ক্রান্তিকাল (Krantikaal) : 06
পরদিনও সুবর্ণার কলেজে যাওয়া হল না। তবে রাজীবকে জানিয়ে হরেনের সঙ্গে দেবীকে স্কুলে পাঠিয়ে দিল। হরেনই তাকে ছুটির পর বাড়ি নিয়ে আসবে।
বিকেলের দিকে তিনটে ট্যাক্সিতে করে বারজন মানসিক ভারসাম্যহীন নিরাশ্রয় মহিলা ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ চলে এল। তাদের নিয়ে এসেছেন মনোরমা। অধিকারী এবং বন্দনা সাহা। দু’জনে প্রায় সমবয়সী। মনোরমার মতো বন্দনাও ঝাড়া হাত-পা মানুষ, কোনওরকম পিছুটান নেই। প্রতাপপুর মিউনিসিপ্যালিটিতে ভাল। চাকরি করতেন। সেটা ছেড়ে দিয়ে এখন নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর ডেপুটি সেক্রেটারি। নারী কল্যাণ ছাড়া আর কিছু বোঝেন না।
প্রথমে খবর দেওয়া হয়েছিল এগারো জন আসবে। পরে জেল থেকে জানানো হয় সংখ্যাটা এগারো নয়, বারো। অর্থাৎ একজন বেশি। যা ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাতে বাড়তি একটি মহিলার জন্য অসুবিধা হবে না।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর নিচে নেমে অপেক্ষা করছিল সুবর্ণা। মনোরমাদি মহিলাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। ছবি মালাকার, সন্ধ্যা ভট্টাচার্য, মালতী রায়, নলিনী সেন, পদ্মা কর্মকার, জবা মণ্ডল, গোপালীবালা সাহা, তারা সর্দার, লতিকা মৈত্র, বিন্দুবাসিনী দাস, পার্বতী বর্মন এবং পারুল দে। এদের বয়স তিরিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে।
তিনজন বাদে অন্যদের মোটামুটি সুস্থই মনে হল সুবর্ণার। তবে কেমন যেন জড়সড়, উদ্বিগ্ন, ভীত। অদৃশ্য খোলের ভেতর নিজেদের গুটিয়ে রেখেছে তারা। বিনা অপরাধে দীর্ঘকাল জেলে কাটিয়ে মুক্তি পাওয়ার পর নিরাপত্তাহীনতায় হয়তো ভুলছে। হয়তো ওরা শুনেছে মাসখানেক ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ আশ্রয় পাবে। তারপর কোথায় যাবে জানে না। যাদের সামনে শুধুই অন্ধকার, তাদের চোখে মুখে এইরকম নৈরাশ্য, উৎকণ্ঠা আর আড়ষ্টতা বুঝি সর্বক্ষণই লেগে থাকে। বাকি তিনজনকে একেবারেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। বিশেষ করে পারুল দে নামের মহিলাটিকে। বছর চল্লিশেক বয়স হলেও বেশ সুশ্রী এবং স্বাস্থ্যবতী। চোখের দৃষ্টিতে একটা অদ্ভুত উগ্রতা। সে মাথাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারিদিক দেখছিল।
একতলার চারটে বেডরুমে খাট পেতে রাখা হয়েছিল। তিনটে ঘরে চারজন করে মহিলা থাকবে। নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর যে দু-তিনজন কর্মী এই মহিলাদের দেখাশোনা করবে বাকি ঘরটা তাদের জন্য। রান্নার দু’জন লোক থাকবে বাড়ির পেছন দিকে যে পড়ো সার্ভেন্টস কোয়ার্টারগুলো রয়েছে তার একটা ঘরে। নীচের তলাটা সাফ করার সময় ওটাও সামান্য মেরামত করে বাসযোগ্য করে তোলা হয়েছে।
এক মাসের অতিথিদের জন্য আগেই পরটা আর আলু ভাজা করে রেখেছিল রান্নার লোকেরা। তাদের চা করতে বলে মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরগুলো ঘুরিয়ে দেখাল সুবর্ণা।
মনোরমা এবং বন্দনা, দু’জনেই বললেন, চমৎকার ব্যবস্থা হয়েছে। ওঁরাই ঠিক করে দিলেন আশ্রিতারা কে কোন ঘরে থাকবে।
মহিলারা কাপড়ের ব্যাগে বা টিনের সুটকেসে জামাকাপড় এবং টুকিটাকি কিছু জিনিস নিয়ে এসেছিল। ব্যাগ-ট্যাগগুলো তারা গুছিয়ে রাখল।
প্রতিটি ঘরের সঙ্গেই অ্যাটাচড বাথরুম। সুবর্ণা প্রতিটি ঘরে গিয়ে মহিলাদের সেগুলো দেখিয়ে বলল, আপনারা হাত-মুখ ধুয়ে নিন। চা-খাবার আসছে।
কিছুক্ষণ পর হল-ঘরে রান্নার লোকেরা মেয়েদের চা আর খাবার দিয়ে গেল। ওদের সঙ্গ দেবার জন্য মনোরমা, বন্দনা আর সুবর্ণা এক কাপ কার চা নিল।
কাপে চুমুক দিয়ে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করল, মেয়েদের সব সময় দেখাশোনার জন্য কারা আসবে মনোরমাদি?
মনোরমা বললেন, নমিতা আর তাপসী।
নমিতা সান্যাল আর তাপসী বসু নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর সক্রিয় কর্মী। দু’জনেই চাকরি করে। সুবর্ণা বলল, কিন্তু নমিতার স্কুল আর তাপসীর অফিস আছে। ওরা। কি টানা একমাস এখানে পড়ে থাকতে পারবে?
না না, অতদিন ওদের পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। ওরা দশদিনের ছুটি নিয়েছে।
তারপর?
মনোরমা জানালেন নমিতা আর তাপসীর পর দশদিনের জন্য আসবে পরমা এবং মমতা, তারপর সুরভি আর অঞ্জলি। তিনি যাদের নাম করলেন তারাও চাকরি-বাকরি করলেও নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর সঙ্গে আন্তরিকভাবে যুক্ত। প্রতাপপুর সিটির এরকম বহু মেয়ের মধ্যেই সমাজসেবার বীজ বুনে দিয়েছেন মনোরমা।
সুবর্ণা বলল, কই, নমিতা আর তাপসী তো এখনও এল না?
হাতের ঘড়ি দেখে মনোরমা বললেন, এখন পৌনে পাঁচটা বাজে। ছ’টার ভেতর ওরা চলে আসবে।
কথা বলছিল ঠিকই, তবে সুবর্ণার চোখ ছিল মহিলাদের দিকে। সে লক্ষ করল, পারুল ছাড়া বাকি সবাই খাচ্ছে। পারুল পরটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে মেঝেতে ফেলছে, পরক্ষণে তুলে থালায় রাখছে। কখনও বা চায়ের কাপে জল ঢেলে দিচ্ছে। তার মুখে পাগলাটে, শব্দহীন হাসি।
সুবর্ণা পারুলকে কী বলতে যাচ্ছিল, মনোরমা থামিয়ে দিয়ে বললেন, ও যা করছে, করতে দাও। বাধা দিও না, কিছু বোলোও না। জেল থেকে বলে দিয়েছে যখন খিদে পাবে, ঠিক খেয়ে নেবে। ওর কোনও ব্যাপারে বাধা দিলে ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে।
এমন একটা মহিলাকে বাড়িতে রাখা প্রচণ্ড ঝুঁকির ব্যাপার। কখন, কী কারণে হঠাৎ খেপে উঠবে, কে জানে। ভেতরে ভেতরে একটু ভয়ই পেয়ে গেল সুবর্ণা।
মনোরমা তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভেবো না, ওকে তোমার দেখতে হবে না। তাপসী আর নমিতাকে বুঝিয়ে দিয়ে যাব; ওরা ঠিক সামলে নেবে।
সুবর্ণা মনে মনে আরাম বোধ করল। মাথা হেলিয়ে দিয়ে বলল, আচ্ছা
মনোরমা এবার বললেন, ওরা খেতে থাক। চল, তোমার শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসি।
রাজীবকে আগেই জানানো হয়েছিল চারটে নাগাদ মেয়েদের নিয়ে মনোরমা এ বাড়িতে আসবেন এবং দোতলায় গিয়ে সংগ্রামনারায়ণের সঙ্গে কথা বলবেন। রাজীব বলেছিল, মনোরমা দোতলায় ওঠার আগে তাকে যেন জানিয়ে দেওয়া হয়। সুবর্ণা বলল, আপনি একটু বসুন। বাবা দুপুরে ঘুমোন তো। দেখে আসি জেগেছেন। কিনা। মনোরমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওপরে উঠে গেল সে।
রাজীব শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে এলোমেলো পায়চারি করছিল। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ তাঁর খাটে ঘুমোচ্ছিলেন। আর সংগ্রামনারায়ণ অন্য দিনের মতো তার বেডরুমের জোড়া জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখছিলেন।
সুবর্ণা নিঃশব্দে, পা টিপে টিপে রাজীবের কাছে এসে চাপা গলায় বলল, ওরা এসে গেছে।
রাজীব বলল, হ্যাঁ, অনেকের গলা শুনতে পাচ্ছি।
মনোরমাদি এখন দোতলায় আসবেন।
ঠিক আছে, আসুন না’
চিন্তিতভাবে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করল, আপনি—মানে–
রাজীব একটু হেসে বলল, সেটা ভেবে রেখেছি। আপনাদের যে অস্ত্রশালা আছে সেখানে ঢুকে দরজা বন্ধ করে থাকব।
সেই ভাল।
আপনার মনোরমাদি কতক্ষণ থাকবেন?
কতক্ষণ আর, ম্যাক্সিমাম কুড়ি পঁচিশ মিনিট।
ঠিক আছে, ওঁকে নিয়ে আসুন।
যেভাবে এসেছিল তেমনি চুপিসারে নিচে নেমে গেল সুবর্ণা। মিনিট তিন-চারেক বাদে মনোরমাকে সঙ্গে করে ফের যখন ওপরে উঠল শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে রাজীবকে দেখা গেল না। চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ করল, ডান পাশে রাজবংশের প্রাচীন অস্ত্রশালার দরজা ভেতর থেকে আটকানো।
সুবর্ণা হল-ঘর পেরিয়ে সংগ্রামনারায়ণের ঘরের কাছে এসে ডাকল, বাবা–
শীতের সূর্য দূরের গাছপালার আড়ালে অনেকখানি নেমে গেছে। শুধু মাথার দিকের সামান্য একটা রক্তিম ফালি চোখে পড়ছে।
সন্ধের আগে আগে এই সময়টায় অঘ্রাণের মিহি কুয়াশা বিষাদের মতো নেমে আসছিল প্রতাপপুর সিটির ওপর।
সুবর্ণার কণ্ঠস্বর কানে যেতে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালেন সংগ্রামনারায়ণ। তার পাশে মনোরমাকে দেখে খুশি হলেন। কয়েক পা এগিয়ে এসে বললেন, বাইরে দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে এসো। প্রতাপপুর সিটির এই একটি মাত্র মানুষ, বয়সে ছোট হলেও, তাকে মনে মনে শ্রদ্ধা করেন তিনি। মনোরমাকে দেখলে তার দুচোখ স্নিগ্ধ, নরম হাসিতে ভরে যায়।
মনোরমাকে বসতে বলে সংগ্রামনারায়ণ খাটে বসলেন। সুবর্ণাকে বললেন, ওকে চা মিষ্টি টিষ্টি দিয়েছ বৌমা?’
মনোরমা বললেন, আপনি ব্যস্ত হবেন না মেসোমশাই। আমার চা খাওয়া হয়ে গেছে। আপনি কেমন আছেন বলুন।
সংগ্রামনারায়ণ হাসলেন, দু-তিনটে হার্ট-অ্যাটাকের পর যেমন থাকা উচিত তার চেয়ে অনেক ভাল আছি। সুবর্ণাকে দেখিয়ে বললেন, বৌমা সেবাযত্ন করে আমার আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছে।
একসময় প্রচণ্ড ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে সুবর্ণাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। এখন প্রশংসা করে তার কিঞ্চিৎ ক্ষতিপূরণ করতে চাইছেন কি সংগ্রামনারায়ণ? বিয়ের পর চোদ্দ বছর কেটে গেছে। এই প্রথম ওঁর মুখে এ ধরনের কথা শুনল সুবর্ণা।
মনোরমা সস্নেহে বললেন, হ্যাঁ। ওর মতো মেয়ে হয় না। একটু চুপ করে থেকে ফের গম্ভীর গলায় শুরু করলেন, মেসোমশাই, আপনার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
কীসের কৃতজ্ঞতা?
আপনি নন-ক্রিমিনাল মেয়েগুলোকে আশ্রয় না দিলে ওদের নিয়ে খুব মুশকিলে পড়ে যেতাম।
আমাদের একতলাটা ফাঁকা পড়ে আছে। ক’টা নিরাশ্রয় মেয়ে না হয় থাকলই। সংগ্রামনারায়ণ বলতে লাগলেন, আমার লজ্জাটা কোথায় জানো? মেয়েরা এখানে থাকছে আর তোমরা তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করছ। আমাদের প্যালেসে এমন ঘটনা আগে আর কখনও ঘটেনি।
মনোরমা বিব্রত বোধ করলেন, এ নিয়ে মন খারাপ করবেন না মেসোমশাই। আমরা মেয়েদের জন্যে নানা জায়গা থেকে সাহায্য পাই। নিজেদের পয়সা তো খরচ করতে হয় না।
সংগ্রামনারায়ণ বিষণ্ণ একটু হাসলেন; কিছু বললেন না। মেয়েদের আশ্রয় দেবেন, অথচ খাওয়াতে পারবেন না–তার রাজকীয় মর্যাদায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে।
আরও কিছুক্ষণ পর মনোরমা বিদায় নিলেন। সুবর্ণা তার সঙ্গে নিচে নেমে এল। নমিতা আর তাপসী ছ’টার মধ্যে চলে এসেছিল। মনোরমা তাদের সঙ্গে মহিলাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, এখন থেকে তোমরা এদের দেখাশোনা করবে। সুবর্ণা তো আছেই। আশা করি কোনও প্রবলেম হবে না। রোজ না পারলেও দু-একদিন পরপর আমি বা বন্দনা এসে দেখে যাব।
সুবর্ণাদের হাতে বারোটি মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলার দায়িত্ব তুলে দিয়ে মনোরমা আর বন্দনা চলে গেলেন।
তারপরও কিছুক্ষণ একতলায় কাটিয়ে ওপরে উঠে গেল সুবর্ণা। তার চোখে পড়ল, রাজীব শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে বসে আছে। অর্থাৎ মনোরমা নিচে নামার পর সে অস্ত্রাগার থেকে বেরিয়ে এসেছিল।
রাতে দেবীকে পড়িয়ে, সংগ্রামনারায়ণ এবং শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে খাইয়ে অন্য দিনের মতো আজও ডাইনিং টেবলে খেতে বসেছিল রাজীব আর সুবর্ণা।
খেতে খেতে রাজীব বলল, আপনার রেসপনসিবিলিটি অনেক বেড়ে গেল মিসেস সিংহ। বাড়ির এতগুলো ডিউটি রয়েছে, কলেজ আছে, তার ওপর এই মহিলারা এসেছে। কী করে যে সামলাবেন ভেবে পাচ্ছি না।’
সুবর্ণা একটু হেসে বলল, একটা মাস তো। দেখতে দেখতে কেটে যাবে।
আশ্রিতা মহিলাদের সম্বন্ধে আবার কী বলতে যাচ্ছিল রাজীব, তাকে থামিয়ে সুবর্ণা বলল, আমার কথা তো সবই বলেছি, নিজের চোখেও অনেকটাই দেখেছেন। আপনার সম্পর্কে এখনও প্রায় কিছুই জানা হয়নি আমার।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল রাজীব। তারপর যেন মনস্থির করে বলল, খুব কৌতূহল হচ্ছে?
সুবর্ণা বলল, সেটা স্বাভাবিক কিনা আপনিই বলুন। এক সঙ্গে কয়েক দিন আছি। নিজেই বলেছেন, আমাকে আর অবিশ্বাস করেন না। আপনার দ্বিধা থাকার কথা নয়।
ঠিক আছে। হয়তো বুঝতে পেরেছেন রাজীব আমার আসল নাম নয়। সেটা আর নর্থ-ইস্টের কোথায় আমাদের বাড়ি–এই দু’টো ছাড়া আর সবই বলছি।
অর্থবান বলতে যা বোঝায় রাজীবরা আদৌ তা নয়। মোটামুটি উচ্চ মধ্যবিত্ত বলা যেতে পারে। তার বাবা একটা স্টেট গভর্নমেন্টের ডেপুটি সেক্রেটারি ছিলেন, কয়েক বছর আগে রিটায়ার করেছেন। মা ছিলেন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অ্যাসিস্টান্ট হেড মিস্ট্রেস। তিনি বেঁচে নেই, প্যাংক্ৰিয়াসে ক্যানসার হয়ে মারা গেছেন।
রাজীবরা দুই ভাই, এক বোন। সে সবার ছোট। দাদা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, স্ত্রী আর এক ছেলেকে নিয়ে দিল্লিতে থাকে। সে ওখানকার একটা বড় ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে বেশ উঁচু পোস্টে আছে। দিদি থাকে বাঙ্গালোরে। জামাইবাবু ব্যাঙ্ক অফিসার। ওদের এক ছেলে, এক মেয়ে। দিদিও একটা মাল্টিন্যাশনাল ফার্মে চাকরি করে।
রাজীবদের বাড়ির প্রায় সবারই হায়ার এডুকেশন কলকাতায়। বাবা স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে ইংরেজিতে এম. এ করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দাদা যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ত। মা এবং দিদি ছিলেন লেডি ব্রাবোর্নের ছাত্রী। পরে কলকাতা থেকেই এম. এ পাস করেছে। মা হিস্ট্রিতে, দিদি বাবার মতোই ইংরেজিতে।
মা-বাবা দাদা-দিদির মতো রাজীবও পড়ত কলকাতায়–প্রেসিডেন্সি এবং সায়েন্স কলেজে। ওখান থেকে ফিরে গিয়ে কয়েক বছর একটা কলেজে পড়িয়েছে। সে। আগে থেকেই নর্থ-ইস্টের প্রতি বৈষম্য এবং ঔদাসীন্য ওই অঞ্চলে একটা অগ্নিগর্ভ পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। অসংখ্য যুবক তখন হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। সর্বত্র বাতাসে বারুদের গন্ধ। সমস্ত এলাকা নিদারুণ অস্থিরতার মধ্যে চলছে। এই সময় রাজীবের মনে হয়েছিল তারও কিছু একটা করা দরকার। কলেজ ছেড়ে সে একদিন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল।
প্রায় গোটা নর্থ-ইস্ট জুড়ে পুলিশ তো বটেই, আর্মি প্যারা মিলিটারি আর বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল অনেক আগেই। হত্যা, মৃত্যু, অজস্র, রক্তপাত, ধরপাকড় এবং প্রবল উত্তেজনা–সব মিলিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারত প্রতিদিন উত্তাল, প্রতিদিন খবরের কাগজের শিরোনামে।
তিন চার বার আরও কয়েকজন মিলিটান্টের সঙ্গে ধরা পড়েছিল রাজীব। প্রতিবারই তারা পুলিশ বা আর্মির হাত থেকে পালিয়ে যায়। তবে খুব সহজে নয়, মুখোমুখি মারাত্মক লড়াইয়ের পর। দু’পক্ষই বেপরোয়া গুলি চালিয়েছে। কনফ্রনটেসনে মারা গেছে অনেকে। একবার হাতে, একবার পায়ে, আরেক বার কাঁধে বুলেট লেগেছিল রাজীবের। তিনবারই দু-একমাস করে বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছে। এছাড়া পুলিশ বা জওয়ানদের গুলি তার মাথা, বুক বা কানের পাশ দিয়ে কতবার যে বেরিয়ে গেছে, তার হিসেব নেই। যে কোনও মুহূর্তে তার মৃত্যু হতে পারত।
দিন কুড়ি আগে রাজীব এবং তার কয়েক জন সঙ্গী পাহাড় আর জঙ্গল-ঘেরা যে জায়গাটায় থাকত, আর্মি সেখানে একটা বড় রকমের অপারেশন চালায়। ওরা ছত্রভঙ্গ হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। জওয়ানদের একটা জিপ তাকে দেখতে পেয়ে পিছু নেয়। রাজীব ঘন জঙ্গলে ঢুকে উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ুতে থাকে। তিনটে জওয়ান জিপ থেকে নেমে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে চালাতে তার পিছু নেয় কিন্তু কিছুক্ষণ পর ওরা আর তাকে খুঁজে পায় নি।
জঙ্গল আর পাহাড় ডিঙিয়ে পথ হারিয়ে ক’দিন আগে রাজীব প্রতাপপুর সিটিতে ঢুকে পড়েছিল। কিন্তু সে এখানে আসার আগেই খুব সম্ভব স্থানীয় থানাকে তার ছবি পাঠিয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়। সেদিন প্রতাপপুর পুলিশের তাড়া খেয়ে সে প্যালেসে জোর করে ঢুকে পড়েছিল।
একটানা সব বলে জোরে শ্বাস টানল রাজীব। একটু হেসে বলল, এই হল আমার লাইফ হিস্ট্রি।
একটা চমকপ্রদ দমবন্ধ-করা কাহিনী যেন শুনছিল সুবর্ণা। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে সে। একসময় অবরুদ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করে, আপনার মা তো নেই। বাবা, দাদা বা দিদির সঙ্গে দেখা হয়?
ইমপসিবল। বছর খানেক আগে বাবাকে লাস্ট দেখেছিলাম। দাদা আর দিদিকে কতদিন যে দেখি না!
সুবর্ণা কিছু বলল না।
রাজীব বলে, বুঝতেই পারছেন নানা হাইড-আউটে লুকিয়ে থাকতে হয়।
পুলিশ আর জওয়ানরা ব্লাড হাউন্ডের মতো আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। দাদা আর দিদি অনেক দূরে থাকে। তাদের সঙ্গে দেখা হওয়া মুশকিল কিন্তু বাড়ি গিয়ে বাবাকে যে দেখে আসব, সেটাও ভীষণ রিস্কি।
সুবর্ণা বলল, ওঁদের জন্যে কষ্ট হয় না?
রাজীব বিষণ্ণ হাসে, হা, হয়। আপনার কি ধারণা, আমার সব হিউম্যান ফিলিংস নষ্ট হয়ে গেছে।
প্রথম যেদিন আমাদের বাড়ি ঢুকেছিলেন, আপনি কিন্তু বলেছিলেন মানবিক কোনও অনুভূতি আপনার নেই।
রাজীব চমকে ওঠে, খুব অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বলে, হ্যাঁ, বলেছিলাম। তখন প্রাণ বাঁচানোর জন্যে একটা শেলটারের দরকার ছিল। তাই
তার কথাগুলো যেন শুনতে পাচ্ছিল না সুবর্ণা। হঠাৎ বলে ওঠে, আপনি কখনও কোনও জওয়ান, পুলিশ বা অন্য কাউকে–মানে–’বলতে বলতে থেমে যায়।
তীক্ষ্ণ চোখে সুবর্ণাকে লক্ষ করতে করতে রাজীব বলে, মার্ডার করেছি কিনা? যদি হিউম্যান ফিলিংস থাকে, করলাম কী করে? এটাই জানতে চাইছেন তো?’
সুবর্ণা উত্তর দেয় না।
রাজীব বলে, আপনি যদি কোনও একটা বড় লক্ষ্যের জন্যে যুদ্ধ করেন আর হাতে যদি রাইফেল থাকে তখন কত কী-ই তো ঘটে যেতে পারে। তবে সেন্সলেস কিলিং আমি পছন্দ করি না।
সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, তেমন কিছু কি ঘটছে না? খবরের কাগজে দেখি মুক্তিপণ আদায়ের জন্যে কত লোককে কিডন্যাপ করা হচ্ছে। এসব লক্ষ্যে পৌঁছুতে কতটা সাহায্য করে?
স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে রাজীব। বেশ কিছুক্ষণ বাদে বলে, এত বড় একটা ব্যাপার; দু-চারটে ভুল হতেই পারে।
সুবর্ণা কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই একতলায় প্রচণ্ড হইচই শোনা গেল। পরক্ষণে সিঁড়িতে দুপদাপ আওয়াজ। কারা যেন ঝড়ের বেগে ওপরে উঠে আসছে। সেই সঙ্গে নমিতা আর তাপসীর চিৎকার ভেসে এল, সুবর্ণাদি-সুবর্ণাদি, ওকে ধরুন, ধরুন–
চমকে রাজীব এবং সুবর্ণা মুখ ফিরিয়ে তাকায়। এক সঙ্গে দু’টো করে সিঁড়ি টপকাতে টপকাতে ল্যান্ডিংয়ের কাছে চলে এসেছে সেই মহিলাটি যার নাম পারুল। তার মুখে শব্দহীন, খ্যাপাটে হাসি, চোখে ঘোর-লাগা, হিংস্র দৃষ্টি। পারুলকে ধরার জন্য তার পেছন পেছন দিশেহারার মতো উঠে আসছে নমিতারা।
সুবর্ণা এতটাই হতবুদ্ধি হয়ে পড়ছিল যে কী করবে ভাবতে পারছিল না। রাজীব কিন্তু বসে থাকল না, নিজের অজান্তেই যেন লাফ দিয়ে উঠে সিঁড়ির দিকে ছুটল। পারুল দোতলায় আসার আগেই তাকে ধরে টানতে টানতে নিচে নামিয়ে নিয়ে গেল।
এদিকে হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠছিল সুবর্ণা। সেও ঊর্ধ্বশ্বাসে একতলায় নেমে এসেছে। ততক্ষণে রাজীব জোর করে পারুলকে একটা সোফায় বসিয়ে দিয়েছে। নমিতা আর তাপসী একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য মহিলারা ধারে কাছে নেই। নিজেদের ঘরের দরজার আড়াল থেকে শঙ্কাতুর চোখে পারুলদের দেখছে। হরেনকেও হল-ঘরের একধারে দেখা গেল।
সুবর্ণা তাপসীদের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন সুরে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? এত চেঁচামেচি কীসের?’ পারুলকে দেখিয়ে বলল, এ হঠাৎ দোতলার দিকে যাচ্ছিল কেন?
তাপসী খুবই সাহসী মেয়ে। তবু চিন্তিতভাবে বলল, জানি না। ভীষণ ভায়োলেন্ট হয়ে উঠছিল। একবার বাইরের দরজা খুলে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল, আমরা যেতে দিইনি। একে কী করে সামলাব, বুঝতে পারছি না। হরেনকে দেখিয়ে বলল, উনি আমাদের হেল্প করতে এসেছিলেন, আঁচড়ে কামড়ে রক্ত বার করে দিয়েছে।
হরেন নিঃশব্দে তার দু’হাত সামনে বাড়িয়ে ধরল। সে দু’টো সত্যিই রক্তাক্ত। কনুই থেকে হাতের পাতা পর্যন্ত অনেকগুলো ক্ষতচিহ্ন চোখে পড়ল।
তাপসী থামেনি, কোনওরকমে তিনজনে ধরে তো নিয়ে এলাম। তারপর হঠাৎ দোতলার দিকে দৌড় দিল–’
এই সময় অন্য যে মেয়েরা ঘরের ভেতর ছিল তাদের মধ্যে দু-তিনজন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
চকিত হয়ে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার, ওরা কাঁদছে কেন?
নমিতা বলল, জানি না। তখন আপনি চলে গেলেন, তারপর মাঝে মাঝেই কেঁদে উঠছে। জানতে চাইলে কিছু বলে না।
সুবর্ণা বলল, এ তো ভারি সমস্যার ব্যাপার।
এদিকে পারুল আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে বাইরের দরজার দিকে দৌড় লাগাল। তাপসীরা চেঁচিয়ে ওঠে, পালিয়ে যাচ্ছে, পালিয়ে যাচ্ছে–
কেউ কিছু করে ওঠার আগেই রাজীব বিদ্যুৎগতিতে ছুটে গিয়ে পারুলকে ধরে নিয়ে আসে। জোর করে বসিয়ে দিতে দিতে বলে, কেন সবাইকে এত হয়রান করছেন?
পারুলের পরনের শাড়িটা আলুথালু, চুল উসকো-খুসকো। চোখে মুখে অদ্ভুত পাগলাটে একটা হাসি ফুটে উঠেছে। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে সে চিৎকার করতে থাকে, বেশ করছি–বেশ করছি–
প্রচণ্ড জোরে ধমকে ওঠে রাজীব, চুপ, একদম চুপ। ফের অসভ্যতা করলে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখব।
হঠাৎ ভীষণ কুঁকড়ে যায় পারুল, ভয়ার্ত গলায় বলে, না না, আমাকে বেঁধে না।
খাওয়া হয়েছে?
পারুল উত্তর দেয় না। তাপসী জানায়, ফেলে ছড়িয়ে সামান্য কিছু খেয়েছে।
রাজীব পারুলকে বলল, যান, শুয়ে পড়ুন গিয়ে—
বাধ্য মেয়ের মতো নিজের জন্য নির্দিষ্ট ঘরটিতে চলে যায় পারুল।
হঠাৎ সুবর্ণার মনে হল, রাজীব সম্পর্কে তাপসীদের নিশ্চয়ই কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক। তারা প্রতাপপুর রাজবংশ সম্পর্কে সব জানে। শুনেছে, এ বাড়িতে কেউ বিশেষ আসে না। সুবর্ণার দু-একজন কলিগ বা নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর কর্মীরা এলে নিচে থেকে তার সঙ্গে দেখা করে চলে যায়। মনোরমা আর বন্দনা ছাড়া অন্য কারও ওপরে যাওয়ার হুকুম নেই। যেখানে এ জাতীয় অলিখিত, কঠোর নিয়ম চালু রয়েছে সেখানে অপরিচিত একটি নোক কবে এ বাড়িতে এল, সুবর্ণাদের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক–তাপসীদের মনে এ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। কথায় কথায় ওরা বাইরের কাউকে যদি রাজীবের কথাটা বলে ফেলে তা নিয়ে সমস্যা দেখা দেবে। সুবর্ণার হঠাৎ মনে হল, তাপসীদের তো বটেই, কাল মনোরমাদি আর বন্দনাদি এলে ওঁদেরও জানিয়ে দেবে। কেননা রাজীব সম্পর্কে মনোরমাদিদের কাছে গোপনীয়তা শেষ পর্যন্ত রাখা যাবে না। পারুলের মতো অস্বাভাবিক, খ্যাপা মেয়েকে সামলে যে তাদের দুশ্চিন্তা কমিয়ে দিয়েছে তার কথা না বলে পারা যাবে না।
হঠাৎ যেন মরিয়া হয়ে উঠল সুবর্ণা। রাজীবের ব্যাপারে তার স্নায়ুমণ্ডলী ক’দিন ধরে প্রচণ্ড একটা চাপের মধ্যে রয়েছে। যে কোনও মুহূর্তে সেগুলো ছিঁড়ে পড়বে। সুবর্ণা যেন ক্রমশ অথৈ জলে ডুবে যাচ্ছে। উৎকণ্ঠা, ভয়, অস্বাচ্ছন্দ্য–সব মিলিয়ে এমন একটা অবস্থা যে সে আর পেরে উঠছে না। প্রাণপণে হাতের মুঠি শক্ত করে তার ভেতর রাজীবকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। মুঠিটা ক্রমশ আলগা হয়ে যাচ্ছে।
রাজীব সম্পর্কে তাপসীরা যাতে বাড়তি কৌতূহল প্রকাশ করে না বসে বা মনে কোনওরকম সংশয় না রাখে সে জন্য ওদের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিল সুবর্ণা।
তাপসী রাজীবকে বলল, আপনাকে কী বলে যে কৃতজ্ঞতা জানাব ভেবে পাচ্ছি না। আপনি না থাকলে আমরা ভীষণ বিপদে পড়ে যেতাম।
রাজীব বলল, কী আর এমন করেছি। এর জন্যে আবার কৃতজ্ঞতা কেন?
নমিতা বলল, সুবর্ণাদি, আমি অন্য একটা কথা ভাবছি।
সুবর্ণা জানতে চাইল, কী?
রাত বেশি হয়নি, আপনারা জেগে ছিলেন, তাই রাজীবদা পারুল দে’কে সামলাতে পেরেছে। কিন্তু মাঝরাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে যদি আবার ঝামেলা করে?
এমন একটা সম্ভাবনার কথা ভেবে দেখেনি সুবর্ণা। তাকে চিন্তিত দেখায়। বলে, ও যে ধরনের মহিলা–করতে পারে।
তখন কী হবে?
রাজীব এই সময় বলে ওঠে, আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমি রাত্তিরে এখানে থাকতে পারি। কড়া না হলে ওর খ্যাপামি বন্ধ করা যাবে না।
নমিতা এবং তাপসীর দুশ্চিন্তা অনেকখানি কেটে যায়। একসঙ্গে তারা বলে ওঠে, তা হলে তো আমরা বেঁচে যাই। আপনি থাকলে পারুল দে আর গোলমাল করতে সাহস পাবে না। আপনার ধমক ধামক শুনে ভীষণ ঘাবড়ে গেছে।
রাজীব বলল, আমি হল-ঘরে সোব। হরেনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, একটা তালা পাওয়া যাবে?
যাবে। হরেন দৌড়ে গিয়ে নিজের ঘর থেকে তালা চাবি নিয়ে এল। অবাক হয়ে রাজীবকে লক্ষ করছিল সুবর্ণা। বলল,তালা দিয়ে কী হবে? রাজীব বলল, আমি সারা রাত অ্যালার্ট থাকতে চেষ্টা করব। যদি ঘুমিয়ে পড়ি আর সেই ফাঁকে মহিলাটি পালানোর চেষ্টা করে তাই বাইরের দরজাটা ভেতর থেকে তালা দিয়ে রাখতে চাই। চলুন, ওপর থেকে আমার বিছানা নিয়ে আসি।
সিঁড়ি ভেঙে পাশাপাশি দোতলায় উঠতে উঠতে সুবর্ণা বলল, আপনার এত বড় একটা রিস্ক নেওয়া উচিত হয়নি।
কীসের রিস্ক?
পারুল যখন ওপরে উঠে আসছিল তখন দৌড়ে গেলেন কেন?
আমি না গেলে ওকে কি ঠেকানো যেত?
কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হয়ে যেত। এখন অনেকেই আপনাকে দেখে ফেলল। মানে–
রাজীব বলল, আমার সিকিউরিটির কথা নিশ্চয়ই ভাবছেন? আস্তে মাথা নাড়ল সুবর্ণা। রাজীব বলল, লুনাটিক মেয়েগুলোর মানসিক যা অবস্থা তাতে আমার সম্বন্ধে মাথা ঘামাবে না। দুই সোশাল ওয়ার্কার নমিতা আর তাপসী বিশ্বাস করেছে আমি আপনাদের আত্মীয়। তাছাড়া দরজা ভেতর থেকে তালা দেওয়া থাকবে। আমার ধারণা কোনওরকম প্রবলেম হবে না। একটু থেমে বলল, আসলে–
কী?
সমস্ত দিন কত ব্যস্ততার মধ্যে থাকেন। তবু এতগুলো মহিলার দায়িত্ব নিয়েছেন। ভাবলাম, চুপচাপ তো বসেই থাকি। যে ক’দিন এখানে আছি, আপনাকে যদি একটু সাহায্য করতে পারি–
সবিস্ময়ে রাজীবের দিকে তাকায় সুবর্ণা। একজন ভয়াবহ বিচ্ছিন্নতাবাদী যে বেতাদের নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর কাজে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসবে, ভাবা যায়নি।
গভীর, আন্তরিক গলায় সে বলল, মোস্ট ওয়েলকাম–
দু’জনে সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলায় চলে আসে।
নিরপরাধ, মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলারা ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ আসার পর রাজীবের নির্দেশমতো একতলার বাইরের দিকের দরজাটা ভেতর থেকে তালা দিয়ে রাখা হচ্ছে। কেউ এসে ডাকাডাকি করলে বা কড়া নাড়লে নাম জিজ্ঞেস করে হরেন তালা খোলে। মনোরমাদি বা বন্দনাদি ছাড়া বাইরের অন্য কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থাটা মহিলাদের জন্য তো বটেই, তার চেয়েও অনেক বেশি করে রাজীবের জন্য।
সুবর্ণা লক্ষ করেছে, প্রথম দুদিন শুধু রাতটাই একতলায় কাটিয়ে এসেছে। রাজীব। পরে খাওয়ার সময়টুকু ছাড়া দিনরাত ওখানেই থাকছে। ক্রমশ আশ্রিতা
মহিলাগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছিল সে। বুঝতে পারছিল দীর্ঘকাল অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা আর অকারণে জেল খাটার ফলে অদ্ভুত মানসিক রোগ এদের সমস্ত অস্তিত্বের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে। এরা কেউ সারাক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে। কেউ অবসাদগ্রস্ত, কেউ ধন্দ-ধরা বা অত্যন্ত বিমর্ষ, কেউ চাপা করুণ সুরে কেঁদে যায়। পারুলের মতো দু-একজন আছে যারা মাঝে মাঝেই খেপে ওঠে। এদের সঙ্গ দিয়ে, মজার মজার গল্প বলে, নতুন নতুন আশার কথা শুনিয়ে স্বাভাবিক করে তুলতে চেষ্টা করছে রাজীব।
মনোরমাদি আর বন্দনাদির সঙ্গে এর মধ্যে তার আলাপ হয়েছে। রাজীব সুবর্ণাদের আত্মীয়, এটুকু জেনেই তারা সন্তুষ্ট। সে রোগগ্রস্ত মেয়েদের জন্য দিবারাত্রি পরিশ্রম করছে, সে জন্য কৃতজ্ঞও। খবরের কাগজে যে সন্ত্রাসবাদীর ছবি বেরিয়েছে সেটার সঙ্গে গোয়েন্দাদের মতো তার চেহারা মিলিয়ে দেখার চিন্তাও করেন নি ওঁরা। আসলে নারী কল্যাণ ছাড়া মনোরমাদিদের অন্য কোনও দিকে নজর নেই।
সুবর্ণা রাজীবকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। যে নিষ্ঠুর, বিচ্ছিন্নতাবাদী একদিন জোর করে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ ঢুকে পড়েছিল তার সঙ্গে এখানকার হৃদয়বান, সেবাপরায়ণ রাজীবের কোনও মিল নেই। আগাগোড়া সে বদলে যাচ্ছে।
সকালের দিকে ততটা সময় পায় না সুবর্ণা। কিন্তু বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে সংগ্রামনারায়ণ, দেবী আর শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের খাওয়ার ব্যবস্থা করে, দেবীকে পড়তে বসিয়ে নীচে নেমে আসে। বিকেলে চা খাবার টাবার সে একতলায় রাজীব এবং আশ্রিতা মহিলাদের সঙ্গে বসে খায়। তারপর কাজ শুরু হয়ে যায়। রাজীব আর সে নানাভাবে মহিলাগুলোকে আনন্দে রাখতে চেষ্টা করে।
যা সুবর্ণার বলার কথা, মাঝে মাঝে সেটাই বলে ফেলে রাজীব, মিসেস সিংহ, আপনার শ্বশুর আপনাকে একদিন চরম অপমান করেছে। আপনার হাজব্যান্ড জঘন্যভাবে বিট্রে করেছে। জীবনে অলমোস্ট কিছুই পাননি। আপনার মধ্যে রাগ ছাড়া আর কিছুই থাকার কথা নয়। তবু মানুষের জন্যে এত মায়া রয়েছে কী করে?
সুবর্ণা সামান্য হেঁসে বলে, এটা তো আমিও আপনার সম্বন্ধে বলতে পারি।’
একটু হকচকিয়ে যায় রাজীব। বলে, কীরকম?
উত্তর না দিয়ে সুবর্ণা যেন দূরমনস্কর মতো বলে যায়, আসলে এ এমন এক দেশ, যতই ঘৃণা বা ক্ষোভ থাক, কেউ বোধহয় কাউকে ফেলে চলে যেতে পারে না। অদৃশ্য এক বন্ধন তাদের জড়িয়ে ধরে রাখে। একটু থেমে বলে, করুণা, মমতা, উদারতা, যাই বলুন এটাই ভারতবর্ষের আসল দিক।
রাজীব উত্তর দেয় না।
মহিলারা আসার পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে।
তারপর একদিন মাঝরাতে নিচে প্রচণ্ড হইচই শুনে দোতলা থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে নেমে এল সুবর্ণা।
হল-ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে রাজীব, তার হাতে হ্যান্ড-কাফ। তাকে ঘিরে রয়েছে দশ পনেরো জন আর্মড পুলিশ। প্রতাপপুর থানার ওসি রামেশ্বর বসাক এবং পারুল দে-কে একধারে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। অপ্রকৃতিস্থ, খ্যাপাটে পারুল এখন আশ্চর্য রকমের স্বাভাবিক। অন্য মহিলারা পুলিশ দেখে ভয়ে, আতঙ্কে ঘরে খিল দিয়ে চেঁচামেচি করছে। নমিতা, তাপসী এবং হরেন। বিহ্বলের মতো রামেশ্বরদের দেখছে।
স্তম্ভিত সুবর্ণা সিঁড়ির তলায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তার দিকে নজর পড়তে এগিয়ে এলেন রামেশ্বর। বললেন, মিসেস সিংহ, আমার প্রথম থেকেই ধারণা ছিল ওই মিলিটান্টটা প্রতাপপুর প্যানে’-এ শেলটার নিয়ে আপনাদের হোস্টেজ করে রেখেছে। কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। পারুলকে দেখিয়ে বললেন, তাই আমাদের এই অফিসারটিকে নন-ক্রিমিনাল লুনাটিকদের সঙ্গে এখানে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। সামনের দিকের দরজায় সারাক্ষণ তালা লাগানো থাকে কিন্তু মিলিটান্টটা পেছন দিকের দরজার কথাটা মাথায় রাখেনি। কিছুক্ষণ আগে পারুল দে ওটা খুলে দিয়েছিল। তখন মিলিটান্টটা ঘুমোচ্ছে। পাঁচ মিনিটের ভেতর আমাদের কাজ শেষ করলাম। একেবারে পিসফুল, ব্লাডলেস অপারেশন। একটা গুলিও খরচ হয়নি।’ বলে সগর্বে হাসলেন!
সুবর্ণা রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে থাকে, কিছু বলে না।
রামেশ্বর এবার জিজ্ঞেস করলেন, ওর জিনিসপত্র, মানে ব্যাগ বা সুটকেশ টুটকেশ কোথায়? আমার বিশ্বাস, সেগুলোর ভেতর প্রচুর ওয়েপন পাওয়া যাবে।
ধীরে ধীরে অসাড় একটা আঙুল তুলে দোতলাটা দেখিয়ে দিল সুবর্ণা।
রামেশ্বর বললেন, দোতলার কোথায়?
কাঁপা গলায় সুবর্ণা বলল, বাঁ দিকের শেষ বেডরুমটায়; আমার দাদাশ্বশুর যেখানে থাকেন।
রামেশ্বর একজন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই ওপরে উঠে গেলেন এবং রাজীবের সেই ঢাউস ব্যাগ এবং বাদ্যযন্ত্র রাখার মতো লম্বা খাপটা নিয়ে এসে বললেন, মিসেস সিংহ, এত রাতে আপনাদের বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। বুঝতেই পারছেন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুলিশকে অনেক অপ্রিয় কর্তব্য পালন করতে হয়। আচ্ছা চলি, নমস্কার–
রামেশ্বররা রাজবাড়িতে ঢুকেছিলেন পেছনের দরজা দিয়ে, বেরুলেন সামনে দিয়ে।
নিজের অজান্তেই তাদের সঙ্গে নিঃশব্দে দরজার কাছে চলে আসে সুবর্ণা। বাইরে তারের জাল-বসানো একটা কালো ভ্যান দাঁড়িয়ে ছিল। রামেশ্বরদের সঙ্গে সেটায় উঠতে উঠতে একবার পেছন ফিরে তাকায় রাজীব। বলে, চললাম মিসেস সিংহ। জীবনে আর হয়তো আপনার সঙ্গে দেখা হবে না।
একটু পর শীতের কুয়াশা এবং অন্ধকারে ভ্যানটা অদৃশ্য হয়ে যায়। তার পরও আচ্ছন্নের মতো অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে সুবর্ণা। রাজীবের জন্য কী অপেক্ষা করে আছে–ফাঁসি, না আমৃত্যু কারাদণ্ড? যদি কোনও দিন সে মুক্তি পায় আবার কি হাতে অস্ত্র তুলে নেবে? যার মধ্যে এই সর্বংসহ ভারতবর্ষের মতো এত করুণা, মায়া আর সহানুভূতি রয়েছে সে কি এ দেশ থেকে ছিন্ন হওয়ার কথা আবার নতুন করে ভাববে?
শীতের ঠান্ডা হাওয়া মুখের ওপর আছড়ে পড়ছে। কিন্তু কিছুই যেন টের পাচ্ছিল না সুবর্ণা।