Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ক্রান্তিকাল || Prafulla Roy » Page 2

ক্রান্তিকাল || Prafulla Roy

প্রতাপপুর থানার ওসি রামেশ্বর বসাককে নিচের হল-ঘরে একটা সোফায় বসিয়ে সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে সুবর্ণার জন্য অপেক্ষা করছিল হরেন। খানিক দূরে বাইরের দরজার কাছে তিনজন আমর্ড কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে। ওরা ওসি’র সঙ্গে এসেছে।

সুবর্ণা একতলায় নেমে আসতেই রামেশ্বর বসাক উঠে দাঁড়ালেন। প্রায় ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বললেন, অসময়ে আপনাদের বিরক্ত করতে আসতে হল। কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম।

রাজতন্ত্র কবেই শেষ হয়ে গেছে, তবু প্রতাপপুরের সাধারণ মানুষজন থেকে শুরু করে প্রশাসন, পুলিশ, সবাই রাজবাড়ির অধিবাসীদের যথেষ্ট সমীহ করে। সুবর্ণা রামেশ্বরকে বসতে বলে তার মুখোমুখি অন্য একটা সোফায় বসতে বসতে বলে, বলুন আপনার জন্যে কী করতে পারি। টের পেল, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে যে কাঁপুনিটা শুরু হয়েছিল সেটা এখন কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।

রামেশ্বরের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। হাইট প্রায় ছ’ফুট। মোটা মোটা হাড়ের ফ্রেমে দারুণ মজবুত চেহারা। গায়ের রং তামাটে। মাথাভর্তি কোঁকড়া কোঁকড়া চুলের বেশির ভাগটাই অবশ্য কালো। তবে রগ এবং সিঁথির দু’পাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে বেশ পাক ধরেছে। পুরু কালচে ঠোঁট তার, ছড়ানো চোয়াল, থ্যাবড়া গোছের থুতনি, ঘন জোড়া ভুরুর তলায় তীব্র, সন্দিগ্ধ চোখ দু’টো সর্বক্ষণ চরকির মতো ঘোরে। আজীবন ঘের..ডাকাত ঘেঁটে ঘেঁটে পৃথিবীর কাউকেই বোধহয় বিশ্বাস করেন না। তার কাছে বেশির ভাগ লোকই ঠক, দাগাবাজ, জোচ্চোর কিংবা খুনী। তার ধারণা দুনিয়া থেকে সব ভালমানুষ প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে।

রামেশ্বরের চেহারায় এমন একটা ভীতিকর ব্যাপার আছে যাতে যত বড় ক্রিমিনালই হোক না, তার মুখোমুখি পড়লে ভয়ে তাদের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। একজোড়া পাকানো গোঁফ তার ভয়ঙ্করত্ব অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতাপপুর শহরে অ্যান্টি-সোশালদের যম হিসেবে রামেশ্বরের সুনাম এবং দুর্নাম দুইই আছে। একবার একটা রেপিস্ট অর্থাৎ ধর্ষণকারীকে থানায় এনে এমন মার নাকি দেওয়া হয়েছিল যার ফলে মুখে রক্ত উঠে লোকটা মারা যায়। এই নিয়ে হিউম্যান রাইটসের ব্যাপারে যারা আন্দোলন করে তারা তুমুল হইচই বাধিয়ে দিয়েছিল। সেবার অনেক কষ্টে চাকরিটা বাঁচাতে পেরেছিলেন তিনি। অবশ্য লোকটার মৃত্যুতে তার বিন্দুমাত্র অনুতাপ হয়নি। তাঁর মতে খুনী এবং নারীধর্ষকদের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার নেই। তাদের যেভাবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাবাড় করে ফেলা উচিত। মানবাধিকার ওনারা কেন যে এদের প্রতি এত সহানুভূতিশীল, তিনি সেটা ভেবে উঠতে পারেন না।

ক্রিমিনালদের কাছে রামেশ্বর যত.নির্মমই হন, এমনিতে লোকটা মোটামুটি ভদ্র, হৃদয়বান। সেটা অবশ্য চট করে বোঝা যায় না। তার চরিত্রে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে সহৃদয়তার অদ্ভুত একটা মিশ্রণ ঘটেছে।

রামেশ্বর বললেন, একটা মারাত্মক ধরনের টেরোরিস্ট নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়া থেকে এক উইক আগে আমাদের শহরে এসে ঢুকেছে। ওখানকার পুলিশ আর মিলিটারি থেকে আমাদের অ্যালার্ট করে দেওয়া হয়েছে। কদিন নানা জায়গায় লুকিয়ে থাকার পর খুব সম্ভব খাবার দাবার কিনতে টেরোরিস্টটা আজ সন্ধেবেলায় বেরিয়ে পুলিশের একটা প্যাট্রোল ভ্যানের সামনাসামনি পড়ে যায়। তারপর তাড়া খেয়ে আপনাদের এদিকে চলে আসে। যারা প্যাট্রোল দিচ্ছিল তাদের ধারণা লোকটা আপনাদের প্যালেসে ঢুকে থাকতে পারে। অবশ্য কুয়াশা আর অন্ধকারে ওরা ভাল করে দেখতে পায়নি।

সুবর্ণার চোখের সামনে অদৃশ্য টিভি স্ক্রিনে রাজীবের চেহারাটা ফুটে ওঠে। গাল ভর্তি দাড়ি থাকলেও তার চোখেমুখে মঙ্গোলিয়ান একটা ছাপ রয়েছে যা উত্তর-পূর্ব ভারতেই দেখা যায়। রামেশ্বর যে এর সম্বন্ধেই বলছেন, তা নিয়ে এতটুকু সংশয় নেই সুবর্ণার। প্রথমটা তার মনে হয়েছিল, নোকটা সাধারণ একটা খুনী বা ডাকাত কিংবা জেল-পলাতক কোনও জঘন্য অপরাধের আসামী। এখন দেখা যাচ্ছে সে একজন উগ্রপন্থী।

অনিবার্য কোনও নিয়মে সুবর্ণার চোখদু’টো দোতলার দিকে খানিকটা ঘুরে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল, ওপরে তাকালে রামেশ্বরের মতো ধুরন্ধর পুলিশ অফিসারের সন্দেহ হতে পারে। তাই আর মুখ তোলার চেষ্টা করল না; সোজা রামেশ্বরের দিকে চোখ রেখে আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল।

রামেশ্বর ফের বললেন, লোকটার আসল নাম জানা যায়নি। আইডেন্টিটি গোপন করার জন্যে সে একেক সময় একেকটা নাম নেয়। সে মিলিটান্টদের একটা বড় আউটফিটের লিডার। তার নামে সত্তর আশি জন পুলিশ, মিলিটারি জওয়ান আর সাধারণ সিভিলিয়ান খুনের অভিযোগ আছে। বিরাট বিরাট কোম্পানির ডিরেক্টর বা একজিকিউটিভদের জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে, আটকে রেখে কোটি কোটি টাকা ব্যানসম হিসাবে আদায় করেছে। ওর সঙ্গে সব সময় এ কে-৫৬ রাইফেল, পিস্তল থাকে। আর থাকে এমন কিছু অস্ত্র যা দিয়ে আপনাদের এই প্যালেসের মতো পঞ্চাশটা বাড়ি উড়িয়ে দেওয়া যায়।

শুনতে শুনতে হৃৎপিণ্ডের উত্থান-পতন থমকে গিয়েছিল সুবর্ণার। সে চুপচাপ নিজীবের মতো তাকিয়ে থাকে।

রামেশ্বর থামেননি, লোকটা এই শহরের পক্ষে একেবারেই নিরাপদ নয়। ধরা পড়ার সম্ভাবনা দেখলে কখন কী ধরনের ব্লাস্ট ঘটিয়ে মানুষ, বাড়িঘর ধ্বংস করে ফেলবে, জানি না। যতক্ষণ ও প্রতাপপুর সিটিতে থাকবে, আমাদের কারও শান্তি নেই। একটু থেমে বলেন, আচ্ছা ম্যাডাম–

সুবর্ণা কিছু না বলে তাকিয়েই থাকে।

রামেশ্বর এবার জিজ্ঞেস করেন, আজ সন্ধের পর কোনও আউটসাইডার কি প্যালেসে ঢুকেছে?

সুবর্ণার কানের কাছে রাজীবের সেই হুঁশিয়ারিটা অদৃশ্য অডিও সিস্টেমে বেজে ওঠে। ধীরে ধীরে মাথাটা ডাইনে এবং বাঁয়ে হেলিয়ে দুর্বল স্বরে সে বলে, না।

দেখুন, আপনাদের এত বড় বাড়ি। অন্ধকারে কেউ কোনও দিক দিয়ে ঢুকে লুকিয়ে থাকলে বোঝা মুশকিল।

ওভাবে ঢোকাটা একেবারেই সম্ভব নয়। অন্তত আজ—

এত জোর দিয়ে বলছেন কী করে?

সুবর্ণা জানায় এ বাড়িতে ঢুকতে হলে একতলার হল-ঘরের সামনের দরজা দিয়ে ঢুকতে হবে। পেছন দিকেও একটা দরজা অবশ্য আছে, সেটা ভেতর থেকে বন্ধ থাকে। দোতলায় যেতে হলেও নিচের তলার হল-ঘরের সিঁড়ি ভেঙেই যেতে হবে। সেখানেও শেষ মাথায় একতলার মতো যে দরজাটা আছে সেটাতেও সারাক্ষণ খিল দেওয়া থাকে। আজ সন্ধেবেলায় সুবর্ণা নিচের তলাতেই ছিল, কেউ ঢুকলে সে নিশ্চয়ই দেখতে পেত।

একটু চিন্তা করে রামেশ্বর বললেন, ঠিক আছে, আমরা এখন যাচ্ছি। খুব সাবধানে থাকবেন। আপনাদের এত বড় প্যালেস বলেই বলছি, এখানে কেউ কোথাও লুকিয়ে থাকলে সহজে চোখে পড়বে না। কাল দিনের বেলায় কাজের লোকদের দিয়ে ছাদ টাদগুলো দেখিয়ে নেবেন।

আচ্ছা–

সন্দেহজনক, অচেনা কাউকে চোখে পড়লে দয়া করে থানায় ফোন করে দেবেন।

দেবো।

তাহলে এখন চলি–’ সোফা থেকে উঠে পড়তে পড়তে রামেশ্বর বলেন, আপনার অনেকটা সময় নিলাম। নমস্কার।

নমস্কার। সুবর্ণাও উঠে দাঁড়ায়। তার হাত-পায়ের কাঁপুনি এখনও থামেনি। এরই মধ্যে মনে পড়ল, বাড়িতে কেউ এলে তাকে আপ্যায়ন করাটা রাজপরিবারের দীর্ঘকালের রীতি। এখানে এসে কেউ চা, মিষ্টি কি শরবত খেয়ে যায়নি, এমনটা কখনও হয়নি। আজই প্রথম আতিথেয়তায় ত্রুটি ঘটল। সে যে মায়াকে ডেকে কফি, বিস্কুট টিস্কুট আনতে বলবে, তেমন সাহস হয়নি। ওপরে রাজীব রয়েছে। মায়া এসে কী বলতে কী বলে বসবে, তার ফলে গোটা পরিবারটাই শেষ হয়ে যাবে। তবু রামেশ্বরদের যে সামান্য এক কাপ চা-ও দেওয়া গেল না, সে জন্য মনটা খচখচ করতে থাকে সুবর্ণার।

রামেশ্বররা চলে যাবার পর দরজা বন্ধ করে ফিরে আসে হরেন। সুবর্ণা তখনও দাঁড়িয়ে ছিল।

হরেন মানুষটা খুবই ভাল এবং সৎ। দোকান বাজার থেকে শুরু করে বেশির ভাগ খরচপত্র তার হাত দিয়েই হয় কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারবে না, একটা পয়সাও এদিক ওদিক হয়েছে। কাজে একটু আধটু ফাঁকি যে দেয় না তা নয়। কিন্তু সে সব ধর্তব্যের মধ্যে নয়। দীর্ঘদিন রাজ-পরিবারে থেকে সুখে দুঃখে এদেরই একজন হয়ে গেছে। ঝামেলা ঝঞ্জাট একেবারেই পছন্দ করে না। পুলিশ এবং আদালত টাদালত সম্পর্কে তার অকারণ একটা ভীতি আছে যার কোনও স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই।

হরেন চাপা, ভীরু গলায় বলে, বৌদিদি আপনি তো দারোগাকে বললেন, আমাদের বাড়ির সব দরজা বন্ধ ছিল। খুনেটা ঢুকতে পারেনি। কিন্তু যদি বাইরের পাইপ বেয়ে ছাদে উঠে লুকিয়ে থাকে?

বোঝা গেল, রেন ওয়াটার পাইপের কথা বলছে হরেন। সুবর্ণা বলল, এই রাত্রিবেলা কিছু করার নেই। কাল সকালে ছাদে উঠে একবার দেখে আসব।

ব্যস্তভাবে হরেন বলে, আপনি আবার অতগুলো সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠবেন কেন? আমি যাব।

সুবর্ণা সচকিত হয়ে ওঠে। সে চায় না, হরেন কোনও কারণে ওপরে উঠুক। বলে, না না, তোমার যাবার দরকার নেই। ধর, লোকটা ছাদে লুকিয়ে আছে, আর তার সঙ্গে যদি অস্ত্রস্ত্র থাকে–

হরেনকে এবার ম্রিয়মাণ দেখায়। ঢোক গিলে কিছু বলার চেষ্টা করে, পারে না।

সুবর্ণা বলে, রাত হচ্ছে। এবার রান্না চাপিয়ে দাও। আমি ওপরে যাচ্ছি।

হরেন এ বাড়িতে থাকে ঠিকই, তবে তার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা আলাদা। নিজের রান্না সে নিজেই করে নেয়।

সুবর্ণা আর দাঁড়ায় না, সিঁড়ি ভেঙে ক্লান্ত পায়ে ওপরে উঠতে থাকে। কিন্তু ল্যান্ডিংয়ের কাছাকাছি আসতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। পাশ দিয়ে যে বিশাল, গোলাকার পিলারটা একতলার হল-ঘর থেকে সোজা ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে সেটার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে রাজীব। তার ডান হাতটায় ভাত আর মাংসের ঝোল লেগে বেআছে। বাঁ হাতে সেই পিস্তলটা। চোখাচোখি হতেই একটু হাসল সে। বলল, গুড। খুব ইনটেলিজেন্টলি ওসি’র প্রশ্নগুলোর জবাব দিয়েছেন।

সুবর্ণা আন্দাজ করল, সে নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে রাজীব ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে এসে পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ অফিসারের সঙ্গে তার যা কথাবার্তা হয়েছে, সবটাই শুনেছে। সুবর্ণা তাকে ধরিয়ে দিতে চাইছে কিনা, নিশ্চয়ই সেদিকে লক্ষ্য রাখছিল। ওসি’র কাছে বেস কিছু বলে ফেললে রাজীব কি গুলি করত?

সুবর্ণা তাকিয়েই ছিল, কিছু বলল না।

রাজীব বলে, চলুন, ওপরে যাওয়া যাক।

সিঁড়ি ভেঙে দোতলার দিকে উঠতে উঠতে রাজীব বলে, দু-ঘণ্টা আগে আমি এ বাড়িতে ঢুকেছি। এর মধ্যেই বুঝতে পেরেছি ইউ আর অ্যান এক্সট্রা-অর্ডিনারি লেডি। আই অ্যাম সিওর, আমি যা বলেছি তার বাইরে আপনি কিছু করবেন না। কারণ এ বাড়ির এতগুলো মানুষের লাইফ অ্যান্ড ডেথ আমার ওপর নির্ভর করছে। তবু হয়তো ভাবতে পারেন, কেন লুকিয়ে আপনাদের কথা শুনছিলাম?

সুবর্ণা উত্তর দেয় না। রাজীব বলে, আসলে কি জানেন, মানুষের সাইকোলজি একটা অদ্ভুত জটিল ব্যাপার। পুলিশ দেখে হঠাৎ যদি ডেসপারেট হয়ে কিছু করে বসেন, তাই

সুবর্ণা রাজীবের চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, আপনি কাউকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেন না, তাই না?

রাজীব বলে, এগজ্যাক্টলি। আপনাকে বোধহয় আগেও বলেছি, বিশ্বাস রেসপেক্ট স্নেহ সিমপ্যাথি, এইসব দারুণ দারুণ সব হিউম্যান কোয়ালিটির কোনওটাই আমার মধ্যে নেই। আমাকে বিপদে ফেলার মতো সামান্য চান্সও কাউকে দেব না।’

সুবর্ণা বলে, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? অবশ্য আগেই ওয়ার্নিং দিয়েছেন, আপনিই শুধু প্রশ্ন করবেন আর আমি উত্তর দিয়ে যাব। তবু–

তাকে থামিয়ে দিয়ে রাজীব বলে, কী জিজ্ঞেস করতে চাইছেন?

অসীম দুঃসাহসে সুবর্ণা বলে, আপনার হাতে যেমন ওয়েপন আছে, অন্যের হাতেও তা থাকা অসম্ভব নয়। অস্ত্রের ব্যবহার তারাও জানে। কতদিন এভাবে চালাতে পারবেন?

রাজীবকে অসহিষ্ণু দেখায়। তীক্ষ্ণ গলায় সে বলে, যতদিন সম্ভব।

সুবর্ণা চুপ করে থাকে।

খাওয়া শেষ না করেই ল্যান্ডিংয়ের কাছে নেমে গিয়েছিল রাজীব। দোতলায় এসে আবার খেতে বসে যায় সে।

সুবর্ণা অবশ্য বসে না, ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।

এক টুকরো মাংস মুখে পুরে রাজীব এবার বলে, পুলিশ অফিসারের কাছে আমার পরিচয়টা তো জেনে গেছেন।

সুবর্ণা কাঁপা গলায় উত্তর দেয়, হ্যাঁ। উনি বলেছিলেন আপনি–আপনি–বলতে বলতে থেমে যায়। বাকিটা শেষ করে না।

মাংস চিবুতে চিবুতে খুব সহজ ভঙ্গিতে রাজীব বলে, একজন ড্রেডেড টেরোরিস্ট। আরও একটা ইনফরমেশন উনি আপনাকে দিতে ভুলে গেছেন কিংবা জানেন না।

ক্ষীণ গলায় সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, কী ইনফরমেশন?

রাজীব বলে, আমার মাথার দাম পঞ্চাশ লাখ টাকা–ফাইভ মিলিয়ন। জীবিত বা মৃত, যে অবস্থায় থোক না আমাকে ধরিয়ে দিতে পারলে এই রিওয়ার্ডটা গভর্নমেন্ট থেকে দেওয়া হবে।

সুবর্ণা চোখ নামিয়ে নেয়, কিছু বলে না।

সামনের দিকে অনেকটা ঝুঁকে রাজীব বলে, টাকার অঙ্কটা হিউজ। মানুষের লোভকে খুঁচিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। যে কোনও লোককে, এমনকি ওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে হদ্দ কাওয়ার্ডও এর জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সেটা হবে ভয়ঙ্কর রকমের ঝুঁকি। নতুন আরেকটা সতর্কবাণী উচ্চারণ করে পলকহীন স্থির চোখে সে তাকিয়ে থাকে।

সুবর্ণা বিশাল অঙ্কের পুরস্কার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কৌতূহল প্রকাশ করে না। নিস্পৃহ গলায় বলে, আমার শ্বশুরমশাইকে ওষুধ খাওয়াতে হবে, দাদাশ্বশুরের ডিনার খাওয়ার সময় হয়েছে, দেবীর কালকের পড়াগুলো দেখিয়ে দেওয়া দরকার। আমি কি এখন যেতে পারি?

রাজীব সুবর্ণার দিক থেকে চোখ ফেরাল না। ধীরে ধীরে বলল, হ্যাঁ, যান।

হল-ঘরের মাঝখানে গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকটায় এখন সাতটা বেজে পঁয়ত্রিশ। সেতারের ঝংকার তুলে সেটা বেজে যাচ্ছিল।

ঘড়িটার পাশ দিয়ে প্রথমে নিজের ঘরে চলে আসে সুবর্ণা।

দেবী বিছানায় বসে বই-টই নাড়াচাড়া করছিল। রাজীবকে দেখার পর যে প্রাথমিক ভয়টা পেয়েছিল তার খানিকটা কেটে গেলেও মেয়েটার চোখেমুখে এখনও আতঙ্কের ছাপ লেগে আছে। পড়ায় মন বসাতে পারছিল না সে।

দেবীর পাশে বসে তার পিঠে একটা হাত রেখে সুবর্ণা বলে, কাল স্কুলে কী কী পড়া আছে?

দেবী ইংরেজি গ্রামার, ভূগোল, এরিথমেটিক, বাংলা কবিতা, বিজ্ঞান আর ইতিহাসের বই খুলে পাঠ্য বিষয়গুলো দেখিয়ে দেয়।

সুবর্ণা পাঁচটা অঙ্ক কষতে দিয়ে দেবীকে বলে, এগুলো করে ফেল। আমি ক’টা কাজ সেরে আসি। তারপর বাকি পড়াগুলো করিয়ে দেব।

দেবী আস্তে মাথা নাড়ে।

সুবর্ণা এবার শ্বশুরের ঘরে আসে। সংগ্রামনারায়ণ বিকেলে যে নতুন ট্যাবলেটটা খেয়েছিলেন তার মধ্যে কড়া সিডেটিভ ধরনের কিছু রয়েছে। কিছুক্ষণ আগে যখন রাজীবকে নিয়ে ওঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে গিয়েছিল, তিনি চোখ মেলতে পারছিলেন না। এখন গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। অথচ ফুসফুসকে সতেজ রাখার জন্য একটা ক্যাপসিউল রাত আটটার ভেতর খাওয়ানো দরকার। ডাক্তার স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, সময়ের এতটুকু এদিক-ওদিক যেন না হয়। সেটা সংগ্রামনারায়ণের পক্ষে ক্ষতিকর হবে।

সুবর্ণা খাটের পাশে দাঁড়িয়ে ডাকে, বাবা–বাবা–

সংগ্রামনারায়ণের সাড়াশব্দ নেই। শুধু শ্বাস টানা আর শ্বাস ফেলার তালে তালে বুকটা ধীরে ধীরে ওঠানামা করছে। কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর সংগ্রামনারায়ণ অস্ফুটে বললেন, উঁ–

একটু উঠুন। ওষুধ খেতে হবে।

দাও–

খাটের পাশেই একটা নিচু সাইড টেবলে নানা আকারের শিশি আর স্ট্র্যাপের ভেতর বহু রকমের ওষুধ। সারা দিনে ষোলো সতেরোটা ট্যাবলেট এবং ক্যাপসিউল খেতে হয় সংগ্রামনারায়ণকে। গাদা গাদা ওষুধ তার নির্জীব হৃৎযন্ত্রকে খানিকটা সচল রেখেছে।

টেবলটায় ক্যাপসিউল ট্যাপসিউল ছাড়াও রয়েছে বড় ওয়াটার বটলে ফোঁটানো বিশুদ্ধ জল আর কয়েকটা কাঁচের গেলাস, চামচ, প্লেট ইত্যাদি। এক গেলাস জল। আর একটা ক্যাপসিউল নিয়ে সংগ্রামনারায়ণের কাছে এসে দাঁড়াল সুবর্ণা। তিনি চোখ খুললেন না, ঘুমের আচ্ছন্নতার মধ্যে মাথাটা সামান্য তুলে হাঁ করলেন।

ওষুধ এবং জল খাইয়ে মুখ মুছিয়ে দিতেই সংগ্রামনারায়ণের মাথাটা ফের নরম বালিশের ভেতর ডুবে গেল। সুবর্ণা জিজ্ঞেস করল, রাতে কী খাবেন বাবা?

ঘুমন্ত গলায় সংগ্রামনারায়ণ বললেন, কিছু না। আমাকে ঘুমোতে দাও।

মানুষটা ভয়ানক বদরাগী এবং জেদী। রাজত্ব না থাকলে কী হবে, উগ্র রাজকীয় মেজাজটা এখনও তার মধ্যে থেকে গেছে। দেড়শ বছরের প্রাচীন রাজবংশের দুর্বিনীত রক্ত যে তার শিরায় শিরায় বয়ে চলেছে, এক মুহূর্তের জন্য তিনি তা ভুলতে পারেন না এবং চারপাশের মানুষজনকে ভুলতে দেনও না। তার অহংকার, ক্রোধ আর প্রতাপ যে কতটা বিধ্বংসী সেটা সুবর্ণার চেয়ে কে আর ভাল জানে। তিনি যা স্থির করবেন সেটাই চূড়ান্ত, তার ওপর আর কথা নেই।

সুবর্ণা বেরিয়ে যাচ্ছিল, জড়ানো গলায় সংগ্রামনারায়ণ বললেন, তোমার সেই আত্মীয়টির থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছ তো?

ওষুধের ঘোরের মধ্যেও তার মস্তিষ্ক পুরোমাত্রায় সক্রিয়। দু’টো স্ট্রোক সংগ্রামনারায়ণকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছে। তবু মাথাটা তার পরিষ্কার, কিছুই ভোলেন না। এমন কি কড়া ওষুধের কারণে এখন এই আচ্ছন্নতার মধ্যেও রাজীবের কথা তার মনে আছে। সুবর্ণা বলল, হ্যাঁ, বাবাঘর থেকে বেরিয়ে সে সোজা কিচেনের দিকে চলে গেল। লক্ষ করল, রাজীব হল-ঘরে নেই। খাওয়া শেষ করে কখন যেন শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে চলে গেছে।

রান্নাঘরে পা দিতেই হাতের ইশারায় সুবর্ণাকে তার কাছে যেতে বলল মায়া।

সুবর্ণা ক’পা এগিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?

মায়া চুপচাপ বসে ছিল। উঠে দাঁড়িয়ে চাপা, ভয়ার্ত গলায় বলল, এ আপনি কাকে বাড়ির ভেতর নিয়ে এসেছেন বৌদিদি?

একটু চমকে ওঠে সুবর্ণা। বলে, কেন, কী হয়েছে?

লোকটা ভাল নয়।

কী করে বুঝলে?

চেহারাটা ডাকাতদের মতো। মায়ার চোখে চোখ রেখে সুবর্ণা বলে, চেহারা দেখে কি সবসময় ভালমন্দ বোঝা যায়?

মায়া বলল, শুধু চেহারাই না–’

তাহলে?

ওর কাছে একটা পিস্তল আছে।

সুবর্ণার খানিক আগের চমকটা এবার বদলে গিয়ে দ্রুত মাথার ভেতর প্রবল দুশ্চিন্তার সৃষ্টি করে। রাজীবের সঙ্গে যে মারণাস্ত্র রয়েছে সেটা দেবী আর সে ইতিমধ্যেই জেনে ফেলেছে। বাড়ির অন্য কেউ, বিশেষ করে কাজের লোকেরা জানুক, তা একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়। ঘাবড়ে গিয়ে তারা কিছু করে বসলে গোটা পরিবারের পক্ষে প্রচণ্ড ক্ষতির সম্ভাবনা।

সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, পিস্তল যে আছে, তুমি জানলে কী করে?

আপনি যখন দারোগাবাবুর সঙ্গে কথা বলতে গেলেন ওই লোকটা খাওয়া ফেলে সিঁড়ির পাশের মোটা থামটার আড়ালে গিয়ে পিস্তল বের করে দাঁড়িয়ে ছিল।

এ বাড়ির কাজের লোকেরা কোনও ব্যাপারেই কৌতূহল প্রকাশ করে না। কিন্তু রাজীবকে দেখার পর থেকেই মায়া তার সম্পর্কে সন্দিগ্ধ হয়ে আছে। সুবর্ণা ভাবল, সে যখন নিচে ওসি’র সঙ্গে কথা বলছে, মায়া ওর ওপর নিশ্চয়ই লক্ষ রাখছিল। বলল, কোনও ভয় নেই। যেমন কাজ করছিলে করে যাও। শুধু ওর সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলবে না।

মায়ার গলার কাছ’টা উৎকণ্ঠায় ভীষণ কাঁপছিল। বলল, আমাদের বিপদ হবে না তো?

ঠিক এই প্রশ্নটা দেবীও করেছিল। ভঙ্গুর একটু হেসে সুবর্ণা মায়ার ভীতিটা উড়িয়ে দেবার সুরে বলল, না না, কীসের বিপদ। বলল বটে, মনে মনে সে কিন্তু জানে তার এই ভরসা দেওয়াটা কতখানি দুর্বল আর অর্থহীন।

মায়া তবু কী বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে সুবর্ণা ফের বলে, আমি দাদাভাইয়ের ঘরে যাচ্ছি। তুমি ওঁর রাতের খাবারটা নিয়ে এস। ওই সঙ্গে এক ডেকচি গরম জল আর তোয়ালে। বলেই চলে যায়।

শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে একটা সোফায় কাত হয়ে বসে ছিল রাজীব। দু’দিন পর স্নান করে, প্রচুর পরিমাণে ভাত মাংস টাংস খেয়ে ক্লান্তি অনেকখানি কেটে গিয়েছিল তার। পেটে ভাত পড়লে যা হয়, চোখে ঢুল আসছিল কিন্তু নিজেকে। ঘুমিয়ে পড়তে দিচ্ছিল না সে। রাত্রিবেলা নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত তার পক্ষে ঘুমনো সম্ভব নয়। চোখ মেলে রেখে অন্যমনস্কর মতো সে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে লক্ষ করছিল।

সেই আগের মতোই ডিভানে বসে বিহ্বলের মতো তাকিয়ে আছে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ। মুখে সেইরকমই শব্দহীন, অবোধ হাসি।

সুবর্ণা ঘরে ঢুকতেই সোজা হয়ে বসল রাজীব। তার দিকে একপলক তাকিয়ে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের পাশে গিয়ে দাঁড়াল সুবর্ণা। বলে, রাত হয়েছে। এবার খেয়ে শুয়ে পড়তে হবে। রাজীবকে দেখিয়ে বলল, ইনিও এই ঘরে শোবেন। আপনার অসুবিধা হবে না।

কোনওরকম প্রতিক্রিয়াই দেখা গেল না। গাছ, পাথর বা অচেতন বস্তুর সঙ্গে কথা বললে যেমন উত্তর পাওয়া যায় না, এখানেও ঠিক তা-ই। মুখে সেই অদ্ভুত হাসিটি নিয়ে একইভাবে তাকিয়ে রইলে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ।

হঠাৎ রাজীব বলে ওঠে, আই উইদড্র মিসেস সিংহ।

তার কথাটা বুঝতে না পেরে সুবর্ণা একটু অবাকই হল।

রাজীব বলে, তখন বলেছিলাম, আপনার গ্র্যান্ডফাদার-ইন-ল’র হাসি এবং তাকানোটা অ্যাক্টিং হতে পারে। এখন দেখছি, না, ওটা রিয়াল।

সুবর্ণা উত্তর দিল না।

রাজীব ফের বলে, ওল্ড এজে পঙ্গু, অকর্মণ্য, স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে বেঁচে থাকাটা হরিবল ব্যাপার।

একজন নিষ্ঠুর উগ্রপন্থী, যার কাছে মৃত্যু বা হত্যা চাঞ্চল্যকর কোনও ঘটনাই নয়, যার মাথার ওপর পঞ্চাশ লক্ষ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে, যার কাছে বাঁচা এবং মরার মাঝখানে পার্থক্যটা বড়ই ক্ষীণ, বড়ই সূক্ষ্ম শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের এই পরিণতিতে সে যে বিচলিত হতে পারে, সেটাই অবাক করার মতো ব্যাপার।

মায়া গরম জল এবং দুধ খইটই নিয়ে আসে।

সুবর্ণা তোয়ালের একটা প্রান্ত গরম জলে ভিজিয়ে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের হাত পা মুখ সযত্নে মুছিয়ে ধরে ধরে তার খাটে নিয়ে বসিয়ে দেয়।

শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের জন্য জল এবং খাবার দিয়ে মায়া পালাতে চাইছিল। যেখানে একজন বিপজ্জনক আগন্তুক বসে আছে তার ধারে কাছে থাকাটা নিরাপদ নয়। কিন্তু তক্ষুণি আর যাওয়া হল না।

সুবর্ণা বলে, আমাদের স্টোরে বড় আলমারিতে বাড়তি লেপ তোষক মশারি টশারি আছে। সেগুলো এনে এ ঘরের ডিভানে বিছানা করে দাও।

আচ্ছা–

মায়া চলে যেতেই শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে খাওয়ানোর তোড়জোড় শুরু করে সুবর্ণা। গরম দুধে খই ঢালতেই সঙ্গে সঙ্গে মিইয়ে যায়। তার সঙ্গে চিনি মিশিয়ে চামচে করে মুখে দিতে থাকে সে।

এই বয়সে, বিশেষ করে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের মতো মানুষের ক্ষুধাতৃষ্ণার বোধটাই মরে যায়। অন্যমনস্কর মতো মুখের ভেতর খই দুধ নাড়াচাড়া করতে । থাকেন তিনি। অবিকল বাচ্চাদের মতো। খানিকটা পেটে যায়, খানিকটা কষ বেয়ে। গড়িয়ে পড়ে। নরম পাকের পুরো একটা সন্দেশও খাওয়ানো যায় না, অর্ধেকের বেশিটাই পড়ে থাকে।

শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের খাওয়ার পালা চুকতে আধ ঘণ্টা লেগে যায়। তারপর তাকে শুইয়ে, খাটের মশারি ফেলে, চারপাশে গুঁজে দিয়ে সুবর্ণা বলে, দাদাভাই ঘুমিয়ে পড়ুন।

এদিকে ডিভানে বিছানা পেতে মশারি খাঁটিয়ে দিয়ে গিয়েছিল মায়া। রাজীবের দিকে ফিরে সুবর্ণা বলে, আমি এবার যাব। ইচ্ছা করলে আপনি শুয়ে পড়তে পারেন।

রাজীব বলে, হ্যাঁ, শুয়েই পড়ব। ঘুম পাচ্ছে।

কী ভেবে সুবর্ণা বলে, দরজা ভেতর থেকে নিশ্চয়ই বন্ধ করে দেবেন?

রাজীব বলে, তা তো দিতেই হবে। আমার সেফটির ব্যাপার আছে না?

তার ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল সুবর্ণা। দরজা খুলে ঘুমিয়ে পড়লে সে লোজন ডাকতে পারে, পুলিশকে খবর দিতে পারে। অর্থাৎ নিজের নিরাপত্তার চিন্তাটা এক মুহূর্তের জন্য ভোলে না রাজীব। সুবর্ণা একটু হেসে বলে, আমি কিন্তু আপনার কথা ভাবিনি। দাদাভাই রাত্তিরে ঘুমিয়ে পড়লে আমরা বাইরে থেকে দরজার শেকল তুলে দিই। তবু নজর রাখতে হয়। কেননা হঠাৎ হঠাৎ উঠে ঘুমের ঘোরে ঘুরে বেড়ানো ওঁর অভ্যাস।

নাইট ওয়াকার?

হ্যাঁ। একবার শেকল লাগাতে ভুলে গিয়েছিলাম। অন্ধকারে উনি ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির মুখ পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন। নেহাত সেই সময় আমার ঘুমটা ভেঙে যায়, নইলে সর্বনাশ হয়ে যেত।

আপনি কি রোজ রাত্তিরে উঠে উঠে ওল্ড ম্যানটিকে দেখে যান?

তা তো দেখতেই হয়। আমি একটু কষ্ট করলে একটা মানুষ যদি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারে, সেটা করব না?’ বলে বেরিয়ে যায় সুবর্ণা।

অবাক রাজীব ধীরে ধীরে উঠে দরজায় ছিটকিনি এবং খিল, দু’টোই লাগিয়ে দেয়।

নিজের ঘরে এসে ঘণ্টাদেড়েক ধরে দেবীর কালকের স্কুলের পড়াগুলো করিয়ে দেয় সুবর্ণা। কাল তার নিজেরও অনার্সের দু’টো ক্লাস আছে। দেবীকে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে কিছু রেফারেন্সের বই দেখে নেয় সে। ভাল পড়ায়, ভাল নোট দেয়। তাই তার কাছে ছাত্রছাত্রীদের দাবি অনেক। তাদের প্রত্যাশা কখনও অপূর্ণ রাখে না সুবর্ণা।

পড়াটড়া হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি খাওয়ার পালা চুকিয়ে শুয়ে পড়েছিল তারা। মস্ত খাটে সে আর দেবী পাশাপাশি শোয়। তাদের লেপ আলাদা। কাউকে জড়িয়ে। ধরে ঘুমোতে অস্বস্তি হয় দেবীর। আজ কিন্তু তার লেপের ভেতর ঢুকে মাকে আঁকড়ে ধরে, গায়ের সঙ্গে লেপটে শুয়েছে মেয়েটা। ঘুমের মধ্যেও মাঝে মাঝে। কেঁপে উঠছে। কারণটা অনুমান করতে পারছিল সুবর্ণা। রাজীবের জন্য তার সুস্থ, স্বাভাবিক মেয়েটা ফিয়ার সাইকোসিস অর্থাৎ ভয়ে মানসিক রোগের শিকার না হয়ে পড়ে। দেবী তার জীবনের অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে। স্বামী বিক্রমের সঙ্গে সুবর্ণার আদৌ কোনও সম্পর্ক নেই। সে এ বাড়ি ছেড়ে দশ বছর আগে চলে গেছে, কোনওদিনই আর ফিরবে না। দাম্পত্যজীবন মেয়েদের কাছে বুঝিবা সবচেয়ে মূল্যবান ঐশ্বর্য। সেদিক থেকে সুবর্ণা একেবারে নিঃস্ব। বিক্রমের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর সেই শূন্যতার বেশির ভাগটাই ভরাট করে দিয়েছে দেবী। কলেজে তার একটা ভাল চাকরি আছে, থাকার জন্য বিশাল প্রাসাদ আছে, আছে অসংখ্য গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রী, বহু মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব। কিন্তু এসব দিয়ে কি দাম্পত্য জীবনের রিক্ততা পূরণ হয়? ভেতরে ভেতরে কবেই ক্ষয়ে ক্ষয়ে সে শেষ হয়ে যেত। হয় যে নি, তার কারণ দেবী। মেয়েটা নিজের অজান্তে অবিরল তার বেঁচে থাকার শক্তি জুগিয়ে চলেছে। সে সুবর্ণার আশ্রয়, অবলম্বন। শ্বাসবায়ুর মতো অপরিহার্য। রাজীবের জন্য দেবীর যদি কিছু হয়ে যায় সে বাঁচবে না।

আজ সন্ধের পর থেকে কয়েকটা ঘণ্টা এ বাড়িতে যে সব ভীতিকর, চমকপ্রদ আর দমবন্ধ করা ঘটনা ঘটে গেল তার চাপে স্নায়ুগুলো টান টান হয়ে গিয়েছিল সুবর্ণার। এখন, বিছানায় দামী লেপের আরামদায়ক উষ্ণতার ভেতর শরীর ঢেলে দেবার পর সেগুলো শিথিল হয়ে আছে। একটানা দীর্ঘ সময় উত্তেজনা এবং আতঙ্কের অসহনীয় চাপ আজকের মতো খানিকটা কেটে গেলেও ঘুম আসছে না। বার বার রাজীবের চিন্তাটা ঘুরে ঘুরে তার মস্তিষ্কে হানা দিতে থাকে। সেই সঙ্গে কোনও কার্যকারণ ছাড়া হঠাৎ অদৃশ্য মঞ্চের পর্দা সরে গিয়ে তার নিজের জীবনের নানা দৃশ্য ফুটে উঠতে লাগল। অলৌকিক নাটকের মতো। অলৌকিক হয়েও কিন্তু রিয়াল।

রাজীবের মতো সেও ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ চোদ্দ বছর আগে ঢুকে পড়েছিল। তবে ওর মতো গায়ের জোরে, আতঙ্কের একটা পরিবেশ তৈরি করে নয়। সে এখানে এসেছিল ভয়ে ভয়ে, সসঙ্কোচে, বিক্রমের পেছনে পেছনে রুদ্ধশ্বাসে।

সুবর্ণাদের বাড়ি শিলিগুড়িতে। বাবা ছিলেন পি ডর ডি’র সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। আই. এ পাশ মা নেহাতই হাউসওয়াইফ, ঘর-সংসারে আবদ্ধ আর দশজন মহিলার মতো আদ্যোপান্ত সুগৃহিণী।

সুবৰ্ণারা দুই ভাইবোন। দাদা গৌতম অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্কিং সারভিসের পরীক্ষা দিয়ে একটা নাম-করা শিডিউল্ড ব্যাঙ্কে ঢুকেছিল। পোমোশন পেয়ে পেয়ে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হয়েছে। আপাতত আছে দিল্লিতে। আর সে নিজে হিস্ট্রিতে ভাল রেজাল্ট করে প্রতাপপুরের রানী স্বর্ণময়ী কলেজ’-এর লেকচারার হয়ে এসেছিল পনের বছর আগে। থাকত কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতর অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের জন্য নির্দিষ্ট হস্টেলে। সে এই শহরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার পড়ানোর এবং সৌন্দর্যের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

যদিও রাজতন্ত্র আর নেই, গভর্নমেন্টের শিক্ষা বিভাগ ফি বছর বিরাট অঙ্কের গ্রান্ট দেয়, তবু প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে রানী স্বর্ণময়ী কলেজ’-এ রাজবংশের মর্যাদা অপরিসীম। তাছাড়া কলেজের নামে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের বাবা অর্থাৎ বিক্রমের প্রপিতামহ রাজা বিজয়েন্দ্রনারায়ণ পঁচিশ লক্ষ টাকার একটা ফান্ড করে গিয়েছিলেন। সেই টাকার ব্যাঙ্ক ইন্টারেস্ট থেকে কলেজের যাবতীয় খরচের অনেকটাই উঠে আসে।

নেটিভ স্টেটগুলো ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে মিশে যাবার সময় ঠিক হয়েছিল রাজবংশের কেউ একজন সব সময়ই কলেজের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান হবেন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকার রাজপরিবারের সঙ্গে এই চুক্তিটিকে কখনও অমর্যাদা করেনি। সুবর্ণা যখন লেকচারশিপ নিয়ে আসে, বিক্রম ছিল চেয়ারম্যান।

স্বাভাবিক কারণেই সুবর্ণার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বিক্রমের। তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় গুঁজে পড়েছিল সে। যখন তখন হস্টেলে চলে আসত। সুবর্ণাকে তার টু-সিটার স্পোর্টস-কারে তুলে নিয়ে শহর থেকে হাইওয়ের দিকে চলে যেত। কোনওদিন বা পঞ্চাশ মাইল দূরে পাহাড়ের গায়ে ছবির মতো একটা লেকের ধারে, যেটা চমৎকার টুরিস্ট স্পট। ছোট্ট মোটরবোটে দুরন্ত স্পিড তুলে লেকের জল তোলপাড় করে তারা যেন উড়তে থাকত।

আভাসে ইঙ্গিতে কলিগদের কেউ কেউ বিক্রম সম্পর্কে সুবর্ণাকে সতর্ক করে দিয়েছিল। কিন্তু বিক্রম দুশ্চরিত্র, লম্পট, প্লে-বয় টাইপের ছেলে–এসব সতর্কবার্তা তার এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যেত। তখন সবে তেইশে পা দিয়েছে সুবর্ণা। একজন সত্যিকারের সুপুরুষ তরুণ রাজপুত্র তার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছে, এটা তার যুবতী হৃদয়ের অহংকারকে যেন শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। অল্প বয়সে প্রিন্স অ্যান্ড আ স্ট্রিট গার্ল’ নামে একটা সিনেমা দেখেছিল সে, কিংবা ওই নামের বইও পড়ে থাকতে পারে। সেখানে এক রাজকুমার পথের এক গরিব অনাথ মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল। এও তেমনই এক অবিশ্বাস্য কাহিনী। সে রাস্তার মেয়ে নয়, সাধারণ মিডল ক্লাস ফ্যামিলিতে তার জন্ম। একেবারেই কমোনার-অনভিজাত। তার বেলায় কাহিনীর নামটা একটু বদলে দেওয়া যেতে পারে–প্রিন্স অ্যান্ড আ কমন গার্ল। একটি কৌলিন্যহীন, অখ্যাত মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ের পক্ষে একজন রাজপুত্রকে জয় করে নেওয়ার মধ্যে প্রচণ্ড উন্মাদনা থাকে। ব্যাপারটা প্রায় রূপকথার মতো। সুবর্ণা যেন রঙিন বাতাসে স্বপ্নের ঘঘারে ভেসে বেড়াচ্ছিল।

পরিচয়ের একমাসের মাথায় বিক্রম বলেছিল, তোমাকে ছাড়া বাঁচব না সুবর্ণা। আমি একটা ডিসিসান নিয়ে ফেলেছি।

সুবর্ণা জিজ্ঞেস করেছিল, কীসের ডিসিসান?’

এক উইকের ভেতর আমরা বিয়ে করছি। তবে

তবে কী?

আমার বাবাকে তা জানানো যাবে না। তুমি অবশ্য তোমাদের বাড়িতে জানাতে পারো।

সুবর্ণা চমকে উঠেছিল, তোমার বাবাকে জানানো যাবে না কেন?

বিক্রম জানিয়েছে, দেড়শ বছরের ইতিহাসে তাদের বংশের ছেলেমেয়েদের ভারতবর্ষের অন্য রাজপরিবারে ছাড়া আর কোথাও বিয়ে হয়নি। সুবর্ণাকে সে বিয়ে করলে সেটা হবে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর পক্ষে পৃথিবীকে রসাতলে পাঠানোর মতো একটা দুর্ঘটনা। দেড়শ বছর ধরে বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে যে রক্তধারা বয়ে চলেছে তা বিশুদ্ধ থাকুক, সেদিকে তার বাবা সংগ্রাম নারায়ণের তীক্ষ্ণ নজর। রাজত্ব নেই, রাজতন্ত্র নেই, তবু আত্মম্ভরিতাকে যখের মতো আগলে রেখেছেন তিনি। তুচ্ছ, হেজিপেজি ঘরের ছেলেমেয়েকে বিয়ে করে প্রতাপপুর রাজ-পরিবারের বংশধরেরা নিষ্কলঙ্ক রাজরক্তের সঙ্গে কমোনারের রক্ত মিশিয়ে দূষিত করে ফেলুক সেটা তিনি কিছুতেই হতে দেবেন না। পুত্রবধূ হিসেবে সুবর্ণাকে মেনে নেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।

শুনতে শুনতে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল সুবর্ণার। এস্ত ভঙ্গিতে সে জিজ্ঞেস করেছে, তা হলে?

বিক্রম হেসেছে, বাবা মেনে নেবেন না বলে আমি পিছিয়ে যাব? রয়ালটি নেই। ইন্ডিয়ান ডেমোক্রেসিতে মুদি, মাছওলা, সুইপারের ভোটের যা দাম, আমাদেরও তাই। এক্স রাজা-মহারাজাদের জন্যে স্পেশাল কোনও খাতিরের ব্যবস্থা নেই কনস্টিটিউশনে। রাজা টাজা আর কমোনাররা একদিন একাকার হয়ে যাবে। আমাদের বংশে সেই প্রসেসটা আমিই শুরু করব তোমাকে বিয়ে করে। এটা একরকম রেভোলিউশনই বলতে পার। প্রতাপপুর রয়াল ফ্যামিলিতে আমিই প্রথম রেবেল।

সুবর্ণা জানতে চেয়েছে, তোমার বাবা মেনে না নিলে বিয়েটা হবে কী করে?

গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাডাল্ট ইয়াং ম্যান আর ইয়াং গার্লদের জন্যে প্রচুর সুবিধা করে দিয়েছে। ইনডিপেনডেন্সের পর এই প্রতাপপুর সিটিতে মিনিমাম এক ডজন ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিস হয়েছে। এখন বিয়ে করাটা কি কোনও প্রবলেম? তবে–

কী?

এবার বিক্রম যা উত্তর দিয়েছিল তা এইরকম। তার বাবার বিয়ে হয়েছিল সাউথ বেঙ্গলের এক রাজবাড়িতে। ঠাকুরদা বিয়ে করেছিলেন মধ্যপ্রদেশের এক নেটিভ স্টেটের প্রিন্সেসকে। একমাত্র পিসিমার বিয়ে হয় উদয়পুর স্টেটে। ঠাকুরদার বাবা কি তার বাবা আর ঠাকুরদাদের কথা না হয় বাদই দেওয়া হল। কারণ প্রতাপপুর স্টেটের তখন বিপুল অর্থ, প্রচণ্ড প্রতাপ এবং দেশ জুড়ে খ্যাতি। অন্য দেশীয় রাজ্যগুলো এই বংশের ছেলেমেয়েদের জামাতা বা বন্ধু হিসেবে পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। ফলে পূর্বপুরুষদের যে সব বিয়ে হয়েছে তার জাঁকজমক শুধু স্বপ্নেই দেখা যায়। ঠাকুরদার আমলে কিংবা তার পরে কিছুকাল রাজতন্ত্র চালু থাকলেও নানা কারণে রাজবংশের গৌরব অনেকটাই পড়তির দিকে। তবু তার বাবা এবং পিসির বিয়েতে দশ মণ করে বাজি পুড়েছিল। ইন্ডিয়ার নাইনটি পারসেন্ট নেটিভ স্টেটের রাজা বা প্রিন্সরা নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। আর । এসেছিলেন গভর্নর জেনারেল, হাইকোর্টের চিফ জাস্টিস, আর্মি কমান্ডার, বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট থেকে দেশের বিখ্যাত সব পার্সোনালিটি। কলকাতা থেকে নাম করা সানাইওয়ালারা আর দশটা মিলিটারি ব্যান্ডপার্টি এসে। দু’সপ্তাহ ধরে বাজিয়ে গিয়েছিল। স্টেটের কোনও বাড়িতে সাতদিন রান্না চড়েনি। সমস্ত প্রজা রাজবাড়িতে ভোজ খেয়েছে। প্রতাপপুর সিটি ফেরারি টেলসের কোনও শহরের মতো অজস্র রং আর আলোয় সেজে উঠেছিল। গেস্টদের হাতির পিঠে রুপোর ছত্রির তলায় বসিয়ে চারিদিকে ঘোরানো হয়েছিল। তাদের কেউ কেউ লেকের ওধারের জঙ্গলে শিকার খেলতে গিয়েছিলেন।

বিক্রম একটানা বলে যাচ্ছিল, আলো, সানাই, ব্যান্ডপার্টি, হাতি, ঘোড়া, রোলস রয়েস গাড়ির মিছিল, শিকার, হীরে, মুক্তো, পান্না, সোনার মোহর, দামী দামী পোশাক, প্যালেস জুড়ে বিলিতি পারফিউমের সুগন্ধ আর সারাদিন ভোজ সব মিলিয়ে সেই গ্র্যাঞ্জার সেই পেজেন্ট্রি তুমি ভাবতেও পারবে না। কিন্তু—

নিঃশ্বাস বন্ধ করে যেন অলীক এক রূপকথার গল্প শুনে যাচ্ছিল সুবর্ণা। এবার জিজ্ঞেস করেছে, কিন্তু কী?

বিক্রম বলেছে, আমাদের বিয়েতে এসব কিছুই হবে না। রাজত্ব টাজত্ব চলে যাবার পর অত খরচ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। যেটুকু আছে, তোমাকে বিয়ে করলে বাবা একটা পয়সা তো বার করবেনই না, বরং যতভাবে বাধা দেওয়া সম্ভব দেবেন। আড়াইশো টাকা খরচ করে ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিসে কাজটা চুকিয়ে ফেলতে হবে।

এমন সাদামাঠা, গোপন বিয়েতে মন একেবারেই সায় দিচ্ছিল না সুবর্ণার।. একটু তরুণীর জীবনে বিয়েকে ঘিরে অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন থাকে। কিন্তু তার কতটুকুই বা পূরণ হবে? মনে হচ্ছিল, নিঃশব্দে চুরি করে সে কিছু একটা পেতে চলেছে। কিন্তু বিক্রমকে নিয়ে সুবর্ণা এমনই আচ্ছন্ন যে এসব তাকে বলা যায়নি। শুধু ঝাপসা গলায় জিজ্ঞেস করেছে, ঠিক আছে, তুমি যা বললে তাই হবে। কিন্তু বিয়ের পর আমরা কোথায় থাকব?’

কোথায় আবার, আমাদের বাড়িতে।

কিন্তু তোমার বাবা?

সুবর্ণার দ্বিধা বা ভীতিটা কী কারণে সেটা বুঝতে পারছিল বিক্রম। তার কাঁধে একটা হাত রেখে বলেছিল, যুদ্ধটা কি আমার একার? আমাদের বংশের ট্র্যাডিশনটা আমার সঙ্গে তুমিও তো ভাঙছ। বিয়ে যখন হচ্ছেই, লিগালি তুমি প্রতাপপুর রয়াল ফ্যামিলির বৌ হবে। ইউ মাস্ট এস্টাব্লিশ ইওর রাইটস। কী, পারবে না?

বিক্ৰম কথা বলত চমৎকার। একেবারে মুগ্ধ হয়ে শোনার মতো। একজন। কমোনারকে রাজবাড়িতে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সুবর্ণার কাছে হঠাৎ এটা দারুণ উত্তেজক অ্যাডভেঞ্চারের মতো মনে হয়েছিল। ভয়টা খানিক কাটিয়ে সে বলেছিল, চেষ্টা করব।

দ্যাট শুড বি দা স্পিরিট।

বিয়ের ব্যাপারে শিলিগুড়িতে গিয়ে মা, বাবা এবং দাদার সঙ্গে কথা বলেছিল সুবর্ণা। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ে আর রাজবংশের একটি ছেলে–পার্থক্যটা এত বিশাল যে সে সুখী হতে পারবে কি না, কিংবা তার। বিবাহিত জীবন শেষ পর্যন্ত অটুট থাকবে কি না–এ নিয়ে বাড়ির সবার ভীষণ। দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল উন্মাদনার বশে বিয়ের এই সিদ্ধান্তটা খুবই হঠকারী। তারপর যখন শুনলেন, ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিসে গিয়ে চুপচাপ বিয়েটা। সারতে হবে তখন মা-বাবা আর দাদার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়।

অবশ্য মা-বাবা চিরদিনই যথেষ্ট লিবারাল। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে, তারা সুশিক্ষিত। সন্তানদের ওপর নিজেদের মতামত, পছন্দ-অপছন্দ বা ইচ্ছা অনিচ্ছা কখনও চাপিয়ে দেননি। শুধু শুভাকাঙ্ক্ষীর মতো পরামর্শ দিয়েছিলেন, ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিসে যাবার আগে সমস্ত দিক যেন ভাল করে ভেবে নেয় সুবর্ণা।

বাড়ির সবার প্রচণ্ড সংশয় আর দুর্ভাবনা থাকলেও বিয়েটা কিন্তু হয়ে গিয়েছিল। ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিস থেকে বিক্রমের সঙ্গে সোজা ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ চলে গেছে সুবর্ণা। দোতলায় উঠে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে তারা প্রথমে প্রণাম করেছিল। তখন তাঁর স্মৃতি নষ্ট হতে শুরু করেছে। বিমূঢ়ের মতো তিনি তাকিয়ে ছিলেন শুধু। প্রণামের কারণটা বুঝে উঠতে পারছিলেন না।

সংগ্রামনারায়াণ কিন্তু প্রণাম করতে দেননি। বিয়ের কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখচোখ অসহ্য ক্রোধে লাল হয়ে উঠেছিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শরীরের সব রক্ত যেন সেখানে গিয়ে জমা হয়েছে। মনে হচ্ছিল তিনি ফেটে পড়বেন, কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে সিঁড়ির দিকে আঙুল বাড়িয়ে সুবর্ণাকে বলেছিলেন, নিচে নেমে যাও কক্ষণো দোতলায় উঠবে না। বিক্রমকে বলেছেন, শুয়ার, স্কাউড্রেল, রাস্তার একটা মেয়েকে ধরে এনে রাজবংশের এক গালে চুন, আরেক গালে কালি লাগালি? গেট আউট অফ মাই সাইট।’ বলে পা থেকে শুড়-তোলা এক পাটি চটি খুলে ছুঁড়ে মেরেছিলেন। সেটা সোজা বিক্রমের নাকে লেগে দরদর করে রক্ত ঝরতে শুরু করেছিল।

বিক্রম আগেই পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল, সংগ্রামনারায়ণ তাকে কোনওভাবেই গ্রহণ করতে চাইবেন না। কিন্তু অভ্যর্থনাটা এমন মারাত্মক অপমানজনক হবে, সুবর্ণা ভাবতে পারেনি। তার চোখের সামনে সমস্ত দৃশ্যাবলী ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল, পায়ের তলায় নরম কার্পেটে-মোড়া হল-ঘরটা ঢেউয়ের মতো দুলছিল, টলতে টলতে হুড়মুড় করে সে পড়েই যেত, বিক্রম হাত বাড়িয়ে। তার কাঁধটা ধরে ধীরে ধীরে একতলায় নামিয়ে এনেছিল। বিক্রমের স্পর্শের মধ্যে সহানুভূতি ছিল, ভরসা ছিল, ছিল গভীর মমতা।

বিক্রম বলেছিল, ফার্স্ট রাউন্ডটা বাবা জিতে গেলেন। উনি যে এতটা অফেন্সিভ হয়ে উঠবেন, ভাবতে পারিনি। নার্ভাস হয়ো না। আমাদের ম্যারেড লাইফ প্যালেসে সুদ হবে না, সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। তবে ফাইট এক রাউন্ডেই শেষ হয় না, এটা একটা প্রোট্রাকটেড ওয়ার। আমাদের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে নিতে হবে।

সুবর্ণা উত্তর দেয়নি। অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিল। তারই মধ্যে একটা কাজের লোককে দিয়ে তুলো, ডেটল এবং ব্যান্ড-এড আনিয়ে বিক্রমের ফাস্ট-এডের ব্যবস্থা করেছে সে। আর ভেবেছে দাম্পত্য জীবনের প্রথম দিনটি থেকে যে অসম্মান শুরু হল তা আদৌ শেষ হবে কি না। বিক্রম স্ট্র্যাটেজির কথা বলেছে। কিন্তু ভয়ঙ্কর ক্রোধী, হঠকারী, আত্মম্ভরী একটি মানুষ, যিনি প্রতাপপুর রাজবংশের প্রাচীন গৌরবের মধ্যে যক্ষের মতো বাস করেন, কমোনারদের সম্পর্কে যাঁর প্রবল ঘৃণা তাকে জয় করার মতো পৃথিবীতে কোনও রণকৌশল আছে কি না সুবর্ণার জানা নেই। ভেতরে ভেতরে সে ভীষণ ভেঙেচুরে যাচ্ছিল।

বিক্রম ফের বলেছে, আসলে রাজত্ব চলে যাওয়াটা বাবা গ্রেসফুলি মেনে নিতে পারেননি। যেদিন রাজতন্ত্র অ্যাবলিশড হল সেদিন থেকে তিনি খেপে আছেন। তার বিশ্বাস আমাদের সর্বস্ব গায়ের জোরে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর সবার ওপর, বিশেষ করে ইন্ডিয়ান ডেমোক্রেসির ওপর তার প্রচণ্ড রাগ। ক্রোধ ছাড়া তার মধ্যে আর কোনও ফিলিংই নেই। নাথিং লেফট একসেপ্ট ভায়োলেন্ট অ্যাঙ্গার। এত কাল ওঁর রাগের ধাক্কাটা বাড়ির সবাই সামলেছে। এখন থেকে তুমি হলে নতুন টার্গেট।

সুবর্ণা চুপ করে থেকেছে।

জুতোর বাড়িতে নাক ফেটে গেলেও সংগ্রামনারায়ণের প্রতি বিক্রমের মনোভাব ছিল সহানুভূতিশীল। বাবার আচরণ সম্পর্কে সে যা বলেছে তা মোটামুটি যুক্তিপূর্ণ। দেড়শ বছরের এক প্রাচীন রাজ-পরিবারের প্রতিপত্তি, মর্যাদা এবং স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়াটা তার বংশধরদের পক্ষে প্রচণ্ড ক্ষোভের ব্যাপার। অবিরল সেই ক্ষোভ থেকে সংগ্রামনারায়ণের মধ্যে ক্রোধের সৃষ্টি হয়েছে। নিজেকে সর্বক্ষণ তিনি একটা আগ্নেয়গিরি বানিয়ে রেখেছেন।

বিক্রম থামেনি, জঙ্গল থেকে বাঘ ধরে এনে ট্রেনিং দিয়ে বশ করা হয়, সেটা নিশ্চয়ই জানো?

প্রশ্নটার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ধরতে পারেনি সুবর্ণা। বিহ্বলের মতো জিজ্ঞেস করেছে, হাঁ জানি, কিন্তু হঠাৎ একথা?’

সিলিংয়ের দিকে আঙুল বাড়িয়ে মজার গলায় বিক্রম বলেছে, ওপরে যে ব্যাঘ্রটি আছেন তাকে বাগে আনার ওপর আমাদের ম্যারেড লাইফের পিস, হ্যাপিনেস অনেকটা নির্ভর করছে। টাইগার ট্রেনারের রোলটা নিতে পারবে কি? বাবা তোমাকে যেভাবে ইনসাল্ট করেছে তার একটা জবাব দেওয়া তো দরকার।

সংগ্রামনারায়ণ সম্পর্কে রণকৌশলের কথা বলেছে বিক্রম, বাঘ বশ করার দৃষ্টান্ত দিয়েছে, কিন্তু এসব কিছুই মাথায় ঢুকছিল না সুবর্ণার। সে শুধু ভেবেছিল, এখন থেকে সংগ্রামনারায়ণের সঙ্গে এক বাড়িতে তাকে থাকতে হবে। দোতলায় যাতে না যায় সে জন্য তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কোনওদিন ওপরে যাবেও না সুবর্ণা। কিন্তু সংগ্রামনারায়ণ তো নিচে নেমে আসতে পারেন। কখন যে তিনি কী করে বসবেন তাই বা কে জানে। ভয়ে, আশঙ্কায় সে সিটিয়ে গিয়েছিল।

বিয়ের সময় কলেজ থেকে একমাস ছুটি নিয়েছিল সুবর্ণা। আগেই বিক্রমের কাছে জেনেছে, এ বাড়িটা পুরোপুরি পুরুষতান্ত্রিক। তার শাশুড়ি এবং দিদিশাশুড়ি কেউ জীবিত নেই, অনেকদিন আগে মারা গেছেন। বিক্রমের পিসিমার যখন বিয়ে হয় তখন ওর জন্মই হয়নি। ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর সমস্ত কিছু কাজের লোকেরাই চালায়। রাজবাড়ির বৌ হিসেবে সংসারের দায়িত্ব সে নিজের হাতে তুলে নেবে তেমন দুঃসাহস সুবর্ণার হয়নি। নিজেকে সে একতলাতেই গুটিয়ে রেখেছিল। মায়া আর হরেন তখনও এ বাড়িতে কাজ করত। সকাল, দুপুর এবং রাত্তিরে ওপর থেকে খাবার এনে তাকে খাইয়ে যেত মায়া। সুবর্ণার মনে হত সে যেন শ্বশুরবাড়িতে নয়, কোনও একটা হোটেলে এসে উঠেছে। সংগ্রামনারায়ণের সেদিনের নিষ্ঠুর ব্যবহারে নিজেকে এখানে অবাঞ্ছিত মনে হল সুবর্ণার। তবে কাজের লোকেদের, বিশেষ করে হরেন আর মায়ার সহানুভূতি প্রথম থেকেই পেয়েছিল।

রাজবংশের ছেলের সঙ্গে মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ের বিয়ের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল নানাভাবে–প্যালেসের ভেতরে যেমন, তেমনি বাইরেও। খবরটা জানাজানি হওয়ার পর উদয়পুর স্টেট থেকে বিক্রমের পিসিমা সংগ্রামনারায়ণকে কড়া চিঠি লিখেছিলেন। দেশের পুরনো দেশীয় রাজ্যগুলোতে যেসব আত্মীয়স্বজন ছড়িয়ে রয়েছেন, চিঠি লিখে বা ফোন করে ধিক্কার জানিয়েছিলেন। সবারই বক্তব্য, এই বিয়েটা প্রতাপপুর রাজ-পরিবারকে কলঙ্কিত করেছে, তার মর্যাদা রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে। এ বিয়ে কোনওভাবেই মেনে নেওয়া উচিত হয় নি সংগ্রামনারায়ণদের।

এদিকে মা, বাবা এবং দাদা শ্বশুরবাড়িতে সুবর্ণা কেমন আছে, স্বচক্ষে দেখার জন্য শিলিগুড়ি থেকে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ এসেছিলেন। মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে কথা বলে তারা যখন দোতলায় যেতে চাইলেন, বিক্রম বিব্রতভাবে বারণ করেছিল। কিন্তু শিষ্টাচার বলে একটা কথা আছে। এতদূর এসে কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে মেয়ের শ্বশুর এবং দাদাশ্বশুরের সঙ্গে দেখা না করে যাওয়াটা অভদ্রতা। তারা দোতলায় উঠতেই কুকুর বেড়ালের মতো তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাবা-মা এরপর আর কখনও এ বাড়িতে আসেননি।

সংগ্রামনারায়ণ মায়াকে দিয়ে সুবর্ণাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তার বাপের বাড়ি থেকে কেউ যেন ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ না আসে। মা-বাবা বা অন্য আত্মীয়স্বজন না এলেও দাদা কিন্তু মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যেত। নিষেধাজ্ঞা সে মানে নি। দাদার কাছেই জানা গেছে মা-বাবা তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভীষণ শঙ্কিত; তারা একেবারে ভেঙে পড়েছেন।

এই দুঃসময়ে বিক্রম কিন্তু সারাক্ষণ সুবর্ণাকে আগলে আগলে রেখেছে। বিয়েটা ঘিরে যে উত্তেজনা এবং অশান্তি চলছিল তার কোনওরকম আঁচ যাতে তার গায়ে না লাগে সেদিকে বিক্রমের তীক্ষ্ণ নজর ছিল। সুবর্ণার দাম্পত্য জীবনের এটাই ছিল সবচেয়ে সেরা সময়।

ছুটির মধ্যে অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটেছিল। একদিন দুপুরবেলায় খাওয়ার পর সে ঘুমোচ্ছে, বিক্রম বাড়ি নেই, হঠাৎ মুখের ওপর কীসের স্পর্শ এসে যেন লাগল। পাখির পালকের মতো কিছু একটা আলতোভাবে তার গাল, কপাল, গলা এবং চোখের ওপর চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। মুহূর্তে ঘুমটা ভেঙে যায়, ধড়মড় করে উঠে বসে হকচকিয়ে যায় সুবর্ণা। খাটের পাশে দাঁড়িয়ে হাসছেন শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ। তখনও দু’পাটিতে কয়েকটা দাঁত অবশিষ্ট ছিল, সেগুলো বেরিয়ে পড়েছে। হাসির জন্য হনু দু’টো ঠেলে উঠে চোখজোড়া প্রায় বুজে গেছে। সুবর্ণা বুঝতে পারছিল, তিনিই তার মুখে হাত বুলোচ্ছিলেন।

শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ এর আগে কখনও নিচে নামেন নি। সুবর্ণা শুনেছে তিনি যাতে সিঁড়ি দিয়ে পড়ে না যান, সে জন্য সব সময় তাঁকে চোখে চোখে রাখা হয়। হয়তো পাহারাদারিটা শিথিল ছিল, সেই ফাঁকে একতলায় চলে এসেছেন।

শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ মিহি, ভাঙা ভাঙা স্বরে জিজ্ঞেস করছিলেন, কে তুমি? তখনও একটু আধটু কথা বলতে পারতেন তিনি।

বিহ্বলের মতো তাকিয়ে ছিল সুবর্ণা। বলেছে, আমি—আমি–আমাকে চিনতে পারছেন না?

উত্তর না দিয়ে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ বলেছেন, আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছ বুঝি?

সুবর্ণা বুঝতে পারছিল, তাকে চিনতে পারেননি শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ। বলেছিল, আপনার নাতির সঙ্গে ক’দিন আগে দোতলায় গিয়ে প্রণাম করে এলাম। মনে নেই?

হতভম্বের মতো তাকিয়ে ছিলেন শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ। তার স্মৃতি পুনরুদ্ধারের জন্য সুবর্ণা বলেছে, আমি আপনার নাতবৌ–

কিন্তু প্রতিক্রিয়া কিছুই হয় নি। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আগের মতো হেসে যাচ্ছিলেন।

এই সময় ছুটতে ছুটতে মায়া এসে হাজির। হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিল, দেখুন দিকি বৌদিদি, আমি রান্নাঘরে কাজ করছিলাম, সেই ফাঁকে কখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছেন। পড়ে গেলে কী সর্বনাশটা যে হয়ে যেত!–চলুন–চলুন ওপরে–হাত ধরে টানতে টানতে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে গিয়েছিল।

যদিও বিক্রমের কাছে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের স্মৃতি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা শুনেছে সুবর্ণা এবং তার নিজের কাছেও লক্ষণগুলো ধরা পড়েছে; তবু পেছন থেকে হঠাৎ কী ভেবে মায়াকে ডেকেছিল সে, শোন–

মায়া ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছে, কিছু বলবেন বৌদিদি?

শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে দেখিয়ে সুবর্ণা বলেছে, ওঁর এই অবস্থা হয়েছে কতদিন?

আমি তিন বছর রাজবাড়িতে কাজ করছি। ওঁকে একইরকম দেখছি। শুনেছি আমার আসার অনেক আগে থেকেই নাকি কিছু মনে রাখতে পারেন না।

চিকিৎসা করানো হয়নি?

হয় আবার নি? কলকাতা থেকে বড় বড় ডাক্তার কোবরেজ এনে গুলে খাওয়ানো হয়েছে। কিন্তু কিছু হয়নি। দিনকে দিন বরং আরও খারাপ হচ্ছে।

আচ্ছা তুমি যাও।

বিয়ের জন্য একমাস ছুটি কাটিয়ে কলেজে যেতেই কলিগরা সুবর্ণাকে ঘিরে একেবারে হুলস্থূল বাধিয়ে দিয়েছিল। ছাত্রছাত্রীরাও যথেষ্ট হইচই করেছে, তবে তারা কাছে আসেনি।

কলেজে সুবর্ণার শুভাকাঙ্ক্ষীদের একজন হলেন মাধুরী সান্যাল–সবার মাধুরীদি। মধ্যবয়সী মাধুরী ইংরেজির সিনিয়র প্রফেসর। দারুণ আমুদে আর হাসিখুশি। মানুষ হিসেবে চমৎকার। শ্যামবর্ণ, কিন্তু দেখতে ভারি সুশ্রী। এমন কেউ কেউ আছে, সারাজীবন যাদের মধ্যে শৈশবের সারল্য অটুট থাকে। পৃথিবীর কোনও মালিন্য তাদের স্পর্শ করতে পারে না। মাধুরী এদের মধ্যে পড়েন। পঞ্চাশ পেরুলেও তার মুখমণ্ডলে আশ্চর্য এক পবিত্রতা মাখানো। বললেন, এমন একটা রয়াল ম্যারেজ হল। না ধুমধাম, না গ্র্যান্ড ওয়েডিং ফিস্ট। আমাদের একটু জানালে। না পর্যন্ত।

ফিলসফির অধ্যাপক নিরুপম সান্যাল মাধুরীর স্বামী। রানী স্বর্ণময়ী কলেজ’-এ পড়াতে এসে দু’জনের আলাপ, ভালবাসা এবং বিয়ে। স্ত্রীর স্বভাবের মাধুর্য এবং সারল্যের অনেকটাই তার ভেতরও চুঁইয়ে চুঁইয়ে প্রবেশ করেছে। এক সঙ্গে জীবন কাটাতে হলে যা হয় আর কি। একজনের ভালমন্দ আরেক জনের মধ্যে ঢুকে যায়।

মজার গলায় নিরুপম বলেছেন, আরে ভাই, তোমার মাধুরীদি আর আমিও চুটিয়ে প্রেম করে বিয়েটা করেছিলাম। আর সেটা গলা ফাটিয়ে কাউকে জানাতে বাকি রাখিনি। কিন্তু তোমরা এত লুকোচুরি খেললে কেন, মাথায় ঢুকছে না। আরে ভাই, ভালবাসার বিয়েটা ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে কোনও দণ্ডনীয় অপরাধ নয়। নো পানিশেবল অফেন্স। কথায় কথায় আরে ভাইটা তাঁর মুদ্রাদোষ।

ভীষণ বিব্রত বোধ করেছে সুবর্ণা। বলেছে, কী অবস্থায় আমাদের বিয়েটা হয়েছে, পরে শোনাব। তবে এটুকু বলতে পারি, কাউকে আগে জানাবার উপায় ছিল না।

পলিটিক্যাল সায়েন্সের আদিনাথ বসুমল্লিকের জীবনে খাওয়াটা টপ প্রায়োরিটি। সাতচল্লিশ আটচল্লিশ বছরের এই প্রৌঢ়টি সম্পর্কে জনরব, স্ত্রী এবং ছেলেপুলেদের ভাল ভাল সুখাদ্যের ভাগ দিতে হবে বলে বিয়েটাই আর করলেন না। আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, কত জায়গায় নেমন্তন্ন খেয়েছি কিন্তু রাজবাড়ির ভোজ কখনও খাওয়া হয়নি। সুবর্ণা, চান্সটা হাতে এসেও ফসকে গেল।

সুবর্ণা খুব লজ্জা পেয়ে গিয়েছিল। একবার ভেবেছিল বলে, বিক্রমের সঙ্গে পরামর্শ করে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ কলিগদের আমন্ত্রণ জানাবে। কিন্তু পরক্ষণে সংগ্রামনারায়ণের ক্রুদ্ধ, নির্দয় মুখটা মনে পড়ায় তার সব উৎসাহ এক ছুঁয়ে নিভে গিয়েছিল।

বেয়াল্লিশ বছরের বেজায় কালো, বেঢপ, ধুমসী থাইরয়েডের পেশেন্ট মৃন্ময়ী বড়াল ভূগোল পড়ায়। তার চেহারাটা বিয়ের অনুকূল নয়, তাই চিরকুমারী। মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগে আছে, কিন্তু ভেতরটা একেবারে বিষের পাত্র। সুন্দর, মহৎ, মনোগ্রাহী–এই ধরনের কোনও কিছুই সহ্য করতে পারে না সে। এমন কুচুটে, হিংসুটে মহিলা ক্কচিৎ চোখে পড়ে। হেসে হেসে বলেছিল, লুকিয়ে বিয়ে না করে উপায় ছিল? প্রতাপপুর স্টেটের প্রিন্স মিডল ক্লাস ফ্যামিলির মেয়েকে কুলবধূ করে প্যালেসে নিয়ে আসবে, আগে জানতে পারলে সংগ্রামনারায়ণ সিংহ ঘাড় থেকে মুণ্ডু নামিয়ে দিত না? তা সুবর্ণা, শ্বশুরবাড়ির আদর টাদর কেমন লাগছে?

রানী স্বর্ণময়ী কলেজ’-এর অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের বেশির ভাগই এসেছে বাইরে থেকে। মৃন্ময়ী কিন্তু এই শহরেরই মেয়ে। রাজবাড়ির যাবতীয় খুঁটিনাটি খবর থেকে রাজ-পরিবারের কে কেমন মানুষ, তাঁদের স্বভাবচরিত্র, সব তার জানা।

মৃন্ময়ীর কথায় তীক্ষ্ণ একটা খোঁচা ছিল। বিশাল স্টাফ রুমটায় হঠাৎ স্তব্ধতা নেমে এসেছে। মুখচোখ দেখে মনে হচ্ছিল, সবাই ভীষণ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিলেন।

ইকনমিকসের বিমলেশ ভট্টাচার্য ছিল সুবর্ণার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। তার থেকে বছর তিনেকের বড়। একই দিনে তারা রানী স্বর্ণময়ী কলেজ’-এ চাকরি নিয়ে এসেছিল। মাধুরীর মতো বিমলেশও একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ–উদার, সহৃদয়, ভদ্র। অযাচিতভাবে সবাইকে সাহায্য করে। সুবর্ণার সত্যিকারের একজন বন্ধু। স্টাফ রুমের গুমোট আবহাওয়াটাকে হালকা করে দেবার জন্য বলে উঠেছিল, মৃন্ময়ীদি, প্লিজ ওসব কথা বলবেন না। আসুন, সুবর্ণাকে আমরা সকলে শুভেচ্ছা জানাই। শাদি মুবারক।

অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা এবার একসঙ্গে গলা মিলিয়ে বলেছিলেন হা হা, নিশ্চয়ই। কনগ্রাচুলেশন সুবর্ণা। মৃন্ময়ী কিন্তু কিছু বলেনি, সে শুধু হাসছিল, আর হাসতে হাসতে তার চোখ দু’টো কুঁচকে যাচ্ছিল। হয়তো হিংসায়, হয়তো বিদ্বেষে।

বাংলার কেতকী ধর আর ফিজিক্সের নবনীতা পুরকায়স্থ সুবর্ণার চেয়ে তিন চার বছরের বড়। তারাও যে এ বিয়েতে খুশি হয়নি, সেটা খুব ভাল করেই জানত সুবর্ণা। বিক্রমের সঙ্গে যখন তার উতরোল প্রেম-পর্ব চলছে তখন প্রায়ই তাদের চোখে আগুনের ঝলক দেখা দিয়ে মিলিয়ে যেত। তার কারণ যে হতাশা কিংবা অন্য কোনও তীব্র প্রতিক্রিয়া, বুঝতে অসুবিধা হত না। সুবর্ণা যেন হঠাৎ প্রতাপপুরে এসে তাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তি ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়েছে।

যতই ঈর্ষাকাতর হোক, কেতকী আর নবনীতা ছিল খুবই চতুর। নিজেদের মনোভাব তারা গোপন রাখতে জানত। এমনকি যখন স্টাফ-রুমে সবাই সুবর্ণাকে বিয়ের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছে, তারাও হেসে হেসে, আহ্লাদে আটখানা হয়ে তাতে যোগ দিয়েছিল।

মজার গলায় বিমলেশ এরই মধ্যে জিজ্ঞেস করেছে, রাজবাড়ির বৌ হলে। এবার থেকে কি হার হাইনেস বলতে হবে?

সুবর্ণা মিষ্টি করে ধমক দিয়ে বলেছিল, ইয়ার্কি কোরো না বিমলেশ।

শুধু রাজবাড়ি বা কলেজেই না, এই বিয়েটা প্রতাপপুর সিটিকেও যে তোলপাড় করে ফেলেছে, সেটা টের পাওয়া যাচ্ছিল। অফিসে, চায়ের দোকানে, বার লাইব্রেরিতে, পাড়ার ক্লাবে, মেয়ে মহলে–সর্বত্র এই নিয়ে তুমুল হইচই। এও শোনা যাচ্ছিল, বিয়েটা টিকবে না। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’ থেকে সুবর্ণাকে বার করে দেওয়া হল বলে।

উত্তেজনা, গুজব, গসিপ–চিরকাল এসব একই রকম চড়া তারে বাঁধা থাকে না। তার আঁঝ ক্রমশ কমে আসে। সুবর্ণার বেলাতেও তাই হয়েছিল। মাসখানেক পর থেকে তার ব্যাপারে কেউ আর মাথা ঘামাতো না। নতুন নতুন উত্তেজনা এসে তাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল।

বিয়ের পর তিনটে বছর চোখের পাতা পড়তে না পড়তেই যেন উড়ে গেছে। এতটা সময় কেটে গেল কিন্তু একবারও সে দোতলায় ওঠে নি। সংগ্রামনারায়ণও। যেতে বলেননি। আগের মতোই যেন হোটেলে দিন কাটিয়ে যাচ্ছিল। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিল সুবর্ণা।

এই তিন বছরে দু’টো বড় ঘটনা ঘটেছিল তার জীবনে। বাবার মৃত্যু এবং দেবীর জন্ম। মৃত্যু সংবাদটা পেয়েই তাকে নিয়ে শিলিগুড়ি গিয়েছিল বিক্রম। শ্রাদ্ধের পর প্রতাপপুর ফিরে আসে। বাবা মারা যাবার বছরখানেক বাদে দেবী হয়েছিল। তার জন্মের দু’মাস আগে সে আবার শিলিগুড়িতে যায়। এবার ফেরে দু’মাসের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। দ্বিতীয় বার গিয়ে মায়ের কাছে চার মাস কাটিয়ে এসেছিল সে। ফিরে আসার পর এমন দু’টো ব্যাপার ঘটল যা তার জীবনকে আগাগোড়া বদলে দেয়। প্রথমটা দারুণ চমকপ্রদ।

দু’মাসের বাচ্চাকে একা রেখে কলেজে যাওয়া যায় না! দেবীর দেখাশোনার ভার দেওয়া হয়েছিল আধাবয়সী চপলাকে। অল্প বয়সে স্বামী হারিয়ে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ কাজ নিয়েছিল সে। অত্যন্ত দায়িত্বশীল, নম্র এবং বিশ্বাসী। দেবীকে খুব যত্ন করত। ঘড়ি ধরে তার খাওয়া, স্নান, ঘুম–এসব নিয়ে সুবর্ণার বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা। ছিল না। সে জানত উপযুক্ত মানুষের হাতেই মেয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

চপলা এমনিতে ধীর, স্থির কিন্তু একদিন কলেজ থেকে ফেরার পর সুবর্ণা লক্ষ করল, তাকে ভীষণ চঞ্চল দেখাচ্ছে, চোখে মুখে প্রবল উত্তেজনার ছাপ। এদিক সেদিক ভাল করে দেখে, সুবর্ণার হাত ধরে ঘরের কোণে টেনে নিয়ে চাপা গলায় সে বলেছিল, আজ কী হয়েছে জানেন বৌদিদি?

চপলার এ জাতীয় আচরণ তার স্বভাবের সঙ্গে মেলে না। খুব অবাক হয়ে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করেছে, কী হয়েছে?

ছোট বাবা দুপুরবেলায়, আপনি যখন কলেজে, একতলায় এসে দেবী মাকে দেখে গেছেন।

এ বাড়িতে কাজের লোকেরা সবাই শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে বড় বাবা, সংগ্রামনারায়ণকে ছোট বাবা, আর বিক্রমকে দাদা বলত।

খবরটা এতটাই বিস্ময়কর যে অনেকক্ষণ বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে ছিল সুবর্ণা। তারপর বলেছে, কী বলছ তুমি!

সংগ্রামনারায়ণের সঙ্গে তার সম্পর্কটা কী ধরনের সেটা প্রতাপপুর । প্যালেস’-এর কাজের লোকেদের জানতে বাকি নেই। চপলা বলেছিল, সত্যিই বৌদিদি। দেবী মা তখন ঘুমোচ্ছিল। কম করে আধ ঘন্টা খাটের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে দেখলেন। চোখের পাতা পড়ছিল না গো। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে ওপরে চলে গেলেন।

সুবর্ণার মনে হয়েছিল, আগ্নেয়গিরির উত্তাপ হয়তো জুড়াতে শুরু করেছে। কিংবা এমনও হতে পারে, মিডল ক্লাস কমোনার বলে তাকে মেনে না নিলেও। দেবীকে অস্বীকার করা তাঁর পক্ষে বুঝিবা সম্ভব হয়নি; কেননা মেয়েটার শরীরে রাজবংশের রক্তধারা বয়ে চলেছে যে।

প্রথমটা যদি মোটামুটি আনন্দদায়ক হয়, দ্বিতীয় ঘটনাটি সুবর্ণার জীবনকে তছনছ করে দিয়েছিল। দেবীকে নিয়ে শিলিগুড়ি থেকে ফেরার পর বিক্রম সম্পর্কে উড়ো কিছু খবর তার কানে আসছিল। এমনকি বেশ ক’টা বেনামী চিঠি পেয়েছিল সে। বিক্রম নাকি অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে ভীষণ মাতামাতি করছে। মেয়েটা কে, কষ্ট করে খোঁজখবর নিতে হয়নি। মৃন্ময়ীই যেচে তাকে জানিয়ে দিয়েছিল। প্রতাপপুর সিটিতে একটা নামকরা ফরেন ব্যাঙ্কের নতুন যে ব্রাঞ্চ ম্যানেজারটি এসেছেন, মেয়েটা তার শালীনাম রুবি। যেমন স্মার্ট, তেমনি দুর্ধর্ষ ফিগার তার, সারা শরীরে চুম্বকের মতো সেক্স অ্যাপিল। দিল্লিতে থাকে, সবে এম. এ পরীক্ষা দিয়েছে, রেজাল্ট বেরুবে তিন মাস পর। সময় কাটাতে দিদি-জামাইবাবুর কাছে এসেছিল। সুবর্ণাকে দেখে একদিন যেমনটা হয়েছিল, রুবিকে দেখে অবিকল তেমনই ঘাড় গুঁজে পড়েছিল বিক্রম।

মৃন্ময়ী তীব্র, নিচু গলায় বলেছে, রাজপুত্রকে বিয়ে করলে কিছু দাম তো দিতেই হয়। এসব গায়ে মেখো না সুবর্ণা। তার মুখে জ্বালা-ধরানো হাসিটি লেগেই ছিল।

কেতকী আর নবনীতা অবশ্য অমন চাছাছোলা ভাষা ব্যবহার করেনি। মুখখানা করুণ করে বলেছিল, কী যে সব শুনছি! বড্ড খারাপ লাগছে। তাদের আক্ষেপের পেছনে চাপা খুশি যে লুকনো ছিল, টের পেতে অসুবিধা হয়নি।

তবে সত্যিকারের যারা হিতাকাঙ্ক্ষী, যেমন নিরুপম, মাধুরী বা বিমলেশরা কিন্তু খুবই দুঃখ পেয়েছিল। তারা আন্তরিকভাবে পরামর্শ দিয়েছে, সুবর্ণা যেন ভেঙে না পড়ে। যেমন করে থোক, রুবির কাছ থেকে বিক্রমকে ফিরিয়ে আনে।

কিন্তু রুবির কথা তুলতে গোড়ার দিকে হেসে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে বিক্রম। সুবর্ণা তাকে ছাড়েনি। ক্রমাগত চাপ দিতে হঠাৎ একদিন তার একটা হাত ধরে টানতে টানতে হল-ঘরের দেওয়ালে সাজানো অয়েল পেন্টিংগুলোর কাছে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। সেগুলো দেখাতে দেখাতে বলেছে, এঁরা কারা নিশ্চয়ই তুমি জানো?’

ছবির এই গ্যালারিতে কেন তাকে ধরে আনা হয়েছে, বুঝতে না পেরে সুবর্ণা প্রথমটা হতবাক হয়ে গিয়েছিল। তারপর বলেছে, জানব না কেন? এঁরা তোমার সব পূর্বপুরুষ–

রাইট, রাইট, রাইট। এঁদের ক্যারেক্টার কেমন ছিল, সেটা বোধহয় তোমাকে বলা হয়নি।

সুবর্ণা উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে ছিল।

বিক্রম হেসে হেসে বলেছে, আমার এই লেট ল্যামেন্টেড গ্রেট, গ্রেট, গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদারেরা ছিলেন একেকটি স্কাউন্ট্রেল। এদের মতো বিখ্যাত লম্পট হোল ইন্ডিয়াতে খুব বেশি ছিল না। কলকাতা, দিল্লি, বেনারসে কত বাঈজি আর রক্ষিতা যে পুষতেন তার হিসেব নেই। সেক্সি, বিউটিফুল ইয়াং উইমেনের শরীর ছাড়া জীবনে আর কিছু বুঝতেন না। তাদের একমাত্র প্যাসন ছিল মেয়েমানুষ। আমার ঠাকুরদা আর বাবা কিন্তু একেবারে অন্য টাইপের। রাজবংশের প্রাইড নিয়ে একটা অদ্ভুত মেক-বিলিভ ওয়ার্ল্ড তৈরি করে তার ভেতর লাইফ কাটিয়ে দিচ্ছেন। ঠাকুরদার বোধবুদ্ধি, মেমোরি অবশ্য নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি যেভাবে বেঁচে আছেন তার কাছে বংশগৌরব টৌরব টোটালি মিনিংলেস।

পলকহীন বিক্রমের দিকে তাকিয়ে শুনে যাচ্ছিল সুবর্ণা।

বিক্রম থামেনি, বংশের কিছু কিছু ব্যাপার থাকে যেগুলো ঘুরে ঘুরে পরের জেনারেশনের মধ্যে ফিরে আসে। ঠাকুরদার আগে ফোর-ফাদারদের সেই প্যাসনটা দু’টো জেনারেশনকে টপকে আমাকে ধরে ফেলেছে।

সুবর্ণার মুখ শক্ত হয়ে উঠেছিল। এমন নির্লজ্জ স্বীকারোক্তি যে কেউ করতে পারে, সেটা শুনেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। এই লোকটাই কি একদিন প্রেমিক ছিল, তাকে পাগলের মতো ভালবেসেছিল, তার জন্য রাজবংশের ট্র্যাডিশন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল? বিক্রমের চোখে চোখ রেখে সে বলেছে, তুমি নিজেকে তোমার পূর্বপুরুষদের মতো লম্পট মনে কর?

বিক্রম হেসে হেসে বলেছে, মেয়েদের সম্বন্ধে একটু বেশি ইন্টারেস্ট দেখালে যদি লম্পট বলা হয়, ধর আমি তা-ই। আমি যে দেবশিশুর মতো নিষ্পাপ নই সেটা বিয়ের আগে তোমার কলিগদের কেউ কেউ শুনিয়ে দেয়নি?

শুনিয়েছে। তবে আমি গ্রাহ্য করিনি। পাস্ট নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। তোমাকে বিয়ের পর তিন বছর দেখেছি। অভিযোগ করার মতো কিছু পাইনি। বলে একটু থেমে ফের শুরু করেছে সুবর্ণা, আমার কথা বাদ দিলেও তোমার একটা বাচ্চা আছে। নিজেকে কন্ট্রোল কর। রুবির সঙ্গে মেলামেশাটা তোমাকে বন্ধ করতে হবে।

বিক্রমের চোখে আগুনের একটা ঝলক চকিতের জন্য দেখা দিয়েই মিলিয়ে গিয়েছিল। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলেছে, কাকে কী বলছ তুমি বোধহয় জানো না। লিমিট ছাড়াবার চেষ্টা করো না।

তার কণ্ঠস্বরে এমন একটা ঠান্ডা কাঠিন্য ছিল যে চমকে উঠেছে সুবর্ণা। রাজতন্ত্র শেষ হয়ে গেলেও সে যে একজন কমোনার নয় সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিল বিক্রম। তার মধ্যে লুকনো রাজবংশের দম্ভটা রক্তের ভেতর থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল যেন। ভয়ে ভয়ে সুবর্ণা বলেছে, রুবিকে জড়িয়ে তোমার কত স্ক্যান্ডাল রটছে সেটা কি তুমি জানো?

এই ধরনের স্ক্যান্ডাল রয়াল ফ্যামিলির একটা ইনএভিটেবল কোয়ালিটি। অর্ডিনারি পিপলের কাছে হয়তো মারাত্মক ক্রাইম। এ নিয়ে মাথা ঘামিও না।

ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল সুবর্ণার। কিছুক্ষণ বিমর্ষ হয়ে থাকে সে। তারপর বলে, আমার কী হবে?

বিক্রম বলেছে, কী আবার হবে। তুমি যেমন আছ তেমনি থাকবে।

একটা কথা জিজ্ঞেস করব? নিশ্চয়ই।

রুবির সঙ্গে তোমার রিলেশানটা কতদূর এগিয়েছে?

বিক্রম ঠান্ডা গলায় বলেছিল, যতদুর এগুলে স্ক্যান্ডালের স্টেজে পৌঁছে যায় ঠিক ততটাই। একটু থেমে ফের বলেছে, তোমার মাথায় মিডল ক্লাসের কিছু ট্যাবু এখনও অ্যাক্টিভ রয়েছে। ওগুলো মাথা থেকে বার করে দিতে পারলে দেখবে আর কোনও প্রবলেম নেই।

সুবর্ণা বলেছিল, এটা ঠিক, জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে পূর্বপুরুষের কিছু কিছু সংস্কার ঢুকে যায়। সেগুলো তার সহজাত; মুখের কথায় এসব কাটিয়ে ওঠা যায় না। সে আরও বলেছে, তুমি বললে তোমাদের বংশের লাম্পট্যের সাইকেলটা তোমার মধ্যে ফিরে এসেছে। রাজত্ব নেই কিন্তু লেচারিটা আছে। ওটা এমন কিছু মহৎ ব্যাপার নয় যে চিরকাল আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে।

বিক্রম স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, উত্তর দেয়নি।

সুবণা থামেনি, আমি মিডল ক্লাস ফ্যামিলির মেয়ে জেনেই কিন্তু তুমি বিয়েটা করেছিলে।

বিক্রম এবার প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছে, প্লিজ স্টপ ইট।

গলা চড়িয়ে তুমি আমাকে থামাতে পারবে না। হিন্দু কোড রিল অনুযায়ী আমি তোমার লিগাল ওয়াইফ। তা হলে রুবির স্টেটাসটা কী হবে–তোমার রক্ষিতা? নাকি আমাকে ডিভোর্স করে তাকে বিয়ে করতে চাও?

রুবিকে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। তোমাকে তো বলেছি, যেমন আছ তেমনি থাকবে।

সুবর্ণা উত্তেজনায় ফেটে পড়েনি। শান্ত গলায় এবার বলেছে, তোমার বাবা আমাকে এখনও মেনে নেননি। তুমি হঠাৎ রুবিকে নিয়ে মেতে উঠেছ। তার মানে অসম্মান আর উপেক্ষার মধ্যে আমাকে এ বাড়িতে পড়ে থাকতে হবে।

বিক্রম চুপ।

সুবর্ণা সমানে বলে যাচ্ছিল, আমি আমার মা-বাবা দাদাকে ছেড়ে সবার আপত্তি সত্ত্বেও তোমার জন্যে এ বাড়িতে চলে এসেছিলাম। হিন্দু কোড বিল আমার মতো মেয়েদের কিছু শক্তি দিয়েছে। আমি কিন্তু সহজে তোমাকে ছাড়ব না।

বিক্রম চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবার ভঙ্গিতে বলেছিল, তা হলে শক্তিটা পরীক্ষা করে দেখতে পার।

এরপর রুবিকে ফোন করে বোঝাতে চেষ্টা করেছে সুবর্ণা। অন্য একটি মেয়ের দাম্পত্য জীবন, স্বামী এবং সন্তান নিয়ে তার সংসার সে যেন ভেঙে চুরমার করে না দেয়। রুবি হা না কিছুই বলেনি, চুপচাপ শুনে গেছে শুধু। সুবর্ণা বুঝতে পারছিল মেয়েটা বিক্রমের ব্যাপারে এমনই মোহাচ্ছন্ন যে কার কতটা ক্ষতি হবে তা নিয়ে ভাবার মতো সময় নেই তার। কিংবা এতে তার কিছুই আসে যায় না। সুবর্ণার একবার মনে হয়েছিল, বিক্রম যে কত বড় লম্পট, দুশ্চরিত্র একদিন তার মতো রুবিকেও ছিবড়ে করে ছুঁড়ে ফেলে দেবে-এসব জানিয়ে দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অপ্রিয় কথাগুলো আর বলেনি।

ফোনের খবরটা রুবির কাছ থেকে পেয়ে গিয়েছিল বিক্রম। সে প্রচণ্ড খেপে গেলেও বাইরে তার প্রকাশ ছিল না। শীতল কণ্ঠস্বরে শুধু বলেছিল, শেম! তোমার মতো একজন তেজী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহিলার পক্ষে স্বামীর প্রেমিকার কাছে করুণা ভিক্ষে করাটা সম্মানজনক নয়।

অপমানে, রাগে মুখ লাল হয়ে উঠেছিল সুবর্ণার। কিছু একটা রূঢ় জবাব দিতে চেয়েছিল সে, কিন্তু গলায় স্বর ফোটেনি।

মানসিক দিক থেকে সুবর্ণা যখন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত তখন হঠাৎ একদিন রুবিকে নিয়ে বিক্রম উধাও হয়ে যায়। এমন খারাপ সময় তার জীবনে আগে আর কখনও আসেনি।

দাদা অভিজিৎ কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে ব্যাঙ্কে জুনিয়র অফিসার হিসেবে ঢুকেছিল। তার প্রথম পোস্টিং ছিল শিলিগুড়িতে। সুবর্ণার যখন দুঃসময় শুরু হল, তার কিছুদিন আগে তাকে দিল্লিতে ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়। শিলিগুড়ির বাড়ি ভাড়া দিয়ে মা, বৌদি আর দু’বছরের ছেলে টুপাইকে নিয়ে সে সেখানে চলে যায়।

দাদা এবং বৌদি দু’জনেই ভাল মানুষ–উদার, সহৃদয়, স্নেহপ্রবণ। সুবর্ণা একবার ভেবেছিল দেবীকে নিয়ে সেখানে চলে যাবে। ওরা কখনও তাদের অবাঞ্ছিত ভাববে না। তাছাড়া একসঙ্গে থাকলেও নিজেদের ব্যবস্থা সুবর্ণা করে নিতে পারবে। ইউনিভার্সিটিতে তার যা রেজাল্ট সেই জোরে দিল্লির কোনও কলেজ বা কমার্শিয়াল ফার্মে একটা কাজ জুটিয়ে নেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু চিরকাল অন্যের কাঁধে, সে যত আপনজনই হোক, ভর করে থাকাটা অস্বস্তিকর। তার সঙ্গে আত্মসম্মানের প্রশ্নও রয়েছে। তাছাড়া, মা, দাদা তার বিয়েতে প্রবল আপত্তি জানিয়েছিল। বার বার ওরা সতর্ক করে দিলেও সুবর্ণা কানে তোলেনি। এখন দাম্পত্য জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ওদের কাছে গিয়ে মুখ দেখাবে কী করে? হঠাৎ নিজের মনকে খুবই দৃঢ় করে নিয়েছিল সে। প্রতাপপুর থেকে পালিয়ে যাবে না; সব কিছুর শেষ দেখে ছাড়বে।

হিংসুটে কলিগরা কিন্তু সুবর্ণার বিবাহিত জীবনের বিপর্যয়ে দারুণ খুশি। সামনাসামনি তারা কিছু বলেনি, এমনকি মৃন্ময়ী বড়ালের মতো পরশ্রীকাতর মহিলাও নয়। তবে তাদের চোখেমুখে যে চাপা বিদ্রূপ এবং উল্লাস ফুটে বেরিয়েছিল তা ছুরির ফলার মতো বুকের ভেতর পর্যন্ত বিধে গেছে। বাইরের রক্তপাত চোখে পড়ে কিন্তু ভেতরের রক্তক্ষরণ কেউ কি দেখতে পায়? হিতাকাঙ্ক্ষীরা অবশ্য তার যন্ত্রণাটা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। অপার সহানুভূতি আর সমবেদনায় তারা সর্বক্ষণ সুবর্ণার পাশে থেকেছে। বিশেষ করে বিমলেশ। সে তাকে ভেঙে পড়তে দেয়নি। বুঝিয়েছে জীবনটা এক বা দুই রাউন্ডের লড়াই নয়, দীর্ঘস্থায়ী এক যুদ্ধ। তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সুবর্ণা ঝাড়া হাত-পা মহিলা নয়। তার একটি মেয়ে আছে। তাকে মানুষ করতে হবে। সে জন্য নিজেকে সারাক্ষণ সতেজ, সজীব এবং তৎপর রাখা দরকার। একটি লম্পটের কারণে নিজেকে চুরমার করে ফেলার মানে হয় না। নিজের এবং মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য শরীর এবং মনের সবটুকু শক্তি সংরক্ষণ করাটা খুবই জরুরি। তা ছাড়া সুবর্ণা কোনও অপরাধ করেনি। অন্যায়, ইতরাম, বজ্জাতি, যা করার করেছে বিক্রম। সঙ্কোচে, লজ্জায়, সুবর্ণার মুখ লুকিয়ে রাখার কারণ নেই। কে কী মন্তব্য করল, কে ব্যঙ্গের হাসি হাসল, এসব পরোয়া করতে হবে না।

বিক্রমের চলে যাওয়াটা দোতলায় কী প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছিল, নিচে থেকে ঠিক টের পায়নি সুবর্ণা। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে এই ঘটনা এতটুকু নাড়া যে দেবে না সেটা সে জানত। তবে সংগ্রামনারায়ণ এটাকে কীভাবে নিয়েছেন, বোঝা যাচ্ছিল না। সে জন্য বেশ খানিকটা উৎকণ্ঠায় ছিল সুবর্ণা। অন্য দিক থেকেও মানসিক একটা চাপ ছিল। বিক্রম নেই, অবাঞ্ছিত পুত্রবধুকে সংগ্রামনারায়ণ বাড়িতে থাকতে দেবেন কি না কে জানে। মায়ার কাছে এইটুকুই শুধু জানা গিয়েছিল, তিনি একেবারে গুম হয়ে গেছেন, সর্বক্ষণ নিজের ঘরে চুপচাপ বসে থাকেন।

মনে পড়ে, মাসখানেক এভাবে কাটার পর একদিন দুপুরের কিছু আগে, তখন সাড়ে দশটা কি এগারটা হবে, নিজের বেডরুমে শুয়ে শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছিল সুবর্ণা। কলেজের ফাউন্ডেশন ডে থাকায় সেদিনটা তার ছুটি। দেবীও বাড়ি নেই, একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে তাকে ভর্তি করা হয়েছে। চপলা তাকে পৌঁছে দিতে গিয়েছিল, তখনও ফিরে আসেনি।

সুবর্ণার বেডরুমের হল-ঘরের দিকের দরজাটা পুরো খোলা ছিল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, হরেনের সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন সংগ্রামনারায়ণ। প্রায় চার বছরের মতো এ বাড়িতে কেটে গেছে সুবর্ণার, কিন্তু ক্কচিৎ তাকে প্যালেসের বাইরে যেতে দেখেছে সে। গেলেও বিকেলের দিকে। এ সময় কখনই নয়। সুবর্ণা বেশ অবাকই হয়ে গিয়েছিল।

তখনও এ বাড়িতে তিনটে গাড়ি ছিল। একটা পুরনো মডেলের ফোর্ড, একটা স্টুডিবেকার, অন্যটা দিশি অ্যামবাসাডর। স্টুডিবেকার আর ফোর্ডটা কখনও সখনও বার করা হত। সংগ্রামনারায়ণ বাইরে বেরুলে অ্যামবাসাডারটাই চড়তেন। বিক্রম যতদিন ছিল, সে-ও ওটাই চালাত। বাড়িতে গাড়িতে দু-চার বারের বেশি চড়েনি সুবর্ণা। বিক্রম জোর করেছে বলে চড়তে হয়েছে। যেখানে তার অধিকারটাই অনেকখানি অনিশ্চিত কিংবা সীমাবদ্ধ সেখানে থাকাটুকু ছাড়া গাড়ি চড়ার মতো আরামের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়াটা তার স্বভাববিরুদ্ধ। সে লোভী নয়।

সুবর্ণা লক্ষ করেছে, নিচে নেমে কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা বাইরে চলে গিয়েছিলেন সংগ্রামনারায়ণ। কিছুক্ষণ পর গাড়ির আওয়াজ শুনে মনে হয়েছিল সেটা গেটের বাইরে বেরিয়ে গেছে।

ঘন্টাখানেকও কাটেনি, সংগ্রামনারায়ণ ফিরে এসেছিলেন। তাকে খুবই অস্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। মুখ থমথমে, চোখ দু’টো টকটকে লাল। হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল তার। অস্থির পা দু’টো এত টলছিল যেন হুড়মুড় করে পড়ে যাবেন। হরেন ধরে ধরে, খুব সন্তর্পণে তাকে ওপরে নিয়ে গিয়েছিল।

দোতলায় উঠেই ফেটে পড়েছিলেন সংগ্রামনারায়াণ। তার একটানা, উত্তেজিত চিৎকারে গোটা ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর ভিত পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল যেন। দুর্বোধ্য, জড়ানো গলায় তিনি সমানে কী বলছিলেন তার একটি বর্ণও বুঝতে পারছিল না সুবর্ণা। নিজের অজান্তেই যেন সিঁড়ির তলা পর্যন্ত ছুটে এসেছিল সে কিন্তু নিষেধাজ্ঞা তার মাথায় ছিল, তাই ওপরে ওঠেনি। অজানা ভয়ে, শঙ্কায় ভেতরে ভেতরে সে কুঁকড়ে গেছে।

যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল তেমনি হঠাৎই দোতলায় সংগ্রামনারায়ণের তর্জনগর্জন, চেঁচামেচি থেমে যায়। অদ্ভুত স্তব্ধতা নেমে আসে গোটা বাড়িটায়। তারপরই ওপর থেকে কাজের মেয়েদের ছোটাছুটি এবং ভয়ার্ত গলার হইচই ভেসে আসে। এক সময় দেখা যায়, ঊর্ধ্বশ্বাসে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে নেমে আসছে মায়া। তার উদ্ভ্রান্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠেছিল সুবর্ণা।

ল্যান্ডিংয়ের মাঝামাঝি এসে তাকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল মায়া। সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে বলেছে, আপনাকে ডাকতে যাচ্ছিলাম বৌদিদি। শীগগির ওপরে চলুন।

ভয়ঙ্কর কিছু যে ঘটে গেছে, সেটা বুঝতে পারছিল সুবর্ণা। মায়ার উৎকণ্ঠা এবং ত্রাস তার মধ্যেও দ্রুত চারিয়ে যাচ্ছিল। কঁপা গলায় সে জিজ্ঞেস করেছিল, কী হয়েছে?

ছোট বাবা অজ্ঞান হয়ে গেছেন।

এটা ভাবা যায়নি। কিছু একটা যে এখনই করা উচিত সেটা বুঝতে পারছিল সুবর্ণা কিন্তু দোতলায় ওঠাটা ঠিক হবে কিনা, সে সম্পর্কে তার যথেষ্ট দ্বিধা ছিল। বে মায়া ফের তাড়া দিয়েছিল, এখন আর পুরনো কথা মনে করে রাখবেন না। বৌদিদি। আসুন–

সংগ্রামনারায়ণের সঙ্গে তার সম্পর্কটা কী, শুধু মায়া কেন, এ বাড়ির সবাই জানত। সুবর্ণা আর দাঁড়িয়ে থাকেনি; বিয়ের চার বছর পর একসঙ্গে দু-তিনটে করে সিঁড়ি টপকে দোতলায় চলে গিয়েছিল।

ওপরের হল-ঘরে, সংগ্রামনারায়ণ তার বেডরুমের সামনে চিত হয়ে পড়ে ছিলেন। চোখ দু’টো বোজা, সারা শরীর ঘামে ভেজা, গালের কষ বেয়ে ফেনা বেরিয়ে আসছিল। শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে কি না বোঝা যাচ্ছিল না।

হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলো সুবর্ণার খুবই চেনা। কয়েক বছর আগে সে যখন কলেজে পড়ে, তার এক মামা তাদের শিলিগুড়ির বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। একদিন রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর সবার সঙ্গে গল্প করতে করতে হঠাৎ তার ম্যাসিভ স্ট্রোক হয়। সংগ্রামনারায়ণের মতোই তারও গা বেয়ে ঘামের ধারা নেমেছিল, গালের পাশে অবিকল এইরকম গাঁজলা।

সংগ্রামনারায়ণ সুবর্ণার সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছেন, বিন্দুমাত্র মর্যাদা কখনও দেননি। তবু অচেতন, অসহায় মানুষটির দিকে তাকিয়ে তার সারা শরীরে শিহরন খেলে যায়–সেটা উৎকণ্ঠায় এবং ভয়ে। দ্রুত সংগ্রামনারায়ণের নাকের সামনে হাতটা নিয়ে আসে সে। না, সব শেষ হয়ে যায়নি, তির তির করে নিঃশ্বাস পড়ছে।

এবার কাজের মেয়েদের সঙ্গে ধরাধরি করে সংগ্রামনারায়ণকে তার বেডরুমে নিয়ে শুইয়ে দেয় সুবর্ণা, তারপর ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর হাউস-ফিজিসিয়ান ডাক্তার দত্তরায়কে ফোন করে। তাকে সে চিনত। কেননা উইকে তিনদিন তিনি এসে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ আর সংগ্রামনারায়ণকে দেখে যেতেন। নিয়মিত যাতায়াতের। কারণে এ বাড়িতে সুবর্ণার স্টেটাসটা কী, সেটা তারও অজানা ছিল না।

ডাক্তার দত্তরায়ের বয়স তখন পঞ্চাশের কাছাকাছি। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। মোটাসোটা ভারী চেহারা, মাঝারি হাইট, রং টকটকে ফর্সা, মুখ নিখুঁত কামানো। পরনে সারাক্ষণ কালো ঢোলা ট্রাউজার্স আর ডবল-কাফওলা সাদা ধবধবে ফুলশার্ট যার হাতার বোতাম কখনও লাগানো থাকত না। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। তিনি এসে দোতলায় সুবর্ণাকে দেখে অবাক হয়েছিলেন কিন্তু এ নিয়ে কিছু বলেননি। তবে পেশেন্টকে পরীক্ষা করতে করতে তাঁর মুখচোখের চেহারা পালটে গিয়েছিল। খুবই চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল তাকে। জিজ্ঞেস করেছিলেন, পরশু ওঁকে দেখে গেছি; বেশ ভাল ছিলেন। হঠাৎ এরকম হল কী করে? কোনও কারণে হঠাৎ এক্সাইটেড হয়ে পড়েছিলেন কি?

সংগ্রামনারায়ণের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া এবং ফিরে আসার পর যা যা ঘটেছে সব বলে গিয়েছিল সুবর্ণা। তিনি ভয়ঙ্কর ক্ষিপ্ত হয়ে চিৎকার করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যান। তবে তার ক্রোধ বা উত্তেজনার কারণটা সুবর্ণার জানা নেই।

এ বাড়ির পুরুষ কাজের লোকেদের বিনা হুকুমে দোতলায় ওঠা বারণ। তবে হরেনকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, ডাক্তার দত্তরায় এলে সে তার ব্যাগ বয়ে ওপরে নিয়ে আসবে। সেদিনও সে এসেছিল এবং সুবর্ণাদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল।

সংগ্রামনারায়ণের আকস্মিক উত্তেজনা সম্পর্কে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিল হরেন; কী ভেবে চুপ করে যায়। পরে অবশ্য সুবর্ণাকে একা পেয়ে যা জানিয়েছিল তা এইরকম। রাজ-পরিবারের চারটে শিডিউল্ড এবং একটা বিদেশী। ব্যাঙ্কে যত অ্যাকাউন্ট ছিল–সেভিংস এবং ফিক্সড সবই জয়েন্ট; এক সঙ্গে সংগ্রামনারায়ণ আর বিক্রমের নামে। ব্যবস্থা এমন করা হয়েছিল, যে কেউ একজন চেক সই করে টাকা তুলতে পারত। সংগ্রামনারায়ণ ব্যাঙ্কে যাওয়া পছন্দ করতেন না। বিক্রমই দরকারমতো যেত। তবে রুবিকে নিয়ে সে পালিয়ে যাবার পর হাতের টাকা ফুরিয়ে এলে সংগ্রামনারায়ণকে সেদিন একটা ব্যাঙ্কে ছুটতে হয়েছিল। সেখানে গিয়ে তিনি একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে যান। তাকে না জানিয়ে সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে তো বটেই, ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙেও প্রচুর টাকা তুলে নিয়েছে বিক্রম। সন্দেহ হওয়ায় অন্য ব্যাঙ্কগুলোতেও গিয়ে খোঁজ নিয়েছিলেন সংগ্রামনারায়ণ। সব জায়গাতেই এক অবস্থা। সব মিলিয়ে কয়েক লাখ টাকা। তুলেছে বিক্রম। তাছাড়া লকার থেকে প্রচুর দামী দামী জুয়েলারি এবং তার নামে। বড় বড় মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির যেসব শেয়ার কেনা হয়েছিল সেগুলো নিয়েও চলে গেছে। এ সবের প্রতিক্রিয়ায় বাড়ি এসে ফেটে পড়েছিলেন সংগ্রামনারায়ণ এবং সঙ্গে সঙ্গে হার্ট-অ্যাটাক।

পেশেন্টকে দেখা হয়ে গেলে ডাক্তার দত্তরায় বলেছিলেন, এখনই ওঁকে নার্সিংহোমে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করতে হবে।

বিক্রম নেই, শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ থেকেও না থাকার মতোই। সিদ্ধান্ত যা নেবার, সুবর্ণাকেই নিতে হবে। এক মুহূর্ত না ভেবে সে বলেছে, আপনি ব্যবস্থা করুন।

তক্ষুণি ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স আনিয়ে প্রতাপপুর সিটির সব চেয়ে নামকরা নার্সিংহোমে সংগ্রামনারায়ণকে নিয়ে গিয়েছিলেন ডাক্তার দত্তরায়। তিনি এর সঙ্গে বহুকাল যুক্ত আছেন। নিজেও একজন বড় হার্ট-স্পেশালিস্ট। ওঁদের সঙ্গে সুবর্ণা আর হরেনও গিয়েছিল।

ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রোগী আর ডাক্তার ছাড়া অন্য কারও প্রবেশ নিষেধ। ডাক্তার দত্তরায় এবং আরও দু’জন স্পেশালিস্ট সংগ্রামনারায়ণকে নিয়ে ভেতরে ঢুকেছিলেন। সুবর্ণারা বাইরে অপেক্ষা করছিল। ঘণ্টাখানেক বাদে ওঁরা বেরিয়ে এসে জানিয়েছিলেন বাহাত্তর ঘন্টা না কাটলে পেশেন্ট সম্পর্কে কোনওরকম ভরসা দেওয়া সম্ভব হবে না।

সেদিনই আরও কয়েকজন ডাক্তারকে নিয়ে একটা মেডিকেল বোর্ড বসানো হয়েছিল। তাঁরা সংগ্রামনারায়ণের ব্লাড টেস্ট, ইসিজি, ওষুধ এবং ইঞ্জেকশনের যে লিস্ট দিয়েছিলেন তার জন্য অনেক টাকা দরকার। ব্যাঙ্ক থেকে বিক্রম বিরাট অ্যামাউন্ট সরিয়ে নিলেও ওদের অ্যাকাউন্টে তখনও প্রচুর রয়েছে। কয়েক লাখ। টাকা সরালে একটা দেড়শ বছরের পুরনো রাজবংশের সঞ্চয় শেষ হয়ে যায় না। কিন্তু সুবর্ণার পক্ষে সেখান থেকে একটা পয়সাও তোলা সম্ভব নয়, কেননা তার নামে তো কিছু নেই। তবে কয়েক বছর কলেজে পড়াচ্ছে সে, মাইনের প্রায় সবটাই ব্যাঙ্কে জমিয়ে রেখেছে। অগত্যা নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে মোটা টাকা তুলতে হয়েছিল।

ডাক্তাররা বাহাত্তর ঘণ্টার কথা বলেছিলেন কিন্তু তার আগেই জ্ঞান ফিরে এসেছিল সংগ্রামনারায়ণের। ওষুধ এবং ইঞ্জেকশনের আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছিল। হার্ট ক্রমশ স্থিতিশীল হতে শুরু করেছিল। চারদিনের মাথায় তাঁকে ইনটেনসিভ কেয়ার থেকে এয়ার-কন্ডিশনড কেবিনে নিয়ে আসা হয়েছিল।

কলেজ থেকে লম্বা ছুটি নিয়ে রোজ দু’বেলা নার্সিংহোমে গিয়ে কয়েক ঘন্টা করে কাটিয়ে আসত সুবর্ণা। প্রথমে তিনটে রাত হরেন আর সে তো সারা রাতই ছিল। কখন কী দরকার হবে, কে জানে। পরে সুবর্ণা যেত কিন্তু কেবিনে ঢুকত না। তাকে দেখলে সংগ্রামনারায়ণের প্রতিক্রিয়া কী হবে, এবং তার হার্টের পক্ষে সেটা ফের কতটা হানিকর হয়ে উঠবে বুঝতে পারছিল না সে। তবে ডাক্তার দত্তরায় তাকে লক্ষ করে যাচ্ছিলেন। সংগ্রামনারায়ণ পুরোপুরি বিপন্মুক্ত হলে একদিন সুবর্ণার হাত ধরে তাঁর কেবিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এই মেয়েটার জন্যে এবার প্রাণে বেঁচে গেলেন। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে সুবর্ণা কী কী করেছে, সব জানিয়ে দিয়েছিলেন।

ডাক্তার দত্তরায়ের হয়তো অভিপ্রায় ছিল, সুবর্ণাকে সংগ্রামনারায়ণ এরপর উপযুক্ত মর্যাদা দেবেন; তাকে দূরে সরিয়ে রাখবেন না। সুবর্ণা কিন্তু এসব নিয়ে একেবারেই ভাবেনি। সংগ্রামনারায়ণ সম্পর্কে তার বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল না। দীর্ঘদিন উপেক্ষিত থেকে থেকে তাতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল সে। সংগ্রামনারায়ণের ব্যাপারে যা যা সে করেছে পরিচিত অন্য কেউ অসুস্থ হলে ঠিক তাই করত। মানুষ হিসেবে স্বাভাবিক কিছু কর্তব্য তো থাকে। সংগ্রামনারায়ণের কাছে তার কোনও প্রত্যাশা ছিল না।

ডাক্তার দত্তরায়ের কথাগুলো চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন সংগ্রানারায়ণ কিন্তু একটি কথাও বলেননি। তবে বারবার তার চোখ চলে যাচ্ছিল সুবর্ণার দিকে। কিন্তু তার মনোভাব বোঝা যাচ্ছিল না।

পরের দিন নার্সিংহোমে কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন সংগ্রামনারায়ণ। স্ট্রেচারে করেই তাকে দোতলায় নিয়ে যেতে হয়েছিল। কেননা উঁচু উঁচু সিঁড়ি ভাঙা তাঁর দুর্বল হার্টের পক্ষে হানিকর।

হরেনকে সঙ্গে নিয়ে নার্সিংহোমে শ্বশুরকে আনতে গিয়েছিল সুবর্ণা। ডাক্তার দত্তরায়ও তাঁকে পৌঁছে দিতে এসেছিলেন। একতলায় সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল সে। সজ্ঞানে মোটামুটি সুস্থ অবস্থায় সংগ্রামনারায়ণ তার ওপরে ওঠাটা পছন্দ করবেন কি না বুঝতে পারছিল না। কিন্তু স্ট্রেচারে শোওয়া অবস্থাতেই তিনি সুবর্ণাকে বলেছিলেন, ওপরে এসো।

নিঃশব্দে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করেছিল সুবর্ণা।

দোতলায় এসে সংগ্রামনারায়ণকে তার বেডরুমে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল। ডাক্তার দত্তরায় জানিয়েছিলেন, বড় ধাক্কাটা সামলে উঠেছেন তিনি, তবে এখন বেশ কিছুদিন শয্যাশায়ী থাকতে হবে। নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে। কোনওভাবেই উত্তেজিত হওয়া চলবে না। একজন নার্সও ঠিক করে দিয়েছিলেন ডাক্তার দত্তরায়। সে সারাদিন থেকে ঘড়ি ধরে সংগ্রামনারায়ণকে ওষুধ খাওয়ানো স্নান করানো থেকে শুরু করে সন্ধের পর রাতের খাওয়া খাইয়ে ছুটি পাবে। তবে নার্সের ওপর ভরসা করলেই চলবে না, তাঁর যত্নের দিকে বাড়ির লোকদেরও লক্ষ রাখতে হবে।

ডাক্তার দত্তরায় চলে যাবার পর সংগ্রামনারায়ণ সুবর্ণাকে বলেছিলেন, আমার অসুখে প্রচুর খরচ হয়েছে। ডাক্তার বলছিল সব টাকাটাই তুমি দিয়েছ। কাল ব্যাঙ্কের লোকদের ডেকে তোমার টাকা দেবার ব্যবস্থা করব।

সুবর্ণা উত্তর দেয়নি, মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। বুঝতে পারছিল, সংগ্রামনারায়ণ কারও কাছে ঋণী থাকতে চান না। সেটা তার রাজকীয় দম্ভে বাধবে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর সুবর্ণা মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করেছে, আমি কি এখন যাব?’

সংগ্রামনারায়ণ বলেছেন, হ্যাঁ, যাও।সুবর্ণা যখন দরজার কাছাকাছি গেছে সেই সময় পেছন থেকে হঠাৎ ডেকেছিলেন, শোন–

সুবর্ণা ঘুরে দাঁড়িয়ে উৎসুক চোখে তাকিয়েছিল।

সংগ্রামনারায়ণ বলেছেন, আজ থেকে দেবী আর তুমি আমার পাশের ঘরে থাকবে। হরেনকে পাঠিয়ে দাও। ওকে দিয়ে সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

সুবর্ণা ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নামতে নামতে অবাক যে হয়নি তা নয়। পরে ভেবে দেখেছে, মুখ ফুটে না বললেও বিয়ের চার বছর পর তাকে দোতলায় গিয়ে থাকতে বলাটা তার কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। কিংবা এমনও হতে পারে হার্ট-অ্যাটাকটা সংগ্রামনারায়ণের মনোবল অনেকটাই নষ্ট করে দিয়েছিল। পাশে তখন এমন একজনকে দরকার যার ওপর নির্ভর করা চলে। হয়তো ভেবেছিলেন, যে সুবর্ণা। তার প্রাণ বাঁচিয়েছে তার হাতে নিজের দায়িত্ব তুলে দেওয়া যায়।

সেদিনই দেবীকে নিয়ে দোতলায় চলে গিয়েছিল সুবর্ণা। কৃতজ্ঞতা, নির্ভরতা, বিশ্বাসের সঙ্গে পুরনো রাগ এবং বিদ্বেষ আর রাজকীয় দম্ভ-সব মিলিয়ে তার সম্পর্কে সংগ্রামনারায়ণের মনোভাবটা ছিল অদ্ভুত রকমের জটিল। ক্রমশ ধীরে ধীরে এটা মেনে নিয়েছিল সুবর্ণা। বিক্রম নেই, কিন্তু রয়েছেন অসহায় দুটি মানুষ। একজন স্মৃতিভ্রষ্ট শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ, অন্যজন রুণ, প্রায়-পঙ্গু সংগ্রামনারায়ণ। অদৃশ্য এক শৃঙ্খল যেন এবং বাড়ির সঙ্গে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে। এ এক আশ্চর্য বন্ধন।

সুবর্ণা নিজে থেকে কোনওদিন কৌতূহল প্রকাশ করেনি। তবে মেজাজ ভাল থাকলে মাঝে মাঝে টুকরো টুকরোভাবে সংগ্রামনারায়ণ প্রতাপপুর স্টেটের কিছু কিছু খবর তাকে শুনিয়েছেন। দেশীয় রাজ্যগুলো ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে মিলেমিশে যখন একাকার হয়ে গেল তখন ক্ষতিপূরণ হিসেবে পুরনো রাজা-মহারাজা এবং নবাবদের পরিবারগুলিকে বার্ষিক বিরাট অঙ্কের রাজন্যভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা হল। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ তখন সুস্থ ছিলেন, বোধবুদ্ধি সম্পূর্ণ অটুট। তার কাছে এটা অত্যন্ত অপমানজনক মনে হয়েছিল। প্রায় স্বাধীন রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নিয়ে সামান্য বকশিস তিনি মেনে নিতে পারেননি। এ যেন গরু মেরে জুতো দানের মতো ঘটনা। নেহরু এবং প্যাটেলকে এ জন্য সর্বাংশে দায়ী করেছিলেন তিনি। তাঁদের নাম শুনলে খেপে যেতেন। ফলে প্রতাপপুর স্টেট বার্ষিক ভাতা ফিরিয়ে দিয়েছিল।

বাবার মতো সংগ্রামনারায়ণের কাছেও রাজত্বের মর্যাদা ছিল সবার চেয়ে মূল্যবান। নেহরু প্যাটেলের প্রতি বিদ্বেষটা উত্তরাধিকার সূত্রে তিনিও। পেয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান ডেমোক্রেসির একজন সামান্য ভোটার হয়ে বেঁচে থাকাটা তাঁর কাছে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর মতো ঘটনা। জীবনে তিনি কখনও ভোট দেননি এবং ভারত সরকারের গ্রান্টও স্পর্শ করেননি।

পূর্বপুরুষদের মতো উড়নচণ্ডে নন সংগ্রামনারায়ণ। ঠাকুরদা, তার বাবা কিংবা তার বাবাদের মতো দশ হাতে খোলামকুচির মতো টাকা ওড়াননি। পারিবারিক যা সঞ্চয় ছিল, তা থেকে বিক্রম কয়েক লাখ সরিয়ে নিয়ে গেলেও যেটুকু অবশিষ্ট আছে, আগেকার মতো রাজকীয় মেজাজে না হলেও বেশ ভালোভাবেই কাটিয়ে দেওয়া যায়। তবু আর্থিক ব্যাপারে তার হয়তো চাপা দুশ্চিন্তা ছিল। তাই খরচ কাটছাঁট করতে শুরু করেছিলেন। তখনও সব মিলিয়ে দশ বারোজন কাজের লোক ছিল। হরেন আর মায়াকে রেখে বাকিরা ভবিষ্যতে যাতে কষ্টে না পড়ে, তাই মোটা টাকা পয়সা দিয়ে বিদায় করা হয়েছিল। গাড়ি ছিল তিনটে। পুরনো, দামী স্টুডিবেকার আর ফোর্ডটা বেচে দিয়েছিলেন।

এর মধ্যে আরও একটা ঘটনা সুবর্ণাকে বড় রকমের ধাক্কা দিয়ে গেছে। সেই যে বিক্রম রুবিকে নিয়ে উধাও হয়েছিল, অনেকদিন তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। মাঝে মাঝে উড়ো খবর ভেসে আসত, সে নাকি লখনৌতে আছে। কখনও বা শোনা যেত, লখনৌ নয়–কলকাতায়। হঠাৎ একদিন বিক্রমের তরফ থেকে ল-ইয়ারের একটা নোটিশ এসেছিল। সে ডিভোর্স চায়। কারণ দাম্পত্য জীবনে বনিবনার অভাব, ইত্যাদি। নোটিশ থেকে বিক্রমের ঠিকানাও পাওয়া গিয়েছিল। সে তখন দিল্লিতে থাকত।

দু’টো দিন দারুণ অস্থিরতার মধ্যে কেটেছে সুবর্ণার। তারপর মনস্থির করে উকিলের চিঠিটা সংগ্রামনারায়ণকে দেখতে দিয়েছিল। হার্ট-অ্যাটাকের পর ডাক্তারের নির্দেশে চুপচাপ, শান্তই থাকতেন তিনি, কিন্তু সেদিন আবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন, হারামজাদা চোরটাকে ডিভোর্স দিও না বৌমা। সেই প্রথম সুবর্ণাকে তার বৌমা বলা। হয়তো এইভাবেই তিনি তাকে প্রতাপপুর রয়্যাল ফ্যামিলিতে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

কয়েক বছর আগে হলে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েটি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে যেত। কিন্তু এখন তেমন কোনও প্রতিক্রিয়াই হয়নি। উদাসীনভাবে সংগ্রামনারায়ণের কথাগুলো শুনে গেছে সে, কিন্তু নিজের সিদ্ধান্ত থেকে এক চুলও নড়েনি। বিক্রমের ল-ইয়ারকে জানিয়ে দিয়েছিল, বিবাহ বিচ্ছেদে সে রাজি।

ছ’মাস পর বম্বে থেকে কোর্টের রায় এসে গিয়েছিল। সম্পূর্ণ আইনসঙ্গতভাবে ডিভোর্সটা হয়ে গেছে। বহুকাল যোগাযোগ নেই বিক্রমের সঙ্গে, তবু মানসিক দিক থেকে যে সূক্ষ্ম, পলকা সম্পর্কটা তখনও অস্পষ্টভাবে থেকে গিয়েছিল সেটুকুও চিরকালের মতো ছিন্ন হয়ে গেল। বুকের মধ্যে কোথাও কি শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল? আসলে অভাববোধটা মানুষের নিজেরই তৈরি। সুবর্ণার ক্ষেত্রে তেমন কিছু একটা হয়ে থাকবে। কিন্তু ভ্যাকুয়াম চিরকাল বুঝিবা থাকে না, ধীরে ধীরে তা পূর্ণ হয়ে যায়।

শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ এবং সংগ্রামনারায়ণের সেবাযত্ন, দেখাশোনা, দেবীর পড়া, কলেজ, পরীক্ষার পেপার দেখা–এসবের পরও আচমকাই মেয়েদের একটা অর্গানাইজেশনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে সুবর্ণা। প্রথম প্রথম এত দিক সামলাতে হিমশিম খেয়ে যেত। এখন আর অসুবিধা হয় না। তার দৈনন্দিন যা রুটিন তাতে একটা দিন আরেকটা দিনের হুবহু জেরক্স কপি। সমস্ত কিছুই গতানুগতিক, খানিকটা বা যান্ত্রিক। কখনও কখনও সুবর্ণার মনে হয়, ভাবাবেগের চেয়ে দায়িত্বপালনই তার কাছে ক্রমশ বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে।

এইভাবেই চলছিল। দেবীকে বড় করে তোলা ছাড়া ভবিষ্যতের নির্দিষ্ট আর কোনও বড় লক্ষ্য সুবর্ণার সামনে আপাতত নেই।

এর মধ্যেই আজ সশস্ত্র, সাঙ্ঘাতিক এক হত্যাকারী যার বিরুদ্ধে গণ্ডা গণ্ডা খুনের চার্জ, ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ ঢুকে সমস্ত পরিবেশটা অসীম ত্রাস এবং উৎকণ্ঠায় ভরে দিয়েছে। …

অন্ধকারে উঁচু সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল সুবর্ণা। বাইরে হল-ঘরে গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকটা সুরেলা ঝংকার তুলে জানিয়ে দিল বারোটা বাজে।

অন্যদিন এর মধ্যে দু-তিনবার শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে দেখে আসে সুবর্ণা। আজ সমস্ত অতীতটা অজস্র পুরনো ঘটনার মধ্যে তাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে ওঁর কথা খেয়াল ছিল না। যদিও রাজীব ভেতর থেকে দরজায় খিল তুলে ছিটকিনি আটকে দিয়েছে তবু শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের খবর নেওয়া দরকার। দেবী তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে। খুব সন্তর্পণে সুবর্ণা তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মশারি তুলে বিছানা থেকে নেমে পড়ল। নিঃশব্দে দরজা খুলে বাইরে এসে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। এ ঘরের দরজা বন্ধ আছে ঠিকই, তবে হল-ঘরের দিকের জানালার একটা পাল্লা খানিকটা ভোলা। ভেতরে নীলাভ নাইট ল্যাম্প জ্বলছে।

জানালার ফাঁকে চোখ রেখে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে আবছা আলোয় দেখতে চেষ্টা করল সুবর্ণা। লেপ মুড়ি দিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন তিনি। কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে নিজের বেডরুমের দিকে যাবে, অন্ধকারে পায়ে কী একটা লেগে সামান্য শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে রাজীবের তীক্ষ্ণ চাপা গলা ভেসে এল, কে? পরক্ষণে হুড়মুড় করে বিছানা থেকে নেমে জানালার ওধারে এসে দাঁড়াল সে। তার হাতে সেই পিস্তলটা সুবর্ণার দিকে তাক করা।

ঘুমের মধ্যেও লোকটার স্নায়ু কতখানি সজাগ, মুহূর্তে টের পেয়ে যায় সুবর্ণা। সংগ্রামনারায়ণের ইন্দ্রিয়ও খুব সতর্ক কিন্তু এতটা নয়। আগেও তার মনে হয়েছে, এখন আরও একবার টের পেল আক্রমণের আশঙ্কা রাজীবকে সর্বক্ষণ তাড়া করে বেড়ায়। তাই ঘুমন্ত বা জাগ্রত, যে কোনও অবস্থাতেই তার স্নায়ুগুলো টান টান হয়ে থাকে।

কাঁপা গলায় সুবর্ণা সাড়া দেয়, আমি–’

ধীরে ধীরে পিস্তলসুদ্ধ হাতটা নামিয়ে নেয় রাজীব। বলে, ও, আপনি। আমি ভেবেছিলাম অন্য কেউ।

সুবর্ণা চুপ করে থাকে।

রাজীব থামেনি। সে বলে, আরেকটু হলে কী বিশ্রী একটা ব্যাপার হয়ে যেত বলুন তো। অন্ধকারে আপনাকে চিনতে পারিনি। ট্রিগারে চাপ পড়লে আচমকা একটা বুলেট বেরিয়ে যেতে পারত। এভাবে না জানিয়ে রাত্রিবেলা চলে আসবেন না। মনে থাকবে?

সুবর্ণা আস্তে মাথা হেলিয়ে দেয়, বলে, থাকবে। তার কণ্ঠস্বরের কাঁপুনি একই রকম রয়েছে।

রাজীব জিজ্ঞেস করে, আপনি বোধহয় আপনার গ্র্যান্ড ফাদার-ইন-ল’কে দেখতে এসেছিলেন?

হ্যাঁ।

আপনাকে তো বলেছি, আমি যতদিন আছি, গ্র্যান্ড ওল্ড ম্যানটি রাত্তিরে ঘর থেকে বেরুতে পারবে না। এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

ঠিক আছে।

শুতে চলে যান। অনেক রাত হয়ে গেছে।

সুবর্ণা তার ঘরের দিকে যাচ্ছিল, রাজীব ডাকে, শুনুন—

সুবর্ণা ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।

রাজীব কর্কশ সুরে বলে, যে কোনও জন্তুর চেয়ে আমার নার্ভগুলো বেশি অ্যালার্ট। যদি ঘুমিয়েও পড়ি কোনওরকম সুযোগ নেবার চেষ্টা করবেন না। সেটা আপনাদের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।

লোকটার ইঙ্গিত মোটামুটি স্পষ্ট। ঘুমন্ত অবস্থায় সুবর্ণা তাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করতে পারে, সেটাই হয়তো বোঝাতে চাইছে। ত্রস্ত ভঙ্গিতে সে বলে, বিশ্বাস করুন, বুড়ো মানুষটাকেই দেখতে এসেছিলাম। কয়েক বছর ধরে রাতে তিন চার বার ওঁকে দেখে যাচ্ছি। এটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। আমার অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল না।

অন্ধকারে অনেকক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে রাজীব। তারপর নরম গলায় বলে, বিশ্বাস করলাম।

সুবর্ণা আর দাঁড়ায় না, নিঃশব্দে নিজের ঘরে ফিরে এসে শুয়ে পড়ে।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress