লঞ্চ একটা নয়
লঞ্চ একটা নয়, দুটো। প্রথম লঞ্চটা চড়ায় আটকে একটুখানি কত হয়ে আছে। দ্বিতীয় লঞ্চটা একটুখানি দূরে, সেটা ধপধপে সাদা রঙের, জলের উপর রাজহংসের মতন ভাসছে।
বৃষ্টির দাপট খানিকটা কমেছে। স্পিডবোটের আওয়াজ শুনেই প্রথম লঞ্চের ডেকের ওপর একজন লোক এসে উঁকি মোরল। এই লঞ্চটার নাম মধুকর। স্পিডবোট মধুকরের পাশেই এসে থামল আগে।
রণবীর ভট্টাচার্য উঠে দাঁড়িয়ে মধুকরের সেই লোকটিকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যেতেই লোকটি যেন ভূত দেখার মতন চমকে উঠল। তারপর এক ছুটে চলে গেল ভেতরে।
রণবীর ভট্টাচার্য হেসে উঠলেন।
বিমান জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, লোকটা পালাল কেন?
স্পিডবোট-চালক বলল, মধুকরের সারেঙ তো মইধরদা! সে গেল কোথায়? ও মইধরদা! মইধরদা!
কেউ কোনও সাড়াশব্দ করে না।
বিমান সন্তুকে জিজ্ঞেস করল, মইধর? এ আবার কী রকম অদ্ভুত নাম?
সন্তু বিমানের চেয়ে ভাল বাংলা জানে। সে বলল, মইধর না। মহীধর!
কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর একজন মোটামতন লোক কোমরের লুঙ্গিতে গিঁট বাঁধতে বাঁধতে এল রেলিং-এর কাছে। দেখলেই বোঝা যায় লোকটা ঘুমোচ্ছিল।
লোকটি এসে খুব বিরক্তভাবে বলল, গোসাবা থানায় সেই সক্কালবেলা খবর দিয়েছি। তারপরেও কোনও লোক পাঠাল না। আমার লঞ্চে খাওয়া-দাওয়ার কিছু নেই। সারারাত কি এখানে না খেয়ে পড়ে থাকব? কাশেম, এনারা করা?
স্পিডবোটের চালক রণবীর ভট্টাচার্যকে দেখিয়ে বলল, ইনি পুলিশের বড় কত। আর এনারা কলকাতা থেকে এসেছেন। সাহেবদের লঞ্চটা দেখবেন।
মহীধর নামের লোকটি বলল, ওই লঞ্চ দেখতে চান, দেখুন গিয়ে! আমি তার কী করব? আমাদের এখন সারা রাত এখানে পড়ে থাকতে হবে? থানা থেকে কিছু খবর পাঠিয়েছে?
রণবীর ভট্টাচার্য বললেন, এ লোকটা তো আচ্ছা দেখছি! একটা কাজের জন্য পাঠানো হল, সে কাজ না পেরে নিজের লঞ্চটাই আটকে ফেলল। চড়ায়। এখন আবার গজগজ করছে!
মহীধর বলল, আমি স্যার পুলিশে কাজ করি না। পুলিশ থেকে এই লঞ্চ ভাড়া করেছে। লঞ্চ চড়ায় আটকে গেলে আমি কী করব?
সন্তু তখনও ভাবছে, প্ৰথম লোকটা ওরকম দৌড়ে পালিয়ে গেল কেন?
কারণটা বুঝতে পারা গেল তক্ষুনি। সেই লোকটা পুলিশের কনস্টেবল, কিন্তু সে একটা লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে দাঁড়িয়ে ছিল। সে রণবীর ভট্টাচার্যকে দেখেই চিনতে পেরেছে। ডিউটির সময় বড় অফিসারদের সামনে সাধারণ পুলিশদের সব সময় পুরো পোশাক পরে থাকতে হয়। তাই সে দৌড়ে ভেতরে গিয়ে হাফ-প্যান্ট আর জামা, বেল্ট, জুতো-মোজা সব পরে এসেছে তাড়াতাড়ি।
এবারে সে এসেই ঠকাস করে দুপায়ের জুতো ঠুকে একখানা স্যালুট দিল রণবীর ভট্টাচার্যকে।
রণবীর ভট্টাচার্য বললেন, তক্তা ফেলো! আমরা এই লঞ্চে আগে একটু জিরিয়ে নিই। ভিজে একেবারে ন্যাত হয়ে গেছি। এক কাপ করে চা খাওয়াতে পারো সবাইকে?
স্যার, চা আর চিনি আছে, দুধ নেই।
ওতেই হবে!
কাকাবাবু বললেন, রণবীর, তোমরা বরং একটু জিরিয়ে নাও আর চা খাও! আমি কষ্ট করে এই লঞ্চে একবার উঠিব, আবার নামব, সে অনেক ঝামেলা। আমি আগে ওই লঞ্চটাতেই চলে যেতে চাই।
রণবীর ভট্টাচার্যতক্ষুনি মত বদলে বললেন, সেই ভাল, চলুন, আমরা সবাই আগে ওই লঞ্চটায় যাই। এরা ততক্ষণে চা বানাক, তারপর ওই লঞ্চেই চা পৌঁছে দেবে।
কাকাবাবু স্পিডবোটের চালককে বললেন, তুমি প্রথমে ওই লঞ্চটার চারপাশে একটা চক্কর দাও! আমি বাইরে থেকে পুরো লঞ্চটা একবার দেখতে চাই।
খুব আস্তে আস্তে লঞ্চটার চারপাশ ঘুরে আসা হল। লঞ্চটা দেখতে খুব সুন্দর। অন্য লঞ্চের মতন লম্বাটে নয়, একটু যেন গোল ধরনের। কিন্তু লঞ্চের গায়ে কোনও নাম লেখা নেই।
এবারে লঞ্চের সামনেটা দিয়ে এক এক করে সবাই ওপরে উঠে এল। কাকাবাবুকে ধরাধরি করে তুলতে হল ওপরে।
রণবীর ভট্টাচার্য বোট-চালককে বললেন, তোমার নাম কাশেম? তুমি ওই লঞ্চে চলে যাও, চা-টা নিয়ে এসো। আর দেখো তো, ওদের ওখানে তোয়ালে বা গামছা-টামছা কিছু পাও কি না! মাথা মুছতে হবে তো!
এই লঞ্চের ডেকে পা দিয়েই সন্তু হ্যাঁচো করে হেঁচে ফেলল।
রণবীর ভট্টাচার্য বললেন, এই রে, ঠাণ্ড লেগে গেছে। জামা খুলে ফেলো, জামা খুলে ফেলো। নইলে নিউমোনিয়া হয়ে যাবে!
তিনি নিজেই আগে খুলে ফেললেন গায়ের জামা।
বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিষ্কার হয়ে এসেছে। কিন্তু সন্ধে হতে আর বিশেষ দেরি নেই।
সিঁড়ি দিয়ে সবাই নেমে এল নীচে। প্রথমেই চোখে পড়ল খাবার ঘরটা। টেবিলের ওপর এখনও কপি-প্লেটগুলো রয়েছে। প্লেটের ওপর পড়ে আছে আধা-খাওয়া খাবার। কাপে অর্ধেকটা কফি। কিন্তু রান্নার অন্য জিনিসপত্র এমনকী কফির কোিটলি, জল খাওয়ার গেলাসেরও কোনও চিহ্ন নেই। সব উধাও।
লঞ্চটার নানান জায়গায় ভাঙচুরের চিহ্ন। এখানে সেখানে হাতুড়ির দাগ। কেউ যেন ভেতরের দেয়ালও পিটিয়ে পিটিয়ে ভাঙবার চেষ্টা করেছে। শোবার ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে একটা ছিন্নভিন্ন বালিশ, কেউ যেন ছুরি দিয়ে সেটাকে ফালা-ফালা করেছে। এক কোণে পড়ে আছে এক পাটি চটি। মনে হয় যেন লঞ্চটার মধ্যে একটা খণ্ডযুদ্ধ হয়ে গেছে।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, আমরা যা রিপোর্ট পেয়েছি, তাতে সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, লঞ্চটার কোনও নাম তো নেই-ই কোন দেশে তৈরি, তারও কোনও প্রমাণ নেই, মালিকের নামে কোনও কাগজপত্র নেই, কিছুতেই বোঝা যায় না। এটা কোন দেশ থেকে এসেছে। তাইতেই সন্দেহ হয়, এর সঙ্গে স্পাইং-এর কোনও সম্পর্ক আছে।
বিমান বলল, এত বড় লঞ্চ নিয়ে একা একা কেউ সুন্দরবনে স্পাইং করতে আসবে? কেন, আমাদের সুন্দরবনে গোপন কী আছে?
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, আমাদের এখানে স্পাই আসবে কেন? মনে হয়, কোনও বিদেশি স্পাই জাপান বা চিনে গিয়েছিল, তারপর হঠাৎ সে কোথাও নেমে যায় কিংবা কেউ তাকে খুন করে জলে ফেলে দেয়। তারপর খালি লঞ্চটা ভাসতে ভাসতে এখানে চলে এসেছে!
কাকাবাবুর কপালটা কুঁচকে গেছে। তিনি গম্ভীরভাবে কিছু ভাবছিলেন। এবার মুখ তুলে বললেন, আমি যা সন্দেহ করছিলুম তা-ই ঠিক! মনে হচ্ছে এই লঞ্চটা কার আমি তা জানি।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য চমকে উঠে বললেন, আপনি জানেন?
কাকাবাবু বললেন, তোমাদের পুলিশদের থিয়োরি তো এই যে, লঞ্চের মালিক খুন বা উধাও হয়ে গেছে অনেক আগেই। এখানে খালি লঞ্চটা ভাসতে ভাসতে এসে ঠেকেছে। কিন্তু যদি এর উল্টোটা হয়?
অৰ্থাৎ?
এমনও তো হতে পারে যে এই লঞ্চের মালিক কোনও কারণে নিজেই এসে পড়েছিল এখানে। হয়তো তার ইঞ্জিনের গণ্ডগোল হয়েছিল কিংবা তেল ফুরিয়ে গিয়েছিল–
হ্যাঁ, কাকাবাবু, সেটা অসম্ভব নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একটা লোক এক এক এত বড় একটা লঞ্চ নিয়ে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াবে কেন? এই লঞ্চে বেডরুম মোটে একটা, বিছানাও একটা, সুতরাং একজনের বেশি লোক ছিল না। অবশ্য, একা একা কেউ কেউ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে রেকর্ড করার চেষ্টা করে। ফ্রান্সিস চিচেস্টার যেমন।
চিচেস্টার লঞ্চে যাননি, পাল-তোলা নৌকোয় গিয়েছিলেন।
সে যাই হোক। কিন্তু সে রকম কোনও অভিযাত্রীর কথা তো শিগগির শোনা যায়নি।
সন্তু হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, রেডিওটা কোথায়?।
কাকাবাবু সন্তুর দিকে ফিরে প্রশংসার চোখে তাকালেন। তারপর বললেন, গুড কোয়েশেচন! ছেলেটার বেশ বুদ্ধিাশুদ্ধি হচ্ছে দেখছি। সত্যিই তো, রেডিওটা কোথায়? ফরেস্ট অফিসার যখন প্ৰথম এই লঞ্চটা দেখে, তখন লঞ্চে কোনও মানুষ ছিল না, কিন্তু রেডিও চলছিল। ফরেস্ট অফিসার কি এই লঞ্চ থেকে কিছু নিয়ে গেছে?
না। হি শুড নট। তার রিপোর্টেই দেখা গেছে, তখন লঞ্চে আর কিছু সব লুট টি হয়ে গেছে। স্থানীয় লোকেরাই লুটপুটে নিয়েছে নিশ্চয়ই।
বিমান বলল, অন্য সব কিছু নিল, কিন্তু রেডিওটা নিল না কেন? কাকাবাবু বললেন, রেডিওটা নিশ্চয়ই ইন-বিল্ট। বাইরে থেকে দেখা যায় না। দেয়ালের গায়ে কোথাও সুইচ আছে, সেটা খুঁজতে হবে।
সবাই মিলে খানিকটা খোঁজাখুঁজির পর সন্তুই প্রথম খুঁজে পেল। রান্নাঘরের দেওয়ালেই রয়েছে পর পর তিনটি নিব। তার মধ্যে প্রথম নবটা ঘোরাতেই শুরু হল খুব জোরে বাজনা।
কাকাবাবু খুব মন দিয়ে সেই বাজনা শুনতে লাগলেন।
বিমান বলল, দেখা যাচ্ছে, এখানে কারা যেন হাতুড়ি দিয়ে দেয়াল ভাঙার চেষ্টা করেছে। কিন্তু রেডিওর আওয়াজ শুনেও তারা রেডিও খোঁজার চেষ্টা করল না? ওই যে ওপরে জালমতন দেখা যাচ্ছে, ওর মধ্যেই বসানো আছে। রেডিওটা।
কাকাবাবু বললেন, এই লঞ্চে ডাকাতি হয়েছে অন্তত দুতিনবার। প্রথমবার এসেছিল বড় ডাকাতরা, যারা লঞ্চের মালিককে মেরেছে আর দামি দামি জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার এসেছে ছিচকে ডাকাতরা, তারা যেখানে যা পেয়েছে তাইই নিয়েছে।
বিমান জিজ্ঞেস করল, আপনি কী করে বুঝলেন, দুতিন বার চুরি-ডাকাতি হয়েছে? একবারেই তো সব নিয়ে যেতে পারে?
যে-ডাকাতরা মানুষ মারে, তারা রান্নার বাসনপত্র কিংবা চেয়ার-বেঞ্চি পর্যন্ত নেয় না। একটা জিনিস লক্ষ করেছ, এই লঞ্চে একটা চেয়ার পর্যন্ত নেই। খাবারের টেবিল আছে, তারও চেয়ার নেই। এগুলো সব কোথায় গেল?
রণবীর ভট্টাচার্য বললেন, আমিও কাকাবাবুর সঙ্গে একমত। খালি লঞ্চ দেখে যে পেরেছে সে-ই একবার উঠে এসে দেখে গেছে, আর হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই নিয়ে চলে গেছে।
বিমান বলল, তাহলে তারা রেডিওটা নিল না কেন?
কাকাবাবু বললেন, এর একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে। এই লঞ্চের মালিককে যখন মেরে ফেলা হয়, তখন রেডিওটা চলছিল। তারপর প্রোগ্রাম বন্ধ হয়ে যায়, রেডিও আপনি চুপ করে যায়। দ্বিতীয় দল যখন আসে, তখন রেডিও চুপ করে ছিল। তাই তারা রেডিও যে আছে তা বুঝতে পারেনি। আমরা অনেক সময় রাত্তিরবেলা রেডিও বন্ধ করতে ভুলে যাই, পরদিন সকালে আপনাআপনি রেডিও বেজে ওঠে!
সন্তু জিজ্ঞেস করল, এখন রেডিওটা বন্ধ করে দেব?
কাকাবাবু বললেন, না।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাজনা থেমে গিয়ে ঘোষণা শুরু হল। কিন্তু দুবোধ্য কোনও বিদেশি ভাষা, ইংরেজি নয়। সন্তু তার একবৰ্ণও বুঝতে পারল না।
কাকাবাবু বিমানকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কোন ভাষা বলতে পারো? তুমি তো অনেক দেশে যাও।
বিমান বলল, ঠিক ধরতে পারছিনা। জার্মান নাকি?
রণবীর ভট্টাচার্য বললেন, না, না, জার্মান নয়, যতদূর মনে হচ্ছে এটা সুইডিশ ভাষা!
কাকাবাবু বললেন, তোমার অনুমানই ঠিক। এটা সুইডিশ ভাষা, স্টকহলম, গোথোনবুর্গ এইসব জায়গার নাম শোনা যাচ্ছে। তা হলে আর কোনও সন্দেহ রইল না। এই বোটের মালিক ইংগামার স্মেল্ট!
তিনি কে?
বাইরে স্পিডবোটের আওয়াজ পাওয়া গেল। কাকাবাবু বললেন, চা এসে গেছে। আগে চা খেয়ে নেওয়া যাক।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, চা ওরা এখানে নিয়ে আসবে। আপনি বলুন ইংগামার স্মেল্ট কে? আপনি তাকে চিনতেন?
কাকাবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, না, তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি কখনও। ইশ, এরকম একজন মানুষের এই বীভৎস পরিণতি হল? সুন্দরবনের কয়েকটা ডাকাতের হাতে ওইরকম একজন মহান মানুষের জীবনটা গেল?
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, ইংগামার স্মেল্ট? মহান মানুষ? অথচ আমি তার নাম শুনিনি? ভদ্রলোক জাতে সুইডিশ?
কাকাবাবু বললেন, পৃথিবীর লোক এই সব ভাল-ভাল মানুষের কথা বড় তাড়াতাড়ি ভুলে যায়। ইংগামার স্মেল্ট সুইডেনের লোক হলেও কিছুদিন আমেরিকায় ছিলেন। বিরাট বৈজ্ঞানিক। যে বছর ভিয়েৎনামে যুদ্ধ শুরু হয়, সেই বছর নোবেল প্ৰাইজের জন্য ওঁর নাম প্ৰস্তাব করা হয়েছিল। উনি সেই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। উনি বলেছিলেন, কোনও বৈজ্ঞানিকের আবিষ্কার যুদ্ধের অস্ত্র তৈরি করার কাজে লাগানো যাবে না। তিনি পৃথিবীর সব বৈজ্ঞানিকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন, যেন কেউ-ই আর কোনও দেশের সরকারকে অস্ত্ৰ বানাতে সাহায্য না করে
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, হ্যাঁ, এই ঘটনা কাগজে পড়েছিলুম। সেই সময়। কিন্তু ভদ্রলোকের নাম মনে ছিল না।
কাকাবাবু বললেন, ইংগামার স্মেল্ট-এর কথা নিয়ে কয়েকটা দিন পৃথিবীর সব কাগজে হৈ-চৈ হয়েছিল, তারপর এক সময় চাপা পড়ে গেল। কিছুদিন পরে লোকে তাঁর কথা ভুলেই গেল। রাগে, দুঃখে, অভিমানে স্মেল্ট নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন।
স্পিডবোটের চালক আর পুলিশ কনস্টেবলটি একটি কেট্লি আর কয়েকটা গেলাস নিয়ে এল। তারপর সেই গেলাসে কালো কুচকুচে চা ঢালল।
স্পিডবোটের চালক জিজ্ঞেস করল, স্যার, আপনারা কখন ফিরবেন? রাত হয়ে গেলে তো মুশকিল হবে! আকাশের অবস্থা খারাপ, আবার ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে। ডাকাতেরও ভয় আছে।
চায়ে চুমুক দিয়ে রণবীর ভট্টাচার্য বললেন, তোমরা বাইরে একটু অপেক্ষা করো! আমি একটু বাদে বলছি। মধুকর লঞ্চটাকে সারা রাত থাকতে হবে কেন? জোয়ার আসছে কখন?
জোয়ার তো আসতে শুরু করেছে, কিন্তু লঞ্চ তবু নড়ছে না। অন্য লঞ্চ এনে ওটাকে টানা দিতে হবে?
একখানা ছোট লঞ্চ উদ্ধার করার জন্য আরও দুটো লঞ্চ লাগবে? ভাল ব্যাপার! যাও, এখন বাইরে গিয়ে বসো। আমাদের দরকারী কথা আছে।
ওরা চলে যেতেই রণবীর ভট্টাচাৰ্য কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, হাঁ, তারপর? আপনি বুঝলেন কী করে যে, এটা সেই স্মেন্ট সাহেবের লঞ্চ? সুইডেনের অন্য কোনও লোকেরও তো হতে পারে? তা ছাড়া রেডিওতে সুইডিশ প্রোগ্রাম হচ্ছে বলেই যে সেখানকার লঞ্চ, তাও জোর দিয়ে বলা যায় না। গান-বাজনা শোনার জন্য লোকে কাঁটা ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে অন্য অনেক দেশের Ceia. Gosgoi i
কাকাবাবু বললেন, বছর কয়েক আগে আমি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় একটা লেখা আর ছবি দেখেছিলুম। ঠিক এই রকম একটা লঞ্চের ছবি। ওরা লিখেছিল, ইংগামার স্মেল্ট সেই লঞ্চে করে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পৃথিবীর কোনও দেশের বৈজ্ঞানিকই তাঁর ডাকে সাড়া দেয়নি বলে তিনি ঠিক করেছিলেন, তিনি আর কোনও দেশেরই নাগরিক থাকবেন না। পৃথিবীর বড় বড় সমুদ্রগুলি এখনও ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার, তা কোনও দেশের এলাকার মধ্যে পড়ে না। তিনি ঠিক করেছিলেন, জীবনের বাকি কয়েকটা দিন তিনি সেই জলে জলেই কাটিয়ে দেবেন।
বিমান বলল, অদ্ভুত প্রতিজ্ঞা তো!
পৃথিবীতে দুচারজন মানুষ এখনও এরকম অদ্ভুত হয় বলেই মানুষের জীবনে এখনও বৈচিত্ৰ্য আছে। নইলে সব মানুষই তো একরকম হয়ে যেত।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কিন্তু অতদিন জলের ওপর ভেসে থাকলে ওঁর খাবার ফুরিয়ে যাবে না?
খাবার তো ফুরিয়ে যাবেই, তার চেয়েও বড় সমস্যা হল পানীয় জলের। সমুদ্রের জল তো খাওয়া যায় না! সেইজন্য মাঝে-মাঝে উনি কোনও বন্দরে এসে কিছু খাবার-দাবার আর মিষ্টি জল সংগ্রহ করে নিতেন। একলা বুড়ো মানুষ, ওঁর বেশি কিছু লগত না।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, আপনি ছবছর আগে খবরটা দেখেছিলেন? এতদিন ধরে উনি সমুদ্রের বুকে ভাসছেন? এতদিন যে কেউ ওঁকে মেরে ফেলেনি, সেটাই তো আশ্চর্য ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোকের মৃত্যু হল। কিনা আমাদের দেশে এসে! যাই হোক, আপনার কথায় তবু একটা সূত্র পাওয়া গেল। এখন সুইডেনে খবর পাঠালে সেখানকার সরকার নিশ্চয়ই কিছু খোঁজ দিতে পারবে। লঞ্চটাও আমরা সেখানে ফেরত পাঠিয়ে দেব! তা হলে এখন ফেরা যাক?
কাকাবাবু বললেন, সেই ভাল। তোমরা ফেরার ব্যবস্থা করো। আমি আজ রাতটা এখানে থাকব।
আপনি এখানে থাকবেন? কেন?
এতদূর যখন এসে পড়েছি, তখন দুএকটা জিনিস সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাই। ইংগামার স্মেল্ট-এর মৃতদেহটা পাওয়া যায়নি কেন?
মৃতদেহ পাওয়া যাবে কী করে? এ জায়গাটা সমুদ্রের এত কাছে, এখানকার সব কিছুই সমুদ্রে ভেসে চলে যায়। কিংবা ডেডবডির সঙ্গে যদি ইট-পাথর বেঁধে ফেলে দিয়ে থাকে, তাহলে কোনওদিনই তা ভেসে উঠবে না।
ইংগামার স্মেল্ট পণ্ডিত লোক ছিলেন। এই সব পণ্ডিতরা লেখাপড়া বাদ দিয়ে কিছুতেই থাকতে পারেন না। নিশ্চয়ই তাঁর এই বোটে অনেক দামি দামি বই ছিল, এই ছবছর তিনি হয়তো লিখেছিলেন অনেক কিছু, সে সবই হারিয়ে গেল?
খুবই দুঃখের কথা, কিন্তু কিছুই তো নেই দেখছি। সাধারণ চোর-ডাকাতরা কি ওই সব জিনিসের দাম ঝোঝে? বোধহয় এমনিই সব জলে ফেলে দিয়েছে।
একজন নিরীহ, নিষ্পাপ, জ্ঞানতপস্বী বৃদ্ধ, তাঁকে যারা মারে, তারা কি মানুষ না পশু? কী-ই বা এমন মূল্যবান জিনিস ছিল এখানে?
কাকাবাবুর গলার আওয়াজটা এমন হয়ে গেল, যেন তাঁর খুব আপনজন কেউ মারা গেছে। সন্তুর হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল। একজন মানুষ পৃথিবীর সব কিছু ছেড়ে দিয়ে শুধু জলে জলে ভাসছিলেন, তাঁকে লোভী মানুষেরা বাঁচতে দিল না!
একটুক্ষণ সবাই চুপ করে রইল, তারপর রণবীর ভট্টাচার্য বললেন, একটা যখন কু পাওয়া গেছে, তখন অপরাধীরা ধরা পড়বেই। কালকেই বড় পুলিশ পার্টি আনিয়ে এতল্লাটাপুরো সার্চ করবে। চলুন, কাকাবাবু, আজ আমরা ফিরে যাই। এখন সওয়া ছটা বাজে। এখনও স্টার্ট করলে আমরা রাত দশটার মধ্যে ক্যানিং পৌঁছে যেতে পারব।
তোমরা এগিয়ে পড়ে তা হলে। আর দেরি করে লাভ নেই। বিমানের পরশু ডিউটি, সন্তুর পড়াশুনো আছে-
আপনি এখানে একা থেকে কী করবেন?
কিছুই না। এমনিই থেকে যাই। স্পিডবোটটা পাঠিয়ে দিও কাল সকালে, এদিকে একটু ঘোরাফেরা করব।
না, না, আপনার এখানে একা থাকা চলবে না। খাওয়া-দাওয়ার কিছু নেই। তা ছাড়া এখানে থাকলে বিপদ হতে পারে। চোর-ডাকাতরা যে আবার আসবে না। তাই-ই বা কে বলতে পারে? আমার জন্য চিন্তা কোরো না। আমার কীরকম একটা ধারণা হয়ে গেছে, আমার কেউ ক্ষতি করতে পারবে না। কতবার কত রকম বিপদে পড়েছি। কিন্তু প্ৰাণটা তো যায়নি। এখানে আর কী হবে? আর খাওয়া-দাওয়ার কথা বলছ? এক রাত্তির আমি না খেয়ে চমৎকার কাটিয়ে দিতে পারি।
না, না কাকাবাবু, আপনাকে এখানে একা রেখে যাওয়া অসম্ভব! চলুন, চলুন এবার
শোনো, রণবীর, আজ যদি চলে যাই, কাল আর ফিরে আসা হবে না। ইংগামার স্মেল্ট-এর সত্যি কী পরিণতি হল, তা না জেনেই চলে যাব? এইসব মহান মানুষের কাছে কি আমাদের কোনও ঋণ নেই? কিছু একটা না করলে আমি শান্তি পাব না।
তা হলে এক কাজ করা যাক। আমিও থেকে যাই আপনার সঙ্গে। সন্তু আর বিমানবাবু ফিরে যাক স্পিডবোটটা নিয়ে।
সন্তু আর বিমান একসঙ্গে বলে উঠল, না, না, তা হতেই পারে না! আমরাও তা হলে থাকব।
কাকাবাবু বললেন, কিন্তু বিমানের তো পরশু ডিউটি।
বিমান বলল, আমার কাল যে-কোনও সময় ফিরলেই হবে। এমনকী, পরশু আমার দুপুর দুটোয় রিপোর্টিং, যদি দেড়টার মধ্যে দমদম এয়ারপোর্টে পৌঁছতে পারি, তাহলেই চলবে। এখন আপনাদের ফেলে আমি যেতে পারব না!
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে থুতনিতে টোকা দিতে দিতে চিন্তিতভাবে বললেন, রাত্তিরে আমরা সবাই মিলে এখানে থাকব? খাবার-দাবার কিছু নেই, তা ছাড়া আমার জরুরি কাজ আছে! কাকাবাবু, আপনি মুশকিলে ফেললেন দেখছি!
আমি তো বলছি, তোমরা সবাই ফিরে যাও! আমি একলা থাকলে কোনও অসুবিধে হবে না।
সে তো আউট অফ কোশ্চেন! তা হলে থাকাই যাক! অনেকদিন এমন কষ্ট করে রাত কাটাইনি। একটা নতুনত্বও হবে?
সিঁড়ির কাছে গিয়ে তিনি হাঁক দিলেন, ওহে, শোনো এদিকে!
স্পিডবোটের চালক ওপর থেকে উঁকি দিয়ে বলল, কী বলছেন, স্যার?
রাত হয়ে গেছে, এখন ফেরা কি ঠিক হবে? আবার যদি ডাকাতরা হামলা করে? তুমি বলো, সে রকম সম্ভাবনা আছে?
বড় নদীর ওপর দিয়ে খুব স্পিডে চলে গেলে কেউ ধরতে পারবে না। আমাদের। অবশ্য দূর থেকে গুলি করতে পারে।
পারে? গুলি করতে পারে? অন্ধকারে জঙ্গলের ভেতর থেকে যদি বন্দুকের গুলি চালায়, তা হলে তো গেছি! না, না, এত কুঁকি নিয়ে রাত্তিরবেলা যাওয়া ঠিক নয়। থেকেই যাওয়া যাক, কী বলো।
আপনি যা বলবেন, স্যার!
খাওয়া-দাওয়ার কী হবে? ওই লঞ্চে চা-চিনি যথেষ্ট আছে তো? সারা রাত শুধু চা খেয়ে থাকব!
পুলিশ কনস্টেবলটি বলল, চা-চিনি আছে, আর কিছু চাল আছে, স্যার।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য উৎসাহিত হয়ে বললেন, চাল আছে? তবে আর কী! নুন নেই? আলু নেই?
নুন আছে, স্যার। আলু নেই।
ইশ। আলু থাকলে ফেনাভাত আর আলুসেদ্ধ চমৎকার খাওয়া যেত। ঠিক আছে। শুধু ফেনাভাতই সই! রাত্তিরে একেবারে খালি পেটে আমি থাকতে পারি না। ওই লঞ্চের সারেংকে বলে। আজ আমাদের ফেনাভাত খাইয়ে দিক, কাল আমি ওদের মুর্গির মাংস খাওয়াব।
ঠিক আছে, স্যার!
আর দ্যাখো তো, ওই লঞ্চে একটা শতরঞ্চি আছে কি না। এই লঞ্চে একটু বসবারও উপায় নেই।
তারপর আপন মনেই হেসে উঠে তিনি বললেন, কে জানে, আমি রাত্রে না ফিরলে আমার খোঁজে আবার একটা লঞ্চ এসে হাজির হয়। কিনা! আসে তো আসুক!