পূৰ্ণিমা গেল
পূৰ্ণিমা গেল। প্রথমা, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থ। তখনও টান ভাটায় খুব জোর। সমুদ্র উজাড় করে মাছ আসছে। ডায়মণ্ড হারবার আর কোলাঘাটের মোহানায় বুঝি মাছ থাই পাচ্ছে না।
সরকারি ডোলের কথা মনে নেই। আর কারুর। বাঁধাছাঁদি ফেলে কেউ ঝগড়া বাঁধাতে চায় না। আর।
আকাশ এক-একবার শুকু-শুকু করে। আবার কালো করে নামে বৃষ্টি।
ফড়ে-পাইকেরদের ভিড় কমে না নদীর ধারে। আতরবালারও কোটাল দেখা যায়। সব সময়েই হাসে। বিলাসকে একটু বেশি চোখে চোখে রাখে। বলে, আমাদের ছোটমাসিটিরে একেবারে মেরেছ?
বলে খিলখিল করে হাসে। চুবড়িতে কিনে কিনে জড়ো করে মাছ। দুলাল আসে, নিয়ে যায়। পালমশাই আর ব্ৰজেন ঠাকুর সকলের মাছই আটকাবার চেষ্টা করে। কত আটকাবে। উপচে পড়ে যে।
হিমি আসে সন্ধ্যার জোয়ারে যখন সয়ারাম বাজারে যায়। মাছমারারা এখন ডাল খায়, একটু পিয়াজ কাঁচালঙ্কাও আসে। ডেঙো ডাটার সঙ্গে দু-চারটে গোল আলুর শখের খাওয়াও দেখা যায়। তাই সয়ারাম বাজারে যায়।
হিমি আসে।–ওগো ঢাপ।
–বলো।
–আর কতদিন?
—এই সময় হল বলে। গঙ্গা যে বড় দিচ্ছে কিনা। এই কালটুকু কাটুক।
—আমার যে বড় ভয় করে ঢাপ।
-কেন?
—সেই যে বলেছি, একলা থাকতে বড় ভয় লাগে। তুমি যে ভয় ধরিয়ে দিয়েছ।
—ভয় কি মহারানি?
—ভয় নয়? এত ভয় যে কোনওকালেই পাইনি গো। তুমি আর দেরি কোরো না।
দেরি করা বিলাসের হাতে নয়। গঙ্গা এত দিন সাড়া দেয়নি। দিল তো, ভরে দিল। না নিয়ে যায় কেমন করে মাছমারা।
তারপর অমাবস্যা এল। বিদায় নিতে লাগল। অনেক মাছমারা।
পালমশাইও বিদায় হল বিদায়-নেওয়া নৌকার সঙ্গে। কিন্তু গঙ্গার কাল তখনও শেষ হয়নি। মাছের পাইকারি দর একশো থেকে আশি, সত্তর, ষাট, পঞ্চাশে নেমে এল আস্তে আস্তে। যেমন করে জোয়ান কোটাল শেষ হয়। অমাবস্যার মরা কোটালে আবার একটু দাম চড়ল।
দর কমল বটে মাছের। মাছমারারা। তবু ক্ষান্ত হয় না সহজে। মাছ মাটিতে পুঁতে ফেলার দিন আসেনি। তাও হয়। অপৰ্য্যপ্ত মাছ, পচে যায়, পড়ে থাকে বাজারে, হাওয়া দূষিত হয়। সেরকমও হয়েছে অনেক বার।
নেমে পাঁচু এখন আর যেন বিলাস ছাড়া জানে না। খুবই প্ৰসন্ন। আদর করে ডাকে ওহে বাছাড়ি।
—কী বলছি কেদমে খুড়ো?
—এমন মাছ কিন্তুন বাবা কয়েক বছর হয়নি। তারপর ভদ্রের ভরা জলের দিকে একটি নিশ্বাস ফেলে বলে, শুধু দুজন দেখে যেতে পারলে না।
হ্যাঁ, দুজন। পাঁচু আর ঠাণ্ডারাম।
সন্ধ্যাবেলার নামো-নামো-অন্ধকার আকাশের দিকে চেয়ে কেঁদে ফেলল সয়ারাম। মুখ চেপে রইল হাঁটুতে।
বিলাস বলল, ও সয়া।
–উঁ?
-কাঁদিসনে রে।
—কেন বিলেস, কাঁদব না কেন?
—না, কাঁদিসনে। কেঁদে কী হবে?
–তোর মতন আমার পাণটা যে শক্ত নয়। বিলেস।
—শক্ত কর। কাঁদিসনে।
—আচ্ছা, কাঁদব না।
শুধু দু-চোখের জলে সব ঝাপসা হয়ে যায় সয়ারামের। দাদার জন্যে বড় শোক পেয়েছে সে।
বুঝি কেদমের গলায়ও কান্না পাকিয়ে পাকিয়ে ওঠে। বলে, দুটি পুরানো লোক গেল।
–তা গেল।
বলে বিলাস দূর দক্ষিণে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। তারপর হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে বলে, এটটা ছিল পাঁচকা।
–বলো।
—ভাবছি বলে টানের সময় আমি সমুদ্রে যাব।
কেদমে পাঁচু তার নৌকোয় এগিয়ে এসে বলে, তা বেশ তো বাবা, খুব ভাল কথা। তোমার ওপরে এখন সবাই সদয়। বার দুয়েক গেছ দক্ষিণে। তুমি ছেলে দড়ো, ঘাত-ঘোঁত বুয়েচ। মহাজন তোমার জুটবে। তুমি মহাজন ধরো, সাঁই নে চলো। আমাদেরও নে চলো।
বিলাস বলে, তাই যাব পাঁচকা। তুমি সবাইকে বলে। সংবাদ দেও গাঁয়ে সব মালো ঝালো নিকিরি চুনুরি মাছমারাদের। তোমাকে আমার সহায় চাই পাঁচকা।
—থাকব বইকী বিলেস, নিশ্চয় থাকব।
হিমি আর থাকতে পারে না। আবার শুক্লপক্ষ এসেছে। জলের ঘোলানি একটু কম দেখা যায়। আশ্বিন মাস পড়ো-পড়ে। এই মেঘ, এই রোদ। এই হাসি, এই কান্না। হিমির প্রাণের মতো। কী কুহক ঠাঁই নিয়েছে তার বুকে। এই ভয়, এই নিৰ্ভয়। এই মুখ ভার, এই আর হেসে বাঁচে না।
বুড়ি দামিনী দেখে আর অদৃশ্যে গালে হাত দেয়। এত পোড় খাওয়া মেয়ে। তবু কেমন ভাব লেগে গেছে। লাগে। এ পোড়া প্ৰাণ, বড় যে নিলাজ। পোড় যত খায়, তত যে গাঢ়-রক্তের ছোঁয়া লাগে।
হিমি এসে হাত ধরে নিয়ে যায়। এবার বিলাসকে।
বিলাস বলে, যাবার সময় ঘাইনে আসে মহারানি।
হিমি বলে, না। ভাদুরে পুন্নিমে। যদি কাটোচ্ছই, সাঁজার কাটিয়ে যাও ঢপ এখেনে। গঙ্গাপুজো হোক, তা পরে যাও।
বিলাস হিমির মুখটি তুলে ধরে। মুখখানি শুকু-শুকু দেখায়। চোখের দুটি তারা বড় চঞ্চল হয়েছে, কিন্তু পাতা দুটি বড় ভারী ভারী লাগে, কেবলই নেমে যায়।
বিলাস বলে, তাই যাব মহারানি।
-ঘরে আসবে কবে ঢপ?
—আর দুটি দিন।
অন্ধকারে উঁচুপাড়ের গাছের তলায় দাঁড়িয়ে কথা বলে দুজনে। সয়ারাম তিবড়ি জ্বালিয়ে, নৌকায় বসে দেখে। বিলাস আর হিমিকে দেখে তার মনে হয়, বাতাসে বড় সোহাগ উথলে উঠছে। ঘরে ফেরার জন্যে প্ৰাণটা হু হু করে ওঠে।
হিমি আবার বলে, ঢপ!
–বলো।
− সাঁজার যদি কাটাও, কাত্তিকে চাকুন্দে মাকুন্দে খয়রাও ছেকে নে যাও।
বিলাস হেসে বলে, গঙ্গার বারোমাসের মানুষ করতে চাও মহারানি?
–সে কপাল কি আমি করেছি?
—আমার যে মাছমারার কপাল। মহারানি, বাড়িতে মা-কাকির সঙ্গে দেখা করে, আমি সমুদ্রে যাব টানের সময়ে।
সমুদ্রে! হ্যাঁ, সমুদ্র সমুদ্র, সমুদ্র। ঘোর অন্ধকারে যেন মিশে একাকার হয়ে গেল বিলাস। নীলাম্বুধি অন্ধকারের মতো মহাসমুদ্র হয়ে গেল। সেই বুকে ভেসে পড়ে বলে হিমি, সমুদ্রের টান লেগেছে আমারও। আমি এখেনে থাকব কেমন করে?
—তুমি যাবে মহারানি? অকুলে ভাসবে আমার সঙ্গে?
—সেই যে আমার বড় সাধ। নইলে থাকব কোথায় গো?
মহাসাগরে হামাল ডাকে। মহাপ্লাবন ওঠে তার বুকে। বিলাস বলে, সেই আমার আশা, মহারানি। তোমাকে নে যাব আমি। তাপর সাঁই নে সমুদ্রে যাব। তার আগে মহাজন ধরব।
–মহাজন কেন?
—মহাজন চাই নে? পাঁচ হাজার ট্যাক চাই আমার। বারো গণ্ডা লৌকা নে আমি যাব, দুশো মাছমারা যাবে আমার সঙ্গে। সাইদার আমি, তাদের খাওয়া-পরা ভাল-মন্দ আমাকে দেখতে হবে।
হিমি যেন সমুদ্রে ড়ুব দেয়। আর ওঠে। বিলাসকে ছাড়ে না। বলে, ঢপ, সমুদ্রের মহাজন হতে মন করে আমার?
তা বটে, পাঁচু বুঝি শুনতে পায় না। এই কালো কুচকুচে পাহাড়ে বুক দেখলে, সমুদ্রের ফড়েনি হতে মন করবেই।
আর—একজনেরও করেছিল।
বিলাস দেখে, অন্ধকারে যেন হিমির মুখখানি সাদা ফুলের মতো ফুটে আছে। বলে, তা, তোমার কাছে আমার সব কিছু বন্দক রেখেই তো সাগরে যাব। তুমি আমার সবচেয়ে বড় মহাজন।
দামিনীর গলা শোনা যায়। হিমি…অ হিমি। ছুঁড়িকে নিয়ে আমার কী জ্বালা গো।
হিমি বিলাসের হাত ধরে টানে, এসো, ডাক পড়েছে।
—দুটো দিন পরে।
আবার দামিনীর গলা শোনা যায়। কী জানি বাবা, কী আছে আমার কপালে।
করা যেন হাসির শব্দ শোনা যায়। হাসির রকম দেখে বোঝা যায়, হিমির পিরিতির রং লেগেছে গোটা পাড়ায়।
যাবার আগে আবার ফেরে হিমি, ঢপ, কাত্তিকের চাকুন্দে মাকুন্দে খয়রার কথা তো বললে না।
বিলাস বলে, তোমার সাধ বলে, কাত্তিক কাটটে যাব। আগনের পেখম আমাকে যাত্রা করতে হবে।
চলে গেল হিমি। বিলাস নেমে এল। সয়ারাম তাকিয়ে থাকে গোল-গোল চোখে। তারপর বলে, মনটা তালে তোর সুস্থির আছে বিলেস?
–কেন?
—না, বলে কোনওরকম বে-ভাবটাব নেই তো।
—আমি বুঝি খালি বে-ভাবে থাকি?
–সে কথা বলছিনে। সে সব কথা আর মনে নেই তো।
বিলাস গম্ভীর হল, তোর খালি আন কথা সয়া। শোন, কামের কথা আছে।
কাঠের হাতা দিয়ে ভাত নেড়ে বলে সয়ারাম, বল।
—কেদমে কাকা পরশুকে দেশে ফিরছে, তুও যা সয়া। ট্যাকা দে দেব তোকে, আমার মার হাত তুলে দিস। না জানি সেখেনে কী টোটাটাই চলছে।
সয়ারাম বলল, যথাখ বলেছিস বিলেস, ফেরার জন্যে আমারও মনটা বড় উথাল-পাথাল করছে। এট্টা কথা বিলেস—
—মনখানেক মাছের দাম রয়েছে আমার কাছে। সাংলোয় ধরা মাছ।
—মাছ তো তুই ধরেছিস।
–কিন্তুন জাল লৌকো, সবই তোর বিলেস।
এত দিন বাদে বিলাসের ভূজোড়া কুঁচকে উঠল। বলে, বড় যে কথা শিখেছিস। মহাজন পেলি নিকি আমাকে?
চুপ করে গেল সয়ারাম। গতিক সুবিধের নয়।।
বিলাস আবার বলে, ট্যাকাগুলান তোর বউয়ের হাতে দিস। আর খুড়োর কথা অ্যাদিনে বাড়িতে গেছে। তুই সব বুঝিয়ে বলিস।
এতক্ষণে আসল ভয়ে চমকে উঠল সয়া। বলে, আর তুই? তুই যাবিনে বিলেস?
আকাশে তারা ফুটেছে। জোয়ারের সর্পিল স্রোতে ছায়া তার নিয়তই হারাচ্ছে। সেই দিকে তাকিয়ে বলে বিলাস, যাব, কাত্তিকের চাকুন্দে-মাকুন্দের কালটা দেখে যাব।
সয়ারামের মনে মনে রাগ, ভয়ও কম নয়। বলে, আরো বাপরে বাপ, আমি তালে কিছু বলতে পারব না।
–না পারলে থাক।
মুখ ফিরিয়ে নিল বিলাস। সয়ারাম বলল, আমার হয়েছে জ্বালা। তা কী বলব বল।
বিলাস বলে, বলিস যেন ভাবনা না করে। বলিস, ধরা রেখেছিলুম। গলায়, পরশুকে কামাব। আর…চুপ করল বিলাস।
সয়ারামও চুপ। থাকো তবে চুপ মেরে। সয়ারাম কথা জুগিয়ে দেবে না তোমার মুখে।
বিলাস বলে, আর কী বা বলবি। বলবি এখেনকের কথা, যা দেখছিস শুনছিস–
উঁ! যা দেখছিস শুনছিস। অথাৎ তোমার মহারানির কথাটিও বলতে হবে।
বিলাস বলেই চলে, ঠিকমতন বলিস, মাকড়ার মতন আবোল তাবোল বলিসনে। আড় আনতে কুড় এনে ভয় পাইয়ে দিসনে।
হুঁ! যত আন চিন্তা তোমার অথচ আড়ি আনতে কুড় আনছে। সয়ারাম। সয়ার কাছে কপটতা করিস তুই বিলাস। তোর বুকে হামাল ডেকেছে, বান চেতে উঠছে। জানি, তোর মন আর মানছে না। মানে কখনও? মহারানিরও যে রকম ভরা গোন দেখছি, তাতে না ভাসিয়ে ছাড়বে না।
মুখখানি গম্ভীর কিন্তু দুঃখী-দুঃখী ভাব করে বলে সয়ারাম, পোষ্কার করে বল কী কইতে হবে।
বিলাস বলে, বলিস যে, খুড়োর হুকুম মেনে কাজ করবে বিলেস। খুড়ে যা বলে গেছে, তাই হবে।
সয়ারাম যেন উল্লুক বনে গেল। খুড়ো কী বলে গেছে বিলেস?
—বলে গেছে, বুড়ির লাতিনের মনখানি পোষ্কার বলে বুয়েছি বিলেস, মেয়েটা তোকে ভালবাসে।
বিশ্বাস করল সয়ারাম। বন্ধু তার মিছে কথা বলে না কোনও দিন।
—হ্যাঁ আর এট্টা কথা—
বিলেস বলে, পরশুকে যদি যাস, সেটা শুকুরবার। শনি রবি সোম মঙ্গল থেকে বুধবার দিন গাড়িতে করে চলে আসিস আবার।
–কেন?
বিলাস অন্ধকারে মুখ ফিরিয়ে বলে, তুই কাছে না থাকলে মনটা ভাল লাগে না।
সয়ারামের হাতের খোঁচায় আর একটু হলে ভাতের হাঁড়ি উলটে পড়ত। বাপুইস রে! নির্যাস প্রাণের কথা তুই এমন করে মুখ ফুটে বলতে পারিস বিলাস। মহারানির গুণ আছে দেখছি। সয়ারামের মন থেকে সব মেঘ কেটে গেল ফুৎকারে। কিন্তু মুখখানি কালো করে বলে, নইলে আমার হাড়-জ্বালানি বাড়বে কেমন করে। জ্বালা বাড়াতে আসতেই হবে।
পরদিন সকালবেলায় মাছ নিতে এল দামিনী। মাছ রোজই কিছু আসে এখন। লোক দিয়ে মাছ পাঠিয়ে দিল দামিনী। তারপর চোখ দুটি ভুর তলায় ঢুকিয়ে সন্দেহজনক ভাবে তাকাল। কাঁড়ারে উঠে এসে, বিলাসের কাছে বসল। তিন মাথা এক করে।
বিলাস বলল, কিছু বলবে মনে লাগছে?
দামিনী বিলাসকে একবার দেখে বলল, হ্যাঁ। বলছিলুম, তোমাদের গাঁয়ের মহাজনকে কত ট্যাকা শুধিলে।
বিলাস বলল, এই ধরো, থাউকো টাউকো বাদ দিয়ে দুশো টাকা।
—বেশ। আমার দেনা আর হিমির দেনা, সবই মিটেছে। এখন তোমার পাওনা হয়েছে কত হিসেব আছে?
বিলাস বলল, হিসাব তো কোনও দিন রাখিনি, খুড়েই রাখত। তোমার হিসেব নেই?
—আছে, সেই কথাই বলতে এলুম। সব কেটেকুটে আড়াইশো ট্যাক তোমার পাওনা আছে। লোকজন জানাজানি না করে সনজেবেলায় যেয়ো ট্যাক আনতে। দিনকাল বড় খারাপ কিনা।
বিলাস বলল, পরশু যাব। আজ আর নয়।
দামিনী বলল, কেদমে পাঁচুর সঙ্গেই চলে যাবে তো?
—উঁহু।
হুঁ। ঠোঁট দুটি কুঁচকে নড়েচড়ে বসল দামিনী ভাল করে। রুষ্ট চোখে তাকিয়ে বলল, তোমার মতলবখানা কী বলে তো?
ওইটি আসলে বলতে এসেছে দামিনী। বলল, এ সব কী শুনছি?
—কী শুনলে?
–নাতনি নাকি তোমার সঙ্গে চলে যাবে?
বিলাস আঙুল দিয়ে পাটাতনে দাগ কাটতে কাটতে বলল, তা গেলে নে যাব।
—নিয়ে যাবে?
বিলাস বলল, মন তো করে তাই।
দামিনীর সারা লোলচর্ম মুখের রেখাগুলি সাপের মতো খানে খানে কুণ্ডলী পাকাতে লাগল। কেমন যেন অবশ হয়ে গেল শরীর। গলা-গলা চোখের দৃষ্টি হারিয়ে গেল সুদূরে। বলল, কোথায় নিয়ে যাবে, সমুদ্রে?
বিলাস বলল, না, লাতিন কি মাছ মারবে? তবে মনখানি তার যেতে পারে সমুদ্রে। ঘরে থাকবে সে।
দামিনী হুশ করে নিশ্বাস ফেলে বলল, আ! মেয়েটা একেবারে মরেছে। যাক, কারুর কথা তো শুনবে না। কেটে ফেললেও না। বুকের মধ্যে যে ফুটছে টগবগ করে।
তারপরে লোলচর্মচাকা চোখে একদৃষ্টি বিলাসকে দেখে বলল, হুঁ, সেই তারই ব্যাটা তো। জোয়ান মেয়ে মাথা ঠিক রাখতে পারবে কেন। কেউটের বিষ পড়েছে যা। তবে মেয়েটা বাঁচলে হয়।
–কে গো।
—সে এক ভাবে থেকেছে, জীবনের একটা ছাঁচ-ছাঁদ আছে মানুষের। সেটা বুঝতে হয়। নইলে দুটোকেই মনের জ্বালায় জ্বলতে হবে না? জলে ডাঙায় মাখামাখি থাকলে কী হবে। জল সে জল, ডাঙা ডাঙা-ই।
সয়ারাম বলে উঠল, শোনো গো আয়ি মা, এ ডাঙা সোতে ভেসে গেছে।
বিলাস বলল, হ্যাঁ, তোমার লাতনিকে আমি চাই। সয়ারাম আবার বলে উঠল, এই কথা! অনেক দিন থেকে বন্ধুর আমার জবর মন ফসফস করছে।
দামিনী বলল দীর্ঘশ্বাস ফেলে, নিয়ে যাবে, নিয়ে যাও। শেষ বয়সে আমাকে খাবে শ্যাল-কুকুরে।
সয়ারাম বলল, তুমো চলো না কেন, শ্যাল-কুকুরে খাবার দরকারটা কী?
দামিনী বলল, না ভাই, তা যেতে পারব না। এ বয়সে আর পুবের দেশ-গাঁয়ে গিয়ে টিকতে পারব না। মরতে বসেছি, তাই বাজারে গে একটু না বসলে ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। ওই রকম অভ্যাস হয়েছে এখন। তা ছাড়া, আমরাও পুবেরই মানুষ। আমার শ্বশুর চলে এয়েছিল এখেনে।
তারপরে হঠাৎ বিলাসের দিকে ফিরে বলল, এ পাড়ার অনেক পিরিত দেখলুম। ছুঁড়িগুলানের মনও বলিহারি। রঙে একেবারে দিশাহারা, যেন একেবারে দপদপ করছে। তা আমার নাতনিকে দুঃখু দিলে, তোমাকে আমি দেখব।
বিলাস বলল, মাছমারার বউ, দুধেভাতে থাকবে না। মাছেভাতে রাখব।
দামিনী যেতে যেতে বলল, সেটুকু যেন সুখের খাওয়া হয়। এই কথা।
বুড়ি চলে গেল। বিলাস বসল। জাল নিয়ে। সাংলো জাল সঙ্গে ছিল কুল্যে চারটি। ইলিশের গায়ের লালায় সব কটি জালই নষ্ট হয়ে গেছে প্ৰায়। বিশেষ জালের গর্ভস্থল, যেখানে মাচের ছাঁচ লাগে, সেখানটি নষ্ট হয়ে যায় আগেই। গেছেও। বিলাস পচা সুতো তুলে, নতুন সুতো পরাতে বসিল।
কিন্তু মনে তার অনেক কথা গাইতে লাগল। মাছমারার বউ আর কবে সুখের ভাত খেয়েছে। সুখের নয়, স্বস্তির ভাত মাছমারার বউ খায় না। প্ৰাণে তার সুখটুকু সার। উপোসের দুঃখ পেতে হয়। কেননা, নদী আর সমুদ্রের মর্জির উপর বাঁচে। মরে মাছমারা।
কিন্তু বুকের রক্ত যেন আগনার মুখের ঢেউয়ের মতো তোলপাড় করে। তোলপাড় করে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সব ভাবনা।
হিমির অকুলে ভাসা মুখখানি ওঠা-নামা করে সেই ঢেউয়ে।
দুলাল এল একটু পরে পরে। লাল চোখ দুটিতে মিটমিটে হাসি। মাছমারার গায়ে যত না গন্ধ, মাছ-বেচনদার দুলালের গায়ে তার চেয়ে বেশি গন্ধ লাগে।
বিলাসকে বলল দুলাল, তোমার কাছে এলুম। তুমি তো আর গেলে না।
বিলাস বলল, এসো খুড়ো। যাব, দু-একদিনের মধ্যেই যাব। আজও যেতে পারি। বসো।
দুলাল বলল, কাজের কথা বলতে এয়েছি। আমাদের পাড়ার সাজারে তোমাকে থাকতে লাগবে। তোমাকেও একটি সাজাভাটা চাঁদা দিতে হবে কিন্তুন, বুইলে?
সাজার হল মাছমারাদের সার্বজনীন গঙ্গাপুজো। সবাই মিলে চাঁদা দেয়। হাতে ধরে কেউ টাকা-পয়সা দেয় না। মাছমারারা একটি ভাটার পাওয়া মাছ সব দিয়ে দেয়, যাদের উপর সাজারের ভার থাকে। তাকে বলে সাজাভাটা। সেই মাছ বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যায়, তাতেই সার্বজনীন গঙ্গাপুজো হয়। তাতে কে কত বেশি দিয়েছে, কম দিয়েছে, সেটা কোনও কথা নয়। যা পায়, তাই দেয়। তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে বইকী। যে যত বেশি গড়ান মারতে পারবে, সে তত বেশি দিতে পারে। তার নাম হয়, মান বাড়ে।
বিলাসদের দেশে গাঁয়েও সাজার হয়। সে বলল, কদিন থাকব না থাকব—
দুলাল হেসে উঠে ঘাড়ে রন্দা মোরল বিলাসের। বলল, সে খবর কি আর চাপা আছে গো। দেশময় রটে গেছে, পাড়াময় রং লেগে গেছে।
–রঙ?
—হ্যাঁ। বড় সহজ মেয়েটিকে তো তুমি পাণে মারোনি। আমার ছোটমাসিকে নিয়ে মেয়ে পুরুষ সকলের মাথাব্যথা।
-বটে?
—নয়তো? কতজনার রং-চটা পিরিতে আবার লাতুন পৌঁচড়া পড়ছে, কত বুড়ির পেখম বয়সের কথা মনে পড়েছে। যার যত সুখ দুঃখ উথলে উঠেছে আমার ছোটমাসির কথা নিয়ে।
তারপর গলা নামিয়ে বলল, তাপর বুক-জ্বলে-যাওয়া আগুনের রং কি কম ফুটেছে! অনেকেরই টাক ছিল, তুমি ছিনিয়ে নিচ্ছি।–আমারও মনটা তুমি তোলপাড় করে দিয়েছ।
—কেন গো দুলাল খুড়ো।
—আমার পেখম বয়সের কথা মনে পড়ে গেল। তোমার খুড়ি, আতরবালা। আতুর কথা বলছি। আমাদের পেখম দেখাশোনার ছবিগুলান ভেসে উঠল চোখের সামনে।
বলতে বলতে হঠাৎ গভীর হল দুলাল। শেষ ভাদ্রের চাঁপা-রং রোদে, চারিদিকে চাঁদ-সোনার ঝিকিমিকি। জল যেন সব সময়েই টাবুটুবু। গাছপালায় ঘোর সবুজের সমারোহ।
দুলাল বলল, ভাল হোক বাবা তোমার ভাল হোক। তালে, সাজাভাটা পাচ্ছি তো?
বিলাস বলল, অনিয়ম করব কেমন করে? দশজনের বিষয়ে আমু একজন।
—বেশ বেশ। কোনও দিন আমাদের সাজারে ছিলে?
–না।
—তবে দেখবে, কালকেতা থেকে বড় বড় যাত্রার দল আসবে। কম করে পাঁচ রাত শুধু যাত্রাগান। তাপর কবি-কোত্তন গান তো আছেই। আজকাল আবার হয়েছে তোমার মাইক না। কি। তাও বাজবে। বড় আমোদ হবে–
নৌকো থেকে নেমে বলল দুলাল, তবে কথা হল কি যে তোমার কাছে এখন সে আমোদ কিছু না।
সয়ারাম বাটনা বাটছিল। হঠাৎ বলে উঠল, তা সে কথা ঠিক।
কিন্তু বিলাসের বুকটা টনটনিয়ে উঠল। খুড়ো যদি থাকত। জাল কোলে নিয়ে দূর জলের দিকে সে তাকিয়ে থাকে। পরমুহূর্তেই মায়ের জন্যে, খুড়ির জন্যে হু হু করে ওঠে মনটা। কত দিন দেখেনি।
দেখবে, মহারানিকে নিয়ে গিয়ে দেখবে। চাকুন্দে-মাকুন্দের কাল যাক।
শুক্রবার কেদমে পাঁচুর যাওয়া হল না। ব্ৰজেন ঠাকুর মশাইয়ের সঙ্গে তখনও হিসাব-নিকাশ মেটেনি। তবে ঠাকুর অনেক বাবা বাছা করেছে। কেদমোকে। বাপ-ব্যাটারা অনেক মাছ দিয়েছে ঠাকুরকে। শনিবারে যাবে কেদমে। সয়ারামেরও একদিন দেরি হয়ে গেল।
নৌকা কম দেখা যায় গঙ্গায়। এত দিন যেন মাছমারাদের মেলা বসেছিল। এখন গঙ্গার বুকখানি বড় নিরালা নিরালা লাগে।
এই বুঝি নিয়ম। গঙ্গার কাছে এসে মাছমারারা কত কপাল কুটেছে। গঙ্গার সাড়া জাগেনি। সাড়া যখন দিল, অমনি মাছ-মারা তার কাজ মিটিয়ে চলে গেল। গঙ্গা এখন একলাই যাওয়া-আসা করবে। কলকল করে। সংসারে কেউ কারুর জন্য বসে থাকবে না। জীবনের এইটি সুখ, এইটি দুঃখ। গঙ্গাকে দেখে যেন মনে হয়, ছেলেদের দিয়ে সে নিশ্চিন্ত। ছেলেরা নিয়েই সুখী।
ওই দেখা যায়। নলেন-টানা বেদিটা রয়ে গেছে এখনও। একটা চিল বসে আছে তার মাথায়। টোটার চিহ্ন ওটা।
আগামী বিষয়ে আর ওটা থাকবে না। ছেলেরা খেলা করতে এসে ভেঙে ফেলবে। নতুন বছরে এসে ওই চিহ্ন না দেখাই ভাল।
সন্ধ্যা হল প্ৰায়।
বিলাস আর গঞ্জের গাছতলায়, নরসুন্দরের কাছে বসে, চুল কেটেছে, দাড়ি কামিয়েছে। এত দিনে জামা গায়ে দেয়নি। ঝাঁপি থেকে ক্ষারে-কাচা গেরুয়া বর্ণের জামখানি বের করতে গিয়ে পাঁচুর জামাটাও চোখে পড়ে গেল। মনে হল, খুড়ো যেন সব দেখছে।
জামাটি গায়ে দিয়ে, কাপড়টি হাঁটুর একটু নীচে নামিয়ে বিলাস গেল হিমির বাড়িতে।
সয়ারাম বন্ধুর আপাদমস্তক দেখে ঠোঁট টিপে বলল, এটুকখানি ফুলল ত্যাল হলে খুশবেই ছাড়ত ভাল।
বিলাস বলল, তোর মুণ্ডু। আমি টাকা আনতে যাচ্ছি বুড়ির কাছ থেকে।
হুঁ, এখন কত ছলাকলাই দেখব রে বিলাস। এই সয়ারামকে এখন অনেক দেখতে হবে। কিন্তু বুকের ভিতরটা তার আনন্দে ভরে উঠেছিল। তার যাওয়া হচ্ছে না বটে বন্ধুর সঙ্গে। যাবে, সে যাওয়ার সময় এখনও হয়নি। কিন্তু মুখ গোমড়া করে বলল, তা এটুক তাড়াতাড়ি আসেন যেন মশাই। কারুর ভাত নে আমি রাত দশ পোহর ধরে বসে থাকতে পারব না।
বিলাস বলল, আচ্ছা, না থাকিস না থাকবি।
বলে সে চলে গেল উঁচু পাড় ভেঙে।
আজও বাড়ি ফাঁকা দেখা যায়। হিমির ঘরের দরজা খোলা রয়েছে।
বিলাস ডাকবার আগেই বেরিয়ে এল হিমি। সদ্য-খোঁপাবাঁধা মাথার চুল চকচক করছে। টকটকে লাল শাড়ি পরেছে একখানি। তাজা ইলিশ-কাটা গাঢ় রক্তের মতো লাল। জামা গায়ে দেয়নি। গলায় দেখা যাচ্ছে সোনার হারের ঝিকিমিকি। পায়ে দিয়েছে। আলতা, কপালে দিয়েছে ছোট টিপ।
বিলাসের চোখে পলক পড়ে না।
হিমির মুখটিও শাড়ির মতো লাল হয়ে উঠল। বলল, কী দেখছ ঢপ?
—মহারানিকে দেখছি। একেবারে যে রক্তারক্তি দেখি।
হিমি বলল, তোমার দেয়া মাছ আজ নিজের হাতে কেটেছি।
—অ। আমি মনে করি বলে, মহারানি কোনও পেজার খুন মেখে এল। অমনি হিমির ঠোঁট ফুলে উঠল অভিমানে, আহা! পেজার খুনই দেখলে খালি। আমার বুকের রক্ত যে সব চলকে পড়েছে বাইরে সেটা কে দেখবে?
বিলাস বলল, রাগ কোরো না। তোমার বুকের রক্ত নয়। তেঁতলে বিলেসের মনের রং ওটা মহারানি।
হিমি হাত ধরে ঘরে টেনে নিয়ে গেল বিলাসকে। আসন পেতে বসিয়ে বলল, আজ দুটি খেতে হবে আমার কাছে, আগেই বলে রাখছি কিন্তু।
বলে হিমি কোথায় যাচ্ছিল। বিলাস তার হাত টেনে ধরল। বলল, তা না হয় খাব। তুমি যাচ্ছ কমনে?
—উনুনটা ধরিয়ে দিয়ে আসি।
—থাক। দুটি পেটে খাবার জন্যে তো কাজ করি। আজ এটু কথা বলি।
–তা বলে খেতে হবে না?
—হবে, না হয় দেরিতেই হবে। না খেয়ে আমি যাব কমনে। তুমি বোসো মহারানি।
বাড়িতে কেউ নেই। হিমি বসল বিলাসের কোলের কাছে। বিলাস তার শক্ত হাতে বেড় দিয়ে ধরে মুখ তুলে ধরে বলল, মহারানি, আমি মাছমারা। অকুলে ভাসি, জীবন বড় সংশয়। তুমি দুঃখু পাবে বড়।
হিমির অকূল সমুদ্ৰ—বিলাস। সেই সমুদ্রের বুকে ড়ুব দিয়ে বলল হিমি, সেইটি আমার সুখ, তুমি তো আছ। শুধু সুখের খবর তো আমি জানিনে কোথায় আছে।
বিলাস বলল, আরও কথা আছে মহারানি।
বলো।
বিলাস বলল, অমর্তের বউয়ের সব কথা। বলল, বড় পাপ আমি বয়ে বেড়াচ্ছি মহারানি। আমার ভেতরের শয়তানটাকে সে উসকে দিইছেল। বুকে আমার আগুন জ্বলছেল খা খা করে। তোমাকে যেদিনে দেখলুম, আমার মন শান্ত হল। তুমি আমার পাপ ধুয়ে দেও।
হিমি হাত দিয়ে বিলাসের মুখ চাপা দিল। ভারী উৎকণ্ঠা ও ত্ৰাসে বলল, কাকে কী বলছি তুমি? সোম্সারে আমি তো পাপ-পুনি বুঝিনে। তা হলে আমার পাপের যে ভরাড়ুবি হবে, ঢপ।
বলে, সে তার জীবনের কথা বলল। যেখানে তার জন্ম, লোকে বলে, সেইটাই পাপের বড় স্থান। ছোট বয়স থেকে সেখানকার পাশ কাটাতে পারেনি। হিমি। পাপ তার নিজেরও অনেক। এ জীবনে কত দাগ পেয়েছে হিমি। এখানকার জীবনের চারপাশে শুধু অশেষ যন্ত্রণা ও অপমান। বড় মিথ্যে, ভণ্ডামি, মন নিয়ে জুয়াচুরি। তাই না হিমি অকুলে ভাসতে চেয়েছে। সেখানে সংহারের মূর্তিও যেমন ভয়ংকর ভালবাসাও তেমনি ছলনাহীন উত্তাল।।
বিলাস বলল, আমরা দুজনেই ধোয়ামোছা করে নিই জীবনটা! হিমি বলল, সেই ভাল।
কখন অন্ধকার হয়েছে, সাঁঝ উতরে রাত গেছে বেড়ে, টেরও পায়নি। হিমি ধড়ফড়িয়ে উঠল। বাতি জ্বালল ঘরের। উনুনে আগুন দিতে গেল গুনগুনিয়ে।
বিলাস বলল, তোমার আইমা কমনে গেল?
হিমি বলল, তার কথা আর বোলো না। কদিন ধরে বুড়ি এত মদ গিলছে। জিজ্ঞেস করলে বলবে, তোর কী। তুই তো যাবি চলে। আমি মদ খাই, নেশা করি, না হয় মরব, তুই চোপা করিসনে।
বিলাসের মনটা খারাপ হয়ে যায়। নাতিনের শোক লাগছে বুড়ির। কিন্তু মন যে মানে না। বিলাস বলল, সঙ্গে যেতে বলেছিলুম।
হিমির গলা আটকে এসেছিল ধোঁয়ায়। বলল, তালেই হয়েছে। এ জায়গা ছেড়ে যাবে?
আর—একবার হিমি কাছে এসে বলল, ঢপ।
-বলো।
–একটা কথা রাখবে?
—নিচ্চয়।
—আমার এক আপদ আছে। তুমি নেবে?
-না গো?
—ট্যাকা। তুমি সমুদ্রে যাবে বলে মহাজন ধরবে বলছিলে? নগদ আর গয়না মিলিয়ে চার হাজার হবে আমার। তুমি নেও।
বিলাস হেসে বলল, ও, সমুদ্রের মহাজনিও করবে? তা, তোমাকে নেব, তোমার সবই নেব। মহারানি।
ঘুরে-ঘুরে বসে-বসে হিমি রাঁধলে। তার রক্ত-শাড়িতে আলো পড়ে, সারা ঘরে বাইরে খেলা চলল রক্তের। বিলাসকে খাইয়ে আবার দু-দণ্ড কথা বলল দু-জনে
বিলাস বলল, এবারে যাই মহারানি?
হিমি বলল, থাকো রাত্ৰে।
বিলাস বলল, সেটা পারিনে যে। কাল সয়া চলে যাবে। লৌকের সংসার, সেখেনে রোজ বাতি দিতে হবে, তিবড়ি জ্বালতে হবে, বসে খেতে হবে। অন্ধকারে একলা লৌকো ফেলে রাখা যাবে। না। তবে পিতিদিন আসব মহারানি, এসে থাকব তোমার কাছে খাব, তাপরে লৌকায় যাব। অমন করে তাককো না, আমার মনটা বড় আঁকুপাঁকু করে।
বাইরে চাঁদ উঠেছে, সামনে পূর্ণিমা। বিলাসের সঙ্গে সঙ্গে উঁচুপাড়ের তেঁতুলতলা অবধি এল হিমি।
বিলাস নৌকায় উঠতেই সয়ারাম কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। ছাঁইয়ের কপালে হ্যারিকেন কমানো। তিবড়িতে এখনও অঙ্গর অঙ্গার দেখা যায়।
বিলাস বলল, শুয়ে পড়লি যে?
—তবে কি সারারাত জেগে থাকতে হবে?
রাগ বোঝা যায় সয়ারামের। বিলাস বলল, খেয়েছিস?
জবাব এল, রোধে-বেঁড়ে রইলুম দুজনের জন্যে, একলা খেতে যাব কোন শখে?
আরে বাবা, বড় চোতেছে। সয়ারাম। বিলাস বলল, তো ওঠ, খেতে দে। সয়ারাম উঠে অবাক হয়ে বলল, ন্যাকামি করছিস নিকি? ফড়েনি বুড়ি যে বলে গেল, তার লাতিনের হাতে খাচ্ছিস?
—তুই দিলেও খাব সয়া। খেতে দে।
সয়ারাম বলল, বাবারে বাবা, এ কী খিদে গো! কিন্তু মনটা খুশি হয়ে উঠল। দুজনের ভাত বেড়ে বসিল সে। তারপরে বলল, দু-এক গরাস খেয়ে উঠে যা। বেশি গিলে শেষে পেট খারাপ করবি। পরদিন চলে গেল সয়ারাম। কেদমে পাঁচুও ছেলেদের নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে দক্ষিণে সাই-যাত্রার বিষয় অনেক কথা বলে গেল। গিয়ে সে সকলের সঙ্গে কথা বলবে। মহাজনের সঙ্গে কথা বলবে বিলাস।
সয়ারাম বলল, আসতে দু-চারদিন দেরি হলে ভাবিসনে বিলেস। সাবধানে থাকিস।
বিলাস তাকে বাড়ির টাকা-পয়সা সব দিয়ে দিল।
তারপর একলা একলা সাজাভাটার মাছ ধরল বিলাস। ধরে সার্বজনীন গঙ্গাপুজোর চাঁদা দিল। এখানকার মাছমারাদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হল। কেবল রসিক কথা বলে না।
হিমি বিলাসকে নিয়ে শহরের নানান জায়গায় বেড়িয়ে বেড়ায়। আজ যায় কালাচাঁদের মন্দিরে, কাল যায় কালীদর্শনে। কোর্টকাছারি দেখায়, জেলখানা চিনিয়ে দেয়।
বিলাস হাঁ করে দেখে। তবে জোয়ারের বেলায়। ভাটায় জাল ফেলা চাই রোজ। আর দক্ষিণ দিকে বারে বারে তাকায় চোখ তুলে। জলে টান পড়ে গেছে, ধারা স্বচ্ছ দেখায়। সমুদ্রের কাল ঘনিয়ে আসছে। বিলাসের মন টান-পাড়াপাড়ি হয়।
সাজার এসে গেল। পাড়ার মধ্যেই একটি খোলা জায়গায় মাথায় তেরপল দিয়ে দিব্যি ঢাকা হয়েছে। প্রতিমার মাটির সঙ্গে রং পড়ে গেছে। ঢাক-কাঁশি উঠেছে বেজে, টাকুর টাকুর, ঢাং টানা, কাঁই না না, কাঁই না না।
এ পাড়া, আর তার আশেপাশে গৃহস্থ, আধা-গৃহস্থ, দেহোপজীবিনী, সকলের মধ্যেই সাড়া পড়ে যায়। একটু যেন কেমন। নেশা-ভাং একটু বেশি চলে সকলেরই, কি মেয়ে, কি পুরুষ।
দুলালকে যখনই চোখে পড়ে, দেখে, মাতাল আন্তরকে জাপটে নিয়ে চলেছে সে। দামিনীও খুব বাড়িয়েছে। সেদিন বিলাসকে চেপে ধরে খাইয়ে দিয়েছে। বলেছে, নাতনিকে খাবি। মদ খাবিনে কেন রে ছোঁড়া?
গঙ্গার মূর্তিখানি বড় ভাল লাগে বিলাসের। কান পর্যন্ত টানা টানা অপলক চোখ, কালো তারা দুটিতে কী তারাস। লাল টুকটুকে ঠোঁট দুটিতে মিষ্টি হাসি। সোনার মতো। রং, চতুৰ্ভুজ মূর্তি। নাকে মস্ত বড় নাথ। হাতিমুখো বাহন মকরের ল্যাজটি কুমোর এমন বাঁকিয়ে দিয়েছে, যেন জলে ঝাপটা মারছে। মস্ত লম্বা শুঁড়টি দিয়েছে বাড়িয়ে। অপলক গোল চোখ দুটি লাল টকটকে দেখা যায়।
তারপর অবাক হয়ে বিলাস দেখে, পুজো যেন হিমিরই। তার নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। উপোসও নাকি তার। ফুল বেলপাতা চন্দন গোছগাছ করছে সে-ই। লালপাড় মুগা সুতোর শাড়ি পরেছে। সকলেই হিমি, হিমিদিদি, হিমিমাসি, হিমিপিসি বলে চেঁচাচ্ছে।
আর মণ্ডপ থেকে-যখন হিমি বিলাসের দিকে তাকায়, বিলাসের বুকে যেন চকমকি পাথরের ঘষা লাগে।
গঙ্গা-মূর্তির সঙ্গে যেন মিশ খেয়ে যায় হিমির মুখ।
ফাঁক পেয়ে বলে বিলাস, বাঙ্গুইসারে, একেবারে চতুর্ভুজের মতন লাগে।
হিমি চোখ মটকে বলে, আর নিজে যে আট-হাতে মাছ ধরো?
তা বটে। বিলাস বলে, মনে হয়, এখেনকের সবার মহারানি তুমি। তোমাকে না হলে চলে না। আর আমার সয় না, কবে নে পালাব। তাই ভাবি।
তারপর যাত্রা-গান আরম্ভ হয়। সয়ারামও এসে পড়েছে। শান্তনু ও গঙ্গা পালাটি বড় ভাল লাগে। আসরে পুরুষদের পাশ ঘেঁষে বসে হিমি, বিলাসের কাছাকাছি থাকার জন্যে। দুজনে পালা দেখে আর চোখাচৌখি করে।…
পালা আরম্ভ হয়েছে। এলানো-চুল সুন্দরী যুবতীকে নদীর পাড়ে দেখে, পদ্মগন্ধে পাগল রাজা শান্তনু তার পিছনে পিছনে যায়। বলে, কে তুমি পদ্মগন্ধা, সুলোচনে, অতি মনোহরা দেবী প্রতিমা! হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনু তোমার পাণি ভিক্ষা করে।
গঙ্গা বলে, তবে প্ৰতিজ্ঞা করো মহারাজ, যদি আমাকে বিবাহ করো, তবে কোনও দিন আমার কোনও কথার প্রতিবাদ তুমি করিবে না। আমার কোনও কাজে কখনও বাধা দিবে না। যে মুহূর্তে বাধা দিবে, সেই মুহূর্তেই হারাবে আমাকে।
রূপমুগ্ধ রাজা বলে, তাই দিব হে নিষ্ঠুরা সুন্দরী দেবী।
দেবপুরী হতে গান ভেসে আসে,
জয় জয় গঙ্গা, গাহ জয় গঙ্গার।
বিধির বিধান এই অষ্টবসু তরাবার।।
তারপর সন্তান হল রাজার। সে সন্তান জন্মমাত্র গঙ্গা সন্তান নিক্ষেপ করে যায় জলে। দর্শক দেখে, গঙ্গা একটি একটি করে হলুদ-গোলা ছেলে আসরে কনসার্ট পাটির এক জায়গায় ফেলে দিয়ে যায়। শান্তনু সন্তান-শোকে, চুল ছিড়তে ছিড়তে নিজের গলা টিপে ধরে আসে রানির পিছনে পিছনে। কিন্তু প্ৰতিজ্ঞানুযায়ী কিছু বলতে পারে না। দর্শকেরাও ব্যাকুল হয়ে ওঠে, ফ্লুট বাঁশিটা সপ্তম সুরে ওঠে কেঁদে।
সব-শেষের সন্তানটি ফেলে দেওয়ার সময় উদভ্ৰান্ত শান্তনু আর স্থির থাকতে পারে না। বলে ওঠে, নিষ্ঠুর সুন্দরী, মা হয়ে তুই পারিস, আমি যে আর পারিনে। আমার যে বুক ফেটে যায়!
গঙ্গা বলে, পূর্ব প্রতিজ্ঞা স্মরণ করে রাজা।
রাজা বলে, দেবী তুষ্ট হও। তুমি আমাকে ত্যাগ করিয়ো না, কিন্তু এই সন্তানটি ভিক্ষা দাও।
—এই নাও।
বলে রাজার হাতে সন্তান দেয় সুন্দরী, তারপরে ছুটে অদৃশ্য হয়ে যায়। রাজা হাসতে গিয়ে কেঁদে ওঠে! শুধু শোনা যায় কে যেন দৈববাণী করে, রাজা, তোমার এই সন্তান জগতের শ্রেষ্ঠ বীর হবে।
রাজা কাঁদে। বিলাসেরও বুকটা যেন ফাটে। কেন, রানি চলে যায় কেন। রানি থাকলে কত ছেলে আরও পেত রাজা। এ ছেলেকে না চাইলেই পারত। তাকিয়ে দেখে, হিমি তার দিকে তাকিয়ে আছে। দু-চোখ-ভরা জলে তার গাল ভেসে যায়। সবাই কাঁদে রাজার বিরহ দেখে।
তারপর আরও অনেক পালা হয় পাঁচ দিন ধরে। নল-দময়ন্তী, শকুন্তলা, চিত্রাঙ্গদা।
একদিন পালা-শুরুর মুখে, দুলালকে না দেখে বিলাস তার বাড়ি গেল। কদিন তাকে সময়মতো দেখা যায় না।
গিয়ে দেখল, হ্যারিকেনটা কমিয়ে, দাওয়ায় বসে আছে দুলাল। কী যেন ভাবছিল, বিলাসকেও চোখে পড়ে না। দাওয়ার উপরে, দরজার কাছে এক জোড়া দামি সুন্দর জুতো। ঘরের বেড়ার ফাঁকে ভিতরে আলো দেখা যায়।
বিলাস বলল, কী করছ খুড়ো বসে বসে?
দুলাল নেমে এল উঠোনে। চুপিচুপি বলল, যাত্রা দেখতে যাওনি।
—গেছলুম। তোমাকে ডাকতে এলুম।
—নককী বাবা আমার।
তারপর ঘরের দিকে তাকিয়ে মুখখানি দহের পাকের মতো ফুলে উঠল দুলালের। বলল, তুমি যাও, আমি পরে যাব।
—ঘরে কে খুড়ো?
দুলাল বাড়ির বাইরে এল বিলাসকে নিয়ে। বলল, তবে তোমাকে বলি বাবা। বাবু আছে ঘরে।
–বাবু?
—হ্যাঁ। বেবুশ্যে ছিল তো আগে। তাপরে মাছ বেচে খাবার শখ হল আমাকে পেয়ে। কিন্তু রূপবতী মেয়েমানুষ, হাটের বাস উঠিয়ে এলে কী হবে, তারা ছাড়ে না। আর মানুষের মন, তাতে এত রকমের চিত্তির-কাটা, রামধনুর চেয়ে বেশি রকমারি বাবা। বাবু এলে, আতু না-না করে, তাপর বলে, এত সব বড় বড় বাবু মানুষ পায়ে পড়ে গো আমার। বলে যেন স্বপ্নের ঘোরে বাবুর ঘরে গিয়ে ওঠে।
তাপরে, বাবু চলে গেলেই দাপিয়ে চেঁচিয়ে কেঁদে একশা করবে। আমাকে মারবে ঠাস-ঠাস করে।
বিলাস তার আদিম চোখে আপলক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। বলল, কেন?
দুলাল বলল, বলে, তুই কেন আমাকে টেনে ধরে রাখিস না, ঘরে কেন যেতে দিস? কিন্তু আমি ধরে রাখব কেমন করে? সে যে আপনি যায়।
দুলালের মুখের দিকে চোখ রাখতে পারল না বিলাস।
সারা গায়ে মাছের গন্ধ, খালি-গা মানুষটা। কী সুখে আছে। তবে আতরের কাছে।
বলল সে, তুমি আছ কেন এখেনে খুড়ো?
দুলাল হাসল। লাল চোখ দুটি চকচক করছে। বলল, কোথায় আর যাব বাবা বিলেস। উপায় নেই যে।
—উপায় নেই?
—না। হাত-পা থাকলেই চলা যায় না যে গো, সেটা বোঝা তো। তোমার লেীকো ছিল, হাল ছিল, গাঙে কত জল ছিল, তবু তো চাকুন্দে-মাকুন্দে দেখে যেতে হচ্ছে।
নিঃশব্দ হাসিতে আগনার জলের মতো ফুলে উঠল দুলাল। বলল আবার, তুমি বাবা মাছমারা, তোমার আকুল আছে। আমি মাছ বেচি, তাই কুলে ভিড়েছি।
তারপরেই সন্ত্রস্ত হয়ে বলল, যাই, ঘর থেকে এখুনি বেরুবে হয়তো। না ধরাধরি করলেই চেঁচিয়ে দাপিয়ে মরবো।
চলে গেল দুলাল। বিলাস দাঁড়িয়ে রইল অন্ধকারে। বুকে যেন খুঁটেজলের কাঁকড়া বিঁধে রইল। যাত্রার আসরে গেল না। পায়ে পায়ে গেল গঙ্গার ধারে।
আকাশে অগণিত তারা। শরতের পরিষ্কার অন্ধকার আকাশ। বিলাসের মনে হল, খুড়ো যেন বলছে, বিলেস, মহাসমুদ্রে যাবি তুই। বুকে তোর ব্যথা থাকছে। কেন? না, মনুষ্যজীবন দেখে জন্ম সার্থক হচ্ছে তোর।
স্পর্শে চমকে পিছন ফিরতে দেখল হিমি। দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে হিমি বলল, কী করছ এখেনে।
এখানে কোনও গোপনতা নেই বিলাসের। বলল, দুলাল খুড়োর কথা শুনছিলুম মহারানি।
হিমি বলল, ও, তাই সব কিছু নিয়ে নানানখানা ভাবিছ বুঝি?
হিমির কথার ইঙ্গিত বুঝে বিলাস বলল, না গো না, ছি! মনটা বড় উদাস হয়ে গেল।
—আর আসরে বসে দু-চোখে অন্ধকার দেখছিলুম আমি। চলো।
–চলো।