গান্ধর্বী (Gandharbi) : 15
মিতশ্রীর বসবার ঘর। ঘরটি খুব বড় নয়। আসলে একটা বেশ বড় হলঘরকে ত্রিপুরী বাঁশের কারুকার্য করা জাফরি দিয়ে দুটো অসমান ভাগ করা হয়েছে। বড় অংশটিতে মিতশ্রীর নিজস্ব ভাষায় ‘সঙ্গীত-নাট্য-অ্যাকাডেমি’ আর দ্বিতীয় অংশটাকে সে বলে ‘ধান্দাবাজদের ওয়েটিংরুম।’ এই অপেক্ষাকৃত ছোট অংশটা অদ্ভুত সুন্দরভাবে সাজানো। বাঁশের জাফরির ভেতর দিয়ে চিত্রবিচিত্র আলোর আলিম্পন এসে ঘরটাকে অলৌকিক করে যায় যখন ওপাশে আলো জ্বলে, অথচ এপাশে জ্বলে না। আর এই অপরূপ পার্টিশনটার সঙ্গেই সামঞ্জস্য রেখে এ অংশের যাবতীয় আসবাব। বেতের এ ধরনের কারুকার্য-করা আসবাব এখনও কলকাতায় পাওয়া যায় না। এ সব এসেছে বম্বে থেকে। বসবার গদি পেছনের বর্ণময় কুশন সবই অত্যন্ত বিশিষ্ট রুচিমাফিক বাছা হয়েছে। মোটা গাছের গুঁড়ির তলার চার ফুট মতো অংশ বার্নিশ করে নিয়ে তার ওপর বসানো আছে এক অসাধারণ নৃত্যশীল নটরাজ। এও কাঠের। শুধু কাঠের নয়, প্রাকৃতিক। একবার বম্বে রোড দিয়ে দীর্ঘ এক সফরের সময় সে গাছের ডালের বিন্যাসে এই নটরাজের আভাস আবিষ্কার করে। তক্ষুনি সেই অংশটিকে কাটিয়ে, এদিক-ওদিক একটু অদলবদল করে নিয়ে ভালো করে পালিশ করে হয়ে গেল তার নটরাজ। তিনি বসলেন তাঁর যোগ্য আসনে, কাঠের গুঁড়ির ওপর। দরজা দিয়ে ঢুকে প্রথম আসনটিতে, অথাৎ দরজার দিকে পেছন করে বসলে সামনে যে দেয়ালটি চোখে পড়ে, তাতে খুব হালকা বিস্কিটরঙের ক্যানভাসে শুদ্ধু বাদামী রেখার এক একটি বলিষ্ঠ আঁচড়ে আঁকা ঘোড়া ঘোড়া ঘোড়া। এদের চোখ নেই অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আলাদা করে ভালো বোঝা যায় না, আছে শুধু সেই তীব্ৰসুন্দর গতিবেগ যা একমাত্র ঘোড়াদেরই থাকে। ঘোড়া মিতশ্রীর প্রিয় পশু। সে বলে ‘আমি যদি দেবী হতাম তাহলে বাহন হিসেবে বেছে নিতুম ঘোড়াকে।’
মিতশ্রী বসেছিল দরজার মুখোমুখি। আসল সোনালি মুগার একটি মেখলা পরে। তার সামনে দুই ভদ্রলোক। একজন অত্যন্ত মোটা। ঘাড় পর্যন্ত নেই। চিবুক দু তিন থাক। রং এত লালচে ফর্সা যে সেই গ্রাম্য বাংলা ছড়ার অংশ মনে পড়ে ‘রক্ত ফেটে পড়ে।’ অন্যজন স্বাভাবিক। বড় গম্ভীর, কিন্তু ক্ষিপ্র চোখ। মোটামুটি দীর্ঘকায়। বেশ পেশীবহুল, অতিরিক্ত মেদ বর্জিত চেহারা। দ্বিতীয় জন বললেন—‘মিতশ্রী দেবী, আপনি একটু কনসিডার করুন। বুঝতেই তো পারছেন এটা একটা এক্সপেরিমেন্ট।’
মিতশ্রী বাঁ পায়ের ওপরে ডান পা তুলে বসেছিল, হেলান দিয়ে। তার দীর্ঘ পা বরাবর মেখলার একটি ভাঁজ। চিবুকের তলায় তিনটি লম্বা লম্বা আঙুল। সে পা বদলে, সামান্য ঝুঁকে বলল—‘কী বললেন? এক্সপেরিমেন্ট? জানেন কোন আসরে মিতশ্রী ঠাকুর আসছে শুনলেই সেখানে টিকিট ব্ল্যাক হয়! রিভলভার পকেটে বডিগার্ড ভাড়া করতে হয় আমাকে? শুধু মত্ত জনতার কাছ থেকে আমাকে নিরাপদ দূরত্বে রাখবার জন্যে? জানেন আমার প্লে-ব্যাক করা ছবির গানের ক্যাসেট ছবি রিলিজ করার আগেই বিক্রি হয়ে যায়!’
—‘সবই জানি। কিন্তু আমরা তো আপনাকে এই মিউজিক্যালটার হিরোইনের রোলে নামাতে চাইছি। হিন্দি ছবির দর্শক যা দেখতে অভ্যস্ত তার থেকে অন্য রকম কিছু করছি। সেই হিসেবে এটা এক্সপেরিমেন্ট বই কি!’
মিতশ্রী একটু হাসল। তার বাঁ কপালে সামান্য একটু চেরা দাগ। ডান গালের চিবুকের কাছে একটা গোল বিন্দুর মতো আছে। তা সত্ত্বেও লোকে তার নামকরণ করেছে অমিতশ্রী। এরা বলছে কী?
ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি বললেন—‘অ্যাকচুয়ালি, আপনি আর্টিস্ট, গায়িকা, অভিনেত্রী তো নন। আপনার গান, আপনার অ্যাপিয়ারেন্স এসবের অ্যাক্সেপটিবিলিটির কথা আমরা একেবারেই ভাবছি না।’
মিতশ্রী বলল—‘কিন্তু আমি তো অ্যাট অল অভিনয় করতে চাই বলে আপনাদের পায়ে ধরিনি। আপনারা আমাকে প্লে-ব্যাক করতে বলছেন। ও.কে.। তাতে আমি রাজি। অভিনয় আমি কোনদিন করিনি। কিরকম করব, গ্যারান্টি দিতেও পারছি না। তা ছাড়া আমাকে বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে পারফর্ম করতে হয়। কতটা সময়ই বা আমি আপনাদের শুটিং-এ দিতে পারবো!’
এবার মোটা ভদ্রলোকটি বলে উঠলেন, ‘বিলিভ মি মিস ঠক্কর উই হ্যাভ সীন মেনি অফ ইয়োর ফোটোগ্রাফস। বাট আফটার মিটিং ইউ দ্যাট ইজ, সীইং ইয়োর ফুল পার্সন্যালিটি, উই আর কনভিনস্ড দ্যাট ইউ আর দা হিরোইন উই আর লুকিং ফর। হমাদের ওরিজিন্যাল প্ল্যানটা হপনাকে দেখে চেঞ্জ করে গেলো।
অন্যজন বললেন—‘অল দ্য সেম। ইট রিমেনস অ্যান এক্সপেরিমেন্ট।’
মিতশ্রী বলল—‘দেখুন, মিঃ সিন্হা আমার শেষ কথা আমি বলেই দিয়েছি। আমার ফিলমে নামার কোনও বাসনা নেই। আয়্যাম নট অ্যাট অল আফটার এ ফিল্ম কেরিয়ার। আমার টার্মস-এ যদি রাজি থাকেন হয়ত করব। পোপোজ্যালটা ইনটারেস্টিং। আমি ফিল্ম ওয়ার্ল্ডেও কিছু কিছু ঘোরাঘুরি করি, দরদাম সম্পর্কে আমার ভালো ধারণা আছে। আচ্ছা এবার আপনারা আসুন।’
সিন্হা কিছু বলবার আগেই অপরজন অর্থাৎ কেজরিওয়াল বলে উঠলেন—‘অলরাইট, অলরাইট মিস ঠক্কর, নেক্সট ডে উই আর কামিং ব্যাক উইথ দা কন্ট্র্যাক্ট ফর্ম। কাইন্ডলি ডেটগুলো আমাদের তাড়াতাড়ি দেবেন। কুইক শেষ করতে চাই।’
মিতশ্রী বলল—‘ঠক্কর নয়, ঠাকুর। শুনুন শীতকালে নভেম্বর টু মার্চ কোনও ডেট দিতে পারবো না। ওইটা হচ্ছে মাইকেল-সীজন। সামার, মনসুন-এর মধ্যে যা কিছু শেষ করতে হবে।’
—‘ফর লোকেশন শুটিং উইন্টার-এ কুছু কুছু ডেট লাগতে পারে, প্লিজ ডোন্ট সে নো।’
লম্বা দুগ্লাস সফ্ট ড্রিঙ্ক খেয়েছেন ভদ্রলোকদ্বয়। হয়ত আশা করেছিলেন হার্ড কিছু মিলবে এত নাম করা গায়িকার বাড়ি। মিতশ্রী সে ক্ষেত্রেও তাঁদের নিরাশ করেছে। শেষ কথাগুলো বলে সে তার পূর্ণ দৈর্ঘ্য মেলে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।
—‘আচ্ছা, নমস্কার।’ ভদ্রলোক দুজন, একজন নাম-করা প্রোডিউসার, এবং অন্য জন উঠতি ডিরেক্টর, এঁদের সে দরজা অবধি এগিয়ে দেবার চেষ্টাও করল না। পার্টিশনের অপর দিকে তার ‘সঙ্গীত-নাটক-অ্যাকাডেমি’র দিকে চলে গেল।
দরজা পেরিয়ে বাইরে ড্রাইভ-ওয়ে। তাঁদের বিশাল বম্বে-ফিল্ম-মার্কা গাড়িটার দিকে যেতে যেতে কেজরিওয়াল তাঁর গলকম্বলের ভেতর থেকে যথাসম্ভব খাদে বললেন—‘হোয়াট এ পার্সন্যালিটি? শী ওয়াকস লাইক এ লেপার্ড।’
সিনহা চিন্তিত স্বরে বললেন—‘আই সি, ইউ হ্যাভ ফলন ফর হার। বাট শী ইজ গোয়িং টু বী টাফ, রিয়্যাল টাফ।’
‘সে কথা যদি বোলেন—‘অল আর্টিস্টস আর ফুল অফ হুইমস্ অ্যান্ড ভ্যানিটি। তারা তো হমাদের ক্রিয়েটিভ কুছু দিচ্ছে, সো উই মাস্ট গিভ দেম অ্যালাউয়্যান্সেস।’
গাড়িটা কখন নিঃশব্দে ছেড়ে গেল মিতশ্রী লক্ষও করল না। ভদ্রলোকদের এক কথায় বিদায় করে সে তার গানের গালচের ওপর বসল। জমাট রক্তের মতো লাল, তাতে হরিণ রঙের নকশা, মাঝে মাঝে গাঢ় সবুজের ছোঁয়া আছে। মেখলা গুটিয়ে নিয়ে তানপুরা সামনে নিয়ে সে বসেছে বটে। কিন্তু এখন তার গাইবার মেজাজ নেই। যদিও এটাই তার সান্ধ্য রেওয়াজের সময়। আসলে মিতুল খুব উত্তেজিত হয়ে আছে। যদিও সে কেজরিওয়াল এবং গৌরাঙ্গ সিনহাকে মুখে দেখিয়েছে ওদের প্রস্তাবে তার এমন কিছু উৎসাহ নেই। কিন্তু আসলে এই প্রস্তাবটাই এখন তাকে গোধূলি লগ্নের চঞ্চলগামিনী মারোয়ার মতো পুরোপুরি অধিকার করে আছে। মিতুল এখন ঠুমরি, দাদরা, গজল হিন্দি-উর্দু হোক বাংলা হোক গায়, সে গানের টুকরা, পকড়, পুকার ইত্যাদির সঙ্গে নানারকম মনোহরণ মুদ্রা করে, শরীর মোচড়ায়, মুখের হাসিতে চোখের চাহনিতে গানের নিবেদন ফুটিয়ে তোলবার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা আছে তার। পায়ে অনেক সময়ে এক হারা নুপূর থাকে, পায়ের কাজও সে তবলার বোলের সঙ্গে করে থাকে। আসলে গানের চেয়েও বেশি প্রতিভা ছিল তার নাচে। অনিন্দ্য শরীর এবং মুখশ্রী তো ছিলই। কিন্তু বাবার সেই এক বুলি—‘উত্তম গানা, মধ্যম বাজনা, ঔর নিকৃষ্ট নাচনা।’
ছোট্টবেলা থেকে সে শুনে আসছে তার মা তার পাঁচ বছর বয়সের সময়ে হঠাৎ মারা গেছেন। কিন্তু সে অতি প্রখর বুদ্ধিমতী মেয়ে। মার অসুখ হল না, কিছু না। আগের দিন রাতে মা তাকে কত আদর করল। কী সুন্দর কত গয়না পরে, কালো ঢাকাই শাড়ি পরে সেজেছিল মা। বাবা সেদিন কোন সারা রাতের ফাংশানে গিয়েছিল। মিতুল বলল—‘মা তুমি এতো সেজেছো? কোথাও যাবে? মা বলেছিল—‘আজকে একটা বিশেষ দিন। সাজতে হয়।’
—‘কি দিন মা? জন্মদিন? তোমার জন্মদিন?’
—‘মৃত্যুদিনও তো হতে পারে?’
—‘যাঃ!’
মা তাকে আদর করতে করতে বলল—‘মিতুল তুই কাকে বেশি ভালোবাসিস রে?’
মিতুল দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলেছিল—‘বাবাইকে।’
—‘কেন রে?’
—‘বাবাই যে আমাকে কতো ভালোবাসে!’ এর চেয়ে বেশি যুক্তি তার মনে আসেনি।
—‘তাহলে ধর আমি যদি মরে যাই। বাবার কাছে থাকতে পারবি তো?’ তখনই মিতুল মাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠেছিল—‘মা, না, না তুমি মরে যাবে না।’
—‘এই তো বললি বাবাকে বেশি ভালোবাসিস!’ֹ
পাঁচ বছরের মেয়ে কী করে বোঝায়, বাবাকে বেশি ভালোবাসা মানে মাকে কম ভালোবাসা না। মাতৃহীন জীবনের জন্য প্রস্তুতি থাকা না। মায়ের বুকের মধ্যে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়েছিল মিতুল। পরদিন উঠেছিল অনেক বেলায়। এখন বড় হয়ে বোঝে মা তাকে দুধের সঙ্গে কিছু একটা ঘুমের ওষুধ কি কিছু খাইয়েছিল। সকালে উঠে দেখল পিসিমা তার বিছানার পাশে বসে রয়েছেন। বিষণ্ণ মুখ। এই পিসিমাও তার বাবার নিজের বোন নয়; গুরুভগিনী গোছের। বাবা দালানে পায়চারি করছে। মুখ বিষণ্ণ, শোকাহত, গম্ভীর। মিতুল প্রথমে শুনল তার মা কোথাও বেড়াতে গেছে, তারপর শুনল তার মা হঠাৎ মারা গেছে এবং তাকে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দুটো গল্পতেই সে মিথ্যের গন্ধ পায়। সে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে থাকে। বাবা, বাবাই তখন তাকে বুকে তুলে নেয়। বাবা গল্প বলতো—মা কত সুখের দেশে গেছে। তাদের জন্য সেখানে অপেক্ষা করছে। সেই সব গল্প এমন সুন্দর করে, বর্ণনা করে শোনাত, যে মিতুল আস্তে আস্তে মায়ের সেই মৃত্যুদিনের সাজ ভুলে গেল। তারপর একদিন যখন সে সুখে, চাপল্যে, বাবার আদরে, জীবনটাকে একটা চমৎকার চড়ুইভাতির মতো উপভোগ করছে, জীবনটা যখন তার কাছে একটা ‘সব পেয়েছির দেশ’, তখন সোহম চক্রবর্তী যে নাকি তাকে ভালবাসত, সে উন্মাদের মতো চোখ লাল করে এসে তাকে নানারকম কুৎসিত সন্দেহের কথা বলেছিল। সেগুলোর অন্যতম ছিল তার মায়ের এমদাদ খানের সঙ্গে পালিয়ে যাবার ইঙ্গিত। এক ঝলকে তার মনে পড়ে যায় সেই রাত্তির, সেই কালো ঢাকাই শাড়ি, গা-ভর্তি গয়না। মায়ের সেই অদ্ভুত সংলাপ। এবং সর্বোপরি সেই ওষুধ-মেশানো দুধ।
এই মায়ের জন্য তার বিশেষ কোনও অনুভূতি নেই। কিন্তু কৌতূহল আছে। সে চুপিচুপি এদিক ওদিক থেকে যা খবর সংগ্রহ করেছে তার প্রথম অংশটা খুব আশাজনক, তার মায়ের পক্ষে, ইমদাদ গাইত, বাজাত। তার সঙ্গে নাকি তার মা ভদ্রমহিলা দুর্দান্ত নাচত। ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকায় তাদের জুটি প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়। তারপরকার খবর আর কেউ বলতে পারে না। ইমদাদ খান তো তার পঞ্চমতম পত্নীকে নিয়ে এখন বম্বেতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। তার মা কোথায় গেল! বয়সও তো কম হল না। বাবার চেয়ে হয়তো সামান্যই ছোট হবে। হয়তো মারাই গেছে। তার ধারণা মা নটী ছিল বলেই বাবা তাকে নাচের দিকে যেতে প্রাণপণে বাধা দিয়েছে।
যাইহোক তাতে তার কোনও ক্ষতি হয়নি। সে এখন নিজেকে নিয়ে, নিজের বর্তমান নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত। জীবন মৃত্যু পাপ পুণ্য কোনটা সম্পর্কেই তার চিন্তা করবার বিশেষ সময় নেই। সে খুব ভালো করে সার কথাটি বুঝেছে, সে একজন পারফর্মার। মানুষ হিসেবে আলাদা করে তার মূল্য কারো কাছে নেই। যতদিন সে সুন্দর, সে মোহন, যতদিন সে মানুষকে তাতাতে পারবে, ততদিনই তার দাম। তার চুম্বকী শক্তিটুকু দিয়েই তার বিচার হবে আমরণ। এই দেহসৌষ্ঠব যখন ঝরে যাবে, কণ্ঠলাবণ্য অন্তর্হিত হবে, এই ব্যাখ্যাতীত আকর্ষিকা শক্তি ফুরিয়ে যাবে, তখন আর তাকে কেউ পুঁছবে না। ইতিমধ্যে সে এই ‘শেষের সে ভয়ংকর দিন’-কে অবচেতনের একদম তলায় ডুবিয়ে রেখে জীবনকে দু’ হাতে লুঠ করে যাচ্ছে। এই জন্যই কেজরিওয়াল আর গৌরাঙ্গ সিনহার ফিলম্টাতে তার আকর্ষণ জেগেছে। সে কেমন, তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ে, তার নিজের সাঙ্গীতিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে কেমন সেটা পূর্ণভাবে ধরে রাখবার সুযোগ রয়েছে ছবিটাতে।
বাবা ছাড়া আর একটা মানুষকেও সে ভালোবাসে না। শ্রদ্ধার যোগ্য বলে মনে করে না। আজ পর্যন্ত সে যতজন ওস্তাদের কাছে গেছে তাঁরা প্রত্যেকে ঠারে ঠোরে কেউ সোজাসুজি তার কাছে দেহকামনা জানিয়েছেন। কোনও জলসায় মাইক্রোফোন হাতে সে যখন প্রচণ্ড দাপটে গায়, বেশির ভাগ সময়েই প্রাচ্য পাশ্চাত্য পাঞ্চ করা সুর, তখন সামনের বিশাল শ্ৰোতৃমণ্ডলীকে তার মনে হয় প্রকাণ্ড একটা বিষাক্ত সাপ। এখন সুরে আচ্ছন্ন তাই তালে তালে দুলছে। সুর সরে গেলেই ছোবল মারবে। এই মুণ্ডহীন জনতাকে সে মনে মনে ঘৃণা করে। তার দেহ-সৌন্দর্যের ওপরেও আছে তার এক ঘৃণামিশ্রিত ভালোবাসা। সোহম তার কাছে চিরকাল অস্পৃশ্য কারণ সে তার এই অতুলনীয় মুখশ্রীকে আঘাত করে ক্ষুণ্ণ করেছে। মিতশ্রী জানে না তার এই ছোট ছোট দুটো কাটা দাগ তার মুখে এমন এক ব্যক্তিত্ব দিয়েছে, যা তার দুর্মর সম্মোহনের অঙ্গ। সে নিজেকে নানাভাবে যত্ন করে সাজায়, শুধু নিজেকে নয়, নিজের পরিবেশকে, যা তার চালচিত্রের কাজ করে। তার বসবার ঘরে আছে বহুরকম আলো। নানান পয়েন্ট থেকে সে সুইচগুলো জ্বালে, নেভায়। কখনও বাঁ দিক থেকে আলো পড়ে তার বাঁ গাল নাকের খানিকটা অংশ, উজ্জ্বল একটি চোখ আলোকিত থাকে, ডানদিক থাকে অন্ধকারে। রহস্যময় সে অন্ধকার। শৈল্পিক আবেদনে পূর্ণ। কখনও একটা বিশেষ জায়গা থেকে তার মাথার একটি কৌণিক বিন্দুতে আলো পড়ে কাঁধে গলায় হাতের ওপর মুখের নানান জায়গায় ছিটকে যায়। এভাবেই তার কাছে আবেদক অতিথিরা তাকে দেখে, একটি অপূর্ব ছবি, কিংবা শিল্পসম্মত ফোটোগ্রাফ, কিংবা ভাস্কর্যের মতো।
বড় বড় কনফারেন্সে মিতুল তার অঙ্গভঙ্গির জন্য খানিকটা অমর্যাদা পায়। যদিও লঘু উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে তার অধিকার অবিসংবাদিত। তেমন খানদানী মার্গসঙ্গীতের আসরে তার ডাক পড়ে না। তার বাবা এ জন্য একটু ক্ষুণ্ণ। কিন্তু মিতুলের ভারী বয়েই গেল। বড় বড় জলসা মিতশ্রী ঠাকুর ছাড়া হয়ই না। নানান ক্লাবের শীতকালীন জলসাতেও সে যায়। তার মতো একাদিক্রমে দাদরা, গজল, চৈতী, পপ-সংগীত, নজরুল গাইবে কে? ইদানীং মিতুলের প্লে ব্যাক করা কয়েকটি ছবি হিট করার পর বম্বে থেকে তার ডাক আসছে। ওইসব খিচুড়ি গান গাইতে তার খুব একটা আপত্তিও নেই। কিন্তু বম্বের নাম-ডাক-অলা প্লে-ব্যাক সিঙ্গারদের থেকে এক পয়সাও সে কম নেবে না। এই শর্তে তাকে কেউ গ্রহণ করতে রাজি হচ্ছে না। মিতুলেরও গরজ নেই। সে গাইতে ভালোবাসে। নাচও তার স্বভাবজ। নিজেকে নানাভাবে দেখতে সে ভালোবাসে। কিন্তু কোনক্রমেই নিজের অমর্যাদা করে নয়। নিজের যাবতীয় শখ মিটিয়ে সে তার বাড়ি বাগান গাড়ি করেছে। জীবনের একমাত্র প্রিয়জন বাবাকে বৃদ্ধ বয়সে সুখে রাখতে পেরেছে। ছোটবেলা থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস না পেয়ে তার উচ্চাকাঙক্ষা সীমিত। অন্তত উচ্চাকাঙ্ক্ষার পেছনে তাকে দৌড়তে হয়নি। যা পেয়েছে এতটাও সে আশা করেনি। এর থেকে বেশি নিয়ে সে কী করবে? তাকে সেক্রেটারি রাখতে হবে, ম্যানেজার রাখতে হবে। এত ব্যস্ত জীবন যাপন করতে হবে যে নিজের ইচ্ছেমতো কিছু করতে পারবে না। যা চায় তা-ই তো সে পায়, আর তার কিসের গরজ? খালি নিজের একটা প্রবৃত্তিকে মিতুল কিছুতেই দমন করতে পারে না। কোনও কোনও পুরুষ মানুষ কোনও কোনও মুহূর্তে হঠাৎ হঠাৎ তার মধ্যে এক লেলিহান আগুনের শিখা জ্বালিয়ে দেয়। তখন তাকে তার চাই-ই। যখন পায় না, কিছুতেই পায় না, তখন নিজের শোবার ঘরে বিশাল বিশাল আয়নার সামনে মিতুল নিজেকে কুটি কুটি করে ছিঁড়ে তছনছ করে ফেলে।
আজকের প্রস্তাবটা নতুন ধরনের বলেই তার কৌতূহল। একটা সঙ্গীত-ভিত্তিক ছবি যাতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয়ও করবে সে আবার গাইবেও সে। টাকার অঙ্কটাকে অনেক উঁচুতে তুলে রেখেছে মিতুল। সে সস্তায় লভ্য নয়। বেশির ভাগ মানুষই যত পায়, তত চায়। মিতুল সেরকম না। খুবই আশ্চর্য কিন্তু সে একেবারেই সে রকম নয়। তার মনে আছে সে একটা ভ্ৰষ্টা মায়ের ফেলে যাওয়া পালক পিতার কন্যা। তার মনে আছে তার গলা আসলে ছিল কাকের মতো কর্কশ, এমনকি একসময়ে বাজখাঁই গলার পুরুষের মতো মোটা। সেই গলা তার বাবা সাধিয়ে সাধিয়ে, তাঁর নিজস্ব নানারকম জড়িবুটি করে এখন এক জোয়ারিদার, সমৃদ্ধ, সাধারণের থেকে একেবারে অন্যরকম কণ্ঠস্বর বার করেছেন। সে এ-ও জানে তার এতো মানসম্মান, অর্থ, সম্পদ কাজে-কাজেই তার বাবারই জন্য। সে সম্ভবত তার মায়ের মতো দেখতে। যিনি নর্তকী ছিলেন বলেই বাবা কিছুতেই তার স্বাভাবিক নাচের ক্ষমতাকে প্রশ্রয় দিলেন না। দেননি ভালোই করেছেন। তার শরীরে মায়ের চিহ্ন কোনগুলো সে যদি জানতে পারত, তা হলে সে সেগুলো মুছে ফেলত, মুছে ফেলবার জন্য প্লাস্টিক সার্জনের কাছে যেত। কিন্তু তার বাড়িতে তার মায়ের একটি ছবিও নেই। অনেক খুঁজেছে সে। ট্র্যাঙ্ক-বাক্স হাঁটকেছে। পুরনো বিদেশি পত্রিকা হাঁটকেছে কিন্তু পায়নি, কোনও বর্ণনাও শোনেনি। বাবার সঙ্গে মিল নেই দেখে লোকে স্বভাবতই বলে সে তার মায়ের মতো দেখতে। সে সেটাই সত্যি বলে ধরে নিয়েছে। মার কথাগুলো সব মনে আছে, তার শেষদিনের সাজ-সজ্জা মনে আছে, শুধু ঘন চুলের মাঝখানে মুখের জায়গাটা শূন্য, একেবারে শূন্য, অথচ পাঁচ বছরে স্মৃতি তো বেশ ভালোই গজিয়ে যায়। মায়ের অনেক চুল ছিল সেটা মিতুলের মনে আছে, তাই সে নিজের চুল ছোট করে কেটে ফেলেছে। হেয়ার স্টাইল পাল্টে পাল্টে সে তার মুখের আদল বারে বারে পাল্টাতে থাকে। যত রকমের আধুনিক সাজ-সজ্জা, গয়নাগাঁটি পরে নিজেকে সে সমস্ত ঐতিহ্যের থেকে আলাদা করে ফেলে তার ব্যক্তিগত ইতিহাসের প্রতি তীব্র ঘৃণায়।
তার এখন যা টাকাকড়ি হয়েছে, বাড়ি-গাড়ি-বৈভব হয়েছে তা দিয়ে তার সব শখ মিটে যায়। আর কী চাই। পুরুষ মানুষ হলে মদ-মেয়েমানুষে উড়িয়ে দিত। যত পয়সা তত ফুর্তি। কিন্তু মিতুল মদ স্পর্শ করে না। এমনিতেই তার অনেকরকম শারীরিক, মানসিক মত্ততা আছে। কৃত্রিম মাদকতার দরকার হয় না। আর তার পছন্দসই পুরুষকে পাবার জন্য তাকে পয়সা খরচ করতে হয় না। যে তার ভেতরে সেই অপ্রমেয় বিদ্যুৎ জাগিয়ে দিতে পারে একমাত্র তাকেই সে গ্রহণ করে। অন্য সব আসঙ্গ-পিপাসুদের তার সুন্দর মুখের একটা দুর্বোধ্য হাসি নিয়ে ফিরে যেতে হয়। তার মা অনেক পুরুষ বিয়ে করেছে। মিতুল বিয়েই করবে না। তাই বলে প্রকৃতি তার শরীরে যে অপরিমিত আনন্দের ভাণ্ডার ভরে দিয়েছে, তাকে সে অস্বীকার করবে? এ হতে পারে না। টাকা পয়সা নামযশ—এসবের লোভ দেখিয়ে তাকে কেউ কাবু করতে পারবে না। কিন্তু তার বারবার মনে হচ্ছে আজকের প্রস্তাবটা গ্রহণ না করলে সে একটা বড় কিছু হারাবে। সে নিজে তার পূর্ণ ব্যক্তিত্ব নিয়ে, তার চলন-বলন, নাচ, গান সমস্ত নিয়ে সেলুলয়েডে চিরদিন বেঁচে থাকবে। এটা এক নম্বর। দ্বিতীয় হচ্ছে যে প্রোডিউসার এবং ডিরেক্টরটি তার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলেন তার মধ্যে ডিরেক্টর অর্থাৎ গৌরাঙ্গ সিনহার সঙ্গে তার আগেই এক জলসায় দেখা হয়েছে, যেখানে তিনি প্রস্তাবটা প্রথম তাকে দ্যান। এই গৌরাঙ্গ সিন্হা হঠাৎ তার মধ্যে সেই অগ্নি সঞ্চার করেছেন যা সে কিছুতেই নিয়ন্ত্রিত করতে পারে না। কিন্তু মিতুল এসব কথা ভদ্রলোককে জানতে দেয়নি। একটি কটাক্ষ, একটি উত্তেজক হাসিও না। সে শুধু তার বসবার ঘরের আলোগুলোকে পছন্দমতো জ্বালিয়েছে। একটি মেখলা পরেছে, লম্বা একটি সোনার মফ-চেন ঝুলিয়ে দিয়েছে গলায়। কানে বীরবৌলি। লম্বা লম্বা আঙুলের নখগুলো লালচে গেরুয়া রঙে রঞ্জিত করেছে। হাতের সোনার চুড়ি এতো সরু যে মাঝে মাঝে তা শুধু ঝলকায়। আঙুলে কোও মহার্ঘ রত্ন নয়। একটা মস্ত বড় গোল্ড স্টোনের আংটি।
জি সিনহা এবং কেজরিওয়াল তাঁদের বম্বে-ব্র্যান্ড গাড়িতে যেতে যেতে মিতশ্রীকে নিয়েই আলোচনা করছিলেন। কেজরিওয়াল সিটে হেলান দিয়ে বললেন, ‘উই মাস্ট হ্যাভ হার অ্যাট এনি কস্ট। ইট উইল ব্রেক রেকর্ডস। উই ওন্ট হ্যাভ টু টীচ হার এনিথিং। শী ইজ লাইক এ প্রিজ্ম, ফ্যাসিনেটিং ফ্রম এভরি অ্যাঙ্গল।’ সিনহা বললেন—‘ইয়া। শী নো’জ এ টু জেড অফ শোম্যানশিপ। ইউ আর রাইট। ওয়েল ইটস ইয়োর মানি, দা ডিসশন টু ইজ ইয়োর্স।’
মিতুল অন্যমনস্কভাবে তানপুরার তারগুলিতে লঘুভাবে আঙুল চালাচ্ছিল। সুরের পরিমণ্ডল তৈরি হয়ে যাচ্ছিল ঘরময় কিন্তু তার সঙ্গে তার কণ্ঠ সংযোগ হচ্ছিল না। হঠাৎ সে শুনতে পেল রামেশ্বর ডাকছেন—‘মিতুল! মিতুল!’ সে তানপুরাটাকে কোলের কাছ থেকে সরিয়ে উঠে দাঁড়াল, সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে দেখল বাবা সিঁড়ি দিয়ে কেমন উদ্বিগ্ন হয়ে নেমে আসছেন।
—‘ওরা কে এসেছিল? মিতুল? ওরা কে? দেখলুম একটা হুড খোলা বিরাট গাড়ি!’ রামেশ্বরের গলায় ভীষণ উৎকণ্ঠা। মিতুল তার আঙুলের আংটিটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল—‘ওরা বম্বের লোক। আমাকে ফিলমে নামতে বলছে।’
—‘তুই রাজি হলি নাকি? নামবি ফিলমে?’
‘মিতুল বলল—‘এর আগে যে ফিলমের অফার আমার আসেনি, তা তো নয়! আমি কি নিয়েছি সেগুলো বাবা?’
—‘না, তা নিসনি। এ লোকগুলো আরও পয়সাঅলা।’
—‘তোমার ধারণা পয়সা বেশি দিলেই আমি সব করতে পারি! বাবাই, তোমার এ ধারণা কেন হল, আমায় বলবে?’
মিতুল এখন সিঁড়ি অবধি চলে এসেছে। সিঁড়ির রেলিং-এর পেতলের মুণ্ডিটার ওপর তার হাত। তার বাবা সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে আছেন। ধপধপে ধুতি আর হাফ পাঞ্জাবি পরা।
রামেশ্বর ইতস্তত করে বললেন—‘না, তা নয়।’
—‘তোমার ভয়টা কিসের? আমি তোমায় ছেড়ে চলে যাবো? কারো সঙ্গে? যাবার হলে অনেক আগেই যেতাম। কথাটা কি জানো বাবাই, তোমাকে ছাড়া আর সব পুরুষ মানুষকে আমি ঘেন্না করি। —ঘেন্না! ঘেন্না করি।’
রামেশ্বর কিরকম কাঁপছিলেন ভেতরের একটা আবেগে, কান্না চাপবার চেষ্টায়। এই বয়সে চট করেই আবেগ মানুষকে অধিকার করে নেয়।
মিতুল বলল—‘বাবাই তবে একটা কথা। এরা আমাকে সাধারণ ফিলমের জন্য ডাকছে না। এরা একজন গায়িকার জীবন নিয়েই গল্পটা তৈরি করছে বাবাই। এই গায়িকার রোলটাই ওরা আমাকে দিতে চাইছে। ন্যাচার্যালি প্লে-ব্যাকও করব। যদি ওরা ঠিকঠাক মূল্য দেয় তো অফারটা আমি নেবো, টাকার জন্যে নয়। বাবাই সামহাউ আই ফীল স্টিম্যুলেটেড, ক্রিয়েটিভলি।’
রামেশ্বর বললেন—‘মিতুল, লোকগুলো ভালো নয়। আমি বুঝতে পারি।’
—‘ডোন্ট ওয়ারি বাবাই। ভালো নয়, খুব খারাপ এরকম অনেক লোকের সঙ্গেই আমি মোকাবিলা করেছি। করতে হয়। ইনক্লুডিং ইয়োর সোহম চক্রবর্তী।’
রামেশ্বর হঠাৎ একেবারে চুপ হয়ে গেলেন। মিতুল প্রায় তাঁর হাত ধরে তাঁকে ওপরে নিয়ে গেল, যদিও তিনি ততটা বৃদ্ধ বা অক্ষম হননি। কিন্তু তিনি এখন ভেতরে ভেতরে কী ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েছেন মিতুল স্পষ্ট বুঝতে পারছে। এই একটা জায়গায় সে তার বাবাকে ইচ্ছে করে আঘাত করে। সম্পূর্ণ ইচ্ছে করে। তার প্রতি ওই অমানুষিক ব্যবহারের পরও বাবা সোহমকে পছন্দ তো করেনই, তাকে তার সঙ্গীত জীবনে চূড়ান্ত সাহায্য করেছেন, সম্ভবত তাকে ভীষণ ভালোও বাসেন। এটা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। সোহমের এখন প্রচণ্ড নাম-ডাক। খেয়াল থেকে সে এখন খানিকটা সরে গেছে। কিন্তু ঠুংরিতে তার মতো ওস্তাদ কমই আছে ভারতে। আর গজলে সে প্রায় একচ্ছত্র নায়ক এখন। বড় বড় খানদানী কনফারেন্সে সে বিশেষ করে ঠুমরীর জন্যেই ডাক পায়। কোনও কোনও গজলের মাইফেল বসে শুদ্ধু তাকে নিয়েই। আবার কিছু কিছু কনফারেন্স তাকে একেবারেই ডাকে না। যেহেতু সে আগে খেয়াল গেয়ে পরে ঠুম্রী-দাদরা ইত্যাদির দিকে যায় না। তবে সোহমের বেশির ভাগ প্রোগ্রামই এখনও পর্যন্ত কলকাতার বাইরে। দূরদর্শনের মাধ্যমে কিছু কিছু শোনা এবং দেখা গেছে। মুখোমুখি হওয়ার আজ পর্যন্ত সুযোগ হয়নি। সুযোগ না হলেই ভালো। সোহম এখন খুব সম্ভব লন্ডনে। খুব নাকি জমিয়েছে।
বাবাকে নিয়ে দোতলায় ওঠবার পর মিতুল হঠাৎ দৃঢ়সঙ্কল্প হল। বলল —’সোহম আমাকে সেদিন কী বলেছিল জানো?’
রামেশ্বর হাত নেড়ে উড়িয়ে দেবার একটা ভঙ্গি করলেন। ভাঙা ভাঙা স্বরে বললেন—‘সে তখন উন্মাদ মিতুল, মাথার ঠিক ছিল না।’
—‘তাই বলে সে তোমাকে লম্পট বলবে? মাকে যা খুশি বলুক। যদিও বলবার কোনও অধিকার তার ছিল না। কিন্তু তুমি তার গুরু। তুমি দেবচরিত্র মানুষ! বাবা আমি আমার জীবনে অনেক গুরু, অনেক ওস্তাদ দেখেছি। আই নো দেম ইনসাইড আউট। তোমাকে অফ অল পার্সন্স্ সে এ কথা কি করে বলে? আর আমার ঘরে যখন এসেছিল তখন একটু উত্তেজিত ছিল ঠিকই, কিন্তু তখনও ও যাকে বলে উন্মাদ তা নয়। ছুরিটা যখন তুলে নিল, তখন না হয় অনেক ওকালতি করে শয়তানের বদলে ওকে উন্মাদ বলে চালাতে চেষ্টা করতে পারো।’
রামেশ্বর প্রথম দিকের ‘লম্পট’ শব্দটা শোনবার পর আর কিছু শুনতে পাননি। ভোঁ ভোঁ করছে সব ইন্দ্রিয়গুলো। লম্পট! লম্পট! লম্পট! সোহম তাহলে তাঁর পূর্বাপর সব ইতিহাসই জানে। কখনও তাঁর কাছে প্রকাশ করেনি তো! মিতুল জানে না। মিতুল যদি জানতে পারে! মিতুল ছাড়া কেউ নেই তাঁর। তিনি তার কাছে মিথ্যাচার করেননি কোনদিন। শুধু সত্য গোপন করে গেছেন। তাঁর তো আর কেউ নেই! মিতুলের শ্রদ্ধা তিনি কি করে হারাবেন? তিনি সামান্য একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—‘মিতুল, মা, সোহম হয়ত ঠিকই বলেছিল। তবে মানুষ তো বদলায়!’
মিতুল দেখল বাবার চোখে জল চিকচিক করছে। সে বলল—‘অ্যায়াম সরি বাবা। কিন্তু তোমার জানা দরকার কেন আমি সোহমের ওপর বীতশ্রদ্ধ। তা ছাড়া আমরা সবাই এখন গ্রোন-আপ, বাবাই। তিরিশ-পার হওয়া মেয়ের কাছ থেকে বাবা এসব শুনতেই পারে! লুকোচুরি করে কী লাভ!’
লুকোচুরি! সত্যিই তো তিনি আজীবন মিতুলের সঙ্গে লুকোচুরি করে এসেছেন। নিজেকে বুঝিয়েছেন মিতুলেরই ভালোর জন্যে। কিন্তু তাঁর নিজের ভালোর জন্যেও কি নয়! মিতুলের যে সাফল্য, ঐশ্বর্য তিনি ভোগ করছেন এ তো ভোগ করবার কথা ছিল কাশীর সেই অখ্যাত গলির অখ্যাত পণ্ডিত কেদারনাথজীর। তিনি তো অনধিকারী। সবচেয়ে দুঃখের কথা তার মায়ের ভ্রষ্টতার কথা সে জেনে গেছে। কিন্তু তিনি নিজেও যে একই পাপে পাপী তা জানে না।
হঠাৎ তিনি নিজেকে বলতে শুনলেন—‘মিতুল, আমি সত্যিই অপরাধী। তোর আসল বাবার কাছ থেকে তোর মায়ের সঙ্গে আমি তোকেও কেড়ে এনেছিলাম। শিষ্যের কাছ থেকে এ অপমান আমার পাওনা বাবা’, বলতে বলতে তিনি বারান্দার ইজিচেয়ারটায় বসে পড়লেন। তাঁর চোখে জল নেই, কিন্তু বুক হু হু করে জ্বলছে। তাঁর মুখ ঝুলে পড়েছে!
মিতুল বাবাকে জড়িয়ে ধরে আস্তে বলল—‘জানি। কেঁদো না।’
রামেশ্বর মিতুলের মুখের দিকে চাইতে পারছেন না, শুধু অবাক হয়ে বললেন —‘জানিস?’
—‘আমি তোমার যত্ন করে লেখা ডায়েরিটা অনেক অনেকবার পড়েছি বাবাই।’ মিতুল বাবার কোলে মাথা রাখল। তারপর আস্তে আস্তে বলল—‘তুমিই আমার সত্যি বাবা। কে সেই পণ্ডিত যার ভীমরতি হয়েছিল বুড়ো বয়সে যুবতী বাইজি বিয়ে করবার আমি জানতে চাই না। তুমি জীবনে আর কখনও বলবে না তুমি আমার বাবা নও।’
রামেশ্বর ফিকে হেসে বললেন—‘বাবার ডায়েরি পড়তে তোর একটুও বাধল না! মিতুল! তুই তো বড্ড দুষ্টু!’
—‘এবং পাকা। ডায়েরিটা আমি বোধহয় আঠার-উনিশ বছর বয়সে প্রথম পড়ি।’
—‘বলিস কি? এতদিন ধরে…মিতুল তখন…তখনও কি তোর কোনও…’
—‘ইট ওয়জ এ জোল্ট। ডেফিনিটলি। বাবা যেদিন আমি জানলাম অন্য একটা লোক আমার বাবা সেদিন জানলার পাশে চুপ করে বসেছিলুম। দেখলুম তুমি দুটো ডাব নিয়ে বাড়ি ঢুকছো, তারপর কিছুক্ষণ পর তুমি ডাবে বরফের কুচি আর গোলাপ জল-টল দিয়ে কী একটা শরবত করতে, সেইটে এক গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকলে, বললে ‘মিতুল, এটা খেয়ে নে তো! বড্ড গরম পড়েছে।’ বাবাই আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল তুমি কিরকম রাতের পর রাত আমায় পিঠে ফেলে পায়চারি করতে করতে গান করতে, একদিন দু ঘণ্টা পরপর গল্প বলবার পরও যখন আমার আরও গল্পের আবদার থামল না, তুমি করুণ চোখে চেয়ে বললে—আর তো গল্প মনে পড়ছে না মিতুল, তখন আমি রেগে-মেগে তোমার প্রিয় এসরাজটা আছড়ে ভেঙে ফেলেছিলুম। তুমি ভাঙা এসরাজের টুকরোগুলো, ছেঁড়া তারগুলো সযত্নে কুড়িয়ে তুলছো এখনও আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাই। সেই ভাঙা এসরাজ জোড়া যায় না। কিন্তু তুমি জুড়ে ফেলেছো সারা জীবন ধরে। তোমার কণ্ঠ ক্লান্ত করা পয়সা দিয়ে আমার কনভেন্টের ফীজ হত, পোশাক হত, খেলনা হতো, যার অনেক কিছু হয়তো না হলেও চলে যেত। বাবাই, নাউ আয়্যাম আ উওম্যান, আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড ইউ, আই ক্যান অলসো আন্ডারস্ট্যান্ড মাই মাদার। বেনারস ছেড়ে চলে আসবার জন্য মাকে আমি দোষ দিই না, দোষ দিই, তোমাকে ফেলে আমাকে ফেলে চলে যাবার জন্যে। বাবা তুমিও তো মানুষ, একটা অন্যায় হয়ত করে ফেলেছিলে কিন্তু সারা জীবন তার জন্য পৃথিবীর কাছে, আমার কাছে মাথা হেঁট করে আছো। বেনামে তুমি সেই কেদারনাথজীকে কত টাকা পাঠিয়েছো, তার হিসেবও আমি তোমার ডায়েরিতে দেখেছি। বাবাই আই ডোন্ট সি আ সিনার ইন ইউ।’
রামেশ্বর কথা বলতে পারছেন না। সুরসরস্বতী তাঁকে শাস্তি দিয়েছেন, আকণ্ঠ শাস্তি। কিন্তু তিনি ক্ষমাও করতে জানেন। তাঁর শাস্তি কোথা দিয়ে আসবে যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি অকল্পনীয় তাঁর ক্ষমার পথ!
মিতুল অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,—‘বাবা, ডোন্ট মাইন্ড, তোমাকে আমি আর একটা কথা বলব। ঠিক বলব না। প্রশ্ন করব। উত্তর দেবে? সঠিক?’ রামেশ্বর ভয়ে ভয়ে মিতুলের দিকে তাকালেন শুধু। মিতুল বলল—‘তোমার মনে হয় না শিল্পীরা অন্য মানুষের থেকে একটু অন্যরকম!’
—‘সে তাদের সৃজনী ক্ষমতায় তো বটেই’ রামেশ্বর বললেন, ‘নইলে তারাও ঠিক আর পাঁচটা মানুষের মতো। মা, বাবা, বধূ, ভগ্নী তফাত হবে কেন?’
—‘না বাবা, যারা সব সময়ে শিল্পের মধ্যে ডুবে থাকে তোমার মতো, আমার মতো, তাদের চাহিদা, তাদের আবেগ একটু অন্যরকম। গানের চর্চা এইভাবে করতে করতে একটা শিল্পী একটা সূক্ষ্ম যন্ত্রের মতো হয়ে যায়। যদি কোনও কিছুর স্পর্শে, কোনও মানুষের সঙ্গে তার শরীর মনের সেই সূক্ষ্ম তারে ঝংকার ওঠে, সে গেয়ে উঠবে না? ঝংকৃত হবে না! বাবাই, অন্য নর্ম্যাল মানুষের ক্ষেত্রেও এটা হয়, তবে কম। কিন্তু শিল্পীর ক্ষেত্রে এটা অবশ্যম্ভাবী। তোমার ক্ষেত্রেও তা হয়েছিল। আমার ক্ষেত্রেও তা হবে। এটা তোমাকে এবার মেনে নিতে হবে বাবাই।’
রামেশ্বরের ভিতরে আবার কাঁপুনি শুরু হল। ভয়ের কাঁপুনি। মিতুলের ক্ষমার মধ্যে কি তাহলে শর্ত আছে?
মিতুল বলল—‘কি হল বাবাই, কথা বলছ না যে!’
রামেশ্বর বললেন—‘তুই যে “নর্ম্যাল” কথাটা ব্যবহার করলি মিতুল! ওটার ওপর তোর যদি শ্রদ্ধা থাকে তাহলে শিল্পীদের আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে নর্ম্যাল হবার।’
মিতুল এখন উঠে আধো-অন্ধকার-বারান্দাটায় আস্তে আস্তে পায়চারি করছে। সে বলল—‘ফ্রয়েড কিন্তু বলেন শিল্পী মাত্রেই খানিকটা অ্যবনর্ম্যাল। নর্ম্যাল হতে হলে তাকে তার শিল্প হারাতে হয়। অ্যাবনর্ম্যাল মানে পাগল-ছাগল নয়। অ্যাবনর্ম্যাল, মানে গতানুগতিক, একেবারে সেন্ট-পার্সেন্ট—যুক্তি বুদ্ধি খতিয়ে-দেখা মানুষ সে নয়। সেন্ট পার্সেন্ট সেন মানে একটা টেরিফিক বোর, বাবা, আমার মনে হয়, সে রকম মানুষ আমি এ যাবৎ সত্যি দেখিনি। এনিওয়ে, তোমার কী বলবার আছে বলো।’
রামেশ্বর বললেন—‘মিতুল, তুই যদি উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যাস, তো সমস্ত জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি যা পেয়েছি তা তো মিথ্যে হয়ে যাবে! তোকে যেমন সঙ্গীতের উত্তরাধিকার দিয়েছি, তেমনি জীবনের অভিজ্ঞতার সারবস্তুটুকুও যদি না দিয়ে যেতে পারি, তাহলে আমি যেখান থেকে আরম্ভ করেছিলুম, সেইখান থেকে আরম্ভ করে, আমি যেখানে শেষ করছি, সেই ভয়ংকরে তুই শেষ করবি মা। তোকে যদি আমার কাঁধে চড়িয়ে দিতে না পারি, আমার তো তাহলে কিছুই করা হল না। জীবনে করার মতো কাজ তো আর কিছুই করতে পারিনি।’
মিতুল বলল—‘বাবাই তুমি উচ্ছঙ্খলতা বলতে যা মীন করছে, সেভাবে উচ্ছৃঙ্খল হওয়ার কথা আমি ভাবছি না। আসলে বাবাই তোমরা অন্য যুগের, আমরা তোমাদের মতো ইলোপ-টিলোপ করে চিরদিন পাপের ভয়ে জবুথবু হয়ে বসে থাকি না। যা ক্ষণিকের, যা পথের তাকে পথেই ফেলে আসতে পারি। আমরা জানি কাঞ্চনজঙ্ঘা খুব মহিমময়, তার সেই মহিমা এক দুর্লভ ক্ষণে উন্মোচিত হয়, আবার পরক্ষণেই মেঘে ঢেকে যায়। এই কাঞ্চনজঙ্ঘাকে আমরা তার দুর্লভতাসমেত উপভোগ করি। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে, সকালের সূর্যের জাদুমাখা কাঞ্চনজঙ্ঘাকে যে বাড়িতে উঠিয়ে আনা যায় না, সব সময়ে তাকে দেখার আশাও যে দুরাশা এটা আমরা জানি। হোয়াট আই মীন ইজ বাবাই আমি যদি বাইশ শ্রুতিতে কিম্বা ধরো বাইশ ইনটু একশ ইকোয়ালস বাইশ শ’ শ্রুতিতে বাজতে পারি, তুমি তোমার ওল্ড ভ্যালুজ দিয়ে আমার নৈতিক বিচার করবে না। কখনও মনে করবে না তোমার মেয়ে তোমার কৃতকর্মের জন্য তোমার ওপর শোধ তুলছে। তোমাদের জেনারেশনের পক্ষে সেটা ভাবাই স্বাভাবিক। আই ওয়ান্ট টু বি আ ফ্রী বার্ড, অ্যাবসল্যুটলি ফ্রী, অ্যাজ আ বার্ড, আ মেল বার্ড, অ্যান্ড আই ক্যান নেভার ডেজার্ট য়ু। এ সব কথা তোমাকে কখনও বলতাম না। কিন্তু আজকাল তোমার মুখে খুব উদ্বেগ দেখি, দুশ্চিন্তায় কালো হয়ে থাকো। একেক সময়ে অনর্থক আমার ওপর রাগ করো। তাই বললাম। আমার মাথার ভেতরে, বুকের ভেতরে কোথাও একটা স্থির বিন্দু আছে বাবাই, আ স্টিল পয়েন্ট। গোলকধাঁধার মতো নানান পথ ঘুরে ঘুরে আমি সেই বিন্দুটাতে ঠিক পৌঁছে যাই।’
রামেশ্বর সাগ্রহে বললেন—‘সেই বিন্দুটা। সেটাই আসল। মিতুল সেটা খুঁজে পেয়েছিস তাহলে। তুই তুলনা দিতে বাজনার সঙ্গে বাজার কথা বললি। বাজা অনেক লেভেলের হতে পারে মা। সে এক অদ্ভুত বাজা। ইন্দ্রিয়কে ভর করে ইন্দ্রিয়ের বাইরে চলে যাওয়া, আকাশের সঙ্গে, বিশ্বলোকের সঙ্গে মিশে যাওয়া, সেইরকম বাজা…
মিতুল হেসে বলল—‘বাজি তো বাজব। বললাম তো বাবাই আই অ্যাম আ ফ্রী বার্ড। আমি জানি না শেষ পর্যন্ত কিসে পৌঁছবো, কোথায় পৌঁছবো, বাট আই কীপ মাইসেল্ফ ওপ্ন। লেট মি লিভ মাই লাইফ, প্লিজ।’
বারান্দার গোল আলোর তলায় মেখলা পরা মিতুল দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখানে ওখানে চিকচিক করেছি সোনা। কানের বীরবৌলি দুলছে দুলছে। মিতুল তার অনেক দিনের বলতে চাওয়া কথাগুলো বাবাকে বলে ফেলতে পেরেছে, সে এখন তাই মগ্ন, মুক্ত, উর্বশী, কিন্তু অন্য উর্বশী। পুরুষ-বক্ষে রক্তধারা নাচাতে সে ব্যগ্র নয়। সে একদম মুক্ত, কারো নয়, অপ্সরা, জলকন্যা। সে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।
রামেশ্বর বারান্দার ঠাণ্ডা অন্ধকারে বসে রইলেন। আজ প্রথম তিনি অনুভব করলেন মিতুল তার মায়ের মেয়ে নয়, পণ্ডিত কেদারনাথেরও মেয়ে নয়, তাঁর নিজের প্রিয়শিষ্যা ললিতে কলাবিধৌ—তা-ও নয়। সে বোধহয় সত্যি-সত্যিই তাঁদের তিনজনের কাঁধকে পর পর সিঁড়ির মতো ব্যবহার করে উঠে গেছে। দাঁড়িয়ে আছে অনেক উঁচুতে, স্বর্ণ ঈগল যেমন দাঁড়িয়ে থাকে, অনেক উঁচুতে, একা, আপন ইচ্ছায়। যে কোনও সময়ে সে তার সোনালি পাখা বিস্তার করে উড়ে যাবে, যখন উড়বে মনে হবে না সে এই পৃথিবীর, কিন্তু আবার একদিন এসে বসবে এই কাঁধের ওপর, সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়। আবার উড়ে যাবে। যাক। যা মিতুল, যারে আমার আগুনের পাখি, তোর পা থেকে খুলে নিলুম ঘর-ঘরানা আর খানদানের ভারী ভারী শেকল। ওড়। উড়তে থাক।