শুভ নববর্ষ
শুভ নববর্ষ। বৃদ্ধেরা শিহরিয়া উঠিল। নিতান্ত অশুভ প্রারম্ভ। রুদ্ররূপে মৃত্যু প্রবেশ করিয়াছে–সঙ্গিনী মহামারীকে লইয়া। চণ্ডীমণ্ডপে বর্ষগণনা পাঠ ও পঞ্জিকা-বিচার চলিতেছে। করিতেছে খোঁড়া পুরোহিত, শুনিতেছে শ্ৰীহরি ঘোষ এবং প্রবীণ মণ্ডলেরা।
গতরাত্রির শেষভাগ হইতে বায়েনপাড়ার তিন জন আক্রান্ত হইয়াছে; বাউরিপাড়ায় দুই জন। উপেন মরিয়াছে। শ্ৰীহরি গম্ভীরভাবে বসিয়া ভাবিতেছিল। এ যে প্রকাণ্ড দায়িত্ব সম্মুখে। গ্রামকে রক্ষা করিতে হইবে। হতভাগ্যের দল, তাহার সহিত বিরোধিতা করিয়াছে বলিয়া সে এ সময় বিমুখ হইলে, সে যে ধর্মে পতিত হইবে। অবশ্য কাজ সে আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। ভূপাল চৌকিদারকে ইউনিয়ন বোর্ডে পাঠাইয়াছে। স্যানিটারি ইন্সপেকটারের কাছে সংবাদ দিতে ইউ-বির সেক্রেটারিকে পত্ৰ দিয়াছে। লোকটি কাল সকালেই আসিয়াছিল। বাউরিপাড়ায়, বায়েনপাড়ায় কিছু চাল সাহায্য দিবার কথাও সে ভাবিয়া রাখিয়াছে। চণ্ডীমণ্ডপের ইদারাটিকে কলেরার সংস্পর্শ হইতে বাঁচাইয়া রাখিবার জন্য কঠোর ব্যবস্থা করিয়াছে। কালু শেখ পাহারায় মোতায়েন আছে।
বুড়ি রাঙাদিদি আজ সকালে ভগবানকে গাল দেয় নাই; সে জোড়হাতে তারস্বরে বার বার বলিতেছে-ভগবান, রক্ষে কর, হে ভগবান! দোহাই তোমার বাবা! তুমি ছাড়া গরিবের আর কে আছে দয়াময়! গেরাম রক্ষা কর বাবা বুড়োশিব! হে বাবা! হে ভোলানাথ! হে মা কালী।
পদ্ম আকুল হইয়া উঠিয়াছে উচ্চিংড়ে ও গোবরার জন্য। আসাপা ছেলে—সাপ দেখিলে ধরিবার মত দুঃসাহস উহাদের; কি করিয়া উহাদের সে বাঁচাইবে? তাহার সর্বাঙ্গ থরথর করিয়া কাঁপিতেছে।
যতীনও চিন্তান্বিত হইয়া উঠিয়াছে; বাংলাদেশে কত লোক কলেরায় মরে, কত লোক। ম্যালেরিয়ায় মরে, কত লোক অনাহারে মরে, কত লোক অর্ধাশনে থাকে—এ সব তথ্য সে জানে। নিয়তিকে সে স্বীকার করে না। সে জানে এ মনুষ্যকৃত ত্ৰুটি, আপনাদের অজ্ঞানতার অক্ষমতার অপরাধের প্রতিফল। অপরাধ একমাত্র এই দেশটিতেই আবদ্ধ নয় মানুষের ভ্রম হইতে, ভেদবুদ্ধি হইতে, অক্ষমতা হইতে উদ্ভূত এ অপরাধ পৃথিবীর সর্বত্র ব্যাপ্ত। ব্যাধি এক দেশ হইতে অন্য দেশে সংক্রামিত হয় নাই, সেই দেশ হইতেই উদ্ভূত হইয়াছে—অর্থগৃধুর ধন উপার্জন-শক্তির প্রতিক্রিয়ায় চৌর্যের মত, দানধর্মের প্রতিক্রিয়ায় ভিক্ষাব্যবসায়ের মত। পুলিশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-রিপোর্ট সে পড়িয়াছে—ভিক্ষুকের দল এক-একটা শিশুকে হাঁড়ির ভিতর দিবারাত্র বসাইয়া রাখে—বৎসরের পর বৎসর বসাইয়া রাখে, যাহাতে তাহাদের অর্ধাঙ্গ বৃদ্ধি না। পায়, পুষ্ট না হয়। পরে ইহাদের বিকলাঙ্গের দোহাই দিয়া দিব্য ভিক্ষার ব্যবসার পুতুল করিয়া তোলে। হয়ত এ দেশের ক্ৰটি বেশি, এ দেশে লোক বেশি মরে, কুকুর-বিড়ালের মত মরে। তাহার প্রতিকারের চেষ্টাও চলিতেছে। হয়ত একদিন—তাহার চোখ জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিয়া উঠিল—আরতির যুগল কপূর-প্রদীপের শিখার মত মুহূর্তের জন্য, পরমুহূর্তেই সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। কালের দ্বারে বলি ভাবিয়া দৃঢ়চিত্তে আজ কিন্তু এ সমস্ত সে দেখিতে পারিতেছে না। পদ্মের মত সমস্ত গ্রামখানাই কবে কখন তাহার সমস্ত অন্তরকে মমতায় আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছে—সে বুঝিতে পারে নাই। গ্রামের এই বিপর্যয়ে—বিয়োগে-শোকে সে নিতান্ত আপনজনের মতই একান্ত বিষণ্ণ ও ব্যথিত হইয়া উঠিল।
বৈশাখের প্রথম দিন। সেই মধ্যরাত্রে কিছু বৃষ্টি হইয়াছে, তারপর আর হয় নাই। হু-হু করিয়া গরম ধূলিকণাপূর্ণ বাতাস বহিতেছে ঝড়ের মত। সেই বাতাসে শরীরের রক্ত যেন শুকাইয়া যাইতেছে। মাটি তাতিয়া আগুন হইয়া উঠিয়াছে। চারিদিকে যেন একটা তৃষাতুর হা-হা-ধ্বনি উঠিয়াছে। কোথাও মানুষ দেখা যায় না। এক দিনেই এক বেলাতেই একটা মানুষের মৃত্যুতেই মানুষ ভয়ে ত্রস্ত হইয়া ঘরে ঢুকিয়াছে, একটা মানুষও আর পথের উপরে নাই।
শুধু বাহির হইয়াছে দেবু ও জগন। তাহারা এখনও ফেরে নাই। যতীনও একবার বাহির হইয়াছিল, অল্পক্ষণ পূর্বে ফিরিয়াছে। সে ফিরিতেই পদ্ম অঝোর-ঝরে কাঁদিয়া বলিল-আমাকে খুন কোরো না তুমি-তোমার পায়ে পড়ি। দোহাই একটু সাবধানে থাক তুমি।
যতীন ভাবিয়া পায় না—এই অবোধ মা-মণিকে সে কি বুলিবে?
দেবু গিয়াছে উপেনের সৎকারে। সকাল হইতে দেবু যেন একাই একশো হইয়া উঠিয়াছে। এই অর্ধ-শিক্ষিত পল্লী-যুবকটির কর্মক্ষমতা ও পরার্থপরতা দেখিয়া যতীন বিস্মিত হইয়া গিয়াছে। আরও একটা নূতন জিনিস সে দেখিয়াছে। ডাক্তারের অভিনব রূপ। চিকিৎসকের কর্তব্যে তাহার এতটুকু ক্ৰটি নাই। শৈথিল্য নাই। এই মহামারী ক্ষেত্রে নির্ভীক জগন-পরম যত্নের সহিত প্রতিটি জনকে আপনার বিদ্যাবুদ্ধি মত অকাতরে চিকিৎসা করিয়া চলিয়াছে। গ্রামে সে কখনও ফি লয় না; কিন্তু এমন ক্ষেত্রে, কলেরার মত ভয়াবহ মহামারীর সময় ডাক্তারদের উপার্জনের বিশেষ একটা সুযোগ পাইয়াও জগন আপনার প্রথা-রীতি ভাঙে নাই,এটা জগনের লুকাইয়া রাখা একটা আশ্চর্য মহত্ত্বের পরিচয়। মুখে আজ তাহার কর্কশ কথা পর্যন্ত নাই, মিষ্ট ভাষায় সকলকে অভয় দিয়া চলিয়াছে।
দেবু ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডে টেলিগ্ৰাম পাঠাইয়াছে। টেলিগ্রাম লইয়া জংশনে গিয়াছে দুর্গা। ইউনিয়ন বোর্ডেও দেবু সংবাদ পাঠাইয়াছে, পাতু সেখানে গিয়াছে। নিজে সে রোগাক্রান্তদের বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়াছে। যাহারা গ্রাম হইতে সরিয়া যাইতে চাহিয়াছে—তাহাদিগকে সাহায্য করিয়াছে। তারপর উপেন বায়েনের সৎকারের ব্যবস্থা করিতে বসিয়াছে। বায়েনদের মধ্যে এখানে সক্ষম পুরুষ মাত্র তিন জন। তাহাদের এক জন পলাইয়াছে। বাকি দুই জন রাজি থাকিলেও দুই জনে একটা শব লইয়া যাওয়া অসম্ভব কথা। পাশেই বাউরিপাড়ায় অনেক লোক আছে। বটে, কিন্তু বাউরিরা মুচির শব স্পর্শ করিবে না। তবে বাউরিদের মাতব্বর সতীশ তাহার সঙ্গে আছে।
শ্মশানের পথও কম নয়, ময়ূরাক্ষীর গর্ভের উপর শ্মশান দূরত্ব দেড় মাইলের উপর। অনেক চিন্তা করিয়া শেষে বেলা এগারটার সময় আপনার গাড়ি গরু আনিয়া, দেবু গাড়িতে করিয়া উপেনের সকারের ব্যবস্থা করিল।
সৎকারের ব্যবস্থা করিয়াই তাহার কর্তব্য শেষ হইল না; বাউরিবায়েনদের দায়িত্বজ্ঞান কম হয়ত গ্রামের কাছেই কোথাও ফেলিয়া দিবে আশঙ্কা করিয়া সে শবের সঙ্গে শ্মশান পর্যন্ত যাইতে প্রস্তুত হইল। তা ছাড়া পাতুও তাহার সঙ্গী—মাত্র দুই জনে এই কলেরারোগীর মৃতদেহ লইয়া শ্মশানে যাইতে তাহারা যেন ভয় পাইতেছিল। দেবু তাহা অনুভব করিল। এবং বলিল–ভয় করছে পাতু?
শুকমুখে পাতু বলিল–আজ্ঞে?
–ভয় করছে নিয়ে যেতে?
–করছে একটুকু। ভয়ার্ত শিশুর মতই অপকটে সে স্বীকার করিল।
–তবে চল, আমি তোমাদের সঙ্গে যাই।
–আপুনি?
–হ্যাঁ, আমি। চল যাই।
পাতু ও তাহার সঙ্গীর মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। পাতু বলিল—আপুনি বাঁধের ওপরটিতে শুধু দাঁড়াবেন তা হলেই হবে।
–চল, আমি শ্মশান পর্যন্তই যাব।
প্রচণ্ড উত্তাপে উত্তপ্ত বৈশাখী দ্বিপ্রহরে তাহারা গাড়ির উপর শবদেহ চাপাইয়া বাহির হইয়া পড়িল। মাঠ আজ জনশূন্য। রাখালেরা সকলেই প্ৰায় এই বাউরিবায়েনের ছেলে—তাহারা এমন আতঙ্কিত হইয়া উঠিয়াছে যে, মাঠে গরু লইয়া আসে নাই। গ্রামের আশপাশেই গরু লইয়া চুপচাপ বসিয়া আছে। বৈশাখী দ্বিপ্রহরে এই ধু-ধু করা প্রান্তরে আসিয়া যদি অকস্মাৎ তাহারা রোগাক্রান্ত হইয়া পড়ে, তাহা হইলে কি হইবে? মাঠে আগুনের মত ধুলায় পড়িয়া তৃষ্ণায় ছটফট করিয়া মরিবে যে! এই আতঙ্কে তাহারা আতঙ্কিত। চারিদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় মাঠখানা খাখা করিতেছে। মধ্যে যে বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে, তাহার আর এক বিন্দুও কোথাও জমিয়া নাই। মাটির রস পর্যন্ত শুকাইয়া গিয়াছে। প্রাচীন কালের বড় বড় সিচের পুকুরগুলি এমনভাবে মজিয়া গিয়াছে, মোহনার বাঁধ এমনভাবে ভাঙিয়া গিয়াছে যে, বিন্দু বিন্দু করিয়া যে জল ভিতরে জমে, তাহাও নিঃশেষে বাহির হইয়া আসে। গ্রামের প্রান্ত হইতে ময়ূরাক্ষী পর্যন্ত কোথাও এক ফোঁটা জল নাই। ঝড়ের মত প্রবল বৈশাখী দ্বিপ্রহরের বাতাসে মাঠের ধুলা উড়িতেছে; তাহাতে যেন আগুনের স্পৰ্শ। ইহারই মধ্যে গাড়িটা ধীর গতিতে চলিয়াছিল। ক্যাঁ-ক্যাঁ-ক্যাঁ -চাকার দীর্ঘ একটানা একঘেয়ে শব্দ উঠিতেছে। ক্যাঁ-ক্যাঁ–
পাতু বলিল—এবার আর আমাদের রক্ষে নাই; কেউ বাঁচবে না পণ্ডিত মশায়।
দেবু স্নেহসিক্ত স্বরে অভয় দিয়া বলিল–তুই পাগল পাতু! ভয় কি?
–ভয়? পাতু হাসিল, বলিল—একেবারে পয়লা বোশেখ নামুনে ঢুকল গাঁয়ে। তা ছাড়া লোকে বলছে—এবার আমরা চণ্ডীমণ্ডপ ছাইয়ে দিলাম না-বাবা বুড়োশিবের রাগেই হয়ত–
দেবুও একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। সে দেবধর্মে বিশ্বাসী। কিন্তু বাবা কি এমনই অবিচার করিবেন? নিরপরাধের অপরাধটাই বড় হইবে তাঁহার কাছে? দেবোত্তর সম্পত্তি যাহারা আত্মসাৎ করিয়া লইয়াছে, তাহাদের তো কিছু হয় নাই? সে দৃঢ়স্বরে বলিলনা পাতু, বাবার কাছে। কোনো অপরাধ তোমাদের হয় নাই। আমি বলছি।
পাতু বলিল—তবে ইরকমটা ক্যানে হল পণ্ডিত মশাই?
দেবু কলেরার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আরম্ভ করিল।
উঃ! এই ঠিক দুপুরে স্ত্রীলোক কে এদিকে আসিতেছে? বোধ হয় জংশন হইতে ফিরিতেছে। হ্যাঁ, তাই তো। এ যে দুৰ্গা! দুৰ্গা টেলিগ্ৰাম পাঠাইয়া ফিরিতেছে।
উপেনের শবের সঙ্গে দেবুকে দেখিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল—নিকটে আসিয়া তিরস্কার-ভরা কণ্ঠ করিয়া বলিল—এ কি করেছ জামাই! তুমি কেন এলে? তুমি যাচ্ছ কেন? ফের!
দেবু কথাটা একেবারে ঘুরাইয়া দিল—এতক্ষণে ফিরলে দুর্গা! টেলিগ্ৰাম হল?
–হল। কিন্তু তুমি কিসের লেগে যাচ্ছ জামাই? ফিরে চল!
–ফিরছি, তুই যেতে লাগ।
–না, তুমি ফের আগে!
–পাগলামি করিস না দুর্গা। তুই যা, আমি শিগগির ফিরব।
তাহারা চলিয়া গেল; দুর্গার চোখ দিয়া অকারণে জল পড়িতে আরম্ভ করিল।
শীঘ্ৰ ফিরিব বলিলেও শীঘ্ৰ ফেরা হইল না। ফিরিতে অপরাত্ন গড়াইয়া গেল। ময়ূরাক্ষীর কাদা-বালি-গোলা, হাঁটুডোবা জলে কোনোমতে স্নান সারিয়া বাড়ি আসিয়া দেবু ডাকিল–বিলু!
ছুটিয়া বাহির হইয়া আসিল খোকা, তাহার খোকনমণি। দুটি হাত বাড়াইয়া সে ডাকিল–বা-বা!
দেবু দুই পা পিছনে সরিয়া আসিয়া বলিল–না, না, ছুঁয়ো না আমাকে। না।
খোকন আমোদ পাইয়া গেল। মুহূর্তে তাহার মনে পড়িয়া গেল লুকোচুরি খেলার আমোদ, সে খিলখিল করিয়া হাত বাড়াইয়া আরও ছুটিয়া আসিল। খোকনের আমোদের ছোঁয়াচ দেবুকেও লাগিল—সে আরও খানিকটা সরিয়া আসিয়া বলিল না খোকন, দাঁড়াও ওখানে। তারপর সে ডাকিল বিলুকে।—বিলু–বিলু!
বিলু বাহির হইয়া আসিল-অভিমান-স্ফুরিতাধরা। সে কোনো কথা বলিল না। চুপ করিয়া স্বামীর আদেশের প্রতীক্ষায় দরজার কাছে দাঁড়াইয়া রহিল। দেবু কি তাহার সর্বনাশ করিতে চায়? এই প্রখর গ্রীষ্ম, তাহার উপর এই ভয়ঙ্করী মহামারী, দেবু সেই মহামারী লইয়া মাতিয়া উঠিল–তাহার সর্বনাশ করিবার জন্য? সে সমস্ত দুপুর কাঁদিয়াছে।
দুর্গা আসিয়াছিল। সে বিলুকে তিরস্কার করিয়া গিয়াছে। বলিয়া গিয়াছে, একটুকুন শক্ত হও বিলু-দিদি, জামাই-এর একটু রাস টেনে ধর। নইলে এই রোগের পিছুতে ও আহার নিদ্রে ভুলবে, হয়ত তোমাদের সর্বনাশনিজের সর্বনাশ করে ফেলবে।
দেবু তাহার মুখের দিকে চাহিয়া তাহার অভিমান অনুভব করিল। হাসিয়া বলিল—আমার বিলুমণির রাগ হয়েছে? শিগগির একটু থোকাকে ধর বিলু!
বিলুর চোখের জল আর বাঁধ মানিল না। ঝরঝর করিয়া সে কাঁদিয়া ফেলিল।
দেবু বলিল—কেঁদো না, ছি! কথা শোন, শিগগির ধর খোকাকে। আর আমাকে একটু খড় জ্বেলে আগুন করে দাও, তারপর তাড়াতাড়ি এককড়া জল গরম চাপাও। গরম জলে হাত-পা ধুয়ে ফেলব; কাপড়-জামাও গরম জলে ফুটিয়ে নিতে হবে।
বিলু কোনো কথা বলিল না, ছেলেটিকে টানিয়া কোলে তুলিয়া লইল। ছেলেটি দেবুকে সকাল হইতে দেখিতে পায় নাই, সে চিৎকার আরম্ভ করিয়া দিল-বাবা দাব! বাবা দাব!
বিলু তাহার পিঠে একটা চাপড় বসাইয়া দিয়া বলিল—চুপ কর বলছি, চু-উ-প। তবুও তাহার জিদ দেখিয়া তাহাকে দুম করিয়া নামাইয়া দিল।
দেবু আর সহ্য করতে পারিল না। বিলুকে তিরস্কার করিয়া বলিল-আঃ বিলু! ও কি হচ্ছে? শিগগির ওকে কোলে নাও বলছি।
বিলু আজ ক্ষেপিয়া গিয়াছে, সে বলিল—কেন, তুমি মারবে নাকি? ছেলের আদর কত করছ—তা জানি।
দেবু স্তম্ভিত হইয়া গেল।
বিলু হু-হু করিয়া কাঁদিয়া উঠিল; বলিল—এমন দগ্ধে মারার চেয়ে আমাকে তুমি খুন করে ফেল। আমাকে তুমি বিষ এনে দাও।
দেবু উত্তর দিতে গেল—সান্ত্বনা-মধুর উত্তরই সে দিতেছিল। কিন্তু দেওয়া হইল না। সৰ্পশৃষ্টের মত সে চমকিয়া উঠিল, শিহরিয়া উঠিল—পিছন হইতে খোকা তাহাকে দুই হাত দিয়া জড়াইয়া ধরিয়া খিল খল করিয়া হাসিতেছে। ধরিয়াছে, সে ধরিয়াছে—পলাতককে সে ধরিয়াছে। দেবু পিছন ফিরিয়া খোকার দুই হাত শক্ত করিয়া ধরিয়া ফেলিল, আর্তস্বরে বিলুকে বলিল–শিগগির জল গরম কর বিলু, শিগগির। খোকার হাত ধুয়ে দিতে হবে। এখুনি হয়ত ওই হাত মুখে দেবে।
খোকা দুরন্ত অভিমানে চিৎকার করিয়া হাত পা ছুড়িয়া কাঁদিয়া অস্থির হইয়া উঠিল। তাহার ধারণা হইল—তাহার বাবা তাহাকে দূরে ঠেলিয়া দিতেছে। শুধু সে কাঁদিলই নাকিয়া পড়িয়া রোষে ক্ষোভে দেবুর হাতের এক জায়গায় কামড়াইয়া প্রায় ক্ষতবিক্ষত করিয়া দিল। শেষে তাহার ভিজা কাপড়ের খানিকটাও দাঁত দিয়া চিড়িয়া দিল।
দেবু ইহাতে রীতিমত আতঙ্কিত হইয়া উঠিল। বিলুকে একপ্রকার হাত ধরিয়া বাড়ির মধ্যে টানিয়া আনিয়া বলিল—বিলু, লক্ষ্মীটি, সব বুঝিয়ে বলছি তোমায়। চট করে এখনই গরম জল চড়াও। খোকার মুখখানা তাড়াতাড়ি ধুইয়ে দাও।–
বিলুর রাগ কিন্তু একটু পরেই নিভিয়া গিয়াছে। দেবুর কোলে খোকনকে দেখিয়া সে মহাখুশি হইয়া উঠিয়াছে। বলিল—তুমি কি নিষ্ঠুর বল দেখি! ছেলেটা আমার চেয়েও তোমাকে ভালবাসে—আর তুমি কিনা ওকে ফেলে বাইরে বাইরে থাক! তোমার বোধহয় বাড়ির বাইরে পা দিলে সংসার বলে কিছুই মনে থাকে না! ছিঃ, খোকাকে ভুলে যাও তুমি?
দেবু বলিল না। আর যাব না বিলু, আমি প্রতিজ্ঞা করছি আর যাব না।
গরম জলে মুখ হাত পা ধোওয়াইয়া, নিজে ধুইয়া দেবু থোকাকে এতক্ষণে ভাল করিয়া। কোলে লইল। বাপের কোলে থাকিয়াই সে মাকে কাছে আসিতে দেখিয়া বাপের বুকে মুখ। লুকাইল। বিলু দেখিয়া হাসিয়া বলিল-ওই দেখ দেখি।
খোকন বলিয়া উঠিল—না, দাব না। না, দাব না।
বিলু খিলখিল করিয়া হাসিয়া বলিল—ওরে দুষ্ট ছেলে! না, দাবে না তুমি? বাপ পেয়ে আমায় ভুললে বুঝি? আচ্ছা, আমিও তোমাকে মেনু দেব না!
খোকন এবার মায়ের মন রাখিতে দেবুকে বলিলবাবা, মা দাই!
বিলু বলিল—উঁহুঁ! বাবাকে ধরে রাখ, বাবা পালাবে।
দেবুর বুকখানা রুদ্ধ আবেগে তোলপাড় করিয়া উঠিল।
সেটা বিলুর চোখে পড়িল। সে শঙ্কিত হইয়া প্রশ্ন করিল–হ্যাঁগা, তোমার শরীরটা ভাল আছে তো?
হাসিবার চেষ্টা করিয়া দেবু বলিল—শরীরটা খুব ক্লান্ত হয়েছে।
–একটু চা করব, খাবে?
–কর।
চা খাইয়াও সে তেমনি নীরব বিষণ্ণতার মধ্যে উদ্বেগ-উদ্বেলিত অন্তরে একটা ভীষণ কিছু। অপেক্ষা করিয়া রহিল। সন্ধ্যার সময় বাউরিবায়েনপাড়ায় একটা কান্নার রোল উঠিল। কেহ। নিশ্চয় মরিয়াছে। দেবু খোকাকে ঘুম পাড়াইতে পাড়াইতে অধীর হইয়া উঠিল।
বিলু বলিল—কেউ মল বোধহয়!
তিক্তস্বরে দেবু বলিল—মরুক গে, আমি আর খোঁজ নিচ্ছি না।
অবাক হইয়া বিলু তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল; তারপর বলিল—আমি কি তোমাকে। বলেছি যে, কেউ মলে তুমি খোঁজ করবে না, না তাদের বিপদে তুমি দেখবে না! উপেন বায়েন—মুচি, তার সকারের জন্যে গাড়ি দিলে, আমি কিছু বলেছি? কিন্তু তুমি শ্মশান পর্যন্ত সঙ্গে গেলে কেন বল দেখি? খাওয়া নাই—এই বোশেখ মাসের রোদ! তাই বলেছি আমি।
খোকা দেবুর কোলে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। বিলু খোকাকে দেবুর কোল হইতে লইয়া বলিল–যাও, একবার দেখে এখুনি ফিরে এস। তোমার উপর কত ভরসা করে ওরা তো জানি।
দেবু যন্ত্রচালিত পুতুলের মতই বিলুর কথায় বাড়ি হইতে বাহির হইয়া পড়িল। চণ্ডীমণ্ডপে খোল-করতাল লইয়া হরিনাম-সংকীর্তনের দল বাহির করিবার উদ্যোগ হইতেছে। মৃঙ্গের ধ্বনিতে নাকি অমঙ্গল দূরীভূত হয়।
ও-পাড়ার ধর্মদেবের পূজার আয়োজন চলিতেছে। সে সতীশকে ডাকিল। সতীশ আসিয়া তাহাকে প্রণাম করিয়া বলিল অবস্থা যে ভয়ানক হয়ে উঠল পণ্ডিতমশায়! বিকেলে আবার দুজনার হয়েছে। গণার পরিবার একটুকু আগে মারা গেলেন।
—তাড়াতাড়ি সৎকারের ব্যবস্থা কর।
–আজ্ঞে হ্যাঁ। সেসব করছি। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া অপরাধীর মত সে বলিল–উ বেলায় রূপেনের মড়া নিয়ে আপনাকে—কি করব বলেন! আমাদের জাত তো লয়। আমাদের লেগে আপনাকে এত ভাবতে হবে না।
কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া দেবু বলিল—ডাক্তার বিকেলে এসেছিল?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। বিকেলে আবার ঘোষমশায় নোক পাঠিয়েছিলেন–চাল দেবেন বলে। তা ডাক্তারবাবু বললেন–-কিছুতেই লিবি না।–আমরা যাই মশায়।
দেবু অন্যমনস্কভাবে চুপ করিয়া রহিল। তাহার মনের মধ্যে ধীরে ধীরে একটা গভীর উদাসীনতা যেন নিবিড় কুয়াশার মত জাগিয়া উঠিতেছে—তাহার সুখ দুঃখ সব যেন সংবেদন-শূন্যতায় আচ্ছন্ন হইয়া যাইতেছে। যে গভীর উদ্বেগ সে সহ্য করিতেছিল—সেই উদ্বেগ যেন। পুরাণের নীলকণ্ঠের হলাহল। নীলকণ্ঠের হলাহলের মতই তাহাকে যেন মোহাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছে।
সতীশ আবার ডাকিলপণ্ডিতমশায়!
—আমাকে কিছু বলছ?
সতীশ অবাক হইয়া গেল, বলিল–আজ্ঞে হ্যাঁ।
পণ্ডিতমশায় আর কে আছে এখানে, ও-নামে আর কাহাকে ডাকিবে সে?
–কি বল?
–বলছি। রাগ করবেন না তো?
–না না, রাগ করব কেন?
—বলছিলাম কি, ঘোষমশায় চাল দিতে চাইছেন, তা লিতে দোষ কি? অভাবী নোক সব এই মহা বেপদের সময়–
দেবু প্রসন্ন সহানুভূতির সঙ্গেই বলিলনা না, কোনো দোষ নাই সতীশ। ঘোষমশায় তো শত্ৰু নন তোমাদের, আমাদেরও নন। তিনি যখন নিজে যেচে দিতে চাচ্ছেন—তখন নেবে বৈকি।
সতীশ দেবুর পায়ের ধূলা লইয়া বলিল—আপনকার মত যদি সবাই হত পণ্ডিতমশায়! আপনি একটুকুন বলে দেবেন ডাক্তারবাবুকে। উনি আবার রাগ করবেন।
–আচ্ছ, আচ্ছা। আমি বলে দোব ডাক্তারকে।
–ডাক্তারবাবু বসে আছেন নজরবন্দিবাবুর কাছে।
দেবু ফিরিল। কিন্তু আজ আর যতীনের ওখানে যাইতে ইচ্ছা হইল না। সে বাড়ির পথ। ধরিল। বাড়িতে দুর্গা আসিয়া বসিয়া আছে। দুর্গা বলিল—আমাদের পাড়া গিয়েছিলে জামাই পণ্ডিতঃ গণার বউটা মারা গেল, নয়?
–হ্যাঁ। সে বিলুকে বলিলখোকন কই?
–সে সেই ঘুমিয়েছে, এখনও ওঠে নি।
ঘুমিয়েছে! দেবু একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিল। প্ৰায় ঘণ্টাচারেক কাটিয়া গেল, খোকা নিশ্চিন্ত হইয়া ঘুমাইতেছে। ঘুম সুস্থতার একটা লক্ষণ। তারপর সে দুর্গাকে প্রশ্ন করিল-তুই এতক্ষণ ছিলি কোথায়?
–জংশন গেছলাম।
বিলু বলিল—একটু জল খাও। দুর্গা খাতা ফিরিয়ে মিষ্টি এনেছে।
—তাই তো। হারে দুর্গা, জংশনে দোকানদারদের কাছে ভারি কথার খেলাপ হয়ে গেল রে!
–সেসব ঠিক হয়েছে গো, তোমাকে অত ভাবতে হবে না।
দুর্গা হাসিল—বিলু-দিদির মত লক্ষ্মী তোমার ঘরে, ভাবনা কি? বিলু-দিদি আমাকে দু টাকা দিয়েছিল, আমি দিয়ে এসেছি। আবার সেই আষাঢ়ে কিছু দিয়ে রথের দিনে, আর কিছু আশ্বিনে,–দোকানি তাতেই রাজি হয়েছে।
পরম আরামের একটা নিশ্বাস ফেলিয়া এতক্ষণে সত্যকার হাসি হাসিয়া দেবু বলিল—বিলু, আমি যতীনবাবুর কাছ থেকে একটু ঘুরে আসি, বুঝলে?
–এই রাত্তিরে আবার বেরুচ্ছ? তা একটুকুন জল খেয়ে যাও।
–আমি যাব আর আসব। জল এখন আর খাব না।
–আচ্ছা উপোস করতে পার তুমি! বিলু হাসিল। দেবু বাহির হইয়া গেল।
যতীনের আসরে আজ কেবল যতীন, জগন, আর চা-প্রত্যাশী গাঁজাখোর গদাই। চিত্রকর নলিনও আসিয়া একটি কোণে অভ্যাসমত চুপ করিয়া বসিয়া আছে। সে আজ একটি টাকা চাহিতে আসিয়াছে। গ্রাম ছাড়িয়া কয়েক দিনের জন্য সে অন্যত্ৰ যাইবে।
জগন অনর্গল বকিতেছে। দেবুকে দেখিয়া ডাক্তার বলিল—কি ব্যাপার হে, এ বেলা পাত্তাই নাই! আমি ভাবলাম, তুমি বুঝি ভয় পেয়েছ।
দেবু হাসিল।
যতীন বলিল—শরীর কেমন দেবুবাবু? শুনলাম শ্মশানে গিয়েছিলেন, ফিরেছেন চারটের পর।
–শরীর খুব ক্লান্ত। নইলে ভালই আছি।
—তুমি মুচি মড়ার সঙ্গে গিয়েছ, চণ্ডীমণ্ডপে গিয়ে দেখে এসো একবার ব্যাপারটা! আর তোমার রক্ষে নাই।
দেবু ও-কথা আমলেই আনিল না, বলিল-আচ্ছা ডাক্তার, কলেরার বিষ যদি শরীরে ঢোকে, তবে কতক্ষণ পরে রোগ প্রকাশ পায়?
জগন হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিল—তুমি ভয় পেয়ে গিয়েছ দেবু-ভাই!
গদাই ওপাশ হইতে সসঙ্কোচে বুলিল—কিসের ভয়? ওর ওষুধ হল এক ছিলিম গাঁজা।
দেবু আর কোনো প্রশ্ন করিল না, প্ৰশ্ন করিতেও তাহার ভয় হইতেছে। বিজ্ঞানের সত্য যদি তাহার উৎকণ্ঠা বাড়াইয়া দেয়? সে বারবার মনে করিলবিজ্ঞানই একমাত্র সত্য নয়, এ সংসারে আর একটা পরম তত্ত্ব আছে—সে পুণ্য, সে ধর্ম। তাহার ধর্ম, তাহার পুণ্য তাহাকে রক্ষা করিবে। সেই অমৃতের আবরণ থোকাকে মহামারীর বিষ হইতে অবশ্যই রক্ষা করিবে।
যতীন বলিল—কি ব্যাপার বলুন তো দেবুবাবু? হঠাৎ এ প্রশ্ন করলেন কেন আপনি?
দেবু বলিল-আজ যখন বাড়ি ফিরলাম, শ্মশানে উপেনের শব আমাকে ধরতে হয়েছিল; তারপর অবিশ্যি ময়ূরাক্ষীতে স্নান করেছি। তারপর বাড়ি ফিরে——কে? দুর্গা নাকি?
হ্যাঁ, দুর্গাই। অন্ধকার পথের উপর আলো হাতে আসিয়া দুর্গাই দাঁড়াইল।
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে দুর্গা বলিল হ্যাঁ, বাড়ি এস শিগগির। খোকার অসুখ করেছে,একবারে জলের মতন
দেবু বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত উঠিয়া একলাফে পথে নামিয়া ডাকিল–ডাক্তার।
বৈজ্ঞানিক সত্য ধর্মবিশ্বাসের কণ্ঠরোধ করিয়া শেষে কি তাহার গৃহেই রুদ্রমূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করিল?
সর্বনাশী মহামারী মানবদেহের সকল রস দ্রুত শোষণ করিয়া জীবনীশক্তিকে নিঃশেষিত করিয়া দেয়। সেই মহামারী দেবুর সকল রস, সকল কোমলতা নিষ্ঠুর পেষণে পিষ্ট করিয়া পাথর করিয়া দিয়া তাহার ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। একা খোকা নয়, খোকা ও বিলুদুজনেই কলেরায় মারা গেল। প্রথম দিন খোকা, দ্বিতীয় দিন বিলু। শুশ্রুষা ও চিকিৎসার কোনো ত্রুটি হয়। নাই। জংশন শহর হইতে রেলের ডাক্তার, কঙ্কণার হাসপাতালের ডাক্তার দুই জন বড় ডাক্তার। আনা হইয়াছিল। কঙ্কণার হাসপাতালের ডাক্তারটি সংবাদ পাইয়া আপন হইতেই আসিয়াছিল। লোকটি গুণগ্রাহী, দেবুর প্রতি শ্রদ্ধাবশতই আসিয়াছিল। জগন নিজে জংশনে গিয়া রেলের ডাক্তারকে আনিয়াছিল। অনাহারে অনিদ্রায় দেবু অকাতরে তাহাদের সেবা করিয়াছে আর ঈশ্বরের নিকট মাথা খুঁড়িয়াছে—দেবতার নিকট মানত করিয়াছে। দুর্গাও কয়দিন প্ৰাণপণে তাহার সাহায্য করিয়াছে। জগন ডাক্তারের তো কথাই নাই; যতীন, সতীশ, গদাই, পাতু দুই। বেলা আসিয়া তত্ত্ব লইয়া গিয়াছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় নাই। দেবু পাথরের মত অশ্রুহীন নেত্রে নীরব নির্বাক হইয়া সব দেখিল-বুক পাতিয়া নিদারুণ আঘাত গ্রহণ করিল।
বিলুর সৎকার যখন শেষ হইল তখন সূর্যোদয় হইতেছে। দেবু ঘরে প্রবেশ করিলনিঃস্ব, রিক্ত, তিক্ত জীবন লইয়া। সুখ-দুঃখের অনুভূতি মরিয়া গিয়াছে, হাসি ফুরাইয়াছে, অশ্রু শুকাইয়াছে, কথা হারাইয়াছে; মন অসাড়, দৃষ্টি শূন্য; ঠোঁট হইতে বুক পর্যন্ত নীরস শুষ্ক–সাহারার মত সব খাখা করিতেছে। দেওয়ালে ঠেস দিয়া সে উদাস শূন্য দৃষ্টিতে সম্মুখের দিকে। চাহিয়া রহিল। সব আছে—সেই পথ, সেই ঘাট, সেই বাড়িঘর, সেই গাছপালা, কিন্তু দেবুর দৃষ্টির সম্মুখে সব অর্থহীন, সব অস্তিত্বশূন্য ঝাপসা, এক রিক্ত অসীম তৃষাতুর ধূসর প্রান্তর আর বেদনাবিধুর পাণ্ডুর আকাশ। ওই বিবর্ণ ধূসরতার মধ্যে ভবিষ্যৎ বিলুপ্ত নিশ্চিহ্ন।
সমস্ত গ্রামের লোকই ভিড় করিয়া আসিয়াছিল তাহাদের অকৃত্রিম সহানুভূতি জানাইতে। কিন্তু দেবুর এই মূর্তির সম্মুখে তাহারা কে কিছু বলতে পারিল না। যতীনও তাহাকে সান্ত্বনা দিতে আসিয়া নিৰ্বাক হইয়া বসিয়া ছিল। আত্মগ্লানিতে সে কষ্ট পাইতেছে—তাহার মনে হইতেছে দেবুকে সে-ই বোধহয় এই পরিণামের মুখে ঠেলিয়া দিয়াছে। জগনও স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। শ্ৰীহরি, হরিশ, ভবেশও আসিয়াছিল। তাহারাও নীরব। দেবুর সম্মুখে কথা বলিতে শ্ৰীহরিরও যেন কেমন সঙ্কোচ হইল।
ভবেশ শুধু বলিল হরি-হরি-হরি।
নির্বাক জনমণ্ডলীর প্রান্তদেশে দাঁড়াইয়া কে ডাকিল–ডাক্তারবাবু!
বিরক্ত হইয়া জগন বলিল—কে? কি?
–আজ্ঞে, আমি গোপেশ। একবার আসেন দয়া করে।
–কেন, হল কি?
দেবু একদিকের ঠোঁট বাঁকাইয়া বিষণ্ণ হাসিয়া বলিল—আর কি? বুঝতে পাচ্ছ না? যাও দেখে এস।
জগন দ্বিরুক্তি করিল না, উঠিয়া গেল। যতীন বলিল—দাঁড়ান, আমিও যাচ্ছি।
একে একে জনমণ্ডলী নীরবে উঠিয়া চলিয়া গেল, দেবু একা ঘরে বসিয়া রহিল। এইবার তাহার ইচ্ছা হইল সে একবার বুক ফাটাইয়া কাঁদিবে। চেষ্টাও করিল, কিন্তু কান্না তাহার আসিল না। তারপর সে শুইবার চেষ্টা করিল। এতক্ষণে চারিদিক চাহিয়া চোখে পড়িল চারিদিকে শত সহস্ৰ স্মৃতি দেওয়ালে খোকার হাতের কালির দাগ, বিলুর হাতের সিঁদুরের চিহ্ন, পানের পিচ, খোকার রং-চটা কাঠের ঘোড়া, ভাঙা বাঁশি, ড়ো ছবি। পাশ ফিরিয়া শুইতে গিয়া শয্যাতলে যেন কিসের চাপে সে একটু বেদনা বোধ করিল। হাত দিয়া সেটা বাহির করিলখোকার বালা! সেই বালা দুই গাছি, বিলুর নাকছাবি, কানের ফুল, হাতের নোয়া। একটা পার-ফাটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া সে অকস্মাৎ ডাকিয়া উঠিল—খোকা! বিলু!
ঠিক এই সময়ে বাড়ির ভিতরের দিকের দরজার মুখে কে মুখ বাড়াইয়া বলিল, দেবু!
–কে? দেবু উঠিয়া আসিল–রাঙাদিদি?
বুড়ি হাউহাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। তাহার সঙ্গে আরও কেউ।
একা রাঙাদিদি নয়, দুৰ্গাও একপাশে বসিয়া নীরবে কাঁদিতেছিল।
দেবুর ইচ্ছা ছিল, গভীর রাত্রে—সকলে ঘুমাইলে—বিশ্বপ্রকৃতি নিস্তব্ধ হইলে সে একবার প্ৰাণ ভরিয়া কাঁদিবে।
একা নয়। সন্ধ্যা হইতে বহুজনেই আসিয়াছিল, সকলে চলিয়া গিয়াছে। তাহার নিকট শুইতে আসিয়াছে কেবল—জগন ডাক্তার, হরেন ঘোষাল ও গাঁজাখোর গদাই, উচ্চিংড়ের বাবা তারিণী। শ্ৰীহরি ভূপাল চৌকিদারকেও পাঠাইয়াছে। সে রাত্রিতে দেবুর দাওয়ায় শুইয়া থাকিবে।
সকলে ঘুমাইয়া পড়িলে দেবু উঠিল। উঠানে আসিয়া ঊর্ধ্বমুখে আকাশের দিকে চাহিয়া সে দাঁড়াইয়া রহিল। খোকা নাই—বিলু নাই—বিশ্বসংসারে কোথাও নাই। স্বৰ্গ মিথ্যা, নরক মিথ্যা, পাপ মিথ্যা, পুণ্য মিথ্যা। কোন্ পাপ সে করিয়াছিল? পূর্বজন্মের? কে জানে? একবার যতীনের কাছে গেলে হয় না? একা বসিয়া সে খোকা ও বিলুকে চিন্তা করিবার অবসর খুঁজিয়াছিল, কিন্তু তাহাও যেন ভাল লাগিতেছে না। আত্মগ্লানিতেই তাহার অন্তর পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। সেই তো মৃত্যুর বিষ বহন করিয়া আনিয়াছিল। সে-ই তো তাহাদের হত্যা করিয়াছে। কোন্ লজ্জায় সে কাঁদিবে? সে বাহির হইয়া দাওয়ায় আসিয়া দাঁড়াইল। দূরে রাস্তায় একটা আলো আসিতেছে।
এত রাত্রে আলো হাতে কে আসিতেছে? এক জন নয়, জনকয়েক লোকই আসিতেছে।
কাহার কণ্ঠধ্বনি বাজিয়া উঠিল।–-পণ্ডিত!
দেবুর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন ন্যায়রত্ব; তাহার সঙ্গে যতীন, পিছনে লণ্ঠন হাতে আর একটি লোক।
—আপনি? কিন্তু আমাকে তো—
–চল, বাড়ির ভেতর চল।
–আমাকে তো প্রণাম করতে নাই—আমার অশৌচ।
সস্নেহে তাহার মাথায় হাত দিয়া ন্যায়রত্ন বলিলেন—অশৌচ! তিনি মৃদু হাসিলেন। একটা কিছু আন পণ্ডিত, এইখানে এই উঠোনেই বসা যাক। ঘরের ভেতর থেকে ঘুমন্ত লোকের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে যেন। থাক, যারা ঘুমোচ্ছে ঘুমোক। তোমার সঙ্গে নিরালায় একটু আলাপ করব বলে এত রাত্রে আমার আসা। লোকজনের ভিড়ের মধ্যে আসতে ইচ্ছা হল। না, পথে যতীন ভায়া সঙ্গ নিলেন। এঁদের দৃষ্টি জাগ্রত তপস্বীর মত। ফাঁকি দিতে পারলাম না। দেখলাম আকাশের দিকে চেয়ে উনিও বসে আছেন তোমার মত। আমাকে বললেন—তোমার এই নিষ্ঠুর বিপর্যয়ের জন্য উনিই দায়ী। ওঁর চোখে জল ছলছল করে উঠল। তাই ওঁকে সঙ্গে নিয়ে এলাম। আমাদের সুখ-দুঃখের কথায় উনিও অংশীদার হবেন।
ন্যায়রত্ন হাসিলেন। এ হাসি সুখের নয়—দুঃখেরও নয়—এক বিচিত্র দিব্য হাসি।
দেবুও হাসিল। ন্যায়রত্বের হাসির প্রতিবিম্বটিই যেন ফুটিয়া উঠিল। ঘর হইতে একটি মোড়া আনিয়া পাতিয়া দিয়া সে বলিল—বসুন।
ন্যায়রত্ন বসিয়া বলিলেন—বস, আমার কাছে বস। বস যতীন ভায়া, বস।
তাহারা মাটির উপরেই বসিয়া পড়িল। দেবু বলিল—এই সেদিন পরমশ্রদ্ধায় বিলু আপনার পা ধুইয়ে দিয়েছিল কিন্তু আজ আজ সে কোথায়!
ন্যায়রত্ন তাহার মাথার উপর হাত রাখিয়া বলিলেনদেবু-ভাই, আমি সেইদিনই বুঝে গিয়েছিলাম এই পরিণামের দিকেই তুমি এগিয়ে চলেছ। তোমাকে দেখেই বুঝেছিলাম,
তোমার স্ত্রীকে দেখেও বুঝেছিলাম।
দেবু ও যতীন উভয়ে বিস্মিত হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
ন্যায়রত্ন যতীনের দিকে চাহিয়া বলিলেন—সেদিনের গল্পটা মনে আছে বাবা! সবটা সেদিন বলি নি। বলি শোন। গল্প এখন ভাল লাগবে তো?
দেবু সাগ্রহে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল–বলুন।
ন্যায়রত্ন আরম্ভ করিলেন—সেই ব্ৰাহ্মণ ধনবলে আবার আপন সৌভাগ্যে প্রতিষ্ঠিত হলেন। পুত্ৰ-কন্যা-জামাতায়, পৌত্র-পৌত্রী-দৌহিত্র-দৌহিত্রীতে সংসার হয়ে উঠল—দেববৃক্ষের সঙ্গে তুলনীয়। ফলে অমৃতের স্বাদ ফুলে অগুরু-চন্দনকে লজ্জা দেয় এমন গন্ধ। কোনো ফল অকালে ঘৃত হয় না, কোনো ফুল অকালে শুষ্ক হয় না।
পরিপূর্ণ সংসার তার, আনন্দে শান্তিতে সুখে স্নিগ্ধ সমুজ্জ্বল। ছেলেরাও প্রত্যেকে বড় বড় পণ্ডিত, জামাতারাও তাই। প্রত্যেকেই দেশান্তরে স্বকর্মে প্রতিষ্ঠিত। কেউ কোনো রাজার কুলপণ্ডিত, কেউ সভাপণ্ডিত, কেউ বড় টোলের অধ্যাপক। ব্রাহ্মণ আপন গ্রামেই থাকেন আপন কর্ম করেন।
একদিন তিনি হাঁটে গিয়ে এক মেছুনীর ডালার দিকে চেয়ে চমকে উঠলেন। মেছুনীর ডালায় একটি কালো রঙের সুডৌল পাথর, গায়ে কতকগুলি চিহ্ন। তিনি চিনলেন, নারায়ণ-শিলা শালগ্ৰাম। মেছুনীর এই অপবিত্র ডালায় আমিষ গন্ধের মধ্যে পূত নারায়ণ-শিলা! তিনি চমকে উঠলেন এবং তৎক্ষণাৎ সেই মেছুনীকে বললেন মা, ওটি তুমি কোথায় পেলে?
মেছুনী একগাল হেসে প্রণাম করে বলল-বাবা, ওটি নদীর ঘাটে কুড়িয়ে পেয়েছি, ঠিক একপো ওজন; বাটখারা করেছি ওটিকে। ভারি পয় আমার বাটখারাটির। যেদিন থেকে এটি পেয়েছি—সেদিন থেকে আমার বাড়বাড়ন্তর আর সীমা নেই।
সত্য কথা। মেছুনীর এক-গা সোনার গহনা।
ব্রাহ্মণ বললেন–দেখ মা, এটি হল শালগ্রাম-শিলা। ঐ আমিষের মধ্যে এঁকে রেখে দিয়েছ–ওতে তোমার মহা-অপরাধ হবে।
মেছুনী হেসেই সারা।
ব্রাহ্মণ বললেন–ওটি তুমি আমাকে দাও। আমি তোমায় কিছু টাকা দিচ্ছি। পাঁচ টাকা দিচ্ছি তোমাকে।
মেছুনী বললে–না বাবা। এটি আমি বেচব না।
—বেশ, দশ টাকা নাও!
–না, বাবা-ঠাকুর। ও আমাকে অনেক দশ টাকা পাইয়ে দেবে।
–বেশ, কুড়ি টাকা।
–না বাবা। তোমাকে জোড়হাত করছি।
–আচ্ছা, পঞ্চাশ টাকা!
–হবে না।
–একসো!
–না গো, না।
–এক হাজার!
মেছুনী এবার ব্রাহ্মণের মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। কোনো উত্তর দিল না; দিতে পারল না।
–পাঁচ হাজার টাকা দিচ্ছি তোমায়!
এবার মেছুনী আর লোভ সংবরণ করতে পারল না। ব্রাহ্মণ তাকে পাঁচটি হাজার টাকা গুনে দিয়ে নারায়ণকে এনে গৃহে প্রতিষ্ঠা করলেন। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, প্রথম দিনেই ব্ৰাহ্মণ স্বপ্ন দেখলেন—একটি জ্যোতির্ময় দুরন্ত কিশোর তার মাথার শিয়রে দাঁড়িয়ে তাকে বলছে—আমাকে কেন তুমি মেছুনীর ডালা থেকে নিয়ে এলে? আমি সেখানে বেশ ছিলাম। যাও, এখুনি ফিরিয়ে দিয়ে এস আমাকে।
ব্ৰাহ্মণ বিস্মিত হলেন।
দ্বিতীয় দিনেও আবার সেই স্বপ্ন। তৃতীয় দিনের দিনে স্বপ্নে দেখলেন কিশোরের ভীষণ উগ্ৰমূর্তি। বললেন—ফিরিয়ে দিয়ে এস, নইলে কিন্তু তোমার সর্বনাশ হবে।
সকালে উঠে সেদিন তিনি গৃহিণীকে সব বললেন। এতদিন স্বপ্নের কথাটা প্রকাশ করেন নি, বলেন নি। আজ আর না বলে পারলেন না।
গৃহিণী উত্তর দিলেন-তাই বলে নারায়ণকে পরিত্যাগ করবে নাকি? যা হয় হবে। ও চিন্তা তুমি কোরো না।
রাত্রে আবার সেই স্বপ্ন, আবার–আবার। তখন তিনি পুত্ৰ-জামাতাদের এই স্বপ্ন-বিবরণ লিখে জানতে চাইলেন তাদের মতামত। মতামত এল, সকলেরই এক জবাব-গৃহিণী যা বলেছিলেন তাই।
সেদিন রাত্রে স্বপ্নে তিনি নিজে উত্তর দিলেন, ঠাকুর, কেন তুমি রোজ এসে আমার নিদ্রার ব্যাঘাত কর, বল তো? কাজে-কর্মে-বাক্যে-চিন্তায় আমার জবাব কি তুমি আজও পাও নি? আমিষের ডালায় তোমাকে আমি রেখে দিতে পারব না।
পরের দিন ব্রাহ্মণ পূজা শেষ করে উঠে নাতি-নাতনীদের ডাকলেন প্রসাদ নেবার জন্যে। সকলের যেটি ছোট, সেটি ছুটে আসছিল সকলের পিছনে। সে অকস্মাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। ব্ৰাহ্মণ তাড়াতাড়ি তাকে তুললেন কিন্তু তখন শিশুর দেহে আর প্রাণ নাই। মেয়েরা ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল। ব্রাহ্মণ স্তম্ভিত হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
রাত্রে স্বপ্নে দেখলেন—সেই কিশোর নিষ্ঠুর হাসি হেসে বলছে—এখনও বুঝে দেখ। জান। তো, সর্বনাশের হেতু যার, আগে মরে নাতি তার।
ব্রাহ্মণ নীরবে হাসলেন।
তারপর অকস্মাৎ সংসারে আরম্ভ হয়ে গেল মহামারী। একটির পর একটি—একে একে নিভিল দেউটি। আর রোজ রাত্রে একই স্বপ্ন। রোজই ব্ৰাহ্মণ নীরবে হাসেন।
একে একে সংসারে সব শেষ হয়ে গেল। অবশিষ্ট রইলেন ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণী।
আবার স্বপ্ন দেখলেন—এখনও বুঝে দেখ ব্ৰাহ্মণী থাকতে!
ব্রাহ্মণ বললেন—তুমি বড়ই প্ৰগলভ হে ছোকরা, তুমি বড়ই বিরক্ত করছ আমাকে।
পরদিন ব্রাহ্মণীও গেলেন।
আশ্চর্য, সেদিন আর রাত্রে কোনো স্বপ্ন দেখলেন না!
অতঃপর ব্রাহ্মণ শ্রাদ্ধাদি শেষ করে, একটি ঝোলায় সেই শালগ্রাম শিলাটিকে রেখে ঝোলাটি গলায় ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। তীর্থ থেকে তীৰ্থান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে, নদ-নদী-জঙ্গল-পাহাড়-পর্বত অতিক্রম করে চললেন। পূজার সময় হলে একটি স্থান পরিষ্কার করে বসেনফুল তুলে পূজা করেন, ফল আহরণ করে ভোগ দেন প্ৰসাদ পান।
অবশেষে একদা তিনি মানসসরোবরে এসে উপস্থিত হলেন। স্নান করলেন—তারপর পূজায় বসলেন। চোখ বন্ধ করে ধ্যান করছেন এমন সময় অপূর্ব দিব্যগন্ধে স্থানটি পরিপূর্ণ হয়ে গেল, আকাশমণ্ডল পরিপূর্ণ করে বাজতে লাগল দেব-দুন্দুভি। কে যেন তার প্রাণের ভিতর ডেকে বলল—ব্রাহ্মণ, আমি এসেছি।
চোখ বন্ধ করেই ব্রাহ্মণ বললেন-কে তুমি?
—আমি নারায়ণ।
–তোমার রূপটা কেমন বল তো?
–কেন, চতুর্ভুজ। শঙ্খ চক্র–
–উঁহুঁ, যাও যাও, তুমি যাও।
–কেন?
–আমি তোমায় ডাকি নি।
–তবে কাকে ডাকছ?
–সে এক প্ৰগলভ কিশোর। প্রায়ই সে স্বপ্নে এসে আমাকে শাসাত, আমি তাকে চাই।
এবার সেই স্বপ্নের কিশোরের কণ্ঠস্বর তিনি শুনতে পেলেন, ব্রাহ্মণ, আমি এসেছি!
চোখ খুলে ব্রাহ্মণ এবার দেখলেন হ্যাঁ, সেই তো বটে।
হেসে কিশোর বললেন—এস আমার সঙ্গে।
ব্ৰাহ্মণ আপত্তি করলেন না, বললেন—চল। তোমার দৌড়টাই দেখি।
কিশোর দিব্যরথে চড়িয়ে তাঁকে এক অপূর্ব পুরীতে এনে বললেন—এই তোমার পুরী। তোমার জন্যে আমি নির্মাণ করে রেখেছি। পুরীর দ্বার খুলে গেল; সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল—সেই সকলের ছোট নাতিটিযে সর্বাগ্রে মারা গিয়েছিল। তার পিছনে পিছনে আর সব।
গল্প শেষ করিয়া ন্যায়রত্ন চুপ করিলেন।
দেবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মুখ তুলিয়া একটু হাসিল।
যতীন ভাবিতেছিল এই অদ্ভুত ব্রাহ্মণটির কথা।
ন্যায়রত্ন আবার বলিলেন—সেদিন তোমাকে দেখে—বিলুকে দেখে এই কথাই আমার মনে হয়েছিল। তারপর যখন শুনলাম-উপেন রুইদাসের মৃতদেহের সৎকার করতে গেছ তুমি তাদের সেবা করছ, তখন আর সন্দেহ রইল না। আমি প্রত্যক্ষ দেখতে পেলাম-মেছুনীর ডালার শালগ্ৰাম উদ্ধার করতে হাত বাড়িয়েছ তুমি। আত্মা নারায়ণ, কিন্তু ওই বায়েন-বাউরিদের পতিত অবস্থাকে মেছুনীর ডালার সঙ্গে তুলনা করি, তবে আধুনিক তোমরা রাগ কোরো না যেন।
এতক্ষণে দেবুর চোখ দিয়া কয়েক ফোঁটা জল ঝরিয়া পড়িল।
ন্যায়রত্ন চাদরের খুঁট দিয়া সস্নেহে সে জল মুছাইয়া দিলেন। দেবুর মাথায় হাত দিয়া বহুক্ষণ বসিয়া রহিলেন। তারপর বলিলেন—এখন উঠি ভাই। তোমার সান্ত্বনা তোমার নিজের কাছে, প্রাণের ভেতরেই তার উৎস রয়েছে। ভাগবত আমার ভাল লাগে। আমার শশী যেদিন মারা যায় সেদিন ভাগবত থেকেই সান্ত্বনা পেয়েছিলাম। তাই তোমাকে আজ বলতে এসেছিলাম। ভাগবতী লীলার একটি গল্প।
যতীনও ন্যায়রত্নের সঙ্গে উঠিল।
পথে যতীন বলিল—এই গল্পগুলি যদি এ যুগের উপযোগী করে দিয়ে যেতেন আপনি!
হাসিয়া ন্যায়রত্ন বলিলেন—অনুপযোগী কোন জায়গা মনে হল ভাই?
–রাগ করবেন না তো?
–না, না, না। সত্যের যুক্তির কাছে নতশির হতে বাধ্য আমি। রাগ করব! ন্যায়রত্ন শিশুর মত অকুণ্ঠায় হাসিয়া উঠিলেন।
–ওই আপনার মাছের চুবড়ি চতুৰ্ভুজ শঙ্খ চক্র ইত্যাদি।
–ভগবানের অনন্ত রূপ। যে রূপ খুশি তুমি বসিয়ে নিয়ো। তা ছাড়া ব্ৰাহ্মণ তো চতুর্ভুজ মূর্তি চোখেই দেখেন নি। তিনি দেখলেন—তাঁর স্বপ্নের মূৰ্তিকে সেই উগ্ৰ কিশোরকে।
যতীন বাড়ির দুয়ারে আসিয়া পড়িয়াছিল, রাত্রিও অনেক হইয়াছে। কথা বাড়াইবার আর অবকাশ রহিল না, ন্যায়রত্ন চলিয়া গেলেন।
বসিয়া থাকিতে থাকিতে যতীনের মনে অকস্মাৎ রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার কয়েকটি ছত্র গুঞ্জন করিয়া উঠিল।
ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে
দয়াহীন সংসারে,
তারা বলে গেল ক্ষমা করো সবে বলে গেল ভালবাসা–
অন্তর হতে বিদ্বেষ বিষ নাশো।–
বরণীয় তারা স্মরণীয় তারা, তবুও বাহির-দ্বারে
আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে।…
নাঃ, ন্যায়রত্নের কথা সে মানিতে পারিল না।