কেস নং 287 37/2B, গোবরডাঙ্গা
দুপুর 2টো কি আড়াইটে হবে, গোবরডাঙ্গা থানায় জিডি করতে এসেছেন এক বৃদ্ধ। বয়স আনুমানিক 77 / 78 হবে। পাশের বেঞ্চে বসে আমি কিছু ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকলাম অলিখিত।
যতটুকু শুনলাম, বৃদ্ধর বক্তব্য – আমি অসুস্থ, বয়স্ক মানুষ। নিজে রান্না করি নিজে খাই। আমার এক ছেলে আছে। সে তার ফ্যামিলি নিয়ে একই বাড়িতে আলাদা খায়, আমাকে দেখে না তারা। তবুও আমাকে শান্তিতে বাঁচতে দিচ্ছে না। রোজদিন আমার সাথে ঝগড়া করে কিছু না কিছু নিয়ে। নাতি তো আজ প্রায় আমার গায়ে হাত তুলেছে বলা যায়। ওরা কোনো দিন আমাকে মেরেই ফেলবে। আপনাদের সাহায্য নিতে তাই ছুটে আসলাম এখন।
বৃদ্ধর সকল কথা খুব মন দিয়ে শুনলেন থানার ইনচার্জ। যথারীতি ফোনে ডেকে পাঠালেন ছেলেকে তার ফ্যামিলিসহ। ফোনেই ছেলে বললেন , ওনার ওয়াইফ অসুস্থ, উনি আসছেন কথা বলার জন্য।
তড়িঘড়ি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন মৃগাঙ্ক বাবু ( মৃগাঙ্ক সেন )। ছুটে আসলেন গোবরডাঙ্গা থানায়। কি হয়েছে জানতে চাইলেন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে। থানার অফিসারের মুখে সবটুকু শুনে উনি(মৃগাঙ্কবাবু) চমকে উঠলেন। কারণ – তিনি কখনও ভাবতেই পারেন নি যে, ওনার পিতা ওনার ফ্যামিলির নামে রিপোর্ট করতে পারেন। যে পিতাকে উনি ভগবানের মত শ্রদ্ধা করতেন। কখনও ওনার বিরুদ্ধে জোরে কথা বলা তো দূরে থাক, উনি ওনার পিতার ভুল কথাকেও আজীবন সংসারের শান্তির জন্য সমর্থন করে এসেছেন। আজ সেই পিতা ছেলের বিরুদ্ধে থানায় বলছেন – ” ওরা আমাকে মেরে ফেলতে পারে” । নিজেকে তিনি ধিক্কার দিলেন মনে মনে। আজ এই প্রথমবার মৃগাঙ্কবাবুর তার পিতার প্রতি জমা সকল শ্রদ্ধা-সন্মান মিথ্যা বলে মনে হলো।
মৃগাঙ্কবাবু অফিসার কে সবিনয়ে বললেন — আসলে ঘটনাটা ছিল গত 3দিন আগের। গত শনিবার অফিস ছুটি থাকায় আমি(মৃগাঙ্কবাবু) বাড়িতেই ছিলাম। ছেলেও বাড়িতে ছিল। তাই সকাল থেকেই বাড়ির কাজ একটু বেশি ছিল। আমার ওয়াইফ সকালের ব্রেকফাস্ট বানিয়ে যথারীতি দুপুরের লাঞ্চের প্রিপারেশন শুরু করেছে, এমন সময় হঠাৎ সিলিন্ডারের গ্যাস শেষ। আমাকে এসে বললো , অন্য সিলিন্ডার চেঞ্জ করে দিতে। চেঞ্জ করতে গিয়ে দেখি , সেটাও খালি হয়ে পড়ে আছে যথাস্থানে। দুপুরের রান্না তখনও শুরু হয়নি, ঘড়ির কাঁটা 12 টা ছুঁই ছুঁই। আমিও দিশাহারা হয়ে চেনাজানা বেশ কয়েকজনকে কল করলাম, যাতে একটা ভরা সিলিন্ডার অ্যারেঞ্জ করতে পারি। বন্ধু স্থানীয় কয়েকজনের বাড়িতেও গেলাম, কিন্তু কোথাও একটা ভরা সিলিন্ডার পাওয়া গেলো না। অগত্যা, সকল রান্না বাদ দিয়ে ইনডাকশন ওভেনে ( পর্যাপ্ত বাসনের অভাব তবুও) একটু আলু সেদ্ধ ভাত ফুটিয়ে দিনের কাজ শেষ হলো।রাতের খাবার কিনে খাওয়া হলো। সিলিন্ডার সাথে সাথেই বুকিং করা হয়েছে , কিন্তু পরের দিন রবিবার অর্থাৎ ছুটির দিন , তাই সিলিন্ডার পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কোনরকমে ড্রাই ফুড, ব্রেড দিয়ে দিন কাটানো হলো। রাতে বাইরে থেকে কেনা খাবার খেতে হলো। পরের দিন সোমবার। ভাবলাম আজ ভরা সিলিন্ডার এসে যাবে, তাই কিছুটা আশ্বস্ত হয়েই অফিস বেড়ালাম। একটু বেলা বাড়তেই বাড়িতে ফোন করে জানতে পারলাম, আজকেও আসেনি সিলিন্ডার। তাই কোনো রকমে ইনডাকশন ওভেনের পোড়া ভাত খেয়ে দিন কাটানো হলো। রাতে রুটি-তড়কা, আর অসুস্থ বউয়ের জন্য একটু সুপ কিনে কাটলো।
পরেরদিন অর্থাৎ আজ সকালে আমি অফিসে বেড়িয়েছি। বেলায় বাড়ি থেকে ফোন আসলো, বললো – গ্যাস এসে পৌঁছেছে কিন্তু খালি সিলিন্ডার দেওয়া নিয়ে ভীষণ অশান্তি তৈরি হয়েছে। কারণ – নিচের ঘরের জমা থাকা খালি সিলিন্ডার দেবে না বলে বাবা অশান্তি শুরু করেছে , সেই নিয়েই গন্ডগোল।
ছেলে আর বউয়ের দাবি – গ্যাসের বইতে লেখা দুটো সিলিন্ডার, অথচ আমরা একটা সিলিন্ডার পাচ্ছি কেনো। বাবার গ্যাসের বইতে 1টা সিলিন্ডার লেখা , অথচ উনি 2টো সিলিন্ডার আটকে রেখেছেন। সেই নিয়েই কথা অল্প-বিস্তর কাটাকাটি শুরু। মা অসুস্থ, বাড়িতে ঠিকমত রান্না ও খাবার খাওয়া নিয়ে সমস্যা চলছেগত দুদিন ধরেই। তাই স্বভাবতই নাতির একটু ক্ষোভ জন্মেছে মনে মনে দাদুর প্রতি। কিন্তু গোল বাঁধল যখন খালি সিলিন্ডার দেওয়া নিয়ে দাদুর মেজাজ তুঙ্গে উঠলো। কিছুতেই উনি জমিয়ে রাখা খালি সিলিন্ডার হাতছাড়া করবেন না। ওনার গ্যাসের বুক উনিবকৌকে দেখাতে অস্বীকার করছেন, আবার বলছেন ওই দুখানা সিলিন্ডার নাকি ওনার। এই নিয়েই দাদু আর নাতির কথা কাটাকাটি, তার কারণেই আজ থানায় উনি( বৃদ্ধ ) থানায় এসেছেন তার ছেলে ও তার ফ্যামিলির নামে জিডি করতে।
থানার অফিসার ইনচার্জ বললেন, এইসব সামান্য সমস্যা আপনারা বাড়িতেই মিটিয়ে ফেলুন, শুধুশুধু এইসব ছোটো ছোটো ব্যাপার নিয়ে অশান্তি করে লাভ নেই। তাছাড়া উনি বৃদ্ধ মানুষ। ওনার প্রতিই সকলে সহমর্মিতা প্রকাশ করবে। আপনারা সকলেই একটু ধৈর্য্য রাখুন। মৃগাঙ্কবাবু তার পিতার প্রতি সহানুভূতির স্বরে বললেন – যার কাছে আজ 20টা বছর সকল সেবা নিলে অপদে – বিপদে ( সকল অসুস্থতায়), যার হাতের রান্না আজ 20বছর ধরে খেয়ে বাঁচলে, যারা কখনও তোমাকে আলাদা করে নি তাদের থেকে,( আজ তুমি নিজে একা থাকতে চেয়ে, তুমি একা খাবে বলে আজ যাদেরকে আলাদা করে দিয়েছো) আজ তাদের নামে থানায় এসে মিথ্যা রিপোর্ট করে কি লাভ পেলে,,,? একথা বলেই দ্রুত বাইরে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
আমি তখনও সকল কথা শুনছি থানায় বসে কিছুটা দূর থেকে। আর আশ্চর্য্য হয়ে ভাবছি – মৃগাঙ্কবাবুর গ্যাসের বইতে যদি দুটো সিলিন্ডার লেখা থাকে, আর ওনার পিতার গ্যাসের বইতে যদি একটা সিলিন্ডার লেখা থাকে, তাহলে তো সত্যি করেই চিন্তার বিষয় যে – ওনারা 3জনে 1টা সিলিন্ডার এবং ওনার পিতা একজন বয়স্ক মানুষ টাও তিনি 2তো সিলিন্ডার নিয়ে আটকে রেখে ছেলে-বউমা-নাতির নামে এইরকম একটা মিথ্যা রিপোর্ট কি করে করতে পারেন ? না পেলাম না, এর কোনো সদুত্তর।
আজ মৃগাঙ্কবাবু তার পিতার কৃতকর্মে ভীষণ মর্মাহত। নিজের বাবার এহেন আচরণে কিছুটা অবাক , কিছুটা বিধ্বস্ত তিনি। বলার মত কোনো ভাষা নেই আজ মৃগাঙ্কবাবুর মুখে।