বিপদ হইল পদ্মকে লইয়া
ইহার পর বিপদ হইল পদ্মকে লইয়া। তাহার মেজাজের অন্ত পাওয়া ভার। এই এখনই সে এক রকম, আবার মুহূর্ত পরেই সে আর এক রকমের মানুষ। উচ্চিংড়ে গোবরা পর্যন্ত প্রায় হতভম্ব হইয়া পড়িয়াছে। তবে তাহারা বাড়িতে বড় একটা থাকে না। বিশ তারিখ হইতে গাজনের ঢাক বাজিয়াছে, মাঠের চেঁচুড়ে দিঘি হইতে বুড়াশিব চণ্ডীমণ্ডপ জাকাইয়া বসিয়াছেন, তাহারা দুই জনে নন্দী-ভৃঙ্গীর মত অহরহ চণ্ডীমণ্ডপে হাজির আছে। গাজনের ভক্তের দল বাণ-গোসাই লইয়া গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা সাধিতে যায়—ছোঁড়া দুইটাও সঙ্গে সঙ্গে ফেরে।
গ্রামে গাজনে এবার প্রচুর সমারোহ। শ্ৰীহরি চণ্ডীমণ্ডপে দেউল ও নাটমন্দির তৈরির সঙ্কল্প মুলতুবি রাখিলেও হঠাৎ এই কাণ্ডের পর গাজনের আয়োজনে সে উঠিয়া-পড়িয়া লাগিয়াছে। লোকে ভক্ত হইতে চাহিতেছে না কেন তাহার কারণ সে বোঝে। দেবু ঘোষ, জগন ডাক্তার আর দুগ্ধপোষ্য একটা আগন্তুক বালক ষড়যন্ত্ৰ করিয়া তাহাকে অপমান করিবার জন্যই গাজন ব্যৰ্থ করিবার ব্যবস্থা করিয়াছে, তাহা শ্ৰীহরি বোঝে। তাই হঠাৎ সে এবার গাজনে কোমর বাঁধিয়া লাগিয়া গেল। ছোট ধরনের একটি মেলার আয়োজনও করিয়া ফেলিল। দুই দল ভাল বোলান গান—একদল ঝুমুর, একদল কবিগানের পাল্লার ব্যবস্থা করিয়া সে গ্যাট হইয়া বসিল। যাহারা বলিয়াছে চণ্ডীমণ্ডপ ছাইব না, তাহারাই যেন চব্বিশ ঘণ্টা আনন্দ আয়োজনের দ্বারপ্রান্তে পথের কুকুরের মত দাঁড়াইয়া থাকে তাহারই জন্য এত আয়োজন। ভাত ছড়াইলে কাক ও কুকুর আপনি আসিয়া জোটে। সেই যেদিন ধান দাদন করে, সেদিন গ্রামের লোক তাহার বাড়ির আশপাশে ঘুরিয়া ঘুরিয়া তাহার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করিয়াছে। ইহারই মধ্যে ভবেশ খুড়া বহুজনের দরবার লইয়া আসিয়াছে। কথাবার্তা চলিতেছে, তাহারা ঘাট মানিয়া ক্ষমাপ্রার্থনা করিতে প্রস্তুত; প্রজা-সমিতিও তাহারা ছাড়িয়া দিবে বলিয়া কথা দিয়াছে।
গড়গড়া টানিতে টানিতে শ্ৰীহরি আপন মনেই হাসিল। তবে ওই হরিজনের দলকে সে ক্ষমা করিবে না। কুকুর হইয়া উহারা ঠাকুরের মাথার উপর উঠিতে চায়!
কাল আবার অনিরুদ্ধের মামলার দিন। সদরে যাইতে হইবে। শ্ৰীহরি চঞ্চল হইয়া উঠিল। অনিরুদ্ধ জেলে গেলে পদ্ম একা থাকিবে। অন্নের অভাব হইবে বস্ত্রের অভাব হইবে। দীর্ঘতনু, আয়তনয়না, উদ্ধতা, মুখরা কামারনী। এবার সে কি করে দেখিতে হইবে। তারপর অনিরুদ্ধের চার বিঘা বাকুড়ি। কামারের গোটা জোটাই নিলামে উঠিয়াছে। হয়ত নিলাম এতদিন হইয়া গেল। যাক।
কালু শেখ আসিয়া সেলাম করিয়া বলিল—হজুরের মা ডাকিতেছে।
–মা? ও, আজ যে আবার নীলষষ্ঠী! শ্ৰীহরি উঠিয়া বাড়ির ভিতরে গেল।
চৈত্র-সংক্রান্তির পূর্বদিন নীল-ষষ্ঠী। তিথিতে ষষ্ঠী না হইলেও মেয়েদের যাদের নীলের মানত আছে, তাহারা ষষ্ঠীর উপবাস করিবে, পূজা করিবে, সন্তানের কপালে ফোঁটা দিবে। নীল অর্থাৎ নীলকণ্ঠ এই দিনে নাকি লীলাবতীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। লীলাবতীর কোল আলো করিয়া নীলমণির শোভা। নীলষষ্ঠী করিলে নীলমণির মত সন্তান হয়।
পদ্ম সকল ষষ্ঠীই পালন করে; সে-ও উপবাস করিয়া আছে। কিন্তু বিপদ হইয়াছে উচ্চিংড়ে ও গোবরাকে লইয়া। আজ সকালবেলা হইতেই তাহাদের দেখা নাই। চড়ক-পাটা বাহির হইয়াছে। ঢাক বাজাইয়া ভক্তরা গ্রামে গ্রামে ফিরিতেছে। একটা লোহার কাটায় কণ্টকিত তক্তার উপর একজন ভক্ত শুইয়া থাকিবে। সে কি সোজা কথা! সেই বিস্ময়কর ব্যাপারের পিছনে পিছনে তাহারা ফিরিতেছে। আগে এখানে বাণ ফেঁড়া হইত, এখন আর হয় না।
পদ্ম অপেক্ষা করিয়া অবশেষে নিজেই চণ্ডীমণ্ডপের প্রান্তে আসিয়া পাঁড়াইল। চণ্ডীমণ্ডপে ঢাক বাজিতেছে। বোধ হয় এ বেলার মত চড়ক ফিরিয়া আসিল।
চণ্ডীমণ্ডপ ঘিরিয়া মেলা বসিয়াছে। খানবিশেক দোকান। তেলেভাজা মিষ্টির দোকানই বেশি। বেগুনি, ফুলুরী, পাপড়-ভাজা হইতেছে। ছেলেরা দলে দলে আসিয়া কিনিয়া খাইতেছে। খানচারেক মনিহারি দোকান। সেখানে তরুণী মেয়েদেরই ভিড় বেশি-ফিতা, টিপ, আলতা, গন্ধ কিনিতেছে। গাছতলায় ছোট আসর পাতিয়া বসিয়াছে তিনজন চুড়িওয়ালী। একটা গাছতলায় বৈরাগীদের নেলোও বসিয়াছে কতকগুলা মাটির পুতুল লইয়া। ওমা, বুড়ো পুতুলগুলো তো বেশ গড়িয়াছে! উঁকা হাতে তামাক খাইতেছে—আবার ঘাড় নাড়িতেছে! বয়স্কেরা ঘুরিয়া বেড়াইতেছে—অলস পদক্ষেপে। আজ কাল দুই দিন কোনো চাষের কাজ নাই। হাল চষিতে নাই, গরু জুতিতে নাই। এই দুই দিন সর্বকর্মের বিশ্রাম।
উচ্চিংড়ে ও গোবরার সন্ধান মিলিল না। তাহা হইলে চড়ক হইতে এখনও ফেরে নাই! ও ঢাক শ্ৰীহরি ঘোষের ষষ্ঠী-পূজার ঢাক। পদ্ম বোধহয় জানে না—ঘোষ এবার দশখানা ঢাকের বন্দোবস্ত করিয়াছে।
পাতু নিজের গ্রাম ছাড়িয়া অন্য গ্রামে বাজাইতে গিয়াছে। সর্বত্রই এক অবস্থা। বাদ্যকরের চাকরান জমি প্রায় সর্বত্রই উচ্ছেদ হইয়া গিয়াছে। এ গ্রামের ঢাকী ও গ্রামে যায়, সে গ্রামের ঢাকী আসিয়াছে এ গ্রামে। সতীশ বাউরিও তাহার বোলানের দল লইয়া অন্য গ্রামে গিয়াছে।
অগত্যা পদ্ম বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া মাটিতে আঁচল বিছাইয়া শুইয়া পড়িল। পরের সন্তান। লইয়া এ কি বিড়ম্বনা তাহার! কিছুক্ষণ পর আবার সে বাহির হইল। এবার শুষ্ক মুখ, ধূলিধূসরদেহ ছেলে দুইটাকে দেখিতে পাইয়া তাহাদিগকে ধরিয়া যতীনের সম্মুখে আনিয়া বলিল—এই দেখ, একবার ছেলে দুটোর দশা দেখ! তুমি শাসন কর!
যতীন কিছু বলিল না, মৃদু হাসিল।
পদ্ম বলিল—হেসো না তুমি। আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে যায় তোমার হাসি দেখলে। ভেতরে এস একবার, ফোঁটা দেব।
ফোঁটা দিয়া পদ্ম বলিল হাসি নয়, উচ্চিংড়েকে তুমি বল, এমনি করে বাইরে বাইরে ফিরলে তুমি ওকে রাখবেই না এখানে, জবাব দেবে। খেতে দেবে না। গোবরাটা ভাল—ওকে নিয়ে যায় উচ্চিংড়েই। কাল ওরা যেন না বেরোয় ঘর থেকে।
যতীন এবার মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য টানিয়া আনিয়া বলিলতথাস্তু মা-মণি। তারপর সে উচ্চিংড়েকে কড়া রকমের ও গোবরাকে মৃদু রকমের শাসন করিয়া দিল। অর্থাৎ দুই জনকেই দুই রকমের কান মলিয়া দিল।
কিন্তু তাহাই কি হয়?
উচ্চিংড়ে আর গোবরা হোম-সংক্রান্তি, অর্থাৎ গাজনের দিন কি ঘরে থাকিবে? সেই ভোররাত্রেই ঢাক বাজিবার সঙ্গে সঙ্গেই উচ্চিংড়ে গোবরাকে লইয়া বাহির হইল, আর বাড়িমুখো হইল না,পাছে পদ্ম তাহাদের আটক করে।
আজ বুড়োশিবের পূজা। পূজা হইবে, বলিদান হইবে, হোম হইবে। আজ ভক্ত শুইয়া থাকিবে সমস্ত দিন। লোহার কাঁটাওয়ালা তক্তাখানা এমনভাবে বসানো আছে যে ঘুরাইলে বনবন করিয়া ঘোরে।
উচ্চিংড়ে গোবরাকে বলিল-আজ ভাই আমরা শিবের উপোস করব।
—উপোস? গোবরার ক্ষুধাটা কিছু বেশি।
–হ্যাঁ। বাবা বুড়োশিবের উপোস। সবাই করে, না করলে পাপ হয়। উপোস করলে মেলা টাকা হয়।
সবাই গাজনের উপবাস করে, এ কথাটা গোবরা অস্বীকার করিতে পারিল না। গাজনের উপবাস প্রায় সর্বজনীন। বাউরিবায়েন হইতে উচ্চতম বর্ণ ব্রাহ্মণ পর্যন্ত আজ প্রায় সকলেরই উপবাস। অনিরুদ্ধের মামলার তদ্বিরে দেবু উপবাস করিয়াই সদরে গিয়াছে। শ্ৰীহরিরও উপবাস। কিন্তু উপবাস করিলেই টাকা হয়—এ কথাটা গোবরা স্বীকার করিতে পারিল না। তাহা হইলে
পণ্ডিত গরিব কেন?
গোবরার অন্তরের একান্ত অনিচ্ছা উচ্চিংড়ে বুঝিল; বলিল—বেশি ক্ষিদে লাগে তো, হুই চৌধুরীদের বাগানে গিয়ে আম পেড়ে খাব! বেশ বড় বড় হয়েছে, বুঝলি? আম পাড়লে চৌধুরীরা কিছু বলবে না, আর ওতে পাপও হবে না।
এবার গোবরার তেমন আপত্তি রহিল না।
–শেষকালে না-হয় কারু বাড়িতে মেগে খাব দুটো।
উঁহুঁ মা-মণি তা হলে মারবে। বলবে—ভিখিরি কোথাকার, বেরো হতভাগারা।
—তবে চল, আমরা মহাগেরাম যাই। সেখানে এখানকার চেয়ে বেশি ধুম। আর সেখানে মেগে খেলে, মা-মণি কি করে জানবে! তাই চল।
গোবরা এ প্রস্তাবে উৎসাহিত হইয়া উঠিল।
গ্রামের প্রান্তে একটা জলশূন্য পুকুরের পাড়ে খোঁড়া পুরোহিতের তেঠেঙে ঘোড়াটা ঘাস খাইতেছিল। উচ্চিংড়ে দাঁড়াইল। বলিল—এই, ঘোড়াটা ধর দিকি!
চাট ছুড়বে।
—তোর মাথা। পেছনকার একটা ঠ্যাং খোঁড়া। চাঁট ছুড়তে গেলে নিজেই ধপাস করে পড়ে যাবে। ধ। ওইটার উপর চেপে দুজনা চলে যাব। তোর কাপড়টা খোল, নাগাম করব।
সত্যই ঘোড়াটা চাঁট ছুড়িতে পারে না; কিন্তু কামড়ায়, খেঁকি কুকুরের মত দাঁত বাহির করিয়া মাথা উঁচাইয়া কামড়াইতে আসে। এটা উচ্চিংড়ে জানি না। সম্ভবত এটা ঘোড়াটার আত্মরক্ষার আধুনিকতম অস্ত্র আবিষ্কার। অশ্বারোহণের সঙ্কল্প ত্যাগ করিতে হইল।
সন্ধ্যায় গাজনের পূজা শেষ। চড়ক শেষ হইয়াছে। ভক্তদের আগুন লইয়া ফুল-খেলাও হইয়া গিয়াছে। বলি হোমও হইয়া গিয়াছে। কপালে তিলক পরিয়া ভবেশ ও হরিশ চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়া আছে। শ্ৰীহরি এখনও সদর হইতে ফেরে নাই। ঢাকীর দল প্রচণ্ড উৎসাহে ঢাকের বাজনার কেরামতি দেখাইতেছে। বড় বড় ঢাক, ঢাকের মাথায় দেড়হাত লম্বা পালকের ফুল। এ ঢাকের আওয়াজ প্রচণ্ড, ভদ্রলোকেরা বলে, ঢাকের বাদ্য থামিলেই মিষ্টি লাগে। কিন্তু ঢাকের গুরুগম্ভীর আওয়াজ নিপুণ বাদ্যকরের হাতে রাগিণীর উপযুক্ত বোলে যখন বাজে, তখন আকাশ বাতাস পরিপূর্ণ হইয়া যায়—গুরুগম্ভীর ধ্বনির আঘাতে মানুষের বুকের ভিতরেও গুরুগম্ভীর ঝঙ্কার উঠে। নাচিয়া নাচিয়া নানা ভঙ্গি করিয়া মুখে বোল আওড়াইয়া এক একজন ঢাকী পর্যায়ক্রমে ঢাক বাজাইতেছে, তাহাদের নাচের সঙ্গে নাচিতেছে-কাকের পাখার কালো পালকের তৈয়ারি ফুল; একেবারে মাথার কাছে বকের সাদা পালকের গুচ্ছ।
হরিশ আক্ষেপ করিতেছিল—এবার চৌধুরী আসতে পারলেন না, ঠাঁইটি একেবারে খা খ করছে।
চৌধুরী প্রতি বৎসর উপস্থিত থাকে। ঢাকের বাজনার সে একজন সমঝদার শ্রোতা। বসিয়া বসিয়া তালে তালে ঘাড় নাড়ে। পাশে থাকে একটি পোটলা। বাজনার শেষে চৌধুরী পোটলা খুলিয়া পুরস্কার দেয়-কাহাকেও পুরনো জামা, কাহাকেও পুরনো চাদর, কাহাকেও বা পুরনো কাপড়। এবার চৌধুরী শয্যাশায়ী হইয়া আছে। সেই মাথায় আঘাত পাইয়া বিছানায় শুইয়াছে, আর ওঠে নাই। ঘা শুকাইতেছে না, সঙ্গে সঙ্গে অল্প অল্প জ্বরও হইতেছে।
চণ্ডীমণ্ডপের চারিপাশে মেলার মধ্যে পথে ভিড় এখন প্রচুর। মেয়ে, ছেলে, স্ত্রী, পুরুষ দলে দলে ঘুরিতেছে। সন্ধ্যার পর কবিগান হইবে। কলরবের অন্ত নাই। অকস্মাৎ সেই কলরব ছাপাইয়া কালু শেখের গলা শোনা গেলহঠ হঠ, হঠ সব!
ভিড় ঠেলিয়া পথ করিয়া কালু শেখ বাহির হইয়া আসিল—তাহার পিছনে শ্ৰীহরি। ঘোষ ফিরিয়াছে। ভবেশ ও হরিশ অগ্রসর হইয়া গেল।
শ্ৰীহরি ফোকলাদাঁতে একগাল হাসিয়া বলিল—সুখবর! দুই মাস সশ্রম কারাদণ্ড।
পথের ভিড় ঠেলিয়া দেবু ঘোষও যাইতেছিল। বিমর্ষমুখে সে গেল যতীনের ওখানে।
যতীন, দেবু, জগন ও হরেন—আজ সান্ধ্য মজলিসে লোক কেবল চার জন। সকলেই চুপ করিয়া বসিয়া আছে। আজিকার সমস্যা-পদ্মকে এ সংবাদটা কে দিবে, কেমন করিয়া দিবে?
ভিতরের দরজায় শিকল নড়িয়া উঠিল। পদ্ম ডাকিতেছে। যতীন উঠিয়া গেল। অনিরুদ্ধের দণ্ডের কথা শুনিয়া যতীন খুব বিষ হয় নাই। দুই মাস জেল যতীনের মতে লঘুদণ্ডই হইয়াছে। যে মন লইয়া অনিরুদ্ধ দেবুকে মিথ্যা দণ্ড হইতে বাঁচাইতে গিয়া সত্য স্বীকারোক্তি করিয়াছে, সে মন যদি তাহার টিকে—তবে সে নূতন মানুষ হইয়া ফিরিবে। আর যদি সে মন বুদ্বুদের মত ক্ষণস্থায়ীই হয়—তবুও বা দুঃখ কিসের! দারিদ্র-ব্যাধিতে জীর্ণ মনুষ্যত্বের মৃত্যু তো ধ্রুবই ছিল। কিন্তু বিপদ হইয়াছে পদ্মকে লইয়া। কি মায়ায় যে এই অশিক্ষিতা আবেগ-সর্ব পল্লীবধুটি তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়াছে তাহা সে বুঝিতে পারে না। বুদ্ধি দিয়া বিশ্লেষণ করিয়াও সে তাহাকে উপেক্ষা করিতে পারে না। বৃহত্তর জীবন, মহত্তর স্বার্থের মানদণ্ডে ওজন করিয়াও সে কিছুতেই তাহার মূল্যকে অকিঞ্চিৎকর করিয়া তুলিতে পারে না। মাটির মূর্তির মধ্যে সে দেবীরূপ কল্পনা করিতে পারে না। জলে বিসর্জন দিলে সে মূর্তি গলিয়া কাদা হইয়া যায়, জলতলে সে রূপ পঙ্কসমাধি লাভ করে, এ সত্য মনে করিয়া সে হাসে। কিন্তু ঐ ভঙ্গুর মাটির মূর্তি অক্ষয় দেবীরূপ লাভ করিল কেমন করিয়া? কালের নদী-জলে তাহাকে বিসর্জন দিলেও যে সে গলিবে না বলিয়া মনে হইতেছে। শিক্ষা নাই সংস্কৃতি নাই, অভিমান ও কুসংস্কার সর্বস্ব পদ্ম মাটির মূর্তি ছাড়া আর কি? সে এমন সজীব দেবীমূর্তি হইয়া উঠিল কি করিয়া? কোন্ মন্ত্রে?
ইতিমধ্যে কাঁদিয়া কাঁদিয়া পদ্মের চোখ দুইটা ফুলিয়া উঠিয়াছে। চোখের জল মুছিতে মুছিতে ম্লান হাসিয়া সে বলিল-দু মাস জেল হয়েছে?
যতীন আশ্চর্য হইয়া গেল। ইহার মধ্যে কথাটা তাহাকে কে বলিল? মাথা নিচু করিয়া সে বলিল–হ্যাঁ।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল পদ্ম, বলিলতা হোক। ভালয় ভালয় ফিরে আসুক সে। কিন্তু পণ্ডিতকে যে তার পাপের দণ্ডভোগ করতে হয় নাই, সে যে সত্যি কথা বলেছে—সেই আমার ভাগ্যি। তা না হলে তার অনন্ত নরক হত, সাত পুরুষ নরকস্থ হত।
যতীন অবাক হইয়া গেল।
পদ্ম বলিল জল গরম হয়েছে, চা তুমি করে নাও। আমি একবার দেখি সেই মুখপোড়া ছেলে দুটোকে। এখনও ফেরে নাই। সারাদিন খায় নাই।
—তুমিও তো খাও নি মা-মণি? খেয়ে নাও। যতীনের মনে পড়িল—কাল পদ্মের নীলষষ্ঠীর উপবাস গিয়াছে। আজ আবার সে সারাদিন গাজনের উপবাস করিয়াছে।
—খাব। সে দুটোকে আগে ধরে আনি।
যতীন আর কিছু বলিবার পূর্বেই পদ্ম বাহির হইয়া গেল।
শ্ৰীহরির খিড়কির ঘাটে শ্রীহরির মা উচ্চকণ্ঠে সবিস্তারে অনিরুদ্ধের শাস্তির কথা। দম্ভ-সহকারে ঘোষণা করিতেছে। এ সে বহুক্ষণ পূর্বেই আরম্ভ করিয়াছে, এখনও শেষ হয় নাই। পুত্ৰগৰ্বিতা বৃদ্ধা শুধু অপেক্ষা করিতেছে—অদূরে উচ্চকণ্ঠের একটি সবিলাপ রোদন-ধ্বনির।
কথাবার্তা কহিবার অবসর আজ খুব কমই হইতেছিল।
চা খাওয়া শেষ করিয়া যতীন বলিল চৌধুরী কেমন আছেন ডাক্তারবাবু?
দেবু চমকাইয়া উঠিল, অনিরুদ্ধের হাঙ্গামায় আজ দুদিন চৌধুরীর সংবাদ লওয়াই হয় নাই!
জগন বলিল—একটু ভাল আছেন। তবে এই একটুকু ঘা আর কিছুতেই সারছে না। ঘায়ের মুখ থেকে অল্প অল্প পুঁজ পড়ছে, আর প্রায়ই সামান্য সামান্য জ্বর হচ্ছে।
যতীন বলিল—যাব একদিন দেখতে।
দেবু বলিল-কালই চলুন না সকালে। আমি যাব।
—আমাকে ডেকো দেবু। তোমাদেরই সঙ্গে যাব। আমাকে তো যেতেই হবে, একসঙ্গেই যাব। হরেন যাবে নাকি?
–টুমরো তো হবে না ব্রাদার! পয়লা বোশেখ খাতা ফেরার হাঙ্গামা আছে। আমাকে ছুটতে হবে আলেপুর, ইছু শেখের কাছে—গোটাচারেক টাকা আনতে হবে। নইলে বেটা বৃন্দাবনকে তো জানঃ একটি পয়সা আর ধার দেবে না।
পয়লা বৈশাখ হালখাতা। কথাটা যেন ঝনাৎ করিয়া পড়িল। কথাটা দেবুরও মনে হইল। ধার সে বড় করে না। তবে এবার তাহার অনুপস্থিতিতে দুর্গার মারফত জংশনের একটা দোকানে বাকি পড়িয়াছে এগার টাকা দশ আনা। অনিরুদ্ধের হাঙ্গামায় কথাটা তাহার মনেই হয় নাই। দুৰ্গাও কোনো তাগাদা দেয় নাই। টাকাটা বা কোথা হইতে আসিবে? আসিয়া অবধি নিজের ভাবনা যে ভাবাই হয় নাই। কিন্তু না ভাবিলে ভবিষ্যৎ কি হইবে?
সে যদি হঠাৎ মারা যায়, তবে কি বিলু এই পদ্মের মত—কিংবা অবশেষে তারিণীর স্ত্রীর মতভাবিতেই সে শিহরিয়া উঠিল। বার বার সে নিজেকে ধিক্কার দিয়া উঠিল—ছি, ছি, ছি!
তবুও চিন্তা গেল না। বিলুর বদলে মনে হইল খোকার কথা।
তাহার খোকাও কি ওই উচ্চিংড়ের মত না-না—না। সে মনে মনেই বলিল—কিছুতেই না। কাল নববর্ষের প্রথম দিন হইতে সে নিজের ভাবনা ভাবিবে, আর নয়—আর নয়। স্ত্রী-পুত্র লইয়া—দারিদ্য লইয়া দশের ভাবনা ভাবিবার অধিকার তাহার নাই, সে অধিকার ভগবান তাহাকে দেন নাই। সে ভার—সে অধিকার শ্ৰীহরির। গোটা গাজনের খরচটা সে-ই দিয়াছে। গোটা দেশের লোককে ধান দাদন সে-ই দিয়াছে; সে ভার তাহার।
সে অত্যন্ত আকস্মিকভাবে উঠিয়া পড়িল।
জগন জিজ্ঞাসা করিলকি ব্যাপার হে? হঠাৎ উঠলে?
–একটা জরুরি কাজ ভুলেছি।
সে চলিয়া আসিল। পথে চণ্ডীমণ্ডপে উঠিয়া শিবকে প্রণাম করিল—হে দেবাদিদেব মহাদেব, ভালয়-ভালয় এ বৎসর পার করে দিলে। আশীর্বাদ কর–আগামী বৎসরটি যেন ভালয়-ভালয় যায়।
খোঁড়া পুরোহিত তাহাকে আশীর্বাদী নিৰ্মাল্য দিল।
পথে নামিয়া সে বাড়ি গেল না। সে গেল দুর্গার বাড়ি। দুর্গাই দোকান হইতে ধার আনিয়া দিয়াছিল। তাহারই মারফতে একটা টাকা কাল সে পাঠাইয়া দিবে এবং মাসখানেক সময় চাহিয়া লইবে। সময় একটু বেশি লওয়াই ভাল। বৈশাখের প্রথমেই সে তিসি, মসিনা, গম, যবযে কয়টা ঘরে আছে বিক্রি করিয়া দিবে। সর্বাগ্রে সে ঋণ পরিশোধ করিবে।
বাড়িতে দুর্গার মা বসিয়া ছিল; একা অন্ধকারে দাওয়ার উপর বসিয়া কাহাকে গালি দিতেছিল রাক্ষস, প্যাটে আগুন নাগুক আগুন নাগুক আগুন নাক! মরুক, মরুক, মরুক। আর হারামজাদী, নচ্ছারী, বানের আগে কুটো, সব্বাগ্যে তোর যাওয়ার কি দরকার শুনি?
দেবু জিজ্ঞাসা করিল-ও পিসেস, দুর্গা কই?
বিলু দুর্গার মাকে বাপের বাড়ির গ্রামবাসিনী হিসাবে পিসি বলে, তাই দেবু বলে পিসেস। অর্থাৎ পিস-শাশুড়ি।
দুর্গার মা মাথায় একটু ঘোমটা টানিয়া দিল। জামাইয়ের সামনে মাথায় কাপড় না থাকিলে, এবং জামাই মাথার চুল দেখিলে, চিতায় নাকি মাথার চুল পোড়ে না। ঘোমটা দিয়া দুর্গার মা বলিল—সে নচ্ছারীর কথা আর বোলো না বাবা! বানের আগে কুটো! রূপেন বায়েনের কি না। কি ব্যামো হয়েছে, তাই সৰ্বাগ্যে গিয়েছেন তিনি।
রূপেন অর্থাৎ উপেন। আত্মীয়স্বজনহীন বৃদ্ধ উপেন, আহা-হা বেচারি! কেউ নাই সংসারে। কিন্তু সে তো এখানে থাকে না। সে তো কঙ্কণায় ভিক্ষা করিত।
দেবু প্রশ্ন করিল—উপেন আজকাল গায়ে ফিরেছে নাকি?
—মরতে ফিরেছে বাবা। গায়ে আগুন নাগাতে ফিরেছে। কাল থেকে গায়ে গাজনের মেলা দেখতে এসেছে। আজ সকালে ফুলুরীর দোকানদার কতকগুলো তে-বাসী ফুলুরী ফেলে দিয়েছিল—সেনেটারি বাবু আসবে শুনে। রূপেন তাই কুড়িয়ে গবাগব খেয়েছে। খেয়ে সনঝে থেকে নামুনে হয়েছে। আমাদের দুগ্গা বিবি তাই শুনে দেখতে ছুটেছেন। আহা-হ্যাঁ, দরদ কত! কি বলব বাবা বল?
নামুনে অর্থাৎ কলেরা। সর্বনাশ! সম্মুখে এই বৈশাখ মাসকোথাও এক ফোঁটা পানীয় জল নাই, এই সময় কলেরা!
সে দ্রুতপদে আসিয়া উঠিল উপেনের বাড়ি। এক মুহূর্তে তাহার সব ভুল হইয়া গেল।
উঠানে মাটির উপর পড়িয়া জরাজীর্ণ বৃদ্ধ ছটফট করিতেছিল, জ-ল-জ-ল-জ-ল! স্বর অনুনাসিক হইয়া উঠিয়াছে। অন্য কেহ নাই, কেবল দুর্গা দাঁড়াইয়া আছে, সে যথাসাধ্য সংস্পর্শ বাঁচাইয়া একটা ভাঁড়ে করিয়া তাহাকে জল ঢালিয়া দিয়াছে। বৃদ্ধ কিন্তু আপনার জল খাইবার ভড়ের নিকট হইতে অনেকটা দূরে আসিয়া নিস্তেজ হইয়া পড়িয়াছে। কম্পিত বাহু বিস্তার করিয়া বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তীব্ৰ ব্যগ্রতায় সে চিৎকার করিতেছে–জল—একটু জল।
দেবু অগ্রসর হইল, ভঁড়টি লইয়া উপেনের মুখের কাছে বসিয়া একটু একটু করিয়া জল ঢালিয়া দিতে আরম্ভ করিল। দুর্গাকে বলিল-দুর্গা, শিগগির গিয়ে একবার জগনকে খবর দে। বলবি আমি বসে রয়েছি।
যতীনের কথাও একবার মনে হইল। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবিল—বিদেশী ভদ্রলোক। তাহাকে এসব বিপজ্জনক ব্যাপারে টানিয়া আনা উচিত হইবে না। এ তাহাদের গ্রাম, এখানকার সকল দুঃখ-কষ্ট একান্ত করিয়া তাহাদের। অতিথি-আগন্তুককে দিতে হয় সুখের ভাগ। দুঃখের ভাগ কি বলিয়া কোন মুখে সে তাহাকে লইতে আহ্বান করিবে।