ক্ষতবিক্ষত
ক্ষতবিক্ষত অবস্থা। ছেড়ে কথা বলিনি। ওরাও যেমন ঝেড়েছে, আমরাও সঙ্গে সঙ্গে রিটার্ন ঝাড় দিয়েছি। ঢাকাই শাড়ি, ব্লাউজ পিস দিয়ে কর্তা-গিন্নি একটা সন্দেশের একটুখানি ঠুকরে রাজহাঁসের মতো প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে বেরিয়ে গেল। বছরে এই একবার পুজোর আগে দেখা হয়। ক্রমশই যত বড়লোক হচ্ছে, ততই দূরে সরে যাচ্ছে। আগে চেহারা ছিল কঞ্চির মতো, এবারে দেখছি একজোড়া গ্যাসবেলুন। আগে খড়খড় করে হাঁটত এখন হাঁটে থেবড়ে থেবড়ে। একালের রাজনীতি একেবারে মা লক্ষ্মী। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে পারলেই প্রোমোটার। বাথরুমেও মোবাইল গান গাইছে, জিন্দেগি এক সফর।
সেদিন শ্মশানে। একজনকে চুল্লিতে ঢোকাচ্ছে। চাদরের তলায় হঠাৎ মোবাইলের জল-তরঙ্গ। এ কী রে? তাঁর স্ত্রী সাশ্রু নয়নে বললেন, সঙ্গে দিয়ে দিয়েছি। কোথায় যাচ্ছে কে জানে? সেখানে এসি-অ্যাটাচাড-বাথ ঘর পাবে কি না কে জানে। কানে তুলো ঢোকাবার সময় বলে দিয়েছি, হ্যাঁ গো! যেখানেই থাকো, এই মোবিল দিয়ে দিলুম, কনট্যাক্ট কোরো।
ঢাকাই মেরে বেরিয়ে গেছে, মারো জামদানি।
অনেক দাম।
বেচে দাও।
কী বেচব?
ফ্যান-ফোন-ফ্রিজ। যো কুছ হ্যায়। ইজ্জত কি সওয়াল!
বোম্বাইয়ের বাবু ছেলে-মেয়েদের বিদেশি মাল লড়িয়েছে। এরিকশন।
চলো ক্যামাক স্ট্রিট। কিনে আমি ডিকিনশন। ওর তো দুটো!
চারটে।
চারটে কী করে হয়! একটা যমজ হল যে!
এইভাবে বাড়লে আমি কী করতে পারি! ওর পেট্রলের টাকা। আমার যে কোরোসিন, হাতে হারিকেন। ঠিক হ্যায়, করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে। ভেঙে ফেলো।
কী ভাঙব?
একটা ফিক্সড ভেঙে ফেলো।
সেই ভীতিপ্রদ মানুষটির আবির্ভাব। সদা উৎফুল্ল। সবসময় মুখে ঠোসা জর্দা-পান। কোনও কথাই বোঝার উপায় নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে কানেকশান। পয়সার মা-বাপ নেই। চারশো টাকার ইলিশ একাই খেয়ে ফেলে। হজমের দায়িত্ব নিজের ওপর না রেখে বিলিতি এজেন্সিকে দিয়ে রেখেছে। ডেলি এক বোতল।
গত বছর এক ডজন বাংলাদেশি পাঞ্জাবি দিয়েছিল। এক-একটার এক-একরকম ডিজাইন। ছাত্রজীবনে আমাকে সবাই বলত, খ্যাংরাকাঠির মাথায় আলুরদম। অভিজ্ঞ বন্ধু অ্যাডভাইস। দিলে, বিয়ে করে ফেল। বিয়ের জল পড়লেই মোটা হয়ে যাবি। চাকরি পেয়েই সাততাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেললুম। রোগা-বউ দেখতে দেখতে গুজরাতি হাতি হয়ে গেল, আমি রইলুম যে কে সেই।
ভায়রার দেওয়া পাঞ্জাবি পরে একদিন রাস্তায় বেরোনো মাত্রই রকের ছেলেদের আওয়াজ পাঞ্জাবির মাথায় আলুরদম। তাড়াতাড়ি পালিয়ে এসে বড় আয়নার সামনে দাঁড়ালুম। বেঠিক। কিছু বলেনি। ক্ষুদ্র মানুষ। ভুড়ি নেই। পাঞ্জাবির স্কুল এত বড় যে পায়ের পাতা দুটো দেখা যাচ্ছে খালি। যেন নাইটি পরেছি। ঘাড় তো নয় বকের গলা। তার ওপর তে-এঁটে মাথা ফিট করা। নাম রাখা যেতে পারে আশ্রয়দাতা পাঞ্জাবি।
সেই ভায়রা এলেন। আতঙ্কে আছি, এইবার ঝুলি থেকে কী বেরোয়! সেই পাঞ্জাবি! একটা পাঞ্জাবি আবার খামে ভরা। পেপার ঘোসার মতো পেপার-থিন পাঞ্জাবি। একটা শাড়ি বেরোল। শাড়িটার নাম চোষা।
মেরে গেল বেধড়ক মার। পালটা মার কী মারা যায়। স্বামী, স্ত্রী দুজনে বসে ভাবছি। তোমার বোন বিয়ে না করলে, এরকম বিপদে পড়তে হত না। বীভৎস ভায়রা ভাই।
তুমি বিয়ে করলে কেন?
মোটা হব বলে। সিলিং ফ্যানটা খুলে দিয়ে আসব, কিংবা ওয়াশিং মেশিনটা!
ও-সব ওদের অনেক আছে। এক-একটা ঘরে চারটে করে পাখা। তিনটে ওয়াশিং-মেশিন। তার মধ্যে একটা পবিত্র।
বাকি দুটো অপবিত্র!
পবিত্রটায় পুজো করার কাপড় কাচা হয়। বাকি দুটোর একটা মেল একটা ফিমেল।
ওয়াশিং মেশিন-এর মেল, ফিমেল!
একটায় ছেলেদের আর একটায় মেয়েদের জামাকাপড় কাচা হয়!
ভদ্রলোকের এইরকম বিকট টাকাপয়সা হল কী করে?
ব্যবসা করে। তোমার মতো পড়ে পড়ে নাক ডাকলে তোমার মতোই অবস্থা হবে। সারাটা জীবন নাকে কান্না।
তোমাকে দিয়ে দিলে কেমন হয়। পুজোর সময় শাড়ির পর শাড়ি, আর আমার মাথার চুল খাড়া। চক্ষুলজ্জায় আমাকে দু-একজন দেয় বটে, একটা পাজামা, একটু ফতুয়া পাঞ্জাবি। হাটের মাল।
পাড়ার প্যান্ডেলে গিয়ে মাকে জানালুম, মা! এর একটা বিহিত করো। অসুরের বদলে আমাকেই যে মেরে শেষ করে দিলে মা।
স্বপ্নে মা এলেন, বাবা নান্টু!
বলো মা।
আমাকে তো আসতে হবেই বাবা। আমি যে এখন করপোরেট। তুই একটা কাজ কর, সামনের বার, তোর বউকে শাড়ি দিলে, তুই তাকে একটা গামছা দিস। ভালো করে প্যাক করবি, ভেতরে একটা চিরকুটে লিখে দিবি, তোমার সিক্ত গাত্রে গামছার দিব্য-স্পর্শ অনুভব করে পুলকিত হও। ঘটেও গামছা, তোমাকেও গামছা।
গামছাটাই আমাদের অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি। গামছাই আমাদের ধর্ম। পুরোহিত গামছাতেই চাল-কলা বাঁধেন। গায়েহলুদে গামছা। শ্রাদ্ধেও গামছা।
গামছার পোশাক বিদেশেও যাচ্ছে।