ক্রান্তিকাল (Krantikaal) : 03
ভোরবেলায় ঘুম থেকে ওঠা সুবর্ণার চিরকালের অভ্যাস। সূর্যোদয় হয়ে গেছে, অথচ সে বিছানায় শুয়ে আছে, খুব অসুস্থ হয়ে পড়া ছাড়া এমনটা কখনও ঘটেনি।
আজকের দিনটা কিন্তু ব্যতিক্রম।
মায়ার ডাকে ধড়মড় করে উঠে সুবর্ণা দেখল, বেশ বেলা হয়েছে। পুব দিকের দুই জোড়া জানালা দিয়ে নভেম্বরের ঠান্ডা সোনালি রোদের ঢল নেমেছে ঘরের ভেতর। সকালের দিকে অন্যদিন অনেকটা সময় কুয়াশায় চারিদিক ঝাপসা হয়ে থাকে। আজ কিন্তু প্রতাপপুর সিটির বাড়িঘর, রাস্তা, গাছপালা–সব কিছু স্পষ্ট। কোথাও কুয়াশার চিহ্নমাত্র নেই।
দেবী তার আগেই উঠে পড়তে বসে গেছে। ওকে কোনওদিনই পড়ার জন্য তাড়া দিতে হয় না।
মায়া খাটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সুবর্ণা বলল, এত বেলা হয়ে গেছে। আগে ডাকো নি কেন?
মায়া বলে, তিন-চার বার ডেকে গেছি। ভাবলাম কাল ওইরকম একটা ধকল গেছে। নিশ্চয়ই ঘুমোতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। তাই আর জোর করে জাগাই। নি।
মায়া ধকলের কথা বলতে রাজীবের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে বুকর ভেতর ভয়ের ছায়া পড়ে। যতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল, একরকম কেটে গেছে। এই সকাল থেকে আবার দীর্ঘ, একটানা উৎকণ্ঠার শুরু। কিন্তু কিছুই করার নেই সুবর্ণার; অদ্ভুত এক মরণফাঁদে তারা আটকে গেছে। স্নায়ুমণ্ডলী কতকাল এই চাপ সহ্য করতে পারবে কে জানে।
বিছানা থেকে নামতে নামতে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, দেবীকে খেতে দিয়েছ?
হ্যাঁ দেবী মা’র খাওয়া হয়ে গেছে।
বাবা?
উনি শুধু চা আর দু’খানা বিস্কুট খেয়েছেন। আপনাকে খুঁজছিলেন।
মুখ টুখ ধুয়ে যাচ্ছি। বাথরুমের দিকে যেতে যেতে সুবর্ণা বলল, দাদুরও তো কিছু খাওয়া হয়নি।
মায়া বলে, কী করে হবে? আপনি জোর করে না খাওয়ালে তো খেতেই চান না।
সুবর্ণা জিজ্ঞেস করল, কাল যিনি আমাদের বাড়ি এসেছেন, তাকে চা দিয়েছ?
ত্রস্ত স্বরে মায়া বলে, না।
বাথরুমের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে যায় সুবর্ণা। বলে, কেন?
লোকটার কাছে যেতে আমার হাত-পা কাঁপে। তাই—
ঠিক আছে, তুমি সবার খাবার গুছিয়ে রাখো। আমি আসছি।
মায়া চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর মুখ ধুয়ে বাসি কাপড় বদলে কিচেনে চলে এল সুবর্ণা। একটা মস্ত ট্রেতে তিনজনের মতো ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে অপেক্ষা করছিল মায়া। সংগ্রামনারায়ণের ফ্যাটওলা খাবার খাওয়া বারণ। তার জন্য রয়েছে নরম করে সেঁকা দু-স্লাইস পাঁউরুটি, কলা, ছানা আর এক গ্লাস ঠুট জুস। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের দুই মাড়িতে একটাও দাঁত নেই, তিনি চিবোতে পারেন না। তাই তার জন্য ছানা, ফলের রস আর পাতলা সুজি। তবে রাজীবের জন্য কড়া বাটার টোস্ট, কলা, ওমলেট এবং চা।
ট্রেটা হাতে তুলে নিয়েছিল মায়া। সুবর্ণা তার হাত থেকে সেটা নিয়ে বলল, তোমাকে যেতে হবে না। আটটা বেজে গেছে। রান্না চড়িয়ে দাও।
মায়া বলল, হরেনদা নিচ থেকে জিজ্ঞেস করছিল বাজারে যেতে হবে কিনা।
ফ্রিজে মাছ-মাংস আনাজ যা আছে, আজ চলে যাবে না?
যাবে।
তাহলে বাজারে যাওয়ার দরকার নেই।
হরেনদা ফের ডাকলে তাই বলে দেব।
কী রান্না হবে তা আর জানতে চাইল না মায়া। অনেক বছর সে এখানে আছে। চারবেলা কে কী খাবে, সব তার মুখস্থ।
মিনিট পনেরো পর আমার চাটা আমার ঘরে দিয়ে যেও। বলে সোজা সংগ্রামনারায়ণের বেডরুমে চলে এল সুবর্ণা। বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে প্রতাপপুরের লোকাল বাংলা কাগজ দৈনিক দিনকাল’ পড়ছিলেন তিনি। বিকেলে এ বাড়িতে আসে কলকাতার একটা ইংলিশ ডেইলি। স্বাধীনতার পর শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটা ছোট এয়ারপোর্ট করা হয়েছে। ট্রেন আর দূর পাল্লার বাস ছাড়াও প্লেনে কলকাতার সঙ্গে এখন প্রতাপপুরের নিবিড় যোগাযোগ। দুপুরের ফ্লাইটে প্যাসেঞ্জার এবং নানা মালপত্রের সঙ্গে কলকাতার যেসব কাগজ আসে, বিকেলে সেগুলো বাড়ি বাড়ি বিলি হয়। সকালবেলা দৈনিক দিনকাল’ ছাড়া আর কোনও কাগজ নেই। স্থানীয় পত্রিকা বলে এখানকার মানুষজনের আলাদা একটা আবেগ রয়েছে। কলকাতার কাগজগুলোর মতো ছাপাটাপা বা লেখা অত ভাল না হলেও, চোখ ধাঁধানো রঙিন ছবি না থাকলেও সবাই ভাবে এটা তাদের একান্ত নিজস্ব পত্রিকা। তাই প্রতাপপুর সিটিতে দৈনিক দিনকাল’-এর প্রচুর কাটতি। প্রায় সব বাড়িতেই কাগজটা রাখা হয়।
পায়ের আওয়াজ শুনেও কাগজ থেকে চোখ সরালেন না সংগ্রামনারায়ণ। বললেন, মায়া বলছিল আজ সকালে ঘুম ভাঙতে তোমার বেশ দেরি হয়েছে। শরীর কি খুব খারাপ হয়েছিল?
সুবর্ণা ট্রে থেকে খাবারের প্লেট আর ফুট জুসের গ্লাস খাটের পাশের একটা নিচু সাইড টেবলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, না।
হাতের কাগজটা একপাশে রেখে এবার সুবর্ণার দিকে তাকালেন সংগ্রামনারায়ণ। বললেন, তোমাকে দেখে কিন্তু ভাল লাগছে না। চোখ-টোখ বসে গেছে।
অন্যদিন মুখ ধুয়ে ড্রেসিং টেবলের সামনে দাঁড়িয়ে চিরুনি দিয়ে চুল ঠিক করে নেয় সুবর্ণা। আজ বাথরুম থেকে বেরিয়েই কিচেনে চলে গিয়েছিল। আয়নায় নিজেকে দেখা হয়নি। না দেখলেও সংগ্রামনারায়ণ যখন বলছেন, নিশ্চয়ই তার চোখেমুখে কিছু একটা ছাপ পড়েছে। রাজীব এ বাড়িতে ঢোকার পর থেকে যে ভয় আর উৎকণ্ঠা শুরু হয়েছিল এটা তারই চিহ্ন।
খাবারের প্লেট নামানো হয়ে গিয়েছিল। সংগ্রামনারায়ণের খাটের আরেক ধারে উঁচু একটা টেবলে নানা আকারের সারি সারি ওষুধের শিশি আর প্যাকেট সাজানো রয়েছে। সেগুলো থেকে গোল, চৌকো, লম্বা, লাল, সবুজ, হলুদ-সব মিলিয়ে পাঁচটা ক্যাপসিউল আর ট্যাবলেট বের করে খাবারের প্লেটগুলোর পাশে রাখতে রাখতে সুবর্ণা বলল, না না, আমি ঠিক আছি।
বিয়ের পর সে যখন নিচে থাকত, সংগ্রামনারায়ণ তার সঙ্গে একটি কথাও বলেননি। কখনও সখনও একতলায় নামলে তার দিকে তাকাতেন না পর্যন্ত। তিনি নার্সিংহোম থেকে ফেরার পর দেবীকে নিয়ে সুবর্ণা দোতলায় উঠে এল। তখন অবশ্য কথা বলতেন, কিন্তু খুবই কম। যেটুকু না হলে নয়, ঠিক ততটুকুই। তবে দেবীর ব্যাপারটা বরাবরই আলাদা। সুবর্ণারা নিচে থাকার সময়ও রোজই মায়াকে পাঠিয়ে তাকে ওপরে নিয়ে যেতেন সংগ্রামনারায়ণ। রুক্ষ, কর্কশ, উগ্র একটি মানুষের ভেতর থেকে স্নেহপ্রবণ, কোমল আরেকটি মানুষ বেরিয়ে আসত। আসলে প্রতিটি মানুষের মধ্যে কত ধরনের মানুষ যে লুকানো থাকে! নানা সময়ে নানা চেহারায় বিদ্যুৎচমকের মতো তারা বেরিয়ে পড়ে।
বিক্রমের সঙ্গে ডিভোর্সের পর সংগ্রামনারায়ণ কিছুটা বদলে গিয়েছিলেন। মুখ ফুটে সেভাবে প্রকাশ না করলেও সুবর্ণার প্রতি তার হয়তো চাপা সহানুভূতি ছিল। আগের সেই উদাসীনতা, উপেক্ষা বা রূঢ়তা ক্রমশ কমে আসছিল। তাছাড়া সর্বক্ষণ যার সেবাযত্নের ওপর নির্ভর করতে হয় তার প্রতি স্বাভাবিক একটা কৃতজ্ঞতা থাকেই। বিবাহ বিচ্ছেদের পর থেকে সুবর্ণাকে কাছে বসিয়ে প্রায়ই অনেক গল্প-টল্প করেন। এটাই হয়তো তাঁর সমবেদনা প্রকাশের পদ্ধতি। আজ যে তার জন্য সংগ্রামনারায়ণকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে, কয়েক বছর আগে তা ভাবাও যেত না।
সংগ্রামনারায়ণ বললেন, ঠিক আছি বললে তো হবে না। আজ কলেজে না গিয়ে রেস্ট নাও।
সুবর্ণা জানাল আজ তার বেশ কয়েকটা ইমপর্ট্যান্ট ক্লাস আছে; কলেজে না গেলেই নয়। তারপর বলল, আপনি খান। দাদাভাইয়ের এখনও খাওয়া হয়নি। আমি যাচ্ছি–
হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় সংগ্রামনারায়ণ বললেন, তোমার সেই আত্মীয়টি ব্রেকফাস্ট করেছেন?
এখনও করেন নি। আমি তার খাবার নিয়ে যাচ্ছি।
কাল রাত্তিরে আলাপ হয়নি। ব্রেকফাস্ট হয়ে গেলে ওঁকে আমার ঘরে নিয়ে এসো।
একটু চুপ করে থেকে সুবর্ণা বলল, আচ্ছা—
বাকি খাবারসুদ্ধ ট্রেটা তুলে নিয়ে ঘর থেকে সে বেরুতে যাবে, ব্যস্তভাবে সংগ্রামনারায়ণ বললেন, একটু দাঁড়াও বৌমা–
উৎসুক চোখে তাকায় সুবর্ণা।
এই দেখ কাগজে কী সাঙ্ঘাতিক খবর বেরিয়েছে। বিছানার ওপাশ থেকে দৈনিক দিনকাল’-এর কপিটা তুলে নিয়ে আঙুল দিয়ে সংগ্রামনারায়ণ দেখাতে থাকেন, এই যে-’
খাটের কাছে এগিয়ে আসে সুবর্ণা। খবরের কাগজের প্রথম পাতায় নিচের দিকে বড় বড় হরফে পাঁচ কলমের হেডলাইন চোখে পড়ে। প্রতাপপুর সিটিতে উত্তর-পূর্ব ভারতের ভয়ঙ্কর এক সন্ত্রাসবাদীর প্রবেশ। সঙ্গে দাড়ি-টাড়িসুদ্ধ রাজীবের তিন কলমের ছবি আর স্টাফ রিপোর্টারের দীর্ঘ প্রতিবেদন।
ছবিটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে হৃৎপিণ্ড যেন জমাট বেঁধে গিয়েছিল। মাথাটা এত টলছিল যে হুড়মুড় করে সুবর্ণা পড়েই যেত, কোনওরকমে সামলে নিল।
সংগ্রামনারায়ণ বলছিলেন, কাগজে লিখেছে টেরোরিস্টটা পুলিশের তাড়া খেয়ে কাল আমাদের প্যালেসের দিকে চলে এসেছিল। এত বড় বাড়ি, কোথাও ঢুকে-টুকে বসে আছে কিনা কে জানে। একটু থেমে বললেন, কাল রাত্তিরে পুলিশ নাকি তার খোঁজে আমাদের বাড়িতে এসেছিল?
চমকে ওঠে সুবর্ণা। শ্বাসরুদ্ধের মতো জিজ্ঞেস করে, কে বললে?
সংগ্রামনারায়ণ বললেন, এই তো, রিপোর্টটায় বেরিয়েছে।
আস্তে মাথা হেলিয়ে দেয় সুবর্ণা। বলে, হ্যাঁ।
আমাকে ডাকোনি কেন?
আপনার শরীর ভাল না। ডাকলে টেনসন হত। সেটা হার্টের পক্ষে ক্ষতিকর। তাই–
চোখ কুঁচকে সংগ্রামনারায়ণ বললেন, এই যে ব্রেকফাস্ট নিয়ে এলে, এখনও তো পুলিশের খবরটা দাওনি।
ভেতরে ভেতরে একটু থমকে যায় সুবর্ণা। তারপর বলে, ভেবেছিলাম দাদাভাইকে খাইয়ে এসে বলব।
সংগ্রামনারায়ণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কাল পুলিশ এসে কী করল? বেহ সুবর্ণা বলল, একতলাটা ঘুরে ঘুরে দেখল। আমাদের সাবধানে থাকতে বলল। আর টেরোরিস্টটার ডেসক্রিপশান দিয়ে অনুরোধ করল, এমন কাউকে দেখলে তক্ষুণি যেন থানায় ফোন করি।
ঠিক আছে।
সুবর্ণা আর দাঁড়াল না। স্তব্ধ হৃৎপিণ্ডটা এখন প্রবল বেগে ওঠানামা করছে।
রোজ খুব ভোরে হকার তাদের কাগজ দিয়ে যায়। মায়া একতলা থেকে সেটা তুলে প্রথমে তার কাছে নিয়ে আসে। সকালে খুঁটিয়ে কাগজ পড়ার সময় নেই; দ্রুত পাতা উলটে উলটে হেডলাইনগুলো দেখে শুধু, তারপর সংগ্রামনারায়ণের ঘরে পৌঁছে দেয়। অবশ্য বড় রকমের চাঞ্চল্যকর কোনও খবর থাকলে পুরোটা পড়ে ফেলে। আজ দেরি করে তার ঘুম ভাঙার জন্য খুব সম্ভব মায়া কাগজটা সংগ্রামনারায়ণকে দিয়ে গিয়েছিল। আগে সুবর্ণার হাতে পড়লে ওটা সে সরিয়ে ফেলত। খবরের কাগজ না পড়লে সংগ্রামনারায়ণের পেটের ভাত যে হজম হয় না, এমন নয়। পরে যদি চাইতেন কোনও একটা অছিলা খাড়া করে এড়িয়ে যাওয়া যেত। সুবর্ণা বলত, আজ কাগজ দেয়নি বা অন্য কিছু। দৈনিক দিনকাল’-এর প্রিন্টিং মেশিনটা অনেক কালের পুরনো। মাঝে মাঝেই গোলমাল করে, তখন দু-একদিন কাগজ বেরোয় না। এই অজুহাতটা দিলে অবিশ্বাস করতেন না সংগ্রামনারায়ণ। অবশ্য কাগজটা আগে ওঁর হাতে গেলেও ততটা দুশ্চিন্তার কারণ হত না, কিন্তু রিপোর্টের সঙ্গে রাজীবের ছবিটা ছাপা হয়ে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। রাজীবকে দেখামাত্র সংগ্রামনারায়ণ চিনে ফেলবেন। তখন যে তার কী প্রতিক্রিয়া হবে ভাবতেও শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে বরফের মতো ঠান্ডা একটা স্রোত বইতে থাকে। প্রবল উৎকণ্ঠায় তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। মনে হচ্ছে রক্তচাপ হঠাৎ বিপজ্জনকভাবে কমে গিয়ে চোখের সামনের সমস্ত কিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
উদ্ভ্রান্তের মতো টলতে টলতে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে এসে একেবারে হকচকিয়ে গেল সুবর্ণা। বৃদ্ধটির ঘুম ভেঙে গেছে। তিনি মশারির ভেতর চুপচাপ বসে আছেন। অন্যদিন মায়া তাকে বিছানা থেকে তুলে মুখ ধুইয়ে পোশাক পালটিয়ে সোফায় বা ডিভানে বসিয়ে দিয়ে যায়। পরে এসে সুবর্ণা খাইয়ে দেয়। তার চমকটা শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের জন্য নয়। এই ঘরে আর যার থাকার কথা তার বদলে আরেক জন চেয়ারে বসে আছে। লোকটার মুখ নিখুঁত কামানো, চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, পরনে অ্যাশ কালারের পরিষ্কার ট্রাউজার আর সাদা শার্টের ওপর লাল উলের পুল-ওভার। বিহ্বলের মতো তাকিয়ে লোকটাকে। দেখছিল সুবর্ণা। লোকটা বলল, আমাকে চিনতে পারছেন না মিসেস সিংহ! আমি রাজীব।
মুখ থেকে দাড়ির জঙ্গল নির্মূল করলে চেহারা যে এতটা বদলে যেতে পারে ভাবা যায়নি। তাছাড়া সুবর্ণার মস্তিষ্ক গভীর উৎকণ্ঠায় ঠাসা। খুঁটিয়ে লক্ষ করার মতো মনের অবস্থা তার ছিল না। থাকলে ঠিকই চিনে ফেলত। সামান্য যুক্তিবুদ্ধি প্রয়োগ না করলে বুঝতে পারত, এ ঘরে রাজীব ছাড়া বাইরের আর কারও থাকা সম্ভব নয়। বুকের ভেতর শ্বাস যেন আটকে গিয়েছিল সুবর্ণার। আবদ্ধ বাতাসটা। ধীরে ধীরে বাইরে বের করে দিয়ে বলল, ও, আপনি!
রাজীব বলল, আজ আপনার শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে আমাকে ফর্মালি ইনট্রোডিউস করিয়ে দেবেন। কাল আমার যে ওয়াইল্ড চেহারাটা দেখেছিলেন সেই অবস্থায় তো যাওয়া যায় না। ভাববেন মোস্ট সার্টেনলি আমি একটা ক্রিমিনাল। তাই সকালে উঠেই দাড়িটাড়ি সাফ করে, কাঁচি দিয়ে মাথার পেছন দিকের চুলের গোছা কেটে, স্নান সেরে, প্যান্ট-জামা চেঞ্জ করে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।
প্রচণ্ড টেনসনের মধ্যেও সামান্য আরাম বোধ করল সুবর্ণা। কাগজে যে ছবিটা বেরিয়েছে তার সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে রাজীবের চেহারার হয়তো তেমন মিল খুঁজে পাবেন না সংগ্রামনারায়ণ। যেহেতু সুবর্ণা আত্মীয় হিসেবে তার পরিচয় দেবে তাই মিল খোঁজার চেষ্টা করবেন না। দাড়ি থাকা এবং না থাকার মধ্যে তফাত বেঅনেকটাই। কলকাতার বাইরের শহরগুলো থেকে যেসব কাগজ বেরোয়। সেগুলোর ছাপাটাপা বেশ খারাপ। রাজীবের যে ছবিটা দৈনিক দিনকাল’-এ বেরিয়েছে সেটা খুব একটা স্পষ্ট নয়। তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তি না থাকলে দাড়িওলা আর দাড়ি কামানো, ফিটফাট রাজীব যে একই লোক, ধরা মুশকিল।
রাজীব এবার বলল, আমাকে এখন আপনার আত্মীয় বলে পরিচয় দেওয়া যেতে পারে, তাই না?
তার কণ্ঠস্বরে হয়তো একটু মজা বা শ্লেষ ছিল। সুবর্ণা উত্তর দিল না। ট্রেটা একটা টেবলে নামিয়ে রেখে ক্ষিপ্র হাতে মশারি খুলে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে বাথরুমে নিয়ে গেল। তার মুখ ধুইয়ে, পোশাক বদলে একটা সোফায় এনে বসাল। রাজীবকে ব্রেকফাস্ট দিয়ে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে খাওয়াতে খাওয়াতে চাপা গলায় বলল, একটা খারাপ খবর আছে।
খেতে খেতে চমকে সুবর্ণার দিকে তাকায় রাজীব। খুব আস্তে জিজ্ঞেস করে, কী খবর?
সুবর্ণা বলল, লোকাল একটা ডেইলিতে আজ বেরিয়েছে, নর্থ-ইস্টের একজন মারাত্মক টেরোরিস্ট প্রতাপপুর সিটিতে এসে ঢুকেছে। তার ছবিও ছাপা হয়েছে। কাল আপনার যে চেহারা দেখেছিলাম তার সঙ্গে ছবিটার খানিকটা মিল আছে।
চোখের দৃষ্টি অনেকক্ষণ স্থির হয়ে রইল রাজীবের। তারপর সে জিজ্ঞেস করল, পেপারটা কোথায়?
আমার শ্বশুরমশাইয়ের কাছে।
ওটা কি দেখা যায়?
পরে দেখাব। এখন চাইতে গেলে সন্দেহ করতে পারেন।’ বলে একটু থামল সুবর্ণা। তারপর কী ভেবে বলল, কিন্তু–
রাজীব বলল, কিন্তু কী?
ওটা বেঙ্গলি ডেইলি। বাংলা পড়তে অসুবিধে হবে না?
এক সময় আমি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ আর সায়েন্স কলেজের ছাত্র ছিলাম। বাংলাটা আগেই জানতাম। কলকাতায় থাকার সময় আরও ভাল করে শিখে নিয়েছি।
সুবর্ণা চুপ করে থাকে।
রাজীব জিজ্ঞেস করে, রিপোর্টটায় কী লিখেছে?
সুবর্ণা বলল, আমি ডিটেলে পড়িনি। শুধু হেডলাইন আর ছবিটাই দেখেছি। কিছুক্ষণ ভেবে রাজীব বলল, আপনার শ্বশুরমশাই আমাকে দেখলে কি কোনওরকম প্রবলেম হতে পারে?
কোন ধরনের প্রবলেমের কথা রাজীব বলছে, বুঝতে পারছিল সুবর্ণা। সে বলল, আপনি কতটা ট্যাক্টফুল হতে পারেন, তার ওপর সব নির্ভর করছে। আমার রিকোয়েস্ট, অ্যাপিলও বলতে পারেন–এমন কোনও ঘটনা যেন না ঘটে যাতে একজন হার্ট-পেশেন্টের ক্ষতি হয়।
এটা বোধহয় কালও আপনি বলেছিলেন।
হ্যাঁ।
আপনাকে যেটুকু দেখছি, মনে হয় শ্বশুর দাদাশ্বশুর, সবাইকে খুব ভালবাসেন।
ভেতরে ভেতরে কেমন যেন থমকে যায় সুবর্ণা। সে বলে, কতটা ভালবাসি বলতে পারব না। তবে আমি সামনে থাকতে কারও ক্ষতি হোক, কিংবা একটু যত্ন করলে কেউ যদি আরও কিছুদিন ভালভাবে বেঁচে থাকে, সেটা দেখতেই হবে। মানুষ হিসাবে এটুকু করতেই হয়।
এইসব শব্দপুঞ্জ একজন উগ্রপন্থীকে, যার কাছে হত্যাটা নেহাতই জলভাতের মতো ব্যাপার, আদৌ নাড়া দেয় কি না বোঝা যায় না। রাজীব কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ টেলিফোন বেজে ওঠে। ধীরে ধীরে সেটা তুলে নিয়ে সুবর্ণা হ্যালো’ বলতেই ওধার থেকে গম্ভীর, ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, কে বলছেন?
সুবর্ণা নিজের পরিচয় দেয়।
নমস্কার ম্যাডাম। আমি রামেশ্বর বসাক।
প্লিজ একটু ওয়েট করুন। মাউথপিসে হাত চাপা দিয়ে সুবর্ণা রাজীবকে খুব নিচু গলায় বলে, ওসি।
কী জন্যে ফোন করেছে?
এখনও বলেননি।
আমার কথা উঠলে আপনাকে কী বলতে হবে, ইউ নো প্রেটি ওয়েল।
ফোনের মুখ থেকে হাত সরিয়ে সুবর্ণা বলে, বলুন মিস্টার বসাক। আমার কাছে কি কিছু দরকার আছে?
রামেশ্বর বললেন, কাল আপনাদের প্যালেসের গ্রাউন্ড ফ্লোরটা শুধু দেখে এসেছিলাম। আজ দিনের আলোয় দোতলা আর ছাদটায় যদি ভাল করে খুঁজে দেখেন–
দ্বিধান্বিতভাবে সুবর্ণা বলে, দেখেছি। কেউ নেই।
আমাদের কাছে খবর আছে, টেরোরিস্টটা প্যালেসের কাছাকাছি কোথাও আছে। কাল সন্ধে থেকেই আপনাদের ওদিকটায় প্লেন ড্রেসে পুলিশ ওয়াচ রাখছে। লোকটা অন্য কোথাও গেলে তাদের চোখে পড়ত।
ও।
আজকের কাগজটা দেখেছেন?
উত্তর দিতে গিয়ে সুবর্ণা লক্ষ করল, স্থির চোখে পলকহীন তার দিকে তাকিয়ে আছে রাজীব। সে বলল, ভাল করে দেখা হয়নি।
রামেশ্বর বললেন, ওতে টেরোরিস্টটার ছবি বেরিয়েছে। দেখে নেবেন। তা হলে লোকটাকে চিনতে সুবিধা হবে।
আচ্ছা।
পরে আবার আপনাকে ফোন করব।
ঠিক আছে।
সুবর্ণার জবাবগুলো শুনে রাজীব মোটামুটি আন্দাজ করতে পেরেছিল রামেশ্বর কী ধরনের প্রশ্ন করেছেন। তবু জিজ্ঞেস করল, ওসি অত কী বলছিল?
টেলিফোন নামিয়ে রেখে তার সঙ্গে রামেশ্বরের যা কথাবার্তা হয়েছে, সব জানিয়ে দিল সুবর্ণা। তারপর আবার শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে খাওয়াতে লাগল।
হঠাৎ ফোন আসায় খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল রাজীবের। ফের খেতে খেতে বলল, তার মানে এই প্যালেসের ওপর পুলিশ নজর রাখছে। দেখা যাচ্ছে খুব সহজে এখান থেকে বেরুনো যাবে না।
সুবর্ণা উত্তর দিল না।
ব্রেকফাস্ট করার পর রাজীব যখন চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে সেই সময় শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের খাওয়া শেষ হল। সুবর্ণা বলল, আমার শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে এখন আলাপ করতে যাবেন কি?
হা হা, নিশ্চয়ই। দ্রুত বাকি চাটুকু খেয়ে উঠে দাঁড়ায় রাজীব। সুবর্ণাও উঠে পড়েছিল। রাজীবকে সঙ্গে নিয়ে সে সংগ্রামনারায়ণের বেডরুমে চলে আসে।
ব্রেকফাস্ট শেষ করে, ক্যাপসিউল আর ট্যাবলেট খেয়ে ফের খবরের কাগজ পড়ছিলেন সংগ্রামনারায়ণ। সুবর্ণা ভয়ে ভয়ে বলল, বাবা, ওঁকে নিয়ে এসেছি। সে টের পাচ্ছিল, পা দু’টো ভীষণ কাঁপছে।
কাগজ থেকে চোখ তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ রাজীবকে লক্ষ করেন সংগ্রামনারায়ণ। তারপর সামান্য দূরে একটা ডিভান দেখিয়ে বলেন, বসুন–
বসতে বসতে রাজীব বলে, আমি রাজীব। বয়সে আপনার থেকে অনেক ছোট। আপনি করে বললে অস্বস্তি হবে।
বেশ, তুমি করেই বলব। সংগ্রামনারায়ণ বললেন, কাল বৌমা যখন তোমার কথা বলল, ওষুধের রি-অ্যাকসানে চোখ মেলে তাকাতে পারছিলাম না।
হ্যাঁ, শুনেছি।
তুমি বৌমার কিরকম যেন আত্মীয় হও?
রাজীব উত্তর দেওয়ার আগেই, চোখকান বুজে মানুষ যেমন সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়, অবিকল সেইভাবে সুবর্ণা বলে ওঠে, উনি আমার বৌদির পিসতুতো দাদা।
তার বলার ভঙ্গিটা এতই অস্বাভাবিক এবং সন্ত্রস্ত যে মুখ ফিরিয়ে একবার তাকে দেখে নিলেন সংগ্রামনারায়ণ। তারপর ফের রাজীবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় থাকো?
রাজীবের মধ্যে কিন্তু কোনওরকম চাঞ্চল্য নেই। অবিচলিত সুরে বলল, দিল্লিতে।’
চাকরি করো?
না।
তা হলে?
আপাতত কিছুই প্রায় করি না। একটা কলেজে পড়াতাম, ছেড়ে দিয়েছি।
এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করা হয়তো অশোভন মনে হল সংগ্রামনারায়ণের। তাই অন্য কথায় চলে গেলেন, দিল্লি থেকে সোজা আমাদের এখানেই এসেছ?
হ্যাঁ। আস্তে মাথা নাড়ে রাজীব। বলে, জরুরি একটা কাজে আমাকে আসাম যেতে হবে। আমার বোন আর ভগ্নিপতি বলল, আপনার বৌমার সঙ্গে দেখা করে যেতে। তাই
ভালই করেছ। তোমার এখানে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো?
না।
একটু চুপ করে থেকে সংগ্রামনারায়ণ বললেন, রয়ালটি চলে গেছে। জওহরলাল-প্যাটেলরা জোর করে প্রতাপপুর স্টেট কেড়ে নিয়ে আমাদের ভিখিরি করে দিলে। তোমার আদরযত্ন কতটুকু আর করব! যখন রাজত্ব ছিল তখন যদি আসতে–একটু থেমে ফের বললেন, তখন আর আসবে কী করে? তোমার হয়তো সে সময় জন্মই হয়নি।
সুবর্ণা অবাক হয়ে যাচ্ছিল। উগ্র, ক্ষিপ্ত, রগচটা সংগ্রামনারায়ণ অনেকটা বদলে গেছেন ঠিকই কিন্তু এমন আন্তরিকভাবে রাজীবের সঙ্গে কথা বলবেন, ভাবতে পারেনি।
রাজীব জানাল, আদরযত্নের বিন্দুমাত্র ত্রুটি হচ্ছে না, সে বেশ আরামেই আছে।
কী উত্তর দিতে গিয়ে দৃষ্টিটা স্থির হয়ে গেল সংগ্রামনারায়ণের। ধীরে ধীরে এবার বললেন, জানো রাজীব, কাল অদ্ভুত একটা কো-ইন্সিডেনস ঘটেছে।
রাজীব উৎসুক সুরে জিজ্ঞেস করে, কীসের?’
কাল তুমিও এসেছ। এদিকে প্রায় একই সময়ে নর্থ-ইস্টের একজন ভয়ঙ্কর টেরোরিস্টকে আমাদের প্যালেসের কাছে দেখা গেছে। পুলিশ তার খোঁজে প্যালেসে ঢুকেও পড়েছিল। তাকে অবশ্য পায়নি। তবে বৌমাকে সাবধান করে দিয়ে গেছে।
সুবর্ণা চমকে ওঠে। রাজীব কি ধরা পড়ে গেল? দাড়িটাড়ি কামিয়েও কি সংগ্রামনারায়ণের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি? এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, ভাবতেও সাহস হচ্ছিল না সুবর্ণার। নিঃশ্বাস বন্ধ করে সে দাঁড়িয়ে থাকে।
সংগ্রামনারায়ণ টেরোরিস্ট বা পুলিশের কথা বললেও রাজীবের চোখে মুখে বিন্দুমাত্র অস্থিরতা দেখা গেল না। খুব শান্ত গলায় সে বলল, আপনার বৌমার কাছে আমিও তা শুনেছি।
একটু চুপচাপ।
তারপর সংগ্রামনারায়ণ বললেন, দিল্লি থেকে এতটা রাস্তা এসেছ। নিশ্চয়ই শরীরের ক্লান্তি কাটেনি। রেস্ট নাও গিয়ে। পরে আবার দেখা হবে।
সুবর্ণা একধারে দাঁড়িয়ে দু’জনকেই লক্ষ করছিল। ধীরে ধীরে তার বুকের ভেতর থেকে আবদ্ধ বাতাস বেরিয়ে আসে। যাক, সংগ্রামনারায়ণ রাজীবকে সন্দেহ করেননি। আপাতত দুর্ভাবনাটা অন্তত কাটল।
রাজীব চলে গিয়েছিল। সুবর্ণা ঘর থেকে বেরুতে যাবে, সংগ্রামনারায়ণ বললেন, বৌমা, একটু পরে যেও–’
সুবর্ণা থেমে যায়।
সংগ্রামনারায়ণ বলেন, রাজীবকে তুমি আগে কখনও দেখেছ?
বুকের ভেতরকার ধকধকানি হঠাৎ যেন বেড়ে যায় সুবর্ণার। তাহলে কি সংগ্রামনারায়ণ রাজীবের ব্যাপারে পুরোপুরি নিঃসংশয় নন? কাঁপা গলায় সুবর্ণা বলে, না।
সংগ্রামনারায়ণ জিজ্ঞেস করেন, ও-ই যে তোমার বৌদির পিসতুতো দাদা, বুঝলে কী করে?
প্রায় মরিয়া হয়ে সুবর্ণা বলে, আমার দাদার চিঠি নিয়ে উনি এসেছেন।
আর কোনও প্রশ্ন করলেন না সংগ্রামনারায়ণ। শুধু বললেন, আচ্ছা যাও।
সংগ্রামনারায়ণের সন্দেহ সম্পূর্ণ কেটেছে কি না বোঝা গেল না। সুবর্ণা আর দাঁড়াল না, সোজা নিজের ঘরে চলে এল।
মায়া তার জন্য অনেকক্ষণ আগে চা এবং দু স্লাইস টোস্ট রেখে গিয়েছিল। কাপটা তুলে ঠোঁটে ঠেকাতেই দেখা গেল চা জুড়িয়ে একেবারে জল। মাখন লাগানো টোস্ট ঠান্ডা হয়ে জুতোর চামড়ার মতো শক্ত হয়ে গেছে। মায়াকে বললে পাঁচ মিনিটের ভেতর আবার করে এনে দেবে।
সুবর্ণার চোখ দ্রুত হল-ঘরে গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকটার দিকে চলে গেল। ন’টা বাজতে মিনিট পাঁচেক বাকি। সে ঠিক করে ফেলল, এখন আর কিছু খাবে না।
একবারে ভাত খেয়ে সওয়া দশটায় দেবীকে নিয়ে বেরিয়ে যাবে।
দেবীর ক্লাস এগারোটায় শুরু। বাড়ি থেকে মোটরে মিনিট পাঁচেকের পথ। দশটা পঁয়তাল্লিশ কি পঞ্চাশে বেরুলেও অসুবিধা নেই। অন্যদিন হরেনই তাকে স্কুলে পৌঁছে দেয়, ছুটির পর বাড়ি নিয়ে আসে। কিন্তু রাজীব ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ ঢোকার পর দেবী এত ভয় পেয়ে গেছে যে মাকে ছাড়তে চাইছে না। তাই সুবর্ণা ওকে স্কুলে পৌঁছে তো দেবেই, ছুটির পর সঙ্গে করে নিয়েও আসবে।
দেবীকে খানিকক্ষণ পড়িয়ে সুবর্ণা তাকে বাথরুমে পাঠাল। তারপর নিজেও স্নান করে নিল। সোয়া দশটায় খাওয়া-দাওয়া সেরে বাড়ি থেকে বেরুবার আগে মায়াকে বলল, বাবাকে ঠিক বারটায় খেতে দিয়ে দাদাভাইকে নিজে খাইয়ে দেবে। আমি বিকেলে এসে বাবাকে ওষুধ খাওয়াব।’ কলেজে বেরুবার আগে রোজ এই কথাগুলো মায়াকে মনে করিয়ে দেয় সে, যদিও এর কোনও প্রয়োজন নেই। কেননা মায়ার দায়িত্ববোধ যথেষ্ট। সে থাকতে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ এবং সংগ্রামনারায়ণের এতটুকু অযত্ন হবে না।
মায়া চাপা, ভীরু গলায় জিজ্ঞেস করল, আর ওই লোকটা?’
সুবর্ণা বলল, উনি যখন আমাদের বাড়িতে এসেছেন তখন অতিথিই। না খাইয়ে তো রাখা যাবে না। উনি কখন খান জানি না, জিজ্ঞেস করে এসে বলছি।
রাজীব সংগ্রামনারায়ণের ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের বেডরুমে চলে গিয়েছিল। একটা চেয়ারে এখন চুপচাপ বসে আছে। সুবর্ণা তার কাছ থেকে জেনে এসে মায়াকে বলল, বাবা আর দাদাভাইয়ের খাওয়া হলে ওঁকে খেতে দেবে। ঘরে দিতে হবে না, খাওয়ার টেবলে দিও।
মায়া এবার কী বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল। তার মনোভাব বুঝতে পারছিল সুবর্ণা; ওর কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, কোনও ভয় নেই। আমি যেভাবে বলেছি সেভাবে চলবে। তা হলে ওই ভদ্রলোক কোনও ঝামেলা করবেন না। আরেকটা কথা–’
মায়া জিজ্ঞেস করে, কী?
ওর কাছে যে পিস্তল-টিস্তল আছে, বাবাকে বলবে না।
আচ্ছা–
সুবর্ণা বাড়ির গাড়ি কখনও ব্যবহার করে না। প্রতাপপুর সিটিতে প্রচুর সাইকেল রিকশা আর অটো। সামনে যেটা পাওয়া যায় সেটা ধরেই সে কলেজে যাতায়াত করে। অন্য কোনও দরকারে বেরুলেও সেই অটো কিংবা রিকশা।
প্যালেস থেকে বেরিয়ে একটা সাইকেল রিকশা নিল সুবর্ণা আর দেবী। কাল ওসি রামেশ্বর বসাক বলেছিলেন, তাদের বাড়ির চারপাশে নজরদারি করার জন্য প্লেন ড্রেসের পুলিশ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন রাস্তায় প্রচুর লোকজন। সর্বত্র ব্যস্ততা। দোকানপাট, পোস্ট অফিস, ব্যাঙ্ক, যেদিকেই তাকানো যাক, উপচে পড়া ভিড়। তীক্ষ্ণ চোখে এধারে ওধারে লক্ষ করতে লাগল সুবর্ণা কিন্তু বিশাল জনতার মধ্যে কারা সাদা পোশাকের পুলিশ, জানা অসম্ভব। ভিড়ের ভেতর তারা নিশ্চয়ই মিশে আছে। কীভাবে এই অদৃশ্য পুলিশ বাহিনী রাজীবের জন্য গোপন ফাঁদ পেতে রেখেছে কে জানে।
দেবীদের রানী রাজেশ্বরী গার্লস হাই স্কুল’টা আগে পড়ে। তাকে গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে সুবর্ণা যখন তার কলেজে পৌঁছল, ঘড়িতে এগারোটা বেজে নয়। আজ তার প্রথম ক্লাস এগারটা দশে। হাতে একটুও সময় নেই।
রিকশা ভাড়া মিটিয়ে সোজা স্টাফ রুমে এসে ছাত্রছাত্রীদের অ্যাটেন্ডান্স রেজিস্টারটা নিয়ে উধ্বশ্বাসে উঁচু উঁচু সিঁড়ি ভেঙে তেতলায় ক্লাস রুমে চলে এল সুবর্ণা। চোদ্দ পনেরো বছর এই কলেজে পড়াচ্ছে সে, একদিনও এক মিনিট দেরিতে সে ক্লাসে ঢোকেনি। আজ কিন্তু প্রচণ্ড তাড়াহুড়ো করেও ঠিক সময়ে পৌঁছুনো গেল না।
রানী স্বর্ণময়ী কলেজ’ এক সময় ছিল শুধু মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত। পরে কো-এড করা হয়। ক্লাসের মাঝখান দিয়ে সরু প্যাসেজ। সেটার একধারে মেয়েদের বসার জন্য সারি সারি বেঞ্চ, আরেক দিকের বেঞ্চগুলো ছেলেদের। মাঝখানের প্যাসেজটাকে ডিমার্কেশন লাইন বা সীমান্তরেখা বলা যেতে পারে।
সুবর্ণার পড়ানোর স্টাইল, ব্যক্তিত্ব আর চমৎকার ব্যবহার–সব মিলিয়ে এমন দারুণ একটা আকর্ষণ রয়েছে যে, পারতপক্ষে ছেলেমেয়েরা তার ক্লাস কামাই করে না। তাছাড়া সে যেসব নোট দেয় সেগুলো পরীক্ষার পক্ষে খুবই জরুরি। ক্লাসে অ্যাবসেন্ট থাকা মানে নোটগুলো পাওয়া যাবে না, তাতে তাদেরই ক্ষতি।
সুবর্ণা ক্লাসে ঢুকে ঝড়ের গতিতে রোল কল করে রেজিস্টারটা টেবলের একধারে রেখে দিল। মেয়েদের ভেতর থেকে কে একজন বলে উঠল, দিদি আজ আপনি ছ’মিনিট লেটে ক্লাসে এসেছেন।
সুবর্ণা এক পলক মেয়েটির দিকে তাকিয়ে একটু হাসল শুধু।
রোল কলের পর এক মিনিটও সময় নষ্ট করল না সে। অন্যদিনের মতো পড়ানো শুরু করল। ক্লাস লেকচার, নোট দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে বার বার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল সুবর্ণা। এই ক্লাস-রুম, পঞ্চাশ জন ছাত্রছাত্রী এবং জানালার বাইরে প্রতাপপুর সিটির নানা দৃশ্যাবলী আর শব্দপুঞ্জকে পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে সিনেমার ক্লোজ শটের মতো রাজীবের মুখটা ক্রমশ চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। বাড়িতে এখন কী হচ্ছে কে জানে। মায়া যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। নিশ্চয়ই এমন কিছু করবে না যাতে তার নিজের ক্ষতি হয়। কিন্তু হঠাৎ ঘাবড়ে গিয়ে যদি হইচই বাধিয়ে বসে? সুবর্ণার মনে হয়েছে, সংগ্রামনারায়ণ রাজীবকে পুরোপুরি বিশ্বাস। করেননি। সন্দেহ মেটাতে যদি তিনি উঠে গিয়ে তার আসল আইডেন্টিটি জানার জন্য চাপ দিতে থাকেন? সুবর্ণা আর ভাবতে পারছিল না।
বছরের পর বছর সিলেবাসে কোনও পরিবর্তন নেই। পড়াতে পড়াতে সব তার মুখস্থ হয়ে গেছে। যান্ত্রিক নিয়মে ক্লাসটা শেষ করে স্টাফ রুমে চলে আসে সুবর্ণা। তার ভেতরে যে প্রচণ্ড আলোড়ন চলছিল, ছেলেমেয়েরা টের পায়নি।
স্টাফরুমের বড় ওয়াল ক্লকটায় বারটা বেজে পাঁচ। এখন পর পর দু’টো পিরিয়ড তার অফ। পরের ক্লাসটা সেই একটা চল্লিশে।
স্টাফ রুমটা মোটামুটি ফাঁকাই। অধ্যাপক অধ্যাপিকারা পরের ক্লাস নিতে চলে গেছেন। যাঁদের অফ-পিরিয়ড তারাই শুধু ছড়িয়ে ছিটিয়ে এধারে ওধারে বসে আছেন। ফিজিক্সের নবনীতা পুরকায়স্থ, ভূগোলের বেঢপ মোটা মৃন্ময়ী বড়াল, ইকনমিকসের বিমলেশ ভট্টাচার্য এবং হিস্ট্রির আদিনাথ বসুমল্লিক ছাড়া এখন আর কেউ নেই।
মৃন্ময়ীর যথেষ্ট বয়স হয়ে গেছে। দু-তিন বছরের মধ্যে রিটায়ার করবে। শেষ পর্যন্ত বিয়েটা আর করে উঠতে পারেনি। এ জীবনে সেটা আর সম্ভব নয়। সুবর্ণার। প্রতি চিরদিনই তার প্রচণ্ড ঈর্ষা। সুবর্ণা সুন্দরী, অসম্ভব জনপ্রিয় অধ্যাপিকা, ডিভোর্স হয়ে গেলেও সে রাজবংশের বউ–এসব মৃন্ময়ীর মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়। আগে চাঁছাছোলা ভাষায় বিশ্রীভাবে তাকে বিধিয়ে বিধিয়ে কথা বলত। তার আচরণ, অঙ্গভঙ্গি ছিল খুবই দৃষ্টিকটু। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আগেকার উদ্যম আর ঝঝ অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন ভেতরে তার যা-ই থাক, বাইরে একেবারে চুপচাপ। সুবর্ণার সঙ্গে বহুদিন সে কথা বন্ধ করে দিয়েছে। নবনীতাও এক সময় ছিল প্রচণ্ড ঈর্ষাকাতর। তবে মৃন্ময়ীর মতো অসভ্যতা কখনও করেনি। একটা বর জুটিয়ে ফেলার পর একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সুবর্ণার সঙ্গে এখন তার। ব্যবহার যথেষ্ট আন্তরিক। কোনওদিন যে হিংসে করত, বোঝাই যায় না।
আদিনাথ বসুমল্লিকেরও মৃন্ময়ীর মতো রিটায়ারমেন্টের সময় হয়ে এসেছে। তিনি একেবারে ঝাড়া হাত-পা মানুষ। কলেজ এবং খাওয়া ছাড়া আর কিছুই। বোঝেন না।
স্টাফ রুমে চতুর্থ যে মানুষটি বসে আছে, সেই বিমলেশের মতো হিতাকাঙ্ক্ষী মা-বাবাকে বাদ দিলে সুবর্ণার জীবনে আর একজনও আসেনি। এমন মালিন্যহীন, স্বচ্ছ মানুষ আগে কখনও দেখেনি সে। ডিভোর্সের পর যখন ভেঙে পড়েছিল, বিমলেশই তাকে আগলে আগলে রেখেছে। তার দীর্ঘ ভবিষ্যতের কথা ভেবে একবারই শুধু বলেছিল, সুবর্ণা রাজি হলে সে তাকে বিয়ে করতে চায়। বুঝিয়েছিল, এই সোসাইটিতে তার এবং দেবীর নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে। এমন একজন পাশে থাকা চাই যার ওপর নির্ভর করা চলে, যাকে বিশ্বাস করা যায়।
সুবর্ণা রাজি হয়নি। প্রতাপপুর রাজবংশের প্রতি তার বিন্দুমাত্র মোহ ছিল না। বিক্রম যে শূন্যতার সৃষ্টি করে গ্লিয়েছিল তা ক্রমশ ভরাট হয়ে আসছিল। একটি হৃদয়হীন বিশ্বাসঘাতকের জন্য তার মনে যা জমা হচ্ছিল তার নাম ঘৃণা। তবু দু’টি অসহায় বৃদ্ধকে ফেলে চলে যেতে পারেনি সে।
বিমলেশ দ্বিতীয় বার বিয়ের কথা বলেনি। সুবর্ণাকে পায়নি, তবু সর্বক্ষণ অপার সহানুভূতি এবং গভীর মমতায় সে তাকে ঘিরে আছে। কাম্য নারীটি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে, সে জন্য তার মনে হয়তো দুঃখ আছে, আছে আক্ষেপ এবং তীব্র, গোপন কাতরতা। বাইরে কিন্তু তার প্রকাশ নেই। সুবর্ণাকে ছাড়া অন্য মেয়ের কথা সে ভাবতেই পারে না। একটা জীবন কাছাকাছি থেকেও তারা দূরেই রয়ে গেল।
অ্যাটেন্ডান্স রেজিস্টারটা টেবলের এক ধারে রেখে বিমলেশের কাছে এসে বসে পড়ল সুবর্ণা।
আদিনাথের নিত্যকর্মপদ্ধতির মধ্যে রয়েছে কলেজে এসে দু’বার টিফিন খাওয়া। দশটায় ভরপেট ভাত খেয়ে দু’টো টিফিন বাক্স বোঝাই করে খাবার নিয়ে আসেন। বারটায় এবং চারটেয় তাঁর টিফিনের সময়। নিয়মানুযায়ী প্রথম বাক্সটা খুলে খেতে শুরু করেছিলেন। সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী ব্যাপার বল তো? কাগজে দেখলাম একটা মারাত্মক টেরোরিস্ট তোমাদের ওদিকে নাকি কাল ঘোরাঘুরি করছিল। পুলিশ চেজ করাতে ভ্যানিশ হয়ে যায়। তোমাদের প্যালেসে ঢুকে পড়েনি তো?
নবনীতা বিশাল টেবলের শেষ প্রান্ত থেকে বলে উঠল, রিপোর্টটা আমিও দেখেছি। লোকটার যে ছবি ছাপা হয়েছে, মনে হয় রুথলেস মার্ডারার। তোমাদের জন্যে এত ভয় করছিল যে বলে বোঝাতে পারব না। ভেবেছিলাম তোমাকে ফোন করব।’
না না, আমাদের বাড়িতে টেরোরিস্টটা ঢোকেনি। এমন ত্রস্তভাবে সুবর্ণা কথাগুলো বলল যে তার নিজের কানেই কেমন যেন বেখাপ্পা ঠেকল।
নবনীতা আবার বলে, আমার হাজব্যান্ড সকালে বাজারে গিয়েছিল। সে দেখে এসেছে প্রতাপপুর সিটিটা ভীষণ প্যানিকি হয়ে উঠেছে। লোকটার কাছে ডেডলি ওয়েপন রয়েছে। সে নাকি এত ডেসপারেট, যা খুশি করতে পারে।
রাজীব যে কতটা সাঙ্ঘাতিক এবং বেপরোয়া, প্রতাপপুর সিটিতে সুবর্ণার মতো সেটা আর কেউ জানে বলে মনে হয় না। গোটা বাড়িটাকে তার পিস্তলের নলের মুখে রেখে সে আজ কলেজে এসেছে। সেখানে এখন কী হচ্ছে কে জানে।
প্রচণ্ড অস্থিরতা বোধ করছিল সুবর্ণা। গলাটা প্রবল মানসিক চাপে শুকিয়ে যাচ্ছে। ভাল করে বসতে পারছিল না সে। স্টাফ রুমের একধারে একোয়া গার্ড লাগানো আছে। একবার সেখানে গিয়ে জল খেয়ে এল। কিন্তু কণ্ঠনলীর শুষ্ক, খসখসে ভাবটা কিছুতেই কাটছে না।
আদিনাথ বসুমল্লিক, যাঁর কাছে খাওয়াটাই একমাত্র প্যাসন, এছাড়া অন্য কোনও ব্যাপারে যার এতটুকু কৌতূহল নেই, তিনিও যে বেশ বিচলিত হয়ে পড়েছেন সেটা এবার বোঝা গেল। বললেন, তোমাদের অত বড় প্যালেস, ঢুকে কোথাও লুকিয়ে আছে কিনা কে জানে। কাগজে লিখেছে পুলিশ কাল রাতে তোমাদের ওখানে গিয়েছিল। ভাল করে চারদিক খুঁজে দেখেছিল তো?
কাঁপা গলায় সুবর্ণা বলল, হ্যাঁ।
যে মৃন্ময়ী বড়াল বহু বছর তার সঙ্গে কথা বলে না, সেও হঠাৎ বলে উঠল, রাতের অন্ধকারে ওই বিশাল বাড়িতে খোঁজাখুঁজি করা মুশকিল। পুলিশ ডেকে দিনের আলোয় আগাগোড়া সার্চ করাও। লোকটা কোথাও লুকিয়ে থাকলে তোমরা বিপদে পড়বে।
মৃন্ময়ীকে কথা বলতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল সুবর্ণা। যে মহিলা তাকে। চিরকাল হিংসে করে এসেছে তার এই উদ্বেগটুকু কিন্তু খুবই আন্তরিক যা সুবর্ণার বুকের ভেতর কোনও একটা সূক্ষ্ম, গোপন জায়গায় ঝঙ্কার তুলে গেল। কিন্তু তাকে জানানো গেল না, বিপজ্জনক লোকটা জোর করে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর দখল নিয়ে বসে আছে। ফ্যাকাসে একটু হেসে শুধু বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন মৃন্ময়ীদি।
এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি বিমলেশ। চুপচাপ সে শুধু সুবর্ণার অস্থিরতা লক্ষ করছিল। এবার খুব নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, তোমার কী হয়েছে বল তো সুবর্ণা?
সুবর্ণা চমকে ওঠে। বলে, কী আবার হবে? কিছু না বলতে বলতে হঠাৎ তার মনে হয় বাড়ির একটা খবর নেওয়া দরকার। স্টাফ রুমের একধারে একটা টিপয়ের ওপর টেলিফোন রয়েছে। সুবর্ণা সোজা সেখানে গিয়ে ওটা তুলে নিয়ে ডায়াল করল। সে জানে ফোনটা রাজীবই ধরবে। তার সঙ্গে কথা বলে বাড়ির পরিস্থিতিটা নিশ্চয়ই জানা যাবে।
ওধার থেকে রাজীবের গলা ভেসে এল, হ্যালো, কে বলছেন?
কণ্ঠস্বর শুনে মনে হল নোকটা অতি মাত্রায় সতর্ক হয়ে আছে। ফোন করে কেউ তাকে ফাঁদে ফেলতে চায় কিনা, সেটা যেন বুঝে নিতে চাইছে। সুবর্ণা বলল, আমি–-আমি মিসেস সিংহ।
কোত্থেকে ফোন করছেন?
কলেজ থেকে।
এবার যেন অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে গেল রাজীব। বলল, কোনও দরকার আছে?
সুবর্ণার মতো স্মার্ট, শিক্ষিত মেয়েও বেশ খতিয়ে গেল। একটু ভেবে বলল, আপনার কোনওরকম অসুবিধা হচ্ছে না তো?’
টেলিফোনের ওপ্রান্তে হাসির শব্দ শোনা যায়। হাসতে হাসতে রাজীব বলে, আমার সুবিধা-অসুবিধা জানার জন্যে আপনি কিন্তু ফোনটা করেননি ম্যাডাম।
বিমূঢ়ের মতো সুবর্ণা জিজ্ঞেস করল, তবে কী জন্যে করেছি?
আপনি জানতে চাইছিলেন, আমি ম্যাসাকার ট্যাসাকারের মতো কোনও কাণ্ড ঘটিয়ে বসে আছি কিনা।বলে জোরে জোরে, প্রবল শব্দ করে হেসে ওঠে রাজীব।
লোকটা কি থটরিডার? মুখ না দেখেও, শুধু গলা শুনেই অন্যের মনের কথা জেনে যায়? হতচকিত সুবর্ণা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর যেন ধড়ফড় করতে করতে বলে ওঠে, না না, বিশ্বাস করুন এসব আমি কিছুই ভাবিনি। সে টের পাচ্ছিল এই নভেম্বরেও তার কপালে দানা ঘাম জমে উঠেছে।
রাজীব তার কথার জবাব না দিয়ে বলল, আপনি চলে যাবার পর যা যা ঘটেছে সংক্ষেপে জানিয়ে দিচ্ছি। চুপচাপ তো বসে থাকা যায় না। আপনার জড়ভরত দাদামশাইয়ের সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টা করেছি। বাট দ্যাটস অ্যাবসোলুটলি ইমপসিবল। উনি অবশ্য দু-একবার রেসপন্ড করতে চাইছিলেন কিন্তু গলা দিয়ে মিহি ঘোড়ার ডাকের মতো সামান্য একটু আওয়াজ ছাড়া আর কিছু বেরোয়নি। মায়া সকালে ব্রেকফাস্ট দিয়ে সেই যে চলে গিয়েছিল, আর তাকে দেখিনি। খুব সম্ভব এ বাড়িতে আমার প্রেজেন্সটা সে পছন্দ করছে না কিংবা আমাকে ভয় পাচ্ছে। আপনার শ্বশুরমশাই বার দুই হল-ঘরে এসে আমার দিকে তেরছা চোখে তাকাতে তাকাতে ফের নিজের বেডরুমে ঢুকে গেছেন। আমি যে আপনার দাদার পিসতুতো শালা সেটা খুব সম্ভব উনি বিশ্বাস করেননি। আপনার দাদা, বৌদি বা তাদের ছেলেমেয়েদের নাম আমার জেনে নেওয়া হয়নি। শ্বশুরমশাই জেরা করলে মুশকিল হত। বাড়ি ফিরে ওঁদের তো বটেই, অন্য ক্লোজ আত্মীয়স্বজনদের নামও জানিয়ে দেবেন। ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা তো চাই।
দুর্বোধ্য গলায় কিছু একটা বলতে চাইল সুবর্ণা, পারল না।
রাজীব থামেনি, এর মধ্যে একজন মহিলা ফোন করেছিলেন। খুব সম্ভব আপনি যে উইমেন্স অর্গানাইজেশনটার সঙ্গে যুক্ত উনি তার সেক্রেটারি কিংবা ওইরকম কেউ হবেন। নামটা বলেছিলেন কিন্তু মনে করতে পারছি না। ভেরি সরি।
সুবর্ণা বলল, কে, মনোরমাদি?
হা হা, রাইট–মনোরমা অধিকারী। ওঁর ধারণা ছিল, আজ আপনার ক্লাস দেরিতে। বললেন, যদি সম্ভব হয় আজই সময় করে একবার যেন অর্গানাইজেশনের অফিসে যান। না যেতে পারলে সন্ধের পর উনি আবার বাড়িতে ফোন করবেন।
অনেক ধন্যবাদ।
তরল গলায় এবার রাজীব বলে, আপনার প্রাইভেট সেক্রেটারির কাজটা আশা করি ভালই করেছি, কী বলেন?
উত্তর না দিয়ে সুবর্ণা বলল, আচ্ছা এখন তা হলে ছাড়ি। আপনার যখন যা দরকার, মায়াকে বলবেন। ও দিয়ে যাবে।
সুবর্ণা টেলিফোন নামিয়ে রাখতে যাচ্ছিল, ব্যস্তভাবে রাজীব বলে উঠল, ছাড়বেন না, ছাড়বেন না। সব চাইতে ইমপর্টান্ট খবরটাই তো আপনাকে দেওয়া হয়নি।
কী?
কিছুক্ষণ আগে পুলিশের ফোন এসেছিল।
বুকের মধ্যে হিমের স্রোত বয়ে যায় সুবর্ণার। গলার ভেতর থেকে প্রতিধ্বনির মতো দু’টো শব্দ বেরিয়ে আসে, পুলিশের ফোন!
রাজীব বলল, হ্যাঁ। আপনাকে চাইছিল, বললাম কলেজে গেছেন। আমি কে জানতে চাইল, বলেছি আপনাদের কাজের লোক। আরও বলল, আজ খবরের কাগজে একটা দাড়িওলা ভয়ঙ্কর লোকের খবর বেরিয়েছে। তার মতো কাউকে দেখলে তক্ষুণি যেন থানায় জানিয়ে দেওয়া হয়। পরে ওরা আপনাকে কন্ট্যাক্ট করবে।
ঠিক আছে। শুকনো, ঝাপসা গলায় বলতে বলতে শিথিল হাতে ফোন নামিয়ে রেখে সুবর্ণা ফের বিমলেশের কাছাকাছি সেই চেয়ারটিতে এসে বসে। এই মুহূর্তে নিজের চেহারা দেখতে পাচ্ছিল না সে। সামনে একটা আয়না থাকলে বুঝতে পারত, তাকে কতটা বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে।
পুলিশের লোকেরা ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর সবাইকে চেনে। কাজের লোক বলে পার পেয়ে গেছে রাজীব। যদি ওরা তার নামটা জানতে চাইত? নিজের নাম অবশ্যই জানাতো না সে। তবে কী বলত? যাই বলুক, পুলিশ সন্দেহের বশে বাড়ি চলে এলে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হত কে জানে।
বড় হ্যান্ডব্যাগ থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছে নিল সুবর্ণা। চুল এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। ক্লান্তভাবে হাত দিয়ে চেপে চেপে সেগুলো ঠিক করতে লাগল।
সুবর্ণা লক্ষ করেনি, যে স্টাফ রুমে ঢোকার পর থেকে বিমলেশ তার দিকে তাকিয়ে আছে। এক মুহূর্তের জন্যও চোখ অন্য দিকে সরায়নি। খুব আস্তে করে সে ডাকে, সুবর্ণা–
সুবর্ণা মুখ ফেরায়।
বিমলেশ বলল, তোমাকে আজ ভীষণ রেস্টলেস দেখাচ্ছে।
সুবর্ণা কষ্ট করে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল, কই না, আমি ঠিক আছি।
গলার স্বর অনেক নিচে নামিয়ে বিমলেশ জিজ্ঞেস করে, বাড়িতেকাল পুলিশ এসেছিল, আজ ফোন করেছে–
তাকে থামিয়ে দিয়ে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, পুলিশের ফোনের কথা তোমাকে কে বললে?
তুমি এতক্ষণ টেলিফোনে যা যা বলেছ, আমি সব শুনেছি। পুরোটা বুঝতে পারিনি। কেননা ওধার থেকে যে বলছিল তার কথা আমারপক্ষে শোনা সম্ভব নয়। তবে অনেকটাই বুঝতে পেরেছি।
সুবর্ণা উত্তর দিল না। বিমলেশ স্টাফ রুমের চারপাশ একবার দেখে নিল। আদিনাথ, নবনীতা বা মৃন্ময়ী যাতে শুনতে না পায়, সেইভাবে বলল, তোমার চোখমুখ বুঝিয়ে দিচ্ছে, ভীষণ টেনসনে আছ।
সুবর্ণা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।
বিমলেশ সুবর্ণার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, সত্যি কথাটা কি এবার বলবে?
বিহ্বলের মতো সুবর্ণা বলে, কী জানতে চাইছ?
বিমলেশ বলল, আমার ধারণা, টেরোরিস্টটা তোমাদের বাড়িতেই ঢুকে আছে। সে এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছে যে ভয়ে, আতঙ্কে তুমি মুখ খুলতে পারছ না। অ্যাম আই রাইট?
সুবর্ণা চোখ নামিয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে থাকে। এই পৃথিবীতে এখন বিমলেশকেই সবচেয়ে বিশ্বাস করে সে। কিন্তু রাজীব বার বার সতর্ক করে দিয়েছে কোনওভাবেই তার কথা কাউকে বলা চলবে না। নিষ্ঠুর এই হত্যাকারী যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে তার সম্বন্ধে বিমলেশের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, তার পরিণতি সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু কাল সন্ধে থেকে প্রচণ্ড চাপে সুবর্ণার স্নায়ুমণ্ডলী ভেঙে চুরমার হচ্ছে। তার সহ্যশক্তিও শেষ সীমায় পৌঁছেছে। মনের মধ্যে যে দ্বন্দ্বটা চলছিল, এক সময় মরিয়া হয়েই তা কাটিয়ে ওঠে সুবর্ণা। আস্তে আস্তে মাথা হেলিয়ে বলে, তুমি যা বললে সেটাই ঠিক। আমি কী যে করব, বুঝতে পারছি না।
আমাকে সব খুলে বলল। দেখি সমস্যার কোনও সলিউসন বার করা যায় কিনা।
কিন্তু এই স্টাফ রুমে বসে বলাটা রিস্কি হয়ে যাবে। কেউ না কেউ শুনে ফেলতে পারে।
ঠিক। এক কাজ করা যাক—
বল।
তোমার ক’টা পর্যন্ত ক্লাস আছে?
লাস্ট ক্লাসটা তিনটে কুড়িতে শেষ হবে।
আমারও তাই। তারপর আমার ফ্ল্যাটে চল। সেখানে বসে সব শুনব।
একটু ভেবে সুবর্ণা বলে, আজ তোমার ওখানে যাওয়া সম্ভব নয়। দেবীর ছুটির পর ওকে স্কুল থেকে বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। তাছাড়া ফিরতে দেরি হলে লোকটা কিছু সন্দেহ করতে পারে। অবশ্য ও জানে আমি আমাদের উইমেন্স অর্গানাইজেশনের অফিসে কলেজের পর যেতে পারি।
ভালই হল। আমরা দু’জনে লাস্ট ক্লাসটা অফ করে আগে আগে যদি বেরিয়ে পড়ি কোনও প্রবলেম হবে না। আমাকে সবটা বলার পর দেবীকে নিয়ে তুমি ঠিক সময়ে বাড়ি যেতে পারবে।
প্রতাপপুর সিটির মাঝামাঝি মহারাজা সমরেন্দ্রনারায়ণ অ্যাভেনিউতে একটা মাল্টি-স্টোরিড বাড়ির দোতলায় বিমলেশের ফ্ল্যাট। তার সংসার পুরোপুরি ভূততান্ত্রিক। দু’টো কাজের লোক পবন আর হরিলাল সব কিছু চালায়। পবন দুবেলা রান্না করে। হরিলাল বাজার করা, বাসন মাজা, ফাইফরমাশ খাটা–এইসব করে থাকে। দু’জনেই মাঝবয়সী।
এখানে আরও অনেক বার এসেছে সুবর্ণা। তিন কামরার এই ফ্ল্যাটের বেডরুম, ড্রইংরুম, কিচেন, বিমলেশের পড়ার ঘর–কোথায় কী আছে তার সব মুখস্থ।
বিমলেশ আর সুবর্ণা ড্রইংরুমে এসে বসল। বিমলেশ বলল, আগে একটু কফি খেয়ে নেওয়া যাক, কী বল?
সুবর্ণা বলল, ঠিক আছে।
পবনকে ডেকে কফি করে আনতে বলল বিমলেশ।
পবন কাজেকর্মে খুবই চৌকস। পাঁচ মিনিটের মধ্যে শুধু কফিই না, সেই সঙ্গে কেক আর কাজু বাদামও এসে গেল।
কফিতে চুমুক দিয়ে বিমলেশ বলল, শুরু করো।
কাল সন্ধে থেকে এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, একটানা বলে গেল সুবর্ণা। সমস্ত ব্যাপারটা এতটাই ভীতিকর যে ড্রইমরুমটায় দম বন্ধ করা আবহাওয়ার সৃষ্টি করল। চমকপ্রদ রহস্য কাহিনীতেও এমন শ্বাসরোধী ঘটনাপ্রবাহ থাকে না।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বিমলেশ জিজ্ঞেস করল, নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়া থেকে লোকটা কী জন্যে এই প্রতাপপুর সিটিতে পালিয়ে এল, কিছু বলেছে? ওখানকার বেশির ভাগ স্টেটেই আর্মি আর প্যারামিলিটারি ফোর্স নামানো হয়েছে। তাদের তাড়া খেয়েই কি?
সুবর্ণা বলল, কিছুই বলতে পারব না। লোকটা শুরুতেই শাসিয়ে রেখেছে তার সম্বন্ধে কোনওরকম কৌতূহল প্রকাশ বা প্রশ্ন করা চলবে না। যার সঙ্গে ডেডলি ওয়েপন আছে, তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার মতো দুঃসাহস আমার নেই।
বিমলেশ বলল, এখন পর্যন্ত ঠান্ডা মাথায় যা যা করেছ, প্রচণ্ড নার্ভের জোর আর ইনটেলিজেন্স না থাকলে তা করা সম্ভব নয়।
প্রশংসার কথাগুলো শুনেও যেন শুনল না সুবর্ণা। শেষ রক্ষা না হওয়া পর্যন্ত তার বুদ্ধিমত্তা বা স্নায়ুর জোর প্রমাণিত হবে কীভাবে? মাত্র কয়েক ঘণ্টা তো কেটেছে। যদি রাজীব কয়েক দিন থেকে যায়, স্নায়ুমণ্ডলী কি অক্ষত থাকবে? মনের জোর বা সঠিকভাবে মস্তিষ্ক খাটানোর কাজটা কি অটুট রাখা সম্ভব হবে? সে বলে, কাল সন্ধে ছ’টা থেকে আজ বিকেল তিনটে পর্যন্ত, মাত্র একুশটা ঘন্টা তো কাটল। লোকটা কতদিন আমাদের হোস্টেজ করে বাড়িতে থেকে যাবে জানি না। কেউ ভয়ে হঠাৎ কিছু করে বসলে আমরা একজনও বেঁচে থাকব না। এদিকে ওসি-কে বলেছি, আমাদের বাড়িতে কেউ ঢোকেনি। তিনি কতটা বিশ্বাস করেছেন জানি না। মাঝে মাঝেই ফোন করছেন। প্যালেসের ওপর ওয়াচ রাখার জন্য প্লেন ড্রেসের পুলিশ লাগিয়ে দিয়েছেন। এই অবস্থায় আমার কী করা উচিত বলতে পারো?
তোমার একার না, বাড়ির প্রতিটি লোকের একমাত্র কাজ হল সারাক্ষণ মাথা ঠান্ডা রাখা। টেরোরিস্টটাকে খুব কেয়ারফুলি হ্যান্ডল করতে হবে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তারপর বিমলেশ বলল, কাগজে দেখলাম লোকটা সেসেসানিস্ট–বিচ্ছিন্নতাবাদী। ভারতবর্ষ থেকে ওরা আলাদা হয়ে ইন্ডিপেনডেন্ট স্টেট করতে চায়। ওর সঙ্গে আলাপ করতে আগ্রহ হচ্ছে।
সুবর্ণা আঁতকে ওঠে, কেন?
বিমলেশ বলল, দেখ, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় উগ্রপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম। সেসব তোমাকে বলেছি। স্বপ্ন দেখেছিলাম দেশ শোষণ থেকে মুক্তি পাবে, সমাজ ব্যবস্থা পুরোপুরি বদলে যাবে। বিশ্বাস করতাম, রাইফেলের নল ছাড়া এসব কিছুই করা যাবে না। এক্সপ্লয়টেশনের অধিকার কেউ, সহজে ছাড়তে চায় না। আমার এখনও ধারণা, সোশাল সিস্টেমকে পালটাতে হলে ভায়োলেন্স ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা বোধ হয় নেই।’
সুবর্ণার মনে পড়ল, বেশ কয়েক বছর আগে তাদের বন্ধুত্বটা যখন শুধু আড্ডা আর ফাজলামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, নির্ভরতা এবং আস্থার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে সেই সময় একদিন বিমলেশ তার জীবনের অনেক কথাই বলেছিল। সে একজন বড় মাপের স্বপ্নদর্শী, একজন আইডিয়ালিস্ট। ভাল রেজাল্ট করে কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে আই. এ. এস, আই. পি. এস হব, বা মাল্টিন্যাশনাল কোনও কোম্পানির টপ একজিকিউটিভের পোস্ট বাগাব, কিংবা আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া কি জার্মানিতে গিয়ে বিশাল কেরিয়ার তৈরি করব–এসব তার ভাবনার মধ্যে কখনও ছিল না স্বাধীনতার পর কিছু লোকের ঘরে টাকার পাহাড় জমতে লাগল, দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেল দেশের শতকরা ষাট ভাগ মানুষ, ভ্রষ্টাচারে ছেয়ে গেল সারা ভারতবর্ষ, আদর্শবাদ আর মানবিক মূল্যবোধগুলোকে গলা টিপে শেষ করে দেওয়া হল। পচা, গলা, দুর্গন্ধওলা সোশাল সিস্টেম দেশকে ধ্বংসের কাছাকাছি যখন পৌঁছে দিয়েছে সেই সময় বিমলেশ এবং তার মতো অসংখ্য তরুণ হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছিল। তাদের ধারণা সশস্ত্র আন্দোলন ছাড়া সিস্টেমকে। ভাঙা যাবে না। তারপর অনেক দিন কেটে গেল। তাদের স্বপ্নপূরণ হয়তো হয়নি। তবু সেদিনের রাজনৈতিক বিশ্বাসের অনেকখানি এখনও তার মধ্যে থেকে গেছে। তবে এখন আর সে অ্যাক্টিভিস্ট নয়, সক্রিয়ভাবে কিছুই করে না। বিশ্বাসটুকু বাদ দিলে ছাত্রছাত্রীই তার কাছে সব। সুবর্ণা ছাড়া তার মতো জনপ্রিয় অধ্যাপক রানী স্বর্ণময়ী কলেজ’-এ আর একজনও নেই।
বিমলেশ বলল, আমার সঙ্গে লোকটার আলাপ করিয়ে দাও না–
জোরে জোরে প্রবলবেগে মাথা নেড়ে সুবর্ণা বলল, অসম্ভব। রাজীব কাউকে বিশ্বাস করে না। তোমাকে হঠাৎ নিয়ে গেলে তার রি-অ্যাকসন মারাত্মক হবে। ভাববে তোমাকে দিয়ে তাকে ট্র্যাপে ফেলতে চেষ্টা করছি।
হঠাৎ নিয়ে যাবে কেন? আগে ওর কনসেন্ট নেবে।
এক্ষুণি তোমাকে কথা দিতে পারছি না। কিছুদিন যাক, লোকটার মতিগতি বুঝতে চেষ্টা করি। যদি দেখি খানিকটা সফট হয়েছে, আমাকে তেমন অবিশ্বাস করছে না, তখন তোমার কথা বলব।
বেশ। তাই বলো—
কিন্তু–
কী?
তুমি ওই লোকটার সঙ্গে আলাপ করতে চাইছ কেন?
দু’টো কারণে। প্রথমত বুঝতে চেষ্টা করব পুলিশ যদি হঠাৎ কোনও কু পেয়ে ওকে ধরার জন্য প্যালেসে হানা দেয়, ও তোমাদের কতটা ক্ষতি করতে পারে। দ্বিতীয় কারণটা তাত্ত্বিক বলতে পার। আমরা নিজেদের দেশের মধ্যে থেকেই সিস্টেম বদলের কথা ভেবেছিলাম। ওরা ইন্ডিয়া থেকে কেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চায় সেটা জানতে চাইব।
একটু চুপচাপ।
তারপর বিমলেশ আবার বলল, ইন ফ্যাক্ট, আগে কখনও কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। ওদের সম্পর্কে আমার যথেষ্ট কৌতূহল আছে।
কৌতূহল কতটা মিটবে জানি না। এখন বলো আমি কী করব?
কিছুক্ষণ ভেবে বিমলেশ বলল, আপাতত ক’টা দিন যেমন চলছে চলুক। আমিও ভাবি, তুমিও চিন্তা কর। ওর হাত থেকে মুক্তির একটা পথ নিশ্চয়ই বেরিয়ে যাবে।