গয়া ১৯২৪
শেষবার আমরা যখন বাড়ি বদলালাম, অর্থাৎ আগের বাড়ি ছেড়ে এখনকার বাড়িতে এলাম, সে প্রায় আট বছর আগের কথা।
লোকে যখন একটা বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়ি যায়, অনেক জিনিস ফেলে আসে; কিছু ভুলে ফেলে আসে, আবার কিছু ইচ্ছে করেও ফেলে আসে। অনেক সময় বড় বাড়ি থেকে ছোট বাড়িতে উঠে যাওয়ার সময় অনেক কিছুই ছেড়ে যেতে হয়।
কিন্তু এ যাত্ৰা আমরা এসেছিলাম আগের থেকে বেশ একটু বড় বাড়িতে, ফলে আগের বাড়ির প্রায় সবকিছুই ঝেটিয়ে নিয়ে এসেছিলাম।
কিন্তু সেটাই সব নয়। এ বাড়িতে এসে আমরা কতকগুলো জিনিস উপরি পেয়ে গেলাম।
এটা একটা সরকারি বাসাবাড়ি। আমার চাকরির সুবাদে সরকার থেকে আমাকে থাকতে দেওয়া হয়েছে, আমার আগে যিনি ছিলেন, তিনি তখন বদলি হয়ে দিল্লি চলে গেছেন। ফলে অনেক ছোটখাটো জিনিসই তিনি নিয়ে যেতে পারেননি।
আরও দু-চার মাস ব্যবহার হতে পারত এমন দুটো ঝাটা ও একটা বড় পাপোশ, অল্প ভাঙা কিন্তু বেশ কাজ চলে যায় এমন একজোড়া শিল-নোড়া, মরচেধরা পাখিহীন শূন্য একটা লোহার খাঁচা, একটা কুকুরের চেন, দুটো পুরনো বকলস–এই সব জিনিস তো ছিলই, আর ছিল কিছু শূন্য বোতল, পুরনো বই ও ম্যাগাজিন।
কিন্তু এ সমস্ত ছাড়াও বাড়িতে আমরা আরেকটা জিনিস পেয়েছিলাম। সেটা একটা ফটো, বাইরের ঘরের দেয়ালে টাঙানো কাঁচের ফ্রেমে বাঁধানো একটা পুরনো ফটোগ্রাফ।
ফটোগ্রাফটি অনেক পুরনো, উনিশশো চব্বিশ সালের। গয়া জেলা আদালতের বার লাইব্রেরির কর্মকর্তা ও সদস্যদের গ্রুপ ফটো। কালো কোট ও চাপকান পরা একদল নানা বয়েসের উকিল, তাদের অনেকেরই বড় বড় গোঁফ, দু-চারজনের লম্বা দাড়িও আছে। ছবির নীচে ধারাবাহিকভাবে সকলের নাম লেখা। সম্ভবত বার লাইব্রেরির বারান্দার সামনের সিঁড়িতে ছবিটা তোলা হয়েছিল। সিঁড়ির বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন উচ্চতায় উকিলবাবুরা গম্ভীরমুখে দণ্ডায়মান রয়েছেন। ছবির ওপরে ইংরেজিতে সন এবং লাইব্রেরির নাম লেখা রয়েছে, যেমন থাকে এধরনের সব ছবিতে।
বুঝতে পারলাম এই বাড়িতে আমার আগের বাসিন্দা যিনি ছিলেন, তিনি ভুল করে এই ফটোটি ফেলে রেখে চলে গিয়েছেন। শেষ মুহূর্তে দেয়াল থেকে ছবিটি খুলে নিয়ে যেতে ভুলে গেছেন।
এই ফ্ল্যাটের সেই পূর্ববর্তী বাসিন্দা, মিস্টার তরফদার, চাকরিসূত্রে আমার যথেষ্ট পরিচিত। এই গ্রুপ ফটোগ্রাফের মধ্যে রয়েছেন হয়তো তার কোনও নিকট আত্মীয়, বাবা বা ঠাকুরদা। তাঁদের মূল্যবান পারিবারিক স্মৃতিচিহ্ন এই ফটোটা।
আমার পুরনো অফিস থেকে মিস্টার তরফদার দিল্লি বদলি হয়েছেন। সেখানে গিয়ে তার দিল্লি অফিসের ঠিকানা সংগ্রহ করে তাঁকে ওই ভুলে ফেলে যাওয়া ফটোটি সম্বন্ধে জানালাম ও লিখে দিলাম : ফটোটা দেয়ালে যেখানে ছিল সেখানেই থাকছে, ওটায় আমি হাত দিচ্ছি না। তিনি যদি কখনও কলকাতায় আসেন, আমাদের এখান থেকে যেন ওটা নিয়ে যান।
কয়েকদিন পরেই মিস্টার তরফদারের চিঠি এলো, এবং তার চিঠি পড়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তিনি লিখেছেন, ওই ফটোর কোনও ব্যক্তির সঙ্গে তার কিংবা তার পরিবারের কারও কোনও সংস্রব নেই। তাদের বংশের কেউ কখনও গয়ায় বাস করেনি, দু-একবার পিণ্ড দিতে গিয়েছেন, কিন্তু সেই পর্যন্তই।
মিস্টার তরফদারের চিঠি পড়ে আরও জানলাম যে, তিনিও এসে দেয়ালে ঝোলানো অবস্থায় ফটোটি পেয়েছিলেন এবং আমারই মতো তার পূর্ববর্তী বাসিন্দাকে যোগাযোগ করে ফটোটি ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। দুঃখের বিষয় তিনি ফটোটি ফেরত দিতে পারেননি, কারণ সেই পূর্বতর বাসিন্দা ফটোটির দায়িত্ব সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন এবং জানান যে, তিনিও বাড়িতে এসে দেয়ালে ঝোলানো অবস্থায় ফটোটি পেয়েছিলেন।
আমার যদি অনেক সময় থাকত এবং সরকারি নথি খুলে আমার বর্তমান ফ্ল্যাটের প্রাক্তন বাসিন্দাদের তালিকা ও নাম-ঠিকানা জোগাড় করে একে একে যোগাযোগ করতে পারতাম, হয়তো প্রকৃত মালিকের কাছে, যিনি প্রথমবার ভুল করে ছবিটি ফেলে রেখে যান, তার জিনিস ফেরত দিতে পারতাম।
কিন্তু সে বড় কঠিন কাজ। ছবিটি তোলা হয়েছিল উনিশশো চব্বিশ সালে আর আমাদের এই সরকারি ফ্ল্যাট বাড়িটায় সরকারি কর্মচারীর বসবাস শুরু হয়েছে পঞ্চাশ দশকের শুরু থেকে।
এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে আমিই শুধু একটানা আট বছর আছি। অন্যেরা কেউ দুবছর, বড় জোর আড়াই বছর। কেউ কেউ তার চেয়ে কম সময়েও থেকেছেন।
মোটমাট অন্তত জনা-দশ-বারো সরকারি কর্মচারী আমার আগে এ বাসায় থেকে গেছেন। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, তাদের মধ্যে কয়েকজন ইতিমধ্যে লোকান্তরিত হয়েছেন, একজন সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন, আর অন্য একজন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ সরকারি তহবিল তছরুপ করে যথাকালে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন।
সুতরাং অনেক রকম চিন্তা করে আমি আর এই ফটোর মালিককে খুঁজে বার করার চেষ্টা করিনি। আমার পূর্বের বাসিন্দারা যা করেছিলেন, আমিও ঠিক তাই করেছি। দেয়ালে ঠিক যে জায়গায় ফটোটা ছিল সেখানেই রেখে দিয়েছি, একটুও নড়চড় করিনি। শুধু চুনকামের সময় খুলে একটু সরিয়ে রাখি, আবার চুনকাম সারা হয়ে গেলে ফটোর ওপরের কাঁচটা ভাল করে মুছে দেয়ালের নির্দিষ্ট স্থানে টাঙিয়ে দিই, সাদা দেয়ালে কালো কোট, চাপকান পরা পুরনো কালের ভারী ভারী মানুষদের চমৎকার মানায়।
আমাদের বাইরের ঘরে কেউ এলেই ছবিটার দিকে তাঁর নজর যায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ জানতে চান, আপনারা কি আগে গয়ায় থাকতেন? আমি এই প্রশ্নের কোনও সরাসরি উত্তর দিই না, শুধু একটু মৃদু হাসি।