রান্ত ফিদের কাস্ত্রো গভীলভাবে শোকাহত হন।

মার্কেসকে দক্ষিণ আমেরিকান কিছু বৈপ্লবিক দলের প্রতি সহানুভূতিশীল মনে করা হয়। তিনি কলম্বিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও একজন কঠোর সমালোচক। কলম্বীয় সরকার-দলীয় সমর্থকেরা তার বিরুদ্ধে গেরিলা গ্রুপ, বিশেষ করে এফএআরসি ও ইএলএন-কে সাহায্য করার অভিযোগ করলেও এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তিনি টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্র পরিচালক রোদ্রিগো গার্সিয়ার বাবা।

তিনি ২০১৪ সালের ১৭ই এপ্রিল মেক্সিকো শহরে ৮৭ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। তার মৃত্যুতে বিশ্বসাহিত্যে “মার্কেস পর্বের” যবনিকাপাত হয়। তার মৃত্যু ছিল সংঘর্ষপ্রপীড়িত কলম্বিয়া নামক দেশটির সবচেয়ে গৌরবের মানুষটির অবসান। তার মৃত্যুতে কলম্বিয়াতে নেমে আসে গভীর নি:স্তব্ধতা। “কলম্বিয়া তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারালো” – এই ছিল সাধারণ মানুষের অনুভূতি। সারা পৃথিবীর গল্পপ্রেমী মানুষ এই প্রিয় লেখকের চিরবিদায়ে শোকাতুর হয়ে পড়ে।

মৃত্যুর পর শেষকৃত্যের জন্য একই দিন অপরাহ্নে তার মরদেহ মেক্সিকো শহরে সান হেরোনিমো এভিনিউতে অবস্থিত একটি ফিউনেরাল হোম-এ নিয়ে যাওয়া হয়। বিনা বিলম্বে ১৯শে এপ্রিল একটি পারিবারিকক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তার দাহ অনুষ্ঠিত হয়।২১শে এপ্রিল সোমবার মেক্সিকো শহরের প্যালেস অব ফাইন আর্টস-এ একটি স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয় যাতে মেক্সিকো এবং কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্টদ্বয় উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া জন্মভূমি কলম্বিয়ায় একটি প্রতীকী শেষকৃত্যানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। হাজার হাজার পাঠক ও গুণগ্রাহী এই সকল অনুষ্ঠানে ভক্তিআকুল চিত্তে অংশ গ্রহণ করে।

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 1 of 6 ): 1 23 ... 6পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress