Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

আওরঙ্গাবাদ!

সিধুজ্যাঠার চোখ কপালে উঠে গেল। —এ যে সব্বোনাশের মাথায় বাড়ি! জায়গাটার তাৎপর্য বুঝতে পারছ ফেলু? আওরঙ্গাবাদ হল এলোরায় যাবার ঘাঁটি। মাত্র বিশ মাইলের পথ, চমৎকার রাস্তা। আর এলোরার মানে বুঝতে পারছ তো? এলোরা হল ভারতের সেরা আর্টের ডিপো! পাহাড়ের গা থেকে কেটে বার করা কৈলাসের মন্দির-যা দেখে মুখের কথা আপন থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। আর তা ছাড়া পাহাড়ের গায়ে লাইন করে দেড় মাইল জায়গা জুড়ে আরও তেত্ৰিশটা গুহা-হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন-তার প্রত্যেকটা মূর্তি আর কারুকার্যে ঠাসা। আমার তো ভাবতেই রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছে!…কিন্তু প্লেন থাকতে ট্রেনে যাচ্ছে কেন লোকটা?

যদ্দূর মনে হয়, মূর্তিটা ও হাতের কাছে রাখতে চাইছে। প্লেনে গেলে সিকিউরিটি চেক-এর ব্যাপার আছে। হাতের ব্যাগ খুলে দেখে পুলিশ। ট্রেনে সে ঝামেলা নেই।

আওরঙ্গাবাদের ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমারও গলা শুকিয়ে গেল। ফেলুদা হাতের ঘড়ির দিকে দেখে তড়িাক করে মোড়া ছেড়ে উঠে পড়ল।

কী ঠিক করলে? সিধুজ্যাঠা জিজ্ঞেস করলেন।

আমাদের প্লেনেই যেতে হবে।

সিধুজ্যাঠা যে ভাবে ফেলুদার দিকে চাইলেন তাতে বুঝলাম গর্বে ওঁর বুকটা ভরে উঠেছে। মুখে কিছু না বলে তক্তপোশ থেকে উঠে গিয়ে আলমারি থেকে একটা চটি বই বার করে ফেলুদার হাতে দিয়ে বললেন, এটা তোমায় হেলপ করবে। ভাল করে একবারটি পড়ে নিয়ো।

বইটার নাম এ গাইড টু দ্য কেভস অফ এলোরা।

ফেলুদা বাড়ি এসেই জুপিটার ট্র্যাভলসের মিস্টার বকসীকে ফোন করে জিজ্ঞেস করল। আগামীকাল সকালের বম্বে ফ্লাইটে টিকিট আছে কি না; ওর তিনটে সিটি দরকার। তিনটে শুনে আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম। সিধুজ্যাঠাও যাবেন নাকি সঙ্গে? ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করাতে ও শুধু বলল, দলে আরেকটু ভারী হলে সুবিধে হয়।

বকসী বললেন, এমনিতে জায়গা নেই, তবে ওয়েটিং লিস্টে ভাল পোজিশন। আমি টিকিট ইসূঢ় করে দিচ্ছি। আপনারা সকলে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে এয়ারপোর্টে এসে যাবেন। মনে হয় হয়ে যাবে।

সকালের ফ্লাইট নটার মধ্যে বম্বে পৌঁছে যাবে; তারপর সেখান থেকে সাড়ে বারোটার সময় আরেকটা প্লেন ছেড়ে দেড়টায় আমাদের আওরঙ্গাবাদ পৌঁছে দেবে। এই পরের টিকিটটাও জুপিটার করে দেবে, আর দেবে আমাদের আওরঙ্গাবাদ ও এলোরার থাকার ব্যবস্থা। আমরা পৌঁছে যাব কালই, মানে শনিবার, আর মল্লিক পৌঁছবেন রবিবার।

বুকিং-এর ঝামেলা মিটিয়ে ফেলুদা আরেকটা নম্বর ডায়াল করছে, এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই দেখি নাম্বার ওয়ান জনপ্রিয় রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস লেখক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু। ফেলুদা যেন ভূত দেখেছে এমন ভাব করে রিসিভারটা রেখে দিয়ে বলল, আশ্চর্য-এই মুহূর্তে আপনার নম্বর ডায়াল করছিলাম।

জটায়ু তার ভাঁজ করা প্লাস্টিকের রেনকোটটা টেবিলের উপর রেখে সোফায় বসে পড়ে বললেন, তা হলে আমার সঙ্গে আপনার একটা টেলিপ্যাথেটিক যোগ রয়েছে বলুন! আমারও ক’দিন থেকেই আপনার কথা মনে হচ্ছে।

কথাটা আসলে হবে টেলিপ্যাথিক, কিন্তু লালমোহনবাবুর ইংরেজি ওইরকমই। ভদ্রলোকের চেহারা বেশ খোলতাই হয়েছে; দেখে মনে হল বই লিখে বেশ দু পয়সী। রোজগার হচ্ছে।

বেশ করে একটু লেবুর সরবত করতে বলুন তো আপনার সারভেন্টটিকে-বড্ড গুমোট করেছে। আর ফ্রিডিজেয়ার থেকে যদি একটু বরফ দিয়ে দেয়…

সরবতের আড়ার দিয়ে ফেলুদা কাজের কথায় চলে গেল।

খুব ব্যস্ত নাকি? নতুন উপন্যাসে হাত দিয়েছেন?

হাত দিলে কি আর এখানে আসতে পারি? ছক কেটিচি। খুব জমবে বলে মনে হয়। ভাল ফিলিম হয়। অবিশ্যি হিন্দি প্যাটার্নের। পাঁচখানা ফাইট আছে। বেলুচিস্তানের ব্যাকগ্রাউন্ডে ফেলিচি আমার হিরো প্রখর রুদ্রকে। আচ্ছা-অৰ্জ্জুন মেরহাত্রাকে কেমন মানায় বলুন তো হিরোর পার্টে? অবিশ্যি আপনি যদি অ্যাকটিং করতে রাজি হন তা হলে তো–

আমি হিন্দি জানি না। যাই হাক, আপাতত আমাদের সঙ্গে আসুন-কৈলাসটা ঘুরে আসি। ফিরে এসে না হয় বেলুচিস্তানের কথা ভাববেন।

কৈলাস। সে কী মশাই–আপনার কি তিব্বতে কেস পড়ল না কি? সেখানে তো শুনিচি চিনেদের রাজত্ব।

কৈলাস পাহাড় নয়। কৈলাস মন্দির। এলোরার নাম শুনেছেন?

ও হা হা, তাই বলুন। তা সে তো শুনিচি সব মন্দির আর মূর্তি টুর্তির ব্যাপার। আপনি হঠাৎ পাথর নিয়ে পড়লেন কেন? আপনার তো মানুষ নিয়ে কারবার।

কারণ, কতগুলো মানুষ ওই পাথর নিয়ে একটা কারবার কেঁদে বসেছে। বিশ্ৰী কারবার। সেটা বন্ধ করা দরকার।

লালমোহনবাবু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছেন দেখে ফেলুদা ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল। সব শুনেটুনে লালমোহনবাবুর গোল চোখ আরও গোল হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবুক বার করে কী সব লিখেটিখে নিয়ে বললেন–

এ এক নতুন খবর দিলেন। আপনি। এই সব পাথরের মূর্তির এত দাম? আমি তো জানতুম হিরে পান্না চুনি–এই সব হল দামি পাথর। যাকে বলে প্রেশাস স্টোনস। কিন্তু এও তো দেখছি কম প্রেশাস নয়।

আরও বেশি প্রেশাস। চুনি পান্না পৃথিবীতে হাজার হাজার আছে, ভবিষ্যতে সংখ্যায় আরও বাড়বে। কিন্তু কৈলাসের মন্দির বা সাঁচির স্তুপ বা এলিফ্যান্টার গুহা-এ সব একটা বই দুটো নেই। হাজার-দু হাজার বছর আগে আমাদের আর্ট যে হাইটে উঠেছিল। সে হাইটে ওঠার কথা আজকের আর্টিস্ট ভাবতেই পারে না। সুতরাং সে যুগের আর্ট দেশে যা আছে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যারা তাকে নষ্ট করতে চায় তারা ক্রিমিনাল। আমার মতে ভুবনেশ্বরের যক্ষীকে হত্যা করা হয়েছে। যে করেছে তার কঠিন শাস্তি হওয়া দরকার।

লালমোহনবাবুকে ততবার জন্য এ-ই যথেষ্ট। এমনিতেই ভদ্রলোকের নতুন দেশ দেখার শাখ, তার উপর ফেলুদার সঙ্গে একজন অপরাধীর পিছনে ধাওয়া করা-সব মিলিয়ে ভদ্রলোক ভারী উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। প্লেনের টাইম, জামা-কাপড় কী নিতে হবে, মশারি লাগবে কি না, সাপের ওষুধ লাগবে কি না ইত্যাদি জেনে নিয়ে উঠে পড়ে বললেন, আমার আরও একসাইটেড লাগছে কেন জানেন তো? কৈলাস নামটার জন্য। কৈলাস-কই লাশ! বুঝতে পারছেন তো?

ক’দিনের জন্য যাচ্ছি জানা নেই, তবে দিন সাতেকের বেশি হবে না। আন্দাজ করে প্যাকিং সেরে ফেলতে বেশি সময় লাগল না। ফেলুদাকে প্রায়ই তদন্তের ব্যাপারে বাইরে যেতে হয়, তাই ওর একটা আলাদা সুটকেসে কিছু জরুরি জিনিস আগে থেকেই প্যাক করে রেডি করা থাকে। তার মধ্যে ওষুধপত্র, ফাস্ট-এড বক্স, মেক-আপ বক্স, বাইনোকুলার, ম্যাগনিফাইং গ্লাস, ক্যামেরা, ইস্পাতের তৈরি পঞ্চাশ ফুট টেপ, একটা অল-পারপাস নাইফ, নানারকম সরু সরু তারা-যা দিয়ে দরকার হলে চাবি ছাড়াই তালা-টালা খোলা যায়, একটা নিউম্যান কোম্পানির ব্র্যাড্‌শ-বা রোল-প্লেন-বাসের টাইম টেবল, একটা রোড ম্যাপ, একটা লম্বা দড়ি, এক জোড়া হান্টিং বুট। এতে জায়গা যে খুব একটা বেশি নেয় তা নয়; তাই একই সুটকেসে ওর বাকি জিনিসও ধরে যায়। জামা-কাপড় বেশি নেয় না। এককালে পোশাকের শখ ছিল, এখন কমে গেছে। সিগারেট খাওয়াও দিনে বিশটা থেকে দশে নেমে গেছে। স্বাস্থের ব্যাপারে ওর চিরকালই যত্ন। যোগব্যায়াম করে, একগাদা খায় না, তবে নতুন গুড়ের সন্দেশ বা খুব ভাল মিহিদানা পেলে সংযমের তোয়াক্কা রাখে না।

ফেলুদার কাছে টুরিস্ট ডিপার্টমেন্টের অনেকগুলো চটি বই ছিল, তার মধ্যে এবার যেগুলো লগতে পারে তার কয়েকটা নিয়ে আমি উলটেপালটে দেখে নিলাম। দশটা নাগাদ শোবার আগে ফেলুদা ঘড়িতে অ্যালার্ম দিল, আর যদি কোনও কারণে অ্যালার্ম না বাজে তাই ওয়ান সেভেন খ্রিতে টেলিফোন করে সকালে চারটের সময় ঘুম ভাঙিয়ে দেবার কথা বলে দিল।

তার ঠিক দশ মিনিট বাদে মিস্টার মুৎসুদ্দির কাছ থেকে ফোন এল। বললেন, মল্লিক বম্বে থেকে একটা ট্রাঙ্ক কল পেয়েছিল কিছুক্ষণ আগে! মল্লিক যে কথাগুলো বলে তা হল এই—মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি এসে গেছে। বাপ তাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে বিশ পঁচাত্তর। তাতে বম্বের লোক ইংরেজিতে বলে, ক্যারি অন। বেস্ট অফ লাক।

আমি কথাগুলোর মাথামুণ্ডু বুঝতে পারলাম না। সেটা ফেলুদাকে বলতে ও বলল, তোর মাধ্যমীনারায়ণ তেলের দরকার হয়ে পড়েছে।

ভাগ্যিস এই তেলের ব্যাপারটা আমার জানা ছিল, তা না হলে এটারও মানে ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করতে হত। মধ্যমনারায়ণ তেল মাথায় লাগালে নাকি মাথা ঠাণ্ডা হয়। আর বুদ্ধি বাড়ে।

বম্বের প্লেন সাড়ে ছটায় না ছেড়ে ছাড়ল প্রায় এক ঘণ্টা পরে। বেশ কয়েকটা ক্যানসেলেশন ছিল, তাই আমাদের জায়গা পেতে কোনও অসুবিধা হয়নি।

বাক্স-রহস্যের ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে জীবনে প্রথম প্লেনে চড়েছিলেন লালমোহনবাবু; এটা বোধ হয়। দ্বিতীয়বার। এবার দেখলাম টেক-অফের সময় দাঁত-টাত খিঁচিয়ে সেই বিশ্ৰী ব্যাপারটা আর করলেন না। কিন্তু প্রথম দিকটা যখন আমরা মেঘের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন প্লেনটা বেশ ধড়ফড় করছিল, আর লালমোহনবাবুর অবস্থা আরও অনেকেরই মতো বেশ শোচনীয় বলে মনে হচ্ছিল। একবার একটা বড় রকম ঝাঁকুনির পর ভদ্রলোক আর থাকতে না পেরে বললেন, এ যে মশাই চিৎপুর রোড় দিয়ে ছাকড়া গাড়িতে করে চলছি বলে মনে হচ্ছে!! নাটবলুন্টু সব খুলে আসচে না তো?

আমি আর ফেলুদা দুটো পাশাপাশি সিটে বসেছিলাম, আর লালমোহনবাবু বসেছিলেন প্যাসেজের ওদিকে ফেলুদার ঠিক পাশেই। ব্রেকফাস্ট খাবার কিছুক্ষণ পর ভদ্রলোক একবার ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, দাঁর-খড়কের ইংরেজি কী মশাই? তারপর সেটা জেনে নিয়ে ভদ্রলোক নিজেই বোতাম টিপে এয়ার হাস্টেসকে ডাকিয়ে এনে, এক্সকিউজ, টুথপিক প্লিজ বলে খড়কে আদায় করে নিলেন। তারপর ঘণ্টা খানেক পরে বম্বে সম্বন্ধে একটা বুকলেট পড়তে পড়তে বললেন, অ্যাপোলোটা আবার কীরকম বাঁদর মশাই?

ফেলুদা এলোরার গাইড বুকটা চোখের সামনে থেকে নামিয়ে বলল, বাঁদর নয়, বন্দর। পোর্ট।

ও, পোর্ট! তা হলে ইংরিজিতে পোর্ট লিখলেই হয়, বান্দার লেখার কী দরকার? হুঁ!

আমরা তিনজনের কেউই আগে বম্বে যাইনি। পশ্চিমে সবচেয়ে দূরে গেছি। রাজস্থানের জয়সলমীর। এবার এমনিতে বম্বেতে থাকার কথা নয়, তবে ফেলুদা বলেছে এলোরায় সব ঠিক ভাবে উতরে গেলে ফিরবার পথে দু-তিনদিন বম্বে থেকে আসবে। ওর এক কলেজের বন্ধু ওখানে থাকে, গ্ল্যাক্সো কোম্পানিতে কাজ করে, সে অনেক’দিন থেকেই নেমন্তন্ন করে রেখেছে!

প্লেন ল্যান্ড করার আগে যখন বেল্ট বাঁধতে বলছে, তখন আমি ফেলুদাকে একটা কথা জিজ্ঞেস না করে পারলাম না। বললাম, মল্লিকের কাল রাত্রের টেলিফোনের ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে দেবে?

ফেলুদা যেন আকাশ থেকে পড়ল।

সে কী রে-তুই, ওটা সত্যিই বুঝিসনি?

উহুঁ।

মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি চলে এসেছে। মেয়ে হল যক্ষীর মাথা, শ্বশুরবাড়ি হল সিলভারস্টাইন—যে মাথাটি কিনেছিল, আর বাপের বাড়ি হল মল্লিক—যার কাছে মাথাটা ছিল।

বুঝিয়ে দিলে সত্যিই জলের মতো সোজা। বললাম, আর বিশ-পঁচাত্তর?

ওটা ল্যাটিচিউড আর লঙ্গিচিউড। ম্যাপ খুলে দেখবি ওটা আওরঙ্গাবাদে পড়ছে।

স্যান্টাকুজ এয়ারপোর্টে নামলাম দশটার সময়। আড়াই ঘণ্টা পরে আবার প্লেন ধরতে হবে, তাই শহরে যাবার কোনও মনে হয় না— যদিও আকাশ থেকে শহরের গমগমে চেহারা দেখে চোখ ট্যারা হয়ে গেছে।

এয়ারপোর্টের বাথরুমে হাতমুখ ধুয়ে রেস্টোরান্টে ভাত আর মুরগির কারি খেয়ে আওরঙ্গাবাদ যাবার প্লেনে উঠলাম পৌনে একটায়। মাত্র এগারোজন যাত্রী। ফেলুদা বলল এটা টুরিস্ট সিজন নয়। তাই এত কম লোক। আওরঙ্গাবাদে যারা যায় তারা অনেকেই নাকি অজন্তা—এলোরা দেখতেই যায়।

এবার আমি আর লালমোহনবাবু পাশাপাশি, আর প্যাসেজের উলটা দিকে ফেলুদা, আর তার পাশে একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক—তার চোখে মোটা কালো চশমা, নাকাটা খাঁড়ার মতো লম্বা। আর ব্যাকা, আর চওড়া কপালের পিছন দিকে একরাশ কাঁচাপাকা ঢেউ খেলানো চুল ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো। আওরঙ্গাবাদের খুদে এয়ারপোর্টে নেমে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। হত না, কিন্তু তাঁর নাকি গাড়ি আসার কথা ছিল, আসেনি, তাই উনি আমাদের সঙ্গে এয়ারলাইনসের বাসে শহরে এলেন। বাঙালি বলে মনে হয়নি, তাই যখন ফেলুদার সঙ্গে বাংলায় কথা বললেন তখন বেশ অবাক লাগল।

কোথায় উঠছেন? ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।

আওরঙ্গাবাদ হোটেল।

আমিও তাই। …এদিকে কী? বেড়াতে?

হ্যাঁ, সেইরকমই। আপনি?

আমি এলোরা নিয়ে একটা বই লিখছি। আগে আরেকবার গেছি, এটা দ্বিতীয়বার। ইন্ডিয়ান আর্ট হিস্ট্রি পড়াই মিশিগানে।

ছাত্রদের উৎসাহ আছে?

আগের চেয়ে অনেক বেশি। আজকাল তো ইন্ডিয়ার দিকেই চেয়ে আছে ওরা। বিশেষত ইয়াং জেনারেশন।

বৈষ্ণব ধর্মের খুব প্রভাব শোনা যাচ্ছে? ফেলুদা একটু ঠাট্টার সুরেই প্রশ্নটা করেছিল। ভদ্রলোক হেসে বললেন, হরেকৃষ্ণর কথা বলছেন তো? জানি। তবে ওরা কিন্তু খুব সিরিয়াস। মাথা মুড়িয়ে ফোঁটা কেটে ধূতির কোঁচটা দুলিয়ে কেমন খোল করতাল বাজায় দেখেছেন তো? চোখে না দেখে দূর থেকে শুনলে খাঁটি কীর্তনের দল বলে ভুল হবে…

এয়ারলাইনস আপিসের পাশেই আওরঙ্গাবাদ হাটেল, পৌঁছতে লাগল। মাত্র পনেরো মিনিট। ছোট হাটেল, তবে থাকার ব্যবস্থা বেশ ভাল। খাতায় নামষ্টাম লিখিয়ে আমরা দুজন গেলাম। এগারো নম্বর ঘরে, লালমোহনবাবু চোদ্দেয়। ফেলুদা স্যান্টাক্রজ থেকে একটা বম্বের কাগজ কিনেছিল, রেস্টোরান্টে খাবার সময় ওটা পড়তে দেখেছিলাম। এবার ঘরে এসে চেয়ারে বসে মাঝখানকার একটা পাতায় কাগজটা খুলে আমায় জিজ্ঞেস করল, ভ্যান্ডালিজম মানে জানিস? পরিষ্কার না জানলেও, আবছা আবছা জানতাম। গুণ্ডামি ধরনের কোনও ব্যাপার কি? ফেলুদা বলল, পঞ্চম শতাব্দীতে যে বর্বর জাতি রোম শহরকে ধ্বংস করেছিল তাদের বলত ভ্যান্ডালস। সেই থেকে ভ্যান্ডালিজম বলতে বোঝায় কোনও সুন্দর জিনিসকে নির্মমভাবে ধ্বংস করা। ,

কথাটা বলে ফেলুদা কাগজটা আমার হাতে দিল। তাতে খবর রয়েছে—মোর ভ্যান্ডালিজম। তার নীচে বলছে-মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহাতে ত্রিংশ শতাব্দীর কান্ডারিয়া মেহাদেও মন্দিরের গা থেকে একটা মেয়ের মূর্তির মাথা কে বা কারা যেন ভেঙে নিয়ে গেছে। বরোদার এক আর্ট স্কুলের চারজন ছাত্র মন্দিরটা দেখতে গিয়েছিল, তারাই নাকি প্রথম ব্যাপারটা লক্ষ করে। গত এক মাসে এই নিয়ে নাকি তিনবার এই ধরনের ভ্যান্ডালিজমের খবর জানা গেছে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে এই মূর্তির টুকরোগুলোকে নিয়ে ব্যবসা করা হচ্ছে।

আমি খবরটা হজম করার চেষ্টা করছি এমন সময় ফেলুদা গন্তীর গলায় বলল, যদ্দূর মনে হয়-অক্টোপাস একটাই। তার শুড়গুলো ভারতবর্ষের এদিক-ওদিকে ছড়িয়ে এ-মন্দির ও-মন্দির থেকে মূর্তি সরাচ্ছে। যে-কোনও একটা গুঁড়কে জখম করতে পারলেই সমস্ত শরীরটা ধড়ফড় করে উঠবে। এই জখম করাটাই হবে আমাদের লক্ষ্য।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress