উকিল বিষাণ দত্তের পসার
উকিল বিষাণ দত্তের তেমন কোনও পসার নেই। কালেভদ্রে দু-একজন মক্কেল আসে। কিন্তু আজকাল তাঁর চেম্বারে এত ভিড় যে, ছুঁচ ফেলার জায়গা নেই।
বিস্তর মানুষ সঙ্গে একজন করে দাড়িগোঁফওয়ালা তোক ধরে এনেছে। কারও সাদা লম্বা দাড়ি, কারও ছাঁটা দাড়ি, কারও চাপ দাড়ি, কারও ছুঁচলো দাড়ি, কারও বা ফ্রেঞ্চকাট।
ফটিক দাস তার উলটোদিকে বসা হরেন বৈরাগীকে বলছিল, “বলি হরেন, শেষ অবধি নিজের খুড়োকেই কি জাদুকর গজানন বলে উকিলবাবুকে গছাতে নিয়ে এলে! না হয় তোমার খুডোর একটু মাথার দোষই আছে, তা বলে এরকম পুকুরচুরি করা কি ভাল?”
হরেন বৈরাগী একটু খিঁচিয়ে উঠে বলল, “তুমিই বা কম যাচ্ছ কিসে ফটিকদা? তোমার পাশে উটি কে তা বুঝি জানি না? ও হল ময়নার হাটের চুড়িওলা নন্দকিশোর। কি বলল হে নন্দভায়া, ঠিক বলেছি?”
ফটিক একটু থতমত খেয়ে বলে, “আহা, অত চেঁচানোর কী আছে? এ নন্দকিশোর হতে যাবে কেন? চেহারার একটু মিল থাকতেই পারে। তা বলে”।
সাতকড়ি গায়েন ভজহরি মুৎসুদ্দিকে দেখে আঁতকে উঠে বলে, “ভজহরিদাদা যে! তোমার সঙ্গে উটি কে বলো তো! চেনা-চেনা ঠেকছে!”
“আরে না না, চেনা-চেনা ঠেকবে কী? এ হল জাদুকর গজানন, অনেক মেহনত করে ধরতে হয়েছে রে ভাই।”
“কিন্তু এ তো খালপাড়ার বটকৃষ্ণ বলে মনে হচ্ছে যেন!”
নগেন হালদার তার সঙ্গে আসা দাড়িওয়ালা লোকটাকে নিচু স্বরে বোঝাচ্ছিল, “ওরে বাপু, ঘাবড়ানোর কী আছে বলো তো! যদি গজানন বলে পাশ হয়ে যাও তা হলে তো পাঁচ লাখের এক লাখ তোমাকে দেবই।”
“কিন্তু মশাই, ওরা যদি আমাকে নিয়ে গিয়ে ফাঁসিতে ঝোলায়?”
“দুর বোকা, ওসব নয়। মনে হচ্ছে মেঘনাদবাবু কোনও গুরুতর কাজের ভার দেবেন বলেই গজাননকে খুঁজছেন। আর ধরো, যদি তোমার ভালমন্দ কিছু হয়েই যায়, তা হলে তোমার বউকে গুনে গুনে এক লাখ দিয়ে আসব কথা দিচ্ছি।”
“না বাবু, বড্ড ভয়-ভয় করছে। পেটের দায়ে এলুম বটে। কিন্তু শেষ অবধি”
রাম খাজাঞ্চি হঠাৎ একজনকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, “আরে কে ও? শ্যামাপদ নাকি হে? সঙ্গে কে বলো তো! আরে এ তো হরিপুরের সেই কাপালিকটা!”
শ্যামাপদ গম্ভীরভাবে বলল, “তুমি চোখের চিকিৎসা করাও হে রাম! আমার কাছে কেউ কখনও ভেজালের কারবার পায়নি। ন্যায্য জিনিস বরাবর ন্যায্য দামে বিক্রি করে এসেছি। এর বাপ-পিতেমোর দেওয়া নাম গজানন কি না একেই জিজ্ঞেস করে দ্যাখ।”
বীরু মণ্ডল একটু নিচু গলায় হরিপদ ঘোষকে বলল, “এঃ হে। হরিপদদা, লোকটার গালে যে নকল দাড়ি সেঁটেছ তা আঠাটা ভাল করে লাগাবে তো! বাঁ দিকের জুলপির নীচে আলগা হয়ে আছে যে।”
হরিপদ শশব্যস্তে সঙ্গী লোকটার দাড়িটা চেপে বসাতে লাগল। বিড়বিড় করে বলল, “মানুষটা মেকআপের কিছুই জানে না দেখছি, সাতটা টাকা জলে ফেললুম।”
সত্যচরণের সঙ্গে একজন দাড়িওলার একটু তর্কাতর্কি হচ্ছে। দাড়িওলা বলছিল, “মশাই, গজাইয়ের দোকানের গরম রসগোল্লা খাওয়ানোর কড়ার করিয়ে নিয়ে এলেন, তা কোথায় কী? এতক্ষণ বসিয়ে রাখছেন, লোকের খিদেতেষ্টা পায় না নাকি?”
সত্যচরণ বলছিল, “ওরে বাপু, হবে, হবে। কাজটা ভালয়-ভালয় উতরে দাও, রসগোল্লা যত চাই পাবে। ফট করে আবার নিজের পৈতৃক নামটা বলে ফেলো না। হুশিয়ার থেকো।”
“কিন্তু রসগোল্লা কি গরম থাকবে? ঠাণ্ডা মেরে যাবে যে! না মশাই, এ কাজ আমার পোযাচ্ছে না।”
উকিলবাবুর মুহুরি এসে এক-একজনকে ভেতরে উকিলবাবুর ঘরে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে।
নবকৃষ্ণের ডাক পড়তেই সে হাসিমুখে উঠে দাঁড়াল, সঙ্গের লোকটাকে নড়া ধরে টেনে তুলে বলল, “চলো হে, ডাক পড়েছে। এঃ, ঘুমে যে একেবারে কাদা হয়ে ছিলে বাপু! কোঁচার খুঁটে মুখের নালঝোল একটু মুছে নাও।”
উকিলবাবুর ঘরে বিষাণ উকিল গম্ভীর মুখে বসে আছে। নবকৃষ্ণ ঢুকেই হাসি-হাসি মুখে বলল, “ওঃ কী পরিশ্রমটাই না গেছে উকিলবাবু, আর বলবেন না। হরিপুর থেকে সেজো শালা খবর পাঠাল যে, দাড়িগোঁফওলা গজাননকে কালীতলার হাটে দেখা গেছে। অমনি ছুট-ছুট, কালীতলার হাট কি এখানে! তারপর সেখানে গিয়ে খবর পেলুম, গজানন পালিয়ে নয়নপুরের তেঁতুলতলায় গয়েশ ষড়ঙ্গীর বাড়িতে ঢুকেছে। তা সেখানে গিয়ে–”
বিষাণ দত্ত খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নবকৃষ্ণের সঙ্গে আসা লোকটাকে দেখছিল। হঠাৎ বলল, “কপালের বাঁ ধারে আঠাটা কোথায় গেল?”
“অ্যাঁ!”
“তা ছাড়া, গজাননের নাকের ডগায় তিল আছে।”
নবকৃষ্ণ চটে উঠে বলল, “তা সেটা আগে বলবেন তো। ঝুটমুট হয়রানি হল মশাই। গজানন চেয়েছিলেন, ধরে এনেছি। এখন আব চাইছেন, তিল চাইছেন, এর পর হয়তো টাক চাইবেন, টিকি চাইবেন। এত আশা থাকলে কাজ হয়?”
বিষাণ দত্ত একটু মৃদু হেসে বলে, “ওরে বাপু, যার জিনিস সে তো পছন্দ করে নেবে! যাকে-তাকে নিলেই তো হবে না। পাঁচ-পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে কি ভেজাল জিনিস নেবে নাকি?”
নবকৃষ্ণ গজগজ করতে করতে বিদেয় হল, এল রাধাগোবিন্দ হাইত, সঙ্গে একজন কোলকুঁজো তেকেলে বুড়ো, বিশাল পাকা দাড়ি। রাধাগোবিন্দ কপালের ঘাম হাতের কানা দিয়ে মুছে একটা শাস ছেড়ে বলল, “ওঃ, গজানন তো নয়, যেন পাঁকাল মাছ। যতবার ধরি, পিছলে যায় মশাই। শেষে কি করলুম জানেন, মাছ ধরার জাল দিয়ে সাতপুরার বাজারের কাছে বাছাধনকে ধরে ফেললুম। দেখেশুনে নিন, একেবারে পাক্কা গজানন।”
বিষাণ দত্ত মাথা নেড়ে বলল, “ওঁকে চিনি হে, উনি হলেন ক্ষেমঙ্করী দাসী মেমোরিয়াল বিদ্যালয়ের রিটায়ার্ড পণ্ডিতমশাই। কানেও শোনেন না, চোখেও ভাল দেখেন না, ভুজুং-ভাজুং দিয়ে আনলে নাকি?”
রাধাগোবিন্দ জিভ কেটে বলে, “আজ্ঞে না, অতবড় ভুল হওয়ার নয় আমার। দেখেশুনেই এনেছি।”
“ভুল একটু হয়েছে বাপু, ইনি গজানন তর্কতীর্থ। বুড়ো মানুষটাকে আর কষ্ট দিও না। জায়গামতো রেখে এসো।”
একের পর এক গজানন বাতিল হয়ে ফিরে যেতে লাগল। নিতাই সাহা তো বলেই গেল, “আমার গজাননকে যদি আপনার পছন্দ না হয় তা হলে ধরতে হবে খাঁটি গজানন আপনি ভূভারতে পাবেন না।”
একেবারে শেষে মুহুরি যাদের ধরে নিয়ে এল তারা হল গন্ধর্ব আর শাসন ভট্টাচার্য।
বিষাণ দত্ত বলল, “গন্ধর্ব যে! তা তোমার সঙ্গেও একজন গজানন দেখছি নাকি? তা এঁর তো দেখছি দাড়িগোঁফ নেই!”
গন্ধর্ব বলল, “না, ইনি গজানন নন। এঁর নাম শাসন ভট্টাচার্য। আমরা একটু জরুরি কথা জানতে এসেছি।”
“বোসো বোসো, রোজ দশটা-বিশটা গজানন সামলাতে সামলাতে আমি কাহিল হয়ে পড়েছি। আমার এখন গজানন ফোবিয়া হয়েছে।”
গন্ধর্ব আর শাসন বসল। গন্ধর্ব বলল, “গজাননকে নিয়ে যে চারদিকে একটা সাড়া পড়ে গেছে তা আমরাও টের পাচ্ছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না গজাননকে কার এত দরকার।”
বিষাণ দত্ত গম্ভীর হয়ে বলল, “আমার এক মক্কেলের।”
শাসন ভট্টাচার্য বলল, “মহাশয়, আমরা মেঘনাদবাবু সম্পর্কে কিছু জানিতে চাই। ইনি কে এবং কী উদ্দেশ্যে জাদুকর গজাননকে খুঁজিতেছেন তাহা জানিতে পারিলে বিশেষ সুবিধা হয়।”
বিষাণ দত্ত জ্ব তুলে বলে, “ও বাবা, আপনি যে সাধুভাষায় কথা কন দেখছি!”
“আজ্ঞা হাঁ মহাশয়, ইহাই আমাদের বংশের রীতি।”
“রীতি! এ-আবার কীরকম রীতি মশাই?”
শাসন বিনীতভাবে বলে, “আমাদের বংশে দেবভাষায় বাক্যালাপেরই প্রথা ছিল। আমার প্রপিতামহ পর্যন্ত এই ভাষাতেই কথা কহিতেন। আমার পিতামহ ছিলেন আইনজীবী। তিনি দেখিলেন সংস্কৃতে কথা কহিলে মক্কেল বুঝিতে পারে না, বিচারপতি আপত্তি করেন, সাক্ষীগণ এক প্রশ্নের অন্য উত্তর দেয়। অগত্যা জীবিকার প্রয়োজনে তিনি দেবভাষার পরিবর্তে সাধুভাষায় বাক্যালাপ করিতে শুরু করেন। তদবধি আমরা এই ভাষাই ব্যবহার করিয়া আসিতেছি।”
“আপনার দাদু তা হলে উকিল ছিলেন? কী নাম বলুন তো!”
“আজ্ঞা, ব্রজমাধব ভট্টাচার্য।”
“হ্যাঁ, খুব নাম ছিল তাঁর। প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি। তা কী জানতে চান বলুন।”
“মহাশয়, আমরা মেঘনাদবাবু সম্পর্কে জানিতে আগ্রহী।”
বিষাণ দত্ত বলল, “মেঘনাদবাবু সম্পর্কে যে আমিও ভাল জানি তা নয়। মাসখানেক আগে এক দুর্যোগের রাতে ভ ভদ্রলোক এসে হাজির। ওই প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টিতে কারও ঘরের বাইরে বেরনোর কথাই নয়, তাই আমি লোকটিকে দেখে খুব অবাক হই। তাঁর গায়ে বেশ দামি পোশাক ছিল। জরির কাজ করা একটা জামা, ধাক্কা পাড়ের ধুতি, সবই অবশ্য ভিজে সপসপ করছিল। মাথায় বাবরি চুল, বিশাল পাকানো গোঁফ আর গালপাট্টায় যাত্রাদলের রাজা বলে মনে হচ্ছিল।”
“মহাশয়, মেঘনাদবাবুর আকৃতিটি কীরূপ ছিল?”
“সে কথাই বলছি। বিরাট লম্বা-চওড়া চেহারা। দেখে মনে হয় ব্যায়ামবীর বা কুস্তিগির কিছু একটা হবেন। চোখদুটোও বেশ ভয়ঙ্কর। তাকালে বুকটা গুড়গুড় করে।”
“মহাশয়, মেঘনাদবাবু কি একা ছিলেন?”
“হ্যাঁ। তবে মশাই, এসব কিন্তু গুহ্য কথা। মেঘনাদবাবু তার কথা কর্তাকে বলতে নিষেধ করে গেছেন। নিতান্তই গন্ধর্বকে ছেলেবেলা থেকে চিনি আর আপনি ব্রজমাধব ভট্টাচার্যের নাতি বলেই বলছি। পাঁচকান করবেন না কিন্তু।”
“না মহাশয়, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। অগ্রে কহুন।”
“লোকটিকে দেখে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। মেঘ ডাকলে যেমন শব্দ হয়, ওঁর গলাটাও তেমনই সাঙ্ঘাতিক। নিজের পরিচয় দিলেন, ওঁর নাম মেঘনাদ রায়। কাছে ধর্মনগরে ওঁর বাড়ি। ব্যবসাবাণিজ্য আছে। এও বললেন, “বিশেষ জরুরি দরকারেই উনি এসেছেন। উনি একজনের সন্ধান চান। সন্ধান পেলে সন্ধানদাতাকে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার দেবেন। তখন আমি বললাম, নিরুদ্দেশ ব্যক্তির সন্ধান পেতে হলে পুলিশের কাছে যাওয়াই ভাল। উনি মাথা নেড়ে বললেন, “না, পুলিশকে তিনি জড়াতে চান না। তিনি চান গোটা মহল্লায় গজাননের সন্ধান করা হোক। তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন তিনি লোকটার সন্ধান চাইছেন। উনি শুধু বললেন, “গজানন ওঁর খুব ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয় এবং বিশেষ প্রিয়পাত্র। কিন্তু সম্প্রতি উনি স্মৃতিভ্রংশ হয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। গজাননের সন্ধান না-পাওয়া পর্যন্ত উনি শান্তিতে থাকতে পারছেন না। সেইজন্য উনি আমার সাহায্য চান। আমি বললাম, এটা তো উঁকিলের কাজ নয়। উনি তখন আমাকে মোটা টাকা ফি দিলেন। বললেন, “আমাকে উনি বুদ্ধিমান লোক বলে মনে করেন। তা ছাড়া পোস্টার দিলে বা ঢ্যাঁড়া পেটালে পুলিশ হয়তো এ-নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে, আমি উকিল বলে সেটা সামলাতে পারব।”
“মহাশয়, গজাননের সন্ধান পাইলে উনি যে প্রতিশ্রুত পাঁচ লক্ষ টাকা দিবেন তাহার নিশ্চয়তা কী?”
বিষাণ দত্ত একটু দোনোমনো করে বললেন, “আপনারা চেনা লোক বলেই বলছি। উনি পাঁচ লাখ টাকা আমার কাছেই গচ্ছিত রেখে গেছেন। আমি অবশ্য আপত্তি করেছিলাম। গাঁ-গঞ্জ জায়গা, চুরি-ডাকাতি হতে কতক্ষণ? উনি কথাটা গায়ে মাখলেন না। বললেন, “চুরি-ডাকাতি যাতে না হয় তার দিকে তিনি লক্ষ রাখবেন এবং তা সত্ত্বেও যদি চুরি-ডাকাতি হয় তবে তিনি আমাকে দায়ী করবেন না। এ-টাকার রসিদও তিনি নেননি।”
“মহাশয়, আপনি আইনজীবী, স্বভাবতই সন্দিহান স্বভাবের। আপনার লোকটিকে সন্দেহ হইল না?”
“হ্যাঁ, তা হয়েছে। ধর্মনগরে লোক পাঠিয়ে খোঁজ-খবরও নিয়েছি। তবে তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। সে যাকগে, পারিশ্রমিক পেয়ে কাজ করছি, আমার আর বেশি জেনে কী হবে?”
“জাদুকর গজাননকে পাইলে মেঘনাদবাবুকে কীরূপে খবর দিবেন তাহা ভাবিয়াছেন কি?”
“না, ভাবিনি। তিনি বলে গেছেন গজানন ধরা পড়লে তিনি লোকমুখে ঠিকই খবর পেয়ে যাবেন।”
“মহাশয়, উনি জাদুকর গজাননের কীরূপ বিবরণ দিয়াছেন?”
“শুধু বিবরণ নয়, উনি একটি ছবিও আমাকে দিয়ে গেছেন। এই যে।”
বলে ড্রয়ার থেকে তুলট কাগজে আঁকা একটা বেশ পুরনো ফ্রেমে বাঁধানো ছবি বের করে শাসনের হাতে দিল বিষাণ। হেসে বলল, “কপালের বাঁ ধারে একটা আব আছে, নাকে তিল। কিন্তু মাথায় ঝাঁকড়া চুল আর দাড়ি-গোঁফ থাকায় মুখশ্রী বোঝা দুষ্কর। গজানন যদি দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে ফেলে থাকে, তা হলেই চিত্তির।”
শাসন আর গন্ধর্ব মিলে ছবিটা ভাল করে দেখল। ভুষো কালি জাতীয় কিছু দিয়ে আঁকা ছবি। কাগজটায় নানারকম দাগ লেগেছে। ফলে ছবিটা খুব স্পষ্ট বোঝা যায় না। কিন্তু গজাননের দু’খানা চোখ যেন মোহময় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
ছবিটা ফিরিয়ে দিয়ে গন্ধর্ব বলল, “জাদুকর গজাননকে মাঝে-মাঝে যে দেখা যাচ্ছে সেকথা জানেন কি বিষাণদা?”
“খুব জানি। সে নাকি ভেসে-ভেসে বেড়ায়। যতসব গাঁজাখুরি গপ্পো। কিন্তু টাকার লোভে কত লোক যে সাজানো গজানন নিয়ে আসছে তার হিসেব নেই। আজ তো শুনলুম কে যেন তার নিজের খুড়োকে গজানন সাজিয়ে নিয়ে এসেছিল।”
“হাঁ মহাশয়, একটা গণ্ডগোল পাকাইয়া উঠিতেছে।”
“কিন্তু আপনারা এব্যাপারে ইন্টারেস্টেড কেন তা জানতে পারি?”
শাসন একটু চিন্তা করে বলল, “কিংবদন্তির পিছনে ধাবন করা আর মরীচিৎকার পিছনে ছুটিয়া যাওয়া একই ব্যাপার। তবে মহাশয়, কিংবদন্তি বলিতেছে প্রায় দুই শত বৎসর বয়ঃক্রমের গজানন আজিও জীবিত। গন্ধর্ববাবু তাহা বিশ্বাস করেন না। আমি বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কিছুই করি না। সম্ভবত বিষয়টি লইয়া মস্তক ঘর্মাক্ত করিতে হইত না। কিন্তু চিন্তার উদ্রেক হইতেছে মেঘনাদবাবুর আবির্ভাবে। ইনি কোথা হইতে কী উদ্দেশ্যে আসিয়া আবির্ভূত হইলেন এবং কী কারণে পঞ্চ লক্ষ মুদ্রায় গজাননকে ধরিতে চাহিতেছেন তাহাই রহস্য। জাদুকর গজানন তাঁহার প্রিয়পাত্র, এই কথাটি বিশ্বাসযোগ্য নহে।”
বিষাণ দত্ত বলল, “কেন বিশ্বাসযোগ্য নয় বলুন তো!”
শাসন বলল, “তাহা বলিতে পারি না। মহাশয় কি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে বিশ্বাস করেন?”
“কথাটা শুনেছি। টের তো পাই না।”
“মনে হয় ওইরূপ কোনও ইন্দ্রিয়ই আমাকে ইহা বিশ্বাস করিতে নিষেধ করিতেছে। কথাটা হয়তো বিজ্ঞানসম্মত হইল না। কিন্তু আমি নাচার। একটি কথা জিজ্ঞাসা করিব কি?”
“করুন।”
“মেঘনাদবাবু আপনাকে বিশ্বাস করিয়া পঞ্চ লক্ষ মুদ্রা বিনা রসিদে দিয়া গেলেন, ইহা কিন্তু অদ্ভুত। ইচ্ছা করিলে আপনি এই টাকার কথা তো অস্বীকার করিতে পারেন।”
“হ্যাঁ, সেটাও অদ্ভুত বইকি! পাঁচ লক্ষ টাকা তো সোজা নয়!”
“মহাশয়, আমার মনে হয়, মেঘনাদবাবু ভাল করিয়াই জানেন যে, ওই টাকা আত্মসাৎ করা আপনার পক্ষে সম্ভব নহে। কারণ মেঘনাদবাবু উহা আপনার নিকট হইতে পুনরুদ্ধার করিবার মতো ক্ষমতা রাখেন।”
“তার মানে?”
“তিনি আপনাকে হয়তো প্রচ্ছন্ন হুমকি দেন নাই, কিন্তু তার নিজের বাহুবলের উপর প্রগাঢ় আস্থা আছে।”
বিষাণ দত্ত একটু নড়েচড়ে বসে বলল, “লোকটা কি ষণ্ডাগুণ্ডা নাকি?”
মাথা নেড়ে শাসন বলে, “তাহা বলিতে পারি না। তবে মহাশয় বোধ করি কোনও সাধারণ শৌখিন মানুষের সঙ্গে লেনদেনটি করিতেছেন না। মেঘনাদবাবু প্রয়োজনে তাহার টাকা আদায় করিয়া লইবার ক্ষমতা রাখেন।”
“চিন্তায় ফেললেন মশাই!”
“চিন্তা এক অতীব প্রয়োজনীয় জিনিস। মহাশয়, ব্যাপার আবার পূর্বাপর ভাবিয়া দেখুন এবং সতর্কতা অবলম্বন করুন।”
বেরিয়ে এসে নির্জন, অন্ধকার রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে গন্ধর্ব জিজ্ঞেস করল, “কী বুঝলেন শাসনবাবু?”
শাসন মৃদুস্বরে বলল, “কিছুই বুঝি নাই মহাশয়, কেবল কয়েকটি অসংলগ্ন অনুমান করিতেছি মাত্র।”
“আমি তো কিছু অনুমানও করতে পারছি না।”
“পরিস্থিতি তদ্রুপই বটে! একটার সহিত অন্যটা মিলিতেছে না, যুক্তি হার মানিতেছে।”
“তাই বটে!” ঠিক এ-সময়ে পেছন থেকে হঠাৎ কী একটা ভারী জিনিস বিদ্যুদ্বেগে ছুটে এসে শাসনের মাথা ঘেঁষে সামনে ঠঙাত করে পড়ল।
“বাপ রে!” বলে গন্ধর্ব মাথা চেপে বসে পড়ল।
শাসন ঘুরে দাঁড়াল। অন্ধকার রাস্তায় খুব অস্পষ্ট একটা ছায়ামূর্তি দ্রুত কোনও গাছের আড়ালে সরে গেল বলে মনে হল তার।
“মহাশয়, আলোটি প্রজ্বলিত করুন।”
গন্ধর্ব উঠে দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বেলে পেছনটা দেখল। ফাঁকা রাস্তা।
“কী ব্যাপার বলুন তো!” হতভম্ব গন্ধর্বের প্রশ্ন।
“মহাশয়, আমরা আক্রান্ত।”
“কিন্তু কেন?”
“বাতিটি ধরুন।” বলে নিচু হয়ে শাসন যেটা কুড়িয়ে নিল তা সাধারণ ইট-পাটকেল নয়, একটা মাঝারি আকারের লোহার ভারী বল।
“দেখিতেছেন মহাশয়, এই লৌহগোলকটি আমার মস্তকে লাগিলে করোটি চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া যাইত।”
“অল্পের জন্য বেঁচে গেছি।”
“হাঁ মহাশয়। খুবই অল্পের জন্য।”
“চলুন তো, দেখি বেয়াদবটা কে?” শাসন ম্লান হেসে বলল, “বেয়াদবটি আমাদিগের জন্য অপেক্ষা করিয়া নাই। তবু চলুন।”
পিছিয়ে গিয়ে তারা চারদিকে টর্চের আলো ফেলে দেখল। কাউকে দেখা গেল না।
“কে হতে পারে বলুন তো!”
শাসন উদাস গলায় বলল, “আবার অনুমানের উপর নির্ভর করিতে হইবে। বরং বিষয়টি লইয়া আরও একটু চিন্তা করা যাউক। চলুন মহাশয়, অগ্রসর হই।”
“কিন্তু আমায় যদি মারে?”
“আততায়ী পলাইয়াছে। পুনরাক্রমণের আশঙ্কা সম্ভবত নাই। তবে সতর্ক হইতে হইবে। মধ্যে মধ্যে পশ্চাতে দৃষ্টিক্ষেপ প্রয়োজন।”
“কী ছুঁড়ে মেরেছিল বলুন তো!”
“অনুমান করি ইহা পুরাতন আমলের অব্যবহৃত কামানের গোলা।”
“সর্বনাশ! ওটা পেল কোথায়?”
“আততায়ীদের নানা পন্থা আছে।”
গন্ধর্বের গা একটু ছমছম করছে। সে বলল, “আমার বাড়ি তো সামনে, কিন্তু আপনাকে তো দু’ মাইল হাঁটতে হবে। আজ রাতটা থেকে যান।”
“না মহাশয়, অদ্য আর কিছু হইবে না।”